CH Ad (Clicksor)

Friday, April 26, 2013

নীলা



আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




নীলা




নীলা আমার আত্মা, আমার চেতনা, আমার প্রেরণা, আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমারহাসি, আমার কান্না, আমার আলো, আমার আধার, আমার সমস্ত অস্তিত্ব। নীলা বিহিনআমি অর্থহীন। আামার জাগতিক, পারলৌকিক সকল চিন্তায়, কল্পনায়, আবেগে নীলা।কল্পকথার কাহিনীর মত অসম্ভব রূপবতি নীলা আমার দুঃসময়ের সঙ্গী। সুখের সারথী।আমার বর্তমান, আমার অতীত। এই যে এখন আমি হোস্টেলের ছাদের এক কোনেটেবিল-চেয়ার পেতে বসে কলম চালাচ্ছি, তার প্রেরণা দাত্রীও নীলা। আমারসামনে-পিছনে, উপরে, নীচে বাতাসের কণায় নীলার অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমস্তপৃথিবীটাই যেন নীলার ছোয়ায় নীলাময় হয়ে আছে।
কলম চালাতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। চোখে অঝোরে পানি ঝরছে। চোখের পানিতেভিজে যাচ্ছে লেখার কাগজ। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট স্পর্শ অনুভব করছি। নীলা, নীলা, নীলা, সমস্ত আকাশ কেন এত নীল? তাহলে কি নীলা আকাশের ঐ বিশাল নীলের মাঝেবিদ্যমান? জানি না। বাতাসের বেগে চোখের পানি গালবেয়ে ফোটা ফোটা হয়ে উড়ে গেলকয়েক ফোটা। এই চোখের পানি কি নীলার শুকনো কবরের মাটিতে পড়ে ওকে শান্ত করবেনা?
বাতাসে কিসের এত গন্ধ ভেসে আসছে? নীলা ফূলের গন্ধ কি? নীলা নামের কোনফুল আছে কি? নিশ্চয় আছে। হয়ত এত দিন কোন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এই ফুলের প্রজাতিআবিস্কার করতে পারেনি। আমি পেরেছি। হ্যা,ঁ এটা নীলা ফূলেরই গন্ধ। ভবিষ্যৎউদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরাও হয়ত গোলাপ,জবা ফুলের মত নীলা ফূল নিয়েআলোচনা করবে।
নীলা এখন অনেক দুরে, কোটি কোটি, হাজার হাজার কোটি মাইল দূরে। সমস্তজীবন, তার পরের, তারও পরের জীবন এবং আরও অনেক জীবন ধরেও যদি সেকেন্ডে একলক্ষ মাইল বেগে চলে এমন কোন গাড়িতে চড়ে তার কাছে যেতে চাই, তবুও পারব না।পারব না তাকে ছুতে। তার কোমল পরীশ্রেষ্ট সুন্দরীর হাতের কবজি স্পর্শ করতেপারব না। অথচ সে আমার চার পাশ অহরহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার প্রতিটি নিশ্বাসে, রক্তের প্রতিটি কণায়, হৃদ পিন্ডের সঞ্চালনের সাথে, শরীরে প্রবেশ করে আমারঅন্তরকে ব্যাথায় ককড়িয়ে দিচ্ছে। আমি বার বার বিশ্রাম নিতে চাচ্ছি। লেখাবন্ধ করে দূরে, অনেক দূরে, অন্য কোথাও পালাতে চাচ্ছি। ক্লান্তিতে চোখ বুঝেআসছে। কিন্তু পারছিনা। কোথায় পালাব? কত দিন পালিয়ে থাকব? পৃথিবীর এমন কোননিরাপদ আশ্রয় আমার জন্য নেই যেখানে নিশ্চিন্তে পালিয়ে থাকতে পারি। আমিজানি, আমি পালিয়ে থাকতে পারব না। পুলিশ খুনের দায়ে আমাকে গ্রেফতার করবেইকরবে। আজ না হোক, কাল, কাল না হোক পরশু, না হয় তার পরের দিন, না হয় তারওপরের দিন, তবুও আমি জানি পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করবেই করবে। খুন যে আমিকরেছি, সত্য প্রমানিত হলে মৃত্যু দন্ড হবে আমার। খুব সম্বব বেশী দিন পালিয়েথাকতে পারব না আমি। আমারহোস্টেলে প্রায় প্রায় বিভিন্ন বয়সের স্মার্টটাইপের লোকজন আসছে। এরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক না হয়ে পারে না। কি করে যেএরা খুনির গন্ধ নাকে পায়, বুঝিনা। অথচ দুই জন রাষ্টপতি এদেশে খুন হয়েছেন, এখবর কি তারা পায়নি?
আজও দুপুরে ঘুমিয়ে আছি। আমার বন্ধু কবির আমাকে ডেকে তুলল। সাথে কদম ছাটচুল ওয়ালা এক ভদ্র লোক। আমার সাথে পরিচিত হতে এসেছেন। ব্যাটা সাহিত্যিক।আমিও সাহিত্য চর্চা করি শুনে আমার সাথে ভাব জমাতে চান। আমি ঘুম থেকে উঠেবাথরুমে যেয়ে হাত মুখ ধুলাম। ফিরে এসে দেখি কবির নেই। লোকটি আমার ডায়রিওল্টাচ্ছে। আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল। সাহিত্যিক হলে ডায়রি ওল্টাবে কেন? সামনেই কয়েকটা লেখা পড়ে আছে টেবিলে। কয়েকটা চমৎকার বিদেশী বইও আছে। সেগুলোওল্টাতে পারত? আমি নিজেকে সামলে নিলাম। নিশ্চয় গোয়েন্দা। খুব সাবধানে কথাবলতে হবে। আামাকে দেখেই গোপের তলে সামান্য হেসে বললেন, আপনিতো চমৎকারলেখেন। লেখা পড়েই ভাবলাম একটু সাক্ষাত করি। কবির আপনার বন্ধু, আমিও তেমন।
আমি ভাবছি, ব্যাটা বলে কি? আমার লেখা পড়ে ভক্ত হয়ে গেল? কোথায় পেল আমারলেখা? বইয়ের দোকানে? অসম্ভব! আমার কোন লেখাই এখনও প্রকাশ পায়নি। আমি হলামগিয়ে সেই বাথরুমের সিঙ্গারের মত পাতি লেখক। এখানে ওখানে এক পাতা করে লেখাপাঠাই। দু’একটা প্রেমের গল্প, কবিতা লিখি। এতেই যা চেনে দু’একজন। এতটুকুলেখা পড়েইভক্ত হয়ে কেউ সক্ষাত করতে আসবে ভাবতে পারিনি।
লোকটার কথা শুনে আরও সতর্ক হলাম। জীবনে যার বই প্রকাশ হয়নি এই ভদ্রলোকতারও বই পড়ে ফেলেছেন। ভক্তও হয়েছেন। আমার সামনে উপবিস্ট আমার সাক্ষাতপ্রার্থী। কত বড় চিজরে বাবা!
আমি বললাম, তো কোথায় পেলেন আমার বই? আমার তো কোন বই প্রকাশ হয়নি। লোকটাএকটু ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললেন না মানে কবিরের কাছে শুনলাম আপনি লেখেনটেখেন আর কি!
এতেই আমার বই পড়ে ফেললেন? আপনিতো আচ্ছা চিজ দেখছি। আপনার তো পুলিশেদেওয়া উচিত। লোকটি আর বসলেন না। কবিরকে খুজতে চলে গেলেন। সমস্ত বিকাল আরদেখা গেল না। পরে কবির বলল, ওনারসাথে কোন বন্ধুত্ব নেই তার। তিনিই কবিরকেপেয়ে ম্যানেজ করে হোস্টলে এসেছেন আমার খোজে। আমি নিশ্চিত হলাম, মুক্ত আলোবাতাসে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার শেষ হয়ে আসছে খুব শীগ্রই আমি ধরা পড়ে যাব।বার বার আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি পালিয়ে থাকতে পারবো না। আর তাই তো আমিলিখতে বসেছি অতীতের কাটা তারের বেড়ায় আবদ্ধ আামার জীবন কথা, যা খুবলে খুবলেখাচেছ আমার জীবনকে প্রতিটি মুহুর্ত। যে কাহিনী আমার লিখতে হাত কাপছে। চোখেঅঝোর পানি ঝরছে। চোখের পানিতে জামার কলার ভিজে গেছে। কাগজেও পড়েছে দু’একফোটা। চোখের এই পানির ফোটা নীলার কবরে কি পড়ছে বাতাসে ভেসে ভেসে? জানিনা, নীলা, নীলা, তুমি কোথায় গো সোনা? তোমারই কাহিনী লিখতে যে আমার হৃদয় খুনহচ্ছে রক্ত ঝবছে। নীলা, নীলা সোনা আমার নীলা-নীলা-নীলু গো-আমার! তুমি কোথায়সোনা?

আমার জন্ম সাতক্ষীরা জেলায়। উনিশত পয়ষট্রিতে। পহেলা জুলাই। আমার বাবাছিলেন একজন স্কুল মাষ্টার এবং আদর্শ কৃষক। দরিদ্র পিড়ীত বাংলাদেশের একটিগ্রামে একজন স্কুল মাষ্টার আধুনির্ক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতেন, চমৎকার ফসলফলাতেন। অশিক্ষিত কৃষকদের মাঝে কৃষি বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। বাবা কৃষি কাজেসফলতা পেয়েছিলেন বেশ ক’বার। শ্রেষ্ট আদর্শ কৃষক হবার গৌরব অর্জন করেন এবংকয়েকটা সোনার মডেলও পান। মাঝে মাঝে সে গুলো বাক্স থেকে বের করে মা-বাবাদেখতেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতেন, বলতেন তোমাকেও কোন না কোনবিষয়ে মেডেল পেতেই হবে। তোমাকেও কোন না কোন বিষয়ে শ্রেষ্ট হতেই হবে। বাবা, আমি কি প্রেমেরক্ষেত্রে শ্রেষ্ট হয়নি? আদর্শ প্রেমিকের গৌরব কি আর্জনকরতে পারিনি? আমি শ্রেষ্ট প্রেমিক হিসেবে কি একটা মেডেল পেতে পারি না? বাবাএই প্রশ্নের উত্তর আজ কে দেবে?
বাবার নাম ছিল মোহাম্মদ আজারউদ্দীন বি,এ,বি,টি। আমার ছোট চাচার নাম ছিলমোহাম্মদ আবিদ হোসেন বি,এ। যতদূর পরে জেনেছি তিনি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বেকারছিলেন এবং বেকার অবস্থায় বিয়ে করেন। তার বিয়েতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা আমারজানা নেই। এই বেকার দম্পতির ঘরেই ১৯৭১ সালে নীলার জন্ম হয়। আমার আবছা মনেআছে সামান্য কিছু ঘটনা। চাচীর প্রচণ্ড ব্যাথা শুরু হল। চার দিক ছোটা ছুটিশুরু করছে সবাই। একজন মহিলা সম্ভবত ধাই তিনি বার বার পান মুখে দিয়ে পানেরচিপ ফেলতে আসছেন বাইরে। আমি বারান্দার এক কোনে দাড়িয়ে লোকজনের ছোটা ছুটিদেখছি। মাঝে মাঝে চাচীর গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসছে কানে। সবাই অধীর আগ্রহেঅপেক্ষা করছে। বাবা বাড়ি ছিলেন না, কিছু পরে আসলেন। সাথে সাথে আমি বাবারকাছে গেলাম। বললাম, চাচী কাদছে ভীষণ। সবাই ঘরে নিয়ে গেছে। বাবা বললেন, তুমিচুপ কর। আমি চুপ করলাম। বাবা জামা গায়ে দিয়েই ডাক্তার বাড়িতে ছুটলেন।ডাক্তার এলেন তখন বিকাল প্রায় চারটা। সামন্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে।সন্ধার দিকে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন চাচীর ঘর থেকে। একটা বাচ্চার কান্না ভেসেএল সবার কানে। কান্নাও যে আনন্দ ও স্বস্তি বয়ে আনতে পারে সেই ছোট অবস্থায়বুঝলাম।
নীলার জন্মের পর পরই পৃথিবীতে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল বাতাস। সেইহালকা শীতের মধ্যেও গাছের পাতা একটু নড়ে উঠেছিল। কিছু পরে বাড়ির ছাদের উপরদিয়ে একঝাক পাখি উড়ে গিয়েছিল উত্তর দিকে। বয়স্ক মহিলারা এসব দেখে মন্তব্যকরেছিল, শুভ লক্ষণ। মেয়েটি হবে লক্ষী, জগৎ শ্রেষ্ঠা, যেমন রুপবতী তেমনগুনবতী ও সৌভাগ্যবর্তী হবে। শুনে বাবা হাসলেন। আমাকে বললেন, যা চাচীকে দেখেআয়। তোর মাকে আমার কাছে আসতে বল। আমি তাই করলাম।
নীলার জন্মের পরের দিন দুটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। প্রথমটা আমাদেরপারিবারিক, দ্বিতীয়টাজাতীয় পর্যায়ের কিংবা আর্ন্তজাতিক পর্যায়ের ঘটনা।পারিবারিক ঘটনাটি এমন, আমাদের একটা পোষা গর্ভবতী গাভী ছিল। সে তারনির্দিষ্ট সময়ের আঠার দিন আগে বাচ্চা দিয়ে বসল। গ্রামের সবাই গভীর আগ্রহনিয়ে দুটো বিষয় ভাবতে লাগল। কিভাবে এটা সম্ভব? আঠার দিন আগে বাচ্চা প্রসবেরঘটনা ্এই প্রথম। কেউ কেউ বলল, সঠিক হিসাব হয়ত জানে না। বাবাজোর দিয়েইবললেন, তার হিসাব ঠিক আছে। এই ঘটনাকে তারা সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে মন্তব্যকরল। একই সাথে দুটো প্রজাতির দুটো ব্চ্চাা দান। একটায় পারিবারিক প্রশান্তি।অন্যটা পুষ্টি আর আর্থিক নিশ্চয়তার প্রতীক। বাবা গ্রামের মানুষের মতামতকেঅবৈজ্ঞানিক বলে
মন্তব্য করলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে। ছাত্ররা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েদিল। পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করল। সারা দেশে উত্তাল হাওয়াবইতে লাগল। শাসক গোষ্ঠী ভড়কে গেল। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে ইয়াহিয়া খানটালবাহানা শুরু করে দিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের দাবিকে মেনে নিতেপারল না। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাধ্য হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করল।নেতাদের ঘোষণার অপেক্ষা করল না। এই দুটি ঘটনা ঘটল নীলা জন্মাবার ঠিক পরেরদিন। তাহলে নীলা কি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দৃষ্টা হয়ে জন্ম নিয়েছিল? তার জন্মের মধ্যেই কি সৃস্টিকর্তার কোন ইঙ্গিত ছিল?
১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ আমার বয়স পাঁচ বছর আট মাস নয়দিন পূর্ণ হল। নিয়মঅনুসারে পাঁচ বছর বয়স হলেই স্কুলে ভর্তি হবার কথা। আমি ভর্তি হতে পারিনি।সত্তরের নির্বাচন আর সাইক্লোন সমস্ত পরিকল্পনা নষ্ট করে দিল। তাই বাবার হাতধরে আমি ১০ই মার্চ ভর্তি হতে গেলাম স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে। এর আগে আমিযে বই পড়তে শিখিনি তা না। বাবা বাডিতে এক মাষ্টার রেখেছিলেন। তিনি আমারঅক্ষর জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। ছবির বই দেখে ছবি আঁকা শেখাতেন। ছবি সম্পর্কেহাত নেড়ে নেড়ে বিজ্ঞ পন্ডিতের মত কক্তৃতা দিতেন। পাহাড় সম্পর্কে ধারণাপেলাম সেই ছোট থেকেই। পরে জেনেছিলাম, আমার সেই শিক্ষক ছবি বিশেষজ্ঞ। এইশিক্ষকের আর একটি মুগ্ধ করার মত গুন ছিল। সেটা হল, শুর করে করে নামতাপড়ানো। বেশ ছন্দের মত মনে হত। মনে হত কোন মধু সুধা আমার শরীরে প্রবেশ করছে।আর আমি আনন্দিত হয়ে সেই মধুর স্বাধ নিচ্ছি। বাড়িতে পড়ে পড়ে আমি মোটমুটিসেই বয়সের উপযোগী হয়ে উঠলাম।
প্রথম দিন আমার সাথে যাদের পরিচয় হল, আমি শুর করে নামতা পড়ে আরছবি,পাহাড় সম্পর্কে গল্প করে ওদের তাক লাগিয়ে দিলাম। স্কুলের স্যার প্রথমদিনেই আমার নাম দিলেন লিটন পন্ডিত এ্যাবাউট ছবি এন্ড নামতা। স্কুল ছুটিরআগেই বাড়ি ফিরলাম। মা যতœ করে খাওয়ালেন। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে সঞ্জুমিয়া, বাড়ি ফিরলি যে তাড়াতাড়ী? আমি বললাম, বাবা স্কুলের চেয়ে বাড়িতে ভালপড়তে পারব। স্কুল ঘর ভীষণ নোংড়া। বাবা বললেন ঠিক আছে, তাই হবে। আমি স্কুলেযাওয়া বন্ধ করলাম।
বাড়িতে আমার পদচারনা ছিল কিছুটা নির্লুপ্ত টাইপের। নিজের ঘরে অনেক সময়বসে কটিয়ে দিতাম। ছবির বই নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নাড়াচাড়া করতাম। নামতালিখতাম। ছবির বইতে ছাপা পাহাড়ের ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করতাম। ডেকে না দিলেখেতে যেতাম না। মা-বাবা ব্যস্ত থাকতেন চাচী আর নীলাকে নিয়ে। আমাকে নিয়েব্যস্ত থাকতেন আমার সেই ছবি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক। চাচা সারাদিন কোথায় যেনথাকতেন চাকরীর ধান্দায়। তাকে নিয়ে বাবা মাঝে মাঝে বকাবকি করতেন।
এর মধ্যে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া নাটক জামিয়ে ফেললেন। হঠাৎ ঢাকায়নির্বিচারে গনহত্যা চালিয়ে বসল পাকিস্তানিরা। মুক্তিকামীরাও স্বাধীনতার ডাকদিয়ে বসলেন। শুরু হল যুদ্ধ। সমস্ত মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘঠতে লাগল সবঅসভাবিক ঘটনা। দলে দলে মানুষ যে যার সুবিধা মত দলে যোগ দিতে লাগল। বাবামৌন মুক্তি যোদ্ধা হলেন। চাচা হলেন শ্রেণী শত্র“ খতম আন্দোলনের সমর্থক।মাঝে মাঝে বাবা আর চাচার মধ্যে উত্তপ্ত কথা কাটা কাটি হত। বাবা বলতেনশ্রেণী শত্র“ খতমের নামে তোরা ত ডাকাতি করছিস। চাচা বলতেন, বাঁশের লাটি আরখোন্তা-কোদাল, দু’একটা পাখি মারা বন্দুক দিয়ে তোমরা দেশ স্বাধীন করতেপারবেনা। বাবার দৃষ্টিতে শ্রেণী শত্র“ খতমকারীরা স্রে¬ফ ডাকাত । আদর্শহীনএকদল সংঘবদ্ধ খুনী। চাচা বলতেন, তোমরা তো স্রে¬ফ মুজিবের চামচা। সেপাকিস্তানের জেলখানায় বসে পোলাও-বিরাণী খাচ্ছে, আর তোমরা খালে-বিলে, বনেজঙ্গলে লাঠি সোটা নিয়ে যুদ্ধ করছ এবং স্বেচ্ছায় নিজেরা বলছ শহীদ হচ্ছে।সেতো জেল থেকে বেরিয়ে নানা চমৎকার বক্তৃতা দিয়ে তোমাদের মন ভোলাবে। বাবা আরকিছু বলতেন না। দেখতে দেখতে গ্রাম প্রায় লোকজন শূন্য হয়ে গেল। বাবা তারকিছু প্রতিবেশি নিয়ে আমাদের বাড়িতে সারা রাত গল্প গুজব করতেন। গোপনেবিভিন্ন ক্যাম্পে খবরা খবর পৌছে দিতেন। চাচা প্রায় বাড়ি আসতেন না। ছোটবাচ্চা মেয়ে নীলার জন্যও কোন দিন আসতেন না। চাচি কেঁদে কেটে অস্তির হতেন।হঠাৎ একদিন রাতে বাড়ি ফিরলেন। সাথে একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এক বস্তাভর্তি গহনা ঘাটি এবং নগদ টাকা। চাচার চোখ দুটা লাল টকটক করছে। বাবা সাহসকরে বললেন, কিরে আবেদ এগুলো কোথায় পেলি? চাচা কিছু বললেন না। হাত মুখ ধুতেলাগলেন। চাচী ফুপিয়ে ফূপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমার মাও অবাক হলেন। বাবাবললেন, এগুলো কোথায় পেলি? চাচা বললেন, এগুলো এখন আমার সম্পদ। বাবায় চাচায়বেশ কথা কাটা কাটি হল। এক সময় আমরা সবাই শুনতে পেলাম চাচা বললেন দেখ বড় ভাইহয়েছ বলে সব কিছুতে নাক গলিও না। এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের সময় কোন নিয়মকানুন থাকে না। তুমি আমাকে কিছু করতে বাধ্য কর না। আমি একটু পরেই চলে যাব।আর ফিরব না। চাচা তার কথা রাখলেন। সেদিন রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন।এক পলকের জন্য নীলাকে দেখলেননা। মা-চাচি-বাবা আমি কাঁদছি অঝোরে। নীলাকাঁদছে ট্যা- ট্যা করে। ওর কান্নার মধ্যে ও কি কোন ইঙ্গিত ছিল? সেই যে চাচাগেলেন, আর এলেন না! যুদ্ধ শেষ হলেও তিনি এলেন না। বাবা বহু খোজা খুজিকরলেন।


দুই-২
আজ হোস্টেলের ছাদে বসে আমি যে কাহিনী লিখছি, সে কাহিনী সর্ব নাশাদুর্দান্ত ঝড়ের প্রকোপে সর্ব শ্রান্তপ্রকৃতির কাহিনী। তার সূত্র পাত ঘটেউনিশত আটত্তর সালের বসন্তের আগমনের প্রথম দিকে। আমার বয়স তখন প্রায় তের ছুইছুই। তের বছর বয়সে কি বসন্তের আগমন উপলব্দি করা যায়?
আমি সে দিন স্কুলে মন বসাতে পারছিলাম না। বার বার বাইরে মন চলে যাচ্ছিল।স্যার ক্লাসে কি পড়াচ্ছেন বুঝতে পারছিনা। খড়কুটোর মত নিরস মনে হতে লাগল।সেই দিন আমার জীবনের সর্বনাশার যে বীজ শরীরে প্রবেশ করেছিল তা থেকে চারাগজাতে শুরু করল। শরীর,মন,চঞ্চল হয়ে উঠল। মনকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না।শরীরের আশ্চার্য পরিবর্তনে ভয় পেয়ে গেলাম। বিষয়টা নিয়ে কারোর সাথে আলোচনাকরার প্রয়োজন বোধ করলাম। কিন্তু বিশ্বস্ত কাউকে পেলাম না। এভাবে ঘোরেরমধ্যে কাটল বেশ কয়েক সপ্তাহ। এর পর একদিন ক্লাসের মধ্যে দেখলাম আমার একবন্ধু একটা সাপ্তাহিক বিনোদন পত্রিকা দেখছে। তাতে অসম্ভব সুন্দরী সবমেয়েদের ছবি, নানা ভঙ্গিতে ছাপান। বন্ধুর নাম তুষার। লম্বা দোহারা গড়ন।হালকা নরম গোপ নাকের নীচে উঠার আয়োজন করছে। আমার সাথে দারুন ভাব। ছাত্রহিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণীর। ওর আই, কিউ, খুব উন্নত নয় আমার মত। আমি দেখতেচাইলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে পত্রিকা দেখাল। মুগ্ধের মত দেখলাম। সমস্তশরীর চঞ্চল হয়ে উঠল। আমার শারীরিক পরিবর্তন এবং চঞ্চলতা বাবার চোখ এড়াল না।বাবা তার পরিচিত এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বাবার একটাঔষধ আনার উছিলায়। ডাক্তার আংকেলের বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই ভাব। টেকো মাথা।কাধের উপরে হালকা কিছু চুল। হিসাব কষলাম, এরকম একটা টেকোমাথার চুল টাকাতেনাপিতেরা কত নেয়?
ডাক্তার আমাকে বাবার ঔষাধটা দিলেন। তার পর আমার সাথে কথা বলা শুরুকরলেন। ঐ বয়সের শারীরিক সমস্যার অহেতুক ভয় দুর করার যাবতীয় পরামর্শ দিলেন।বাজে চিন্তা মাথায় আনতে নিষেধ করলেন। কিছু ঔষধ পত্রও দিলেন। সৎ থাকতেপরামর্শ দিলেন। ভাল বন্ধুর সাথে মিশতে বললেন। আমি বাধ্য ছেলের মত আংকেলেরসমস্ত উপদেশ মেনে নিলাম। আংকেল আরও বললেন, তোমাদের এই যে বয়ঃসন্ধিকালেরব্যাপার স্যাপার নিয়ে তোমরা আমাদের মত পরামর্শক পাচ্ছ। কিন্তু আমাদের সময়এসব কথা কাউকে বলাও যেত না। লোকে নীচু চোখে দেখত। আতংকিত ভাব জাগিয়ে দিত।তিনি আরও বললেন স্কুলের পাঠ্য বিষয়ে এই সব বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা উচিত। আমিআর বসতে চাইলাম না। বিদায় নিলাম বুড়ো ডাক্তার, পরামর্শক আংকেলের কাছ থেকে।
ডাক্তার আংকেলের কোন উপদেশ কাজে লাগতে পারলাম না। গোপনে সিনেমা হলে যেতেশুরু করলাম। নারীর স্পর্শ পেতে ইচ্ছা হতে লাগল। সিনেমা দেখে প্রেম করারস্টাইল, অজশ্র স্টাইল মনে আসতে লাগল। প্রেম,প্রেম,প্রেম! তখন যেন প্রেমইআমার সমস্ত আতœার খোরাক। স্কুলের সমস্ত মেয়েকেই আমি প্রেমিকা হিসাবে পেতেচাইতাম। প্রচন্ড প্রেম তেষ্টায় জীবন যায় যায় অবস্থা। আমার ভাব সাব দেখে একবন্ধু বলল, বাবাকে বলে বিয়ে করে ফেল। প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম। রৌদ্রেরউত্তাপের সাথে সাথে আমার শরীর উত্তপ্ত হতে লাগল। অসম্ভব প্রেম তেষ্টায় কাতরহতে থাকলাম। অথচ কাউকে ভালবাসতে পারছিলাম না। প্রত্যেক মেয়েরই নিজস্ব একটারুপ আছে, সৌন্দার্য আছে, প্রত্যেক মেয়েকেই প্রেমিকা হিসাবে পেতে ইচ্ছা হত।রুপ সৌন্দর্য সম্পর্কে তখন আমার কোন ধারনা ছিল না। বাজারে বইয়ের দোকানঘুরে ঘুরে রুপ সৌন্দার্য সম্পর্কে বই খুজতে শুরু করলাম। বিখ্যাত কিছুসাহিত্যিতদের নারী ও সৌন্দর্য বিষয়ক বই পত্র পড়লাম। প্রেম ও নারীর সম্পর্ক, প্রেমের সাথে রুপ ও সৌন্দর্যের সম্পর্ক বিষয়ে প্রচুর বই পড়লাম। নারীরআকর্ষণ কিসে? প্রেমের মূলমন্ত্র কি? এত সব বুঝতে বুঝতে আমার বয়স তের পারহয়ে গেল। এসব বিষয়ে তখন বন্ধুদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা হত। নারীর সৌন্দর্যকিসে এনিয়ে বিস্তর বিতর্ক চলত। কেউ নারীর সৌন্দর্য হিসেবে কোকড়ানো চুল, চোখ, ঠোট,মুখ হাসিকে বোঝাত। আমি একমত হতে পারতাম না। এর কিছু দিন পর বুকস্টল থেকে ‘নারীর শ্রেষ্ট সম্পদ ও সৌন্দর্যের প্রতীক’ বই টি কিনে পড়তে শুরুকরলাম।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে অজশ্র স্বপ্ন দেখতাম। রাজ্যের সব মেয়ে এসে ভীড় করতেলাগল আমার চোখের সামনে। সবারই চোখের মাদকতা আমাকে আকর্ষণ করত। কিন্তুপ্রত্যেকের মধ্যেই যেন কিছু একটার অভাব। দুর্বিসহ যন্ত্রনায় জীবন ধ্বংস হয়েযাবার মত অবস্থা। লেখা পড়া সিকেয় উঠতে লাগল। ক্লাস টিচার বাবার কাছে নোটিশপাঠালেন যে, ছেলের লেখাপড়ার মান নিম্নগামী। বাবা আমার ভাবসাব দেখে একটাকড়া ধমক লাগালেন একদিন। কিরে ব্যাটা সঞ্জু? লেখাপড়া করিস না? আমি ভড়কেগেলাম। বললাম, করিতো বাবা। বাবা বললেন, বেশ, তাই কর। আমি ঘাড় নেড়ে সায়দিলাম। বুঝতে পারলাম, আমি লেখাপড়া থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। নারীর রুপ, সৌন্দর্য আর প্রেম নিয়ে ভাবতে থাকলে লেখাপড়া সত্যিই সিকেয় উঠবে। মন প্রানবড় কষ্টে বইয়ের কালো অক্ষরের দিকে নিবন্ধ করলাম। খুব অল্প দিনেই আমি নারীররুপ সৌন্দর্য ও আকর্ষনের বিষয় সম্পর্কে ছোট খাট একজন বিশেজ্ঞ হয়ে গেলাম।দেখলাম শুধু আকর্ষণীয় উচ্চতা, ফর্সা ধব ধবে রুপ, ঠোটের হাসি, চোখের চাউনিইনারীর আসল সৌন্দর্য নয়। পরীর মত সুন্দর নারীদের আরও একটা,বৈশিষ্ট্য থাকতেইহবে। সেটা হল ‘ছলনা’। ‘ছলনা’ নারীর সৌনর্যের আর একটা স্বর্গীয় রুপ। যেনারীর মধ্যে ‘ছলনা’ নেই, সে সত্যিকার রুপবতী নয়। কিছু কামনা, বাসনা, প্রত্যাশিত প্রাপ্তির মধ্যে ‘ছলনা’ প্রেমকে সত্যিই দৃঢ় করে। পরীর মতশ্রেষ্ট সুন্দরী হতে হলে অবশ্যই ‘ছলনা’ শব্দ টি যুক্ত থাকতে হবে। আমি তখনবসন্তের প্রথম ধ্ক্কাা কাটিয়ে উঠেছি। মেয়েদের মধ্য আমার প্রবল চাহিদা। আমারদৈহিক উচ্চতা, শারীরিক গড়ন, চুলের ছাট, পোশাক, কথা বলার ধরণ, বিতর্কপ্রতিযোগিতায় উপস্থিত যুক্তি খন্ডন, ফুটবল, ক্রিকেট খেলা, সবটাই মেয়েরাআকর্ষণ করত। আমি যেটাই করতাম, সেটাই শ্রেষ্ট হত তাদের কাছে।
উনিশত আশি সালের প্রথম মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক দিন, শেষ রাতের দিকেএকটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নটা ছিল এই রকম, আমি পাহাড়ের উপরে উঠছি, পাহাড়েরউপরে সবুজ গাছ পালা দেখছি, প্রকৃতির রুপ সুধা পান করছি। নীল আকাশ, হালকাবাতাস, চুলগুলো পিছনে উড়ে যাচ্ছে। নীচে ঝর্ণার স্রোত ধারা। নেচে নেচে পানিনেমে যাচ্ছে দূরে। ছোট নালা, সাদা পানির স্রোতে পূর্ণ। হঠাৎ দেখলাম, একটাবুনো হাতি আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমার মধ্যে উত্তেজনা ভয় কোনটাই হল না।হাতিটি আমার কাছা কাছি এল। শুড় দিয়ে আমার জামায় ঘষতে লাগল। আমি হাসছি। কোনউত্তেজনা নেই। মনে হল যেন বুনো হাতির সাথে মানুষের বুঝি এটাই স্বাভাবিকসম্পর্ক। কিছু পরে হাতিটি আমাকে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। আমি তখনও হাতিটিরদিকে তাকিয়ে তার শুড় উচু করে চলে যাওয়া দেখছি। দেখতে দেখতে চোখ চলে গেলঝর্ণার নীল পানিতে। স্বচ্ছ পানির স্রোত, দেখতে মধুময় লাগল। হঠাৎ কানে ভেসেএল একটা হাসির শব্দ। খিল খিল করে হাসা। কাচের চুড়ির ঝনঝনে শব্দের মত উচ্ছলপ্রানবন্ত। কানে ছন্দের মত আছড়ে পড়তে লাগল। আমার দৃষ্টি উদাস হল। দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার নীচে ঝর্ণার পানিতে একটা মেয়ে। বয়স বড়জোর আট কিনয়। গায়ে লাল ফ্রক, মুখ চাঁদের মত গোল। থুতনিটা সামান্য লম্ব। মাথায়একরাশি চুল। পিঠের উপর ছড়ানো। ঠিক যেন ছোট পরী। হয়ত পরীর বাচ্ছা। শুধু ছবিরপরীদের মত ডানা নেই। শুধু হাসছে আর দু’হাতে পানি ছড়াচ্ছে। জামা ভিজাচ্ছে।আর কেউ আছে কিনা চারপাশে ভাল করে লক্ষ করলাম। কাউকে পেলাম না। একটু পরেঝর্ণার পানিতে সাতার কাটতে শুরু করল। লালফ্রক আর লাল পাজামা পানিতে ভিজেশরীরের সাথে আটকে গেছে। হাসের মত ডুবছে আর উঠছে। একটু নীচে নেমে গেলাম। আরওকাছাকাছি। আরও কাছে, আমি তন্ময় হয়ে মেয়েটিকে দেখছি। চেহারায় দুষ্টামিরআভাস। চোখ ফেরাতে পারলাম না। এক দৃষ্টিতে লাল পরীকে দেখছি। দাঁত দিয়ে নীচেরঠোট কামড়াচ্ছি। চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কাটুক সাতার লাল পরী পানিতে, আমি তাকাচ্ছি আর ঐ দৃশ্যের সৌন্দর্য সুধা পান করছি। থর থর করে কাপছি আমি।কেন আমার এমন হচ্ছে? কিছু পরে মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। একি দেখলাম আমি! এতোসাক্ষাত পরী। আমাকে দেখে আশ্চার্য হল না। বরং দাঁত দিয়ে নীচের ঠোট চেপেধরে চোখ সামান্য বড় করে একটা আদুরে দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমিও দেখছি।দু’জনে চোখ ফেরাতে পারছিনা। ভাবলাম এই কি আমার কল্পকথার রাজকন্যা? যার খোজেআমি অহর্নিশ ব্যস্ত? আমি হাসছি। মেয়েটিও হাসছে। আমি কাছে এগিয়ে যাচ্ছি।সেও রহস্যময়ী ভঙ্গীতে দূরে সরে যাচ্ছে। এক তীব্র হতাশায় হৃদয়টা মোচড় দিয়েউঠল। সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল।


তিন- ৩
১৯৮১ সালের ১লা জুলাই আমার বয়স হল ষোল। এই সময় একটা ব্যাপার ঘটল।নিদ্রায়, অনিদ্রায় আমি যে নারীকে খুজতাম, তাকে পেয়ে গেলাম। একদিন স্কুলেথেকে ফিরে ছাদে উঠলাম। ফ্রেস বাতাস নিয়ে ফুসফুসকে শক্তিশালী করছি। হঠাৎদেখি কুসুম কালারের সকার্ড পরা একটা মেয়ে। পায়ে কেডস। জিনসের প্যান্ট। হাতেবেসলেট। চুলগুলো এলোমেলো। মুক্তোর মত দাত বের করে হাসছে। দুষ্টামীতে ভরাহাসি।শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। আহ্-রে! এই তো সেই মেয়ে! এর সব রুপইআছে। সব সৌন্দর্যে পূর্ণ। চেহারায় দুষ্টামীর ভাব। আমি যত তাকাচ্ছি, ততপাকা পরিচিত প্রেমিকার মত করে হাসতে লাগল। চোখের তারায় কামনা আর আহবানেরঝিলিক। আমি স্থির থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এইতো সেদিনের নীলা, আজ এই সেই। ওতো গোটা পৃথিবীর সৌন্দর্য পিপাসু পুরুষদের ঠন্ডা করে দিতে পারবে। নিজেরসাথে বহু ধস্তা ধস্তি করলাম। বোঝালাম। পারলাম না। বৃষ্টিকে কি আটকানো যায়? আমি নীলার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমাদের সেই দিনের ছোট নীলা আমার সমস্ত কামনায়আগুন ধরিয়ে পূর্ণ নারীতে পরিণত হল। চারদিকের সমস্ত নারী আমার পাছে ফিকে হয়েগেল। আমার প্রেমে নীলা যেন গলে গলে পড়তে লাগল। ওর তখন বয়স আর কত হবে? বড়জোর দশ।
যুদ্ধের পর খোজ খবর নিয়ে বাবা নিশ্চিন্ত হলেন চাচা বেচে নেই। নীলা ওচাচীর অভিভাবক হলেন আমার বাবা। এই সুযোগে নতুন চাঁদের মত আমাদের প্রেম বড়হতে লাগল। নীলাকে আমি ছবি আঁকা শেখাতাম,কবিতা আবৃতি বুঝিয়ে দিতাম। এই সবঅতিরিক্ত কাজ করতাম নীলাকে কাছে পাবার জন্য কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতাম। নীলাড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকত। না পারার অপরাধে ওর গাল টিপে দিতাম। মা-বাবামনে করতেন শাস্তি দিচ্ছি। নীলা ভাবত, মধুর পরশ পাচ্ছি।
আমার প্রতি নীলার প্রচন্ড টান ছিল। সময়ে অসময়ে পড়া দেখিয়ে দিতে বলত। আমিমাথার চুল ধরে হালকা টান দিতাম। ও হাসত। দাঁত গুলো যেন মুক্তার মত ঝিকমিককরছে। হাসলে গালে টোল পড়ে।
দিন দিন আমরা দু’জন ভালবাসার সাগরে ডুবে গেলাম। নীলা গভীর রাত পর্যন্তপড়া শুরু করল। আমিও পড়তাম। একঘরে। এই পড়ার সুযোগে আমার একটা হাত নীলার হাতছুয়ে ফেলত। নীলা আলত করে হাতটা এগিয়ে দিত। আমি হাত ম্যাসেজ করে দিতম। বুকেতখন কম্পন শুরু হত। পড়ার শব্দ হত আরও উচ্চ। সবাই ভাবত আমরা পড়ার সাগরে ডুবেআছি।
এক সময় রাত গভীর হত। আমরা দু’জনে লোভনীয় আনন্দে ডুবে যেতাম। আমি ঠোটে, কানের লতিতে, গলায় আদর একে দিতাম। ও শিউরিয়ে শিউরিয়ে উঠত। এক সময় আমার আঠাথেকে নিজেকে মুক্ত করে ও চাচীর ঘরে শুতে যেত। আমি যন্ত্রনায় ছটফট করতামসারারাত। আমার কামনা, বাসনা তীব্র হতে লাগল। যন্ত্রনায় ছটফট করতাম। নীলারতীব্র ঝাঝালো রুপ আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে দিত। নীলা স্কুলে যাবারসময় পরত কেডস, জিনসের প্যান্ট আর টি শার্ট। বইয়ের ব্যাগ পীঠে ঝুলিয়ে যখনহাটত, তখন মনে হত স্বর্গের অপস্বরী। ছেলেরা হা করে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে।স্কুলের স্যারেরা পর্যন্ত বোকা বনে যেত ওর তীব্র রুপের ঝাঝে। অল্প বয়সেই ঔপাকা যুবতী মেয়েদের মত হাসত। ছুরির মত ধারাল হাসি সবারই বুক চিরে ফেলত। আরকসাইয়ের মত দিব্যি হেসে কথা বলত ও।
স্কুলের গেটে, রাস্তায় হু-হু করে নীলার ভক্ত বাড়তে লাগল। ফুলের ষ্টিকপ্রায় প্রতিদিনই পেত ও। মাঝে মাঝে স্টিকের মধ্যে চিঠিও পেতে শুরু করল। সবইআমাকে দেখাত। আর আমার বুকের ভিতর ধক ধক করে উঠত। ভাবতাম এই বুঝি কেউ আমারনীলাকে ছিনিয়ে নেবার ষড়যন্ত্র করছে। ও গুলো যতো দেখতাম ততই আমি বলতাম, নীলাসোনা আমি তোমাকে ভালবাসি। নীলা তখন খিল খিল করে হাসত। বুঝতাম ও খুব মজাপাচ্ছে। আমাদের প্রেম গভীর হবার সাথে সাথে বিচিত্র সব সখও মাথায় আসতে লাগল।দু’জনে মিলে ছাদের উপর গড়ে তুললাম বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান। এ কাজেবাবার উৎসাহ ছিল প্রচুর। বহুদুর থেকে তিনিও ফূলের চারা এনে দিতেন। মা-চাচীদু’জন ব্যস্ত থাকতেন সংসার গোছানোয় আমরা ব্যস্ত থাকতাম বাগানের যতেœ।
নীলার সয়স যত বাড়তে লাগল। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলার অভ্যাসও বেড়েযেতে লাগল। একদিনের একটা ঘটনার কথা বলি, সে দিন ছিল মঙ্গলবার। শ্রাবন মাস।ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরছে। নীলা বাবাকে চা তৈরী করে দিল। ঔ এক কাপ নিল। আমি শুনলামনীলা বলছে, জানেন চাচাজি, আজ একটা অদ্ভত ব্যাপার ঘটবে। রাত দুটোয়। বাগানেএকটা বিরল প্রজাতির ফূলের চারা আছে। রাত দু’টোয় ফুল ফোটে। পনের মিনিট পরেইঝরে যায়। কত মর্মান্ত্রিক ব্যাপার, তাইনা চাচাজি? বাবা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, খুবই দুঃখজনক। মাত্র পনের মিনিটের আয়ূ। নীলা সাথে সাথে আবদার ধরল আজকিন্তু সাথে থাকবেন চাচাজি। আমি আর আপনি দেখব, কখন ফুল ফোটে। ঠিক দুটোয়কিনা! বাবা সাথে সাথে বললেন না মা, আমি যেতে পারব না। আমার আবার ঠন্ডালাগলে সমস্যা হবে। নীলা ততই জোর ধরে। শেষটায় বাবা বললেন, তোমরা দেখগে মা।কাল আমার সাথে গল্প করলেই আমার দেখা হবে। নীলা কপট রাগ দেখাল। আমি হাসলাম।নীলা ঠিক রাত একটা আটান্ন মিনিটে আমাকে ডেকে তুলল। শিগগিরি চল ছাদে। আমিবললাম, এই বৃষ্টির মধ্যে? বলল, আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। দু’জনেছাদে উঠে গেলাম। একটি ছাতার নীচে আমরা দু’জন। ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। সিড়ির দরজায়ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে মাথা থেকে ছাতা ফেলে দিল। আমরা ভিজতে থাকলাম। বৃষ্টিররিনি ঝিনি শব্দে মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আমি ওর ঠোটের নোনতা স্বাদ নিলাম। পরমআবেশে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর ভেজা শরীরে হাত বোলাতে লাগলাম। শরীরের উত্তাপবৃষ্টির পানি যেন ঠান্ডা করতে পারছিল না। ওর ঘাড়ের নরমচুলে, থুতনিতেঅসংখ্য দুষ্টামির ছাপ মেরে দিলাম। ঠিক পনের মিনিট পরে নীচে নেমে গেলাম। ঘরেঢুকে টিউব লাইটের আলোয় ঠিক জলপরীর মত দেখাল ওকে। আমাদের সমস্ত সুখের মাঝেওনীলার মধ্যে মাঝে মাঝে দুঃখবোধ জেগে উঠত। তখন ওর কাছে সব কিছুই মিথ্যে হয়েযেত। হাতের কাছে যা কিছু থাকত ছুড়ে ফেলে দিত। আমাকেও ওর অসহ্য মনে হত।সাময়িত। তারপর আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাদত। আমি ওরমাথায় হাত বুলিয়ে দুঃখ ভোলাতে চেষ্টা করতাম। একসময় বাচ্চা মেয়েদের মতঘুমিয়ে পড়ত। নীলার এই দুঃখটা ওর বাবাকে নিয়ে বাবা বেচে আছে কি মরে গেছে তাসে জানেনা। এই দুঃখবোধ তীব্র হত ছাব্বিশে মার্চ ও ষোলই ডিসেম্বর। বছরের এইদুই দিনে ওকে সামলানো খুব কঠিন হত। এই দুদিনে আমাদের বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থাহত। যখন খুব ছোট ছিল বাবা ওকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সারা দিনচিড়িয়াখানা, পার্ক, ইত্যাদি সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। অজস্র লজেন্স, চকলেটখেতে দিতেন। ওকে হাসাবার জন্য বাবা মাঝে মাঝে জুকারদের মত ব্যবহার করতেন।জামা-কাপড় আর খেলনার দোকানে নিয়ে যেতেন। ওর পছন্দ মত খেলনা, প্যান্ট, ফ্রক, কেডস, চুলে বাধা গাডার, ফিতা যা যা ওর পছন্দ হত সব কিনে দিতেন। সন্ধায় যখনবাড়ি ফিরত নীলার মনে কোন দুঃখ থাকত না। হেসে হেসে কেনা জিনিস দেখাত। বাবারাতে ওকে কেনা জামা কাপড় পড়তে বলতেন। ও পরত আর বেনী দুলিয়ে হেসে হেসে ঘরভরিয়ে দিত। আমরা খুশি হতাম। নতুন জামা প্যান্ট আর কেডস পরে টিউব লাইটেরআলোয় যখন হেটে বেড়াত মনে হত একটা বাচ্চাপরী হেটে বেড়াচ্ছে।
বড় হবার সাথে সাথে ওর দুঃখবোধটা আরও বেড়ে গেল। তখন আর শুধু কেনা কাটাকরেই ওর কষ্ট ভোলান যেত না। মুখ ভীষণ গম্ভীর করে থাকত। কাঁদত। মুখে বালিশগুজে দিয়ে শুয়ে থাকত। মা-বাবা ও চাচী কেও ওর ঐ ভাব কাটাতে পারত না। সবাইচলে গেলে আমি খুব আদর করে ডাকতাম, এই সোনা, শোন না—সোনা, মাথায় হালকা ঝাকিদিতাম। ও নীচের ঠোট দাঁতে চেপে ধরে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করত। আমিথুতনি ধরে মুখটা উচু করে বলতাম, নীলা সোনাগো, তুমি কষ্টে থাকলে আমার হৃদয়ছিড়ে যায়। এটা কি জাননা? ও ঝর ঝর করে কেদে দিত। ওর ফর্সা গাল বেয়ে চোখেরপানি যখন নামত, মনে হত মুক্তার দানা ঝরে ঝরে পড়ছে। দেখতে ভাল লাগত। চোখেরপানি মুছে দেয়ার সুযোগে একটু আদর করতাম। আস্তে বলতাম, চল বেড়িয়ে আসি, ভাললাগবে।

আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা তৈরী হয়ে নিতাম। চার দিকে আনন্দ উৎসব। আমরা আনন্দউৎসবে যোগ দিতাম না। আমার নীলা সোনাকে নিয়ে যেতাম নির্জন পার্কে। গাছেরছায়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। গাছ, আকাশ দেখে দেখে সময় কাটাতেচেষ্টা করতাম। একসময় ক্লান্ত হতাম। ও বলত, আইচক্রীম খাব। কিনে দিতাম। আমিখেতাম বাদম। মাঝে মাঝ আজগোবী কথা বলত। যেমন, জান- সোনা, আমিও মরে যাব।বাবার মত চলে যাব। আর আসব না। দুঃখভরা হাসি দিত। আমি ভয় পেয়ে যেতাম। ওকেবুকে টেনে নিতাম। সাথে সাথে আদর করতাম। ওর ঘাড়ের নরম চুলগুলোতে আঙ্গুলবুলাতাম। পরম আনন্দে ও ডুবে থাকত কিছুক্ষণ। আমি বলতাম, নীলা হাসবে না? আমারকোলে মাথা রেখে চোখ বুঝে বলত, না। হাসতে ভাল লাগছে না। আমি তখন বানিয়েবানিয়ে নানা রকম হাসির গল্প করতাম। ও খিল খিল করে হেসে উঠত। সাথে সাথে মনেহত পার্কের ঐ ফুলগাছ, মেহগনি গাছ, ও মাটি সবাই আনন্দে ঝনঝন করছে। আস্তে করেদাবির সুরে বলত, সিনেমা দেখব। সিনেমা হলে ঢুকতাম, প্রেমের রসে করুনপরিনতির বই বেশী সময় দেখতে পারতাম না। ও মন খারাপ করত। টেনে হল থেকে বেরকরে আনতাম। হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিতাম। ও বলত, খুব কষ্ট লাগছে। কেন? বলত, নায়িকার সাথে নায়কের এমন ব্যবহার দেখেও কষ্ট লাগবে না? আমি বলতাম, কষ্টেরকি আছে। আমি তো তোমার সাথে অমন ব্যবহার করছিনা। ও হাসত। পার্কে ফিরে খেতামচুইংগাম, দামী চকলেট। এক সময় নীলা বলত, গা গুলিয়ে যাচ্ছে। বমি বমি লাগছে।বলতে বলতেই বমি করে দিত। টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ওর মুখে পানি ছিটিয়ে দিতাম।কিছু সময় পার্কের বেঞ্চে আমার উরুর উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিত। আমি ওর পিঠেছড়িয়ে থাকা চুলে হাত বুলিয়ে দিতাম। পার্কের মানুষগুলো কৌতুহল নিয়ে আমাদেরদিকে তাকাত। সন্ধ্যার দিকে ওর জন্য থ্রি পিস, কিছু প্রসাধনী, মা-বাবা-চাচীরজন্য মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরতাম। ও এসেই ঘুমিয়ে পড়ত। সে দিন আর দেখা হত না।
আমাদের এই ভালবাসার লুকোচুরির খেলা বেশী দিন গোপন রাখতে পারিনী। আমরাধরা পড়ে গেলাম। অথচ সেদিন খারাপ লাগার মত কিছু করিনি। সে দিনের ঘটনা নালিখলে নীলার সোনার ভালবাসার কাহিনী সম্পূর্ণ হবে না। সে দিন ছিল শুক্রবার।সম্ভবত ভাদ্রমাস। রাতে প্রচন্ড জ্যোস্না হবার কথা। বাতাসে জ্যেৎস্না গলেগলে পড়বে। নারকেল গাছের পাতায় জ্যোৎস্না পড়ে চিক্ চিক্ করবে। এদৃশ্য আমারভাল লাগে। যখনই প্রচন্ড জ্যোৎস্না হয় আমি একা একা ছাদে উঠে ঘন্টার পর ঘন্টাফুলের টবের পাশে বসে থাকি মাদুর পেতে। সেদিনও ছিলাম। আমি একদৃষ্টিতে পূর্বদিকে তাকিয়ে আছি। লাল টকটকে চাঁদ সবে উঠেছে। চারদিকে আলো ঝরে পড়ছে। আমিএকদৃষ্টিতে দেখছি। হঠাৎ পিছন দিকে পায়ের শব্দ পেলাম। তাকালাম না। একটু পরপিছন থেকে নীলা দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমার পিঠে ওর শরীরেরআতিরিক্ত অপরিহার্স মাংসের চাপ অনুভব করলাম। মুহুর্তে গায়ে বিদ্যুৎ বয়েগেল। বাম হাতে আমার মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আদর করতে লাগল। ওর গরমনিশ্বাস আমাকে উতালা করে তুলল। আমার মুখের নোনতা স্বাদ নিতে লাগল ও। ওরশরীর থেকে প্রসাধনীর গন্ধ ভেসে আসল নাকে। কড়া মিষ্টি গন্ধ। আমি ওকে আরওকাছে নিতে চাইলাম। ও বাধা দিল। মুখে সামান্য উউম-উউম, আদর আর আবেগমাখা শব্দহতে লাগল। আমি বাধা দিলাম না। আমি স্বর্গের সুখ অনুভব করলাম। ও আমাকেস্বর্গসুখ দিচ্ছে। ওর মুখের নোনতা লালায় আমার ঠোঁট জ্বলে যেতে লাগল। ঠোটছেড়ে মুখে, কপালে, গলায়, ঘাড়ের নরম চুলে চুমো খেতে লাগল। ঠিক এই সময় পিছনেমায়ের কড়া গলা শুনতে পেলাম, কে ওখানে? সাথে সাথে মনে হল নীলা আমার পিঠেরউপর মরে পড়ে আছ। আমি বুদ্ধিমান। আমার আই,কিউ ও ভাল। আমি চোখ বুঝে বললাম, প্রচন্ড মাথাধরেছে। একটু মাথা টিপে দিচ্ছে। সাথে সাথে ওর দু’হাত আমারমাথার চুলের মধ্যে খেলা করতে লাগল। বিলি কেটে দিতে লাগল। তবুও মাকে বুঝানোগেল না। আমরা মায়ের ঘোর সন্দেহের মধ্যে পড়লাম। দু’জনের অবাধ চলাফেরয়নিষেধাজ্ঞ দিলেন।
আমাদের উপর মায়ের গোয়েন্দাগিরি শুরু হল। নীলা পনের দিন আর আমার সামনেআসল না। আমিও খোজার চেষ্টা করলাম না। নীলা ওর মায়ের ঘরে পড়তে শুরু করল, আমিআমার ঘরে। বাড়িতে কেহ কিছুই জানল না। দুদিন পর আমি অসহ্য হয়ে উঠলাম।বুঝলাম শরীরটা এবার সত্যিই কয়লা হয়ে যাবে। বার বার সুযোগ খুজতে লাগলাম।খাতা, বই, ষ্টাপলার, গজপিন, আলপিন এই সব চাইতাম। যাতে নীলা আমার কাছে আসারসুযোগ পায়। আমার চাহিদার কথা বলা মাত্রই মা এসে হাজির হতেন। আমার মুখবিরক্তিতে ভার হত। ভাবতাম এই বয়সে ছেলের উপর এত গোয়েন্দা গিরি কেন? মাদীর্ঘরাত জেগে থাকতেন। যত সময় নিশ্চিত না হতেন যে, আমরা ঘুমিয়েছি ততসময়।জিদ করে আরও রাত জাগা শুরু করলাম। যাতে মায়ের জেগে থেকে গোয়েন্দা গিরিরস্বাদ মিটে যায়। হলনা, উনি যেন ঘুমিয়ে থেকেও দু’চোখ খোলা রাখতেন। ঘুমিয়েছেনকিনা জানার জন্য পেনন্সিল মেঝেতে ফেলে দিতাম। সাথে সাথে জেগে উঠতেন। আমারঘরে ছুটে আসতেন। বলতেন, কি পড়লরে সঞ্জু? আমি বলতাম, কই কিছুই নাতো। আনমনেবলতেন, শুনলঅমতো কিসের একটা শব্দ! তার পর চলে যেতেন। মায়ের খোজা খুজিকেবাবা-চাচী ভাবতেন আমাদের জন্য তার দরদ গলে গলে পড়ছে। আমি ভাবতাম আমাদের উপরঅত্যাচার করা হচ্ছে।
আমার নীলা আমার সামনে হেটে যাচ্ছে, হাসছে, বই পড়ছে অথচ আমি কাছেপাচ্ছিনা। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করতাম। দু’দিন আদর করতে না পেরে, আদর নাপেয়ে জান কয়লা হয়ে উঠল। এই দুদিনে বুঝলাম, নীলা রুপের রানী হয়েছে। ও গোটাপৃথিবী ঠান্ডা করে দিতে পারবে। ওর রুপ শিখা দপদপ করছে। সেই শিখায় আমি জ্বলেপুড়ে খ্াক হয়ে যাচ্ছি। আমি সুযোগ খুজতে থাকলাম। একটা সুযোগ পেয়েও গেলাম।গোয়েন্দাগিরির তৃতীয় দিন। মা নামাজ কামাই দিতেন না। মাগরিবের নামাজে বসলেনসেদি। আমি ঘর থেকে বের হলাম না। নীলা ছাদ থেকে কাপড় চোপড় উঠারে বলে জোরেজোরে বলল এবং দ্রুত উঠে গেল। আমিও উঠে গেলাম। তিন দিন বিচ্ছেদে আমরা কাতরহয়ে পড়েছিলাম। আমাকে সিড়ির দিকে আসতে দেখে ও দাড়িয়ে গেল। দ্রুত কাছে টেনেনিলাম। ঠোটে,মুখে,গলায় যেখানে সুযোগ পেলাম আদর করলাম। ওইটুকু সময়ে যেটুকুপারলাম করলাম।
মায়ের গোয়েন্দাগিরি বেশীদিন টিকলনা। বয়সের চাপে অতিরিক্ত চিন্তায় মায়েরহাই প্রেসার দেখা দিল। ডাক্তার দেখালাম। বললেন, নিয়মিত অষুধ না খেলেস্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। ফেরার সম্ভবনা কম। মা-শান্ত হয়ে গেলেন। এক মাস পরঅনিয়মে মায়ের স্ট্রোক হল। হাস পাতালে মা মারা গেলেন। বাবা নীলা-চাচী-খুবকাদলেন। আমি কাঁদলাম না। মায়ের মৃত্যু আমাকে সাময়িক কষ্ট দিলেনও আনন্দিতহয়ে ছিলাম বেশী।
মায়ের মৃত্যুর পর সংসারটা অন্যরকম মনে হত। চাচী সারা দিন সংসার দেখাশুনা করতেন। বাবা বাইরের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরতেন। খবরের কাগজেরহেড লাইন এক নজরে দেখে শুয়ে পড়তেন। বাবার নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর চেষ্টা করতনীলা। বাবা যত সময় বাড়ী থাকতেন, নীলা সব সময় আঠার মত লেগে থাকত। বাবার কোনকষ্টহতে দিত না নীলা। আমরা পেয়ে গেলাম মধু খাওয়ার চমৎকার সুযোগ।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশী ভাবতে লাগলেন। বাবাচাইতেন আমি কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে গ্রামের কৃষকদের সেবা করি। আমিচাইতাম মেডিকেল সায়েন্সে ডিপে¬ামা করে পাহাড়ী দরিদ্র উপজাতীদের সেবা করি।
ছন্দের মত চলতে লাগলাম আমরা। রুটিন ব্রেক হত না। যে যার মত চলছি। এরমধ্যে সকল হিসাব নিকাশ ভুল প্রমাণিত হল। যে চাচাকে ভাবতাম মারা গেছেন। তিনিএক দিন রাত দশটায় দুটো সুটকেস নিয়ে হাজির হলেন। কোট প্যান্ট টাই পরাচমৎকার এক সুপুরুষ। এটা ঘটল ঊনিশত তিরাশিতে। চাচা যেন এতদিন পর আরও যুবকহয়েছেন। একাত্তরে যে বেকার ল্যাদলেদে যুবককে দেখতাম এযেন সেই নয়। চাচীহাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বাবাও আমি আনন্দে নেচে উঠলাম। শুধু নীলা কিছুবুঝতে পরলনা ছবি ছাড়া ও ওর বাবাকে ভাল করে দেখেইনি। চাচা নীলাকে জড়িয়ে ধরেঅজশ্র কাদলেন। আদর করলেন। মার জন্য দুঃখ করলেন। এতদিন পর চাচা যেন কেঁদেকেঁদে ফ্রেস হলেন। নীলাতো চাচাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে গেল।আমাকে নীলাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে চাচা কাঁদলেন। কিছু সময় আমরা যোরেরমধ্যে কাটালাম। চাচা খাওয়া দাওয়া করলেন এবং বাবার সাথে একান্ত আলোচনায়বসলেন।


চার- ৪
তিন দিন পরে চাচা সম্পর্কে যেটা জানলাম, সেটা হল এই রকম—- চাচা একাত্তরেনকশালী লিডার হয়ে অনেক খুন খারাবী করেছেন। লূট-পাট করেছেন। সঙ্গীদের কাউকেভাগ দেননি। সম্পদ নিজের বলে মনে করলেন। নিজের লোক তখন শত্র“ হয়ে গেল। তিনিআতœ গোপন করলেন। দেশ স্বাধীন হলেও শত্র“ কমল না। তিনি কিছুদিন চিটাগাং এরদিকে ছিলেন। পাহাড়েও কিছু দিন কাটিয়েদেন। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটল ।তিনি এই পরিবর্তনের সুযোগে সাদা জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন। ঢাকায়ফিরলেন। উত্তরায় ভাড়া বাসায় একা একা থাকতে শুরু কলরেন, ব্যবসা পাতি শুরুকরলেন। নিজেকে মুক্তি যোদ্ধা বলে পরিচয় দিলেন। প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে গেল।এখন তার অনেক ব্যবসা। বৈধ অবৈধ মিলে কয়েক কোটি টাকার মালিক। গুলশান, মতিঝিল, উত্তরায় মোট আটখানা প্রাসাদতুল্য বাড়ি। এসব এলাকায় তার নাম বললে যেকোন রিক্সা, ট্যাক্সি ওয়ালা দেখিয়ে দেবে। তবে আবিদ হোসেন নামে তাকে কেউচিনবে না। বলতে হবে বীরমুক্তিযোদ্ধা সাকিব হোসেন। এখন ঢাকায় তিনি নীলা ওনীলার মাকে নিয়ে যেতে চান। বাবা রাজি হলে তিনি এবং আমিও যেতে পারি।
সবশুনে বাবা হাসলেন। বললেন খুন খারাবী করে বড়লোক হয়েছিস। ছিলি নকশালী, হলি মুক্তিযোদ্ধা নামছিল আবেদ হোসেন, পাল্টে হলি কিনা সাকিব হোসেন। এখনবলছিস আমাদের সবাইকে সেখানে যেতে হবে। অসম্ভব! চাচার মুখটা অনেক মলিন হয়েগেল। অবশেষে বাবাকে হার মানতে হল। দীর্ঘ দিন পর চাচী তার স্বামীকে পেলেন।নীলা তার বাবাকে পেল, এখন তাদের কেন আটকাতে হবে? বাবা অমত করলেন না।

আমার নীলা সোনাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন আমার কসাই চাচা তিরাশিতে। সেদিন ছিলরবিবার। শনিবার বিকালে নীলাকে মার্কেটে নিয়ে গেলাম। ওর জন্য কিছু জামাকাপড়, রেডিমেড সোনার গহনা কিনলাম।দু’জনে কিছু সময় নির্জনে কাটালাম। কেউকোন কথা বলতে পারলাম না। নীলার দিকে চাইতেও পারলাম না। বাড়ি ফিরে আসলাম।রাতে খাওয়া দাওয়া করলাম। বাবা-চাচা-চাচী ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি একা একা ছাদেউঠে গেলাম। সমস্ত নীল আকাশ মনে হল কালো মেঘে ঢাকা। অসংখ্যা উজ্বলতারকারাজিকে মনে হতে লাগল বিষন্ন। মনে হতে লাগল আমার সামনে কেবল অন্ধকার।গাছের সেই সৌন্দার্য চোখে পড়ল না। নীরব মনে হল সব। ফুলবাগানটায় ঘুরলাম। চোখজ্বলতে লাগল।
রবিবার সকালে আমার কেনা গহনা শাড়ি পরে নীলা পূর্ণপরী হয়ে বসল। আমিভাবলাম, যে ভাবে সেজেছে নীলা গোটা পৃথিবী আজ থ হয়ে যাবে। আমার মনে ভয় ঢুকেগেল। এই নীলাকে আমি ফিরে পাবতো? ঢাকার মানুষ একে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেত? মনে মনে বললাম, হায় আল্ল¬াহ্ গোটা ঢাকা শহরের সমস্ত পুরুষদের তুমি অন্ধ করেদাও। কেউ যেন আমার নীলাকে না দেখে। যে দেখবে সেই পাগল হয়ে যাবে। নীলাকেবিদায় করে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। মাথাটা ঝিম ঝিমকরছিল। একটা মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট খেলাম। চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার পরঘুম ভাঙ্গল। ঘুম চোখে উঠলাম। বাথরুমে যেয়ে হাত মুখু ধুলাম। পড়ার টেবিলেখবরের কাগজ রাখা। দেখলাম। এই প্রথম বুঝলাম, নীলা ছাড়া আমার অস্তিত্বঅর্থহীন। শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নীলাকে আমি ভূলতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না।আমার স্বপ্নে, অনিদ্রায় নীলা বার বার এসে দাড়াতে লাগল। আস্তে আস্তে নীলারশয়ন কক্ষে প্রবেশ করলাম। খাট পড়ে আছে খালি। বালিশগুলো সাজানো। বিছানা চাদরতুলে রাখা। খাটে হাত বুলাতে লাগলাম। কিছু পরে নীলার শয়ন খাটে শুয়ে পড়লাম।নীলার শরীরে একটা চমৎকার গন্ধ ছিল।গন্ধটা খুজতে লাগলাম। যে বালিশ মাথায়দিয়ে আমার সোনা ঘুমাতো সেটি বুকে চেপে ধরে স্বাদ নিতে লাগলাম। কিছু সময়এভাবে কাটালাম। খাট থেকে উঠলাম। নীলার পড়ার টেবিলে বসলাম। ওর পড়ার বইগুলোতে হাত বুলালাম। বই খুলে কিছু পড়তে চেষ্টা করলাম। আজে বাজে কিছু কাগজছিড়ে ফেললাম। ছোট বেলায় ব্যবহার করা ছবি আকার পেন্সিলগুলো দেখলাম সাজানো।কয়েকটি ছবিও দেখলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। নীলাকে ভূলে থাকারজন্য অনেক চেষ্টা করলাম। কোন স্বৃতি যাতে মনে না পড়ে তার জন্য ছবি পেন্সিলগুলো নষ্ট করে ফেললাম। এরপর আলমারির দিকে নজর গেল। দেখলাম কিছু নীল রঙেরজিন্সের প্যান্ট, স্কুলের ব্যাগ, কিছু প্রসাধনী, কেডস্ পড়ে রয়েছে। পারলামনা আমি। আমার অস্তিত্ব থেকে নীলাকে সরাতে পালাম না। সমস্ত ঘর খানাতেই নীলারছোয়ায় নীলাময় হয়ে আছে। ঠিক করলাম এখন থেকে নীলার ঘরেই আমি পড়ব, শোব। ঘরথেকে বেরিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠলাম। অন্ধকার! আকাশে উজ্জ্বল তারাগুলো একদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। বাতাসে আমার চুল গুলো বার বার চোখের উপরপড়ছে। ভাবলাম, এই বাতাসে কি আমার নীলার শরীরের গন্ধ ভেসে আসবে না? কোননীলাবার্তা কি আসবে না? আস্তে আস্তে ফুলগাছগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আদরকরলাম। গাদাফুলের ডগাটা নিয়ে আমার মুখে চোখে গলায় বুলিয়ে দিলাম। আহ, কিস্বাদ! ঠিক যেন নীলার শরীরের গন্ধ। কিছু সময় চোখ বুজে স্বাদ নিলাম।
রাতে বাবা আমি খেতে বসলাম। বাবার মনও ভালছিলনা। স্নেহ আর ঘৃর্ণা একসাথেমিশে আছে বাবারমুখে। আমি কিছুই বললাম না। বাবাই প্রথম বললেন মন খারাপলাগছে? আমি বললাম, না। বাবা আমার কথায় আস্বস্ত হতে পারলেন না। আবার বললেন, তেলে জলে মেশে না। তোর চাচা এখন কোটি পতি। আমি গরীব। আর মিশবে না। পৃথিবীতেমানুষ মানুষে একটাই পার্থক্য, যার আছে, আর যার নেই। রক্তের সম্পর্ক অর্থেরকাছে মিথ্যে। আমি কিছুই বললাম না। বাবা আবার বললেন, তুই হোস্টেলে চলে যা।ওখানে তোর পড়ালেখা ভাল হবে। স্বাস্থ্যের প্রতিও যতœ নিতে পারবি। মন ভাললাগবে। আমি বাবার কথা শুনেও শুনলাম না। দ্রুত খেয়ে উঠে গেলাম। বাবার সাথেকোন কথা না বলেই শুতে গেলাম রাত দশটায়। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বপ্নদেখলাম। স্বপ্নটা এই রকম- নীলা সমুদ্রের তীরে হাটছে। পায়ে সাদা কেডস্, কালোজিন্সের প্যান্ট, লাল রঙের হাফহাতা গেঞ্জি, চোখে কালো সান গ্ল¬াস, চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া, হাতে একটা কালো বেল্টের ঘড়ি। আমি দূর থেকে ডাকছি, নীলাহাসছে মিটি মিটি। সে হাসির ছুরি আমার অন্তর কেটে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। আমিডাকছি। নীলা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি দেখছি, বাতাস ওর দিকে ছুটেচলেছে। সমুদ্রের স্রোত ওকে ছুতে চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে সমস্ত প্রকৃতি ওকেদেখছে। আমি ডাকছি তো ডাকছি। নীলা সোনা ছুটেই চলেছে। ডাকতে ডাকতে আমার ঘুমভেঙ্গে গেল। পিপাসা অনুভব করলাম। একগ্ল¬াস ঠান্ডা পানি খেলাম। মনের ভিতর ভয়ঢুকে গেল। আমার সোনা সত্যিই কি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে দুরে, বহু দূরে…? যেখানে আমার নীলা সোনার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়? বাকী রাত আর ঘুম হলো না।
বাবার কড়া তাগিদেই পরের সপ্তাহে হোস্টেলে উঠলাম। দুইশ আট নম্বরে ছিটপেলাম। দু’জনের থাকার ব্যবস্থা। আমার রুমমেট একজন গিটার বাদক। কলেজক্যাম্পাসে তার সুখ্যাতিও আছে। বান্ধবীর সংখ্যাও প্রচুর। সারা দিন কেউ নাকেউ তার ভক্ত হয়ে আসে। আমিও হালকা টাইপের একজন কবি। কবি হিসাবে পরিচিতিওআছে। কলেজে একবার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে পুরুস্কার ও পেয়েছিলাম। দু’জনেচমৎকার মানিয়ে নিলাম। দু’জনে শিল্প সাহিত্য সংগীত নিয়ে বিস্তর আলোচনাকরতাম। ও বানিজ্য বিভাগের ছাত্র-আমি বিজ্ঞান বিভাগের।
হোস্টেলের হৈ হুল্লু¬ড়ের মধ্যে নিজেকে ছেড়ে দিলাম। টেবিল টেনিস, দাবা, তাস খেলায় মেতে উঠলাম। ব্যাময়াগারে বেশ কিছু সময় কাটাতে লাগলাম স্বাস্থ্যটিক রাখার জন্য। বিতর্ক করতাম। কবিতা সংগীত চর্চাতেও মন দিলাম। পড়াশুনাতেওপ্রচুর উন্নতি হতে লাগল। পরীক্ষাতে ফাষ্ট হতে লাগলাম। নীলার কথা বেশ কিছুদিন জোরাল ভাবে মনে এলনা। তবে অন্তরে তীব্র ব্যাথা অনুভব করতাম। এরমধ্যেবাবা বাড়ি থেকে চিঠি পাঠালেন। মা-মুলিধরনের কিছু উপদেশ ছিল চিঠিতে। কিছুটাকা, সাথে নিলার পাঠানো একটা চিঠি। চিঠিটা আমার কাছেই লেখা। নীল রং এরখাম। উপরে দরদ করে লেখা “সঞ্জুকে”। বাবা বোধ হয় খোলেননি। খুললে আমারভালবাসা কয়লা হয়ে যেত এতক্ষণ।
আমি চিঠিটা খুললাম। পড়লাম। চিঠির সারবস্তু এরকম- ঢাকায় বাবার সাথেআটখানা বাড়িই ঘুরে ফিরে দেখেছে। খুব মজা পেয়েছে। এত চমৎকার বাড়ী তাদের!কয়েকটা স্বুলও দেখা হয়েছে। সব চেয়ে নামী স্বুলে ভর্তি হয়েছে। সেখানে টেনিসকোর্ট আছে। মেয়েদের ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা হয় নিয়মিত। ডিবেটিংক্লাবের সদস্য হয়েছে। সুইমিং পুল আছে। সেখানে ছেলে মেয়েরা একসাথে সাতারকাটে। আমার মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল। আমার পরীসোনা একগাদা ছেলেদের সাথে সুইমিংপুলে সাতার কাটবে? জলপরীর মত আমার সোনা ডুবেডুবে সাতার কাটবে? হায়আল্ল¬াহ! ঐ বোকা ছেলেরা কি সাতার কাটবে? না হা করে আমার নীলা সোনাকেসাতারের পোশাকে দেখবে? ওরাতো সাতারের কথা ভুলেই যাবে। শেষে আমার সোনালিখেছে, তুমি ছাড়া আমার জীবনের সব কিছুই অর্থহীন। যত দ্রুত সম্বব ঢাকায় এস।চিঠিটা বন্ধ করলাম। বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে বেশ করে পানি দিলাম। বেশ ঠান্ডাঠান্ডা ভাবলাগল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। ঘুমুতে চেষ্টা করলাম। পারলামনা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সুইমিং পুল। সেখানে নীলা সাতার কাটছে। সাতারেরপোশাকে ওকে সবায় দেখছে। ও হেসে হেসে জলপরীর মত এগিয়ে যাচ্ছে।
মাথার মধ্যে অজস্র আজে বাজে ভাবনা ঢুকে পড়ল। যেমন- নীলা আজ স্কুল সাতারপ্রতিযোগিতায় চাম্পিয়ান হয়েছে। এবার বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নেবে। পেপারে ওরসাতারের পোশাকে ছবি ছাপা হয়েছে। শুধু ওর সাতারের পোশাকে ছবি ছাপানোর জন্য ঐপত্রিকার বিক্রি সংখ্যা বেড়ে গেল দ্বিগুন। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়াতেলাগলাম। আবার ভাবালাম, নীলা খুব ভাল টেনিস খেলে। স্কুল প্রতিযোগিতায়চা¤িায়ান। জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। গ্যালারি ভর্তি দর্শক। সবায়নীলাকে সাপোর্ট করছে। ওর সাফল্যে গ্যালারি হাঁসি আর হাত তালিতে ভরে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে ও রহস্যময়ী হাসি দিয়ে গ্যালারীর দিকে তাকাচ্ছে। হায় দর্শক, খেলার কি দেখবে? সবাই হা করে নীলার দপদপে রুপ সৌন্দর্য দেখছে। খেলার পোশাকেচমৎকার লাগছে। আর ভাবতে পারলাম না। না জানি আমার নীলা সোনা এবার ফিল্মেওনামবে! ঢালিউড থেকে বলিউড, সেখান থেকে হলিউড। আরও কত কি সব নামি দামি হবেযে আমার সোনা! চোখ খুললাম। আজে বাজে ভাবনা গুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।একটা সিডেটিভ ট্যাবলেট ও একগ্ল¬াস ঠান্ডা পানি খেলাম।
পরের দিন সকাল আটটা পনেরই ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা আর প্রচুর পানি খেলাম।প্রায় ন’টায় কলেজে গেলাম। কলেজের ভীড় আমাকে উতালা করে তুলল। চারদিকে কতআলো কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। যে দিকে তাকাই কেবলই অন্ধকার, সবফাঁকা। কদমগাছের তলায় বসে পড়লাম। অন্য ছেলেরা ক্লাস থেকে বের হয়ে আসছে।আবার ঢুকছে। আমি বেলা দশটা আটত্রিশ মিনিট পর্যন্ত বসে থাকলাম। মাটিতে ভেসেউঠা কদমকগাছের উপর বসে ভাবতে লাগলাম। নীলা কি করছে এখন? স্কুল টাইম। স্কুলেগেছে কি? কোন ড্রেসটা পরেছে? চুলে শ্যাম্পু করেছে কি? মাজায় বেল্ট পরেছে, না কি? কার সাথে স্কুলে গেল? গাড়ীর ড্রাইভার নিশ্চয় আছে। ড্রাইভার কি একানীলাকে নিয়ে যায়? তাহলে তো সব ভেস্তে যাবে। আমার সোনার রুপ সৌন্দর্য তাহলেতো একা ঐ ড্রাইভারই দেখে নিচ্ছে। আদরের সুবাদে পিঠে একটু হাতও বুলিয়ে দিতেপারে। পড়ার উপদেশ দিয়ে দু’আঙ্গুল দিয়ে গালও টিপে দিতে পারে। শালারড্রাইভাররা সব খচ্চর। সুযোগ সন্ধানী। এরা সব পারে। আর ভাবতে পারলাম না। উঠেপড়লাম। বন্ধুদের চেচামেচি শুনতে পেলাম। বাঃ! একেবারে আমার কাছে বসে আছেসবায়। অথচ আমি বুূঝতেই পারিনি। ভাবী কবি হিসাবে ওরা আমাকে ঠাট্রা করতে শুরুকরল। আমি ভাবলাম, কবিতা না ছাই লিখব। ও সব চুলোয় দেব। শালার ফালতু কবিতা!কবি, কবিতার নাম, সারমমর্, ভাষা, ছন্দ, তাল, ছত্র সব যদি নীলা হত!

বেলা বারটার দিকে হোস্টেলে আসলাম বন্ধুদের আঠা ছাড়িয়ে। কিছুটা বিবর্ষহয়ে পড়লাম। এ-কয়দিন মনের সাথে বেশ লড়াই করেছি। ব্যাস্ত থেকেছি। কিন্তু আরপারছিনা। নীলাকে না দেখে থাকতে পারছিনা। হৃদয়, মন হাহাকার করে উঠতে লাগল।নীলাই যেন একমত্র সম্বল। যা আমাকে সজীব করবে। কলেজের অনেক মেয়েকেই নীলারআসনে বসাতে চাইলাম। পারলাম না। আমার নীলা পৃথিবীতে একা। ওর মত পরী শ্রেষ্ঠাআর একটিও নেই। ও যত দুষ্টু, তার মত আর কেউ নেই। ক-জন দিতে পারবে ওর মতহাসি? মুক্তো ঝরবে, ঝকঝকে দাত বের হবে, চোখের তারা উজ্জ্বল হবে, ঐ জল ভেজাচোখ, কার এমন আছে? তার মতো ভালবাসাতে পারও তো চাই। ঠিক করলাম ঢাকায় যাব।আমার সোনাকে না দেখে থাকতে পারব না। আমার সোনাকে সবাই দেখবে, আদর করবে, ভালবাসবে, আর আমি পারবনা? তা হয় না। আমার সোনাকে ঢাকার খচ্চর টাইপ মানুষেরকাছে ছেড়ে দিতে পারি না। বাবাকে হালকা নোটিশ দিয়ে পরের দিন রওনা দিলামঢাকায়।


পাঁচ-৫
গাবতলী বাসষ্ট্যান্ডে ভোর চারটা ছত্রিশ মিনিটে গাড়ী পার্ক করল। তখন ছিলভাদ্র মাস। বৃষ্টির কোন ধরাবাধা নিয়ম ছিলনা। এই রৌদ্র, এই বৃষ্টি, এমনঅবস্থা। সেদিন বৃষ্টি শুরু হল, ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ইলেকট্রিকলাইটের আলোয় মুক্তার মত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা যেন নীলারহাসির মত। আমি উসখুস করতে লাগলাম। বৃষ্টির মধ্যে হেটে হেটে যাব বলে বেরহলাম। হেলপার বললেন, আরে ভাই, এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছেন? কাকভেজা হয়ে যাবেনত। আমি হাসলাম। বললাম, ভিজতে আমার ভালই লাগে। যে অন্ধ আবেগআর ভালবাসার টানে আমি ঢাকায় পৌছালাম তা কি বৃষ্টির মত শীতল বস্তু আটকাতেপারে? যদি সমস্ত ঢাকা শহর অগ্নিকুন্ড হয়ে যেত? আর তার মধ্য দিয়েই যদি হাটতেহত? আমি তবুও থামতাম না। আগুনে পুড়তে পুড়তে আমি নীলার ঘরের দরজায় কড়ানাড়তাম। আর এ তো শান্ত শীতল বৃষ্টি।
আমার নীলা কি এই বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেয়েছিল? বৃষ্টির ছন্দ কি আমার আগমনবার্তা পৌছিয়ে দিয়েছিল? জানিনা পেয়েছিল কি না। তবে আমি পিচের উপর হাটতেহাটতে বৃষ্টি ভেজা নীলা ফূলের গন্ধ পেয়েছিলাম। সমস্ত ঢাকা শহর যেন নীলাফুলের গন্ধে ভরপুর। দু’হাতে নীলা যে ভাবে আমাকে জাপটে ধরত ঠান্ডা বৃষ্টিরপানিকে মনে হয়েছিল জাপটে ধরা নীলারসেই হাত। আনন্দে হাটতে হাটতে সকালআটটায় উত্তরায় পাঁচ বাই চার সড়ক ধরে নকশী নামের বাড়ীর গেটে পৌছলাম।প্রকান্ড বাড়ি। দুই তলা। বাড়ির নাম, “নকশী”। একটি নিয়ন বাতি জ্বলজ্বল করছে।সমস্ত বাড়িটা ঝলমলে । গেটের উপর তরুলতা ফুলের গাছ। লতার মত বেয়ে উঠেছে।গেটের কাছে যেয়ে নাম ফলক দেখলাম। বীর মুক্তি যোদ্ধা মোহাম্মদ ছাকিব হাসান।বাড়ি নং পাঁচ বাই এক, উত্তরা, ঢাকা। ডান পাশে কলিংবেল বোর্ড।
পৃথিবীতে কত রকমের আশ্চার্য ঘটনা ঘটে। আমার চাচার বাসায় সেই রকম একটা আশ্চার্য ঘটনা সে দিন ঘটল।
আমাকে দেখে চাচী আবেগ সামলাতে পারলেন না। শাড়ির আচল দিয়ে ভেজা মাথা-মুখমুছিয়ে দিলেন। অনেক সময় বুকে চেপে ধরলেন। বুঝতে পারলাম চাচী কাঁদছেন। আমারওচোখে পানি এসে গেল। চাচা আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। চাচার চোখের তারাচকচক করতে লাগল। কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। না পেরে দ্রুত সিড়ি বেয়েউপরে উঠে গেলেন। ডাকতে লাগলেন নীলা মা-নীলা দেখে যা কে এসেছে। আমাদের বংশেরআলো, প্রদীপ, সিগগির ওঠ। চাচার চেচামেচিতে নীলা ঘুম জড়ানো চোখে আশ্চার্যমানুষটিকে দেখতে নেমে এল। আমাকে দেখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।চাচা-চাচীর মত কোন উচ্ছ্বাস নেই। কোন আবেগ নেই। শুধু একদৃষ্টিতে আমার দিকেতাকিয়ে দেখতে লাগল। মনে হল আমাকে কত কাল দেখেনি। চোখের তারা স্থির। মাথারচুল এলোমেলো। পরনে হালকা খয়েরী রংঙের স্কাট। আমি দেখতে লাগলাম আমার মানসপ্রিয়াকে। যাকে একটু দেখার জন্য ছুটে আসা। বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষাকরতে পারলাম না। সেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। স্থির। নিশ্চল। দু’জনই বিহ্বল।মনে হল, আমাদের এই দেখা দেখির লগন শেষ হবে না কোন দিন। কিছুক্ষণ পর আমারনীলা সোনার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে গালবেয়ে টপ টপ করে পড়তে লাগল। হাত উঠিয়েপানি মোছানোর দরকার বোধ করল না।একটু পরে ঠোটে মৃদ হাসি ফুটে উঠল। এই জলভেজা চোখ, গাল বেয়েঝরে পড়া পানি, ঠোটে মৃদ হাসি, এক সাথে এত রূপ আরক’জনের আছে? আমার সোনা কিছু না বলে আস্তে আস্তে উুপরেউঠে গেল। প্রকৃতিযাকে এত রূপ এক সাঙ্গে দিয়েছে তার কথা বলার কি দরকার?
বেডরুমের স্মৃতি আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। আমি বাথরুম থেকে ফিরে এসেদেখি, এরই মধ্যে নীলা নিজেকে তৈরী করে নিয়েছে। নীল বঙের একটা শাড়ী পরেছে।চুল ব্রাস করেছে। কানে লাল-নীল পাথরের দু’টো দুল। শাড়ীর আচল মেঝে বরাবরনেমে গেছে। ডান হাতে অনেকগুলো কাচের চুড়ি, টুন টুন করে আওয়াজ তুলে বিছানাতৈরী করছে।
আমি বললাম, নীলা কেমন আছ?
বলল, ভাল, এতদিন পরে মনে পড়ল?
আমি বললাম, এতদিন পরে মনে পড়বে কেন? সব সময়ই তো মনে পড়ে।
নীলা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, সব সময় না ছাই, চাচা কেমন আছেন, তাই বল। একটাখবর দিলেতো গাড়ী পাঠাতে পারতাম। আমি বললাম, খবর দেবার সময় পেলাম কোথায়? তোমার চিঠি পড়ে আমার মাথা খারাপ হবার উপক্রম হল। ভাবলাম, আমার সম্পদ কেউচুরি করবে হয়ত! তাই পাহারা দিতে এলাম। বাবাকে হালকা নোনিশ দিয়েছি মাত্র।
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা স্বর্গীয় পরী আমাকে দেখছে। আস্তে আস্তেনীলার একটা হাত ধরলাম। ও কেঁপে উঠল। মনে হল যেন, বৃষ্টিতে ও ভিজে ঠান্ডাহয়ে যাচ্ছে। চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না।বুকের ভিতর টেনে নিলাম। আদর করলাম। অনেক সময় জড়িয়ে থাকলাম দু’জন। একসময়নীলা বলল, ঠিক আছে আর না। এবার একটু বিশ্রাম কর। সারারাত জার্নি করে এসেছ।তার উপর আবার ভিজেছ, অসুখ বিশুখ বেধে যেতে পারে। তখন আমার দায়িত্ব বেড়েযাবে। আমি বললাম, তাহলেতো বেঁচে যাই। তোমার ছোয়ায় ছোয়ায় মরে যাব। রাগীভাবেনীলা বলল, ছিঃ- এসব কি বল, বলত? তুমি শোও। আমি চা-আনতে যাচ্ছি। চা না কপিখাবে বলত? আমি বললাম, তোমার হাতের চা, কপি, পরটা সব খাব, নিয়ে এস। আমিবিছানায় শুয়ে পড়লাম। চাচী এসে চা দিয়ে গেলেন। চাচা বাইরে বেরিয়ে গেলেন।যাবার আগে আমার ঘরে এলেন। বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। কিছু সময় অন্যান্যগল্প করলেন। বিশ্রাম নিতে বললেন। চা খেয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। নীলা আমার মাথায়হাত বুলাতে লাগল। ক্লান্তি মাখা ঘুম ঘুম আবেশে বুঝতে পারলাম, একটা অপূর্বরূপবর্তী নারী আমার মুখের উপর ঝুকে আমাকে দেখছে। তার মাথার এলো চুল আমারমুখের উপর ঝুলে পড়েছে। হালকা শুড়সুড়ি লাগছে। কাচের চুড়ির টুন টুন শব্দশুনতে পাচ্ছি। একটা পরী মাখা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। আমার মাথার চুল টেনেদিচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি। আবার শুনতে পাচ্ছি। আমাকে বলছে, এ্যাই, এ্যাইদুষ্ট শোন, শুনছ, আমি ডাকছি, তুমি এই কয়দিন আমাকে না দেখে কি ভাবে থাকলে? এ্যাই শোন, আমি আর কিছু মনে করতে পারলাম না। ঘুম ভাঙ্গল দুপুর দুইটা বেজেএকচলি¬শ মিনিটে। হাত ঘড়িটা দেখে আবার কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকলাম। বাইরেরকোলাহল কানে ভেসে আসতে লাগল। বাইরে ঝলমলে রোদ, চার দিকে শুমনো খট খটাঅবস্থা। ভোরের বৃষ্টির কোন চিহ্ন নেই। মানব জীবনকি এই রকম। এই ভাল, এইমন্দ। আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এমন সময় চাচী এলেন ঘরে। বললেন, এ্যাইসঞ্জু, ওঠ খাবি না? কত বেলা হয়েছে জানিস?
আমি বললাম, জানি চাচীজান?
চাচী বললেন ,বলতো একটা আন্দাজ করে শুনি, দেখি তোর আন্দাজ কেমন?
আমি বললাম, দুইটা সাতচলি¬শ মিনিট, কত সেকেন্ড সেটা বলতে পারছিনা।
চাচী বললেন, ঠিক আছে। তোর ধারনা ক্ষমতা ভাল, তোর বাবার মত। ওঠ খাবি চল।
আমি উঠলাম। বাথরুমে যেয়ে হাত মুখ ধুলাম। লূুকিং গ্লাসে দেখলাম, চোখ লালহয়ে আছে। শরীর বেশ ঝরঝরে। ভিজে যাওয়ার কারনে জর-জারী হওয়ার কোন সম্ভবনানেই।
এই প্রথম ঘর বাড়ির চাকচিক্যময় জৌলুস লক্ষ করলাম। আধুনিকতার ছোয়া আছে।লাইব্রেরী, একুইরিয়াম, টিভিরুম, টেনিস কোর্ট সবই আছে। একটা ছোট খাট বেহেস্তখানা। সেই বেহেস্তের পরী নীলা। কবুতরের মত উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। নেই শুধুচাকর-বাকর। হাটতে হাটতে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। নীলা বসে আছে আমার জন্য।আমাকে দেখে মিটি মিটি হাসছে, ঠিক যেন বেহেস্তের পরী টাইপের কোন এক মেয়ে।চোখ নামানো যায় না। চাচী বললেন, নে খাবি তো কিছু। ক্ষিধে লাগেনি তোর? আমিবললাম মনে মনে, ক্ষিধে আমার লেগেছে চাচী জান, তবে তা ভাত মাংসের নয়। রূপেরক্ষিধে। প্রেমের ক্ষিধে। তা না হলে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় আসি?
খেতে বসলাম। একটা এলাহী ব্যাপার। খাশীর মাংস দিয়ে পোলাও রান্না। এরইমধ্যে বগুড়ার দই আনিয়েছেন। আমি আর নীলা খাচ্ছি, চাচী পাতে বেড়ে দিয়ে আনন্দপাচ্ছেন। তিনটা কুড়ি মিনিটে খাওয়া শেষ করলাম।
নীলাদের নকশী নামক ছোট খাট বেহেস্তের মত বাড়ীতে আমি দশ দিন ছিলাম। এই দশদিনের মধ্যে যা যা ঘটেছিল তারসবটা এখন আর আমার মনে নেই। তবে দশ দিনেরসমস্ত ঘটনার সার বস্তু এই রকম…..।

…..নীলা স্কুলে যাওয়া বন্দ করে দিল। সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে চাচা যেতেনব্যবসা দেখা শুনা করতে। আমি আর নীলা বেরিয়ে পড়তাম গাড়িতে করে। চিড়িয়া খানা, সংসদ ভবন, চান্দ্রিমা উদ্যান, রমনা পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বুড়িগঙ্গালেক, এয়ার পোর্ট ঘুরে বেড়াতাম। প্রকৃতির উম্মুক্ত কবুতরের মত আমরা দু’জনউড়ে বেড়াতাম। সারা দিন বাকম বাকম করে ক্লান্ত হয়ে বিকালে বাসায় ফিরতাম।খাওয়া দাওয়া সেরে রেষ্ট নিতাম।সন্ধ্যায় চাচী আমাকে ঢাকা শহরের সব চেয়েনামী মিষ্টির দোকানে নিয়ে যেতেন। মিষ্টি খাওয়াতেন। ফিরতাম রাত আটটার দিকে।কোন কোন দিন এই সময় চাচা বাসায় ফিরতেন। কোন কোন দিন রাত এগার,বারটাও বেজেযেত। আমরা খেয়ে নিতাম। চাচী ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়তেন। আমি আর নীলা ছাদে উঠেরাতের ঢাকা শহর দেখতাম। আমরা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতামব্যস্তময় শহরের দিকে। রাস্তায় অহরহ গাড়ি আলো ফেলে ছুটে চলেছে। রঙিন আলোরঝলকানি। আকাশে তাকাতাম। অন্ধকার মনে হত। অনেক সময় তাকানোর পর জোনাকের মততারা দেখা যেত। চাঁদের আলো ম্ল¬ান মনে হত। আমি আর নীলা তারা গুনতে চেষ্টাকরতাম। এক সময় আমার কোলে মাথা রেখে তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। একহাজার, এক হাজার এক,দুই তারা—— আমি আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। চাঁদেরআলোয় ওর আশ্চর্য ফর্সা মুখটা অনেক্ষণ ধরে দেখতাম। এক সময় ওর ঘুমন্ত শরীরকোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিতাম। চাচার সাথে খুব কম দেখা হত। সকালে আমি যখনউঠতাম, দেখতাম চাচা বাইরে, আর চাচী ভাত বেড়ে বসে আছেন। সকালে নাস্তা করেআবার আমাদের উড়ে বেড়ান। আমাদের বেপরোয়া চাল চলন চাচীর চোখ এড়াল না। নীলারউড় উড় ভাব। আমার ভালবাসায় ভরা চোখের তারা। যখন তখন আমাকে নিয়ে নীলারঅতিরিক্ত আগ্রহ। ছাদে বসে রাতের নিস্তব্ধতা উপভোগ করা। তারা গোনা। এ সবইচাচী জানকে সন্দেহ বাতিক গ্রন্থ করে তুলল। পঞ্চম দিন রাতে আমরা খাচ্ছি।চাচীজান কিছুটা বিমর্ষ হয়ে বললেন। সঞ্জু, তোর বয়স কতরে? আমি বললাম, আঠারো।চাচী বললেন, নীলার কত জানিস? আমি কিছু বললাম না। চাচী বললেন, ওর এখন বার।এই বয়সে তোরা দু’জন কত কাছা কাছি চলে যাচ্ছিস, জানিস? এই বয়সটা গলে যাওয়ারবয়স। একটু সাবধান হ। নইলে সবাই কষ্ট পাবি। তোর কোন কষ্ট হোক আমি চাইনা।আবার নীলার কোন কষ্ট হোক তাও চাইনা। আমি আর খেতে পারলাম না। হাত ধুয়ে উঠেচলে গেলাম বেডরুমে। নীলার মুখ গম্ভীর। আমি কিছু না বলে ব্যাগ গোছাতেলাগলাম। রাতের বাসেই বাড়ি ফিরব। নীলা ঝর ঝর করে ঁেকদে উঠল। সোনা গো তুমিআমাকে একা রেখে যেওনা। আমি এই শহরে একা থাকতে পারবনা। বললাম, নীলা তোমারকোন কষ্ট হবে না। এই ব্যস্তময় শহরে আমাকে ভূলে থাকার সব কিছুই তুমি পাবে।এই সময় চাচী জান ছুটে আসলেন আমার ঘরে। আমার গোছগাছ দেখে অবাক হলেন কিছুটা।তার পর বললেন, রাগ করিসনা সঞ্জু, তোকে আমি যেতে দেব না। তুইতো আমাদের বংশেরআলো। আমার কথায় কষ্ট নিতে নেই, বাবা। তোকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হয়, তাকিজানিস? জানিস তুই? তোর মাথাটা আমি সারারাত কোলে করে বসে থাকতে চাই। জানিসতা? চাচিজান ঁেকদে ফেললেন। বললেন, আমি তোর চাচার সাথে তোদের ব্যাপারে কথাবলব। এখন ফ্রেস হয়ে আনন্দ কর। টিভি দ্যাখ, টেনিস খ্যাল, মন ভাল হবে।ভাবলাম, মন ভাল হবে না-ছাই হবে। টিভিতে কি নীলার মত মেয়েদের দেখা যাবে? আমার মনের ভাষা বুঝবে? আমার সাথে দুষ্টামি করবে? ছাই করবে। সেদিনও আমরাদু’জন ছাদে উঠলাম। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে আটকে ধরতে চেষ্টাকরলাম। ওর কড়া সেন্টে আমার বুক ভরে তুলতে লাগল। ও বার বার বলতে লাগল, জান, ওগো সোনা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তুমি আমাকে ছেড়ে পালাবে না। বল, পালাবে না? আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আদর করতে করতে বললাম, নানীলা, আমি তোমাকে অন্য কোথাও রাখব না। সারা জীবন আমার বুকের মধ্যে তোমাকেচেপে রাখব। আদর করব, ভালবাসব, ভালবাসতে বাসতে আমরা জীবন নিঃশেষ করে দেব।তবুও কারও কথা আমরা মানব না। নীলা সেদিন সারা রাত আমার বুকের মধ্যে ওর মুখগুজে দিয়ে শুয়েছিল। সেদিন ঘরে শুতে যাইনি। ছাদে শুয়েছিলাম। শিশিরে আমাদেরশরীর ভিজে গিয়েছিল। রাতে চাচী আমাদের খুজতে এসেছিলন কিনা কে জানে?
ষষ্ট দিন সকালে ব্যতিক্রম ঘটল। চাচাজান, আমি,নীলা একত্রে নাস্তা করতেবসলাম। চাচার মুখটা হাসি খুশি কি ভারী বুঝা গেলনা। তবে মাঝে মাঝে হাসিফোটাতে লাগলেন। একসময় বললেন, সঞ্জুকে তো আমি কোথাও নিয়ে যেতে পারিনি। আজনিয়ে যাব। শুধু সঞ্জুকে নিয়ে সারা দিন কাটাব। কত দিন একা একা থেকেছি। চাচীবললেন, কোথায় নিয়ে বেরুবে? চাচা বললেন, যাব কোথাও দু’বাপ বেটায়। আমার কিযাওয়ার জায়গার অভাব আছে? চাচী শুধু বললেন, অঁ। নীলা ওর বাবার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ও আর খেতে পারলনা। মাংস রান্নাটা খুব বাজেহয়েছে বলে চাচীকে বকাঝকা করতে করতে হাত মুখ ধুয়ে উঠে গেল। এ নীরব অভিমানআর প্রতিবাদ আমার অন্তরকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল।
সকাল নয়টায় আমি আর চাচা রওনা হলাম। এয়ার কন্ডিশনড পাজেরো গাড়ী। ড্রাইভারগাড়ি স্টাট দিলেন। লোকজনের ভিড় আর অসংখ্য রিক্সার মাঝদিয়ে আমাদের গাড়িছুটে চলল। বিশ মিনিট পরে গাড়ি যেখানে এসে থামল, সেই জায়গার নাম গাজীপুর।একটা কটন মিলেন সামনে।
চাচার নির্দেশমত আমি গাড়ি থেকে নামলাম। কর্মচারীরা ছুটা ছুটি করতে লাগল।আমাকে বিশেষ মেহমান ভাবতে লাগল। চাচা মিলের কর্মকর্তা শ্রেণীর সকলকেডাকলেন। তাদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সব শেষে ছোট একটা বক্তৃতাদিলেন যার সারমর্ম এই রকম— আমি তার বড় ভাইয়ের ছেলে। তবে তার কাছে আমি নিজেরসন্তানের মত। আমি এক মাত্র বংশধর। ভবিষ্যতে মার্কিনমুল্লুকে পড়া শুনারউদ্দেশ্য রওনা হব এবং ফিরে এসে এই সব ব্যবসা দেখা শুনা করব। কর্মকর্তাদেরমুহু মুহু হাতে তালি আর দীর্ঘায়ূ কামনায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমাদের অন্যযায়গায় যেতে হবে এই কথা বলে সভা শেষ করলেন। একাউন্টট্যন্টের সাথে কিছুজরুরি চেক ট্যান্সফর করার ব্যাপারে আলোচনা করলেন।কিছু ক্ষণ পর ম্যানেজারসাহেব আসলেন। তার সাথেও চাচা আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বললেন। সালাম জানিয়ে তারাদু’জনেই বিদায় হলেন। আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন সমস্ত দিন চাচা আমাকেনিয়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বেড়ালেন এবং একই রকম বক্তৃতা দিলেন।ঢাকা শহবে তার আটটা বাড়ির গল্প শুনেছিলাম। গত পাঁচ দিনে নিলা বা চাচি সেসম্পর্কে কোন কথা বলেনি। এমনকি কৈতুহলি হয়েও নীলা বলেনি যে সাভারের বাড়িটাএমন, জয়দেবপুরেরটা এমন কিংবা গুলশান বনানীর শফিং মলটা এমন। চাচাই সেই কাজটিকরলেন। সব শেষে একটা সেমিনারেহাজির হলাম। চাচা সেখানে প্রধান অথিতী।সরকারী প্রতিনিধি ও শিল্পপতিদের মধ্যে ব্যবসায়িক সংক্রান্ত আলোচনা। আমাকেসবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এক সময় চাচা গাড়ি করে বাড়ি ফিরতে বললেন। আরবললেন, তার ফিরতে একটু দেরি হবে। হঠাৎ করেই একদল জাপানী প্রতিনিধদের সাথেসভার আয়োজন।
বাসায় ফিরে আর এক যন্ত্রনায় পড়লাম। নীলা আমাকে জেকে ধরল, বলল, কোথায়কোথায় গেলে? আমি সমস্ত দিনের হিসাব মহারনীর কাছে দাখিল করলাম। তিনি বিশ্বাসকরলেন না। মুখ ভার করে জানালা দিয়ে বাহিরে একটা ফেরিওয়ালার দিকে চেয়েথাকল। আমি একটু আদর করে ডেকে একটা মিথ্যে বলে ওকে হাঁসাতে চেষ্টা করলাম ওখিল খিল করে হাঁসতে লাগল। মনে হল যেন সমস্ত বাড়িটা খুশিতে ঝলমল করছে। গোসলকরে খেয়ে একটু রেষ্ট নিয়ে চাচির সাথে আরেকদফা বেড়াতে বের হলাম। গাড়ি থাকলেবেড়াতে কত সুবিধা!
বেড়ানো সময় সাধারণত চাচি থাকতেন না। এই অভিভাবকহীন স্বাধীন বেড়ানোতেআমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। নীলা বোধ হয় ভাবতে লাগল, আমি আর নীলা ছাড়া আমাদেরপাশে আর কেউ নেই। গাড়ি ছুটে চলেছে চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে। আমার বাম পাশেনীলা ডান পাশে চাচি। গাড়ির পিছনের ছিটে আমরা বসা। এর মধ্যে নীলা ডান পায়েরহাটু দিয়ে আমার হাটুটে ঘষতে লাগল। চোখ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আর হাটুচলে এল আমার দিকে- ভাবা যায়! এমন দুর্দন্ত প্রেমিকা যার আছে সেই জানে এই সবমেয়েদের দাপাদাপি সামলানো কত কঠিন কাজ। আমি চাচির সাথে কথা বলতে বলতে বামহাতটা আমার বাম কানের লতিতে ঘষতে লাগলাম। হাতে নীলার উড়ান্ত চুলের স্পর্শ্বপেলাম এই স্পশ্বের সুখ অনুভব করলাম শুধু আমরা দু’জন। চন্দ্রিমা উদ্যানযাবার কথা থাকলেও আমরা শের-এবাংলা নগর হয়ে সংসদ ভবন এলাকায় এসে নামলাম।চমৎকার! সমনে কত লোক অথচ কেউ কাউকে চিনি না। ড্রাইভার গাড়িতে বসে। আমরা তিনজন হাটতে লাগলাম। লুই অ্যাই ক্যান কে ধন্যবাদ দিলাম। আমরা হাটছি এর মধ্যেনীলা আমার একটা হাত ধরে ফেলল। কাছা কাছি চলতে চলতে আমি প্রায় ওর পায়ে জড়িয়েপড়ে গেলাম। সাথে সাথে চাচি ডান হাতটা ধরে রক্ষা করলেন। চাচি নিজেকেসামলাতে পারলেন না, নীলার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেল, এভাবে হামলে পড়ছিসকেন? একটু ভদ্র, সভ্য হ বেহায়া হয়ে গেছিস দিন দিন। প্রেমে কি দুনিয়ায় আরকেউ পড়ে না। লোকজন মানবি না? নীলার সাদা ফর্সাা আশ্বর্য মুখটা মুহুর্তেমলিন হয়ে গেল। আমি যে খুশি হলাম তা না। আমার অন্তরের উচ্ছ্বাস মরে কাট হয়েগেল। বেড়ানোর আর কোন ইচ্ছা থাকল না। দ্রুত বাসায় ফিরে আসলাম।
সে দিন রাত আটটার সময় চাচা জান বাসায় ফিরলেন খাওয়া দাওয়া সারলেন। আমিতখন নীলার রিডিং রুমে বসে ম্যাগাজিন দেখছিলাম। ম্যাগাজিনের নাম উরংঢ়ষধু ড়ভভষড়বিৎ.নানা রকম সব ফুলের বর্ণনা দেওয়া তাতে। নীলার কোন ফুল পছন্দ, কোন ফুলকত দিন পর পর ফোটে আর ঝরে যায় এই নিয়ে আলোচনা করছিলাম আমরা। দেখলাম, এব্যাপারে নীলা মাঝারী ধরনের একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন। চিন দেশের একটাফুলের বর্ণনা দিচ্ছিল হাত নেড়ে নেড়ে। এমন সময় চাচি জান আমাদের মাঝে হাজিরহলেন। মুখটা খুব খুশি খুশি মনে হলো না। তবে যে খুব মরা মরা তাওনা। এই দুটিরমাঝা মাঝি অবস্থায়। এর কি নাম বাংলা অভিধানে আছে মনে পড়ছে না। আমাকে বললেনসঞ্জু ছাদে যা তোর চাচা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। কথা বলবে। সেদিন ছাদে চাচাআমার সম্পর্কে বললেন,— শোন সঞ্জু, তুমি আমাদের বংশের এক মাত্র আলো। আমিতোমাকে ভীষণ ভালবাসি, স্নেহ করি। আমি চায় তুমি জীবনে অনেক বড় হও, প্রতিষ্টিত হও। আমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল কর। আমি কত বড় হয়েছি সেটা নিজেরচোখে দেখেছো। আগামী দশ বছরের একটা প্লান আছে আমার। সেই অনুযায়ী আমি ঢাকাসিটি করর্পোরেশন এর মেয়র সহ মুন্ত্রি পর্যায় চলে যাব। কেউ ঠেকাতে পারবেনা। তাই আমি চাই তুমিও বড় হও। ফালতু আবেগ বাদ দিয়ে লেখা পড়া করে মানুষ হও।তুমি ইচ্ছা করলে পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশে যেয়ে পড়া শুনা করতে পার। সবব্যবস্থা আমি করে দেব। আমার যে অর্থ সম্পদ আছে সাভাবিক ভাবেও তুমি তার একটাঅংশ পাবে। তার পরও আমি দু’টো কটন মিল এবং সাভারের বাড়িটা তোমার নামে লিখেদিচ্ছি। বাড়িটা কতটুকু জমির উপর তৈরী তা জান? মাত্র এগার একর। কটন মিলদু’টোর খরচ বাদ দিয়ে বাৎসরিক আয় কত টাকা জান? কোটি টাকার উর্দ্ধে।বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় দু’টি কটন মিল আছে। সেই দু’টিই আমার। আজ থেকে তুমিতার মালিক। তবুও তুমি নীলাকে চেয়েও না সঞ্জু। 

তিনি আরও বললেন– শোন সঞ্জু, আমার নিখোজ জীবনে নীলা নীলার মা তোমার বাবার কাছে নিরাপদ ছিল। আমি ভুলিনিতা। আমিও নিশ্চিত ছিলাম যে, তারা তোমার বাবার কাছে নিরাপদ আছে। এই সুযোগেআমি ব্যবসায়ি হয়েছি, রথি- মহারতি টাইপের একজন মানুষ হয়েছি। তাই তোচেয়েছিলাম তোমার বাবাকে ঢাকায় এনে সুখে রাখি। একজন মুক্তি যোদ্ধা, ঢাকায়তার পরিচিতি হোক। তার নামে স্কুল, কলেজ বানিয়ে দিই। দু’একটা দেশি-বিদেশীসেমিনারে বক্তৃতা দিক। তার দর্শন তুলে ধরুক। তা তিনি করলেন না। উল্টো আমাকেখুনি, চোর, নকশাল টকশল বলে ঘৃণা করলেন। তা করুকগে ঘৃণা। আমাকে ঘৃণা করারএকজনই আছেন তিনি তোমার বাবা। পৃথিবীর আর কেউ আমাকে ঘৃণা করার মত নেই। ঢাকায়এখন আমি স্বনামে প্রতিষ্ঠিত। যে প্রতিষ্ঠার জন্য আমি এত সংগ্রাম করলাম, মিথ্যার আশ্রায় নিলাম, খুন টুন ও করলাম। আজ কি করে সে প্রতিষ্ঠার অপমৃত্যুঘটাবো নীলাকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে? আমি যদি গ্রামের সেই ল্যাদ লিদে বেকারবিএ পাস আবিদ হাসান থাকতাম, নীলা যদি তার মেয়ে হত, আমি আপত্তি করতাম না।কিন্তু এখন নীলা একজন মুক্তি যোদ্ধার মেয়ে, তার বিয়েও হতে হবে রাজ রাণীরমত। সবাই যখন জানবে তোমার মত একজনের সাথে মেযে বিয়ে দিচ্ছি, তখন এলিটসুচাইটিতে আমার মুখ কালি হয়ে যাবে। দোহাই সঞ্জু আমার এত বড় ক্ষতি করো না।তুমি আমাদের বংশের একমাত্র আলো, আমি চাই না সেই আলো এত তাড়া তাড়ি নিভে যাক, বরং সেই আলো আরো উজ্জ্বল হোক আমি সাহায্য করব।
এর পর নীলার ভবিষ্যত সম্পর্কে যা বললেন, তা হুবহু তুলে ধরলাম- নীলারজন্য ছেলেকে হতে হবে শ্রেষ্ট রুপবান, শ্রেষ্ট মেধাবী, শ্রেষ্ট ফ্যামিলি এবংধনী। এক কথায় ক্লাস ওয়ান টাইপ ছেলে, যে ছেলে জীবনে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয়হয়নি, সেই রকম। কারণ নীলাও শ্রেষ্ট রূপবতী। লেখাপড়াও চমৎকার। স্কুলের রেকডবলছে- ও ফাষ্ট হবে। নীলার যখন বিয়ে হবে তখন এক এলাহি ব্যাপার ঘটবে। বিয়েরদিন তারিখ ঠিক করা হবে এক বৎসর আগে। সেই দিন থেকে ঢাকার শহরের সব শ্রেণীরমানুষকে খাওয়ানো হবে। ঢাকা শহরের ম্যাপ ধরে কয়েকটা সেকশানে ভাগ করা হবে।প্রথমে খাবে এতিম ফকির তার পর খাবে রিক্সাওয়ারা, ট্রেক্সী ওয়ালা, বাস চালক।এর পর খাবে ব্যবসায়ীরা, এখানে ও পুজি ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস করা হবে। এরপর চাকুরীজিবীদের ও এভাবে খাওয়ানো হবে। এখানেও শ্রেণীবিন্যাস করা হবে।তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরীজিবীদের একদিন, এরপর দ্বিতীয়। সব শেসে প্রথমশ্রেণী কর্মচারীদের। এরপরের পর্বে খাওয়ানো হবে রাজনিতী বিদদের।এখানেপ্রথমে খাওয়ানো হবে ফিল্ড লেভেলের নেতা কর্মিদের। পরে খাওয়ানো হবে, পাতিনেতা ও মাঝারী ধরণের নেতাদের। সব শেষে খাওয়ানো হবে এমপি, মন্ত্রিদের। তবেপ্রধান মন্ত্রিও রাষ্ট্রপতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। শুধু কি তাই? নীলার এই বিয়ের খাওয়ানো পর্ব থেকে পাতি মাস্তান, বড় মাস্তান, গড ফাদার, পকেট মার, ভাসমান পতিতা, লাইসেন্স ধারী পতিতা কেহই বাদ পড়বে না। তবে এসবক্লাসিফিকিসনের জন্য ভাল কোন দেশীও পরিসংখ্যান কোম্পানীকে দায়িত্ব দেওয়াহবে। কেউ যাতে বাদ না পড়ে। সব শেষে ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটা মহাসড়কেএবং এয়ারপোর্টে একটি করে উন্নত মানের হোটেল বসানো হবে। যাতে ঢাকা শহরেআগমণ ও বহিরগমনকারী কেউ খওয়া থেকে বাদ না পড়ে। ঐ এক বৎসর ঢাকা শহবে লোডশেডিং থাকবে না। এ জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রি ও বিদ্যুৎ সচিবদের নিয়ে একটিতদারকি কমিটি গঠন করা হবে।
পুরা ঢাকা শহরকে আধুনীক সাজে সাজানো হবে। এজন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়াহবে। আবেদন করার সুযোগ সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুমাত্র- জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, লণ্ডন, ও ফ্রান্সদের জন্য। তবে চীনকেও বিশেষ বিবেচনায় আবেদন করার সুযোগদেওয়া হবে। কারণ ওরাও আজকাল ভাল সাজগোজ বোঝে। নীলার বিয়ের পোশাক, গহনা সবকিছুই আন্তজাতিক ভাবে যাচাই বাচাই করে কেনা হবে। যাচাই বাচই কমিটি সচিবদেরমধ্য থেকে করা হবে। এ সব ব্যাপারে বিদেশী কিছু নাম করা কম্পানীকে অফার করাহবে। এমন কি কাজল দানিটাও আনা হবে জার্মান থেকে।
চাচার এই ভাষণ শুনার পর আমি থ হয়ে গেলাম। সে দিন রাতে আর ঘুম হলো না।সারা রাত ছাদে দাড়িয়ে কাটিয়ে দিলাম। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল ঢাকাশহরের সুসর্জিত ঝিলমিল ছবি। বধু বেসে নীলা দাড়িয়ে। রূপ ঝলমল করছে। চোখেজার্মান কাজল কোম্পানীর কাজল আর হরিণীর চঞ্চলতা। ঠোটে দুষ্টামির হাসি। চোখেখুশির কান্না, যেন পান্না হয়ে ঝরছে গাল বেয়ে। আলোয় ঝলমল করছে ওর সমস্তশরীর, সমস্ত নারী বৈশিষ্ট্য। আমি আর কল্পনা করতে পারলাম না। কাক ডাকা ভোরেবেডে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
প্রিয় পাঠক, যিনি আমাকে ভীষণ ভালবাসেন,উন্নতি, প্রতিষ্টা কামনা করেন।তিনি আমাকে, আমার ভালবাসাকে কি করে হত্য করতে পারেন? আর তিনিও বা কি করেভাবতে পারলেন যে, দু’টো কটোন মিল আর সাভারের এগার একর জমির উপর তৈরীবাড়িটার লোভে আমি আমার সোনা রানীকে অন্যের হাতে তুলে দেব? অন্য একজন টাকাওয়ালা, ক্ষমতা ওয়ালা, লোমশ বুদ্ধিজিবী টাইপ পুরুষ আমার সোনাকে খুবলে খুবলেখাবে। আমি এ অন্যায় করতে পারি না।
মুহুর্তে অনুভব করলাম, আমি নীলাকে ছাড়া বাঁচব না। নীলা আমার প্রাণ, মণ, দেহ সব।আমার সমস্ত অস্তিত্ব। আমি যে হাত দিয়ে ওর শরীরে আদর করেছি, সেইহাত এখনও নীলাময় হয়ে আছে। আমার সমস্ত শরীরে নীলার আদরের চিহ্ন। আমার ঠোট, চোখ, কপাল, গলা সবই নীলার আদর সোহাগে ভরা। আমি কি করে তাকে ভূলব? আমারসামনে আমার নীলা সোনা অন্য একজনের বৌ হবে, আদর করবে। হয় না, হতে পারে না।নীলার অঙ্গ সৌন্দার্য শুধু আমার জন্য। ঐ রূপ, যৌবনের শিখায়, রূপেরদাপাদাপি, সব- সবই আমার। আমি ছাড়া ওর শরীরে কেউ হাত দিতে পারবে না। আমিছাড়া ওর শরীরের ব্যাকরণ কে ভাল বুূঝবে? ওর যৌবন বসন্তে অন্য কোন ভ্রমর মধুখাক আমি তা চায় না। ওর যত মধু সব আমি চুষে খেতে চাই। আর কেউ না— কেউ না —কেউ না—-কেউ না—–

পিয় পাঠক, আমার চাচার সাথে বুঝাপড়ার তিন দিনের মাথায় আমার সোনাকে নিয়েপালিয়ে গেলাম। আমি বহু চেষ্ট করেছিলাম, যাতে সমস্ত ঘটনা তিনি সহজ ভাবে মেনেনেন। তাতে তার সব কিছুই বজায় থাকত। তিনি তার ধারের কাছেও গেলেন না। বাবাপর্যন্ত টেলিফোনে সব কথা শুনে তাকে অনুরোধ করলেন। তিনি কারো চোখের পানি, অনুরোধ কিছুই শুনলেন না। তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। আমিও আমার সিদ্ধান্তেঅটল ছিলাম।
প্রিয় পাঠক, আর একটু ধৈর্য ধরুন। অধির হবেন না। আমাকে গালা গালি করবেননা। আমার এই লেখা পড়ে হয়তো বুদ্ধিজীবি ধাড়ী পাকা চুল ওয়ালা অভিভাবকরাবলবেন, হারামজাদাকে জুতিয়ে গালের সব ক’টি দাঁত ফেলে দেওয়া দরকার। কিন্তুআপনারাই বলুন, সামাজিক রীতিনীতিআর বড়দের হুমকি ধামকিতে প্রেম কি কখনওচাপা পড়ে? আপনারা হয়তো আপনাদের জীবনের প্রেমকে অস্বীকার করে মহৎ হয়েছেন।কিন্তু আমি আমার প্রেমকে স্বীকার করেই মহৎ হতে চাই– তাই তো আমি আমার নীলাসোনাকে নিয়ে পালিয়ে গেলাম।
রাজরানী নীলা সোনাকে নিয়ে পালানো পর যে সময় আমাদের কাটল, যে সমস্যায় আমিনিপতিত হয়েছিলাম সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলতে হবে।আজ না বলতে পারলে আমি আর কোন দিনই বলতে পারবো না। কারণ আমার হোস্টেলেপুলিশ রেড এলার্ট জারি করেছে। কোন কোন রুমে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সবইশুনতে পাচ্ছি। হয়তো একটু পরে আমি পালিয়ে যাব, নয়তো গুলি খেয়ে মারা যাব, নতুবা আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়ব। তখন পুলিশের লাঠির গুতো খেয়ে সব ভূলে যাব।এই ছাদে এখন আর কেউ নেই। উপরে আকাশ, তার, ছোট ছোট পাখি মাঝে মাঝে উড়েযাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। পাশে অনেক বড় বিল। ধান গাছ বাতাসে দুলে দুলে উঠছে, অন্ধকারে ঢেউয়ের মত লাগছে। একটা মোমবাতির যে আলো তাও আবার আমি আড়াল করেরেখেছি যাতে বেশি দুর হতে বোঝা না যায়। হ্যঁ, আমার সেই অভিজ্ঞতা বড়ইবিচিত্র , বড়ই করুন। সোনা রানীর সাথে পালিয়ে দিন কাটানো ঘটনাকে লিখতে আমারহাত কাপছে। চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে হাতের কব্জি। তবুও–তবুও– আমাকে লিখতেহবে।
অপরিকল্পিত ভাবে পালিয়ে প্রথম একটা হোচট খেলাম। কোথায় যাব, থাকব ঠিক ছিলনা। ঢাকার বাইরে একটা অখ্যাত হোটেলে আশ্রয় নিলাম। প্রথম দিন গেল খোজ খবরনিতে। প্রথমে ঠিক করলাম দেশের কোন এক অখ্যাত গ্রামে আশ্রয় নেব। পরে বুঝলাম, সেটা ঠিক হবে না। সারা দেশ চষে ফেলাবে আমার নকশানলী কসাই চাচা। ঠিকই ধরেনিয়ে যাবে আমার সোনারাণীকে। এমন এক জায়গায় যেতে হবে যেখানে আমার কসাই চাচাপৌছাতে পাবেনা। এই প্রথম বুঝলাম, প্রেম করে পালাতে হলে ভূ-গোল সম্পর্কেওভাল জ্ঞান থাকা চাই। এই দিকটাই আমি দুর্বল। ঠিক করলাম কোন একজন ভাল ভূ-গোলবিদের কাছে জানতে হবে পৃথিবীর কোন কোন এলাকায় এখনও জনবসতি গড়ে উঠেনি। কিংবাকোথায় আশ্রায় নিলে আমাদের কেউ খুজে পাবে না। তেমন একজনকে পেয়েও গেলাম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-গোল বিভাগের চেয়ারম্যান। ভদ্রলোক প্রথমে আমাকে আমলদিলেন না। ভ্রু কুচকে তাকাতে লাগলেন। শেষে একটা কার্ড দিয়ে বললেন, সন্ধারপর বাসায় এসো, এখন ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে একটা সন্দেহ মনেরকোণে উকি মারল। সোনাকে নিয়ে পালিয়েছি আজ দু’দিন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়নিতো ছবি দিয়ে? ফার্মগেট থেকে কয়েকটা পত্রিকা কিনলাম। তন্ন তন্ন করে ঘাটলাম।কোথাও আমাদের খরব ছাপা হয়নি। কিছুটা দুঃচিন্তা মুক্ত হলাম। ভাবলাম সমানে বড়কঠিন পথ এই পথ আমাদের একা একা চলতে হবে। আমাদের এই প্রেমের স্বীকৃতি কেউদেবেনা। নিজেদের প্রেমের পথে নিজেদেরকেই চলতে হবে।
সন্ধ্যা হতে তখন চার ঘন্টা বাকী। এই সময়টা কি করা যায়? নীলাকে রেখেএসেছি সেই হোটেলে। সেখানে আপাতাত নিরাপদ আছে। কারও মনে কোন সন্ধেহ জন্মেনি।একবার ভাবলাম হোটেলে যেয়ে একবার ওকে দেখে আসি। পরক্ষণে ভাবলাম সময় নষ্টকরা ঠিক হবে না। আমাদের কিছু কেনা কাটা করতে হবে। সেটা আগে করা দরকার। আমিগুলশান- মতিঝিল এলাকার দোকান গুলোর ধারে কাছে গেলাম না। কারণ ওসব দোকানেরকর্মচারী, ম্যানেজার সবাই আমাকে দেখেছে চাচার সাথে। শেষে সব ধুলোয় মিশেযাবে। আমি ঢুকলাম ফার্মগেটের পাশে কিছু দোকান আছে সেখানে। একটা ব্যাগকিনলাম। আমার জন্য কয়েকটা প্যান্ট, গেঞ্জি, রাফ ইউজের জন্য তিনটা হাফশার্ট, চারটা তোয়ালে। নীলার জন্য এক ডজন স্কার্ট,মোজা, কেডস। সামনে শিত কালসেজন্য ওম ধরনের গরম কোর্ট। চুলের ফিতা, গাদার, সিনেটারী প্যাড, কিছু ঔষধপত্র। ওখান থেকে বাংলা বাজার গেলাম। কিছু বই কিনার দরকার। দীর্ঘ পথের সাথিবই। নীলার খুব পছন্দের কিছু ম্যাগাজিন। রূপ চর্চার উপর তিনটি বই। একটাপৃথিবী ভ্রমণের গাইড ও একটি বিশ্ব মানচিত্র। এই সব কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়েগেল। জিনিষ গুলি গুছিয়ে একটা দোকানে রাখলাম। বললাম একটু পরে নিয়ে যাব, ধরেন এক ঘন্টা পর। দোকান দার কাচা-পাকা চুলের মাঝারী বয়েসের মাইডিয়ারটাইপের একজন লোক। তিনি হাসি মুখে সম্মতি দিলেন।
ঠিক সন্ধ্যায় আমি প্রফেসর সাহেবের বাসায় উপস্থিত হলাম। ভদ্রলোককে দেখেমনে হলো তিনি আমার জন্য রেডি ছিলেন। চোখের চশমা খুলতে খুলতে বললেন বসো।আঙ্গুল দিয়ে সোফা দেখিয়ে দিলেন। আমি বসলাম। ঘরের দেয়ালের দিকে তাকালাম, নানা রঙ্গের ছবি বাধানো। দৃশ্যাবলি, পাহাড়, নদী এই সব ছবি। তিনি বললেন, বলতুমি কি জানতে চাও? আমি বললাম, স্যার, পৃথিবীর এমন কোন জায়গা কি আছে সেখানেসারা জীবনের জন্য পালিয়ে থাকা যায়? কেউ খুজতে যাবে না— আমার প্রশ্ন শুনেহা-বনে গেলেন। তিনি বললেন, সব জায়গায় তো যাওয়া যায়। তা না হলে সেখানে যারাথাকে তারা গেল কি ভাবে? বসতি গড়ল কি ভাবে? আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম যে, স্যার এমন কোন জায়গায় আমি যেতে চাই যেখানে আমাদের খুজতে যেতে পারে কিন্তুখুজে পাবে না, লুকানোর অজশ্র জায়গা থাকবে। প্রফেসর সাহেব খানিকক্ষণ ভাবলেন।তার পর বললেন, এশিয়ার মধ্যে একটাা জায়গার নাম বলতে পারি, এটা ভারত নেপালসিমান্তে। তাপল্যাং নামক জায়গায়। ওখানে ভারতীয় পুলিশ ও যায় না, নেপালীপুলিশও যায় না। যায়গাটা সাংঘাতিক নিরাপদ। তবে সেখানে পৌছানো খুবই কঠিন।পাহাড়ী উচু নিচু পথ। প্রচন্ড ঠান্ডা বরফ পড়ে। ওখান থেকে সম্ববত নেপালেরমধ্য দিয়ে চীনেও যাওয়া যায়। চীনের কিছু পাহাড়ী এলাকা আছে যেখানে তুমিচিরকালের মত লুকিয়ে বসবাস করতে পার। তিনি তাপল্যাং যাওয়ার একটা গাইড লাইনদিলেন। আর এই বিষয় সংক্রান্ত কিছু বইয়েল নাম লিখে দিলেন যাতে আমি নিজে পড়েসে সব যায়গায় যেতে পারি। প্রফেসর সাহেব আমার প্রশ্ন শুনে প্রথমে ভেবেছিলেনআমি খুন টুন করেছি কিনা? পরে আমি সত্য কথা বললে সামান্য হেসে স্বাগতজানালেন। আমাদের সুখী জীবন কামনা করলেন। চলে আসার সময় তাঁকে ইনফরমেশন ফিবাবদ দুটো কচকচে পাঁচশত টাকার বের করে দিলাম। তিনি নিতে চাননি। আমি জোর করেদিলাম। দ্রুত ব্যাগ বই পত্র গুছিয়ে আমি একঘন্টার মধে হোটেলে উঠলাম। কলিংবেল টিপতেই নীলা দরজা খুলে দিল। দেরির জন্য কিছু কপট রাগ দেখাল। তাতে ওরসৌন্দর্য বেড়ে গেল দ্বিগুন। আমি রাগ কমানোর জন্য জড়িয়ে ধরে হালকা আদরকরলাম। চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। ভেবেছিলাম– মা-বাবাকে ফেলে এসে নীলা খুব ভেঙ্গে পড়বে। হয়তো কান্না কাটি করবে। আমাকেদোষারোপ করবে। ফিরে যেতে চাইবে। তার কোনটিই করলনা। বরং কিছু পরে খুব আনন্দেও ফেটে পড়ল। জামা কাপড় বই দেখে নেচে উঠল। এত সব কেন? আমি বললাম, রাজকন্যার জন্য এসব তো লাগবে। সেদিন রাতটা কেটেছিল অনেকটা চিন্তামুক্ত ভাবে।আগের দিনের মতোভয়ে ভয়ে নয়। সেদিন বেছে বেছে চকৎকার একটা স্কাট পরল ও। পয়েদিলকেডস। এর পর আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম। নিকটেই একটা খাবার হোটেলপেলাম। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফিট ফাট। পছন্দ মত খাবার খেলাম। আমি কিছুটাকম খেতে চাইলে নীলা রাগ করল। বলল, তুমি কি টাকা বাচাচ্ছ কম খেয়ে? আমি কিছুবললাম না। নীলা বলল, যে টাকা আমি এনেছি আগামী ছয় বছর যদি আমরা দু’জনপ্রজাপতির মত উড়ে উড়ে বেড়ায় আর প্রথম শ্রেণী হোটেলে থাকি আর খাই তবুওফুরাবে না। এখন ভাল করে খাও। টাকার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। ছয় বছর কমসময় নয়, এর মধ্যে কিছু একটা উপায় হবে। বার বছর বয়সের একটা মেয়ের এই ধরণেরপাকা পাকা কথায় আমি না হেসে পারলামনা। খেয়ে দেয়ে হোটেলে ঢুকলাম।ম্যানেজারকে একটা গিফট দিলাম। বললাম, আমরা এই হোটেলে আছি বাবা শুনেছেন, তাঁর পক্ষ থেকে আপনার উপহার, যেন আপনি আমাদের দিকে খেয়াল রাখেন- এই আর কি!ম্যানেজার গলে গেলেন যেন। কোন অসুবিধা হবে না এই বাক্যটি অন্তত দশ বারবললেন। আরও বললাম, বাবা হয়ত আপনার কাছে টেলিফোন করতে পারেন, খেয়াল রাখবেন।ম্যানেজার ঘাড় নাড়লেন। রুমে ঢুকেই নীলা বইয়ের উপর হামলে পড়ল। রুপ চর্চার বইদেখে থ হয়ে গেল। আরও রূপ চাই? আমি হাসলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎপরিকল্পনায় মেতে উঠলাম। তাপল্যাং এর কথা শুনে নীলা আনন্দে আটখানা হয়ে গেল।মাউন্ট এভারেষ্ট, সাদা সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়, গাছ- সব যেন ওর চোখের তারায়ভেসে উঠল। আমি বললাম, নীলা, এত আনন্দ করো না এখনও আনন্দের সময় আসেনি। আগেএকটা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা দরকার। পাসপোর্ট অফিসে যাওয়া দরকার। কালএক ঘন্টার মধ্যে পাসপোর্ট বের করতে হবে। দেখতে দেখতে রাত এগারটাা বেজে গেল।নীলা হাই তুলছে দু’হাত উচু করে। এই সময় ওর বুকের উপর থেকে উড়না সরে গেল।আমি দেখলাম লোভী চোখে। ও একটু হাসল। ঠোট চেপে মুখ নীচু করে বলল, এ্যাই, তুমি গোপনে এসব দেখনাকি? আমি বললাম, কি-কি দেখি? কিছু না বলে ও পালাতে গেল।আমি পালাতে দিলাম না। দু’হাতে জোরে এটে ধরলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, বল নাসোনা- আমি তোমার কি দেখি? আমার সোনা লজ্জায় মরে গেল যেন। দু’হাতে মুখএটেধরে বলল, বলব না, বলব না। ছাড়, ছাড় কেউ দেখে ফেলবে। আমি আরও জরে এসে ধরলামবুকের মধ্যে। ওর শরীরের উষ্ণু স্পর্শ আমার বুকে লেগে পাগল করে তুলল। থুতনিধরে মুখ উচু করে ঠোটে চুমু খেলাম। অজশ্র আদর করলাম। আমার আদরে ও অতিষ্ট হয়েউম্ উম্ শব্দ করতে লাগল। জড়িয়ে ধরে থাকলাম অনেক্ষণ। আর পালাতে পারলো নাআমার সোনা। আমার অজশ্র আদরে ও গলে গেল। কত সময় আমি ওকে বুকের ভিতর জড়িয়েধরেছিলাম ঠিক খেয়াল নেই। ডুবে ছিলাম দু’জন দু’জনার আদরের সাগরে। সেদিন আমারপ্রিয়া সোনার রূপ দেখে আমি পাগল হয়েছিলাম, ওর রূপ সুধা চুষে খেয়েছিলাম।আমি বুঝতে পারলাম, ওর ঘুম ছুটে গেছে। যে কামনার ঝড় ওর শরীরে বয়ে চলেছে তারচুড়ান্ত নিস্পতি না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে পাবে না। ওর চোখে মুখে চুড়ান্তকামনার আহবান- আবার উত্তেজনা দমাবারও প্রবল ইচ্ছা। ও থর থর করে কাপতে লাগল।আমি ওকে বিছানায় শুয়ে দিলাম। মাথা টিপে দিলাম। হাত ম্যাসেজ করে দিলাম।অনেক পরে ও শান্ত হল। মাথায় দু’টো বালিশ দিয়ে দু’হাটু ভাজ করে ঘুমিয়ে পড়ল।কিন্তুৃ পাঠক, বিশ্বাস করুন, আমি আমার সোনা রাণীর দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণকরিনি। আমি ওকে অপবিত্র করিনি। গোপনে আমার সোনা রাণীর মধু চুরি করিনি। যাকেআমি ভাল বাসি যার গর্ভে তার মত আর এক ভবিষ্যত সোনা রাণীর আগমণ ঘটবে, তাকেআমি কি করে অপবিত্র করব? এতটা চরিত্রহীণ, বেহায়া আমি নই। আমার বাবা, চাচা, চাচী, সমাজ সবাই আমাকে দিন্দা করতে পারে কিন্তু দোষি করতে পারবে না। অনেকরাত্রে নীলার ঘুম ভাঙ্গল। পানি খেতে চাইল। পানি দিলাম। ফ্লাক্সে রাখা চাএকটা বিস্কুট ও কয়েকটাআফেল দিলাম। শান্ত ভাবে খেল। খাওয়া শেষে আমার সোনাআমার বুকের মধ্যে কুন্ডুলি পাকিয়ে দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল।মাঝে মাঝে আমার পায়ের উপর ওর উরু, হাটু উঠে আসতে লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সোনা বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে? ঘুমের ঘোরে বলল মার কথা।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল সকাল সাতটায়। ঘুম জড়ানো চোখে আমি দেখলাম, নীলা আমার মুখের উপর ঝুকে পড়া, ওর এলো চুলগুলো মুখের উপর কয়েকগোছা, কয়েকগোছা ওর পিঠে ছড়িয়ে আছে। ডান হাতটা আমার মাথার চুলের গোড়া ধরে হালকা টানদিচ্ছে, চোখ দুটি আশ্চার্য মায়াময় হরিনীর মত।
আমাকে বলল, এই আর কত ঘুমাবে, বল? আমি বললাম, আরও দু’ঘন্টা, ও বলল, ইশকুড়ের বাচ্ছা। উঠ আর ঘুমাতে হবে না। আমি বললাম উঠে কি করব? ও বলল, গল্পকরব। আমি বললাম, ঠিক আছে তুমি গল্প বল আমি শুনি।
নীলা সোনা আমার ঘুমের আবেশ বুঝতে পারল। বলল ঠিক আছে তুমি ঘুমাও আমিতোমার মাথা ম্যাসেজ করে দিই। বুঝলাম, আমার সোনা বেশ পাকা গিন্নী হয়ে গেছে।মাথা ম্যাসেজ করতে করতে বলল, ইস দেখেছ, তোমার নাকের গোড়ায় মস্ত একটা ব্রোন, কেটে দেব? আমি বললাম, ব্যাথা পাবতো। আমার সোনা রানী বলল, দাড়াও আস্তেদিচ্ছি। ব্যাথা লাগবে না। দেখতে বিশ্রী দেখাচ্ছে। আমি ঘুমের ভান করলাম। ওমুখের ব্রোন কাটার পর আস্তে আস্তে আমার ঠোটে আঙ্গুল বোলাতে লাগল। আশ্চর্যশিহরন জেগে উঠল আমার মধ্যে। পরে আস্তে করে হামি খেতে লাগল। ও আস্তে আস্তেআমাকে কমনার দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। আমি বাধা দিলাম না। ওর কামনার শিহরনে, আদরের অত্যাচারে আমার ঠোট ছিড়ে যেতে লাগল। আমি আমার হাত দুটো দিয়ে ওর চুলেবোলাতে লাগলাম। ও পরম তৃপ্তিতে আমাকে আদর করতে লাগল। ও জ্বিব দিয়ে ঠোটচাটতে লাগল। নোনতা স্বাদ পেতে লাগলাম। একসময় আমার চোখের পাতা চোখ, গলা, ঘাড়ের নীচে নরম চুলে আদর বসিয়ে দিল। আমি চেষ্টা করলাম নিজেকে দমন করতে। আমিএকটি হাত ওর মাথার চুলের মধ্যে থেকে সরিয়ে পিঠে বোলাতে লাগলাম। কি কোমলআমার সোনা রানীর পিঠ! আমি প্রান পনে নিজেকে দমন করলাম। আমি ইচ্ছা করলে আমারসোনারানীর সমস্ত সম্পদ সেই সময় চুরি করতে পারতাম, ওকে নিঃস করে ছোবড়ার মতফেলে দিতে পারতাম। আমি তা করিনি। আমার সোনারানীকে আমি ধ্বংস করিনি, ঠকাইনি।রক্ষা করেছি। চরম বিপর্যয়ের মুহুর্ত থেকে ওকে আমি সরিয়ে পবিত্র রেখেছি।

আমার সোনার কামভরা ভালবাসার আঠা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাথরুমে গেলাম।প্রথম কর্মটা সারলাম। ফিরে এসে দাত ব্রাস করলাম। বিস্কুট, ফল, আর চা দিয়েনাস্তার শেষে নীলাকে বললাম, সোনাগো, আমরা পালিয়েছি, তোমার বাবা আমাদেরসন্ধান পেলে আমাকে গুলি করে মারবে, তোমাকেও আস্ত রাখবে না। নীলা কিছু বললনা।
আমি আবার বললাম- নীলা, আমরা যে পথে বেরিয়েছি, এক সাথেই আমাদের থাকতেহবে। একই খাটে শুতে হবে। তুমিতো ভাল ভাবেই বোঝ। একই পর্যায়ের একটা ছেলেএকটা মেয়ে একসাথে থাকলে প্রথমে একটু বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। তার পর বন্ধুতেরসুবাদে, একটু আদর স্নেহ বিনিময় হয়। এক সময় আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছা জাগে।
নীলা হাসতে হাসতে বলল, অনেক কিছুটা কি? আমি বললাম, বলবনা। ও প্রায় হামলেআমার মুখের উপর মুখনিয়ে এসে বলল, এই বলনাগো- কি করার ইচ্ছা হয়? আমি একটুআস্তে বললাম সহবাস করার ইচ্ছা হয়॥
নীলা প্রায় সাথে সাথে বলল, এই তুমি একটা আস্ত ফাজিল, চোর। তুমি আমাকেচুরি করেছ। তোমাকে পুলিশে দেব। আমি বাবা ও সব কিছু করতে পারবনা বলে দিলাম।আমি হাসলাম সোনার দিকে তাকিয়ে। খুশিতে ওর চোখ ঝলমল করছে। আমি বললাম, ঠিকআছে- কিছুৃ না কর, একটা সম্পর্ক তো তৈরী করা দরকার। চল আমরা বিয়ে করি।সেদিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। প্রথমে খেয়ে নিলাম। নীলারজন্য খাবার রুমে পাঠিয়ে দিলাম। ওকে রেষ্ট নিতে বলে আমি বেরিয়ে পড়রাম। সেদিনবেরুনোর উদ্দেশ্য ছিল দুটো । একটা পাসপোর্ট অফিস, দ্বিতীয়টা হল কাজী অফিসখোজ করা।
আমি প্রথমে গেলাম পাসপোর্ট অফিসে। কিচূ দালাল সেখানে ঘোরা ঘুরি করে।পাসপোর্ট নেয়ার নিয়ম, সময ও টাকার পরিমান একটা নোটিশ বোর্ডে মারা। সেদিকেতাকিলাম না। খুজতে লাগলাম দালালদের। বিপদের সময় এসব অসৎ মানুষেরা বেশীউপকারে আসে। পেয়ে গেলাম এক দালালকে। এক ঘন্টার মধ্যে পাসপোর্ট করে দেয়ারদাবী শুনে আকাশ থেকে পড়ল যেন। আমি নগদ চারখানা চকচকে পাচশত টাকার নোট সামনেমেলে ধরলাম। বললাম কাজ হলে তোমার জন্য স্পেশাল পুরুস্কার। তোমার বসকে তুমিম্যানেজ কর। বাংলাদেশে টাকা দিলে সব হয়। যত টাকা লাগুক, দেব। তবু এক-দুইঘন্টার মধ্যে আমার পাসপোর্ট চাই-চাই। পুরস্কারের লোভে দালাল সামলাতেপারলনা। ছুটে গেল তার বসের কাছে। হাসিমুখে ফিরে এল। ছবি আর টাকা পয়সা নিয়েগেল। পাঁচ মিনিট পরে আমাকে ফরম পুরুন করতে ডাক পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে তারবসের চোখ স্থির হয়ে গেল। মনে হল, তিনি যেন আমাকে খুজছেন। মুখে শুধু বলল, ওআই সি, তাহলে ইউ আর। আমাকে বললেন, বস এখানে। আমি বসলাম। অফিসার বাথরুমেরদিকে গেলেন। এক কর্মচারীকে বললেন, মফিজ তুমি ফরমটা পুরুন করে সই সাক্ষরকরিয়ে নাও আমি কয়েকটা জরুরী টেখিফোন করব, তুমিতো জানআমার ওয়াইফ এখনইন্ডিয়ায় পিয়ারলেস হসপিটালে চিকিৎসাধীন, ওখানে খোজ নিতে হবে। বলে একটু চোখইশারা করলেন। তার পর বললেন, ওনাকে চা দাও। এত বড় মালদার পার্টি, একটু আদয়যতœ কর। আমার সন্দেহ হল। আমি আগে একবার বলেছিযে, আমার আই, কিউ, ভাল। চাচীরধারনা আমার আনুমান ক্ষমতাও ভাল। আমি ঘোরতর সন্দেহের মধ্যে পড়লাম। নিশ্চয়কোন ষড়যন্ত্র আছে। আমার চাচা সমস্ত অফিসে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়নি তোই? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়নি তো? সাথে সাথে স্থির হয়ে গেলাম। আগে পত্রিকা দেখতেহবে। আমি উঠব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু তড়িঘড়ি করলে সন্দেহের মধ্যে পড়ব বলেপকেটে হাত দিয়েই বললাম এই যা। মফিজ বলল, কি হল? আমি বোকার মতো হেসে বললাম, ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। টাকা আনতে পরিনি, শার্ট চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমি আধাঘন্টার মধ্যে এনে দিচ্ছি। বলে পকেট থেকে আর একখানা পাঁচশত টাকার নোট মফিজকেদিলাম। বললাম এটাও রাখুন বাকী টাকা আনতে যাচ্ছি এসে দেব। তবে কাজটা দ্রুতকরেন। জি আচ্ছা বলে মফিজ তার বসকে ডাকতে গেল। আমি এই ফাঁকে বেরিয়ে পড়লাম।আগে পত্রিকা অফিসে গেলাম। চার পাঁচটা জাতীয় পত্রিকা কিনলাম। একি! সবপত্রিায় আমাদের ছবি সহ বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সন্ধান চেয়েছেন। সন্ধান প্রার্থীআমার চাচা নয়, স্বয়ং স্ব-রাষ্ট্র সচীব, আমি পাথর হয়ে গেলাম, পালাতে পারবতো! ঘোরতর সন্দেহ হল আমার পিছনেই কোন গোয়েন্দা নেই তো? একসময় মনে হল আমাকেকে একজন অনুসরণ করছে। আমি পিছন ফিরে তাকাতেই সেও তাকাচ্ছে। আমি হাটলাম তোসেও হাটল। লোকটার চোখে কাল চশমা। কদমছাট চুল। আমি নিশ্চিত হলাম, ব্যাটাপুলিশের লোক। আমি হঠাৎ একটু জেদি হয়ে গেলাম, একটু চ্যালেঞ্জ নিলাম ব্যাটাকেমন পুলিশের লোক। আর কিভাবেই বা আমাকে অনুসরন করে। একবার ভাবলাম ওনারকাছেই না হয় সিগারেট চেয়ে নেব। সাহসে কুলালো না। আমার চাচা যে মানুষ তিনিহযত শুধু পুলিশকেই জানাননি গোটা ঢাকা শহরের মানুষকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমারপিছনে। আমি সাহস হারালাম না। এগলি ওগলি এ দোকানে ও দোকানে করে প্রায় আধাঘন্টা পর লোকটাকে আর দেখলাম না। আমি সরাসরি বাসে না উঠে, রিকসা ভ্যন চড়েচড়ে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে এসে দেখি নীলা রাজবানীর মত সেজে বসে আছে। চোখেকাজল সুরমাও দিয়েছে। লাল রঙ্গের স্কার্ট মোজা আর কেডস পরে খাটে বসে বিশ্বভ্রমনের গাইড দেখছে। আমাকে দেখেই নেচে উঠল আনন্দে।
আমি বললাম সর্বনাশ হয়েছে নীলা। ও ফ্যাকাসে হয়ে বলল, কি হয়েছে? আমিপত্রিকা গুলো ওর সামনে ফেলে দিলাম। ও দেখল। আমি দেখলাম ও কিছুটা ভয় পেয়েগেছে। আমি কিছুটা সন্দেহের মধ্যে রাখলাম ওকে। ভালকরে যাচাই করা দরকার। চরমবিপদে অনেক সময় সবাই দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারে না। যে আবেগে আমার সাথে ঘরছেড়েছে। এই দুর্যেগে জীবন মরনের সন্ধিক্ষনে হয়ত ওর মোহ কেটে যেতে পারে। আমিবললাম এখন কি করবে নীলা? নীলা বলল, কি করব আবার, পালাতে হবে। আমি বললাম, নীলা এখন আবেগের চেয়ে যুক্তির বেশী প্রয়োজন। তুমি ভেবে দেখ- তোমার বাবা যেকাজটা করেছে- তাতে গোটা প্রশাসন আমাদের খুজে বেড়াচ্ছে। এখনও সময় আছে, তুমিতোমার বাবার কাছে ফিরে যাও। তুমি তার একমাত্র মেয়ে। তিনি তোমাকে ক্ষমাকরবেন। আমি তাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। আমাকেও হয়ত ক্ষমা করতে পারেন। অথবাআমাকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারেন। কেউ কিছুই জানতে পারবেনা। এইটাইসম্ভবনা বেশী। তুমি ইচ্ছা করলে তোমার বাবার কাছে ফিরে যেতে পার কিন্তু আমারপক্ষে আর কোথাও ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারন এই ঘটনার জের হিসেবে আমারবাবাকেও হয়ত এতক্ষন পুলিশ জিঞ্জাসা বাদ করছে। নীলা বলল-তাও অসম্ভব কিছু না।খুনীরা আপন পর মানে না। আমি বললাম, নীলা আমার নীলা সোনা, স্বপ্নের রাণীআমার, তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাও। তোমার ছোয়া যতটুকু পেয়েছি তাতে এইপৃথিবীতে আমার আর কিছুই পাবার নেই। সেই স্মৃতি নিয়ে আমি সারা জীবন বেচেথাকব।
নীলা বলল- তার মানে তুমি আমাকে নিতে চাচ্ছ না? তুমি এতই ভীত? আমাকে কিভেবেছ বলত? তোমাকে বিপদে ফেলে আমি ফিরে যাব বাবার কাছে? না- গো সোনা তা আরহয় না। যে পথে পা বাড়িয়েছি সেই পথই আমার একান্ত আপন। তুমি বিশ্বাস না কর চলকাজী অফিসে। আমি দেখলাম নীলাকে আর ফেরানো যাবে না। দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টেনিলাম। আমি বললাম, এখানে আর থাকা নিরাপদ নয়। দ্রুত গোছ গাছ কর। এক্ষুনিবেরুতে হবে। সময় মাত্র দশ মিনিট।
সেদিন দশ মিনিটের মধ্যে আমরা হোটেল ত্যাগ কললাম। আসার সময় ম্যানেজারকেবললাম, বাবার এক বন্ধুর ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়েছে। যখন তখন অবস্থা।হাসপাতালে আছে। তাই চলে যাচ্ছি। আরও একখানা পাঁচশত টাকার নোট বকশিস দিলামম্যানেজারকে। পথে এসে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ট্রাক্সিতে করে সায়েদাবাদনামলাম। ঠিক করলাম আগে সীমান্ত বর্তী কোন এলাকায় যাওয়া দরকার। আনেকটানিরাপদ হবে। ওখানকার পুলিশরা চোরাকারবারীদের ধরার জন্য ব্যাস্ত থাকে।আমাদের মত প্রেমিক – প্রেমিকাদের জন্য ওদের নজর কম।


ছয়-৬
সেদিন বাসে উঠে আমার রানী সোনার নতুন রূপ দেখলাম। হোটেলে যে স্কার্ট আরকেডস পরেছিল সেটা পাল্টে কাঁচা হলুদ রংয়ের একটা স্কার্ট পরেছে। পায়ে কুসুমকালারের মোজা, সাদা কেডস, চোখে সান গ্লাস মোটা ফ্রেমের। আমি থ হয়ে দেখতেলাগলাম। গাড়ির ড্রাইভারের পিছনে আমাদের ছিট। জানালার ধারে ও বসা। বাতাসেচুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ে আমার মুখে আছড়ে পড়তে লাগল। মিষ্টি মিষ্টি একটাগন্ধ আমার নাকে এল। ঠোটে আবার হালকা লিপষ্টিক ও দিয়েছে। তারই ফাঁক দিয়েমুক্তোর মত দাঁত বের করে কথা বলতে লাগল। আমি বললাম, মাথায় একটা টুপি, হাতেএকটা ছড়ি নিলেনা কেন? ও বলল কেন? আমি বললাম, যে সাজা তুমি সেজেছ এই দুটোনিলে পুরো ফরাসী মেম হয়ে যেত্ েআমি একটু সাহেব সাহেব ভাব দিয়ে তোমার পাসেবসে থাকতে পারতাম আর কি? নীলা বলল, ফাজলামী করনা সোনা। চুপ কর। আমি চুপকরলাম।
আমি এখনও এক হাজার ডলার বাজী ধরে বলতে পারি সেদিন নীলা যে,, ভাবেসেজেছিল তাতে গাড়ীর প্রত্যেক পুরুষ উতালা হয়েছিল। এমনতেই নীলা শ্রেষ্টসুন্দরী। তার উপর একটু সাজগোজ, পোশাক, সব মিলিয়ে ওকে যে কি রুপবর্তী আরব্যক্তিত্বময় করে তুলেছিল তার তুলনা করা সত্যিই মুসকিল।
এরই মধ্যে একটা সমস্যা বাধিয়ে দিল নীলা। আমি তখন ম্যাগাজিন দেখছি। নীলাদেখছে চরংঢ়ষধু ড়ভ ভঃড়ধিৎ পত্রিকাটা। এই সময় একটা ত্রিশোর্ধ পুরুষ নীলাকেজিজ্ঞাসা করল, প্লিজ ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি একা? নীলা হেসেউত্তর দিল ঘড়ঃ ধঃ ধষষ, নঁঃ যিু? ইংরাজীতে উত্তর দেওয়ায় লোকটা হচকচিয়ে গেল।লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি অনেক দূরে যাবেন? নীলা বলল, ওঃ রং ধহ ড়ষফঃৎরপশ.আপনি কি জানতে চান, সরাসরি বলুন। লোকটা আমতা আমতা করতে লাগল। আমিকথা বলতে যাব এমন সময় নীলা বলল, তুমি চুপ কর। আমি এই সমস্ত পথে ঘাটে প্রেমনিবেদন কারীদের ভালভাবে চিনি। লোকটা থতমত খেয়ে তার জায়গায় গিয়ে বসল। আমিনীলাকে বললাম, ছি নীলা, এভাবে মাথা গরম করনা। লোকটা পুলিশের লোকও হতে পারে।আমরা সন্দেহ হচ্ছে। শেষে সব কয়লা হয়ে যাবে। আমার কথায় পর নীলা যে উত্তরদিল তার উপর আর কোন কথা চলে না। নীলা বলল, নামো তুমি গাড়ি থেকে। নামো বলছি।আমাকে বাসায় রেখে এস। আমি তোমার সাথে যাব না। একজন ভীতু লোক আমার স্বামীহতে পারে না। একজন ভীতু মানুষের সাথে আমাকে সারা জীবন কাটাতে হবে ভাবতেভাললাগছেনা। নীলার হাসিমাখা রূপ দেখেছি, অভিমানি রূপ দেখেছি, কামনায় রূপদেখেছি, কাঁদলে সেই জবাফুলের মত ফোলা ফোলা রূপও দেখেছি। কিন্তু রেগে গেলেকেমন দেখায় সেই দিন দেখলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, আর একটু রাগকরনা সোনা..রাগলে তোমাকে যে কি ভাল লাগে.. নীলাকে কথা গুলো এমন ভাবে বললাম যে, নীলাররাগ নেমে গেল। মুখ নীচু করে হাসতে লাগল। একটু পরে দেখলাম, ওর চোখ দুটো একটুভেজা ভেজা। একটা হাত আমি হাতের মধ্যে টেনে নিলাম। গাড়ির মধ্যে লোকের চোখকেফাঁকি দিয়ে যত টুকু আদর করা যায় করলাম।
আমার সোনাকে নিয়ে যখন মেঘনার উপর উঠলাম, তখন আনন্দে আতœহারা হয়ে গেল।আঙ্গুল দিয়ে নীলা পানি দেখাতে লাগল। রেল সেতু দেখছে, ওর কাছে যেন সব কিছুইএকটা ছন্দময় আনন্দ। একবারও ওর মনে হয়নি যে, বাংলাদেশের গোটা পুলিশ প্রশাসনআমাদের খুজে বেড়াচ্ছে। এই মুহুর্তে গাড়ির মধ্যে থেকে একজন এসে বলতে পারে, কোথায় পালাচ্ছ বদমাইয়েশের দল? ঐ হারামীদের জেলে পাঠাও আমি পুলিশের লোক। এইদেখ আমার পরিচয় পত্র। প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি আমরা নিরপদে সিলেটে পৌছলাম।
সিলেটে পৌছানোর পর নতুন একটা অনুভুতি উপলব্দি করলাম। শহর টাকে মনে হলরক্ষকবচ মায়ের মত। মনে হল যেন, আমি পবিত্র মাটিতে পা দিয়েছি। এই মাটি আমাকেআশ্রয় দেবে। যখন টার্মিনাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলাম, তখন হঠাৎ মনে হলআমি বাংলাদেশে নেই, লন্ডন। এখনকার অনেক মানুষ লন্ডন বসবাস করে।বিল্ডিংগুলোও সেরকম ধাচে তৈরী করা। একারনে সিলেটকে বলা হয় বাংলাদেশেরলন্ডন। আমি সেই লন্ডনে আমার প্রিয়া সুন্দরীকে নিয়ে হাজির হলাম এদিক ওদিককিছু সময় পরিচিত ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করলাম অহেতুক ভয় এড়ানোর জন্য। শেষে একটাআবাসিক হোটেলের খোজ করতে লাগলাম।
হোটেল খুজতে আমার জান কয়লা হয়ে গেল। রাস্তায় যাকে জিজ্ঞ্যেস করি, সেইবলে ঐ তো সামনে। একটু আগে, একটু ঘুরে, এই ভাবে। এদিকে আমার সোনার খিদেওপেয়ে গেছে। হাটতে পারছেনা। রিকসা নেব তারও উপয় নেই। দু’মিনিটেই খালি রিকসাচোখে পড়ছে না। শেষে এক বৃদ্ধ বললেন, সামনের ট্রাফিক আইল্যান্ড পার হয়ে বায়েএকটা হোটেল আছে, নাম সূর্যমুখী।
হোটেলের সামনে বেশ চমৎকার একটা ফুলের বাগান। তাজা তাজা ফুল ফুটে আছে।লাইট পড়ে চকচক করছে। ভীড় একটু কম। বুঝলাম এটা বড়লোকদের হোটেল। আমিম্যানেজারের সাথে কথা বলছি, এই ফাকে নীলা ফুল বাগানের দিকে এগুলো। একটু পরেদেখি আমার সোনা মস্ত একটা তাজা ফুল তুলে বুকে চেপে ধরে গন্ধ নিচ্ছে। আমিবুঝলাম, আমার সোনা এই ভাবে আমাকেও বুকের মাঝে চেপে ধরবে। কোন দিনও কোথাওযেতে দেবে না। আমি এক সপ্তাহের বুকিং দিলাম। হোটেলের খাতায় লিখলাম এম, সঞ্জু, এবং নীলা। ঠিকানা পাচ বাই এক, উত্তরা, ঢাকা। সম্পর্ক-স্বামী-স্ত্রুী। উদ্দেশ্য-হানিমুন। ২০৩ নম্বর লেখা একটা চাবি আমার হাতেদিলেন। সাথে একজন বয় পাঠলেন। ২০৩ নম্বর ঘরের সামনে পৌছালে বয়কে একটা পাঁচশতটাকার নোট দিলাম। বললাম বকশিস।
তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ডবল বেড মাঝারী আয়না। পাশে বাথরুমের দরজা। দরজায়আয়না লাগানো। কাচের জানালা, নীল রঙের পর্দা টাঙ্গানো। দুটো চেয়ার। বেতেরতৈরী, কাচ লাগানো টেবিল, মেঝেতে সুন্দর কার্পেট, চিনা মাটির তৈরী লাইটল্যাম্প পিছনের দিকে ঝুলন্ত বারান্দা। কাঠের তৈরী। বিচিত্র প্রজাতির ফুলেরটব দিয়ে সাজানো। আমার সোনা ঘরে ঢুকেই আয়নার সামনে দাড়াল। নিজেকে দেখছে।কাঁচা হলদে রঙের পোশাকে নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে। রূপসুধা পান করছে।আমি ডাকলাম নীলা, ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। হাসল। আমি বললাম- রেষ্ট নাও।সারাদিন গাড়িতে জার্ণি করে এসেছ, খিদেও পেয়েছে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও।
আমি ঘামে ভেজা চট চটে শার্ট প্যান্ট খুলে বাথরুমে ঢুকলাম। গোসল করলাম।ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। প্রথমে ম্যানেজারের সাথে ভাব জমালাম। কোথায়কি দেখার আছে , কি ভাবে যেতে হবে ভাড়া টাড়া কেমন, লোকজন ভদ্র কিনা, বখাটেছেলেদের উৎপাত আছে কিনা! এরকম সমস্যায় পড়লে জরুরী টেলিফোন নাম্বর, ভদ্রলোকসব তথ্য দিলেন। বললেন, জাফলং, মাধবকুন্ড, হযরত শাহজালাল (র) মাজার খুবইআকর্ষনীয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে এখানে। হাচান রাজার বাড়িওদেখে আসতে পারেন। খুব মরমী গান লিখেছেন তিনি। নামকরা লোক। ম্যানেজারকেএকটা ধন্যবাদ দিয়ে রুমে ঢুকলেন।

এর মধ্যে নীলা গোসল সেরেছে। লেবু গ্েন্ধর সাবান মেখেছে। সুমিষ্ট গন্ধেঘর খানা ভরে আছে। আয়নার সামনে চেয়ারে বসে চুল আচড়াচ্ছে। আমি পিছন তেকে ওরগলা জড়িয়ে ধরে আদর করালাম। ও বলল, এখন আর আদর করতে হবে না, ভীষণ ক্ষিদেপেয়েছে। আমি আদর করলাম। আমার আদর খেয়ে সুটকেসের কাছে গেল। চাবি খুলে একটাশাড়ি পরল। দোর্দান্ত আকর্ষনীয় গোলাপী টাইপের একটা শাড়ী । চুলগুলো পিঠের উপরছড়িয়ে আমার বুকের মধ্যে মাথা গুজে দিল। প্রানপন আবেশে আমি ওকে জড়িয়েধরলাম। প্রান ভরে আদর করলাম। মিষ্টি গন্ধ শুকলাম। ওর মাথায় নরম চুলের মধ্যেআমি মুখ ডুবিয়ে মিষ্টি স্বাদ নিলাম। কিছু পরে আমার বাহু থেকে মুক্ত করেবাইরে বেরিয়ে পড়লাম খেতে। মাছভাজি আর খাশির পোলাও খেলাম। আমি বললাম, ঠান্ডাকিছু খাবে। ও বলল না। খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে দ্রুত রুমে ফিরে আসলাম। রুমে ঢুকেদুজন চুপচাপ শুয়ে থাকলাম কিছু সময়। খানিক বাদে নীলা বলল, একটা জিনিস লক্ষকরেছ? আমি বললাম কি? ও বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোন পুলিশআমাদের সন্ধান পাবেনা। আমি বললাম, কি করে বুঝলে? ও বলল আজ দিনটা লাকী বুঝতেপারছনা? তুমি যে ভাবে ভয় পাইয়ে দিলে তাতে আমি তো ভেবে ছিলাম এতক্ষন এইহোটেলে না থেকে আমি থাকতাম বাসায় আর তুমি থাকতে জেলে হাজতে । আমি বললাম, তাঠিক। নীলা বলল, এখন কি করবে ঠিক করেছ? আমি বললাম, কিছু খোজ নিয়েছি। একসপ্তাহের বুকিং দিয়েছি। যাতে আমাদের উপর নজর না পড়ে। তবে তিন চার দিনেরমধ্যে আমরা হোটেল পাল্টাবো। তবে একটা ব্যাপার হবে। ও বলল কি? আমি বললাম কালযাখন আমরা বেড়াতে বের হব, খাতায় লিখছি আমরা হানিমুনে এসেছি, সেইভাবেউচ্ছাস বাহার রাখতে হবে। কোন বিষন্নতা যেন চোখে না পড়ে। নীলা বলল, ঠিক আছে।আমি দেখলাম, নীলার চোখে ঘুম নেমে আসছে। কথা জাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি কথাবাড়ালাম না। ও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি একটা বই ঘাটতে লাগলাম। ঘুমের মাধ্যে নীলাঅদ্ভুত একটা কান্ড করল। ও শুয়ে আছে কাত হয়ে, বাম হাতটা মাথার তলে, ডানহাতটা মুখের আছে থুতনির নিচে। পা ভাজ করা। শাড়ির একটা প্রান্ত হাটুর উপরউঠে গেছে। লাইট পড়ে ওর ফর্সা পা জ্বল জ্বল করছে রুপোর মত। হঠাৎ ও কি যেনবলতে শুরু করল বিড় বিড় করে। বোঝার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট কথা। কাকে যেনডাকছে। বার বার বলছে, এই এই। হাত নাড়ছে। ঘুমের মধ্যে বালিশ টানছে। আমি ওরহাতটা ধরলাম। ও টানছে আমাকে। আমি ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলাম। ঘুম জড়ানোচোখে দুষ্টামির হাসি। আমি ডাকলাম ও উউম উউম করে ডাক শুনল। হাটুতে হাটুঘসছে। আমি ওর মাথাটা বুকের মধ্যে তুলে নিলাম। ও চোখ খুলে আমাকে দেখল। হাসল।আবার চোখ বুঝল। আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর রেশম রেশম নরম বুকের চাপ আমার বুকেঠেকল। আমি কেপে উঠলাম। ঠোটে আদরের ছোয়া দিলাম। ওর ঘুম ছুটে গেল। ও দুপায়েআমাকে জড়িয়ে ধরল। আমরা দু’জন কামনার গভীরে প্রবেশ করতে চাইলাম। ও আমাকেআদরে আদরে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগল। প্রেমের আবেগে ও আমাকে ওর সর্বস্ব দিতেচাইল। ওর নরম হাত দুটোআমার দু’ চোয়াল ধরে ঠোট চুষতে লাগল। আমি জ্বলে যেতেলাগলাম। নোনতা স্বদে গাল ভরে গেল। ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধে আমাকে আবিষ্টকরে তুলল। আমি বুঝতে পারলাম, ও কামনায় চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাতে চাচ্ছে। আমিনিজেও চাচ্ছি। কিন্তু পারলাম না- আমার সত্যবোধ, সৎচরিত্রবোধ, পবিত্রতাবোধ, আমাকে দমন করে দিল। ওকে আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম, ও থর থর করেকাপতে লাগল।
প্রিয় পাঠক, আমার প্রিয়া সোনার দপদপে যৌন শিখায় আমি পুড়ে পুড়ে খাকহয়েছি। ক্ষত বিক্ষত হয়েছি। যন্ত্রনা চেপে ধরেছি। ওর আহবানকে অপমান করেছি।বাহুর বন্ধন কে ছিন্ন করেছি নিষ্টুর কসাইয়ের মত। ওর কষ্ট অনুভব করে আমারহৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তবুও আমার দুষ্ট প্রিয়া সোনাকে আমি নষ্ট করিনি। ওরপবিত্রতার মূলে আমি আঘাত করিনি। মোম শিখার গলনের মত আমি গলে গলে ভিজে গেছি।তবুও আমার সোনাকে আমি অক্ষত রেখেছি। ওর প্রেমকে আমি কলঙ্কিত করিনি। করতেপারিনা। আমার সোনা সুন্দরীর রানী, পাবিত্রতার দিক থেকে ওকে ছোট করতে চাইনি।আমার সেই পবিত্র সোনা, কামনার সোনারানী, দুষ্ট মেয়ে এখন কোথায় তুমি…..ওগোসোনাআমার —-যেখানেই থাক ভাল থাক।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আর আমাদের ঘুম হল না। আমরা আগামী দিন গুলোতে কিকরব, কোথায় কোথায় ঘুরব, তাপল্যাং কি ভাবে যাব তাই নিয়ে ভাবতে লাগলাম।সিলেটে দেখার জায়গার বর্ণনা শুনে ও আনন্দিত হয়ে উঠল। চা বাগান, জাফলাং
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের নাম শুনে ও ছোট সোনা পরীদের মত ডানা মেলে উড়েবেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে লাগল। ঐ সময় ও যেন এ্রকটা খুশির গানও গুন গুন করেগাইতে শুরু করল। আমি বললাম, এক্ষুনিই বেরুবে নাকি? মিষ্টি করে হেসে বলল, জান, আমি যেন চা বাগান চোখে দেখতে পাচ্ছি। কি সবুজ! কি চমৎকার সবুজ দৃশ্য।ওহ কখন যে সকাল হবে? আমি বললাম সোনা, আগে ঠিক কর কোথায় প্রথমে বেড়াতে যাবে? চা বাগানের চমৎকার দৃশ্য দেখতে হলে শ্রীমঙ্গল যেতে হবে। শ্রীমঙ্গলকে চায়েরদেশ বলা হয়। আমি এমন ভাবে কথাটা বললাম, যাতে মনে হয় শ্রীমঙ্গল অনেক অনেকদূর, যাওয়াও কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। কারণ আমি আগে যেতে চেয়েছিলাম জাফলং। নীলাবলল, ঠিক আছে, তুমিই ঠিক কর প্রথমে কোথায় যাবে? আমি বললাম , আগে জাফলং চল, বই থেকে জেনেছি, সিলেটের যত সৌন্দার্য আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ট সৌন্দার্যময়স্থান হল জাফলং। তার পর মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ।ও বলল ঠিক আছে, তুমি যেটাচাইবে সেটাই হবে। আমি হেসে বললাম, এই তো আমার সোনা ভাল বুঝেছে। একটু আদরকরতে গেলে নীলা বলল, থাক প্লিজ, এখন আর না। বড্ড ঘুম আসছে। একটু ঘুমাব।আমার সোনারানী সেদিন রাত প্রায় দুইটা বার মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ল একটা নাইট গাউনপরে। আমি ঘুমাতে পারলাম না। ঘুমান্ত সোনারানীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম বহুসময়। সাংঘাতিক রূপবতি নীলা নাইট গাউন পরে আরও সরল রূপবতীতে পরিণত হয়েছে।মাথায় একরাশ কালচুল বালিশের উপর ছড়ানো। বাম দিকে কাত হয়ে শুয়েছে। পা ভাজকরা। দুটো বালিশই মাথায় দিয়েছে। আমি কিসে মাথা রাখব তা ভাবেনি আমার সোনা।ওর অপুর্ব সুন্দর মুখ খানা মুহুর্তেই আমার কাছে দুঃখী মনে হলো। আমি আস্তেআস্তে নীলার মাথার কাছে বসলাম, ওর চোখে মুখে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।ভাবতে লাগলাম, এই তো সেই মেয়ে যে তার আদর্শ বোধ থেকে বিচ্যুত হয়নি।ভালবাসার মুল্যদিতে সে সাগরে ঝাপ দিয়েছে। সে জানে না তার তীর কোথায়—॥ সাথেসাথে নিজেকে সামলে নিলাম। উঠে এসে ঝুলান্ত বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতেবসলাম। চার দিকে নিস্তব্দ। গভীর রাতে বৈদ্যুতিক আলোকেও অনেকটা ক্লান্ত মনেহল। এই সময় আমার মনটা একটু দুর্বল হয়ে গেল। বাবা-মা চাচীর কথা মনে পড়ল। আরভাবতে পারলাম না। প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম॥

সাত-৭
পর দিন সকাল সাড়ে আটটায় ঘুম ভাঙ্গল। জেগে দেখি নীলা গোসল সেরে কাপড়পাল্টাচ্ছে। সেজেছেও খানিকটা। চোখে কাজলও দিয়েছে। আমার নড়াচড়া দেখে বলল, ঘুম ভাঙ্গল! আমি বললাম হুম— তুমি কখন উঠলে, নীলার তার কোন উত্তর দিলনা।সোজা বিছানায় নেমে আসল। আমার মাথায় বাম হাত রাখল। ডান হাতটা বুকের উপর দিয়েচোয়াল ছুয়ে বলল, এই সোনা তাড়াতাড়ি ওঠ, বেড়াতে যাবে না? এখনও গোসল করবে, নাস্তা করবে, কত কাজ, ওঠ॥ আমি ইচ্ছা করে বললাম, ভাল লাগছে না। আর একটু শুই।চোখ বুঝে বিছানায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগে। আমার সোনা বলল, তুমি চোখ বুজে আরামকরে শোও। আমি মাথাটা একটু টিপে দিচ্ছি। আরাম করে আর শোয়া হলনা। ওর শরীরেরমিষ্টি মিষ্টি গন্ধ আর উঞ্চ স্পর্শ আরমের বারটা বাজিয়ে দিল। সকালের শান্তপরিবেশ কে অশান্ত হয়ে উঠল। ভাবলাম- আর লুকোচুরি নয়। সত্যি সত্যিই কাজীডাকতে হবে। এই পবিত্র সিলেটের হযরত শাহাজালাল (র) দরগা শরীফেই বিয়ে করতেহবে। আর শোয়া হল না। ওর আদরের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে পড়লাম। গোসলকরলাম। বাহিরে থেকে নাস্ত করলাম। রাতেয় পরিকল্পনা অনুসারে জাফলং দেখতে রওনাহলাম, সকাল দাশটায়। শহর থেকে জাফলং মাত্র দুই ঘন্টার পথ। পথে যেতে যেতেআমার নীলা মনির আনন্দ আর ধরে না। জানালায় চোখ রেখে শুধু হাসতে লাগল। সাদাঝকঝকে দাত মুক্তের মত লাগল। দেখতে দেখতে শ্রীপুরে চা বাগানের নৈশঙ্গিকদৃশ্যে ওর হৃদয় গলে যেতে লাগল। বেলা প্রায় বারটার দিকে জাফলং নামক শান্তনিরিবিলি একটা গ্রামে আমরা পৌছালাম। জাফলংয়ের মেঘ, পাহাড়, অরন্য আর নদী যেনসত্যিই প্রকৃতির এক অপরুপ মিলন মেলা। সেখানকার সৌন্দার্য হৃদয় ছোয়া।পাহাড়ের চুড়ায় যেন মেঘদের মেলা। তামাবিল সীমান্তে উচু পাহাড়ের গায়ে পাহাড়ীঝর্ণার দৃশ্য সাদা বরফের মতো সবুজের বুক চিরে এসব ঝর্ণাপ্রবাহ নৈসর্গিকদৃশ্যকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে। হিমালয় পর্বত থেকে আগত নদীটি সাপের মতএকে বেকে জাফলংয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ ভারতের সীমানা এঁকেদিয়েছে। সীমানার ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। মেঘের দেশ মেঘালয়কে দেখে আমারসোনারানীর আনন্দ আর ধরে না। ময়ুরের মত নেচে নেচে সৌন্দার্য উপভোগ করতেলাগল। জাফলং নদীর রং বেরং এর পাথর দেখে বায়না ধরল পাথর কুড়াবে। সোনালী রঙেরচিক চিক করা পাথর দেখে নীলা কেবলই হাত ধরে আমাকে দেখাতে লাগল। দেখগো কিস্ন্দুর! নদীর তীরে আমরা হাটতে লাগলাম। নদীর তীরে শুধু পাথর আর পাথর দেখেমনে হল জাফলং শুধু পাথরের দেশ। দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়রাম। পাথরেরউপর বসে নদীর পরিস্কার পানি, পাহাড়, ঘন সবুজ বন দেখতে লাগলাম। নৌকা চড়লাম।এই সময় ভাবলাম এই দিনেরস্মৃতিকে ক্যামেরা বন্দী করলে কেমন হয়? এই প্রথমক্যামেরার অভাব অনুভব করলাম। ভাবলাম প্রেম করে পালাতে গেলে একটা ক্যামেরাওথাকা চাই, নইলে রঙ্গীন মধুর স্মৃতিকে ধরে রাকবো- কি করে? দেশ সমাজের আইনেযখন জীবন কয়লা হয়ে যাবে তখন এই ছবিই আনন্দ দেবে। এই সময়কে স্মরণ করিয়েদেবে, যে সময় শুধু আবেগের, আনন্দের। সীমাহীন সৌন্দার্য্যরে জাফলংয়ের পাহাড়নদী, মেঘ, ঝর্ণা, পাখির ডাক আর অরন্যের রুপসুধা একসঙ্গে পান করতে করতেআমাদের সময় চলে গেল। আমার সোনার যে কি আহল্লাদ! বলে, এখান থেকে যাব না। এইপাহাড়ের গুহায় আমরা পালিয়ে বেড়াব, ঝর্ণার পানিতে স্নান করব, সাতার কাটব।আমি বললাম সোনামনিগো, আমাকে নিয়ে কি করবে? সোনারানী প্রথমে আবেগেময়ী হাসিফুটিয়ে বলে, ভালবাসা গো শুধু ভালবাসব। বললাম আর কিছু হবে না? শুধু ভালবাসা -ভালবাসা আর কতদিন চলবে? সোনা বলে অনন্ত কাল—–।
আর বেশী সময় দেরী করতে পারলাম না। এই নৈসগিকি সৌন্দর্য কে বিদায় জানাতেআমাদের জান ফেটে গেল। বিকাল তিনটায় বাজার থেকে কিছু খেয়ে গাড়িতে ওঠলাম।গাড়িতে উঠে আর এক চিন্তা মাথায় ঢুকল। রাতের চিন্তা। দিনটা ভালই কাটে। রাতহলে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হয়। আমার সোনারানীর দাপাদাপি শুরু করে। সেদাপাদাপি আমার সহ্য হয়না। ওর কষ্ট আমার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটায়।
প্রিয় পাঠক, আমার নীলা সোনার রাতের যন্ত্রনা, আর দাপাদাপি বন্ধ করারজন্য আমি একটা নতুন কৌশল নিয়ে ছিলাম। ঘটনাটা হয়ত আপনারা সমর্থন করবেন না।ভাববেন আমি একটা নির্জীব। তবুও অন্তত আমাকে দোষী করার আগে একবার ভেবেদেখুন- আমার জায়গায় আপনারা হলে কি করতেন? আপনারাতো জানেন, আমি আমারসোনারাণীর সরল আবেগের সুযোগ নেইনি। তাকে কলূষিত করিনি। তাকে পবিত্রতার চরমশীর্ষে রাখতে চেয়েছি। তাকে অবৈধ ভাবে আমি দখল করতে চাইনি। তাই সেদিন আমিএকটা ঔষধের দোকান থেকে কিছু ঔষধ কিনলাম। রাতে ঘুমাবার সময় কৌশল করে পানিতেগুলে খাইয়ে দিলাম। আমার সোনা আধা ঘন্টার মধ্যে হাই তুলতে তুলতে ঘুম জড়ানোদুষ্টামির হাসি ঠোটে মেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমি চমৎকার দীর্ঘ ঘুমের সুযোগ পেলাম। পরের দিন খুব দেরী করে নীলার ঘুমভাঙ্গল। মিষ্টি করে হাসল। হাসিতে একটু আদর করলাম। ওর শরীরে ওম ধরানো একটাবিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে দিলাম। বললাম, বেড়াতে যাবেনা? ও প্রায় নেচে উঠল।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর লীলাভুমি মাধবকুন্ড জলপ্রাপাতের উদ্দেশ্য রওনা দিলামআমরা। প্রায় চার ঘন্টা লেগে গেল। পাহাড়, বন আর জলপ্রাপাত। দুধের মত সাদাস্রোতের মত ঝর্ণা ঝরছে অবিরাম। প্রায় দু’শফূট উচু থেকে পাহাড়ের বুক চিরেঅবিশ্রান্ত ধারায় নেমে আসছে সাদা জলবাশি। আমি দেখছি নীলা ছুটো ছুটি করছে।বার বার উচু থেকে পড়া জলরাশী ছুতে যাচ্ছে। আমি বাধা দিচ্ছি। সৌন্দার্যদেখতে দেখতে মুগ্ধ হচ্ছি। শত শত মানুষের মাঝে নীলার চাল চলন বেশী মাত্রায়চঞ্চল। সবাই খেয়াল করছে আমাদের। কেউ কেউ আমার সোনারানীর চঞ্চলতা দেখছে, হাসছে। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সেই মানুষটি আমাদের লক্ষকরছে, গাড়িতে নীলার সাথে যে মানুষটি কথা বলেছিল। আমার শিরদাড়া ঠান্ডা হয়েগেল। আমি নিশ্চিত হলাম সে পুলিশের লোক। মাথায় কদম ছাট চুল। দ্রুত নীলাকেডেকে নিলাম। চা বাগান, পাহাড়, বন, ঝর্ণা মুহুর্তে ফিকে হয়ে গেল। আমিও সতর্কহয়ে গেলাম। নীলাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। নীলাও লোকটাকে চিনতে পারল। একবার ভাবলাম পাহাড়ের মধ্যে হারিয়ে যাই। পারলাম না। মানুষের ভীড়ে লোকটার চোখএড়িয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠলাম।
প্রায় চার ঘন্টা পর সিলেট শহরে পৌছলাম, কিছু খেলাম, সরাসরি হোটেলে উঠলামনা। শহরের প্রান কেন্দ্র হযরত শাহজালাল (র) এর দরগা শরীফে গেলাম। অসংখ্যামানুষ। তার মাঝে নিজেদের আড়াল করে রাখলাম। মাজার শরীফ জিয়ারত করলাম।আল্লাহর কাচে প্রান ভিক্ষা চাইলাম। ভাবলাম মাজারের খাদেমকে ধরে বিয়ে করেফেলি আজই, পারলাম না। সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরলাম। ম্যানেজার কৌতুহলিদৃষ্টিতে আমাদের দেখলেন। মনে মনে ভাবলাম আমরা ধরা পড়ে গেছি। তবুও সাহসহারালাম না।

নীলাকে হোটেলে রেখে আমি বেরিয়ে পড়লাম শহরে। একজন সরকারী কাজীকে খুজতেলাগলাম। পেয়েও গেলাম। সব শুনে কাজী সাহেব যা বললেন তাহল এই রকম—ছেলের বয়সপঁচিশ আর মেয়ের বয়স আঠার না হলে বিয়ে আইন সিদ্ধ হবে না। বিয়ে পড়ালে তারওজেল হবার সম্ভবনা। আমি অবাক হলাম। বার বার বললাম আমরা প্রাপ্ত বয়স্ক। কাজীসাহেব তত মুখ ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন না কোন মতে আইনের বাইরে কিছু করা যাবে না।তোমারও আমার জেল খাটতে হবে। আমার পাঁচশত টাকার চকচকে নোট কাজী সাহেবের মনেকোন লোভ ধরাতে পারলনা। জেল খানার লোহার শিখ তার চোখে ভেসে উঠল। আমি হতাশহয়ে হোটেলে ফিরলাম। ফিরে এসে দেখলাম এর মধ্যে আমার সোনারানী একটা শাড়ী পরেজম কালো সেজেছে। চুলগুলো পিঠের উপর ঢেউ খেলানো। কপালে ছোট করে একটা টিপ, কানে মার্বেল সাইজের লাল- নীল পাথরের দুটো দুল, হাতে চুরি, চোখে কাজল, মুখেজরি ছড়ানো। আমাকে দেখে ভুবন ভোলানো একটা হাসি দিল। মনে হল মাধবকুন্ড দু’শোফুট উচু থেকে ঝরে পড়া ঝর্ণা। আমি বললাম, এমন করে সাজলে কেন? ও বলল জানিনা, যে ভাবে পিছনে পুলিশ ছুটছে যে কোন সময় হয়ত ধরা পড়ে যাব। যদি আর সময় নাপাই। আমি কিছুটা শান্ত হয়ে গেলাম, দাড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ও আবার বলল, কিদাড়িয়ে থাকবে? আমি কিছু বললাম না। আমার একটা হাত ধরে বিছানায় নিয়ে এসে আমারকাধের উপর মাথা রেখে বলল, ওগো আমাকে একটু দেখবে না? দেখনা আমি কেমনসেজেছি। আমি ওর মুখটা উচুকরে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। সত্যিই অপূর্ব। আলোয়ঝলমল করছে ওর রূপ। ও সুন্দরী শ্রেষ্ঠা। ওরমত স্ন্দুরী অতীতে কোনদিন কোননারী ছিলনা, আজও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আমি অবাক দৃষ্টিতে ওকে দেখলাম।আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে কাটল। এক সময় ওবলল, ওগো বিয়েটা সেরে নাও্ আর সময় পাবে না। চার দিকে শত্র“, আমি আরপারছিনা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কাজী সাহেবের কথা বলতে পারলাম না।বললম, কালই একটা ব্যবস্থা করব সোনা। এখন কি একটু ঘুমাবে? ও মাথা নাচিয়েসায় দিল।
বেশ কিছু সময় আদর যতœ করার পর আমার পরীসোনা ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে আমিপালানোর জন্য এক পরিকল্পনা একে ফেললাম। পরিকল্পনাটি ছিল এমন- প্রথমেসাতক্ষীরা যাব। বাবার সাথে একটু দেখা করব।্ কোন দালাল ধরে পড়ার ক্রস করব।কলকাতা হয়ে দিল্লী যাব। সেখানে লোকে সিলিগুড়ি অথবা ঘুম পৌছাব। হাই হিলে সানরাইজ দেখব। আকাশ ভাল থাকলে হয়ত কাঞ্চন জঙ্ঘও দেখা যেতে পারে। ওখান থেকেওয়ায়চুং হয়ে নেপাল সীমান্তে তাপলং পৌছাব। প্রফেসর সাহেব যে যায়গায়র কথাবলেছিলেন ম্যাপদেখে এই রকমই একটা পথের কথা ভেবে নিলাম। তবে দালালের কথাটাআবরও ভাবলাম। ওরা যদি বিশ্বস্ত না হয়? আমি যদি ওদের খপ্পরে পড়ি? ওরাতোপাচারও করে দিতে পারে? তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। বিকল্প আর একটা পথেরসন্ধান পেলাম, সেটা হল এমন জাফলং সীমান্ত অতিক্রম করে মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশকরে বার্মায় যেতে হবে। সেখানে কিছু দিন বৌদ্ধ মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াতেহবে। কিছুদিন থাকার পর চীনে ঢুকলে কোন সমস্যা হবে না। পাহাড় পর্বতে গহীনজঙ্গলে গুহার যে কোন একটা নিরাপদ আশ্রয় আমরা খুজে নেব। যেখানে বাংলাদেশেরপুলিশ আর খুজতে যাবে না। দুটো পরিকল্পনাই আমার পছন্দ হল। কোনটা বেচে নেব, নীলা জেগে উঠলে দুজনে আলোচনা করে ঠিক করব। পরিকল্পনা গুলো বড় বাড়া বাড়িরকমের হয়ে গেল। মনে হল প্রেমের ক্ষেত্রে এমন বাড়া বাড়িই উপযুক্ত। যদিএতটুকু সাহস না থাকে, এতটুকু ঝুকি নিতে না পারি তাহলে পরীমেয়েদের সাথেপ্রেম করি কেন? অসম্ভব রূপবতী সব মেয়েদের রূপের ঝাজে পুড়ে গলে গলে খাক হবআর অনন্ত সুখের জন্য এতটুকু করতে পারব না? দেশের পুলিশ আমাদের ধরবে, হাজাতেদেবে, কিন্তু ঐ ভারত, বার্মা, চীন, ওরা? না ওরা আমাদের কিছুই বলবে না।ওরাতো আমাদের দেশের মা-বাবার মত কসাই না। ওরা আমাদের যদি ধরেও ফেলে সব শুনেঅন্তত গহীন পাহাড়ের কোন একটা গুহায় আমাদের জায়গা করে দেবে। হয়ত অনাবাদীকোন নির্জন জায়গায় আমার আর আমার সোনার জীবন গড়তে দেবে। আমরা সেখানে ঘরবাধব, সংসার করব, আর আমার সোনারানীর পেট থেকে অসংখ্য ছোট পরী জন্ম নেব্।েসমস্ত পাহাড়, ঝর্ণা, সব ছোট ছোট পরীতে ভরে যাবে- হ্যাঁ –হ্যাঁ–হ্যাঁ। আমারপরী সোনা তখনও গভীর ঘুমের দেশে। আমি জেগে ঘুম আনতে চেষ্টা করলাম। এলোমেলোভাবে কিছু সময় পায়চারি করলাম। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম, বাথরুমে গেলাম, চোখে পানির ঝাপটা দিলাম, তবুও ঘুম আসল না। শেষে একটা কাগজ কলম নিলাম, ভাবলাম, বাবাকে একটা চিঠি লিখি, চাচীকে একটা লিখলে কেমন হয়? আবার ভাবলাম কিহবে বাবা- চাচীকে লিখে? কাগজ কলম হাতে ধরা, ভাবলাম কিছু একটা কি লিখব? কিলিখব? সোনাকে নিয়ে কবিতা ,গল্প, উপন্যাস কিছু একটা শুরু কি করব? আমি শুরুকরি, আর অন্য জীবনের কোন এক মানুষ এসে তার ইতি টানুক। শেষে ভাবলাম- না কোনচিঠি, গল্প নয়। কিন্তু কি লিখি? হঠাৎ কাজী সাহেবের কথাটা মনে পড়ল সোনারানীবয়স হতে হবে আঠারো আমার পচিশ। মনে মনে হাসলাম। এ দিকে যৌবন টস টস করছে আরশালার আইন বলে বিয়ের বয়স হয়নি। হারামী কাজী, মনে হয় মান্দু টাইপের কোনমানুষ এই আইন তৈরী করেছে। তা না হলে কি করে এই ছয় বছর আমার সোনাকে দেরীকরতে বলে? ওর দাপা দাপি, কি ওরা দেখে? দেখতে হয় আমাকে। তাইতো সান্তনা দিই।ধমক দিই। সৎচরিত্রের কথা শোনাই। আদর্শ বোধ জাগিয়ে তুলি। সব শেষে ঘুমের ঔষধখাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। বিষয়টা নিয়ে আমার মধ্যে একটা ভাবনা চলে এল। ভাবনাটাএমন-
বাংলাদেশে একটা মেয়ে নয় থেকে বার বছরের মধ্যে যৌবনবর্তী হয়। সন্তানধারনে সক্ষম হয়ে ওঠে। আবার চৌদ্দ পনের বছরের একটা ছেলে সন্তান জন্ম দানেসক্ষম। তাহলে কেন আঠার আর পঁচিশ বছর বিয়ের বয়স সিদ্ধ হবে? আমি এই আইনেরতীব্র বিরোধীতা করছি এবং প্রতিবাদ করছি।

এই আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে শারীরিকসমস্যা দেখা দেবে। আবার জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। আমি এই দুটো ধারনার সাথে একমতনই। যৌবন প্রাপ্তির সাথে সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে শরীর সুস্থ্য থাকে।মনে প্রফুল্লতা আসে, কাজে উদ্যম আসে। আর যৌবন জোর করে চেপে রাখার সমস্যাঅনেক বেশী। অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে একমাত্রচিকিৎসা বিয়ে। আর জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ধারনা তো পুরোপুরি অমূলক। কারণ বিয়েহবার পরও জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করা যায়। সেক্ষেত্রে আইনটা একটু উল্টোতুলে ধরতে হবে। আইন করতে হবে অবশ্যই আঠার বছরের আগে কোন সন্তান নেওয়া যাবেনা। তার জন্য মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়োগ করতে হবে। তাহলেএকদিকে মানসিক প্রফুল্লতা থাকবে, অন্য দিকচরিত্র বজায় থাকবে, জনসংখাওনিয়ন্ত্রনে থাকবে। আর এই যে আইন এটা সরাসরি মানুষকে অবৈধ মিলনে উদ্ধুব্ধকরছে। মাঝের থেকে লাভবান হচ্ছে ঔষধ কোম্পানী, এরা জন্মনিয়ন্ত্রনের উপকরণ আরঔষধ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। হিসাব করলে দেখা যাবে বিবাহিতদম্পতির চেয়ে অবিবাহিত মানুষরাই বেশী বেশী এই সব ঔষধ ক্রয় করে। আইন করে কিযৌবন চেপে রাখা যায়? যৌবনের কি কেলো আইনরে বাবা————–
আর পারলাম না ভাবতে। আমিতো কোন নামকরা বুদ্ধিজীবি নই। নই কোন নামকরাআইনবিদও।আমি হলাম হালকা টাইপের কবি, আর প্রেমিক। আমি কি করে আইনের ঔসবফাক ফোকর বুঝাব?
এই সময় একটা কান্ড ঘটল। হঠাৎ শুনলাম নীলা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। ওরদিকেতাকালাম। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে নিশ্চই। আমি ওর কাছে গেলাম। গায়ে ধাক্কাদিলাম। এই এই নীলা কাদছ কেন? কোন জবাব দিল না। আরও জোরে কাঁদছে। আমি জোরকরে ওকে ডাকলাম। অনেক ধাক্কা দেয়ার পর চোখ বড় করে তাকাল আমার দিকে। ওরমাথাটা কোলে তুলে নিলাম। কোলে মাথা রেখে ছাদের দিকে তাকাল, চোখের দুই ধারদিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ভাবলাম মোহ কেটে যাচ্ছে না তো? ওকি নিজের কাজের জন্যঅপরাধ বোধ করছে? হয়ত নিজের মধ্যে ভয় লজ্জা, অনুশোচনা কাজ করছে, কিন্তু বলতেপারছেনা। সামনে সাম্ভব্য বিপদে ভয় পাচ্ছে। ভাবলাম এই সরল আবেগ কেটে গেলেআমাকেই দোষ দেবে। পৃথিবীর কোন যুক্তি আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। ওর জবানবন্দীই হবে সত্য। আমি যা বলব সব হবে মিথ্যে। একটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ল, মেয়েলোক যা বলে তাই সত্য আর পুলিশ যা বলে তাই আইন, আমি একটু শক্ত হলাম। দেশছেড়ে যাওয়ার আগে শেষ যাচাই করতে হবে।
আমি ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। মুখটা শুকনা হয়ে গেছ্ েআমার সোনার। আস্তেকরে বললাম, নীলা মায়ের কথা মনে পড়ছে? ওবলল না। বললাম তবে কাঁদছ যে? ওবললচাচাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছে। আমি বললাম নীলা একটা কথা বলব? ও বলল বল!বললাম নীলা চল বাড়ি ফিরে যাই। কেউ কিছু জানবে না। ভাববে বেড়াতে গিয়েছিলাম।নীলা বলল না সোনাগো তা আর হয় না। তোমাকে ছাড়া আমি একটা দিনও বাচতে চাইনা।আমিও বহু দেখেছি, বুঝলাম তোমাকে ছাড়া আমার জীবন নিরর্থক। আমার সমস্ত দিন, রাত আমার চঞ্চলতা সবই তোমার জন্য। তুমি আমাকে ফেলে দিও না সোনা।
বললাম তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ছেড়ে যা্িচছ! ও বলল স্বপ্নে দেখলাম যে- আরবলতে পারলনা। ঝর ঝর করে কেদে ফেলল, আমি ওর কান্না থামানোর চেষ্টা কররাম, বুকের মধ্যে ওর মাথা তুলে নিলাম। আদর করলাম, ভালবাসলাম। আমরা ভালবাসার গরমেওর কান্না কমে এল। চুম্বকের মত আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর শরীরের উঞ্চতা স্পর্সআমাকে জালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিল।
আস্তে আস্তে ওর শরীরে ঝড় কমে এল, বাহুমুক্ত হলাম আমরা। আমি উঠে গেলাম ঝুলন্ত বারান্দায় ও আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সাজাল।
পরে ও বলল, স্বপ্নে দেখছে আমি নাকি জোর করে ওকে ওর বাবার কাছে তুলে দিযে চলে যাচ্ছি। মানে হয়এরকম একটা স্ব্েপ্নর?
পর দিন আর সিলেট থাকা নিরাপদ মনে কররাম না। রাতে যে প্লান করে ছিলাম।তার জন্য আমার সোনা আমাকে চমৎকার সব বিশেষণ দিল নামের সাথে। ও জাফলং হয়েভারত যাওয়ার পরিকল্পনাটা পছন্দ করল। আমরা সেই মত খুব ভোরে ব্যাগ-ট্যাগগুছিয়ে বেরিয়ে জাফলং পৌছলাম। খুব সস্তা ধরনের কিছু খাবার খেলাম। জাফলং নতুনকরে ভাল লাগতে লাগল। ওর হৃদয় নেচে উঠল। ঐ তো নদী, ওর পর পাহাড় আর বন, ওটাপেরুতে পারলেই বিপদ মুক্ত। দ্রুত একটা নৌকা ঠিক করলাম। আরো কজন আমাদের সাথেউঠতে চাইলো , কিন্তু নিলাম না। হঠাৎ একজন চওড়া কাদ, কদম ছাট টাইপ চুলওয়ালাএকজন বলে উঠলেন প্লিজ আমাকে একটু নিন না। সেই লোকটি। নিশ্চিত হলাম শালাব্যাটা পুলিশ। মুচকি হাসল, বলল দেখ সোজা নৌকা থেকে নেমে এস, কোন ঝামেলাকরতে ০চাইলে গুলি করে এই নীল পানি লালকরে দেব। মুখে মুচকি হাসি, কিন্তুকথা গুলো বেশ কটমট করে বললেন। তিনি আবার বললেন, শোন নীলা আর সঞ্জুতোমাদেরএক্ষুনি ঢাকায় ফিরতে হবে। যদি সহজে না যেতে চাও তাহলে- বলে- তিনি পকেটথেকে একটা পিস্তল বের করলেন। দেখিয়ে বললেন এর সব কটা গুলিই বেরিয়ে যাবেনির্দয় ভাবে। আমি কথা বাড়ানোর কোন প্রয়জন বোধ করলাম না। নীলা ভয়ে পাংসু হয়েগেল। আমাকে জড়িয়ে ধরল্ বলল ওগো বরং চল গুলি খেয়ে মরি। তবুও ঢাকায় বাবারকাছে ফিরে যাব না। লোকটা কড়া একটা ধমক দিলেন- চুপ বেয়াদপ মেয়ে। এতটুকু মেয়্েএত সাহস, নেমে এস!
আমরা নৌকা থেকে নামলাম- পিছনে নীল পানি আর সাদা পাথর বয়ে যেতে লাগল।কিছু কৌতুহলী মানুষ আমাদের দেখতে লাগল। মনে হল ওরা খুব মজা পাচ্ছে। কেউবাহয়ত মজা দেখার নাম করে আমার নীলা সোনার রূপও চুষতে লাগল। নীলা হঠাৎ শক্তহয়ে গেল। খুব করুন অথচ শক্ত ভাবে বলল শুনুন একটা কথা বলব? লোকটা মাথা নাড়ল, বললেন বল!
নীলা বলল, দেখুন আমার কাছে নগদ চৌদ্দ লক্ষ টাকা আছে, এই চার দিনে কিছুখরচ হয়ে গেছে, বেশ কয়েক ভরি সোনার গহনা আছে। জামা কাপড় আছে বেশ দামি দামি, আমি এই গুলো আপনাকে দিচ্ছি। নগদ টাকার সব গুলো আপনার। শাড়ি আর গহনা গুলোআপনার। মেয়ের বিয়ের জন্য উপহার দিচ্ছি, বিনিময়ে শুধু আমাদের ছেড়ে দিন। ঢাকাথেকে আমাদের পিছু নিয়েছেন্ ধরতে পারেননি, গাড়ির মধ্যে ইচ্ছা করলে ধরতেপারতেন ধরেন নি। এটা আপনার দয়া। লোকটা বললেন গাড়ীর মধ্যে ধরার হুকুম আমারছিলনা। কোথায় যাও সেটা দেখাই আমার দায়িত্ব ছিল। পরশু দিন যখন এখানে তোমরাএসেছ, ভাবলাম পাগলামির শেষ সীমান্তে চলে যাচ্ছ তোমরা। সব জানতেই তোমাদেরধরার হুকুম পেয়েছি। এমন কি গুলি করারও হুকুম আছে। নীলা আবার বেশ আবেগ ঘনকন্ঠে বলল দেখুন এই দুই পা এগুলেই নৌকা। ঐ বয়ে যাওয়া নীল পানির স্রোত।স্রোতে নৌকা খানা ভাসালে মাত্র পনের মিনিট লাগবে ও পারে পৌছাতে। ওপারেভারত। ঐ যে বুনো পদ ম্পর্শ বিহিন পথ পাহাড়ে উঠে গেছে ঐ পথে আমরা চলে যাব।পাহাড়েরে গুহায়, বনে, জঙ্গলে, পশু- পাখির সাথে আমরা ঘর বাধব। আপনি শুধুআমাদের যেতে দিন। এই মাত্র পনের মিনিটে আপনি মাঝারি সাইজের ধনী হয়ে যাবেন।সারা জীবন চাকরী করেও এতটাকা চোখে দেখতে পাবেন না। আর আপনার মেয়ের জন্য যেগহনা আর শাড়ী কাপড় দিলাম, তাতে ও খুশিতে আটখানা হয়ে যাবে। এর বিনিময় আমাদেরযেতে দিন। ঐ তো পাহাড় জঙ্গল, ওখানে কোন মানুষ নেই আছে পশু পাখি-জীবজন্তু।ওদের সাথে আমরা বেশ থাকতে পারব। তবুও-… নীলা সোনা কাঁদতে লাগল।
আমি দু’হাতে ওর চোখ থেকে হাত সরাতে চেষ্টা করলাম। পরলাম না। লোকটা আবারবললেন, পুলিশে চাকরী করি। এসব মায়া কান্না দেখলে চাকরী চলে যাব্।েদ্রুত চল, তোমাদের জন্য বিশেষ গাড়ী অপেক্ষা করছে। এবার নীলা অন্য বেশ ধরল। দুর্দান্তমায়াবি চাউনিতে লোকটাকে কাবু করার চেষ্টা করল। কিছু পরে বীরঙ্গনার মত বলেউঠল- শুনুন- আমার শরীরে যে পোশাক আছে এর দাম তিনহাজার দুইশত টাকা। এতেপ্রায় দুই আনা ওজনের পাত সোনার পাত আছে। আমার হাতের হীরার আংটি- এর দামপনের হাজার টাকা। গলায় চেনটার দাম দশহাজার এগুলোও খুলে নিন। একে বারে খালিহয়ে নগ্ন হয়ে আমি বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেব। ফিরেও আসব না কোন দিন। এই নগ্নঅবস্থায় খালি শরীরে ওপারে চলে যাব। ওই পাহাড়ে তো কোন মানুষ নেই্। ওখানেআমরা শরীর দেখারও কেউ নেই। এই নগ্ন অবস্থা আমরা দু’জন পাহাড়ের গুহায় আদিমমানুষ হয়ে ঘর বাধব। পশু পাখিদের নিয়ে সহ অবস্থান করব। তবুও আমাদের ছেড়েদিন। বলেই নীলা ওর হাতের হীরার আংটি, গলার চেইন, খুলে লোকটার পায়ের নিকটফেলে দিল। জামা খুলতে শুরু করল। আমি বাধা দিলাম।

ছি নীলা এত পাগলামি কর না। ও অঝোরে কাঁদতে লাগল। বার বার বলতে লাগল-স্যার আমাদের ছেড়ে দিন। আমি ওকে শান্তনা দিতে পারলাম না। এক বার ভাবলামব্যাটাকে খুন করে ফেলি, ঐ তো নদী। পেরিয়ে যেতে পারব। পরক্ষনেই ভাবলাম হয়তচার দিকে পুলিশ আমাদের ঘিরে ধরেছে। পালানো সম্ভব নয়। আমার মরতেও কোন আপত্তিছিল না। কিন্তু আমার সোনা? অকালে ওকে হারাতে চাইনি।


আট-৯
ঢাকায় নিয়ে আমার চাচা আমাকে আচ্চা মারদিলেন। কেটে টুকরো টুকরো করেকুকুর দিয়ে খাওয়াতে চাইলেন। নীলাকে গুলি করবে পরিকল্পনা করলেন। চাচীরকান্নাতে সে গুলো করতে পারলেন না। আমাকে কুকুরের মত বের করে ছিলেন। নীলারকান্নায়, সমন্ত বাড়ি কাপতে লাগল থর থর করে। কোন কান্নায় আমার কসাই চাচার মনগলল না।
নীলার ঐ সানসিক অবস্থার মধ্যে বিয়ের আয়োজন করল এক সপ্তাহের মধ্যে। নীলারবিয়ের জন্য আমার চাচা ঢাকার সমস্ত মানুষদের খাওয়ানোর যে পরিকল্পেনাকরেছিলেন তা বাতিল করে দিলেন। তবে বিদেশ থেকে বিয়ের সাওদাপাতি করলেন। ছেলেভারতের কাশ্মীরে থাকে, ব্যবসায়ী। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসা করে। ওর বিয়েহল। আইন আমার সোনার বিয়ে ঠেকাতে পারলনা। বয়স বার কিন্তু কোন কাজী বলেননি যেবিয়ে পড়াতে পারবনা। সব ঠিক ঠাক মত হয়ে গেল। আমার নীলা সোনা আমাকে ছেড়ে চলেগেল। অনেক অনেক অনেক দূর। আমি জানি ও কোনদিনও আর ফিরে আসতে পারবেনা। আসবেওনা কোন দিন। শুধু হৃদয়ের বোবা কান্নায় ওর দু’চোখে পানি ভরে যাবে।কাশ্মিরের আনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যকে ওর কাছে ফিকে মনে হবে। ও চলে গেলকাশ্মীর। আমি হোস্টেলে ফিরে আসলাম। কিছু দিন পর চিঠি পেলাম- ওগো রাজা সোনা, তুমি বিশ্বাস কর, আমি এখনও তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া বাচব না। বিশ্বাসকরো আমি এখনও ঐ পশু লোকটাকে আমার শরীর ছুতে দিইন্ িযেদিন ওই পশু আমারশরীরের গভীরে প্রবেশ করবে সেই দিনই আমার মৃত্যু হবে। সোনাগো আমি তোমাকেপাগলের মত ভালবাসি, এই জীবনেই তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে। ভাল থাক রাজা – নীলা।
এই জাতীয় পত্র পেতাম হোস্টেলের ঠিকানায়। আমার সামনে এই কলেজ, পুকুর, মাঠ, গাছ-পালা, আকাশ, রাতের জ্যোৎস্না সবই মিথ্যে-ছলনা। বাবার সাথে অনেকদিনআর দেখা হলনা। কোন মুখে বাবার সামনে দাড়াব? আমার অধঃপতনে বাবা খুব কষ্টেএকদিন স্ট্রোক হয়ে মারা গেলন। আমি হয়ে পড়লাম একা। সান্তনা দেবার মত কেউ রইলনা। বাবার প্রচন্ড ভালবাসার স্মৃতি আমার এখনও মনে পড়ে। চাচা-চাচী বাবারমৃত্যুর পর আসলেন। খুব কান্নাকাটি করলেন। চাচী আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদলেন।গোপনে আমাকে খরচাপাতি দিতে চাইলেন। আজ খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই চরম দুঃখেআমার সোনা আমাকে কি মনে করেছিল? ওকি ঐ মাঝ বয়সি ভদ্রলোক ব্যবসায়ী মানুষটিকেকবুল করেছিল?
দিন যায় রাত আসে, আকাশে জ্যোৎস্না আর তারায় রাত ঝিকিমিকি করে, পাখির ঝাকমাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। চারদিক আলোয় ভরে যায়। এভাবে চলতে চলতে একদিনহিসাব করলাম, বেশ মাস খানিক আমার নীলা, আমার আতœা, ভালবাসা, আমার নিশ্বাস, প্রেরনা আমাকে চিঠি লেখেনি। ভাবলাম এটাই স্বাভাবিক। অতীত অতীতই। কেন তাকেঘাটাই বার বার। অবশেষে একখানা চিঠি পেলাম। আজও মনে হয় এই চিঠি না পাওয়াইভাল ছিল। চিঠি খানা যে ভাবে মনে আছে তুলে দিচ্ছি- ওগো রাজাসোনা, আমার সময়শেষহয়ে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে শেষ দেখব, পারলাম না। আমাকে ভালবেসেতুমি শুধু অপমানিত হলে। কিছুই তোমাকে দিতে পারলাম না। ভেবেছ আমি স্বামী(?) কে নিয়ে ভাল আছি? ওগো আমার- স্বামীগো আমার ভালবাসা, আমার জীবন, মরন, সবইতোতুমি। এই কথা ঐ পশুকে বলেছি বলে আমাকে ভীষণ সাস্তি দেয়। জানি তুমি আমাকেউদ্ধার করতে পারবেনা। আমাকে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জাপান নিয়ে যাবে। ওখানেআমাকে চিকিৎসা করাবে। আমি জানি, গোপনে ডাক্তারকে দিয়ে আমাকে হত্যা করবে। ওরডায়েরী পড়ে তাই জেনেছি। আমি বাধা দেব না। একটা কথা তোমাকে বলি, সোনা আমাকেতুমি ক্ষমা করোনা। আমার শরীরকে আমি আজও পবিত্র রেখেছে। তোমার নীলা আজওপবিত্র! এখনও আমি আমার শরীরকে স্পর্শ করতে দিইনি- নীলা, লালারক, কাশ্মীর।
চিঠি পড়ার পর আমি বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গেলাম। ভিটেমাটি জমি জমা বিক্রি করেজাপান যাবার জোগাড় করতে লাগলাম। আমার অস্বাভাবিক আচারণ কারও চোখ এড়াল না।হেস্টেল সুপার একদিন বললেন মদটদ খাওনাকি? কোন উত্তর দিলাম না। একদিন বুঝতেপারলাম জাপান যাওয়া হবে না। আমার সোনাকে উদ্ধার করতে পারব না। ও তীলে তীলেমরবে।
জমি বিক্রি করে যে টাকা পেলাম, তাই দিয়ে হোটেলের এক বৎসরের চার্জ মিটিয়েদিলাম। বন্ধুদের খাওয়াতে লাগলাম। হোটেলে লাইব্রেরী ছিলনা। ত্রিশ হাজারটাকার বই কিনে লাইব্রেরী করে দিলাম। নাম দিলাম ‘নীলা গ্রন্থাগার’। দশ হাজারটাকা দিয়ে একটা রিভলবয় কিনলাম। কিছু কার্তুজ ।
সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়তাম ফাকা একটা মাঠে। ফ্রি হ্যান্ডে গুলি ছুড়তেপ্রাকটিস করতাম। ভাল ওস্তাদও পেয়ে গেলাম। ৫০ ফুটের মাথায় নিশানা অব্যার্থহয় এমন প্রকটিস করলাম। মোটা অংকের পুরস্কার দিলাম গুরুকে।
‘নীলা গ্রন্থাগার’ উদ্দোধনের সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমাকে খুব প্রসংসাকরলেন। নীলা কে? জানতে চাইলেন। যত বার তারা প্রশ্ন করলেন, তত বার আমার চোখপানিতে ভরে গেল। বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মুসলাম। প্রকাশ্যে অনেকগুলোমানুষের সামনে এমন ভ্যদভেদে কান্না বড়ই বিরক্তিকর। তবুও আমাকে কাঁদতেহয়েছে। চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারিনি। শিক্ষক, ছাত্র, কলেজ এলাকার সুধীমহলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ল। ওদের প্রশাংসায় আমার সুখ লাগার কথা ছিল। কিন্তুহায়! কোথায় আমার সুখ? সেতো সবই হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।
সেদিন রাতে হালকা টাইপের সবজিযুক্ত খাবার খেলাম। ছাদে উঠলাম রাতএগারটায়। চার দিক শুনসন নীরবতা। আকাশ ভরা তারা। গাঢ় অন্ধকার। দূরে একটাদুটো জোনক আলো ছড়িয়ে পরিবেশকে ভৌতিক করে তুলেছে। কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতেপারলাম না। বার বার নীলা আমার রাজ্যে ভিড় করতে লাগল। মনে হল ও তো আমারপাশে। ঐ তো চুড়ির টুন টুন শব্দে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। মনে হল চিৎকার করেবলি নীলা-নীলা-নীলা-নীলা-সোনা আমার নীলা ————–।

সেদিন নীলা বিরহে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। রাত প্রায় দুটোর দিকে রুমে ফিরে একটা কবিতা লিখলাম- কবিতাটা হল।
নীলা- আমার সোনা, আমার রাণী-
হারিয়ে গেছ তুমি গহীন অন্ধকারে।
সেদিন এসেছিলে ঝড় তুলতে আমার হৃদয়ে,
এই ভবে——-।
আজ কেন লুকালে আধারে?
দেখ কি বিষন্ন আমি।
কি হতাশ আমি-
কত বিবর্ণ এই রজনী।
আকাশ ভরা তারা-
তবুও অন্ধকারে ভরা
এই ধরণী–।
নেই তো কোথাও আলো–
কে জ্বালাবে বাতি-
কে দুর করিবে অন্ধকার রাতি।
এসেছিলে তুমি আমার-
-সাথে বাধবে বলে ঘর।
সেই আমি-পাজি-আইনের মানুষের বলে
হয়ে গেলাম পর।
ওগো- আমার রনী
কোথায় তুমি–
কেমন করে কাটাও তুমি
এ কঠিন দিবস-রজনী॥
কবিতাটি তিন দিন পর এক বন্ধুর চাপে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। দুদিনপর প্রকাশ পেল। খুব প্রশংসা পেলাম। কয়েকজন সমালোচনা করে বলল, বিরহ কাতরপ্রেমিক কবি।
নীলাকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করতাম, মাঝে মাঝে রিভলবরের নলটা নিজের কপালেটেকিয়ে বসে থাকতাম। যদি অন্যমনস্কভাবে আঙ্গুলটা ট্রিগারে চাপ দিত? তাহলেনীলার জ্বালা রক্তের সাথে ভেসে যেত। আমাকে আর জ্বলতে হত না। পুড়তে হত না।মনে মনে নীলার স্বামী, ওর বাবাকে গালাগালি দিতাম। একবার ভাবলাম ওর বাবাকেআগে খতম করে দেই। ও একটা আদর্শহীন মানুষ। ওদের পাপাচারিতে দেশ ধ্বংস হয়েযাচ্ছে। ওদের রেখে কি লাভ এদেশে? ওরাতো প্রেমের শত্র“, আবার দেশেরও শত্র“।ওদের অপরাধের বিচারতো কেউ করেনি, কেউ কোনদিন করবেও না। আমি নিজেই না হয়নিজের আদালতে বিচার করে ওকে মৃত্যুদন্ড দিলাম- ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে মৃত্যু, প্রকাশ্যে নয়- গোপনে, কোথায় পাব জল্লাদ? আমি —আমি— ওরে –আমি, আমিঅভিযোগকারী আমি আদালত, আমি বিচারক, আমিই জল্লাদ, স্পটটা কোথায় হবে?
মনে মনে ভাবতে লাগলাম———
কি ভাবে ওর বাবাকে খুন করলে ধরা পড়ার সম্ভবনা কম, তা নিয়ে গবেষনা করতেলাগলাম। গুপ্ত হত্যাসংক্রান্ত কিছু বইপত্র পড়লাম। বেশ কিছু পদ্দতি বার বারকল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু বই পড়া পদ্ধতির উপর বিশ্বাস করতে পারলাম না।ভাবলাম, এগুলো সবই কল্পনা- ফাকাবুলী, টাকা কামাই করবার জন্য লেখক এই সবআজগুভী পদ্ধতির কথা লিখেছে- এগুলো ফুল প্র“প না। এই পদ্ধতি অনুসারে কাজকরতে গেলেই হাতে নাতে ধরা পড়তে হবে। ঠিক করলাম বাস্তব খুনীদের কাছে পরামর্শনিতে হবে। উপযুক্ত বকশিস পেলে ওরা হড় হড় করে বলে দেবে। খুনের দায়িত্বটাওওরা নিতে চাইবে। কিন্তু আমি ওদের দিয়ে কাজটা করাব না। আমি নিজে কাজটা করতেচাই। নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে কি হয়? না তাতে তৃপ্তি পাওয়া যায়? আমার দরকারআতœতৃপ্তি, চরম তৃপ্তি। আমার সামনে মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করবে, আমি হাসব, যেমন আমার নীলা সোনা কেঁদে ঘর ফাটিয়েছে, সে শুনেনি। সেও ওই রকম চিৎকারদেবে। মৃত্যুর চিৎকার। কাশ্মীর কিংবা জাপান থেকে আমার সোনা শুনতে পাবে। আমিদাঁতে দাত চেপে হাসব- তৃপ্তির হাসি—-হ্যাঁ—হ্যাঁ—হ্যাঁ।
বেশ কিছু টাকা খরচ করে একদিন দু’জন পেশাদার খুনীর সাথে দেখা করলাম। ওদেরচেহারা দেখে বুঝা গেলনা যে এরা এতবড় কিলার। খুনটাকে এরা একেবারে আর্টেরপর্যায়ে নিয়ে এসেছে। মাসে দু’একটা ওডার পেয়ে থাকে। পেমেন্টেরক্ল্যাসিফিকেশন আছে। দামী মানুষ বিগ পেমেন্ট, সাধারণ মানুষ লাইট পেমেন্ট।তবে কোন বাকীতে এরা কাজ করে না। সবই এডভ্যান্স করতে হয়। এডভ্যান্স করে কাজনা হলে টাকা ফিরিয়ে দেয়। মেরে দেয় না। আমাকে পেয়ে ওরা খুশী হল। 

আমাকে একটাক্লাইয়েন্ট ভেবে বসল। খাতির যতœ করল চা- কপি খাইয়ে। আমি খেলাম, সবশেষে আমিআমার কথা বললাম—॥ ওরা হতভম্ব হয়ে গেল, কপালের চামড়া ভাজ হয়ে গেল। বলল এইপথে কেন ভাইজান? এ কাজে নেমনা ভাই। আর বেরুতে পারবেনা। আমরা কি পেরেছি? বেশদীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলেবলল জান ভাই- আমাদের এই চেহারাটাই যা সুন্দর। আরকিছুই সুন্দর নেই, সব মরে গেছে। এক সময় সবই ছিল। তোমার মত বয়সে দলদারীকরতাম। নেতারা আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন ভাবতাম, রাজনীতিই আসলআদর্শ। লেখাপড়া কি করব। আগে দেশ বাচাই। আমাদের কথা শুনে নেতারা খুশি হত।একটু একটু করে আমাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিতে লাগল। টুক টাক বাধা আাসলেনেতাদের টেলিফোন বেজে উঠত। সমস্যা মিটে যেত। একদিন নেতাদের প্রয়োরচানায়কলেজের অফিসরুমে আগুন ধরিয়ে দিলাম। বেধড়ক পিটাতে লাগলাম ছাত্রদের।শিক্ষকদের তিনজন আগুনে পুড়ে মারা গেল। আইন আমাদের কিছু করতে পারলনা। তবেনেতারা এই আগুন লাগনোর ঘটনাকে পুজি করল। যখন তখন বীর বাহাদুর খুনী বলেডাকত। নেতা হবার পরিবর্তে একদিন খুনীই হয়ে গেলাম। আর বলতে পারল না। ঝর ঝরকরে কেঁদে ফেলল। তার পর বলল, জান ভাই- টাকা নিয়ে মানুষ মারি সেটা ঠিক। তবেকেউ যদি স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদদের, যারা ছাত্রদের তাদের সার্থে ব্যবাহারকরে শিক্ষাঙ্গন রক্তাক্ত করছে তাদের টার্গেট করে আসে তবে রেট কনসিশন করব।এমনকি সেভেনটি ফাইভ পারসেন্ট রেট কন্সিশেন করব। একেবারে ফ্রি করলে তৃপ্তিপেতাম- কিন্তু ফ্রি করলে তো আর ব্যবসা চলে না, খাব কি? সংসার চালাব কিদিয়ে। বাজার দর যে ভাবে বেড়ে চলেছে সব মিলিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। আমি বেশ কিছুসময় লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, লোকটা দাত বের করে হাসতে লাগল। কান্নার ভাবকেটে গেছে। বলল- ভাই, নিজেতো খুন করতে পারবেনা। হয়ত ট্রিগার চাপ দিবারআগেই প্যান্ট ভরে পেশাপ করে কাপড় চোপড় নাপাক করে ফেলবে। হেসে উঠল লোকটা।তার পর বলল হাসতে হাসতে, মধ্যখান থেকে তুমি জেলে ঢুকবে। লোকটা বেচে যাবে, আর আমাদের কিছু টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে। বোঝতো ভাই- যাদের যা পেশা তাদের তাইকরতে হয়। এখন যদি সবাই দাড়ি সেভ করার মত সব কাজ নিজেরা করে তাহলে ডড়ৎশপষধংংরভরপধঃরড়হবলে কিছু থাকে না। ওদের কোন পরামর্শ আমার কানে ঢুকলনা।বললাম, আমি প্রফেশনাল করষষবৎ হতে চাইনা। মাত্র দুটো খুন করতে চাই, একটাদেশে আর একটা কাশ্মীর কিংবা জাপান। আমি বললাম, একটা পদ্ধতি বলার জন্যএকহাজার টাকা ফিস দেব। কয়েকটা পদ্ধতি শুনব, এরপর যে পদ্ধতি আমার পছন্দ হবেতার জন্য আতিরিক্ত পাচহাজার টাকা পুরস্কার দেব। ইচ্ছা করলে আমাকে বিশ, পঞ্চাশ, একশ পদ্ধতি বলতে পারেন। প্রতিটির জন্য এক হাজার করে দেব। কাজ করেযা পেতেন তার চেয়ে অনেক বেশী রোজগার হবে। তবুও আমার কাজ অন্য কাউকে দিয়েকরাব না।
নয়-১০
যে পদ্ধতিটা আমার পছন্দ হল সেটা বেশ শক্ত মনে হল। ওদের আড্ডা থেকেবেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকলাম। চোখে মুখে পানি দিতে রেস্টুরেন্টের পিছনেট্যাপে গেলাম। সামনে লূকিং গ্লাস, নিজেকে দেখলাম। না, কোন খুন খুন ভাব জেগেওঠেনি। বেশ শান্ত-শান্ত পাগল বিরহকাতর ব্যর্থ প্রেমিকদের মতই মুখেরচেহারা। এই চেহারা বজায় রাখলে একশটা খুন করলেও ধরতে পারবেনা। আচ্ছা করেচোখে পানি ছিটালাম। একটা আনন্দ উত্তেজনা শুরু হল। খালি একটা চেয়ারে গাএলিয়ে বসলাম, বেয়ারার ডাকে চমকে উঠলাম। ওকে কড়া করে এককাপ কপি আর দুটাসোমাচা আনতে বললাম। এই ফাকে পাশে রাখা খবরের কাগজটা টেনে নিলাম। সমস্ত পাতাজুড়ে আলফাল খবরে ছাপা। ধর্ষন, ছিনতাই, প্রতারনার খবর দিয়ে কাগজ ভরে ফেলছে।আহা যদি এমন খবর থাকত বিবাহ আইন শিথিল করা হয়েছে- এখন থেকে দশবছরের মেয়েপনের বছরের ছেলের মধ্যে বিয়ে আইন সিদ্ধ, তবে শর্ত থাকে যে, মেয়ের বয়স কুড়িবছর না হলে কোন বাচ্চা নিতে পারবেনা। এই শর্ত ভঙ্গ কারীর বিরুদ্ধে কঠোরব্যবস্থা নেবে সরকার। একাজ তদারকির জন্য মাঠ কর্মীদের সার্বক্ষনিক দায়িত্বপালনে জোর তাগিদ দওেয়া হল। হাঁ—হাঁ —।

এমন সময় বেয়ারা কপি সোমচা নিয়ে এল। কাগজ রেখে দিলাম। কপির কাপে চুমুকলাগালাম। বেয়ারা বলল স্যার খবর শুনছেন? আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, এইবেচারা কি আমার পরিচিত? এ আমার কি খবর দেবে? তবুও বললাম, কি খবর? বলল, নামানে আপনার আমার খবর না, তবে সবাই আলোচনা করছে যে ভাবে মনে হয় খবরটা ওদেরসবারই নিজের। আমার অবশ্য এই সব শুনতে ভাল লাগেনা। তবুও আপনি জানেন কিনা তাইবললাম, তা দেখছি আপনিতো এই জগতের বাসিন্দা না। হলে ওই রকম করে তাকাতেন না।
আমি বললাম কি খবর?
বেয়ারা একটু হতাশ হয়ে বলল, ঐ দেখেন আপনার কাছেই আছে । বাংলাদেশের মেয়েজাপানে নিয়ে চিকিৎসার নামে হত্যা। ওর বাবা কিযে কান্না কাটি করতাছে। জাপানবাংলাদেশ নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। কান, মাথা গরম হয়ে উঠল, দ্রুত কাগজ টেনেনিলাম। সেদিন খবরের কাগজ পড়ে আমি থ হয়ে গেলাম। সাভ্যতার নামে এই কিবর্বরতা? খবরের বর্ননা এরকম- নীলা নামের একটি বাংলাদেশী মেয়ে চিকিৎসা করতেস্বামীর সাথে জাপান আসে। লোকটি কোটি কোটি টাকার মালিক। জাপানী ডাক্তারদেরচিকিৎসার নামে মেয়েটিকে হত্যা করার জন্য প্রস্তাব করে। ডাক্তর পিচাশ লোকটিরপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এবং বলে বাচানোই আমাদের ধর্ম, মারা নয়। তাছাড়া এটাজাপানী সভ্যতার পরিপন্থি। লোকটা মোটা অংকের ডলারের প্রস্তাব করে কিন্তুডাক্তার তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এবং আইনি ব্যবস্তা নেবার জন্য হুমকি দেয়।এতে লোকটা ডাক্তারের কাছে ক্ষমা চায় এবং তার কাজে লজ্জিত হয়। একসময় লোকটাস্ত্রীর সেবার নামে স্যালাইনের সাথে পয়জন ঢুকিয়ে দেয়। এতে মেয়েটির মৃত্যুঘটে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী ঔষধের কারনে মৃত্যু হবার কোন সম্ভবনানেই। কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স, সাথে সাথে পুলিশকে খবর দিয়ে লোকটিকেগ্রেফতার করায় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষবাদী হয়ে লোকটির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকরলে পুলিশ তাৎক্ষণাত ভাবে ব্যাবস্থা গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে পিচাস লোকটিস্বীকার করে যে, তার স্ত্রীকে সেই হত্যা করেছে বিষ প্রয়োগ করে। জাপানী আইনঅনুযায়ী লোকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্তা নেয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।সবশেষে নীচে লেখা- মেয়েটির বাব ঢাকার বাসিন্দা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ছাকিবহোসেন। জাপানী দুতাবাসে লাশ নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং মেয়েরস্বামীকে উপযুক্ত শাস্তির দাবী করে। আমার সমস্ত রক্ত সঞ্চালন মুহুর্তেইবন্ধ হয়ে গেল। মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। মনে হল মাথার উপর একহাজারটা বাজ পড়েপৃথিবী ধ্বংম হয়ে যাচ্ছে। সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঘর বাড়ি, গাছ-পালা সব থর থরকরে কাপছে, চারি দিকে চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়েছে। বাচাও বাচাও আর্তনাদভেসে আসছে। কপি সমাচা পড়ে রইল। কিছুই খাওয়া হল না। রেস্টুরেন্টা থেকেবেরিয়ে আসলাম। বাইরে তীব্র আলো, ধুলোবালি লোকের ভিড়। কেউ আমার দিকে তাকিয়েনেই। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। মনে হল আমার কাছে যদি বোমা- ছোট খাট বোমানয়- একেবারে ভিয়েত নামীদের উপর ফেলা নাপাম বা হাইড্রোজেন বোমা কিংবাহিরোশিমো নাগাসাকীর এটম বোমা যদি থাকত। আমি এই মুহুর্তে সমস্ত পৃথিবী লন্ডভন্ড করে দিতাম, এই পৃথিবীতে আমার নীলা নেই এখানে কারোরই বেচে থাকর অধিকারনেই। কারোরই নেই- এমন কি আমারও না।
আমি দ্রুত হোস্টেলে ফিরলাম। পিস্তল সোনাকে তুলে নিলাম, গুলি ভরলাম, পকেটে রাখলাম। ভাবলাম, ঢাকায় পৌছাতে বাসে গেলে চার ঘন্টা লাগবে। যশোর থেকেপ্লেনে গেলে কেমন হয়? ঘড়ি দেখে বুঝলাম, প্লেনের সময় পার হয়ে গেছে। মনে মনেযোগাযোগ ব্যবস্থাকে গালাগালি করলাম। দ্রুত একটা বাসে উঠে বসলাম। ড্রাইভরকেবললাম- তোমাকে প্রতি মিটিটে একশত করে দেব যদি তুমি ঘন্টায় ১ হাজার মাইলবেগে গাড়ি চালাতে পার। ড্রাইভার আমার প্রস্তাবে অবাক হয়ে গেল। মুখ ফেকাসেহয়ে গেল। লোকটার সরল চেহারা আমার পছন্দ হল। জামার কলার ধরে পিচনের ছিটেনিয়ে আসলাম। পিস্তল সোনা পকেট থেকে বের করে নলটা ওর কপালে ঠেকিয়ে বললাম-কোনট্যাফো করবে না- জানে মারা পড়বে। দ্রুত গাড়ী চালাবে আর কোন চেক পয়েন্টে বাপুলিশ দেখলে গাড়ী থামাবে না। পুলিশ গাড়িতে উঠার আগেই তোমার মাথার খুলিউড়িয়ে যাবে। ওকে বেশ হতাশ মনে হল। বললাম- যদি এর ব্যতিক্রম কর তোমার জীবনতো বটেই তোমার পুরা ফ্যামিলিও সেই সাথে শেষ হবে। আর সোজা পথে চললে-পুরুস্কার। এই নাও- বলে ১০ হাজার টাকা মেলে ধরলাম ওর চোখের সামনে। চোখজ্বলে উঠল ওর। মৃদ হেসে আমার প্রস্তাব মেনে নিল।
ঢাকায় পৌছানোর পর আমার মাথায় কোন কৌশল আসলনা। এক অন্য কৌশল মাথায় খেলাকরতে লাগল। ভাবলাম- টাকা গুলো শুধু শুধু গরচা গেল। আমি আমার চাচার নকশিবাড়িতে ঢুকলাম। দেখি চাচি অজ্ঞান, মরে গেছে কিনা বোঝা গেলনা। চাচা তার পাশেবসা- চুল এলোমেলো। আমাকে দেখে ক্ষেপে উঠল। বলল- তুই-হারামজাদা-স্কাউন্ড্রেল- তোর জন্য আমার মেয়েল এই অবস্থা। কি চাস তুই? বেরোএখানথেকে বের। আমি একটু রহস্যের হাসি ফুটিয়ে তুললাম ঠোটে। বললাম থাকতেআসিনি- শুধু একটা জিনিস নিতে এসেছি, নিয়েই চলে যাব। চাচা বলল- কি চাস তুই, বল কি চাস? এটা কি তোর বাবার বাড়ি যে চাইলেই পাবি? বললাম- চাই তোমার জান।সাহসী লোকটি হঠাৎ আতকে উঠল। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে আমাকেদেখতে লাগল। বলল- তোর এত বড় সাহস? বললাম- কথা বাড়িও না জীবনে কোন সখ থাকলেমিটিয়ে নাও, আর শোন- ভদ্র ভাবে কথা বল। পিস্তল বের করলাম- ওর দিকে তাককরলাম। লোকটি নাকি সাহসী! একটা ব্যাঙের যে সাহস থাকে তার তাও নেই। ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। তবে সাহস খুজে পেতে চেষ্টা করছে। আমি জানতাম- আতœরক্ষার জন্যওর একটা পিস্তল আছে। সেটা দোতলায় থাকে। দেখলাম- নজরটা বার বার সিড়ির দিকেবোলাচ্ছে। ও ভয়ে ভয়ে বলল- সোন সঞ্জু তুমি আমার ভায়ের ছেলে, আমারও ছেলে।আমাকে মের না। হাদিসে আছে পিতা হত্যা মহা পাপ। তুমি এমন পাপ করোনা। নীলামারা গেছে ও আর আসবে না। এই সব সম্পত্তির মালিক এখন তুমি। সেই দুটি কটন মিলএখনও তোমার নামে চলে। তোমার নামে ইনকামট্রাক্সের রশিদ আমাকেই কাটটে হয়। এইদেখ তার রশিদ- বলে- লোকটা আলমারির দিকে এগুতে লাগল। আমি সাঁ করে একটাফাঁকা গুলি ছুড়লাম। কাঁচের কোন জিনিস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। একটা সাদামেছো বিড়াল দৌড়ে পালাল। একুইরামের মাছ গুল্ োসাতার কাটতে ভূলে গেল। ওসম্বিত ফিরে পেল। বলল- ছি- সঞ্জু মাথা খারাপ করো না- তুমি কি পত্রিকা পড়েমাথা খারাপ করে এখানে এসোছ? ছি এটা ভদ্র লোকের বাড়ি না? পাগলামী করো না।যাদু আমার, লক্ষী ছেলে পিস্তল ফেলে দাও। ও একটু একটু করে পিছাতে লাগল। আমিওর মতলব বুঝতে পারলাম- ও সময় বাড়াতে চায়, আতœরক্ষার চেষ্টা আর কি! ভাবলাম-লোকটাকে সিড়ির উপরে তুলে একটা দৌড় দিতে বলি। একটা খুন খুন খেলা-চাচা-ভাতিজার খুন খুন খেলা। খেলার বিষয় নীলা- ওর মেয়ে আমার প্রেমিকা ……হাঁ…..হাঁ।
আমি দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। একুইরামের মধ্যে পানি আর মাছ টলমল করছে।একটা গুলি করে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলাম। পানিতে ঘর ভেসে গেল। মাছ গুলোছটফট করতে লাগল। দেখি- এই ফাকে ও সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে চেষ্টা করছে। আমিএকটা গুলি ছুড়লাম। সোজা ওর হাটুতে লাগল। রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। গোংগাছে, কাতরাচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোট চেপে ব্যাথা সামলাচ্ছে। আমি হাসছি। খোড়াতে খোড়াতেদোতালায় উঠতে চেষ্টা করছে ও। বাধা দিলাম না। সারা মেঝেতে রক্ত লেগে লালহয়ে গেছে। ভাবলাম- আহারে – রক্ত যদি লাল না হয়ে নীল হত তাহলে দেখতে বেশ হত।সমস্ত ঘর নীল হত। রক্তে হিমোগ্লবিনের জন্য রক্ত লাল হয়, কোন উপাদান থাকলেরক্ত নীল হয়? আহা- আমি যদি চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে রক্ত লাল না বানিয়ে নীলবানাবার গবেষনা করতাম তাহলে আজ এই ঘর লাল না হয়ে নীল হয়ে যেত। আমার নীলাসোনার স্মৃতি চিহ্ন নীল- সমস্ত ঘর নীলাময় হয়ে যেত। ভাবতে পারলাম না।

পিচাসের মত হাসতে ইচ্ছা করল। ভাবলাম- দ্রুত খেলা শেষ করি, কেউ এসে পড়বেহয়তো। কিন্তু পারলাম না। আরো খেলতে ইচ্ছা করল। আমি একটা সুযোগ দিলাম। সুযোগপেয়ে মৃত্যুর মধ্যেও হেসে উঠল। ও পিস্তল খুজতে আলমারিতে হাত বাড়াল। সাথেসাথে আমি গুলি ছুড়লাম। রক্ত ঝরতে শুরু করল হাত থেকে। ওর প্রচন্ড কাতর মিনতিআমাকে ফেরাতে পারল না। সাথে সাথে আরও দুটি গুলি করলাম ও ঢলে পড়ে গেল।রক্তে সমস্ত ঘর লাল হয়ে গেছে। আসলে কি লাল? না লাল নয়। আমি দেখলাম সমস্ত ঘরনীল রক্তে ভেসে গেছে। চারদিক নীলার শরীরের গন্ধে ভরে উঠল। প্রাণ ভরে চোখবুজে শ্বাস নিলাম। বুঝলাম এক ধরনের বিভ্রম শুরু হয়েছে। দ্রুত ফ্রিজ খুলে একগ্লাস ঠান্ডা পানি খেলাম। আর এখানে নয়, বেরুতে হবে, পালাতে হবে। নীলা নেইতবে নীলাকে অমর করে রাখতে হবে। নীচে নেমে এলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম অজস্রমানুষের ভিড়ে। হারিয়ে গেলাম মানুষ সমুদ্্ের।


এগার
ঢাকা শহরে কিছু দিন উদ্দেশ্য হিন ভাবে ঘুরে বাতাসে নীলার শরীরের গন্ধশুকে বেড়ালাম। পুলিশ দেখলে ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে টানতে হেটেযেতাম। দাঁত বেরকরে স্থায়ী ঢাকাইয়াদের মত হাসতাম। ভিক্ষুকদের পয়সা দিতাম।ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে চা কপি খেতাম। পয়সা দিতাম বেশি।
ঢাকা শহরে আর বেশী দিন থাকতে পারলাম না। যে বাতাসে নীলার গন্ধ শুকেবেড়াতাম, সেই বাতাসই দু’দিনে অসহ্য হয়ে উঠল। রঙ্গিন মধুর স্মৃতি গুলো বারবার সামনে হাজির হতে লাগল। ভাবলাম- এইভাবে আমার মৃত লাশকে টেনে বেড়ানোর কোনমানে হয় না। হয় এই জীবনের অবসান করি, নতুবা ভালভাবে বাচি। সবাই চলে গেছে-এখন আমি স্বাধীন। উপদেশ দেবার, শাসন করবার কেউ নেই। হাতে প্রচুর টাকা আছে।যেমন ইচ্ছা খরচ করতে পারি। কিছু দিন অজথা খরচ করলাম। দান খয়রাত করলাম। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম- ভাবলাম- আর না- আমাকে বাঁচতে হবে। নীলা নেই তো কিহয়েছে? শারীরিক নীলা নেই, কিন্ত নীলা আমার অন্তরে, নিশ্বাসে, রক্তে, ধমনিশিরায় মিশে আছে। এই স্মৃতি নিয়ে আমি বেচে থাকব। নীলাকে আরও নীলাময় করেতুলব। নীলার নামে স্কুল, হাসপাতাল গড়ে দেব। এসব চিন্তায় মন কিছুটা নরম হয়েএল। ফিরে আসলাম হোস্টেলে। কিছু দিন শান্ত ভাবে থাকার চেষ্টা করলাম। নীলাগ্রহ্নগারে বই পড়ে সময় কাটালাম। ভাবলাম- এলোমেলো ভাবনাগুলো কোন দাম নেই।আমাকে হারিয়ে যেতে হবে একটা নির্দিষ্ট ভাবনার মধ্যে। কোন ভাবনায় নিজেকেব্যস্ত রাখব? অনেক ভাবনা মাথার মধ্যে আসতে লাগল। শেষে ঠিক করলাম- আমিপর্বত্য এলাকায় যাব। ওই এলাকার উপজাতীয়দের মধ্যে নিজকে বিলিয়ে দেব। ওরাঅশিক্ষিত, দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত। এব্যাপারে প্রচুর লেখা পড়াকরলাম। পড়ে পড়ে যা জানলাম তা হল- ওদের হাতে এখন অস্ত্র। অধিকার প্রতিষ্ঠায়ওরা আনাড়ি ভাবে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বিশ্বের এক শ্রেণীর মানুষ তাদেরঅস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। ওদেরকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমি ঠিককরলাম- আর দেরি নয়। আমার মত নিঃস্ব মানুষকে ওদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।ওদের হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে কলম তুলে দিতে হবে। ওদেরবোঝাতে হবে- জীবনমানে কি? জীবনের অর্থ কি? দেশ কি? বলতে হবে- এদেশ ভাই তোমাদেরও। কেন ভাইহয়ে ভায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছ? কেন তোমরা নিজেদেরকে অন্যেরমস্তিস্ক দিয়ে পরিচালিত করছ? মুক্তি যুদ্ধে কি তোমরা অংশ গ্রহণ করনি? তাহলে- তাহলে কেন বাংলাদেশকে জাফনা বানাবার আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের মারবেলহিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছ? বেশ কিছু দিন এই বিষয়ে ভাবলাম- কি ভাবে এই সববাস্তবায়ন করা যায়? এসময় নিজের মধ্যে খুন খুন অপরাধ বোধটা কেটে গেল। ঠিককরলাম এই ভাবে বললে পার্বত্য এলাকার মানুষের হাতে কলম তুলে দিতে পারব না।আগে ওদের মাঝে যেতে হবে। ওদের একজন হতে হবে। স্কুল গড়ে দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে হবে। নীলার মত ভালবাসার বাধনেবাধবার মন্ত্র ওদের শেখাতে হবে। আমার সোনা রানীকে ওদের মাঝে শ্রেষ্টত্বেরআসনে বসাতে হবে। পাহাড়ের চুড়া, সবুজ গাছ পালা, ঝর্ণাকে নীল ভালবাসায় নীলাময়করে তুলতে হবে। অশিক্ষিত, অসহায় দরিদ্র উপজাতীদের মধ্যে হতে হাজার হাজারলক্ষ কোটি ছোট নীলা পরি সোনার জন্ম দিতে হবে। ওরা হাসবে, গাইবে, ঝর্ণায়স্নান করবে আমি দেখব- শুধু দেখব- ওদের মধ্যে আমি নীলাকে খুজে পাব। নীলারজন্ম মৃত্যু দিবস পালন করব। ওই দুই দিন নীলাকে নিয়ে কবিতা, গল্প লিখতে বলব।পুরুস্কার দিব। আমি পার্বত্য এলাকায় যাবার জন্য তৈরী হলাম। প্রয়োজনীয় বইপত্র, জামা কাপড়, ঔষধ পত্র কিনলাম। এত ব্যস্ত থেকেছি তবুও এর ফাকে আমিনীলার বিরহে গলে গলে পড়তে লাগলাম। ভাবলাম- চলে তো যাব বাংলাদেশের এই অংশেআর কোন দিনও ফিরে আসবো না। চিরকালের মত বিদায়। শেষটাই এই জন্ম ভূমির জন্যমনটা একটু ভারি হয়ে উঠল। ঠিক করলাম আরও দুদিন থেকে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয়েগেল গোয়েন্দা পুলিশের আনা গোনা।
আমি শুনতে পাচ্ছি নিচে জোরে কথা বার্তা হচ্ছে। রুমে রুমে তল্লাশি হচ্ছে।জিপ ভর্তি পুলিশ গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে। ওরা হয়তো আমাকে জ্যান্ত ধরারচেষ্টা করবে। না পারলে গুলি করেও মারতেও পারে।শব্দ গুলো আস্তে আস্তে সিড়িবেয়ে উপরে দিকে উঠে আসছে। হয়ত নিশ্চিত হয়েছে আমি হোস্টেলে কোথাও লুকিয়েআছি। বুটের গট গট শব্দ ক্রমে জোরে শুনতে পাচ্ছি। তবে আমার সিদ্ধান্ত আমিপাঠককে জানিয়ে দিয়ে যাই- আমার হোস্টেলের পিছনে কাদা পানির বিল আছে আমি এখনতিন তলার ছাদ থেকে ওখানে লাফিয়ে পড়ব। পালাতে চেষ্টা করব। যদি না পারি তবেগুলি খেয়ে মরব। তবুও আমি এই পুলিশের কাছে ধরা দেব না। হয় মৃত্যু নয়ত আমিচলে যাব আমার কঙ্খিত লক্ষ্যে। যেখানে থাকবে শুধু নীলার স্মৃতি-নীলা-নীলা-নীলাময় পাহাড়, ঝর্ণা, সবুজ বনভূমি, আর নীল আকাশ।





কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 




মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment