CH Ad (Clicksor)

Friday, December 13, 2013

কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী_Written By pinuram [৪র্থ খন্ড (চ্যাপ্টার ১০ - চ্যাপ্টার ১২)]

আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী
Written By pinuram




কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#10)

একা একা বিছানার ওপরে শুয়ে রইল, কিছুই আর ভাল লাগছে না ওর। কামনার আগুনে পুড়ে একি করে ফেলল দেবেশ। মনিদিপাকে অনেক হেনস্থা করেছে ও সবার সামনে, আজ ওর পায়ে পরে ক্ষমা চেয়ে নেবে আর কোন দিন ওর সামনে যাবে না।
রাতের আঁধারে চুপি চুপি মই লাগিয়ে মানব জেঠুর ছাদে উঠল দেবেশ। সিঁড়ির দরজা বন্ধ দেখে, পাইপ বেয়ে দুতলায় নামল। চোরের মতন বারান্দা দিয়ে পাটিপে টিপে, মনিদিপার ঘরের দিকে এগোল। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আস্তে করে কড়া নাড়ল দেবেশ। কোন আওয়াজ নেই, আবার কিছুক্ষণ পরে কড়া নাড়ল দেবেশ। এবারে যেন পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল।

দরজা খুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল মনিদিপা, সামনে কাকুতি ভরা চোখে নিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেবেশ। 

ওই মুখ দেখে আরও রেগে গেল মনিদিপা, চোখ ফেটে জল চলে এল, বুকের পাঁজর একটা একটা করে যেন কেউ ভেঙ্গে দিচ্ছে। চাপা স্বরে কেঁদে উঠল মনিদিপা, “তুই একটা স্বার্থপর, নিজের খিদে ছাড়া আর কিছু জানিস না তুই। তুই আমাকে নিয়ে অনেক খেলা করেছিস। আমি তোকে মন দিয়ে...” আর কথা শেষ করতে পারল না... হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল মনিদিপা। দেবেশের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিল, ওকে উত্তর দেবার সময় দিলনা পর্যন্ত। চিৎকার করে উঠল মনিদিপা, বন্ধ দরজার পেছন থেকে, “চলে যা তুই আমার সামনে থেকে, আর কোনোদিন আমার সামনে আসবি না তুই... তুই আমার মান সন্মান সব নিলাম করে দিয়েছিস আজ। আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছিনা, নিজেকে এত ছোটো মনে হচ্ছে।”

বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ হাঁ করে জড় ভরতের মতন দাঁড়িয়ে রইল দেবেশ। ওর শরীরের সব রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে। হাঁটার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছে। বন্ধ দরজার সামনে হাত জোড় করে নিচু স্বরে বলল দেবেশ, “মনিদি আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও আমি তোমার জীবনের সব থেকে বড় পাপী। আমি আর তোমার সামনে কোন দিন আসব না মনিদি।”

মনিদিপা দরজার ওপার থেকে দেবেশের কান্নার সুর শুনে, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল, “একি করেছে ও, শেষ পর্যন্ত একটা লম্পট ছেলে কে মন দিয়ে ফেলছে, তাও আবার নিজের থেকে ছোটো। একি ভুল করে ফেলেছে। একি ভালবাসা না যৌন ক্ষুধা।” ককিয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল মনিদিপা, “আমি তোকে ভালবাসি রে দেবেশ... আমার মতন পাপী আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি যে তোকে প্রান দিয়ে ভালবাসি।”

এই নিশুতি রাতে, দূর থেকে ভেসে এল একটা গান--- 

জড়িয়ে ধরেছি যারে সে আমার নয়
কখন বুঝিনি আমি কে আমার নয়
কখন বুঝিনি আমি কে আমার নয়

মন তার নেমে এল চোখের পাতায় 
ভালবাসা এসে বুকে দাগ দিয়ে যায় 
ভুল দিয়ে মালা গেঁথে
ভুল দিয়ে মালা গেঁথে পরাল আমায়
তবু বোঝা গেল না’ত সে আমার নয়
কখন বুঝিনি আমি কে আমার নয়

----------------------------

বন্ধ দরজার পেছনের সেই আওয়াজ কোনদিন দেবেশের কানে পউছাল না। যেরকম ভাবে পাইপ বেয়ে এসেছিল, ঠিক সেই রকম ভাবে আবার নিজের ঘরে চলে গেল দেবেশ। সারা রাত ঘুমতে পারল না, বিছানায় পড়ে ছটফট করতে থাকল।

সারাদিন দেবেশের মনের মধ্যে শুধু মনিদিপাদির কথা ঘুরে বেরাল, মন আর কিছুতে টিকতে চাইছেনা। আগে মনিদিপাদির কাছে যাবার জন্য মন আকুলি বিকুলি করত এখন মনিদিপাকে ছেড়ে মন আকুলি বিকুলি করছে। বিকেল বেলা কলেজ থেকে ফিরে দেখে বাড়িতে মনিদিপার মা, মানে জেঠিমা বসে মায়ের সাথে গল্প করছে।

জেঠিমা ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি রে কাল তোদের কি কোন ঝগড়া হয়েছিল?”

দেবেশের মনে হল যেন কেউ পেরেক দিয়ে ওর পা মেঝের সাথে গেঁথে দিয়েছে। মাথা নিচু করে উত্তর দিল, “কই না তো।”

জেঠিমা উত্তর দিল, “ও বাবা, কি জানি মেয়ের কি হল, কাল রাতে একদম মন মড়া ছিল। রাতে কিছু খায়নি আবার সকাল বেলাও না খেয়ে বেড়িয়ে গেছে। আজ বলছিল দেরি হবে। এই বারাসাত থেকে কলকাতা, রোজ রোজ যাওয়া, তাই নাকি ও আরও কয়েক জন মিলে ওর অফিসের কাছে একটা ফ্লাট ভাড়া করে থাকবে।” 

মা জেঠিমা কে জিজ্ঞেস করল, “মনি বলল আর তুমি ওকে ছেড়ে দিলে? কি যে কর তুমি দিদি।”

জেঠিমা উত্তর দিল, “তুই ত আর জানিশ না ওকে, ওর যা জিদ।”

মা হেসে উত্তর দিল, “মনি আমার সোনার টুকরো মেয়ে, সাত রাজার এক মানিক। আমার যদি কোন বড় ছেলে থাকত তাহলে তোমার মনিকে আমি আমার বাড়ির বউমা করে নিতাম।”

মায়ের কথা শুনে দেবেশের বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেল, চোখ জ্বালা করতে শুরু করে দিল। তাহলে ওর মনিদিপাদি আর ওর হাতের নাগালের কাছে থাকবে না। চিরদিনের মতন হারিয়ে যাবে, আর মায়ের মনে যে এত সাধ ছিল তা কি আর ও জানত। এখন আর কি হবে।

দিন দুই এই রকম ভাবে কেটে গেল দেবেশের, জীবনটা কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেল ওর। একদিন খবর এল যে মানব জেঠুর বড় ছেলে প্রদিপ কোন পাঞ্জাবি মেয়েকে বিয়ে করে চণ্ডীগড়ে ঘর জামাই হয়ে চলে গেছে। দেবেশের মনে সেই ঘটনাটা তেমন কিছু দাগ কাটল না কেননা প্রদিপ কে ও কোনদিন দেখতে পারত না। 

ব্যাথা লাগল সেদিন, যেদিন কলেজ থেকে ফিরে শুনল যে মানব জেঠু বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় মনিদিপাদির সাথে ভাড়া বাড়িতে থাকবে। সারারাত ধরে দেবেশ কেঁদে বালিশ ভাসিয়ে দিল, দেয়ালে মাথা ঠুকেও কোন কিছুর উপায় করতে পারল না। আর তিন মাস পরে ওর জয়েন্ট আই আই টি পরীক্ষা, কিন্তু সব ছেড়েছুরে ওর মন বৈরাগী হয়ে গেছে। মন বলছে শেষ পর্যন্ত ও বাবার দোকানে গিয়ে বসবে। মনিদিপাদি কে কথা দিয়েছিল যে ও আই আই টি পড়বে, কিন্তু যখন ওর জীবন থেকে প্রান প্রেয়সী মনিদিপা চলেই গেছে তাহলে আর কার জন্য ও জয়েন্ট আই আই টি দেবে। 

এই ভাবে আরও দেড় মাস কেটে গেল। একদিন কলেজ থেকে ফিরে বাবার মুখে শোনে যে মানব জেঠুর নাকি খুব শরীর খারাপ। মাকে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারল যে মানব জেঠুর হার্ট এটাক হয়েছে। তার ওপরে নাকি বুকে পেস মেকার বসাতে হবে। বাবা দৌড় দিয়েছে কলকাতায়। দেবেশের যাবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না, কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবে ও মনিদিপার সামনে। 

কিছুদিন পরে খবর এল যে, পেস মেকার বসানর পরেও মানব জেঠু দেহ রক্ষা করেছেন। সেই কথা শুনে দেবেশের পায়ের তলায় ভুমিকম্প হয়েছিল। না মানব জেঠুর জন্য নয়, মনিদিপাদির কথা ভেবে, দেবেশ আর থাকতে পারেনি। বাবাকে নিয়ে দৌরে গেল গরিয়াহাটায় মনিদিপার বাড়িতে।

চৌকাঠে পা রেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দেবেশ। চোখের সামনে, সাধের মূর্তি মনিদিপাদি যেন কালি মেখে বসে আছে। সেই ফর্সা গোলগাল চেহারার মনিদিপাদি আর নেই, এক কাঠের পুতুল ভাসা ভাসা চোখে নিয়ে বাবার মৃতদেহের পাশে বসে। আস্তে করে হাঁটু গেড়ে মনিদিপাদির পেছনে গিয়ে বসল দেবেশ। আলত করে কাঁধে হাত ছোঁয়াল। পুরনো হাতের পরশ পেয়ে মনিদিপার হৃদয় কেঁদে উঠল।





কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#11)

অনেকক্ষণ পরে পেছনে তাকিয়ে দেবেশ কে দেখে, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল মনিদিপা, “আমার সব শেষ হয়ে গেল রে দেবু।”

ওর চোখের জল দেখে বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেল। দুহাতে মনিদিপাকে জড়িয়ে ধরল দেবশ। কিন্তু কি সান্ত্বনা দেবে, যে যাবার তিনি ত চলে গেছেন ওদের ছেড়ে, চিরকালের জন্য। তাকে ত আর দেবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। মনিদিপাকেই বাবার মুখে আগুন দিতে হয়েছিল, ওর মা ওর দাদাকে আসতে বারন করে দিয়েছিল। যে ছেলে বাবার অসময়ে দেখতে আসতে পারেনি সে ছেলে বাবার মুখে কি আগুন দেবে। বাবার মুখে আগুন দেবার পরে মনিদিপা অজ্ঞান হয়ে গেছিল। দেবেশ ওকে কোলে তুলে মুখে চোখে জল ছিটিয়ে আবার সুস্থ করে তুলেছিল। 

তিনদিনের কাজের পরে দেবেশ বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে আসার আগে দেবেশ মনিদিপাকে বলেছিল, “আমাকে ডাক দিও মনি, আমি তোমার জন্য পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।”

তার উত্তরে মনিদিপা মাথা নেড়ে বলল, “না, আমার জীবনে কারুর দরকার নেই। আমি আমার জীবন নিজে থেকে তৈরি করে নিতে পারব। তুই ভাল থাকিস আর ভাল করে পড়াশুনা করে বড় হস। আমার কথা আর চিন্তা করিশ না তুই। তোর সামনে এক বিশাল পৃথিবী পরে আছে, দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরিস আর আমাকে মন থেকে ভুলে যাস।” তারপরে কানে কানে বলেছিল, “আমরা খেলার ছলে অনেক দূর এগিয়ে গেছিলাম, সেগুলো সব একটা ভয়ানক স্বপ্ন ভেবে আমাকে মাফ করে দিস, যদি পারিস।”

হাত ধরে কেঁদে উঠেছিল দেবেশ, “তুমি আমাকে পর করে দিচ্ছ মনি। আমি কি নিয়ে থাকব জীবনে। আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি, যে।”

মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “তুই আমাকে না আমার শরীরকে ভালবেসে ছিলিস। আজ’ত তুই আমাকে দেখবি’ও না আর কেউ দেখবে না। তুই চলে যা রে, বেশিক্ষণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আত্মহত্যা করব।”

চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফিরে এল দেবেশ। প্রানের মনিদিপাদি কে ফিরিয়ে আনতে পারল না আর। 

নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করল, ভাবল সুকন্যার প্রেমে পরে ও মনিদিপাদি কে ভুলে যাবে। কিন্তু বাধ সাধল সেই পুরনো স্মৃতি। যাই করতে যায় না কেন, সবসময়ে চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় মনিদিপাদির কান্না ভেজা দু চোখ। সুকন্যার সাথে আর ওর ভালবাসা হল না, হলনা কিছুই করা। পড়াশুনা এক রকম গতানুগতিক ভাবে এগিয়ে চলছে। রোজ সকালে উঠে কলেজ যাওয়া, বিকেল বেলা কলেজ থেকে বাড়ি ফেরা। রাতের বেলা পাশের বাড়ি দেখা। মানব জেঠু বাড়ি বিক্রি করে দেবার পরে সেইখানে এক প্রমটার এক পাঁচ তলা ফ্লাট বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ির সাথে সাথে মনিদিপাদির স্মৃতি জড়িয়ে ছিল, সেটাও ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশে গেল একদিন।

কিছুদিন পরে বেশ রাত করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে দেখে বসার ঘরে মা জেঠিমা আরও অনেকে বসে, সবার চোখে জল। দুজনে যেন অনেকক্ষণ ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছে। জেঠিমা দেবেশকে ঢুকতে দেখে আরও জোরে কেঁদে উঠল।
কাঁপা গলায় বলল, “বাবারে... আমার মনি আর নেই...”

কথাটা ঠিক কানে যায় নি দেবেশের। মাথা ঘুরে পরে গেল দেবেশ, কি হয়েছে, জেঠিমা কি বলছে, মনিদিপাদি নেই মানে? কি হয়েছে মনিদিপাদির। বাড়ির চাকর ওর চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরাল। 

মায়ের পাশে বসে মাকে জিজ্ঞেস করল, “ও মা, কি হয়েছে মনিদিপাদির?”

মায়ের দুটি লাল চোখে জল, টলমল করছে, “হ্যাঁ রে বাবা, আমার সাধের মনিদিপা আর এই পৃথিবীতে নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে মেয়েটা। আমার মেয়েটা কত ভাল ছিল রে......”

বাবার দিকে তাকাল দেবেশ, “কি হয়েছে মনিদিপাদির?”

ওর বাবা উত্তর দিল, “মনিদিপা আত্মহত্যা করেছে।”

দেবেশের মনে হল যেন ওর কানের ওপরে কেউ সজোরে এক থাপ্পড় মেরেছে। মাথা ভোঁভোঁ করে উঠল, “কেন কি হয়েছে? কে করল আত্মহত্যা, তোমরা কি করে জানলে?”

ওর বাবা উত্তর দিল, “মনিদিপা অনেক ভাল মেয়েরে। ওর মতন ত মেয়েই হয় না মনে হয়। মানবদার শরীর খারাপের জন্য ওর অনেক টাকার দরকার ছিল, আমাকে একবারের জন্যও বলল না ও। এই একটা চিঠি পাওয়া গেছে ওর ব্যাগ থেকে।”

“মানে?” জিজ্ঞেস করল দেবেশ।

উত্তরে ওর বাবা ওকে জানাল, “আজ খুব সকালে মনিদিপা বলে বেড়িয়ে ছিল যে অফিসের কাজে বম্বে যাচ্ছে। তারপরে ন’টা নাগাদ কেউ গঙ্গার ঘাটে একটা ব্যাগ কেউ কুড়িয়ে পায়, আর তার সাথে মনিদিপার পরনের জামাকাপড়ের কিছু অংশ। লাশ পাওয়া যায়নি, হয়ত গঙ্গার জলে ভেসে গিয়েছে কোথাও। ওর ব্যাগ আর জামা কাপড় দেখে পুলিস ওর অফিসে খবর দেয়। তারপরে অফিসের লোকেরা তোর জেঠিমাকে খবর দেয়। ব্যাগের ভেতরে একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে।”

দেবেশ জিজ্ঞেস করল বাবাকে, “কি লেখা ছিল তাতে।”

****************************************
ও মা, মা গো,
বাবার শরীর খারাপের সময়ে অনেক টাকার দরকার হয়েছিল, তার জন্য আমি অনেকের কাছে হাত পেতে টাকা ধার করেছি। সেই টাকা শোধ করার মতন আমার আর শক্তি নেই। বাবাই যখন রইলেন না ত সেই টাকা শোধ করে কি করব। এদিকে পাওনাদারদের তাগাদা, আর আমি একা একটা মেয়ে। এই বিশাল পৃথিবীতে কাউকে ভরসা করে কিছু বলতে পারলাম না, কাউকে ঠিক ভাবে ভালবাসতে পারলাম না। ও মা, তুমি কেঁদো না যেন, মা গো। তোমার পাগলি মেয়ে তোমাকে আর মুখ দেখাতে পারবে না বলে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, মা। মা গো তুমি কেঁদো না, নরেশ কাকুর কাছে চলে যেও মা, নরেশ কাকু তোমাকে ফেলবে না। 
আর আমার বিয়ের জন্য যে হার টা বানিয়ে ছিলে সেটা দেবেশ কে দিও, বোলো ও যখন বিয়ে করবে তখন যেন ওর বউকে দেয়। আর ওকে বোলো যে ও যেন পড়া শুনা করে, আই আই টি যেন পায়। আমার ভালবাসা ওর সাথে সবসময়ে থাকবে। 
কাকিমা কে বোলো, পরের জন্মে আমি ঠিক কাকিমার বাড়ির বউ হয়ে আসব। মা গো, আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি বড় পাপী অভাগী মেয়ে, মা। পরের বারে ভাল মেয়ে হয়ে তোমার কোলে ঠিক ফিরে আসব। মা গঙ্গা যেন আমাকে নিজের করে নেয়, মা।
ইতি তোমার অভাগী কলঙ্কিনী মেয়ে, মনিদিপা। 
****************************************





কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#12)

চিঠির কথা শোনার পরে দেবেশের দিগবিদিগ জ্ঞান হারিয়ে গেল। কি করবে আর, যার প্রেমে শেষ পর্যন্ত পড়ল সেই ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। সারা রাত কাঁদার পরে সকাল বেলা চোখ মুছে মনিদিপাদির গলার হার হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেল যে আই আই টি ও পাবেই। কারুর সাধ্যি নেই ওর আই আই টি রুখে দেবে। ওর সাথে আছে জেঠিমার দেওয়া মনিদিপার সোনার হার।

এক মাস বাকি আর পরীক্ষা দেবার। পুরপুরি বদলে গেল দেবেশ ঘোষাল। লোহার মূর্তি হয়ে গেছে দেবেশ। কোন ঝড় ঝঞ্জা ওকে ওর পথ থেকে নাড়াতে পারছে না। এই রকম মনব্রিতি নিয়ে জোড় কদমে শুরু করে দিল পড়াশুনা। রোজ রাতে একবার করে ওই সোনার হার টা দেখে আর পড়তে বসে দেবেশ। পরীক্ষা দিল দেবেশ এবং দিল্লি আই আই টি তে, ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পেয়ে গেল। 

কিছু দিনের মধ্যে ওকে বারাসাতের গলি ছেড়ে, তিলোত্তমা কোলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিতে হল দিল্লি। সব সময়ের সাথী মনিদিপার গলার হার। মনিদিপা আর নেই, তবে যদি কাউকে পায় কোনদিন তাকে পড়িয়ে দেবে দেবেশ। এই ভেবে সবসময়ে নিজের কাছে রেখে দিল ওই হার। ওই সোনার হার হয়ে গেল ওর রুদ্রাক্ষ মালা, ওর জীবনের সঙ্গী।


দিল্লী তে পড়ার সময়ে অনেক মেয়ের সানিধ্যে এসেছে দেবেশ, কিন্তু কাউকে ঠিক মনে ধরাতে পারেনি। সবার মধ্যে যেন মনিদিপাকে খুঁজে বেড়ায় ও। 

বছর ঘুরে গেল, দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেলে। পুরান স্মৃতির ওপরে অনেক ধুল জমে গেল। মনিদিপা এখন শুধু মাত্র একটি সোনার হার ছাড়া আর কিছু না। ও এখন আর মনিদিপাকে খোঁজে’না, খোঁজে এক ভালবাসার পাত্রী কে। 

কলকাতার বাড়িতে এখন বাবা মা আর জেঠিমা থাকেন। গরমের ছুটির পরে কলকাতা থেকে ফিরছে দেবেশ। স্টেসান থেকে অটো নিয়ে হস্টেলের দিকে যাচ্ছে। ঠিক আই আই টি গেটের সামনে অটো একটা মেয়েকে ধাক্কা মেরে দিল। বিশেষ কিছু যদিও হয়নি মেয়েটার, তবুও ভদ্রতার খাতিরে নেমে গিয়ে সাহায্য করতে চাইল মেয়েটাকে। মেয়েটার মুখ দেখে দেবেশ থ। রিতিকা উপাধ্যায়, ওদের অঙ্কের প্রফেসার শ্যামল উপাধ্যায়ের মেয়ে, এল এস আর এ পরে। সারা আই আই টি মেয়েটার সৌন্দর্যের পেছনে পরে আছে। 

দেবেশ জিজ্ঞেস করল রিতিকাকে “বেশি লাগেনি ত?”

মুখ তুলে তাকাল রিতিকা, “কি যে বল না, অটো ওয়ালা গুলো একদম দেখে চালায় না।”

দেবেশ বলল, “রিতিকা, তোমার কিন্তু দোষ ছিল। তুমি রাস্তা না দেখে পার হচ্ছিলে আর অটো ধাক্কা মেরেছে। যাইহোক বেশি লাগেনি মনে হয়, চল তোমাকে আমি বাড়িতে ছেড়ে দিচ্ছি।”

রিতিকা একজন অচেনা ছেলের মুখে নিজের নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাকে চেন?”

হেসে উত্তর দিল দেবেশ, “হ্যাঁ তোমাকে কে না চেনে। তুমি উপাধ্যায় স্যারের ছোটো কন্যে আর এল এস আর এ সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আই আই টির সবাই তোমাকে চেনে আর আমি ত ইলেক্ট্রিকালের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তাই আমিও তোমাকে চিনি।”

ওর যা দেমাক তার সামনে কোন ছেলে আজ পর্যন্ত এত সাহস করে কিছু বলতে পারেনি। দেবেশের এত সাহস দেখে রিতিকা হেসে ফেলল, “ওকে চল তাহলে আমাকে বাড়ি পউছে দাও। আজ আমার ক্লাস মিস হল আরকি।”

অটো তে বসে দেবেশ রিতিকাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ত ইংলিশ নিয়ে পড়ছ তাই না?”

“বাঃবা, আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানো দেখছি।” রিতিকা ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

হেসে উত্তর দিল দেবেশ, “তুমি সুন্দরী আর ফেমাস তাই তোমার ব্যাপারে ত সবাই রিসার্চ করে। সেইখান থেকে আমিও কিছু শুনে ফেলেছি।”

হেসে জিজ্ঞেস করে রিতিকা, “তুমি আমার ওপরে রিসার্চ করনি?”

মাথা নাড়ায় দেবেশ, “না আমি করিনি, করার দরকার পড়েনি তাই করিনি।”

প্রশ্ন করল রিতিকা, “সবাই করে রিসার্চ তুমি কেন করনি?”

একদম অকাঠ সত্যি কথা বলে ফেলল দেবেশ, “তুমি ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে তাই করিনি।”

এইরকম ভাবে কেউ যে কথা বলতে পারে সেটা রিতিকার ধারনা ছিলনা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল দেবেশের মুখের দিকে।

“মুখ টা বন্ধ কর নাহলে মাছি ঢুকে যাবে” আলত করে চিবুকে আঙ্গুল ছুঁইয়ে মুখ বন্ধ করে দিল।

রিতিকা ত আর থ বনে গেল, কি সাহস ছেলের বাঃবা, প্রথম দেখায় চিবুকে হাত। 
প্রফেসার কোয়ার্টার এসে গেল। রিতিকা অটো দাঁড় করিয়ে নেমে গেল, সাথে দেবেশ ও নামল। 

মিষ্টি হেসে দেবেশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রিতিকা, “থ্যাঙ্ক ইউ ফর হেল্প। আমি মনে রাখব।”

একটু থেমে তারপরে হ্যান্ড সেক করল দেবেশ, “ওকে বাই।”

পেছন ফিরে চলে যাচ্ছিল দেবেশ, এমন সময়ে পেছন থেকে রিতিকার ডাক, “হ্যালো তোমার নামটা ত জানা হল না। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে তুমি সত্যি আই আই টি তে পড়।”

হেসে উত্তর দিল দেবেশ, “সন্দেহ থাকলে কাল ইলেক্ট্রিকালের প্রাক্টিকাল ক্লাসে চলে এস যখন খুশি আমাকে পেয়ে যাবে। পেয়ে গেলে তবে আমি আমার নাম বলব তার আগে নয়।”

রিতিকার সামনে কোন ছেলে নিজের নাম না জানিয়ে ওই রকম ভাবে চলে যাবে সেটা রিতিকার ঠিক হজম হল না, “ছেলেটা ত বড় বেয়াদপ। আমাকে অমান্য করা, আমার মতন সুন্দরীকে অমান্য করা। ঠিক আছে দেখে নেব আমি।” 

দেবেশ হাসতে হাসতে হোস্টেলের দিকে হাটা লাগাল আর মনে মনে রিতিকার সুন্দর ফর্সা গোল মুখখানির ছবি এঁকে নিল। উফ কি একটা মেয়ে, যেমন দেখতে তেমন যেন দেমাক। হবে নাই বা কেন, বাবা আই আই টির প্রোফেসর, মা যে এন ইউ তে পড়ায়, দিদি সুইজারল্যান্ডএ থাকে, এই রকম মেয়ে কি আর বারাসাতের দেবেশকে ঘাস দেবে।







কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 




পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

click here

পিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment