আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমের ছুটি পরে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তাঁর উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।”
ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”
বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”
অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”
বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, ত হানিমুনে যাচ্ছ নাকি?”
অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”
বুধাদিত্য, “চলে এস এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাব তোমাকে।”
অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”
বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এস।”
অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।”
কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য।
অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার ত ঠিক ভাবে কথা বলা উচিত অনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিক ভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছ বলতে পার? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়ি’টাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।”
রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”
অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।”
অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের স্কুলে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়ত পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।
মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়ত সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পরে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।
দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”
বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”
দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হত।”
বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”
দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করব কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”
বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”
দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যাস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হত।”
দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাব। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসব বাপ্পাকে।”
শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকব। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবক কে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অদ্ভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।
গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”
মাথা নারে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”
বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”
কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”
দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”
বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বস, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”
বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”
দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বস আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।
বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”
মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াব। বল কি খাবে।”
বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।”
দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।”
বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাব, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছ, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”
বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাব।”
দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহ কে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”
দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।
দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পার।”
বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ এখানে?”
দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করব না কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”
দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহ কে কত টুকু চেন?”
বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহ কে চেন?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এই টুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”
দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে আমি মিস্টার গুহ’কে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষা’দির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বল, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহ’কে চেন? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।
বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহ’কে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পরে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহ’কে ছিনিয়ে নিয়েছ।”
বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।
দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহ’র সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে। ঠিক মঞ্জুষা দি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকত। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকো তে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলাম না।”
বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহ’র। পরে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হত, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজন কে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহ’র বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পরাশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নার্সিং পড়িয়ে ছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হত, সবাই যেন আমার দেহ’টাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ধর্ষণ করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হসপিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”
“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পরে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হসপিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আর্থ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যাবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কন্সট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নার্সিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যাবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”
“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহ’র পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিনহ খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষা’দির চিনহ বা তোমার কোন চিনহ ছিল না।”
বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে, তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের আছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসত, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হত, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহ’র প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেক কে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহ’র বিছানায় পরে মদে চুড়। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে যেত। শুধু ভগবান কে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হত যে একদিন হয়ত নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”
পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহ টাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাঁধা দিত আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহ’র কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহ এতই বদনাম ছিলেন যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখত। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিল না, অগত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”
“সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কালী পুজোর দিন। বিকেলবেলা রথিনের সাথে হিরাপুরে দেখা করার কথা ছিল। মিস্টার গুহ আমাকে গাড়িতে করে হিরাপুরে নিয়ে যান। গাড়ি থেকে নামার সময়ে আমার হাত ধরে বলেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। সেই প্রথমবার মিস্টার গুহ আমাকে ছুঁয়েছিলেন, কিন্তু সেই কথা বাইরের লোক জানত না। সেই দৃশ্য দেখে রথিন রেগে যায়। আমার কথা শোনার আগেই আমার ওপরে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, আমাকে নীচ, জঘন্য, মিস্টার গুহ’র রক্ষিতা বলে গালাগালি দেয়। এতই বদনাম ছিলেন মিস্টার গুহ, যে তাঁর হাতের একটু ছোঁয়া আমার দুই বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়। রথিন আমার কোন কথা শুনল না, চলে গেল মুখ ঘুড়িয়ে। সেদিন বুঝেছিলাম, বিস্বাসের আসল মানে। হয়ত আমাদের ভালোবাসার মধ্যে সেই বিশ্বাস ছিল না তাই ভেঙ্গে গেল।”
বুধাদিত্য মাথা নিচু করে দেবস্মিতার ধরা গলার কাহিনী শুনে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে দেখে দুই চোখ জলে ভরা, গাল বেয়ে টসটস করে বড়বড় ফোঁটায় শ্রাবনের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। মাথা দোলায় বুধাদিত্য, সত্যি এই ভদ্রমহিলাকে অনেক ভুল বুঝেছে সে। চোখের জল মুছে বুক ভাঙ্গা হাসি টেনে বলে, “ভাবছ যে এই মেয়েটা তোমার সামনে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে, তাই না। কি দরকার আমার এত দূর এসে তোমাকে বানিয়ে গল্প শুনানোর, বল বুধাদিত্য?”
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, ভাষা হারিয়ে এক নতুন রুপ দেখছে এই দেবী প্রতিমার। ঠিক সেই সময়ে কলিংবেল বাজে, চাইনিজ খাবার নিয়ে লোক এসে যায়। বুধাদিত্য টাকা মিটিয়ে খাবারের প্যাকেট দেবস্মিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। বাপ্পাদিত্য ম্যাগি দেখে খুব খুশি। বাপ্পাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে বুধাদিত্য, বুকের ভেতরে এক শীতল মনোরম বাতাস বয়ে যায়। এই ছোট্ট শিশুর মুখে হাসি দেখে সব দুঃখ, সব কষ্ট নিভে যায় বুধাদিত্যের। চাইনিজ খেতে খেতে বাপ্পার গল্প শুরু হয়, উমংসর নাকি অনেক “ফাইত” করে, অনেক “রাইত” খায়, মাম্মা ওকে বলে পড়াশুনা করলে বড় হয়ে ওকে উমংসরের কাছে নিয়ে যাবে। খাবার পরে বাপ্পাকে নিয়ে শুতে চলে যায় দেবস্মিতা। বুধাদিত্য চুপচাপ বসে থাকে বসার ঘরে, সব কিছু ঠিক, কিন্তু এইসব কথা তাকে এত দিন পরে জানানোর কি দরকার? সেই অঙ্ক মিলাতে পারছে না, বুধাদিত্য। সে’ত মিস্টার গুহ’র সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর জন্য হাত পাতেনি। বারেবারে অঙ্ক মিলাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য।
“ব্লাক কফি খাবে?” দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁর গলার স্বর শুনে অঙ্ক মিলাতে ভুলে যায় বুধাদিত্য। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করে যে, হ্যাঁ। দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু কাপ ব্লাক কফি বানিয়ে আনেন। আবার বসে পড়েন বুধাদিত্যের সামনের সোফায়।
বুধাদিত্য চেয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে, জিজ্ঞেস করে, “বাপ্পা ঘুমিয়ে গেছে?” মাথা নাড়ায় দেবস্মিতা, হ্যাঁ। বুধাদিত্য বড় শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এমন কি হল যে চোদ্দ বছর পরে আমার কথা মনে পড়েছে, মিস্টার গুহ’র? তাঁর জীবন’ত ভালোই চলছিল, তবে?”
দেবস্মিতা ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, এই তবের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি এসছি, বুধাদিত্য। রথিনের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, আমি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। মাস পার হয়ে বছর ঘুরে যায়। দিনেদিনে মিস্টার গুহ’র মদের নেশা আর নারীসঙ্গ বেড়ে যায়। আমি চোখ কান বন্ধ করে নিচের ঘরে পরে থাকতাম আর বাড়ির চাকরদের তদারকি করতাম। মিস্টার গুহ’র ব্যাবসার ম্যানেজার, তরুন সিনহা আমাকে কাজ শিখতে অনেক সাহায্য করেন। কোম্পানির কাজ আমার ঘাড়ে এসে পরে, কেননা মিস্টার গুহ তাঁর অফিস আর মদ নিয়ে পরে থাকতেন। দিনেদিনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। একদিন মিস্টার গুহ’র সাথে এই নিয়ে প্রচন্ড মনমালিন্য হয়। আমি কড়া গলায় জানিয়ে দিয়েছিলাম, যে আমাকে যদি কাজে রাখতে হয় তাহলে বাড়িতে মেয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নেশায় চুড় মিস্টার গুহ আমাকে সেদিন আমার জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন যে এক বেতনভুক্ত চাকর। আমি ওই বাড়িকে নিজের বলে ভাবতাম। মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি ভেঙ্গে যাই। নিজের ঘরে ঢুকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি আমি।”
“ঠিক সেই সময়ে চাকর এসে আমার দরজা ধাক্কা দেয়, চেঁচিয়ে বলে যে দিদিমনি বড়বাবুর কিছু হয়েছে। আমি আত্মহত্যার কথা ভুলে দৌড়ে উপরের ঘরে গিয়ে দেখি যে মিস্টার গুহ রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পরে। চারদিকে কাঁচ ছড়ান, গ্লাস বোতল ভাঙ্গা। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি ওনার মাথা কোলের ওপরে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চাকরকে বললাম তরুন বাবু আর এম্বুলেন্সকে খবর দিতে। মিস্টার গুহ’কে হসপিটালে ভর্তি করা হল। এবারে আর কাছ ছেড়ে যেতে পারলাম না আমি। চোখের সামনে দেখতে পেলাম যে আমার ভবিষ্যৎ মিস্টার গুহ’র সাথে বাঁধা। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ভগবান আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। আমি চোখ বন্ধ করে মেনে নিলাম আমার ভবিতব্যের লেখন।”
“দ্বিতীয় বার ফিরিয়ে আনলাম মিস্টার গুহ’কে, কিন্তু এবারে মন শক্ত করে নিলাম, আমি মিস্টার গুহ’কে আর বিপথে যেতে দেব না। তাঁর মদ খাওয়া, নারীসঙ্গ সব বন্ধ করে দিলাম। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি অফিস যেতে শুরু করেন। ড্রাইভারের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যে শুধু মাত্র অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে একটু দোনামনা ভাব দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু আমি তাঁর মিনতির সামনে নরম হয়ে যাইনি। সময়ের সাথে সাথে মিস্টার গুহ বদলে যান। অফিস থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতেন। ওনার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভাব ছিল আমার মনে, সেটা এক ভালোবাসায় পরিনত হয়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে আসার সময়ে অহেতুক ফুলের তোড়া, আমি চকলেট খেতে ভালবাসতাম, তাই মাঝে মাঝে চকলেট কিম্বা কোন উপহার নিয়ে আসতেন। আমাদের সম্পর্কে এক নতুন মোড় নেয়। আমি জানতাম যে আমাদের বয়সের ব্যাবধান অনেক, আমি জানতাম ভালোভাবে যে আমি কোন পথে চলেছি, কিন্তু আমি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারিনি। ওনার চোখে, ওনার আচরনে আমি আমার ভালোবাসা পুনরায় খুঁজে পাই। সেই পুরানো কচি মেয়েটা আবার আমার মধ্যে জেগে ওঠে, বুক ভরে মুক্তির শ্বাস নিলাম আমি।”
“মিস্টার গুহ’র সাথে দেখা হওয়ার প্রায় দু’বছর পরে, একদিন বিকেলে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি তাঁর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে। আমি মিস্টার গুহ’র সামনে একটা শর্ত রাখলাম, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমাকে তাঁর অতীত জানাতে হবে। তিনি রাজি হলেন, যে আমাকে তাঁর অতীতের কথা, মঞ্জুষা’দির কথা, তোমার কথা, সব বলবে। আমরা দু’জনে আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে গেলাম, বাবা মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দেন না। বলেন যে, মিস্টার গুহ আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়, সেমত অবস্থায় এই বিয়ে হতে পারে না। আমার দৃঢ়সঙ্কল্প’র সামনে বাবা মা শেষ পর্যন্ত ঝুঁকে যান, এবং আমাদের বিয়েতে আসেন। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ছোটো করে হয়েছিল, গোটা কুড়ি বাইশ জন খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে বলা হয়নি সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমার স্বপ্ন ছিল আমার খুব বড় করে বিয়ে হবে, কিন্তু পাশে যখন ভালোবাসার মানুষকে পেলাম তখন আর সেই অলিক স্বপ্ন ছেড়ে মিস্টার গুহ’কে বুকে টেনে নিলাম।”
“সেই প্রথম রাতে আমি মিস্টার গুহ’কে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম যে তাঁর অতীতের কথা না জানালে তিনি আমাকে চিরতরে হারাবেন। আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে তাঁর অতীতের কালো পাতা মেলে ধরে। টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তি আর নারীসঙ্গের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে এই পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছেন। মঞ্জুষাদি’র শত বারন সত্তেও কোন কথা কানে দেননি তিনি। নিজের মনে যা ইচ্ছে হত তাই করতেন, শেষ পর্যন্ত মঞ্জুষাদি’কে একদিন বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন, বলেন যে সে আর তাঁর পুত্র তাঁর চাহিদার মাঝে দাঁড়িয়ে, তাদের তিনি মুখ দেখতে চাননা। তোমাকে তাঁর আগেই হস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চোখে জল, বুকে অনুতাপ, কাঁধে অসীম পাপের বোঝা, ঝুঁকে পড়েছেন মিস্টার গুহ। আমার হাত ধরে কাতর মিনতি করেন তাকে সেই পাপের বোঝা থেকে মুক্ত করতে। আমি তাঁর চোখের জলে, তাঁর নতুন রুপের সামনে গলে গিয়ে বুকে টেনে নিলাম। আমি তাকে বলি যে সেদিন থেকে তাঁর সব কষ্ট সব দুঃখ আমি বরন করে নিলাম। সেইদিন আমি বাড়ির নাম মঞ্জুষা মন্দির রাখি। সেটাই আমার উচিত মনে হয়েছিল।”
“একটা অতি পুরানো কাঠের বাক্স থেকে একটা এ্যালবাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন, তাঁর অতীত সেই হলদে কাগজে আটকা পরে আছে। আমাকে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি দেখিয়ে বললেন যে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি বুকে টেনে বলি যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া জীবন হয়ত ফিরিয়ে দিতে পারবোনা, তবে ওনার ভবিষ্যৎ নিজে হাতে সুন্দর করে তুলবো।”
“দিন যায়, বাড়ির নতুন রানী আমি। আমি ব্যাবসার কাজে ডুবে গেলাম, নিজে হাতে সেই কোম্পানির ভার নিলাম। মিস্টার গুহ’র দুই দুই বার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে, তাই তাকে শুধু অফিস আর বাড়ি করতে নির্দেশ দিলাম। একটি নরম মেয়ে ধিরে ধিরে এক কোম্পানির কর্ণধারে পরিনত হল। আমি আমার সংসার আমার কাজ নিয়ে মেতে উঠলাম। আমাদের ভেতর থেকে মঞ্জুষাদি হারিয়ে গেল। বিয়ের পাঁচ বছর পরে বাপ্পার জন্ম হয়। আমি বাপ্পার নাম রেখেছিলাম তোমার নামের সাথে মিলিয়ে, হয়ত কোনদিন ওর দাদার সাথে দেখা হবে না, তবে নামের মধ্যে হয়ত জানবে যে ওর একটা দাদা এই পৃথিবীতে আছে। বাপ্পা জন্মাবার পরে মিস্টার গুহ চাকরি থেকে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিলেন, সারাদিন বাড়িতে থাকতেন আর বাপ্পার সাথে সময় কাটাতেন। কোন কোন দিন দুপুরে যদি অফিস থেকে বাড়ি আসতাম তাহলে দেখতাম যে বাপ্পা মিস্টার গুহ’র পেটের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে। ওদের দুজনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগত।”
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে গেস্টরুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখে, কচি শিশু বাপ্পা, বিশাল বিছানায় উলটে শুয়ে, লাল পদ্মের মতন গোল মুখ, টোপা টোপা নরম গাল, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ খোলা, গায়ের ওপরে চাদর। দেবস্মিতার চোখের কোনা চিকচিক করছে, বাপ্পাকে আর বুধাদিত্যকে দেখে।
দেবস্মিতা চোখের কোল মুছে বুধাদিত্যকে বলেন, “গত বছর, জুলাই মাসে, আমি অফিসের কাজে একটু ব্যাস্ত ছিলাম। বাপ্পা আমার পায়ের কাছে, টেবিলের নিচে খেলছিল। খুব বায়না ধরে লুকোচুরি খেলার জন্য, ওর সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারতাম না, তাই লুকোচুরি খেলতে বসে গেলাম। বাপ্পা লুকিয়ে গেল একটা আলমারির ভেতরে। আমি খুঁজতে গিয়ে সেই আলমারির নিচে খুঁজে পেলাম সেই পুরানো কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে এ্যালবাম হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাতা উলটাতেই আমার সামনে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি চলে এল। কাগজের ভেতর থেকে তোমার আর মঞ্জুষাদির চোখ আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে হাসছে। সেই ছবি দেখে আমার চোখে জল চলে আসে, আমি বাপ্পার দিকে তাকালাম। এই বিশাল পৃথিবীতে কোন এক কোনায় এক মাতৃহীন ছেলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই নিস্পাপ ছেলেটা যদি আমার বাপ্পা হত তাহলে...” কেঁপে ওঠে দেবস্মিতার গলা, মুখে হাত চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেন তিনি।
দেবস্মিতা ধরা গলায় বলেন, “সেই ছেলেটার কি দোষ, সেও চেয়েছিল এক সুন্দর জীবন, সেও চেয়েছিল ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে, অন্যের পাপের বোঝা ঘাড়ে করে কেন সেই ছেলেটা এই বিশাল পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়াবে। আমি সেদিন সেই ছবি নিয়ে মিস্টার গুহ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিস্টার গুহ’র হাত বাপ্পার মাথায় রেখে বললাম, যে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, তোমাকে ডাকতে, তোমার প্রাপ্য তোমাকে ফিরিয়ে দিতে। মিস্টার গুহ ইতস্তত করেন, তিনি জানান যে তিনি তোমার কোন খবর জানেন না। আমি তাঁর কথা মানতে পারলাম না, আমি জানিয়ে দিলাম যে তিনি যদি তোমার সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন না করেন তাহলে আমি বাপ্পাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। মিস্টার গুহ বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলেন যে তিনি সচেষ্ট হবেন তাঁর পুত্রের সাথে যোগাযোগ করতে। সাথেসাথে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র তাকে ক্ষমা করে দেবে না। আমি জানিয়ে দিলাম, যে ক্ষমার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তাঁর অতীতের জন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনা, কেউ যদি পারে তিনি মঞ্জুষা’দি আর বুধাদিত্য।”
“অনেক জোর করার পরে মিস্টার গুহ রঞ্জন বাবুকে ফোন করেন। তোমার মামিমা ফোন ধরে অবাক হয়ে যান, বেশ কিছুক্ষণ তিনি কথা বলতে পারেন না। আমি বুঝতে পারি তোমার মামিমার রাগ আর বিদ্বেষ। আমি মিস্টার গুহকে তাঁর সামনে অনুরোধ করতে বললাম, যে একবারের জন্য তিনি যেন তোমার ফোন নাম্বার দেন। তোমার মামিমা, শেষ পর্যন্ত তোমার ফোন নাম্বার দিলেন। আমি মিস্টার গুহকে সেইক্ষণেই তোমাকে ফোন করতে বললাম। হাত কাঁপছিল তাঁর, চোখে অনুতাপের অশ্রু নিয়ে ফোন করেছিলেন তিনি। তাঁর পরের ঘটনা তুমি জানো ভালো করে। তোমার সাথে কথা বলার সময়ে তিনি জানতেন যে তুমি মিস্টার গুহ’কে ছেড়ে কথা বলবে না, সব দোষ আমার ওপরে পরবে আর আমার ছেলে বাপ্পার ওপরে পরবে।”
বুধাদিত্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, চোখে জল নেই, বুক ফাঁকা, ধিরে ধিরে জীবনের অঙ্ক মিলছে চোখের সামনে। বুধাদিত্যের সামনে এক কলুষিত দেবী বসে, সমাজ অনেক ঘৃণ্য নাম দিয়েছিল তাঁকে। সেই সব পার করে, এক পাপী আত্মা কে বুকে করে পাঁকের জীবন থেকে টেনে তুলেছে এই দেবী। দেবস্মিতা দেবীর মতন হেসে ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুমি আমাদের বাড়িতে এলে, তোমার আচরন দেখে মনে হল না যে তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পেরেছ। আমি তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারি যে তুমি আমাকেই দোষী সাবস্ত্য করেছ। আমি মিস্টার গুহ’র যখন অর্ধাঙ্গিনী তখন তাঁর পাপ ভাগ করে নিয়েছি আমি। আমি শেষ চেষ্টা করতে তৎপর হয়ে উঠলাম, শেষবারের জন্য তোমার সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলার জন্য। তোমার ঠিকানা জানার জন্য মিস্টার গুহ’কে দিয়ে অনিন্দিতাকে ফোন করালাম। তোমাকে এখানে না জানিয়ে আসার একটাই কারন, তোমাকে জানালে তুমি হয়ত আমাদের আসতে বারন করতে। তাই ভাবলাম একবারে এখানে এসে তোমার সাথে যোগাযোগ করা, চোখের সামনে দেখে অন্তত ফেলে দিতে পারবে না আমাদের।”
বুধাদিত্যের সামনে মিনতির সুরে ধরা গলায় বলেন, “আমি যখন মিসেস গুহ হবার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম, সেই সময়ে আমি জানতাম মিস্টার গুহ কি রকম মানুষ ছিলেন। তিনি বদলে গেছেন, বুধাদিত্য। আজ তিনি এক অন্য মানুষ। আমি জানিনা, তুমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা, কেননা তিনি তোমার অতীত তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।” দুই হাত জোর করে কেঁদে বলেন, “আমার ছেলেটা কোন পাপ করেনি, বুধাদিত্য। তোমার বিদ্বেষের অভিশাপ যেন ওর কাছে না আসে। শুধু তোমার একটু আশীর্বাদ চাইতে এসেছি, বুধাদিত্য, দয়া করে ফিরিয়ে দিও না আমাকে। আমি ভিক্ষে চাইছি, বুধাদিত্য।” দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন দেবস্মিতা।
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে বাপ্পাকে দেখে, এই শিশু কি সত্যি পাপ করতে পারে? ছোট্ট একটি ফুলের কুঁড়ি, এখন জীবন পরে আছে সামনে। বুধাদিত্য ত ভুলেই গিয়েছিল ওর বাবার কথা, তাঁর নতুন জবনের কথা। সামনে বসা এই দেবী প্রতিমা যদি এগিয়ে না আসত, তাহলে হয়ত কোনদিন যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হত না।
বুধাদিত্য কিছু পরে দেবস্মিতাকে বলে, “চিন্তা করো না, আমি তোমাদের মাঝে কোনদিন আসব না।”
চাপা আঁতকে ওঠেন দেবস্মিতা, “না, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পার না। ধানবাদের যা কিছু আছে তাতে বাপ্পার যেমন অধিকার তোমার সেই এক অধিকার। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “আমি কোথাও যাইনি, আমাকে কোথায় ফিরিয়ে নেবে?”
দেবস্মিতা, “তোমার বাবার কাছে, মিস্টার গুহ’র কাছে।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে চুপ করে মাথা দোলায়, কিছু পরে বলে, “তুমি সত্যি একজন দেবী। সব কিছু জেনেশুনে একজন পাপী আত্মার বিষ বুকে টেনে তাঁকে শুদ্ধ করে দিয়েছ। তোমার কথা কি করে ফেলব। ঠিক আছে আমি ছুটি পেলে নিশ্চয় যাব ধানবাদ। আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখব। কিন্তু আমি মিস্টার গুহ’র এক পয়সা নেব না, ক্ষমা করে দিও। আমার সম্পত্তি আমার মা, আমার সাথে আছেন, তাতেই আমি শান্তিতে আছি। আমাদের এই নতুন সম্পর্কের মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে না আসাটাই শ্রেয়।”
দেবস্মিতা চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলেন, “আমি বড় আশা করে এসেছিলাম, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।”
বুধাদিত্য, “না ম্যাডাম, সেটা সম্ভব নয়। দয়া করে সেই অনুরোধ দ্বিতীয় বার করো না, আমি মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারব না তাহলে।”
দেবস্মিতা, “আর বাপ্পা?”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “বুধাদিত্যের ভাই বাপ্পাদিত্য, আমার আশীর্বাদ সব সময়ে ওর সাথে। সত্যি বলছি, আমি ধানবাদ না গেলে জানতেই পারতাম না যে আমার একটা ভাই আছে।”
দেবস্মিতা অবশেষে চোখের জল মুছে হেসে বলেন, “আমি তাহলে মিস্টার গুহ’কে ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমি শেষ পর্যন্ত আমার কার্যে সফল হয়েছি।”
বুধাদিত্য ঠিক বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, “মানে?” ঘড়ি দেখে সকাল প্রায় চারটে বাজে, “তুমি এখন ফোন করবে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ, তিনি জেগে আছেন। তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন, দাঁড়াও একটু কথা বল তাঁর সাথে। তোমার গলার আওয়াজ শুনে হয়ত একটু ঘুমাতে পারবেন।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “বয়স হয়েছে, ফোন করে ঘুমাতে বল এখন। কাল কথা হবে।”
দেবস্মিতা ফোন করেন সুবির বাবুকে, “ওষুধ খেয়েছিলে? রতন ঠিকঠাক খাবার দিয়েছিল?” “হ্যাঁ, বাপ্পা ঘুমাচ্ছে।” “হ্যাঁ, আমার সামনে বসে আছে।” “চিন্তা করো না। আমি কথা দিয়েছিলাম, ফিরিয়ে এনেছি আমি।” “না, সেটা আর হল না। তোমার ছেলে অনেক ঋজু, নিজের আত্মসন্মান আছে।” “তুমি এখন শান্তিতে ঘুমাও, পরে ফোন করব।” “কথা বলবে? ঠিক আছে দিচ্ছি।” ফোন বুধাদিত্যের হাতে ধরিয়ে বলেন, “একটু কথা বল না হলে ঘুমাবেন না।”
সুবির বাবুর গলা কেঁপে ওঠে, “কেমন আছো?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “এক প্রশ্ন কয় বার করবে। ঘুমাতে যাও, আর পারলে কালকে বা পরশুর ফ্লাইট ধরে চলে এস।”
কেঁদে ফেলেন সুবির বাবু, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
বুধাদিত্য, “ঠিক আছে, চলে এস। এখন ত ঘুমাও” ফোন দেবস্মিতাকে ফিরিয়ে দেয়।
ভোরের নবীন ঊষার আলো, খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসে।
দেবস্মিতা ফোন রেখে ওর দিকে হেসে বলেন, “মিসেস গুহ হিসাবে যে সম্পর্ক আমাদের হওয়া উচিত সেই মর্যাদা তুমি দেবে না আমি জানি আর সেটা চাইতেও আসিনি।”
হাঁ করে থাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। আবার কোন নতুন হেঁয়ালি শুরু করল দেবস্মিতা, সেই ভাবতে থাকে।
দেবস্মিতা বলে, “আমি বাড়ির ছোটো ছিলাম, খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা ভাই হোক। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমাদের মাঝে হতে পারে না। তাই না?”
বুধাদিত্য বুঝতে পারে কি বলতে চায় দেবস্মিতা। হেসে বলে, “তুমি দেবী, সুতরাং তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকব ব্যাস। আর সম্পর্কের অলগলিতে ঘুরতে চাই না।”
স্বস্তির শ্বাস নিলেন দেবস্মিতা, জিজ্ঞেস করেন “কফি খাবে?”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “তোমার ঘুম পাচ্ছে না?”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “দশ বছর অপেক্ষা করেছিলাম এই দিন’টার জন্য। আমার না ঘুমালেও চলবে, তুমি ঘুমাতে যেতে পার।”
দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু’কাপ কফি বানিয়ে এনে বুধাদিত্যের সামনে বসে। কফির কাঁপে চুমুক দিয়ে বুধাদিত্যকে প্রশ্ন করে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি, যদিও প্রশ্ন টা অনেক ব্যাক্তিগত, তাও উত্তর জানালে একটু খুশি হব।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “কি?”
দেবস্মিতা মৃদু হেসে বলে, “তোমার রান্নাঘর, সোফার কভার, বাড়ির দেয়াল ইত্যাদি দেখে মনে হয় তোমার জীবনে কেউ আছে, সত্যি কি না জানিনা।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শেষ পর্যন্ত দেবীর কড়া নজরে ধরা পরে গেছে। হেসে বলে, “কি জানি ঠিক জানিনা, আছে কি নেই।”
দেবস্মিতা, “কি ব্যাপার, কি অসুবিধে একটু জানতে পারি কি?”
বুধাদিত্য একটু খানি চুপ করে থেকে বলে, “আমি একজনকে ভালোবাসি।”
শেষ পর্যন্ত নিজের হৃদয়ের কথা ভালোবাসার মানুষকে না জানিয়ে অন্য কাউকে জানাতে হচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে এক অব্যাক্ত ব্যাথা শুরু হয় বুধাদিত্যের।
দেবস্মিতা বড় বড় চোখ করে হেসে বলে, “বেশ ভাল কথা, কবে বিয়ে করছ?”
বুধাদিত্যের মুখ শুকিয়ে যায় ঝিলামের কথা ভেবে, “বিয়ে হয়ত হবে না আমাদের।”
ঝিলাম কিছুদিন পরে সমীরের সাথে বেড়াতে যাবে, ঝিলাম আর সমীরের সুখের সংসার থেকে দুরে সরে যেতে যায়।
দেবস্মিতা, “কেন? অসুবিধে কোথায়?”
বুধাদিত্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেবস্মিতা ওর পাশে বসে ওর পিঠের ওপরে হাত রেখে মৃদু সুরে বলে, “দেবী বলে ডেকেছ, আর নিজের মনের কষ্ট একটু জানাবে না?”
নরম হাতের পরশে মায়ের কথা মনে পরে যায় বুধাদিত্যের, চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে বেদনায়। কোনোরকমে আবেগ সামলে বলে, “বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক, দেবী। জানিনা শুনলে তুমি আমাকে কি বলবে। আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার বন্ধুর বৌ, নাম ঝিলাম। সমীরের সাথে বিয়ে হয় বছর তিন আগে। এই গত বছর দিল্লীতে দেখা, এখন দিল্লীতে থাকে। সমীর আর ঝিলামের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরে খুব টানাপড়েনের মধ্যে চলে। সমীর কাউকে ভালোবাসে বা ভালবাসত। আমি ভেবেছিলাম যে হয়ত ওদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যাবে আর আমি ঝিলামকে আমার করে নিতে পারব। কিন্তু কিছুদিন আগে সমীর ফিরে আসে ঝিলামের জীবনে। আমি সেই একা।”
দেবস্মিতা পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনদিন তোমার মনের কথা ঝিলামকে জানিয়েছ?”
বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “না।”
দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করে, “ঝিলাম তোমাকে ভালোবাসে?”
বুধাদিত্য শূন্য চোখে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবস্মিতা বুঝে যায় যে বুধাদিত্য অথবা ঝিলাম কেউ পরস্পরকে মনের কথা জানায়নি।
চিন্তায় পরে যায় দেবস্মিতা, “সত্যি বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক। এখানে কিছু করা মানে সবার চোখে পাপী, ব্যাভিচারি হয়ে যাওয়া, এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরা। কি করবে ভেবেছ?”
বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “জানিনা, দেবী। আমি সত্যি নিজের কাছে হেরে গেছি। ওদের মাঝে যেদিন বুঝব যে ভালোবাসা ফিরে এসেছে, সেদিন আমি দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাব। আমি জানি, আমি যদি ঝিলামের চোখের সামনে থাকি তাহলে সমীরকে মেনে নিতে ঝিলামের বড় কষ্ট হবে। আমি চাই না ওদের ভালোবাসার মাঝে কাটা হয়ে দাঁড়াতে।”
দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি হারতে পার না, বুধাদিত্য। আমার মন বলছে, একদিন এই কালো মেঘের মাঝ খান থেকে এক নতুন সূর্য উঠবে, তোমার মনের সব কালিমা দূর করে দেবে। সত্যি যদি তোমাকে কোথাও যেতে হয়, তুমি আমার কাছে চলে এস। আমার বাড়ি, তোমার বাবার বাড়ির দরজা তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছে বুধাদিত্য।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “ভেবে দেখব দেবী। যাও একটু বিশ্রাম করো, আমাকে নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও।”
সকাল বেলায় বুধাদিত্য মামাকে ফোন করে সব কথা বলে। প্রমীলা দেবীর মন একটু খারাপ হয়ে যায়। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে মামিমা ভাবছেন যে ছেলে বাবা পেয়ে হয়ত তাকে ভুলে যাবে। বুধাদিত্য মামিমাকে আসস্থ করে, “পমুসোনা”র জায়গা ওর জীবনে অন্য কেউ নিতে পারবে না। বাবাকে হয়ত ফিরে পেয়েছে, কিন্তু রঞ্জনবাবুকে জানায় যে সুবিরবাবু কর্মে নয়, শুধু মাত্র জন্ম দিয়েছেন বলে তাঁর বাবা। তৎক্ষণাৎ প্লেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয় মামা মামীকে। বিকেলের মধ্যে প্রমীলাদেবী আর রঞ্জনবাবু দিল্লী আসেন। প্রমীলাদেবী দেবস্মিতাকে দেখে তার সাথে কথা বলে আসস্থ হন। বাপ্পাকে দেখে বেশ খুশি হন। রাতের মধ্যে সুবিরবাবু দিল্লী পৌঁছান। বাড়ি লোকজনের সমাগমে মুখর ওঠে, ছোট্ট বাপ্পা মায়ের কোলে চেপে নতুন লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুবিরবাবু অনেক চেষ্টা করেন ছেলেকে ধানবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার। বুধাদিত্য সুবিরবাবুকে শোয়ার ঘরে মায়ের ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দেয়’যে ওর মা ওর সাথেই আছে, আর এই সম্পত্তি নিয়ে অথবা ধানবাদ যাওয়া নিয়ে যেন কথা না বলে। জানায় যে, নতুন সম্পর্কে টাকা পয়সা না আসলেই ভালো, মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। বুধাদিত্যের জীবনে সব আছে নতুন আর কিছু চায় না।
পিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
দ্বিতীয় অঙ্ক
Written By pinuram
Written By pinuram
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী (#1)
ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমের ছুটি পরে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তাঁর উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।”
ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”
বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”
অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”
বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, ত হানিমুনে যাচ্ছ নাকি?”
অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”
বুধাদিত্য, “চলে এস এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাব তোমাকে।”
অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”
বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এস।”
অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।”
কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য।
অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার ত ঠিক ভাবে কথা বলা উচিত অনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিক ভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছ বলতে পার? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়ি’টাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।”
রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”
অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।”
অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের স্কুলে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়ত পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।
মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়ত সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পরে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।
দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”
বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”
দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হত।”
বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”
দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করব কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”
বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”
দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যাস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হত।”
দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাব। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসব বাপ্পাকে।”
শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকব। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবক কে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অদ্ভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।
গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”
মাথা নারে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”
বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”
কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”
দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”
বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বস, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”
বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী (#2)
দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বস আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।
বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”
মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াব। বল কি খাবে।”
বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।”
দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।”
বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাব, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছ, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”
বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাব।”
দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহ কে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”
দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।
দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পার।”
বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ এখানে?”
দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করব না কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”
দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহ কে কত টুকু চেন?”
বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহ কে চেন?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এই টুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”
দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে আমি মিস্টার গুহ’কে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষা’দির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বল, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহ’কে চেন? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।
বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহ’কে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পরে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহ’কে ছিনিয়ে নিয়েছ।”
বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।
দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহ’র সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে। ঠিক মঞ্জুষা দি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকত। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকো তে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলাম না।”
বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহ’র। পরে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হত, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজন কে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহ’র বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পরাশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নার্সিং পড়িয়ে ছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হত, সবাই যেন আমার দেহ’টাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ধর্ষণ করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হসপিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”
“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পরে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হসপিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আর্থ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যাবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কন্সট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নার্সিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যাবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”
“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহ’র পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিনহ খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষা’দির চিনহ বা তোমার কোন চিনহ ছিল না।”
বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে, তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের আছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসত, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হত, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহ’র প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেক কে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহ’র বিছানায় পরে মদে চুড়। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে যেত। শুধু ভগবান কে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হত যে একদিন হয়ত নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”
পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহ টাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাঁধা দিত আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহ’র কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহ এতই বদনাম ছিলেন যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখত। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিল না, অগত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী (#3)
“সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কালী পুজোর দিন। বিকেলবেলা রথিনের সাথে হিরাপুরে দেখা করার কথা ছিল। মিস্টার গুহ আমাকে গাড়িতে করে হিরাপুরে নিয়ে যান। গাড়ি থেকে নামার সময়ে আমার হাত ধরে বলেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। সেই প্রথমবার মিস্টার গুহ আমাকে ছুঁয়েছিলেন, কিন্তু সেই কথা বাইরের লোক জানত না। সেই দৃশ্য দেখে রথিন রেগে যায়। আমার কথা শোনার আগেই আমার ওপরে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, আমাকে নীচ, জঘন্য, মিস্টার গুহ’র রক্ষিতা বলে গালাগালি দেয়। এতই বদনাম ছিলেন মিস্টার গুহ, যে তাঁর হাতের একটু ছোঁয়া আমার দুই বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়। রথিন আমার কোন কথা শুনল না, চলে গেল মুখ ঘুড়িয়ে। সেদিন বুঝেছিলাম, বিস্বাসের আসল মানে। হয়ত আমাদের ভালোবাসার মধ্যে সেই বিশ্বাস ছিল না তাই ভেঙ্গে গেল।”
বুধাদিত্য মাথা নিচু করে দেবস্মিতার ধরা গলার কাহিনী শুনে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে দেখে দুই চোখ জলে ভরা, গাল বেয়ে টসটস করে বড়বড় ফোঁটায় শ্রাবনের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। মাথা দোলায় বুধাদিত্য, সত্যি এই ভদ্রমহিলাকে অনেক ভুল বুঝেছে সে। চোখের জল মুছে বুক ভাঙ্গা হাসি টেনে বলে, “ভাবছ যে এই মেয়েটা তোমার সামনে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে, তাই না। কি দরকার আমার এত দূর এসে তোমাকে বানিয়ে গল্প শুনানোর, বল বুধাদিত্য?”
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, ভাষা হারিয়ে এক নতুন রুপ দেখছে এই দেবী প্রতিমার। ঠিক সেই সময়ে কলিংবেল বাজে, চাইনিজ খাবার নিয়ে লোক এসে যায়। বুধাদিত্য টাকা মিটিয়ে খাবারের প্যাকেট দেবস্মিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। বাপ্পাদিত্য ম্যাগি দেখে খুব খুশি। বাপ্পাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে বুধাদিত্য, বুকের ভেতরে এক শীতল মনোরম বাতাস বয়ে যায়। এই ছোট্ট শিশুর মুখে হাসি দেখে সব দুঃখ, সব কষ্ট নিভে যায় বুধাদিত্যের। চাইনিজ খেতে খেতে বাপ্পার গল্প শুরু হয়, উমংসর নাকি অনেক “ফাইত” করে, অনেক “রাইত” খায়, মাম্মা ওকে বলে পড়াশুনা করলে বড় হয়ে ওকে উমংসরের কাছে নিয়ে যাবে। খাবার পরে বাপ্পাকে নিয়ে শুতে চলে যায় দেবস্মিতা। বুধাদিত্য চুপচাপ বসে থাকে বসার ঘরে, সব কিছু ঠিক, কিন্তু এইসব কথা তাকে এত দিন পরে জানানোর কি দরকার? সেই অঙ্ক মিলাতে পারছে না, বুধাদিত্য। সে’ত মিস্টার গুহ’র সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর জন্য হাত পাতেনি। বারেবারে অঙ্ক মিলাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য।
“ব্লাক কফি খাবে?” দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁর গলার স্বর শুনে অঙ্ক মিলাতে ভুলে যায় বুধাদিত্য। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করে যে, হ্যাঁ। দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু কাপ ব্লাক কফি বানিয়ে আনেন। আবার বসে পড়েন বুধাদিত্যের সামনের সোফায়।
বুধাদিত্য চেয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে, জিজ্ঞেস করে, “বাপ্পা ঘুমিয়ে গেছে?” মাথা নাড়ায় দেবস্মিতা, হ্যাঁ। বুধাদিত্য বড় শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এমন কি হল যে চোদ্দ বছর পরে আমার কথা মনে পড়েছে, মিস্টার গুহ’র? তাঁর জীবন’ত ভালোই চলছিল, তবে?”
দেবস্মিতা ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, এই তবের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি এসছি, বুধাদিত্য। রথিনের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, আমি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। মাস পার হয়ে বছর ঘুরে যায়। দিনেদিনে মিস্টার গুহ’র মদের নেশা আর নারীসঙ্গ বেড়ে যায়। আমি চোখ কান বন্ধ করে নিচের ঘরে পরে থাকতাম আর বাড়ির চাকরদের তদারকি করতাম। মিস্টার গুহ’র ব্যাবসার ম্যানেজার, তরুন সিনহা আমাকে কাজ শিখতে অনেক সাহায্য করেন। কোম্পানির কাজ আমার ঘাড়ে এসে পরে, কেননা মিস্টার গুহ তাঁর অফিস আর মদ নিয়ে পরে থাকতেন। দিনেদিনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। একদিন মিস্টার গুহ’র সাথে এই নিয়ে প্রচন্ড মনমালিন্য হয়। আমি কড়া গলায় জানিয়ে দিয়েছিলাম, যে আমাকে যদি কাজে রাখতে হয় তাহলে বাড়িতে মেয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নেশায় চুড় মিস্টার গুহ আমাকে সেদিন আমার জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন যে এক বেতনভুক্ত চাকর। আমি ওই বাড়িকে নিজের বলে ভাবতাম। মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি ভেঙ্গে যাই। নিজের ঘরে ঢুকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি আমি।”
“ঠিক সেই সময়ে চাকর এসে আমার দরজা ধাক্কা দেয়, চেঁচিয়ে বলে যে দিদিমনি বড়বাবুর কিছু হয়েছে। আমি আত্মহত্যার কথা ভুলে দৌড়ে উপরের ঘরে গিয়ে দেখি যে মিস্টার গুহ রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পরে। চারদিকে কাঁচ ছড়ান, গ্লাস বোতল ভাঙ্গা। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি ওনার মাথা কোলের ওপরে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চাকরকে বললাম তরুন বাবু আর এম্বুলেন্সকে খবর দিতে। মিস্টার গুহ’কে হসপিটালে ভর্তি করা হল। এবারে আর কাছ ছেড়ে যেতে পারলাম না আমি। চোখের সামনে দেখতে পেলাম যে আমার ভবিষ্যৎ মিস্টার গুহ’র সাথে বাঁধা। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ভগবান আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। আমি চোখ বন্ধ করে মেনে নিলাম আমার ভবিতব্যের লেখন।”
“দ্বিতীয় বার ফিরিয়ে আনলাম মিস্টার গুহ’কে, কিন্তু এবারে মন শক্ত করে নিলাম, আমি মিস্টার গুহ’কে আর বিপথে যেতে দেব না। তাঁর মদ খাওয়া, নারীসঙ্গ সব বন্ধ করে দিলাম। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি অফিস যেতে শুরু করেন। ড্রাইভারের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যে শুধু মাত্র অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে একটু দোনামনা ভাব দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু আমি তাঁর মিনতির সামনে নরম হয়ে যাইনি। সময়ের সাথে সাথে মিস্টার গুহ বদলে যান। অফিস থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতেন। ওনার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভাব ছিল আমার মনে, সেটা এক ভালোবাসায় পরিনত হয়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে আসার সময়ে অহেতুক ফুলের তোড়া, আমি চকলেট খেতে ভালবাসতাম, তাই মাঝে মাঝে চকলেট কিম্বা কোন উপহার নিয়ে আসতেন। আমাদের সম্পর্কে এক নতুন মোড় নেয়। আমি জানতাম যে আমাদের বয়সের ব্যাবধান অনেক, আমি জানতাম ভালোভাবে যে আমি কোন পথে চলেছি, কিন্তু আমি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারিনি। ওনার চোখে, ওনার আচরনে আমি আমার ভালোবাসা পুনরায় খুঁজে পাই। সেই পুরানো কচি মেয়েটা আবার আমার মধ্যে জেগে ওঠে, বুক ভরে মুক্তির শ্বাস নিলাম আমি।”
“মিস্টার গুহ’র সাথে দেখা হওয়ার প্রায় দু’বছর পরে, একদিন বিকেলে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি তাঁর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে। আমি মিস্টার গুহ’র সামনে একটা শর্ত রাখলাম, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমাকে তাঁর অতীত জানাতে হবে। তিনি রাজি হলেন, যে আমাকে তাঁর অতীতের কথা, মঞ্জুষা’দির কথা, তোমার কথা, সব বলবে। আমরা দু’জনে আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে গেলাম, বাবা মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দেন না। বলেন যে, মিস্টার গুহ আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়, সেমত অবস্থায় এই বিয়ে হতে পারে না। আমার দৃঢ়সঙ্কল্প’র সামনে বাবা মা শেষ পর্যন্ত ঝুঁকে যান, এবং আমাদের বিয়েতে আসেন। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ছোটো করে হয়েছিল, গোটা কুড়ি বাইশ জন খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে বলা হয়নি সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমার স্বপ্ন ছিল আমার খুব বড় করে বিয়ে হবে, কিন্তু পাশে যখন ভালোবাসার মানুষকে পেলাম তখন আর সেই অলিক স্বপ্ন ছেড়ে মিস্টার গুহ’কে বুকে টেনে নিলাম।”
“সেই প্রথম রাতে আমি মিস্টার গুহ’কে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম যে তাঁর অতীতের কথা না জানালে তিনি আমাকে চিরতরে হারাবেন। আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে তাঁর অতীতের কালো পাতা মেলে ধরে। টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তি আর নারীসঙ্গের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে এই পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছেন। মঞ্জুষাদি’র শত বারন সত্তেও কোন কথা কানে দেননি তিনি। নিজের মনে যা ইচ্ছে হত তাই করতেন, শেষ পর্যন্ত মঞ্জুষাদি’কে একদিন বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন, বলেন যে সে আর তাঁর পুত্র তাঁর চাহিদার মাঝে দাঁড়িয়ে, তাদের তিনি মুখ দেখতে চাননা। তোমাকে তাঁর আগেই হস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চোখে জল, বুকে অনুতাপ, কাঁধে অসীম পাপের বোঝা, ঝুঁকে পড়েছেন মিস্টার গুহ। আমার হাত ধরে কাতর মিনতি করেন তাকে সেই পাপের বোঝা থেকে মুক্ত করতে। আমি তাঁর চোখের জলে, তাঁর নতুন রুপের সামনে গলে গিয়ে বুকে টেনে নিলাম। আমি তাকে বলি যে সেদিন থেকে তাঁর সব কষ্ট সব দুঃখ আমি বরন করে নিলাম। সেইদিন আমি বাড়ির নাম মঞ্জুষা মন্দির রাখি। সেটাই আমার উচিত মনে হয়েছিল।”
“একটা অতি পুরানো কাঠের বাক্স থেকে একটা এ্যালবাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন, তাঁর অতীত সেই হলদে কাগজে আটকা পরে আছে। আমাকে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি দেখিয়ে বললেন যে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি বুকে টেনে বলি যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া জীবন হয়ত ফিরিয়ে দিতে পারবোনা, তবে ওনার ভবিষ্যৎ নিজে হাতে সুন্দর করে তুলবো।”
“দিন যায়, বাড়ির নতুন রানী আমি। আমি ব্যাবসার কাজে ডুবে গেলাম, নিজে হাতে সেই কোম্পানির ভার নিলাম। মিস্টার গুহ’র দুই দুই বার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে, তাই তাকে শুধু অফিস আর বাড়ি করতে নির্দেশ দিলাম। একটি নরম মেয়ে ধিরে ধিরে এক কোম্পানির কর্ণধারে পরিনত হল। আমি আমার সংসার আমার কাজ নিয়ে মেতে উঠলাম। আমাদের ভেতর থেকে মঞ্জুষাদি হারিয়ে গেল। বিয়ের পাঁচ বছর পরে বাপ্পার জন্ম হয়। আমি বাপ্পার নাম রেখেছিলাম তোমার নামের সাথে মিলিয়ে, হয়ত কোনদিন ওর দাদার সাথে দেখা হবে না, তবে নামের মধ্যে হয়ত জানবে যে ওর একটা দাদা এই পৃথিবীতে আছে। বাপ্পা জন্মাবার পরে মিস্টার গুহ চাকরি থেকে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিলেন, সারাদিন বাড়িতে থাকতেন আর বাপ্পার সাথে সময় কাটাতেন। কোন কোন দিন দুপুরে যদি অফিস থেকে বাড়ি আসতাম তাহলে দেখতাম যে বাপ্পা মিস্টার গুহ’র পেটের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে। ওদের দুজনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগত।”
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে গেস্টরুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখে, কচি শিশু বাপ্পা, বিশাল বিছানায় উলটে শুয়ে, লাল পদ্মের মতন গোল মুখ, টোপা টোপা নরম গাল, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ খোলা, গায়ের ওপরে চাদর। দেবস্মিতার চোখের কোনা চিকচিক করছে, বাপ্পাকে আর বুধাদিত্যকে দেখে।
দেবস্মিতা চোখের কোল মুছে বুধাদিত্যকে বলেন, “গত বছর, জুলাই মাসে, আমি অফিসের কাজে একটু ব্যাস্ত ছিলাম। বাপ্পা আমার পায়ের কাছে, টেবিলের নিচে খেলছিল। খুব বায়না ধরে লুকোচুরি খেলার জন্য, ওর সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারতাম না, তাই লুকোচুরি খেলতে বসে গেলাম। বাপ্পা লুকিয়ে গেল একটা আলমারির ভেতরে। আমি খুঁজতে গিয়ে সেই আলমারির নিচে খুঁজে পেলাম সেই পুরানো কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে এ্যালবাম হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাতা উলটাতেই আমার সামনে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি চলে এল। কাগজের ভেতর থেকে তোমার আর মঞ্জুষাদির চোখ আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে হাসছে। সেই ছবি দেখে আমার চোখে জল চলে আসে, আমি বাপ্পার দিকে তাকালাম। এই বিশাল পৃথিবীতে কোন এক কোনায় এক মাতৃহীন ছেলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই নিস্পাপ ছেলেটা যদি আমার বাপ্পা হত তাহলে...” কেঁপে ওঠে দেবস্মিতার গলা, মুখে হাত চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেন তিনি।
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী (#4)
দেবস্মিতা ধরা গলায় বলেন, “সেই ছেলেটার কি দোষ, সেও চেয়েছিল এক সুন্দর জীবন, সেও চেয়েছিল ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে, অন্যের পাপের বোঝা ঘাড়ে করে কেন সেই ছেলেটা এই বিশাল পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়াবে। আমি সেদিন সেই ছবি নিয়ে মিস্টার গুহ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিস্টার গুহ’র হাত বাপ্পার মাথায় রেখে বললাম, যে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, তোমাকে ডাকতে, তোমার প্রাপ্য তোমাকে ফিরিয়ে দিতে। মিস্টার গুহ ইতস্তত করেন, তিনি জানান যে তিনি তোমার কোন খবর জানেন না। আমি তাঁর কথা মানতে পারলাম না, আমি জানিয়ে দিলাম যে তিনি যদি তোমার সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন না করেন তাহলে আমি বাপ্পাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। মিস্টার গুহ বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলেন যে তিনি সচেষ্ট হবেন তাঁর পুত্রের সাথে যোগাযোগ করতে। সাথেসাথে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র তাকে ক্ষমা করে দেবে না। আমি জানিয়ে দিলাম, যে ক্ষমার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তাঁর অতীতের জন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনা, কেউ যদি পারে তিনি মঞ্জুষা’দি আর বুধাদিত্য।”
“অনেক জোর করার পরে মিস্টার গুহ রঞ্জন বাবুকে ফোন করেন। তোমার মামিমা ফোন ধরে অবাক হয়ে যান, বেশ কিছুক্ষণ তিনি কথা বলতে পারেন না। আমি বুঝতে পারি তোমার মামিমার রাগ আর বিদ্বেষ। আমি মিস্টার গুহকে তাঁর সামনে অনুরোধ করতে বললাম, যে একবারের জন্য তিনি যেন তোমার ফোন নাম্বার দেন। তোমার মামিমা, শেষ পর্যন্ত তোমার ফোন নাম্বার দিলেন। আমি মিস্টার গুহকে সেইক্ষণেই তোমাকে ফোন করতে বললাম। হাত কাঁপছিল তাঁর, চোখে অনুতাপের অশ্রু নিয়ে ফোন করেছিলেন তিনি। তাঁর পরের ঘটনা তুমি জানো ভালো করে। তোমার সাথে কথা বলার সময়ে তিনি জানতেন যে তুমি মিস্টার গুহ’কে ছেড়ে কথা বলবে না, সব দোষ আমার ওপরে পরবে আর আমার ছেলে বাপ্পার ওপরে পরবে।”
বুধাদিত্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, চোখে জল নেই, বুক ফাঁকা, ধিরে ধিরে জীবনের অঙ্ক মিলছে চোখের সামনে। বুধাদিত্যের সামনে এক কলুষিত দেবী বসে, সমাজ অনেক ঘৃণ্য নাম দিয়েছিল তাঁকে। সেই সব পার করে, এক পাপী আত্মা কে বুকে করে পাঁকের জীবন থেকে টেনে তুলেছে এই দেবী। দেবস্মিতা দেবীর মতন হেসে ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুমি আমাদের বাড়িতে এলে, তোমার আচরন দেখে মনে হল না যে তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পেরেছ। আমি তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারি যে তুমি আমাকেই দোষী সাবস্ত্য করেছ। আমি মিস্টার গুহ’র যখন অর্ধাঙ্গিনী তখন তাঁর পাপ ভাগ করে নিয়েছি আমি। আমি শেষ চেষ্টা করতে তৎপর হয়ে উঠলাম, শেষবারের জন্য তোমার সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলার জন্য। তোমার ঠিকানা জানার জন্য মিস্টার গুহ’কে দিয়ে অনিন্দিতাকে ফোন করালাম। তোমাকে এখানে না জানিয়ে আসার একটাই কারন, তোমাকে জানালে তুমি হয়ত আমাদের আসতে বারন করতে। তাই ভাবলাম একবারে এখানে এসে তোমার সাথে যোগাযোগ করা, চোখের সামনে দেখে অন্তত ফেলে দিতে পারবে না আমাদের।”
বুধাদিত্যের সামনে মিনতির সুরে ধরা গলায় বলেন, “আমি যখন মিসেস গুহ হবার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম, সেই সময়ে আমি জানতাম মিস্টার গুহ কি রকম মানুষ ছিলেন। তিনি বদলে গেছেন, বুধাদিত্য। আজ তিনি এক অন্য মানুষ। আমি জানিনা, তুমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা, কেননা তিনি তোমার অতীত তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।” দুই হাত জোর করে কেঁদে বলেন, “আমার ছেলেটা কোন পাপ করেনি, বুধাদিত্য। তোমার বিদ্বেষের অভিশাপ যেন ওর কাছে না আসে। শুধু তোমার একটু আশীর্বাদ চাইতে এসেছি, বুধাদিত্য, দয়া করে ফিরিয়ে দিও না আমাকে। আমি ভিক্ষে চাইছি, বুধাদিত্য।” দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন দেবস্মিতা।
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে বাপ্পাকে দেখে, এই শিশু কি সত্যি পাপ করতে পারে? ছোট্ট একটি ফুলের কুঁড়ি, এখন জীবন পরে আছে সামনে। বুধাদিত্য ত ভুলেই গিয়েছিল ওর বাবার কথা, তাঁর নতুন জবনের কথা। সামনে বসা এই দেবী প্রতিমা যদি এগিয়ে না আসত, তাহলে হয়ত কোনদিন যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হত না।
বুধাদিত্য কিছু পরে দেবস্মিতাকে বলে, “চিন্তা করো না, আমি তোমাদের মাঝে কোনদিন আসব না।”
চাপা আঁতকে ওঠেন দেবস্মিতা, “না, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পার না। ধানবাদের যা কিছু আছে তাতে বাপ্পার যেমন অধিকার তোমার সেই এক অধিকার। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “আমি কোথাও যাইনি, আমাকে কোথায় ফিরিয়ে নেবে?”
দেবস্মিতা, “তোমার বাবার কাছে, মিস্টার গুহ’র কাছে।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে চুপ করে মাথা দোলায়, কিছু পরে বলে, “তুমি সত্যি একজন দেবী। সব কিছু জেনেশুনে একজন পাপী আত্মার বিষ বুকে টেনে তাঁকে শুদ্ধ করে দিয়েছ। তোমার কথা কি করে ফেলব। ঠিক আছে আমি ছুটি পেলে নিশ্চয় যাব ধানবাদ। আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখব। কিন্তু আমি মিস্টার গুহ’র এক পয়সা নেব না, ক্ষমা করে দিও। আমার সম্পত্তি আমার মা, আমার সাথে আছেন, তাতেই আমি শান্তিতে আছি। আমাদের এই নতুন সম্পর্কের মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে না আসাটাই শ্রেয়।”
দেবস্মিতা চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলেন, “আমি বড় আশা করে এসেছিলাম, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।”
বুধাদিত্য, “না ম্যাডাম, সেটা সম্ভব নয়। দয়া করে সেই অনুরোধ দ্বিতীয় বার করো না, আমি মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারব না তাহলে।”
দেবস্মিতা, “আর বাপ্পা?”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “বুধাদিত্যের ভাই বাপ্পাদিত্য, আমার আশীর্বাদ সব সময়ে ওর সাথে। সত্যি বলছি, আমি ধানবাদ না গেলে জানতেই পারতাম না যে আমার একটা ভাই আছে।”
দেবস্মিতা অবশেষে চোখের জল মুছে হেসে বলেন, “আমি তাহলে মিস্টার গুহ’কে ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমি শেষ পর্যন্ত আমার কার্যে সফল হয়েছি।”
বুধাদিত্য ঠিক বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, “মানে?” ঘড়ি দেখে সকাল প্রায় চারটে বাজে, “তুমি এখন ফোন করবে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ, তিনি জেগে আছেন। তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন, দাঁড়াও একটু কথা বল তাঁর সাথে। তোমার গলার আওয়াজ শুনে হয়ত একটু ঘুমাতে পারবেন।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “বয়স হয়েছে, ফোন করে ঘুমাতে বল এখন। কাল কথা হবে।”
দেবস্মিতা ফোন করেন সুবির বাবুকে, “ওষুধ খেয়েছিলে? রতন ঠিকঠাক খাবার দিয়েছিল?” “হ্যাঁ, বাপ্পা ঘুমাচ্ছে।” “হ্যাঁ, আমার সামনে বসে আছে।” “চিন্তা করো না। আমি কথা দিয়েছিলাম, ফিরিয়ে এনেছি আমি।” “না, সেটা আর হল না। তোমার ছেলে অনেক ঋজু, নিজের আত্মসন্মান আছে।” “তুমি এখন শান্তিতে ঘুমাও, পরে ফোন করব।” “কথা বলবে? ঠিক আছে দিচ্ছি।” ফোন বুধাদিত্যের হাতে ধরিয়ে বলেন, “একটু কথা বল না হলে ঘুমাবেন না।”
সুবির বাবুর গলা কেঁপে ওঠে, “কেমন আছো?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “এক প্রশ্ন কয় বার করবে। ঘুমাতে যাও, আর পারলে কালকে বা পরশুর ফ্লাইট ধরে চলে এস।”
কেঁদে ফেলেন সুবির বাবু, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
বুধাদিত্য, “ঠিক আছে, চলে এস। এখন ত ঘুমাও” ফোন দেবস্মিতাকে ফিরিয়ে দেয়।
ভোরের নবীন ঊষার আলো, খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসে।
দেবস্মিতা ফোন রেখে ওর দিকে হেসে বলেন, “মিসেস গুহ হিসাবে যে সম্পর্ক আমাদের হওয়া উচিত সেই মর্যাদা তুমি দেবে না আমি জানি আর সেটা চাইতেও আসিনি।”
হাঁ করে থাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। আবার কোন নতুন হেঁয়ালি শুরু করল দেবস্মিতা, সেই ভাবতে থাকে।
দেবস্মিতা বলে, “আমি বাড়ির ছোটো ছিলাম, খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা ভাই হোক। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমাদের মাঝে হতে পারে না। তাই না?”
বুধাদিত্য বুঝতে পারে কি বলতে চায় দেবস্মিতা। হেসে বলে, “তুমি দেবী, সুতরাং তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকব ব্যাস। আর সম্পর্কের অলগলিতে ঘুরতে চাই না।”
স্বস্তির শ্বাস নিলেন দেবস্মিতা, জিজ্ঞেস করেন “কফি খাবে?”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “তোমার ঘুম পাচ্ছে না?”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “দশ বছর অপেক্ষা করেছিলাম এই দিন’টার জন্য। আমার না ঘুমালেও চলবে, তুমি ঘুমাতে যেতে পার।”
দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু’কাপ কফি বানিয়ে এনে বুধাদিত্যের সামনে বসে। কফির কাঁপে চুমুক দিয়ে বুধাদিত্যকে প্রশ্ন করে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি, যদিও প্রশ্ন টা অনেক ব্যাক্তিগত, তাও উত্তর জানালে একটু খুশি হব।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “কি?”
দেবস্মিতা মৃদু হেসে বলে, “তোমার রান্নাঘর, সোফার কভার, বাড়ির দেয়াল ইত্যাদি দেখে মনে হয় তোমার জীবনে কেউ আছে, সত্যি কি না জানিনা।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শেষ পর্যন্ত দেবীর কড়া নজরে ধরা পরে গেছে। হেসে বলে, “কি জানি ঠিক জানিনা, আছে কি নেই।”
দেবস্মিতা, “কি ব্যাপার, কি অসুবিধে একটু জানতে পারি কি?”
বুধাদিত্য একটু খানি চুপ করে থেকে বলে, “আমি একজনকে ভালোবাসি।”
শেষ পর্যন্ত নিজের হৃদয়ের কথা ভালোবাসার মানুষকে না জানিয়ে অন্য কাউকে জানাতে হচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে এক অব্যাক্ত ব্যাথা শুরু হয় বুধাদিত্যের।
দেবস্মিতা বড় বড় চোখ করে হেসে বলে, “বেশ ভাল কথা, কবে বিয়ে করছ?”
বুধাদিত্যের মুখ শুকিয়ে যায় ঝিলামের কথা ভেবে, “বিয়ে হয়ত হবে না আমাদের।”
ঝিলাম কিছুদিন পরে সমীরের সাথে বেড়াতে যাবে, ঝিলাম আর সমীরের সুখের সংসার থেকে দুরে সরে যেতে যায়।
দেবস্মিতা, “কেন? অসুবিধে কোথায়?”
বুধাদিত্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেবস্মিতা ওর পাশে বসে ওর পিঠের ওপরে হাত রেখে মৃদু সুরে বলে, “দেবী বলে ডেকেছ, আর নিজের মনের কষ্ট একটু জানাবে না?”
নরম হাতের পরশে মায়ের কথা মনে পরে যায় বুধাদিত্যের, চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে বেদনায়। কোনোরকমে আবেগ সামলে বলে, “বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক, দেবী। জানিনা শুনলে তুমি আমাকে কি বলবে। আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার বন্ধুর বৌ, নাম ঝিলাম। সমীরের সাথে বিয়ে হয় বছর তিন আগে। এই গত বছর দিল্লীতে দেখা, এখন দিল্লীতে থাকে। সমীর আর ঝিলামের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরে খুব টানাপড়েনের মধ্যে চলে। সমীর কাউকে ভালোবাসে বা ভালবাসত। আমি ভেবেছিলাম যে হয়ত ওদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যাবে আর আমি ঝিলামকে আমার করে নিতে পারব। কিন্তু কিছুদিন আগে সমীর ফিরে আসে ঝিলামের জীবনে। আমি সেই একা।”
দেবস্মিতা পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনদিন তোমার মনের কথা ঝিলামকে জানিয়েছ?”
বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “না।”
দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করে, “ঝিলাম তোমাকে ভালোবাসে?”
বুধাদিত্য শূন্য চোখে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবস্মিতা বুঝে যায় যে বুধাদিত্য অথবা ঝিলাম কেউ পরস্পরকে মনের কথা জানায়নি।
চিন্তায় পরে যায় দেবস্মিতা, “সত্যি বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক। এখানে কিছু করা মানে সবার চোখে পাপী, ব্যাভিচারি হয়ে যাওয়া, এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরা। কি করবে ভেবেছ?”
বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “জানিনা, দেবী। আমি সত্যি নিজের কাছে হেরে গেছি। ওদের মাঝে যেদিন বুঝব যে ভালোবাসা ফিরে এসেছে, সেদিন আমি দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাব। আমি জানি, আমি যদি ঝিলামের চোখের সামনে থাকি তাহলে সমীরকে মেনে নিতে ঝিলামের বড় কষ্ট হবে। আমি চাই না ওদের ভালোবাসার মাঝে কাটা হয়ে দাঁড়াতে।”
দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি হারতে পার না, বুধাদিত্য। আমার মন বলছে, একদিন এই কালো মেঘের মাঝ খান থেকে এক নতুন সূর্য উঠবে, তোমার মনের সব কালিমা দূর করে দেবে। সত্যি যদি তোমাকে কোথাও যেতে হয়, তুমি আমার কাছে চলে এস। আমার বাড়ি, তোমার বাবার বাড়ির দরজা তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছে বুধাদিত্য।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “ভেবে দেখব দেবী। যাও একটু বিশ্রাম করো, আমাকে নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও।”
সকাল বেলায় বুধাদিত্য মামাকে ফোন করে সব কথা বলে। প্রমীলা দেবীর মন একটু খারাপ হয়ে যায়। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে মামিমা ভাবছেন যে ছেলে বাবা পেয়ে হয়ত তাকে ভুলে যাবে। বুধাদিত্য মামিমাকে আসস্থ করে, “পমুসোনা”র জায়গা ওর জীবনে অন্য কেউ নিতে পারবে না। বাবাকে হয়ত ফিরে পেয়েছে, কিন্তু রঞ্জনবাবুকে জানায় যে সুবিরবাবু কর্মে নয়, শুধু মাত্র জন্ম দিয়েছেন বলে তাঁর বাবা। তৎক্ষণাৎ প্লেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয় মামা মামীকে। বিকেলের মধ্যে প্রমীলাদেবী আর রঞ্জনবাবু দিল্লী আসেন। প্রমীলাদেবী দেবস্মিতাকে দেখে তার সাথে কথা বলে আসস্থ হন। বাপ্পাকে দেখে বেশ খুশি হন। রাতের মধ্যে সুবিরবাবু দিল্লী পৌঁছান। বাড়ি লোকজনের সমাগমে মুখর ওঠে, ছোট্ট বাপ্পা মায়ের কোলে চেপে নতুন লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুবিরবাবু অনেক চেষ্টা করেন ছেলেকে ধানবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার। বুধাদিত্য সুবিরবাবুকে শোয়ার ঘরে মায়ের ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দেয়’যে ওর মা ওর সাথেই আছে, আর এই সম্পত্তি নিয়ে অথবা ধানবাদ যাওয়া নিয়ে যেন কথা না বলে। জানায় যে, নতুন সম্পর্কে টাকা পয়সা না আসলেই ভালো, মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। বুধাদিত্যের জীবনে সব আছে নতুন আর কিছু চায় না।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment