আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
ভালবাসার রাজপ্রাসাদ
Written By pinuram
Written By pinuram
প্রত্যাবর্তন
নবীন ঊষার সাথে সাথে এক নতুন দিনের আগমন ঘটে পরী আড় অভির জীবনে।
একে একে কনের বাড়ির লোকজন জাগতে শুরু করেছে। সেই ভিড়ে পরী আবার হারিয়ে গেল। সুমন্ত মামা অভির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল যে রাতে কোথায় ছিল। উত্তরে অভি জানিয়ে দিল যে সারা রাত ও বিয়ের প্যান্ডেলে বসে কাটিয়ে দিয়েছে। সেই শুনে মামা হেসে ওকে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বলল। জানিয়ে দিল যে কয়েক ঘন্টা পরে বড় কনে কে নিয়ে বসিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ধিরে ধিরে বিয়ে বাড়ির লোকজন জেগে উঠে মেতে উঠেছে।
গ্রামের হাওয়ায় এক বিশুদ্ধতার আমেজ, বুক ভরে সেই বিশুদ্ধ বাতাস বুকের মাঝে টেনে নিল অভি। কোলকাতায় এই বাতাস পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার। কিছু পরেই বরযাত্রীদের সকালের খাওয়ার ব্যাবস্থা হয়ে গেল। অভির চোখ থেকে থেকে শুধু পরীকে খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু খুজলে কি হবে সেই কন্যের দেখা নেই।
সবে মাত্র খেতে বসেছে অভি, ঠিক এমন সময়ে মাথার পেছনে চাটি মারে পরী।
অভি "আউচ" করে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে রাতের পরী আর নেই। যে দাঁড়িয়ে সে যেন তরতাজা এক ফুল, সদ্য শিশিরে স্নান সেরে ওর কাছে দাঁড়িয়ে।
অভিমানি সুরে বলে, "আমাকে ছেড়েই খেতে বসে গেলে? লজ্জা করে না তোমার।"
অভি, "বাঃরে তোমার দেখা নেই। আড় আমার কি খিদে পায় না নাকি।"
পরী, "কাউকে কি আমার কথা জিজ্ঞেস করা যেত না নাকি।"
অভি, "আচ্ছা বাবা মাফ কর। এবারে বসে পরত, খেয়ে নাও। পেটে কিছু পরেনি বলে মনে হয় মাথাটা একটু গরম।"
প্রাতরাশ সেরে পরী চলে গেল কনের কাছে। বিদায়ের সময় বর্তমান। এই সময়টা অভির একদম ভাল লাগে না। কান্না কাটি একদম সহ্য করতে পারে না ও। বাড়ির ভেতরে ক্রন্দনের রল উঠেছে, সেই শুনে বুঝে গেল যে কনে বিদায় নিতে সময় লাগবে।
অভি চুপ করে উঠানের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক সেই সময়ে পাঞ্জাবির হাতায় টান লাগে, পেছনে তাকিয়ে দেখে যে পরী ওর পেছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে অভির হাত খানি শক্ত করে ধরে ঘন ঘন পিঠের ওপরে নাক ঘষছে। মনে হল যেন চোখের জল আটকানোর প্রবল চেষ্টা করে চলেছে।
অভি, "আরে বাবা, বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি। তোমার বৌদি তোমার বাড়ি যাচ্ছে আবার কি চিন্তা।"
ফুঁপিয়ে ওঠে পরী, "তুমি বুঝবে না।"
বাঁ হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের গোলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে অভি ওকে আসস্থ করতে চেষ্টা করে। পরী তখন অভির ঘিয়ে রঙের শাল খানি জড়িয়ে।
ফিরে যাবার জন্য দুটি গাড়ি প্রস্তুত।
পরী চোখ মুছে নিচু স্বরে বলে, "আমাকে বউদির গাড়িতে যেতে হবে। তুমি ওর বন্ধুদের গাড়িতে যেও। আমার সাথে গেলে কারুর নজরে চলে আসব আমরা।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই কনে কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল গাড়ি। অভি চাপল সুব্রতর বন্ধুদের গাড়িতে আর পরী অন্য গাড়িতে। অভি সামনের সিটে চুপ করে বসে, পেছনে সুব্রতর বন্ধুরা বসে। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলছিল, অভি বিশেষ কান দেয়নি ওদের কথাবার্তার মধ্যে। একসময়ে ওর কানে ভেসে আসলো শুচিস্মিতার নাম।
একজন, "কাল রাত থেকে শুচিস্মিতা কেমন যেন আলদা আলাদা মনে হচ্ছে।"
দ্বিতীয় জন, "হ্যাঁ রে, ঠিক বলেছিস। আমারো সেটাই মনে হয়েছে। এমনিতে খুব হাসি খুশি থাকে মেয়েটা কিন্তু কাল রাতে বেশ গম্ভির ছিল। অনেক ক্ষণ ধরে ওর কোন পাত্তা পাইনি।"
একজন, "ব্যাবহার টা কেমন যেন লাগল আমার, কি ব্যাপার কিছু জানিস নাকি?"
অপর জন, "জাঃ বাবা আমি কি করে জানব।"
অভির দিকে একজন প্রশ্ন করে, "তুমি উলুপি ম্যাডামের ছেলে তাই না।"
মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় অভি, "হ্যাঁ" ওদিকে বুকের ভেতরে আশঙ্কায় কাপুনি ধরে, পরী আর ওকে একসাথে দেখে ফেলেনি ত ওরা, দেখে ফেললেই এক কেলেঙ্কারি কান্ড হয়ে যাবে।
একজন, "ভাই তোমার মা আমাদের স্কুলের টিচার। আমাদের পড়াতেন আর খুব কড়া ম্যডাম ছিলেন।"
হেসে ওঠে অভি, "বাড়িতেও ভীষণ কড়া আমার মা।"
দ্বিতীয় জন, "সুব্রত তোমার মামা হন তাই না?"
অভি, "হ্যাঁ, কিন্তু মায়ের চেয় অনেক অনেক ছোটো ওরা।"
এর মধ্যে একজন একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অভির দিকে বাড়িয়ে দেয়, "তুমি কলেজে পড় তার মানে সিগারেট খাওয়া চলে তোমার। আরে লজ্জা পেও না আমরা তোমার মামার বন্ধু হলে কি হবে, আমাদের দাদা বলে ধরে নিও।"
অভি, "না, আমি কাল রাত থেকে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।"
একজন হেসে বলে, "কনের বাড়ির কাউকে মনে ধরে নিয়েছ নাকি। আচ্ছা তুই ড্রিঙ্ক করো?"
মাথা নাড়ায় অভি, "হ্যাঁ, তবে ভদকা আর রাম।"
একজন, "তাহলে বেশ জমবে। আজ রাতে বাড়ি ফিরে একসাথে বসা যাবে তাহলে। তুমিও চলে এসে আমাদের সাথে।"
কথা বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে একজনের নাম সমির আর একজনের নাম মৃগাঙ্ক। দুজনেই সরকারি চাকুরিরত এবং অবিবাহিত। এও জানা গেল যে সুব্রতর নাকি প্রেম বিবাহ আর কনের নাম মৈথিলী। মৈথিলীর বয়স পরীর মতন কিম্বা পরীর চেয়ে একদু মাসের ছোটো বড় হবে। সুব্রত আর মৈথিলী দেখা কোন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে হয়েছিল, সেই থেকে দু’জনের মাঝে প্রেম হয়। পরে সুব্রতর বড় দাদার মৈথিলীকে দেখে পছন্দ হয় এবং সুমন্ত মামা মৈথিলীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেন। এই ভাবে এই দুই প্রেমিক যুগল বিয়ের বন্ধনে বেঁধে যায়।
অভি মনে মনে ভাবে, "আমি খালি হাতে এসেছিলাম কিন্তু অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছি। আমার ভালবাসা, আমার পরী।"
তমসা উদ্ঘাটন (#01)
বাড়ির সবাই নববধুকে বরন করে নেবার জন্য আগে থেকেই দরজায় উপস্থিত ছিল। অভির মা, দিদা, মেঘনা এবং আরও অনেকে। গাড়ি থেকে নেমে অভি লক্ষ্য করল যে পরী আর মৈথিলী দুজনের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। পরীর হাসিখুসি মুখ দেখে অভির বেশ ভাল লাগল। উৎসুক নয়নে অভি তাকিয়ে ছিল পরীর দিকে কখন একবার চারচোখ এক হয়। মায়ের দিকে গুটি পায়ে এগিয়ে গেল অভি। বাবা এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অভি কে দেখে কাছে ডাকলেন। কনের বাড়ির কুশল মঙ্গল আর রাতের কথা জিজ্ঞেস করলেন। অভি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে রাতে কোন অসুবিধা হয়নি।
মৈথিলীকে বরন করার পরে, পরী ওকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়িতে ঢুকে পড়ার আগে চোরা চাহনি দিয়ে গেল অভির দিকে।
কিছু পরে মৃগাঙ্ক এসে অভিকে ওদের সাথে যেতে বলল। মৃগাঙ্কর বাড়ি দিদার বাড়ির কাছেই। অভি উত্তরে জানাল যে ও জামা কাপড় বদলে ওদের সাথে ওদের বাড়ি যাবে।
বাড়ি ঢোকা মাত্রই মা জিজ্ঞেস করলেন যে ওর শালটার কি হল। অভি জানিয়ে দিল যে রাতে পরীর খুব ঠাণ্ডা লাগছিল তাই ওর শাল পরী নিয়ে নিয়েছে। মা ওর কথা শুনে খুশি হয়ে বললেন যে ভাল কাজ করেছিস। বাথরুমে ঢুকতে যাবে অভি, ঠিক এমন সময়ে পরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের কাঁধের পাশ থেকে অভির দিকে দুষ্টু মিষ্টি হেসে মায়ের গালে চুমু খেল। মা পরীকে এক মৃদু বকুনি দিয়ে বলল রাতের জামাকাপড় বদলে নিতে।
পরী মাকে জিজ্ঞেস করল যে মা ওর মায়ের সাথে কথা বলেছেন কি না। মা উত্তর দিলেন যে রাতের বেলা সবকিছু মিটে যাবার পরে তিনি দিদার সাথে পরীর ব্যাপারে কথা বলবেন।
পরী আদর করে মায়ের গালে চুমু খেয়ে বলল, "তুমি আমার খুব ভাল দিদি। আজ থেকে আমি তোমাকে ছোটমা বলে ডাকব।"
মা ওর গালে আদর করে বলল, "তুই মা, চিরকাল আমার চোখের মনি ছিলিস। কতদিন তোকে দেখিনি। আয় কাছে বস, তোকে দুচোখ ভরে একবার দেখি।"
অভি, বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে মা মেয়ের আদর দেখতে থাকে। মা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে কি দেখছিস? চুপিচুপি মা মেয়ের কথা শুনছিস?"
পরী মায়ের কোলে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মা ওর চুলে বিলি কাটতে থাকে আর ছোট্ট বিড়ালের মতন পরী মায়ের আদর খেতে থাকে।
মা মেয়ের অতিরিক্ত প্রেম আর সহ্য হল না অভির। জামা কাপড় বদলানর জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে, পরী মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কাঁদছে আর মায়ের চোখেও জল। অভি মাকে জিজ্ঞেস করল যে কি হয়েছে। মা কিছু উত্তর দিলেন না, শুধু বললেন চলে যেতে।
ঠিক সেই সময়ে বাইরে থেকে মৃগাঙ্কর ডাক শুনে অভি ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। ঘরের মধ্যে ক্রন্দন রত অভির ভালবাসার দুই প্রতিমা, এক মা এক পরী। মৃগাঙ্কর বাড়ির দিকে যেতে যেতে অভি ভাবতে চেষ্টা করে যে কি কারনে মা আর পরী কাঁদতে পারে। ওর মাথায় কোন কারন খুঁজে পেলে না। মৃগাঙ্ক জানাল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুব্রতও ওদের সাথে ড্রিঙ্ক পার্টিতে যোগদান করবে।
মৃগাঙ্কর বাড়ি পৌঁছে অভি লক্ষ্য করল যে সুব্রত আগে থেকেই বাড়িতে উপস্থিত। তিন তলার ঘরে মদের আসর বসেছে, সমির বারটেন্ডার, সবাই কে গ্লাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে। সমির, মৃগাঙ্কর সুব্রতর আর অভির মাঝে শুধু মাত্র সুব্রতর বিয়ে হয়েছিল, বাকিরা অবিবাহিত। হাসি ঠাট্টা মজা মিলিয়ে মদ্য পান চলতে লাগল। সমির বেশ পটু হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিচ্ছে ওদের কে। সুরার নেশা সুব্রতর আর মৃগাঙ্কর রক্তে লেগে গেছে।
মদের ঝোঁকে মৃগাঙ্ক বলে ফেলল, "গুরু, আমি শুচিস্মিতাকে ভালবাসি।"
সুব্রত ওর কাধ চাপড়ে বলল, "বোকা... তুই ত একটা মস্ত গাধা। এতদিন চুপ করে ছিলিস।"
কথা শুনে অভির মনে হল যেন কেউ ওর কানের ওপরে গরম সিসে ঢেলে দিয়েছে। গ্লাসে চুমুক দিতে ভুলে গেল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মৃগাঙ্কর দিকে, "শালা বলে কি?"
মৃগাঙ্ক সুব্রতকে বলল, "তোর বড়দার ভয়ে ত আমি কিছু বলতেই পারিনি।"
সুব্রত, "বড়দা আমাদের বাবার মতন। বড়দা যতই রাগি হক না কেন, একদম নারকেল আমার বড়দা। ওপরটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা একদম নরম আর জলে ভর্তি।"
মৃগাঙ্ক, "ঠিক আছে তাই হবে। আমি তাহলে তোর বড়দার সাথে কথা বলব।"
মৃগাঙ্কর কথা শুনে অভির মনে হল যেন টেনে এক চড় কসিয়ে দেয় মৃগাঙ্কের গালের ওপরে, "শালার কিনা আমার প্রেমিকার ওপরে নজর?" কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, এক ঢোকে পুর গ্লাসটা গোলায় ঢেলে দেয়। রক্তের সাথে মদ মিশে গিয়ে মাথা ঝিনঝিন করে ওঠে।
সুব্রত অভির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, "এই ছেলে, এই অভিমন্যু। কিছু বল..."
ধুক করে ওঠে অভির বুক। হাতের সামনে ছিল রামের বোতল, একটানে ছিপি খুলে নিয়ে কিছুটা গোলায় ঢেলে নিল। দাতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করল, "আমার কি বলার আছে?"
সুব্রত ওর দিকে হেসে উত্তর দিল, "যা কিছু। তোমার কথা, তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা।"
ওর কথা শুনে যেন অভির প্রানে বাতাস এল, "যাক সুব্রত আমাদের সম্পর্কের কথা কিছু জানে না।"
হেসে জবাব দিল অভি, "না আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। কলেজের সবাই খালি বই পড়া মাগি।"
ওই কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে।
মৃগাঙ্ক নাছরবান্দা, "ভাই সুব্রত, আমি শুচিস্মিতাকে বিয়ে করব।"
ওর কথা শুনে সুব্রত বলল, "সে গুড়ে বালি। পরীর মাথায় নিশ্চয় কিছু একটা চলছে আর সেই জন্য"
অভির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, "ওর মা, আমাদের উলুপিদি আমার বিয়েতে এখানে এসেছেন। আমি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারছি যে আজ কালের মধ্যে এক বিশাল ঝড় আসবে বাড়িতে। আর সেই ঝড়ে অনেক কিছু বদলে যাবে। আমার ছোটবেলার কথা বিশেষ কিছু মনে নেই তবে মায়ের মুখে শুনেছি যে উলুপিদি আমাদের সংসার টাকে নিজের সংসারের মতন করে ভালবাসতেন, বিশেষ করে পরীকে। বাবা মারা যাওয়ার পরে উলুপিদি আমাদের সংসারটাকে টেনে ছিলেন। আমরা সবাই তখন খুব ছোটো। আমাদের ভাত কাপড়ের যোগাড় তিনি করেছিলেন সেই সময়ে। অনেক জল গড়িয়ে গেছে, অনেক দিন কেটে গেছে। আমাদের মধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটে ছিল যার জন্য আজ পর্যন্ত উলুপিদি আমাদের বাড়িতে আর পা রাখেননি। আমি হলফ করে বলতে পারি যে উনি যখন এ বাড়িতে পা রেখেছেন তখন বিশাল কিছু একটা ঘটতে চলেছে।"
অভির মাথা থেকে মদের ঘোর কেটে গেল। কথা বলার মধ্যে সুব্রত গ্লাস নিচে রেখে দিয়েছে। দু’চোখ লাল, কিঞ্চিত জলে টলটল করছে চোখ। সামির দেখল পরিবেশ বেশ সঙ্গিন হয়ে উঠছে। একথা সেকথা বলে পরিবেশটাকে একটু হালকা করতে চেষ্টা করল সমির। কিন্তু সুব্রত থামতে নারাজ, ওর রক্তে যেন আগুন লেগেছে।
তমসা উদ্ঘাটন (#02)
অভির হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, "কেন এসেছে তোমার মা?"
এই প্রশ্ন শুনে সবাই অভির দিকে তাকিয়ে। অভি কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা, চুপ করে থাকে।
সুব্রত, "আমাকে বলতে দে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমার দিদিরা ইন্দ্রানিদি আর চন্দ্রানিদি দায়ী। বড় লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাবার পরে দেমাকে ওদের পা আর মাটিতে পরে না। অতীতে যারা আমাদের সাহায্য করেছিল তাদের সবাই কে ওরা ভুলে গেছে। উলুপিদি যে কারনেই হক আজ আমাদের বাড়িতে এসেছেন, আমি তার পাশে আছি।"
অগত্যা অভিকে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে হল, "মা পরীর জন্য এ বাড়িতে এসেছেন। পরী এম.এস.সি পড়তে চায় এবং মায়ের মতন টিচার হতে চায়। কিন্তু তোমার ফ্যামিলির দিক থেকে অনেক বাধা আছে বিশেষ করে তোমার দিদিদের কাছ থেকে।"
সুব্রত অভির পিঠ চাপড়ে উত্তর দেয়, "আরে কোন চিন্তা করোনা। পরী যা চায় তা করবে। আমি আজ পর্যন্ত চুপ করেছিলাম কিন্তু আজ আমি মুখ খুলব। আজ দিদিরা আমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না।"
ঠিক সেইসময়ে দুষ্টু দৌড়ে এসে জানায় যে সুব্রতর আর অভির বাড়িতে ডাক পড়েছে। বাড়িতে খাবার ঘরে কিছুর আলোচনা চলছে। ওর মুখে এই কথা শুনে সুব্রতর আর অভির নেশার ঘোর একদম কেটে গেল। দু’জনে একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে।
খাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাড়ির সব বড়রা একত্রিত। বাবা, মা তার পাশে দিদা, তার পাশে ইন্দ্রানি মাসি আর চন্দ্রানি মাসি। ওদের সাথে ওদের স্বামিরাও উপস্থিত। তার পরে সশাঙ্ক মামা আর মেঘনা বসে। সব শেষে বসে আছেন সুমন্ত মামা। পরী, মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ইন্দ্রানি, "দেখ উলুপিদি, আমাদের পরিবারের কেউই গ্রাজুয়েশান করেনি তাও আমরা পরীকে পড়িয়েছি। পরীর বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এবারে ওর বিয়ে করা উচিত। আমরা ওর জন্যে ছেলে খুঁজছি। এতে ক্ষতি কি? দেখ, আমাকে আর চন্দ্রানিকে, আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক বাড়িতে হয়েছে।"
মা, "আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, পরী যদি হাইয়ার পড়াশুনা করতে চায় তাতে ক্ষতি কি?"
চন্দ্রানি ঝাজিয়ে ওঠে, "না করবে না। ওর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছিল।"
সুব্রত, "উলুপিদি যা বলছেন ঠিক বলছেন। পরীকে হাইয়ার পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত।"
ওর কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ইন্দ্রানি আর চন্দ্রানি হয়ত ভাবতে পারেনি যে সুব্রত এর মাঝে কথা বলতে পারে।
শশাঙ্ক, "তুই চুপ কর সুব্রত। এই সব ব্যাপারে তুই কথা বলিস না।"
চন্দ্রানি, "তোর মতামত কি কেউ জানতে চেয়েছে? তুই চুপ করে থাক।"
সুব্রত, "কেন আমি চুপ করে থাকব কেন? আমি কি এই পরিবারে কেউ নই?"
ঘরের পরিবেশ বেশ গরম হয়ে উঠেছে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে দেখল, পরীর চোখে জল। দিদা এক বার পরীর দিকে তাকাল। পরী মা'কে শক্ত করে ধরে আছে যেন কেউ ওর প্রাণ টাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইছে।
দিদা সুমন্ত কে জিজ্ঞেস করলেন, "তোর কি মতামত?"
সুমন্ত উত্তর দিলেন, "আমার মনে হয় পরীকে পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত। এর মাঝে আমরা পরীর জন্য ছেলে খুঁজি, এমন ছেলে যে কিনা পরীকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা করতে দেয় আর ও যেন ভবিষ্যতে চাকরি করতে পারে।"
পরী জোরে মাথা নাড়ায়, "না আমি বিয়ে করব না। তোমরা সবাই চাও যে আমি এখান থেকে চলে যাই।"
মা পরীকে শান্ত হতে বললেন।
ইন্দ্রানি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এতদিন পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে কেন এসেছ?"
দিদা ইন্দ্রানিকে এক বকুনি দিয়ে বললেন, "তুই চুপ কর, আর কোনদিন এইরকম ভাবে উলুপির সাথে কথা বলবি না। আমি শশাঙ্ককে বলেছিলাম উলুপিকে নিমন্ত্রন করতে।"
ইন্দ্রানি থামতে নারাজ, "আমরা দুই বোন এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছি। উলুপিদি কি করেছে আমাদের জন্য যে আজ উলুপিদি সতেরো বছর পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে?"
ওর কথা শুনে মনে হল যেন কেউ ঘরের মধ্যে একটা অ্যাটম বম্ব ফেলে দিয়েছে। সবাই চুপ। মায়ের দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
গুরু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন মা, "আমি কি করেছি না করেছি সেটা জিজ্ঞেস করিস না। আমি এখানে শুধু মাত্র পরীর জন্য এসেছি আর আমি তোদেরকে আমার কথা মানিয়ে ছাড়বো। জানতে চাস আমি কি করেছি এই পরিবারের জন্য?"
দিদা কেঁদে উঠে মাকে থামতে বললেন, "উলুপি দোহাই আমার, তুই চুপ কর। আমি পরীকে পড়াশুনা করতে দেব, কিন্তু তুই চুপ কর।"
মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, "তোরা কি জানিস? তোদের কি আর মনে আছে? মেসোমশাই মারা যাবার সময়ে পরী কোলের বাচ্চা আর অভি আমার পেটে। তোদের দেখার কেউ ছিলনা, তোরা সবাই ছোটো ছোটো। মাসিমা সবসময়ে কাঁদত, কি হবে ওনার পরিবারের। সুমন্ত স্কুল ছেড়ে দেয়, ধান কলে কাজ নেয় যাতে তোদের মুখে দু গ্রাস ভাত জোটে। আমার জীবনের সেই পাঁচ বছর আমি এই পরিবারকে দিয়েছি। আমার আয় আমার ভালবাসা সব কিছু। তোদের খাওয়া পরা তোদের জামা কাপড়। আজ তোরা একসাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস সেটা আমার ওই পাঁচ বছরের জন্য।"
দিদা মায়ের হাত ধরে কাতর মিনতি করেন, "দয়া করে চুপ কর, উলুপি।"
পরী নিস্পলক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সমানে গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে চলেছে। অভি আর সুব্রত একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে। মায়ের কথা শুনে কারুর মুখে কোন কথা নেই।
মা, "ওই অভির সাথে, বুকের রক্ত আর দুধ দিয়ে আমি পরীকে বড় করেছি। তোরা সবাই বলতিস যে পরী অভিশপ্ত বলে দূর দূর করতিস, কেননা ওর জন্মাবার পরেই মেসমশাই দেহ রাখেন। আমি বুক কেটে দু টুকরো করে দিয়েছিলাম যাতে পরী বাঁচে।"
সুব্রত চুপ করে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে পরে। ঘরের মধ্যে সবার চোখে জল। ইন্দ্রানি চন্দ্রানি আর তাদের স্বামীরাও হতবাক। বাবা এর মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের মনের অভিব্যাক্তি লুকানোর জন্য।
মা, "যদি আমি বুক কেটে দেখাতে পারতাম তাহলে আজ সেটাও তোদের দেখিয়ে দিতাম আমি। পরী আমার মেয়ে নয় কিন্তু আমার মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি। আমি এখানে তোদের জন্য আসিনি। আমি জানি তোরা সবাই এখন বড়লোক হয়ে গেছিস, পয়সার দেমাকে মাটিতে তোদের পা পরেনা।"
পরী আর দিদা সমানে কেঁদে চলেছে, অভির ও দু’চোখ জ্বালা করছে কিন্তু ছেলে বলে সবার সামনে কাঁদতে পারছে না।
মা, "কাল, বিয়ে বউভাত শেষ হয়ে যাবার পরে, আমি পরীকে নিয়ে কোলকাতা চলে যাব। আমি ওর এডমিশান কোলকাতা উনিভারসিটি তে করাব এবং ওর পরাশুনার দায়িত্ব আমার। তোদের কোন পয়সা আমার চাইনা আর আমি তোদের কোন কথার ধার ধারিনা।"
মায়ের বুক থেকে এক দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হল। পরী মায়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। শশাঙ্ক আর সুমন্ত দুজনেই উঠে গিয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল। অভির মনে হল যেন একটা বিশাল পারিবারিক নাটক শেষ হল এইমাত্র। চারদিকে যেন চোখের জলের ছড়াছড়ি।
অবশেষে সুমন্ত বললেন, "উলুপিদি যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। পরীর ওপরে আমাদের চেয়ে বেশি অধিকার উলুপিদির আর তাঁর অধিকার আছে পরীকে নিয়ে যাওয়ার। আমরা সবাই ভুলে গেছিলাম যে উলুপিদি আমাদের পরিবারের জন্য কি করেছিলেন।"
কিছুক্ষণ থেমে সবার দিকে একবার দেখে বললেন, "কাল বাদে পরশু, আমি এই বাড়ির ভাগ করব। এই বাড়ি সাত ভাগে ভাগ হবে।"
ইন্দ্রানি জিজ্ঞেস করল, "সাত ভাগে কেন? আমরা তো ছয় ভাই বোন?"
যেন একটা সিংহ গর্জে উঠল, "তুই একদম চুপ করে থাকবি। ছয় ভাগ আমাদের ছয় ভাই বোনের আর এক ভাগ মায়ের। মা যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যাবেন।"
শশাঙ্ক সুমন্তর কথায় সায় দিলেন।
সুমন্ত, "আমি চাইনা এই কথা এই চার দেওয়ালের বাইরে যাক। কাল সুব্রতর বউভাত, আমি চাইনা ওর বউভাত মাটি হক। কথা শেষ, আর যেন এই নিয়ে বাড়িতে কোন কথা ওঠে না।"
এই সব তর্ক বিতর্কে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অভি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত ন’টা বাজে।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment