আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight)
Written By pinuram
Written By pinuram
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তপ্ত বালুচর
পরীর আত্মসমর্পণ (#01)
উড়তে মানা আকাশের তোর, বসতে মানা ডালে,
বাসা বাঁধিতও মানা, কি আছে কপালে,
বলি ঝরে হারাতে ত মানা নাই।
ওরে মন পাখি, কেন ডাকাডাকি, তুই থাক না গোপনে,
উড়তে আছে মানারে বন্ধু এই খোলা আসমানে,
তুই থাক না গোপনে।
রাজকন্যে ফিরে আসে তাঁর সোনার খাঁচায়, তাঁর যে আর মাথা গোঁজার জায়গা নেই। ভগ্ন হৃদয়, আশার সব আলো নিভে গেছে। দিগন্তের বুকে সেই ছোটো জাহাজের মাস্তুল ধিরে ধিরে বাঁকা দিগন্তের তলায় তলিয়ে গেল। সেই সাদা ঘোড়া আর ফিরে এল না, পরীর কাঁধ ছুঁয়ে আদর করল না, পরী ওর ডাকের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু শূন্য সে বুক। চারপাশে শুধু অন্ধকারে ঢাকা।
আগস্টে আমি আঠাশ বছরে পা দিলাম। আমি নিজেকে শামুকের খোলে মধ্যে গুটিয়ে নেই, আমার ঘর থেকে খুব বের হতাম। কলেজ শেষ, রান্না ঘর আর আমার ঘর আমার সব কিছু ছিল। বাইরের জগতের সাথে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছোটমা বাবু আমার চেহারা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। মা চলে যাওয়ার পরে আমি যেন কোন কিছুতে আর খুশি খুঁজে পাইনা। সেই সাদা ঘোড়া আর কোনদিন আমার কাছে ফিরে আসবে না, সেটা আমি ভালো ভাবে বুঝতে পেরে গেছিলাম। মায়ের চিতার আগুনে আমার সব আশা, সব আখাঙ্খা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমার মা ছোটমাকে জানাতে পারলেন না তাঁর মনের অভিপ্রায়। সাদা ঘোড়া চিরতরে হারিয়ে গেল। মায়ের সাথে সাথে সেই “অপ্টিক্স নোটবুক” বইয়ের তাকে ঢুকে পরে, সেই ডায়রির লেখার কোন মানে নেই আর।
ছোটমা একদিন আমার ঘরে এসে আমাকে বললেন, “সোনা মা, আমি তোর মায়ের মতন।”
আমি করুন চোখে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, হ্যাঁ সত্যি তুমি আমার মায়ের মতন কিন্তু আমার মা নও। আমি ছোটমাকে ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করি, “আর কি চাও আমার কাছ থেকে, ছোটমা?”
ছোটমা, “ওই রকম ভাবে আমার সাথে কথা বলছিস কেন? এক মা তাঁর মেয়ের কাছে কি আর চাইবে, তাঁর ভালোই চাইবে।”
আমি তোমার মেয়ে হতে চাইনি ছোটমা, আমি তোমার বাড়ির বউমা হতে চেয়েছিলাম। পূরণ করতে পারবে আমার মনের আশা? আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি আমার জন্য ছেলে খুঁজছও?”
ছোটমা মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে, পরী, আমি আর তোর বাবু, তোর জন্য ছেলে খুঁজছি।”
আমি ছোটমায়ের কথা শুনে একটু রেগে যাই, বলি, “আমি স্কুল টিচার হতে চেয়েছিলাম, তাঁর কি হবে? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে।”
ছোটমা আমার পাশে বসে আমার গালে হাত রেখে আদর করে বলেন, “সোনা মা, আমি তোর জন্য সেই রকম ছেলেই খুঁজব যে তোকে চাকরি করতে দেবে, তোকে পড়াশুনা করতে দেবে। বিশ্বাস কর।”
আমি ফুঁপিয়ে উঠি, “যত তাড়াতাড়ি পারো তুমি আমাকে বাড়ি থেকে তারাতে চাও, তাই না?”
ছোটমা মৃদু বকুনি দিলেন আমাকে, “কি সব উল্টপাল্টা বলছিস তুই, আমি কেন তোকে তাড়াতে চাইব।”
আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, চোখের সামনে সব আলো নিভে গেছে। হারানোর মতন আমার কাছে আর কিছু নেই। মনের মধ্যে সব সাহস সঞ্চয় করে ছোটমাকে বলি, “আমার যাওয়ার কোথাও আর জায়গা নেই তাই কি তুমি আমার জীবন নিয়ে খেলা করছ? আমি এখন বিয়ে করব না, আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো, সেখানেই থাকব।”
ছোটমা গম্ভির সুরে বলেন, “তুই ফিরে যেতে পারিস না, আমি তোকে যেতে দেব না। কে তোকে দেখবে? তোর দাদারা? না, ওদের নিজেদের সংসার আছে, ওরাও তোকে বিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। তুই ভালো করে ইন্দ্রানি আর শশাঙ্কর অভিপ্রায় জানিস।”
আমি ছোটমায়ের দিকে আশাহত হয়ে তাকিয়ে থাকি, সত্যি আমার আর কেউ নেই দেখার। আমি ছোটমাকে জানাই যে আমার কিছু সময় চাই ভেবে দেখার জন্য। ছোটমা আমাকে জানান যে কোলকাতার পেপারে আমার বিয়ের জন্য ইস্তেহার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই কথা শুনে আমার মনে হল যেন কেউ গরম তেল আমার মাথার ওপরে ঢেলে দিয়েছে।
আমি জোর গলায় ছোটমাকে বলি, “আমাকে জিজ্ঞেস করার কথা একবারের জন্যেও তোমার মনে হল না?”
খুব ধীর শীতল গলায় উত্তর দিলেন ছোটমা, “আমরা যা কিছু করছি সেটা তোর ভালোর জন্যেই করছি। তোর কিসে ভালো কিসে মন্দ আমরা ভালো করে জানি।”
ছোটমা চলে যাওয়ার পরে আমি চুপ করে বিছানায় বসে থাকি। বাইরের আকাশের মতন মন ভারাক্রান্ত। বর্ষাকাল শেষ, কিন্তু আকাশ একটু মেঘলা। ওর কাছ থেকে কোন যোগাযোগ নেই, আমি আশাহত।
প্রতিদিন বিকেলে দেখতাম আমার বিয়ের জন্য অনেক ফোন আসে। বাবু সেই ফোন ধরে সব কিছু লিখে নিতেন। আমি কিছু বলতাম ওদের। মাঝে মাঝে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করত যে কি ধরনের ছেলে আমার পছন্দ, তাঁর উত্তর আমি দিতাম না।
একদিন আমি ছোটমাকে বলি, “ছোটমা, আমি তোমার সব ঋণ শোধ করে দেব। আমি তোমার রক্ত মাংসের মেয়ে নই, তা সত্তেও তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ। কিন্তু...”
ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিন্তু, কি পরী?”
আমি বুক ভরে এক শ্বাস নেই, কিছুক্ষণ বাবু আর ছোটমার দিকে তাকিয়ে তারপরে বলি, “একবার, শুধু একবারের জন্য আমাকে উপরের ঘরে যেতে দেবে।”
কথা বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছিল।
ছোটমা বাবু আমার মুখে ওই কথা শুনে অবাক হয়ে যান। পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করেন। বাবু গম্ভির গলায় আমাকে বলেন, “না তুমি ওই ঘরে যেতে পারবে না। ওর ঘর তালা বন্ধ।”
আমি ওদের দিকে রেগে তাকিয়ে বলি, “ঠিক আছে, তোমরা এতই যখন আমার বিয়ে নিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরেছ, তাহলে এত খুঁজছ কেন? যাকে খুশি ধরে নিয়ে আস, আমি তাঁর সাথে বিয়ে করে নেব।”
আমি ওদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেই। বুকের মাঝে আগুন জ্বলে ওঠে, বেদনার তীব্র আগুনে আমার পাঁজর, আমার রক্ত ফুটতে থাকে। চুপ করে বিছানায় বসে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে প্রতারনা করল, আমার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলে গেল, একবারের জন্য ফিরে তাকাল না, এত বার বলেও একবারের জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনা, জেগে বসে থাকি আমার অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতকে দেখার জন্য। বুক ফাঁকা, বুক চেপে কান্না দিয়ে ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু বুকের আগুন হাথের ছোঁয়ায় আরও ধিকধিক করে জ্বলে ওঠে।
মাঝ রাতে দরজায় আওয়াজ শুনে আমি উঠে দরজা খুলি। দরজায় ছোটমাকে দেখে আমি একটু থমকে যাই। ছোটমা আমার হাথে ওর ঘরের চাবি দিয়ে করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ছোটমায়ের দুচোখে জল, আমি হাথ থেকে চাবি নিয়ে ছোটমায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকি। ওই চাবি যেন আমার কাছে সব কিছু।
ছোটমা চোখের জল মুছে আমাকে নিচু গলায় বলেন, “সোনা মা, যা। কিন্তু সকালে আমি যেন সঠিক উত্তর পাই।”
আমি ধিরে ধিরে সিঁড়ি চড়ে ওর ঘরের সামনে এসে দাড়াই। বুকের মাঝে এক উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পরে। শ্বাস বন্ধ করে নেই, তালা খোলার আগে। নিচের ঠোঁট চেপে ধরে থাকি, মনে হয় যেই আমি তালা খুলে ভেতরে ঢুকব, সেই খনে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরবে। আমি শেষ পর্যন্ত তালা খুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ি। গত দু’বছর এই ঘর বন্ধ ছিল, কারুর পায়ের চিহ্ণ নেই গরের ধুল মলিন মেঝের ওপরে। বন্ধ থাকার জন্য ঘরের হাওয়া গুমোট বেঁধে থাকে। সেই গুমোট গন্ধে আমার বুক কেঁপে ওঠে, ঠিক যেন একটা ছোটো দিপের শিখা ঝড়ো হাওয়ায় দুলে ওঠে। টেবিলের নিচে এক কোনায় একটা ইদুর মরে পরে আছে। ওর পড়ার টেবিল, চেয়ার ধুলোতে ঢাকা। বিছানার চাদর গত দু’বছরে বদলানো হয়নি। টিকটিকির মল আর ইঁদুরের মল ছড়িয়ে আছে বিছানার চাদরের ওপরে। খাটের দুপাশে মাকড়সার জালে ভর্তি।
আমি জানালা খুলে দিয়ে নতুন বাতাসকে আহবান জানাই সেই বদ্ধ ঘরের ভেতরে। চেয়ারের ধুলো ঝেরে জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসে পরি। চোখের কোনে জল চলে আসে, বুক কেঁপে ওঠে ওর কথা মনে করে। না কিছুতেই কাঁদব না, কার জন্য কাঁদব আমি, যে কিনা আমাকে ভুলে গেছে? ঠিক চলে যাওয়ার আগের দিনে আমি ঠিক সেইখানে বসে ছিলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছবি আঁকছিল। আমি সেইদিকে তাকিয়ে থাকি, হয়ত বাঁ এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমার চোখে শুধু অন্ধকার দেখে, না ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, সব আমার মনের ভ্রম। আমি টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখি একটা ছোটো কাঠের বাক্সে কত গুলো কাঁচের গুলি রাখা। আমি আবার সেই বাক্স যথাস্থানে রেখে দিলাম।
শেষ বারের মতন ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। জানালা বন্ধ করে দিলাম। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি, চোখের পাতা ভিজে আসে। শেষ পর্যন্ত তালা বন্ধ করে দিলাম দরজায়, সেই তালার পেছনে আমার সব আশা সব ভালোবাসা বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে চলে এলাম। ছোটমা বসার ঘরে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আমি ছোটমায়ের হাথে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলি, “আমার আর কোন পথ নেই, যেখানে ভাগ্যবিধাতা আমাকে নিয়ে যাবে, আমি চুপ করে সেখানে যাবো।”
সেইরাতে শেষ বারের জন্য আমি ওর “অপ্টিক্স নোটবুক” তাক থেকে বের করি। ডায়রি আর ওর দেওয়া সেই বুদ্ধের মূর্তি একটা কাগজে মুড়ে একটা বাক্স বন্দি করে দেই। সেই বাক্স আমি মোম দিয়ে এটে দেই।
একদিন আমি ছোটমাকে বলি যে আমি কল্যাণীর সাথে দেখা করতে যাবো। ছোটমা মানা করেন নি। আমি কল্যাণীর বাড়ি যাই, ওর হাথে সেই বাক্স তুলে দিয়ে বলি, “আমার জীবন শেষ।”
কল্যাণী বাক্স হাথে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর মানে।
আমি বলি, “এই বাক্সে কিছু অকেজো জিনিস আছে। আর আমার কাজে লাগবে না ওর ডায়রি। আমার এত শক্তি নেই যে আমি ওর ডায়রি জ্বালিয়ে দেই, তাই তোর কাছে নিয়ে এলাম আমি। তুই আমার হয়ে এই টুকূ কাজ করে দে, পারলে এই জিনিস গুলো ধ্বংস করে দিস। ছোটমা বাবু আমার জন্য ছেলে খুঁজছে, কিছুদিনের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে যাবে।”
কল্যাণী আমার কথা শুনে আঁতকে ওঠে, “কি বলছিস তুই? ও যদি ফিরে আসে?”
আমি ম্লান হেসে ওকে বলি, “দু বছর, দু বছর আমি ওর জন্য অপেক্ষা করে করে হাঁপিয়ে গেছি। একবারের জন্যেও আমার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করল না। ভুলে গেছে আমাকে, ভুলে গেছে ও কাউকে ভালবাসত। ভালোবাসা ওর জন্য নয়, ও এক কাপুরুষ, হৃদয় হীন মানুষ। নিজের বাবা মায়ের কথাও ভুলে গেছে।”
আমার চোখে সেদিন জল ছিলনা, কিন্তু আমার কথা শুনে কল্যাণীর চোখে জল চলে আসে। আমার ফাঁকা বুক, সেই চোখের জল ভরিয়ে দেইতে পারেনা। বেদনায় আর রাগে আমার হাত পা কেঁপে ওঠে। আমি ওর কান্না দেখে ওকে বলি, “কেন এক অভাগিনী মেয়ের জন্য চোখের জল ফেলছিস তুই? কেঁদে লাভ নেই রে।”
আমি ওর গালে হাত দিয়ে বলি, “তুই সুখী থাক, খুব ভালো মা হবি তুই।”
কল্যাণী আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, “পরী...”
সেই নাম শুনে আমার কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। আমি ধরা গলায় ওকে বলি, “কল্যাণী, পরী অনেক দিন আগেই মরে গেছেরে। তোর সামনে এক অন্য মেয়ে দাঁড়িয়ে, মিতা, জানিনা এই মিতার ভবিষ্যতে ভাগ্যবিধাতা কি লিখে গেছে।”
কল্যাণী আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। ওর হাতের স্নেহের স্পর্শে আমার মন গলে যায়, আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠি। কল্যাণী আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে সান্তনা দেয়। আমি ওকে বলি, “কল্যাণী রে, যেদিন ছোটমা ওকে বের করে দেয় সেইদিন পরী মরে গেছে। যেদিন আমার মা মারা যান সেদিন পরী মারা যায় আবার। আমার বুকে বেশি প্রাণ বেঁচে নেইরে কল্যাণী, বারেবারে আমি মরতে পারিনা রে। আমি আমার ভাগ্যের কবলে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছি রে।”
সেইদিন আমি আর গ্রামের বাড়িতে গেলাম না, আমি সারাদিন কল্যাণীর সাথেই ছিলাম। বিকেলে আবার বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বাড়ি ফেরার আগে কল্যাণীকে আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে আসি আমার বিয়েতে আসার জন্য। কল্যাণী ওর গর্ভের ওপরে হাত বুলিয়ে আমার দিকে হেসে বলে, “লাথি মারছে রে। জানিনা তোর বিয়ে কবে, জানিনা যেতে পারবো কিনা, তবে কথা দিচ্ছি যে দীপঙ্কর যাবে।”
পরীর আত্মসমর্পণ (#02)
আমি ফিরে আসি আমার খাঁচায়, হাসতে ভুলে, কাঁদতে ভুলে এক পাথরের মূর্তির মতন দিন গুনতে আরম্ভ করি আসন্ন অন্ধকার দিগন্তের জন্য। কয়েকদিন পরে ছোটমা আমাকে জানায় যে তাদের সাথে আমাকে একটা বিয়ে বাড়ি যেতে হবে। আমি অনুধাবন করেছিলাম যে, বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন উপলক্ষ মাত্র, আসল উদ্দেশ্য মেয়েকে দেখানোর। ছোটমা আমাকে সুন্দর করে সাজতে বলেন আর বলে সেই তুঁতে রঙের শাড়ি পড়তে। আমি কোন বাঁধা দেই না ওদের। মন ভাসিয়ে দেই মরা গাঙ্গে।
অনেকদিন পরে সেদিন আমার যেন সাজতে ইচ্ছে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলি, কেঁদে লাভ নেই পরী, দুঃখ করেও লাভ নেই, দুহাথে বরন কর নতুন জীবন। ওকে উত্যক্ত করার জন্য যেন আমি সেদিন বেশি করে সাজি। তুঁতে রঙের শাড়ি, রুপলি সুতোর ভারী কাজ করা আঁচল, তাঁর সাথে মিলিয়ে ছোটো হাথার ব্লাউস গায়ে। কপালে গাড় নীল আর আকাশী রঙের টিপ, চোখের কোনে কাজল। মাথার চুল সাপের মতন বেনুনি করে বাঁধা, পিঠের ওপরে ঝুলে থাকে। কানে সোনার ঝুমকো, গলার ছোটমায়ের দেওয়া সেই মোটা সোনার হার। বাম কব্জিতে টাইটানের সোনার ঘড়ি আর অন্য হাথে কয়েক গাছি তুঁতে আর সাদা রঙের চুড়ি। নিজেকে দেখে নিজের বেশ ভালো লাগে।
আয়নায় দেখে নিজেকে বলি, “শুচিস্মিতা, তোকে আজ দারুন দেখতে লাগছে।”
সেদিন আমার কাঁধ কেউ ছোঁয় না, কেউ আমার কানেকানে এসে বলেনা যে আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি তার অপেক্ষাও করিনা।
ছোটমা আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলেন, “সোনা মাকে আজ দারুন দেখতে লাগছে।”
আমি ওদের দিকে হেসে বলি, “চলো। আমি ভালো করে জানি আমাকে কেন বিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছ। আমার আঠাশ বছর বয়স হয়ে গেছে, আমার মাথায় কিছু ত বুদ্ধি আছে, ছোটমা।”
ছোটমা আমার দিকে হেসে বলেন, “পরী আমরা যা করছি তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে করছি।”
পরী অনেক দিন আগেই মারা গেছে, ছোটমা, যেদিন তুমি ওকে ঘর থেকে বের করে দিলে, তাঁর সাথে সাথে সেই পরী চলে গেছে এই দেহ ছেড়ে। না আমি সেই কথা মুখে আনিনি, শুধু একটু হেসে ছোটমায়ের সাথে বিয়েবাড়ির দিকে রওনা হয়ে যাই।
বিয়েবাড়িতে কাউকেই আমি চিনতাম না, বাবুর এক আত্মীয়র বিয়ে ছিল। আমার চারপাশে লোকের ভিড়, আমি একা। পুরুষের নজর আমার দিকে, সবাই যেন আমার একটু হাসির জন্য উন্মুখ। আমি মনেমনে ওদের ভাবব্যাক্তি দেখে হেসে ফেলি। খুব একা মনে হয় এই পৃথিবীতে। আমি একটা চেয়ার নিয়ে বিয়ে বাড়ির বারান্দায় বসে আকাশের তারা গুনতে শুরু করে দেই। সামনে দুর্গা পুজো, আকাশে বাতাসে আবার আগমনীর সুর ভেসে আসে। আকাশে পোজা পোজা সাদা তুলোর মতন মেঘের ভেলা চড়ে বেড়ায়। তারা গুনতে গুনতে আমি হারিয়ে যাই ওই খোলা গাড় নীল আকাশে।
একজনের গলা খাঁকাড়ি দেয়ার আওয়াজে আমার চিন্তার তার ভেঙ্গে যায়। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক সুদর্শন যুবক আমার দিকে তাকিয়ে। বেশ লম্বা ছেলেটা, বয়স আমার কাছাকাছি হবে। শক্ত চোয়াল, সুঠাম দেহ। গাড় বাদামি সুটে বেশ সুন্দর দেখায় ছেলেটাকে। আমাকে দেখে হাত জোর করে অভিবাদন জানায়। আমি দাঁড়িয়ে উঠে প্রতি প্রনাম জানাই হাত জোর করে। একটু বিরক্ত বোধ করেছিলাম ওর অযাচিত ব্যাবহারে।
বেশ গভীর গলায় হাসি মুখে আমাকে বলে, “আমি নিলাদ্রি কর্মকার।”
আমি একটু দনামনা করার পরে উত্তর দেই, “শুচিস্মিতা।”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, আপনার নাম জানি, আপনার মা বলেছেন।”
“আমার মা?”
আমি প্রশ্ন করাতে ভদ্রলোক আমার ছোটমায়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে একটু দুরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
নিলাদ্রি, “আমার দাদা ঝামাডোবা কোলিয়ারির ম্যানেজার, আমরা ধানবাদে থাকি। আপনি ধানবাদের নাম শুনেছেন?”
আমি, “হ্যাঁ ধানবাদের নাম শুনেছি।”
নিলাদ্রি সেই ভদ্রলোকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “আমার বাবা, কমলেশ কর্মকার, ধানবাদের খুব বড় কয়লার কন্ট্রাক্টার। আমার দাদার নাম হিমাদ্রি কর্মকার, এইএসএম ধানবাদ থেকে মাইনিং নিয়ে পাস করেছে। এইএসএম জানেন?”
আমি, “হ্যাঁ নাম শুনেছি।”
নিলাদ্রি বলে, “আমি শুনেছি আপনি ফিসিক্সে এমএসসি করেছেন? আমার দাদা পড়াশুনায় খুব ভালো। দাদা মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, উনিশশো-পঁচানব্বইয়ে পাশ করেছেন।”
আমি ওর দাদার বয়স মনে মনে যোগ করে দেখলাম এই বত্রিশের মতন হবে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ছেলেটা বারবার ওর দাদার ব্যাপারে কেন বলছে, নিজের ব্যাপারে কেন কিছু বলছে না। আমাকে চেয়ারে বসতে বলে একটা সিগারেট জ্বালায়।
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, “আমার বাবা দাদার জন্য পাত্রী খুঁজছেন।”
আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি। আমার হাসি দেখে নিলাদ্রি বুঝতে পারে যে আমি এতক্ষণ ওর কথা ভাবছিলাম। নিলাদ্রি আমার চেহারার লাজুক হাসি দেখে বলে, “না না আমি নই, আমার বয়স আপনার মতন হবে এই আঠাস।”
আমি লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেলি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিলাদ্রি। আমাকে মজা করে বলে, “আপনাকে কি নামে ডাকা যায় বলুনত? শুচিস্মিতা বৌদি অনেক বড় নাম, দাঁত খুলে হাতে চলে আসবে।”
আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি, “এমি এখনো আপনার বৌদি হইনি, কিন্তু।”
নিলাদ্রি ছোটমা আর ওর বাবার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “যে ভাবে আপনার মা আর আমার বাবা কথা বলছেন, মনে হয় দাদা থাকলে আপনাদের এই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিত।”
অনেকদিন পরে মনের মধ্যে হালকা হাসির ছোঁয়া পাই আমি, ওর কথাবার্তা খুব মিশুকে, আমার খুব ভালো লাগছিল ওর সাথে কথা বলতে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “আপনার দাদা কোথায়?”
নিলাদ্রি হেসে কপাল চাপড়ে বলে, “কাজ আর অফিস। সত্যি দাদাকে আসা উচিত ছিল, আপনাকে একবার দেখলে দাদা কাজ ভুলে যাবে।”
আমার মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। নিচের ঠোঁট কামড়ে বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মুখ নিচু করে আমার কানের কাছে এসে বলে, “দাদা সত্যি আপনাকে দেখলে থাকতে পারবে না।”
ওর কথাবার্তা মাঝে মাঝে অতি বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছিল।
আমি পেছন ফিরে ছোটমাকে খুঁজতে চেষ্টা করি। ঘুরে দেখি ছোটমা আর নিলাদ্রির বাবা আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে। ছোটমা আমাকে ইঙ্গিত করেন ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে। আমি ঝুঁকে ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “অনেকদিন ধরে ছেলের জন্য একটা লক্ষ্মী ঠাকুর খুজছিলাম, তোমাকে দেখে মনে হল শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছি আমার লক্ষ্মী।”
আমি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের কোনে ছলকে আসা ব্যাথা লুকিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত আমার ভবিতব্য আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, আমার বিবাহ আসন্ন। এক নতুন দিগন্ত, এক নতুন জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
নিলাদ্রির বাবা ছোটমাকে বললেন, “হিমাদ্রির এখানে আসা উচিত ছিল, তাহলে একেবারে শুচিস্মিতাকে দেখে যাওয়া যত। আমাদের আবার আসতে হবে, মা লক্ষ্মীকে দেখতে।”
ছোটমা, “এবারে কিন্তু বৌদিকে নিয়ে আসবেন।”
এমন সময়ে বাবু এসে নিলাদ্রি আর নিলাদ্রির বাবাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
ছোটমা আমার চিবুক ছুঁয়ে বললেন, “খুব আময়িক ভদ্রলোক। হিমাদ্রি মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার।”
আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি, ছোটমা শেষ পর্যন্ত আমাকে তাড়াবার একটা উপায় তুমি খুঁজে পেয়ে গেলে।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে আসার আগে নিলাদ্রি আমার কাছে এসে বলে, “পরের রবিবার আপনাদের বাড়িতে আসছি। আমি একদম পাক্কা যে আপনি আমার বৌদি হবেন।”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলি। সেই হাসিতে খুশির আমেজ ছিলনা, আমার চারপাশে সব যেন মেকি। আমার হাসি মেকি, আমার খুশি মেকি।
বাড়ি ফেরার পরে বাবু জানালেন যে পরের রবিবার আমাকে দেখতে আসবে, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে যাবে। আমি মৃদু মাথা দুলিয়ে বাবুকে বলি, “সত্যি কি আমাকে দেখার কোন দরকার আছে?”
বাবু, “হ্যাঁ নিশ্চয় আছে।”
আমি তোমাদের গলগ্রহ, আমি বাবুকে বললাম, “তোমাদের পছন্দ হলেই হল, আমার জেনে দরকার কি যে আমি কার সাথে বিয়ে করছি? শুধু আমাকে বলে দিও এইদিনে আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে আমি বসে যাব, কাঠের পুতুলের মতন।”
ছোটমা আমাকে করুন সুরে বললেন, “পরী, দয়া করে রবিবার যেন এইরকম ভাবে ব্যবহার করিস না মা।”
আমি চোয়াল শক্ত করে ছোটমাকে বলি, “আমাকে একটু একা থাকতে দিতে পারো?”
আমি ওদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেই।
অবশেষে সেই রবিবার আসে। প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন আমি সকালে উঠে স্নান সেরে নিয়েছিলাম। পরনে ছিল একটা অতি সাধারন নীল রঙের চুড়িদার কামিজ। সকাল পড়ায় দশটা বাজে, আমি রান্না ঘরে দুপুরের খাওয়া রান্না করছিলাম। অতিথিরা, যারা আমাকে দেখতে আসবে তারা দুপুরের খাওয়া খেয়ে যাবে। তাই সেদিন অনেক প্রকারের ব্যাঞ্জন রান্না হয়েছিল, গলদা চিংড়ি, ফ্রাইড রাইস, ইলিশ মাছ আরও অনেক। ছোটমা আমাকে রান্না করতে সাহায্য করছিলেন। রান্না করতে করতে আমার মনে ওর চিন্তা এসে ভর করে। কত সাধারন ছিল ওর খাওয়া দাওয়া, একটু ডাল ভাত আলুসেদ্ধ হলে হয়ে যায়।
কলিং বেল বেজে ওঠে। বাবু নিচে দরজা খুলতে যান। ছোটমা রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে অতিথিদের আদর আপ্পায়ন করতে চলে যান, ছোটমা যাওয়ার আগে আমাকে শাড়ি পড়তে বলে যান।
আমি ছোটমাকে বলি, “আমি কি খেলার পুতুলের নাকি যে সেজে গুঁজে বসে থাকতে হবে? আমাকে যদি পছন্দ করতে হয় তাহলে এই পোশাকেই পছন্দ করবে।”
ছোটমা গম্ভীর সুরে আমাকে বকে দিলেন, “পরী ঘরে গিয়ে শাড়ি পরে নে।”
আমি রাগে দাঁতে দাঁত পিষে নিজের ঘরে ঢুকে পরি। ঢুকতে যাব, সেইসময়ে খাওয়ার ঘরে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলাকে দেখি।
সেই ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে বললেন, “না মা, তোমাকে কাপড় পাল্টাতে হবে না। তুমি যা পরে আছো তাতেই আমরা খুশি।”
ছোটমা আমাকে ইঙ্গিতে বলেন সেই ভদ্রমহিলার পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে, আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। ভদ্রমহিলা আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “ঠিক যে রকমের লক্ষ্মী চেয়েছিলাম সেরকম পেয়ে গেছি।”
ভদ্রমহিলা আমাকে বসার ঘরে আসতে বলে চলে গেলেন।
আমি ছোটমাকে বললাম যে আমার একটু সময় চাই। ছোটমা আমার দিকে একটু বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, “বেশি দেরি করিস না”
আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম চোখে মুখে জল দিতে। মনের আঙ্গিনায় এক অজানা ভিতি ভর করে এসেছে।
ছোটমা আমার কানেকানে বলেন, “পরী দয়া করে সব কিছু ভেস্তে দিস না, মা।”
আমি মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জানিয়ে দেই যে আমি কিছুই করব না, তাদের চিন্তা করতে বারন করে দিলাম। বাথরুমের আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার প্রতিফলন আমাকে বলে, “শুচিস্মিতা অবশেষে তোমার ভবিতব্য তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রানখুলে হাসি মুখে বরন করে নাও তোমার আসন্ন ভবিষ্যৎ।”
আমি সেই প্রতিফলনকে বলি, “আমি প্রাণহীন এক শ্বেত পাথরের মূর্তি, আমি আমার ঋণ শোধ করতে যাচ্ছি!”
পরীর আত্মসমর্পণ (#03)
আমি বসার ঘরে ঢুকে আড় চোখে হিমাদ্রির দিকে তাকাই। সেদিন নিলাদ্রি আসেনি। হিমাদ্রি আর তাঁর বাবা মা এসেছিলেন। আমি হিমাদ্রির দিকে দেখে ভদ্রতার জন্য হাত জোর করে প্রনাম করি। হিমাদ্রি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তরে আমাকে দেখে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। সেই ক্ষণিকের মধ্যে আমি ওকে দেখে বুঝে নেই যে আমার চেয়ে বেশি লম্বা নয় হিমাদ্রি, ওর পাশে দাঁড়ালে হয়ত আমাকে বেশি লম্বা লাগবে ওর থেকে। বিগত কয়েক মাসে আমি অনেক রোগা হয়ে গেছিলাম।
হিমাদ্রির গায়ের রঙ একটু বেশি শ্যামবর্ণের, হয়ত কাজের জন্য গায়ের রঙ পুড়ে গেছে। মাথার সামনের দিকে চুল নেই, একটু টাক। নাকের নিচে পুরু গোঁফ, কালো ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক। একটু ভুরি আছে, তাও আবার সুটের ভেতর থেকে অল্প বেড়িয়ে গেছে।
আমি ওর উলটো দিকের সোফার ওপরে বসে যাই। হিমাদ্রির বাবা আমাকে আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, চুপচাপ নিচু স্বরে তাঁর উত্তর দিলাম। এ যেন এক পরীক্ষার মতন মনে হল আমার।
হিমাদ্রির বাবা ছোটমাকে বললেন, “আমরা এক গৃহবধূ চাইছি।”
আমি একবার হিমাদ্রির দিকে তারপরে ছোটমায়ের দিকে তাকালাম। আমার হারানোর কিছু ছিলনা, আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকনাও। হৃদয়ের অন্তিম সাহসের কনা সঞ্চয় করে বললাম, “আমি স্কুলের টিচার হতে চাই।”
হিমাদ্রি এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসি। বাবু বাকিদের বলেন যে আমাদের দুজনকে একটু একা কথা বলতে দিতে, বাকিদের নিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন।
আমার বুক খুব জোরে জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে দেয়। মনে হল যেন বুকের পাঁজর ভেঙ্গে হৃদপিণ্ডটা এই মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাবে। আমার সামনে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যাক্তি বসে, আমি তাঁর সামনে একটা পাথরের পুতুলের মতন বসে থাকি। সবাই বেড়িয়ে যাওয়ার পরে, অনেকক্ষণ আমাদের দুজনের মুখে কোন কথা ছিলান। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে আমি আমার বুকের ধুকপুক শব্ধ যেন শুনতে পাই।
হিমাদ্রি কিছু পরে গলা খাকরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এই বছর প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করেছ?”
আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।
হিমাদ্রি, “বেশ নাম করা কলেজ।”
আমি আবার মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।
কোলের ওপরে আমার হাত জড় করে রাখা, আমি ছোটো টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই টেবিলের কাঁচের প্রতিফলনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর দৃষ্টি আমার চেহারার ওপরে নিবদ্ধ।
হিমাদ্রি, “শুচিস্মিতা অনেক বিশাল নাম। তোমাকে ছোটো করে কি বলে ডাকা যায় বলতো?”
সেই প্রশ্ন শুনে মনে হল, আবার এক নতুন পরিচয়। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে মন করল না আমার। আমি চুপ করে থাকি।
হিমাদ্রির পরের কথা আমাকে হাসিয়ে দিল, “আচ্ছা, চুপচাপ থাকা ছাড়া আর কি কি করা হয় তোমার?”
আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে লজ্জা ঢেকে নেই। হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাই। সেই প্রথম বার আমাদের চার চোখ এক হয়। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে হিমাদ্রি।
হিমাদ্রি বলে, “বাবার কথা অত মাথায় রেখ না। আমি কথা দিচ্ছি যে তুমি চাকরি করতে পারবে, আমি তাতে বাঁধা দেব না। আমি ধানবাদে অনেক স্কুল জানি, যেখানে তুমি খুব সহজে ফিসিক্স টিচারের চাকরি পেয়ে যাবে।”
ওর কথা শুনে আমার বুকে জল আসে, আমার বুক হালকা হয়ে যায়। আমি মাথা ঝুকিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই।
হিমাদ্রি আমাকে বলে, “এত চুপচাপ কেন, তোমার সম্বন্ধে কিছু বলো? নিলাদ্রি নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছে, তাও তোমার যদি কিছু প্রশ্ন থাকে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো।”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেই, “আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। তোমার যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে তাহলে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে।”
বুক ভরে এক শ্বাস নেই আমি, মাথার ভেতরে কোন প্রশ্ন জাগেনা, বুকের ভেতরে কোন অনুভুতি জাগেনা। চারপাশের ছন্দ আমাকে দুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি অনড়, নিশ্চল। হিমাদ্রি আমার শান্ত চেহারার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে আবার এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়।
সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি শেষে ওকে বলি, “দুপুরে নিশ্চয় খেয়ে যাবে?”
সামনের দিকে ঝুঁকে আমার মুখের কাছে মুখ এনে হিমাদ্রি আমাকে বলে, “তুমি রান্নাও জানো?”
আমি আলতো মাথা নাড়াই, হ্যাঁ।
হিমাদ্রি হেসে বলে, “তাহলে ত খেয়ে যেতেই হচ্ছে।”
দুপুরে খাওয়ার সময়ে সবাই খেতে বসে আমার রান্নার খুব তারিফ করল। আমি সর্বক্ষণ ঠোঁটে এক মেকি হাসি মাখিয়ে ওদের পরিবেশন করে গেলাম।
ওরা চলে যাওয়ার পরে আমি নিজের ঘরে ঢুকে চুপচাপ বিছানার ওপরে বসে পরি। জানালার বাইরের একভাবে তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনে এক তপ্ত বিস্তীর্ণ ফাঁকা মরুভুমি দেখতে পাই। সেই মরুভুমির ওপর দিয়ে এবারে আমাকে হেঁটে যেতে হবে। আমি জানিনা, সেই মরুভুমির মাঝে আমি কোন মরুদ্যান খুঁজে পাবো কি না, আমি শুধু এই টুকু জানি যে সেদিন থেকে আমার বুক এক শূন্য মরুভুমিতে পরিনত হয়ে গেছিল।
ছোটমা আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “হিমাদ্রি কে দেখে কেমন লাগল?”
আমি ছোটমায়ের প্রশ্ন শুনে খুব বিচলিত হয়ে উঠি। ছোটমা আমার মনের কথা জানেন, তাও আমাকে কেন এই প্রশ্ন করা। তিনি ভালো করে জানেন আমার কাকে ভালো লাগে। আমি ছোটমায়ের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে উত্তর দেই, “তোমরা আগে থেকেই আমার জীবনের সবকিছু ঠিক করে ফেলেছ, তারপরে আমার আর কি বলার আছে।”
ছোটমা আমার পাশে বসে আমাকে বললেন, “পরী, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নামি ব্যাক্তি, ওরা খুব বড়লোক। হিমাদ্রি ইঞ্জিনিয়ার, ভালো ছেলে। তোর জন্য অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, আইএএস, আইপিএস, কিন্তু সেসব বাইরের। আমি তোকে বেশি দুরে পাঠাতে চাইনা রে মা। ধানবাদ কোলকাতা থেকে বেশি দুরে নয়, ট্রেনে শুধু মাত্র ছয় ঘন্টা লাগে, তুই আমার সাথে দেখা করতে যেকোনো সময় আসতে পারিস, আমি যেকোনো সময়ে তোর কাছে যেতে পারব।”
আমি মাথা দুলিয়ে বলি, ঠিক আছে।
ছোটমা আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে মুখে হাসি ফুটাতে বলেন, আমি অনেক কষ্টে ছোটমার চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি। কথায় কথায় জানতে পারি যে, হিমাদ্রির বাড়ি ধানবাদের হিরাপুর নামে এক জায়গায়। বাবা মায়ের সাথে একত্র পরিবার। ছোটো ভাই নিলাদ্রি, তাঁর বাবার কন্ট্রাক্টারির কাজে সাহায্য করে, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নাম করা কয়লার কন্ট্রাক্টর। হিমাদ্রির মায়ের নাম রজনী কর্মকার, একজন গৃহবধূ।
সেই বছরের মাঝামাঝি আমার বিবাহের দিন ঠিক করা হয়। ছোটমা মৈথিলী আর মেঘনা বৌদিকে ফোন করে সব জানিয়ে দেন।
একদিন রাতে আমি কল্যাণীকে ফোন করে আমার বিয়ের কথা জানাই। কল্যাণী আমার মুখে সেই সংবাদ শুনে মর্মাহত হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপরে কল্যাণী আহত সুরে বলে, “আমি তোর বেদনাপ্লুত চেহারার সামনে যেতে পারবোনা রে পরী। আমার হয়ে দীপঙ্কর যাবে তোর বিয়েতে।”
আমি কপালে করাঘাত করে ধরা গলায় ওকে বললাম, “মেয়ে হয়ে জন্মেছিরে, ভাগ্যের পরিহাসের সামনে কি করে রুখে দাঁড়াব বল? এই সমাজ আমাদের বলিদান চায় পদেপদে, আমাদের জন্ম শুধু বলিদান দেওয়ার জন্য, রে কল্যাণী।”
কল্যাণী আর কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয়। সেইরাতে আমি আর ঘুমাতে পারি না। নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার চিড়ে আমার কানে বেজে ওঠে আমার বলিদানের সানাইয়ের করুন সুর। সেই কান্নার সুরেও আমার চোখে জল আসেনা, জল শুকিয়ে গেছে।
পরের দিন সকাল বেলা উঠে মৈথিলীকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অত ভোরে মৈথিলী আমাদের বাড়ি পৌঁছে যায়। বসার ঘরে বসে ছোটমায়ের সাথে কথা বলছিল মৈথিলী। আমাকে দেখতে পেয়ে, বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ঠেলে।
ভুরু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “একি করছ পরী?”
আমি প্রথমে ওর প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। আমি ওর মনের ভাবাবেগ তখন ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে না পেরে ওকে প্রশ্ন করি, “কেন কি হয়েছে?”
আমার হাত ধরে বিছানার ওপরে বসিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি বিয়ে করছ? কি ব্যাপার, তোমার ভালোবাসার কি হবে?”
আমি ফাঁকা বুক নিয়ে বিছানার ওপরে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলি, “আমি আর কি করতে পারি, চুরনি?”
মৈথিলী আমার ব্যাথিত মুখখানি নিজের দিকে তুলে ধরে। ওর সমবেদনার স্পর্শে আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। আমার মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে বলে, “কোথায় আছে ও, বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, তুমি চলে যাও। এখানে যা হবে সব আমি সামলে নেব, আমি তোমাকে এই ভাবে পুড়তে দেখতে পারব না।”
আমি ওর বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলি, “আমার আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই চুরনি। আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমার সাথে একবারও যোগাযোগ করেনি।”
আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আমাকে শান্ত করে বলে, “পরী একদম বলবে না যে তোমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমি সারা জীবন তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকব। যা কিছু হোক। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে আমিও বড় নিরুপায়। বাড়ির সবাই এই ভাবে যে তোমার ছোটমা তোমার জন্য যা করছে তাই তোমার জন্য ঠিক।”
সেই প্রথম বার আমি ওর চোখে আমার দুখের জন্য জল দেখি। আমার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে কাঁদে ওর হৃদয়। আমি ওর কোমর জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলি, “আমার মা নেই, ও আর আমার সাথে যোগাযোগ করলনা। আমি জানি না, ও কোথায় আছে, কেমন আছে। আমার আর কোন জায়গা নেই যাওয়ার চুরনি। আমি আমার ভালোবাসা হেরে গেছে চুরনি। ওর ভালোবাসার পরী এই সমাজের নিয়মাবলীর সামনে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে।”
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment