আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
ভালবাসার রাজপ্রাসাদ
Written By pinuram
Written By pinuram
অশ্রুহীন বিদায় (#01)
বি.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। বিগত দুমাস ধরে প্রেয়সী পরী যেন মা ধরিত্রির রুপ ধারন করেছিল। সর্বদা চোখে চোখে রেখেছিল অভিকে। ওকে নিজের ঘর ছেড়ে রাতের বেলায় বসার ঘরে পড়তে বসতে নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে চোখে চোখে রাখতে পারে। সেই কয়দিন পরী নিজেকে এক নিয়ন্ত্রিত মহিলা বানিয়ে তুলেছিল ঠিক তাঁর ছোটমায়ের মতন। অনেক রাত কেটে গেছে যে অভি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত আর পরী ওর মাথার নিচ থেকে বই নিয়ে গুছিয়ে রেখে দিত আর গায়ের ওপরে চাদর ঢেকে দিত। অনেক রাত কেটে গেছে, পরী ওর সামনে বসে এক নয় খবরের কাগজ পড়ত না হলে কোন উপন্যাস নিয়ে বসে থাকত। যাতে অভির ঘুম না পায় সেই জন্য সময়ে সময়ে কফি বানিয়ে আনত। কফি খাইয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিত, কিন্তু একবারের জন্যেও গায়ে হাত লাগাতে দিত না। অভি মাঝে মাঝেই বকা খেত অপটিক্সের বা মেকানিক্সের জন্য। মা প্রথম কয়েকদিন ওদের ওপরে একটু নজর রেখেছিলেন, মনে হয় মা কিছু আচ করেছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে পরী শুধু সামনে বসে উপন্যাস পরে আর টেবিলে কফির সরঞ্জাম তখন মায়ের সন্দেহ দূর হয়ে যায়। পরীর আর অভির ভেতরের কথা মা টের পায়না।
পরী সেই প্রথম রাতের চুম্বনের পরে নিজের চারদিকে এক উঁচু দেয়াল গড়ে তোলে, অভির সাধ্য ছিলনা সেই কঠিন দেয়াল টপকে প্রেয়সী পরীর কাছে পৌঁছানর, সামনে সবসময়ে যেন মাতৃময়ি মূর্তি শুচিস্মিতা দাঁড়িয়ে থাকত। পরী একেবারে বঞ্চিত করেনি অভিকে, মাঝে মাঝে সস্নেহে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিত কিম্বা ঘুম ঘুম পেলে মাথায় চাঁটি মেরে জাগিয়ে দিত কিম্বা রাতে ঘুম না আসলে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পারিয়ে দিত। অভির বুঝতে কষ্ট হয়না যে ওকে অনেক কিছু করতে হবে জীবনে যদি পরীকে নিজের করে নিতে হয়। এই পৃথিবী টাকা চেনে আর চেনে সামাজিক পদমর্যাদা, এই দুটি না পেলে অভি পরীকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না ওর কঠোর বাবা মায়ের শৃঙ্খলা থেকে। শেষ পর্যন্ত মা ধারিত্রি জয় লাভ করেন মেনকার কাছে।
দিনটা, 22শে মে, 2001. বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। অভি বসার ঘরে বসে টি.ভি. তে ওর প্রিয় সিনেমা "Gone with the wind" দেখছে। বাড়ির কারুর ইংরাজি সিনেমা বিশেষ পছন্দ নয় তাই অভি একা একা বসে সিনেমা দেখছিল। গ্রীষ্মকাল কোলকাতায় চেপচেপে গরম, মাথার ওপরের পাখা বনবন করে ঘুরছে। পরী মায়ের সাথে রান্না ঘরে কিছু কাজে ব্যাস্ত আর বাবা রাতের শোয়ার জন্য বিছানা তৈরি করছিলেন।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, তখন ফোন এল। বাবা ফোন তুলে কথা বললেন। কিছু পরে ফোন রেখে বাবা বসার ঘরে ঢুকলেন। বাবার থমথমে মুখ দেখে অভির বুকের মাঝে এক সংশয়ের উদ্রেক হয়। অভি বাবাকে জিজ্ঞেস করে যে কার ফোন এসেছিল।
বাবা, "ব্যানারজি কাকু তোকে এখুনি বেলে ভিউ ক্লিনিকে ডেকেছে।"
ব্যানারজি কাকু মানে অরুনার বাবার ফোন, সেই শুনে অভির আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। এক পলকের মধ্যে পুবালির কান্না ভেজা চোখের কথা মনে পরে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল অভি। পরী আর মা বাবার কথা শুনে রান্না ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে। পরী অভির দিকে তাকাল, অভির চোখ দেখে পরীর বুঝতে বাকি রইল না যে ঘটনা কি ঘটে গেছে।
কোনোরকমে জামা কাপড় পরে অভি বেড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত, এমন সময়ে বাবা অভিকে ডাক দিয়ে বললেন যে পরীও যেতে চায়। অভি মায়ের দিকে তাকাল, পরী জামাকাপড় পরে তৈরি যাবার জন্য। ও ওর ছোটমায়ের দিকে জল ভরা করুন চোখে তাকিয়ে অনুরধ করে অভির সাথে যাবার জন্য। মা পরীর চোখ দেখে বুঝলেন যে পরীকে আটকানো সম্ভব হবে না।
ট্যাক্সিতে পরীর কে জড়িয়ে ধরে থাকে অভি, পরীর অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না যে একটা বিশাল বড় ঝড় আকাশের কোনায় জমে এসেছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারটা নাগাদ ওরা নারসিং হোমে পৌঁছায়। ভেতরে ঢুকে দেখে ব্যানারজি কাকু, কাকিমা, পুবালির বাবা মা আর অরুনা দাঁড়িয়ে। পরীকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনা। পরী অরুনাকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
অভি ব্যানারজি কাকুর কাছে গিয়ে পুবালির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, বিকেল বেলা সবাই চা খেতে ব্যাস্ত ছিল। পুবালি নিজের ঘরে নিজের আলমারি গুছাতে ব্যাস্ত ছিল। আল্মারির মাথায় কোন জিনিস ছিল যার জন্য ও একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে সেটা নামাতে চেষ্টা করছিল। কোথা থেকে একটা মাকরসা দেখে পুবালি আঁতকে ওঠে আর টুল থেকে পরে যায়। আলমারির হাতল মাথায় লাগে আর নাক থেকে রক্ত বের হতে শুর হয়। প্রথমে পাশের ডাক্তার ডেকে রক্ত থামানর ব্যাবস্থা করে, কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। ডাক্তার রক্তের সাথে পুঁজ বের হতে দেখে পুবালিকে নারসিং হোমে ভরতি করতে বলেন। নারসিং হোমে নিয়ে আসা হয় পুবালিকে আর সঙ্গে সঙ্গে অপারেশান শুরু করে দেওয়া হয়।
অভি বাড়িতে ফোন করে বাবা মাকে সব জানায়। বাবা খুব চিন্তিত কেননা ব্যানারজি কাকু বাবার বন্ধু। বাবা পরীকে আর অরুনাকে দেখার জন্য বলেন। অভি লক্ষ্য করে যে অয়েটিং হলের এক কোনায় সমুদ্রনীল দাঁড়িয়ে। অরুনার বাবা মা জানেন না সমুদ্রনীলের ব্যাপার তাই সমুদ্রনীল ওদের সামনে আসতে পারছিল না আর অরুনার সাথে দেখা করতে পারছিল না। অভি ধিরে ধিরে সমুদ্রনীলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ও ব্যাপার টা জানল কি করে। সমুদ্রনীল জানায় যে অরুনা ওকে ফোন করে জানিয়েছে, কিন্তু এখানে এসে বাড়ির সবাইকে দেখে ও আর অরুনার কাছে যেতে পারছে না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে অরুনাকে নিয়ে আসতে বলে। অরুনা অনেক আগেই সমুদ্রনীলকে লক্ষ্য করেছিল কিন্তু বাবা মায়ের জন্য কাছে যেতে পারেনি। পরী অরুনাকে নিয়ে ওদের কাছে আসে। অরুনা সমুদ্রনীল কে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে।
পরী অভিকে বলে, "এখান থেকে চলে এস, ওদের কে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও।"
অভি উত্তর দেয়, "তুই অরুনাকে একা ছেড়ে যেওনা, সেটা ঠিক হবে না। এখানে কেউ সমুদ্রনীলের কোথা এখনো জানেনা তাই ওকে একা ছেড়ে গেলে হিতে বিপরিত হতে দেরি হবে না। তুমি ওদের কাছেই থাক আমি যাই কাকুর কাছে।"
প্রত্যকে মুহূর্ত যেন এক এক বছর মনে হচ্ছিল অভির, সময় যেন আর কাটতে চায় না। উৎকণ্ঠায় সবাই দাঁড়িয়ে। পুবালির বাবা মা খুব চিন্তিত, তাদের একমাত্র মেয়ে আজ অপারেশান টেবিলে শুয়ে, প্রহর গুনছে।
সমুদ্রনীল কিছু পরে অভিকে ডেকে বলল যে ও সারা রাত হস্পিটালে থাকতে পারবে না কারন কেউ ওকে দেখে ফেললে অরুনা মুশকিলে পরে যেতে পারে। অভির সেই কথা ঠিক বলে মনে হল, অভি জানাল যে কিছু খবর থাকলে সমুদ্রনীল কে জানিয়ে দেবে। পরী অরুনার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে চেষ্টা করে।
ধরা গলায় পরী অরুনাকে সান্তনা দেয়, "আরে তুই এত কাঁদছিস কেন, পুবালির কিছু হবে না, চিন্তা নেই। শুধু নাক থেকে রক্ত পড়ছে সেটা অপারেশান করলে ঠিক হয়ে যাবে।"
অভি মনে মনে ভগবান কে ডেকে ওর মনের কথা জানায়, জানেনা ভগবান ওর কথা শুনলেন কিনা তাও শেষ বারের মতন হাত জোর করে প্রার্থনা জানায় তাঁর কাছে। ব্যানারজি কাকু সবাইকে এক বার জিজ্ঞেস করলেন যে কেউ চা খাবে কি না, কেউই অপারেশান থিয়েটারের সামনে থেকে নড়তে নারাজ। অভি পুবালির মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ওর মা জানালেন যে মেয়ের যতক্ষণ না কোন খবর আসছে ততক্ষণ তিনি নড়বেন না।
প্রায় সকাল চারটের সময়ে ডাক্তার বেড়িয়ে এল অপারেসান থিয়েটার থেকে। সবাই উন্মুখ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে, কি খব্র দেন ডাক্তার। অরুনা চোখ বন্ধ করে পরীর হাত শক্ত মুঠির মধ্যে ধরে বসে থাকে।
ডাক্তার জানালেন, "ব্রেনের সামনের দিকের ভেইন্স গুলো খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি ঠিক করার জন্য কিন্তু এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। পুবালি ধিরে ধরে কোমায় চলে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরা না পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। পরের বাহাত্তর ঘন্টা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা কিছু পরে ওকে আই.সি.ইউ তে নিয়ে যাব।"
পরীর দিকে তাকাল অভি, পরীর চোখে জল, অরুনা পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন পরী ওর শেষ সম্বল। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে অরুনার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পরী অরুনার পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে।
অরুনা ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে, তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঠোঁট জোড়া। ওর মুখে দেখে প্রায় ভেঙ্গে পরে অভি, কিন্তু ভাংলে চলবে না ওকে।
অরুনা ধরা গলায় অভির কাছে কাতর মিনতি করে, "একবার, একবার তুই আমার বোনকে ফিরিয়ে এনেছিলিস। কথা দে আবার ওকে ফিরিয়ে আনবি।"
দাতে দাঁত পিষে নিজেকে সামলে নেয় অভি।
পরী মৃদু বকুনি দেয় অরুনাকে, "কি যা তা বলছিস তুই, পুবালির কিছু হবে না। তুই ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবি আর কিছু দিনের মধ্যেই।" অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি গাধার মতন চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো?"
অরুনাকে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ব্যানারজি কাকু এসে জিজ্ঞেস করলেন যে ওরা বাড়ি যেতে চায় কিনা। অভি জানাল যে ও হস্পিটালে পুবালির বাবার সাথে থাকবে আর বাকি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।
পরী অভিকে বলে, "তোমার মনে হয় যে অরুনা এখান থেকে নড়বে?"
অরুনা দিকে তাকায় অভি, অরুনা মাথা নাড়ে, হসপিটাল থেকে যেতে নারাজ যতক্ষণ না পুবালি চোখ খুলে তাকায়। অভি পুবালির মায়ের কাছে যায়, মায়ের মন বাঁধ মানে না, তিনি কিছুতেই নড়বেন না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার দায়িত্ব যে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফেরা। আমি আর পুবালির বাবা এখানেই থাকছি। তোমরা স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে পরে এস। তুমিও সারা রাত জেগে, কিছুই খাওনি।"
পরী কেঁদে ওঠে, "আমাকে ত বলে দিলে, কিন্তু আমি কি করে পুবালির মাকে নিয়ে যাব সেটা একবার বলে দাও। ওই মায়ের একমাত্র মেয়ে যে আই.সি.ইউ তে।"
অভি পরীকে এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বলে, "প্লিস ওদের নিয়ে যাও এখান থেকে। আমি জানি কি ঘটবে।"
পরী হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির মুখের দিকে তাকায়, "কি বলতে চাও তুমি?"
অশ্রুহীন বিদায় (#02)
অভি, "পুবালি আগে থেকে জানত যে ওর হাতে আর বেশি দিন নেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথা মনে আছে তোমার? আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল পুবালি? সেদিন ও আমাকে বলেছিল যে ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি যেন ওর হয়ে সমুদ্রনীলকে বলি অরুনাকে দেখতে।"
পরী অভির হাত শক্ত করে ধরে বলে, "তুমি আমাকে এত দিন এই কথা জানাও নি কেন?"
অভি, "আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওই কথা কাউকে জানাব না, তাই বলিনি।"
পরী, "আজ তাহলে সেই প্রতিজ্ঞা তুমি ভেঙ্গে দিলে? কি মানুষ তুমি?"
অভি, "পরী, আমি শুধু এই দুঃসময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চাইছি আর কিছু না।"
পরী অভিকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। ওকে সান্তনা দেবার মতন ভাষা খুঁজে পায়না অভি।
কিছু পরে পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি খুব শক্ত তাই না, কোন দিন চোখের জল ঝরাও না যে?"
অভি, "পরী, আমার এখন চোখের জল ঝরানোর মতন সময় নেই।"
পরী, "অরুনা আর পুবালির মাকে কি করে সামলাবে?"
অভি, "সময়ের সাথে সব কিছু সামলে নেয়, পরী। সময় খুব বড় মলমের কাজ করে।"
পরী অভির জামা ছেড়ে অরুনা আর পুবালির মায়ের কাছে গিয়ে বসে। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে পুবালির মায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পুবালির বাবা, ব্যানারজি কাকু অভির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অভি, "পুবালি এখন আই.সি.ইউ তে, সে মত অবস্থায় এখানে বসে থাকা টা বোকামো। আমি আর কাকু এখানে আছি, তুমি মেয়েদের নিয়ে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ি যাও, স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে চলে এস। এর মাঝে পুবালির জ্ঞান ফিরে এলে তোমাকে জানিয়ে দেব তুমি চলে এস।"
অভির কথায় পুবালির বাবা আর ব্যানারজি কাকু সায় দিলেন। ব্যানারজি বললেন যে যাবার পথে পরীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন। ব্যানারজি কাকু মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পরে সমুদ্রনীলকে ফোন করে ডেকে নিল অভি। পুবালি বাবা মাথা নিচু করে বসে, অভির কাছে টাকে সান্তনা দেবার মতন কোন ভাষা নেই। সময় যেন থেমে গেছে ওদের সামনে।
অভি বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ব্যানারজি কাকুর সাথে পরী বাড়ি ফিরছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন যে যদি পরী আবার নারসিং হোমে যেতে চায় তাহলে কি করবে? অভি জানাল যে যদি পরী আসতে চায় তাহলে ও বাবাকে ফোন করে দেবে আর বাবা যেন কোন গাড়ির বন্দবস্ত করে দেয় যাতে পরী নারসিং হোমে আসতে পারে। বাবা জানালেন যে তিনি ব্যানারজি কাকুর সাথে কথা বলে নেবেন পরীর যাওয়ার ব্যাপারে।
পরের ছয় ঘন্টা যেন ওদের কাছে ছয় যুগের মতন মনে হয়। অভি আর পুবালির বাবা অতি উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে থাকে কিছু ভাল খবরের জন্য। বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ, বাড়ির সবাই নারসিং হোম পৌঁছে যায়। অরুনাকে দেখতে না পেয়ে অরুনার দাদাকে অভি ওর কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, ব্যানারজি কাকু অরুনাকে নিয়ে অভিদের বাড়িতে গেছে পরীকে নিয়ে আসতে।
কিছু পরে অভি লক্ষ্য করে যে অরুনা আর পরী নার্সিং হোমে ঢুকছে, পেছনে ব্যানারজি কাকু। অরুনার মুখ থমথমে যেন ওর ওপর দিয়ে এখুনি বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে। পরী অভির কাছে এসে পুবালির খবর জিজ্ঞেস করে, অভি মাথা নাড়িয়ে জানায় যে এখন কোন খবর ডাক্তার জানায় নি। অরুনা ওর মায়ের পাশে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে, পরী অরুনার পাশে বসে যায়। অরুনা একবার পরীর দিকে তাকায় থমথমে চোখ নিয়ে।
ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, আই.সি.ইউ থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে এসে পুবালির বাবাকে ডাকেন। সবাই ডাক্তারের দিকে উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থাকে। শেষ খবর আসে, পুবালি ব্যানার্জি, এক নিস্পাপ ফুল, খুব লাজুক মেয়ে, জীবনে হয়ত একটা মাছিও মারেনি পুবালি, সেই মিষ্টি মেয়ে যে কোনদিন কলেজে কারুর সাথে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলেনি, ঝগড়া করা ত দুরে থাক। শুভঙ্কর ব্যানা+জি আর মালা ব্যানার্জির একমাত্র কন্যা সন্তান আর এই পৃথিবীতে নেই।
চাপা ক্রন্দনের রোল জেগে ওঠে চার পাশে। বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসে মায়ের বুক থেকে। পরীর চোখে জল, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে। অরুনা পরীকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে পরে থাকে।
অভি চোয়াল শক্ত করে, হাত মুঠি করে কপালে জোরে এক কিল মারে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে ভগবানের দিকে তাকিয়ে, "শেষ পর্যন্ত আমার কথা রাখলে না তুমি।" বার বার জিজ্ঞেস করে ভগবানকে "এই পৃথিবীতে অনেক দুস্করমিরা আছে, তাদের ছেড়ে কেন এক ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়ে কে কোলে ডেকে নিল? তোমার যদি সত্যি কান থাকে তাহলে তুমি আমার কাতর প্রার্থনা শুনতে পারতে, কিন্তু হায় বিধাতা, আমার প্রার্থনা শোনার কেউ নেই।"
পরী কিছু পরে অভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, "অরুনার দিকে তাকাও।"
অরুনার দিকে তাকায় অভি, অরুনা পাথরের মতন বসে নিস্পলক চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে। চেহারা ভাবলেশহীন, চোখে কোন ভাষা নেই, দু’চোখ যেন কাঁচের তৈরি।
বাবাকে ফোন করে খবর দেয় অভি, বাবা তখন অফিস থেকে বের হবেন। অভি বাবাকে সোজা নার্সিং হোমে এসে পরীকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য অনুরধ করল, "তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাও, এখানে থাকাটা ওর ঠিক হবে না। ভাগ্যের পরিহাস যা ঘটবার সেটা ত ঘটেই গেছে। ওকে বাড়ি নিয়ে যাও বাড়িতে মায়ের কাছে ঠিক থাকবে।"
বাবা জিজ্ঞেস করলেন অভিকে, "তোর কি খবর, কাল রাত থেকে ত কোথাও যাসনি। বাড়ি ফিরবি কখন?"
অভি, "এখুনি কিছু বলতে পারছি না, দেখি কাল সকালে বাড়ি ফিরব।"
অভি পরীকে বলল, "তোমার বাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে আসছে, তাঁর সাথে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।"
পরী অভির কলার চেপে ধরে বলে, "আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।"
অভি, "বুঝতে চেষ্টা করও, পরী। আমার বাড়ি যাবার এখন কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সত্যি কথা বলতে এখন অনেক কাজ আছে এইখানে।"
পরী, "তাহলে আমি অরুনার সাথে থাকব।"
অভি, "না তুমি ওর সাথে থাকবে না।"
পরী চেঁচিয়ে ওঠে, "কেন?"
অভি, "কাল রাত থেকে অনেক কান্নাকাটি করেছ তুমি, আর নয়। তুমি যদি ওর সাথে ওদের বাড়িতে যাও, সেখানে গিয়েও আবার কান্নার রোল শুরু হবে, তাঁর থেকে ভালো কথা বলছি তুমি বাড়ি যাও। তুমি একটু বিশ্রাম নাও বাড়ি গিয়ে তোমার ছোটমায়ের কাছে।"
পরী চাপা স্বরে বলে, "অরুনাকে দেখেছ? চোখের পাতা পড়ছে না ওর, পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা। ও যদি না কাঁদে তাহলে খুব বড় আরেকটা বিপদ হবে। আমাকে ওর কাছে থাকতে দাও।"
অভি, "আমি দেখি কি করতে পারি, কিন্তু তুমি এখন বাড়ি যাবে। অরুনার সাথে ওর বাবা মা আছেন ওকে দেখার জন্য, এখানে আমি কিছু পরে ব্যাস্ত হয়ে যাব তখন তোমাকে দেখার কেউ থাকবে না।"
সবার সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দিল, অরুনা। ও যদি না কাঁদে বা কিছু না বলে তাহলে আরেক বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না।
কিছু পরে অভি আর অরুনার দাদা একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করে ফিরে এল। বাড়ির দিকে পুবালির শেষ যাত্রা।
পুবালির দেহ যখন ওদের সামনে আনা হয়, তখন অরুনা চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধিরে ধিরে পুবালির গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মনে হয় যেন ডাকছে পুবালিকে চোখ খোলার জন্য, কিন্তু ওর গলা থেকে কোন আওয়াজ বার হয় না। একবারের জন্যেও অরুনার চোখের পাতা পরে না বাঁ ঠোঁট কাপে না। নিস্পলক ভাবে চেয়ে থাকে পুবালির বন্ধ চোখের দিকে। ধিরে ধিরে পুবালির মুখের ওপরে ঝুঁকে পরে, কপালে ছোটো একটা চুমু খায় আর গলায় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। পাথরের মতন গলা জড়িয়ে পরে থাকে অরুনা। অরুনার এই ব্যাবহার দেখে সবার বুকের ভেতরে এক নতুন ভয় জাগে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে অরুনাকে উঠানোর জন্য। পরী অরুনার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ওর পিঠে হাত রাখে। পরীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে অরুনা ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে তাকায় পরীর দিকে। চোখে জল নেই, চেহারায় কোন বিকার নেই, অরুনা যেন এক পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। পরীর সাথে চুপ করে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসে পরে।
কিছু পরে বাবা পৌঁছে যান নারসিং হোমে আর পরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ব্যানার্জি কাকু বললেন যে এবারে ওদের বাড়ির দিকে যাত্রা করা উচিত।
বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল পুবালির দেহ। সাদা ফুলে আর মভ রঙের শাড়িতে সাজান হল পুবালিকে। পুর সময়াটা অরুনা চুপ করে পুবালির দেহের পাশে বসে থাকে। পুবালির প্রাণহীন হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে দেয়। দেখে মনে হয় যেন এই ওর বোন আবার জেগে উঠে ওর সাথে কথা বলবে। কিন্তু হায় বিধাতা, পুবালি যে চির নিদ্রায় মগ্ন।
বাড়ি থেকে যখন ওকে নিয়ে বের হবে সবাই, তখন অভি লক্ষ্য করে কলেজের বন্ধুদের। বিদায়ের শেষ ক্ষণ উপস্থিত। পুবালির অন্তিম যাত্রা। বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল জেগে ওঠে, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে অরুনার মা কেঁদে ওঠেন। কিন্তু অরুনা নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে পুবালির মুখের দিকে, চোখে জল নেই, অতি শিতল সেই চোখের চাহনি। অভি এবং বাকিরা পুবালিকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে আসে। অরুনা চুপ করে বাড়ির গেট পর্যন্ত ওদের সাথে আসে তারপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পুবালিকে গাড়িতে তোলা না হয়। তারপরে অরুনা ফিরে যায় বাড়ির মধ্যে, নিজের ঘরে ঢুকে পরে বিছানায় শুয়ে পরে। বাড়ির বেশির ভাগ মহিলাদের নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় না।
নিস্পাপ ফুলের কুঁড়ি, পুবালি ব্যানারজির নস্বর দেহ আগুনে জ্বলে পঞ্চভুতে বিলীন হয়ে যায়। সেইদিন অভি তাঁর জীবনের সবথেকে মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখের সামনে দেখে, স্নেহ ভরা বুকে নিয়ে এক পিতা তাঁর চোখের মণি একমাত্র কন্যের মুখাগ্নি করছেন। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায় অভি, যেন কোন পিতাকে তাঁর কন্যার মুখাগ্নি না করতে হয়।
সমুদ্রনীল আর অভি চুপচাপ দুজনে গঙ্গার তীরে বসে রাতের আকাশের তারা দেখতে থাকে।
সমুদ্রনীল অভিকে জিজ্ঞেস করে, "অরুনা যদি কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে কি হবে? ও ত পাগল হয়ে যাবে, আরও বড় কোন বিপদ ঘটবে।"
অভি, "তুই ওকে ভালোবাসিস, তোকেই কিছু করতে হবে।"
সমুদ্রনীল, "আমি কি করতে পারি, তুই ওকে আমার চেয়ে ভাল করে চিনিস। পুবালির পরে শুচিদি ওর সব থেকে কাছের মানুষ। যদি কিছু করতে পারিস সেটা তোরাই করতে পারিস।"
অভি চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে যে ওদের কেউ দেখছে কিনা। পরিবারের বাকি লোকজন, কিছু দুরে একটা ছাওনির তলায় বসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে অভি,
"তুমি আমার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ, আমার আঁকা, আমার কবিতা, আমার লেখা। তুমি আমার জীবনের সব থেকে ভাল বন্ধুর বোনকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ। তুমি আমার কাছ থেকে আর কি চাও? শেষ বারের জন্য তোমার সামনে প্রার্থনা করছি যে আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা। যদি সেটাও চলে যায় তাহলে আমি জানব যে এই জগতে ভগবান বলে কিছু নেই, আছে শুধু পাথরের এক মূর্তি। শুধু একবারের জন্য প্রমান কর যে তুমি সত্যি আছো।"
সুকৌশল প্রতিজ্ঞা (#01)
যত দিন যায়, অরুনার শারীরিক অবস্থার অধঃপতন হয়। সেই দিনের পর থেকে অরুনা কারুর সাথে কথা বলেনি, একদম চুপ করে গেছে, ভাবলেশহীন চেহারা, দুচোখ যেন কাঁচের তৈরি। দিন রাত পুবালির ঘরের মধ্যে কাটায়, প্রকাশহীন নয়নে চেয়ে থাকে টেবিলে ছড়ানো বই গুলর দিকে, পুবালির আল্মারির দিকে যেখানে পুবালি জামা কাপড় রাখত, ফটোর অ্যালবাম হাতে নিয়ে ওদের ছোটো বেলার ছবি দেখে। অরুনা পুবালির চেয়ে মাত্র তিন মাসের বড়, ছোটো বেলা থেকে হরিহর আত্মা ওরা দু’জনে, যেখানেই যেত বা যা কিছু করত, দু’জনে একসাথে করত। শুধু একজন একটু চঞ্চল আরেকজন শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিল।
অভি মাঝে মাঝেই ওদের বাড়ি গিয়ে অরুনার খবরা খবর নিত। পরীর সাহসে কুলায় না যে অরুনার অভিব্যাক্তিহীন চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। পরী নিজেই এত আঘাত পেয়েছিল যে নিজেকে একটা কচ্ছপের খোলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছিল, ওর ছোটো মা ওর পাশে না থাকলে একদম ভেঙ্গে পড়ত।
পুবালির কাজের দিনে অভিদের যাওয়ার কথা। পরী কান্না শুরু করে, যে ও কিছুতেই ওই বাড়ি যাবে না, কিছুতেই ও অরুনার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। মা আর অভি অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে পরী কে কিন্তু পরী অটল, ও যাবে না।
শেষ পর্যন্ত বাবা ওকে বললেন, "দেখ সোনামা, আমাদের জীবন একটা নদীর মতন, নদী যেমন চলতে চলতে অনেক বাঁক অনেক বাধার সম্মুখিন হয়, তেমনি আমাদের জীবনেও অনেক বাঁধা বিপত্তি আসে, কিন্তু নদীর জল কি আর থেমে থাকে মা, সেত নিজের খেয়ালে বয়ে চলে সাগরের পানে। আমি তোকে পুবালিকে ভুলে যেতে বলছি না, আমি তোকে শুধু একটা অনুরধ করব যে জীবন কারুর একার জন্য থেমে যায় না। ইংরাজিতে একটা কথা আছে সোনামা, Rolling stone gather no moss. তুই যদি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে না চলিস তাহলে তুই পিছিয়ে পড়বি। সেই দিনের পর থেকে তুই অরুনার সাথে একবারের জন্যেও দেখা করিস নি। ভালো মেয়ের মতন চোখের জল মুছে আমাদের সাথে ওদের বাড়ি চল সোনামা।"
পরী দরজা বন্ধ করে বুক ফাটীয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "আমি বুঝি না কেন এই সব আদিখ্যেতা দেখানো? পুবালির চলে যাওয়া কেন লোক খাওয়ান? কোন বৃদ্ধ যদি জেতেন তাহলে আমি নিজেকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু ফুলের মতন নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক মেয়ের চলে যাওয়ায় এই সব কেন?"
বাবা, "দেখ মা, আমরা মানুষ, আমরা সামাজিক প্রাণী। এই সমাজের কিছু নিয়ম কানুন আছে, এই সমাজে থাকতে হলে আমাদের সেই নিয়ম, কানুন মেনে চলতে হয় নাহলে আমরা মানুষ বলে গন্য হব না।"
বাবার কথা শুনে, পরী দরজা খোলে, মা ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা সবাই ব্যানারজি কাকুর বাড়ি পৌঁছে যায়। এক মুহূর্তের জন্যেও পরী ওর ছোটমায়ের কাছ ছাড়ে না।
ওদের বাড়ি পৌঁছানর পরে, অভি ওপরে উঠে পুবালির ঘরের মধ্যে ঢোকে। যথারীতি, অরুনা চুপচাপ শুয়ে পুবালির বিছানার ওপরে। চুপ করে দরজায় দাঁড়িয়ে অভি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, ভেতরে গিয়ে ওকে কিছু বলার সাহস পায় না অভি। কিছু পরে, অরুনার মা ওকে ডেকে নিয়ে যান নিচে। বলেন যে অভির সাথে ওদের কিছু কথা আছে।
নিচে নেমে এসে দেখে যে একটা ঘরে বাড়ির সব লোক জন জড় হয়েছে। ব্যানারজি কাকু, কাকিমা, বাবা মা, পরী, পুবালির বাবা মা। অভি ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
ব্যানারজি কাকু একবার বাবার দিকে তারপর অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "অরুনার শারীরিক আর মানসিক সাস্থের দিনের পরদিন অধপতন হয়ে চলেছে, আর আমরা খুব চিন্তিত তাঁর জন্য। আমরা ওকে সাইকিয়েট্রিস্ট দেখিয়েছি, ওষুধ ও দেওয়া হচ্ছে কিন্তু ও কোন কথা না বলা পর্যন্ত বা কোন কিছু প্রকাশ না করা পর্যন্ত ডাক্তার জানিয়েছেন যে মানসিক অবস্থা আরও ভেঙ্গে পড়বে।"
অভি হাঁ করে সবার দিকে চেয়ে থাকে, ওরা সবাই অভিকে এই সব কথা কেন বলছে, কিছুই বুঝতে পারছে না অভি। পুবালির মায়ের গলা ধরে আসে কান্নায়, "অভিমন্যু আমি এক মেয়ে হারিয়েছি, আমার আর শক্তি নেই আরেক মেয়ে হারানর।"
অভি পরীর দিকে তাকায়, ইশারায় জিজ্ঞেস করে যে কি চলছে? পরী ইশারায় উত্তর দেয় যে এসব ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
অরুনার মা অভির দিকে তাকিয়ে বলেন, "অভিমন্যু, আমরা সবাই জানি যে তুমি অরুন্ধতিকে ভালোবাসো।"
অরুনার মায়ের কথা যেন অভির বুকে এক শক্তিশেল বানের মতন এসে গেঁথে। কান মাথা গরম হয়ে যায় অভির, ভাবাবেগে চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলে পরীর দিকে তাকায়। পরী মায়ের চেয়ারে পেছনে দাঁড়িয়েছিল, প্রানপন শক্তি দিয়ে চেয়ারের পেছনটা ধরে থাকে। বুক ফেটে যায় ওর, ওই কথা শুনে।
অরুনার মা, "তুমি যদি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পার, তাহলে তুমি যা চাইবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।"
অভির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল, চোয়াল শক্ত করে, চোখ বন্ধ করে বুকের মাঝের উত্তাল তরঙ্গ টাকে শান্ত করার প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে গেল। কেউ যেন ওর মাথায় তরল আগুন ঢেলে দিয়েছে, "কি বলছে কাকিমা? এটা কি করে সম্ভব? দুঃস্বপ্নেও এই পাপের কথা ও চিন্তা করেনি। হ্যাঁ, সবার মনের ভেতরে এক ভ্রান্তি ছিল আর সেটা ওরা একদিন কাটিয়ে দেবে তাও ঠিক করেছিল, কিন্তু তাঁর আগেই এই সব?"
ও জানে যে পরী এই কথা শুনে, মরমে মরে যাচ্ছে। চোখ খুলে পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে যে পরী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপণে নিজের মনকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরী, চেহারায় ফুটে উঠেছে এক অব্যাক্ত বেদনার ছাপ, সেই বেদনা ওই ঘরের কেউ টের পেলনা শুধু একমাত্র অভি ছাড়া। পরীর বুকের মধ্যে যেন এক স্টিম ইঞ্জন দউরাচ্ছে যেন, চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। দুঃখে বেদনায় কান নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে পরীর।
পরী ছাড়া বাকি সবাই অভির উত্তরের প্রতীক্ষায়। অভি সবার মুখের দিকে একবার তাকায়, নিরুপায় আজ বীর অভিমন্যু, জানেনা ওর প্রতিজ্ঞার ফল ওদের জীবন টাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু অভি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে যে কিছু একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সবার আশা ভরশা এভাবে ভেঙ্গে দেওয়া ঠিক হবে না। অভিমন্যুর অভি বুকের ভেতর থেকে বলে ওঠে, "ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নেবে অভিমন্যু, তোমার ভালোবাসা আর তোমার স্নেহ আজ দুজনের পরীক্ষা, আজ দুজনেই তোমার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে।"
হাঁটু গেড়ে অরুনার মায়ের সামনে বসে পরে অভি, অরুনার মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, "আমি কথা দিচ্ছি যে আমি তোমার মেয়েকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব।"
আড় চোখে পরীর দিকে তাকায় অভি। পরীর দুচোখ শক্ত করে বন্ধ, মাথা নিচু। মুখে দেখে মনে হচ্ছে যেন বুক এখুনি ফেটে যাবে। প্রাণপণে চোখের জল আর বুকের অভিব্যাক্তি লুকিয়ে রেখেছে পরী। অভি যেন ঘরের মধ্যে পরীর হৃদয় ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পায়। সবার চোখে, পরী অরুনার জন্য চোখের জল ঝরাচ্ছে, কিন্তু একমাত্র অভি ওর মনের অবস্থা জানে, কেন পরীর বুকের মধ্যে এই উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে। রাগে, দুঃখে বেদনায়, পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে পরী।
অভি একবার মাথা নিচু করে মেঝের দিকে দেখে অরুনার মাকে বলে, "আমাকে কথা দাও যে আমি যা চাইব তাই যেন তোমরা মেনে নাও।"
ব্যানারজি কাকু ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে, "তুমি যা চাইবে সেটা তুমি পাবে, আমরা সবাই মেনে নেব। আমি আজ সবার সামনে তোমাকে কথা দিচ্ছি।"
সবার সামনে অভি প্রতিজ্ঞা করে দিল কিন্তু জানেনা যে সেই প্রতিজ্ঞার ফলাফল, ওদের দুজনের জীবনকে কোন মোড়ে নিয়ে যাবে। নদী কোন খাতে বইতে চলেছে, কিছুই জানে না, পরীর আর অভির সম্পর্কের কি হবে জানে না, সবকছুই এক বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে যেন ডুবে গেল। পুবালিকে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সুমদ্রনীল যেন অরুনাকে দেখে, সেই প্রতিজ্ঞা অভি কি করে পূরণ করবে, জানে না।
বাড়ি ফিরে যাবার আগে অভি পুবালির ঘরে যায় অরুনাকে দেখার জন্য। অরুনা এক রকম ভাবে বিছানায় শুয়ে এমন কি পাশ ফিরে দেখেওনি যে কে এল কে গেল। বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে অভির, কিন্তু সেই ভাঙ্গা বুকের কান্না কেউ শুনতে পায় না।
বাড়ি ফেরার সময়ে সারা রাস্তা কারুর মুখে কোন কথা ছিল না, বাবা মা অভি পরী, সবাই চুপ। সবার মনের মধ্যে এক সংশয়ের দানা বেঁধে উঠেছে, বাবা মায়ের চিন্তা অন্য খাতে। অভির মাথায় অন্য চিন্তা, কি করে পরীর প্রতি ওর ভালোবাসা রক্ষা করবে আর একদিকে ব্যানারজি কাকু দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
বাড়ি ঢুকেই পরী নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। বাবা মা শুতে চলে যান, অভি নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ বসার ঘরে বসে থাকে তারপরে ছাদে নিজের ঘরে চলে যায়।
ঘুম আসে না অভির, ছাদের মেঝেতে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তারার মিটিমিটি চাহনি দেখতে থাকে। মাথা যেন খালি হয়ে গেছে, কিছুই ভাবার শক্তি নেই যেন। কয়েক দিনে আগে পূর্ণিমা ছিল তাই চাঁদ বেশ বড় দেখাচ্ছিল। সেই চাঁদও যেন ওর কাছে কাঁদছে, আকাশের তারার ঝিকিমিকি যেন ম্লান হয়ে এসেছে ওর বুকের বেদনার সামনে। অভির মনের মধ্যে উদ্দম ঝড় বয়ে চলে, "এ আমি কি করেছি? কি করে আমি আমার প্রতিশ্রুতি আর ভালোবাসা রক্ষা করব? আমি পরীর কাছে কথা দিয়েছি যে ওকে ছেড়ে আমি যাবো না, ওদিকে পুবালি কেও কথা দিয়েছি যে সমুদ্রনীলের হাতে অরুনার হাত তুলে দেব। আবার ব্যানারজি কাকুর কাছেও প্রতিজ্ঞা করেছি যে অরুনাকে ফিরিয়ে দেব ওদের বুকে। কিন্তু কি করে হবে, একসাথে এত গুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা।"
মাথার নিচে দুহাত ভাঁজ করে ছাদের ওপরে শুয়ে পড়ল অভি। অল্পক্ষণ না অনেকক্ষণ জানে না, ওর চিন্তনের শৃঙ্খলা ভং হয় মৃদু পদক্ষেপের শব্দে। পরী ওর পাশে এসে বসে, জল ভরা ব্যাথা মাখানো চোখ নিয়ে তাকায় অভির মুখের দিকে। কেঁদে কেঁদে পরীর কাজল কালো চোখ দুটি জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি ওইরকম একটা কথা দিতে গেলে কেন?"
অভি চুপ, উত্তর দেবার ভাষা নেই অভির কাছে। পরী ওর বুকের ওপরে লুটিয়ে পরে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, "অভি কথা বলো, কেন এই প্রতিজ্ঞা করতে গেলে তুমি? আমার ভালোবাসা কি কিছুই নয় তোমার কাছে? কেন আমার বুক ভেঙ্গে দিলে?"
অভি পরীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। পরী মুখ তুলে ওর বেদনা ভরা চোখের দিকে তাকায়, "তুমি কি একটি বারের জন্যেও আমার কথা ভেবে দেখলে না? আমি তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব, অভি?"
অন্ধকার আকাশের মাঝে পুবালির চোখ ভেসে ওঠে। পুবালি নেমে এসে অভির কানে কানে বলে, "তুই আমাকে কথা দিয়েছিলিস আর শুচিদি কেও কথা দিয়েছিলিস। তুই কারুর হৃদয় ভেঙ্গে দিতে পারিস না, অভি। তুই আজ মহাভারতের অভিমন্যুর মতন চক্রবুহ্যের মাঝে পরে গেছিস। কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধে মহাভারতের অভিমন্যুর হার হয়েছিল, কিন্তু আমার অভিমন্যু হারতে পারে না। উঠে দাঁরা অভি, যুদ্ধ কর নিজের সাথে আর ততক্ষণ যুদ্ধ কর যতক্ষণ তুই তোর কারযে সফলতা প্রাপ্তি ঘটে।"
অভি পরীর মুখ হাতের মাঝে আঁজলা করে নিয়ে কপালে ছোটো একটা চুমু খায়। পরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে অভির বুকের ভেতরে কি চলছে।
অভি, "তুমি কি ভেবেছিলে? যে আমি অরুনাকে বিয়ে করব?"
সুকৌশল প্রতিজ্ঞা (#02)
মাথা নাড়ায় পরী, "হ্যাঁ, আমি তোমার কথা শুনে তাই ভেবেছিলাম। তুমি অরুনার মুখ দেখে আর সবার চাপের সামনে মাথা নত করে শেষ পর্যন্ত হয়ত অরুনাকে কাছে টেনে নেবে। আমি জানি যে এক সময়ে অরুনার প্রতি তোমার কিছু দুর্বলতা ছিল।"
অভি, "পরী, আমি তোমাকে আর শুধু তোমাকেই ভালবাসি। তুমি ছাড়া এই বুকে আর কেউ স্থান নিতে পারে না, পরী।"
পরী, "তাহলে তুমি ওই রকম কথা দিলে কেন?"
অভি মৃদু হেসে বলে, "আমার মাথায় এক পরিকল্পনা এসেছে, যাতে করে সবার মন রক্ষা হবে।"
পরী অবাক হয়ে অভির মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অভি বলে, "অরুনাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো আমরা, আমাদের সেই পুরানো জায়গায়। একটা নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গায় আশা করি অরুনা ভালো হয়ে যাবে। ওকে শুধু ওর চারপাশের চাপা অবস্থা থেকে বের করা দরকার আর একটু স্নেহের ছোঁয়া দরকার যাতে ওর বুকের ভেতরে যে ব্যাথার পাথর জমে আছে সেটা গলে যায়।"
অভির কথা শুনে পরী চোখ বড় বড় করে অভির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ওর পরবর্তী পদক্ষেপ। অভি বলে, "আমার যতদূর ধারনা যে আমাদের সাথে গেলে ওর মনের অবস্থা ফিরে আসবে। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পরে আমি ব্যানারজি কাকুকে ওর আর সমুদ্রনীলের সম্পর্কের কথা বলব। ব্যানারজি কাকু আমাকে কথা দিয়েছেন যে আমার কথা তিনি শুনবেন, সুতরাং আশা করি তিনি মর্মাহত হবেন না এবং আমার কথা রাখবেন। এই ভাবে সবার কাছে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষা হবে। শুধু একটা কথা, আমাদের সম্পর্কের কথা কাউকে এখুনি জানানো হবে না, কেননা এটা ঠিক সময় নয়। আমার হাতে আরো সময় দরকার পরী, আমাকে চাকরি পেয়ে দাঁড়াতে হবে যাতে আমি বাবা মায়ের সমকক্ষ হয়ে তাদের সম্মুখিন হতে পারি, আর যা আমার নিজের তা আমি দাবি করতে পারি।"
প্রায় একপক্ষ কাল পরে, পরীর মুখে হাসি দেখে অভি অভিভূত হয়ে গেল। এতদিন পরীর মনে শুধু অরুনার জন্য চিন্তা ছিল আর আজ অভির প্রতিজ্ঞা ওকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছিল। অভির ঠোঁটের ওপরে আলতো করে ঠোঁট চেপে ধরে বলে, "তুমি কে?"
পরীর মধুঢালা স্বর পুনরায় শুনে অভির মন গলে গেল, ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হয়েছিল যে পরীকে হারিয়ে ফেলছে।
অভি ওর কোমর জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিল, পরী যেন ওর উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে অভির বুকে গলে গেল। অভি ওর কানে কানে বলে, "মনে আছে একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি আমার মন্ত্রী বুদ্ধিদাত্রি। আজ আমি তোমাকে বলছি, যে আমি তোমার মন্ত্রী, তোমার বুদ্ধিদাতা, আমি তোমার কার্ত্তিক, আমি বটবৃক্ষ তোমাকে ছায়া দেবার জন্য আর আগলে রাখার জন্য, আমি তোমার সস্নেহময় পিতা আর রতিক্রিয়ায় আমি কামদেব।"
পরীর চোখ ভাবাবেগে চিকচিক করে ওঠে। অভি ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের ওপরে টেনে নেয়। একে ওপরের আলিঙ্গন বদ্ধ হয়ে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকে। ওদের নিবিড় প্রেমালিঙ্গনের সাক্ষী হয় আকাশের চাঁদ আর ঝকমকে তারা।
একটু চিন্তা করার পরে অভি বলল, "কিন্তু এর মধ্যে একটা সমস্যা আছে, পরী।"
পরী, "কি সমস্যা আবার উদয় হল?"
অভি, "আমি অরুনাকে নিয়ে বেড়াতে যাব সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমাদের সাথে যদি তুমি যাও তাহলে তোমার সন্দেহ বাতিক ছোটো মায়ের মনে সন্দেহের উদ্রেক হবে আর তোমাকে বাড়িতে আটকে রাখবে। সেই সমস্যার একটা সমাধান আছে আমার কাছে, তুমি কল্যাণী আর রানীকে ফোন করে বল, আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে। তারপরে তুমি তোমার ছোটো মাকে জানাও যে তুমি রানী আর কল্যাণীদের সাথে হিমাচল প্রদেশ ঘুরতে যেতে চাও এবং সাথে অরুনাকে নিয়ে যেতে চাও। তাহলে তোমার ছোটমা তোমাকে বারন করবে না এবং ব্যানারজি কাকুও তোমাকে বারন করবে না কারন তিনি জানেন যে তুমি অরুনাকে খুব স্নেহ করো। যখন অরুনা তোমার সাথে যাবে তখন সবাই আমাকেও তোমাদের সাথে যেতে বলবে, ব্যাস সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।"
নাকের ওপরে নাক ঘষে পরী মৃদুকনে বলে ওঠে, "আমি যে তোমাকে কত ভালবাসি বলে বুঝাতে পারব না অভি..."
অভি দেখল যে পরী হয়ত ভাবাবেগে এখুনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে দেবে তাই ঝট করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ওর ভাবাবেগ প্রেমের আবেশে বদলে দেয়। কিছু পরে নিজেকে অভির ঠোঁট থেকে মুক্ত করে লাজুক হেসে বলে, "তুমি না খুব শয়তান ছেলে।"
মাথা হেলায় অভি, "উম্মম হানি, আমি তোমার বুদ্ধিদাতা মন্ত্রী।"
মাথা নাড়িয়ে অভির সারা মুখে চুলের পরশ ছড়িয়ে দেয় পরী। মখমলের মতন চুলের পরশে প্রেমাবেগে চেপে ধরে পরীকে নিজের বুকের কাছে। পরীর কোমল বুক জোড়া অভির নগ্ন বুকের ওপরে পিষ্ট হয়ে যায়। পরীর কোমল পিঠের ওপরে হাত বুলাতে শুরু করে দেয় অভি, শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে নখের আলতো আঁচর কেটে দেয় মাঝে মাঝে। ওর ছোটো নরম গোল পেট অভির নগ্ন পেটের ওপরে মাখনের মতন লেপে যায়। দুজানু জোড়া করে অভির জানুর ওপরে রেখে দেয় পরী। অভি ধিরে ধিরে হাত নিয়ে যায় সুগোল নিতম্বের ওপরে, আলতো করে চেপে ধরে কোমল নারী মাংস। উত্তপ্ত হাতের চাপে পরীর বুকের মাঝে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, শরীর গরম হয়ে ওঠে প্রেমের নিবিড় আলিঙ্গন পাশে।
তপ্ত নিঃশ্বাসে অভির মুখ ঝলসে যায় প্রায়, পরী মাথা নিচু করে অভির কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘাড়ে কানে চুমু দিতে থাকে। গালে গাল ঘষে বারবার। মৃদু ঘর্ষণের ফলে দুই শরীরে আগুনের ফুল্কি ছিটকে যায়। অভির বুকে কামনার উত্তাল তরঙ্গ দোল খায়, প্রেয়সীর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। বাম হাতে পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে মাঝে মাঝে আঁচরে দেয়। বুকে যেন কামনার বিশাল ঝড় শুরু হয়ে যায়।
অভি দুই পা একটু ফাঁক করে দেয়, পরীর জানু অভির মেলে ধরা পায়ের ফাঁকে গলে যায় আর অভি চেপে ধরে পরীর শরীর। প্রেমের আলিঙ্গনে এতই বিভোর দুই কপোত কপোতী যে ওরা ভুলেই গেছে যে ওরা তখন খোলা আকাশের নিচে।
গ্রীষ্ম কালের মৃদুমন্দ বাতাস ওদের বুকের আগুন যেন আরও জ্বালিয়ে তোলে। মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে দুই শরীর।
অভি ওর কানে কানে বলে, "বেবি..."
পরী ফিসফিস করে বলে, "ম্মম্মম্মম...... কি হল"
অভি ওর সুগোল নরম নিতম্ব চেপে ধরে বলে, "আমারা কি সেলিব্রেট করব?"
নিতম্ব চেপে ধরে পরীর নিম্নাঙ্গ টেনে ধরে নিজের তপ্ত কঠিন সিংহের ওপরে। পরী নিজের নিচে অভির তপ্ত শলাকার স্পর্শ পেয়ে মোচর দেয়। শরীরের মোচরের ফলে বারে বারে অভির সিংহ গিয়ে ধাক্কা মারে পরীর নারীত্বের দোরগোরায়। পরীর বক্ষোপরি তপ্ত নুড়ি অভির নগ্ন বুকে আঁচর কাটতে থাকে, পুড়িয়ে দেয় যেন অভির ত্বক। অভি থাকতে না পেরে চেপে ধরে ওর পুরুষ সিংহটিকে পরীর ঢাকা নারীত্বের দোরগোড়ায়। পরী মৃদুসুরে ককিয়ে ওঠে। প্রেমের দুধ সাগরে ডুব দেবার প্রস্তুতি আসন্ন। অভির মোচর আর চাপের ফলে পরী সিক্ত হয়ে ওঠে, কিছু টা ঘামে কিছুটা প্রেমে।
অভি আবার জিজ্ঞেস করে, "সোনা, আমার এবারে সেলিব্রেট করি?"
পরী ওর কাঁধ থেকে মাথা না উঠিয়ে কানে কানে বলে, "এত কিছু করে, আমার ভেতরে আগুন জ্বালানর পরেও তুমি জিজ্ঞেস করবে, শয়তান ছেলে।"
অভি দুষ্টুমি করে বলে, "ভদ্রলোকেরা সবসময়ে জানান দিয়ে ঘরে ঢোকে সোনা, আর তুমি ত আমার স্বর্গের অপ্সরা, তোমাকে না জানিয়ে কি করে..."
পরী, "উম্মম... কত আমার ভদ্রলোক। কিন্তু খোলা আকাশের নিচে নয়।"
অভি, "আমাদের কেউ দেখতে পাবে না বেবি।"
পরী, "শয়তান ছেলে, আমার কি লজ্জা করে না নাকি। এই রকম খোলা জায়গায় কি মানুষে এসব... ধুত তুমি না..."
পরী মাথা তুলে তাকায় অভির বাসনা তারিত চোখের দিকে। চিবুকের ওপরে চিবুক রাখে পরী, আলতো করে জিব বের করে চেটে দেয় অভির ঠোঁট। আধবোজা ঠোঁটের ভেতর থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাস স্নান করিয়ে দেয় অভির সারা মুখ।
অভি সিনহটিকে মোচর দিয়ে পরীর জানুসন্ধিতে পিষে দিয়ে বলে, "আমি আর থাকতে পারছিনা বেবি। আমাকে তুমি তোমার আলিঙ্গন থেকে অনেক দিন হতে বঞ্চিত করে রেখেছ। আমার ভেতরে বাঁধ আজ যেন ভেঙ্গে যাবে তোমার কোমল ছোঁয়ায়, তোমাকে আমার সাথে মিলিয়ে নেব আজ এই রাতে।"
অভির হাত নিচে নেমে যায়, পরীর গায়ের কাপড় ধিরে ধিরে টেনে উঠাতে শুরু করে। গ্রীষ্মের মৃদু বাতাস পরীর নগ্ন পায়ের গুলির ওপরে বয়ে যায়। আরও ওপরে টানে পরীর রাত্রিবাস, জানুর মাঝে মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যায়।
পরী চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, "শয়তান ছেলে... এখানে নয়।"
অভি ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু পরী সর্ব শক্তি দিয়ে অভিকে ছাদের মেঝের সাথে চেপে ধরে থাকে। পরী মৃদু সুরে বলে, "তুমি যদি আমার সাথে এই খোলা আকাশের নিচে... তাহলে কিন্তু আমি তোমার সাথে কোনদিন কথা বলব না।"
আস্তে করে পরীকে জড়িয়ে ধরে উঠে পরে অভি, পরী ক্ষণিকের জন্যেও অভির গলা ছারেনা। পরীকে কোলের ওপরে উঠিয়ে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
আলো জালাবার জন্য হাত বাড়ায় অভি, পরী চেঁচিয়ে ওঠে, "একদম আলো জ্বালাবে না কিন্তু।"
অভি, "কেন কি হল? আমি আমার পরীকে একবার পুরোপুরি দেখতে চাই।"
বিছানার চাদরে নিজেকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে নেয় পরী, ঠিক যেন মিশরের মমির মতন দেখায় ওকে। দুষ্টু হেসে পরী অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "হ্যাঁ এবারে আলো জ্বালাতে পার তুমি, আমি এই বিছানার চাদর গা থেকে নামাব না।"
দু’চোখ প্রেমের আবেগে চিকচিক করে ওঠে, ঠোঁটে লেগে কামনার তপ্ত আগুন। অভির সারা শরীরে ঘাম দেয়, সিংহ মাথা উঁচু করে নিজের জানান দেয়, বারে বারে ভেতর থেকে গর্জে ওঠে। গালের টোল যেন উত্তপ্ত লাভার ছোঁয়া পেয়ে লাল হয়ে উঠেছে।
অভি আলো জ্বালিয়ে পরীর দিকে এগিয়ে যায়, "তুমি তাহলে আমার সাথে খেলা করতে চাও, দুষ্টু মেয়ে।"
অভি ওর পায়ের দিক থেকে বারে বারে চাদর টেনে নিতে চেষ্টা করে আর বারে বারে পরী পা ছুঁড়ে ওকে আটকে দিতে চেষ্টা করে। অভি বিছানার ওপরে চরে যায় আর পরী ঘুরে শুয়ে পরাতে গায়ের থেকে চাদর সরে যায়। সুযোগ বুঝে শয়তানি করে পরীর কাপড় জানু ওপরে উঠিয়ে দেয়, পেলব মসৃণ জানুর ওপরে অভির উত্তপ্ত চোখের চাহনি যেন ফোস্কা ফেলে দিতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পা ঢেকে দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে পরী। অভি আর থাকতে পারেনা আর শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পরে প্রেয়সীর ওপরে, পরী সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে দেয় আর সারা ঘর অন্ধকারে ঢেকে যায়। জানালা দিয়ে চাঁদের নির্মল আলো ওদের বিছানার ওপরে খেলা করে ওদের উষ্ণ শরীর স্নান করিয়ে দেয়।
ঘামে নাকের ডগা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে, পরীর মুখ দেখে অভি নিজেকে আর দুরে সরিয়ে রাখতে পারে না। ওর ওপরে উঠে গিয়ে, দেহের দুপাসে হাত রেখে শরীরের নিচের অংশ পরীর ওপরে চেপে ধরে। পরীও শয়তানি করে জানু চেপে ধরে যাতে অভি ওর পায়ের ফাঁকে নিজেকে নিয়ে যেতে না পারে। অভি ঝুঁকে পরে পরীর মুখের ওপরে, পরীর দু হাত উঠে আসে অভির কাঁধের ওপরে আর ওর মাথা টেনে নিচে নামিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। ঠোঁটের মধুতে ভরিয়ে দেয় অভি পরীর সারা মুখ, জিবের ডগা ঢুকিয়ে দাঁতের পাটির ওপরে আলতো করে বুলিয়ে দেয়। পরী আর যেন নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারেনা অভি কামাগ্নির পরশ থেকে, ধিরে ধিরে জানু মেলে ধরে আহবান জানায় অভিকে। অভি নিম্নাগ চেপে ধরে পরীর নারীসুখের ওপরে। চুম্বন টিকে না থামিয়ে পরী চাদর টেনে দেয় ওদের গায়ের ওপরে। ওর যে ভীষণ লজ্জা। একে ওপরকে বাহু পাশে বেঁধে ফেলে ওরা।
শরীরের যত রমকুপ ছিল সবকটা উন্মুক্ত হয়ে ওঠে প্রেমের আগুনে, ধিরে ধিরে একে ওপরের হাত ধরে সুখের সাগরে ডুব দেয়। প্রেমের সেই সুন্দর স্বর্গ উদ্যানে ঘুরে বেড়ায়। রতিক্রীড়া শেষে অভির মনে একটা বেদনা থেকেই যায় যে প্রেয়সীর সম্পূর্ণ রুপ দর্শন সে আজও মন ভরে দেখতে পারল না।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment