আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
পাপ কাম ভালোবাসা
Written By pinuram
Written By pinuram
উনবিংশ পর্ব (#01)
মুসৌরি ভ্রমণের পরের রবিবার, সকাল থেকে দেবশ্রী খুব ব্যাস্ত। কাজের লোক দিয়ে সব ঘর আগের দিন পরিষ্কার করে রেখেছিল। দেবায়ন নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার করে। দেবশ্রীর চিন্তা, মিস্টার সেন আর পারমিতা অনেক বড়োলোক, ওদের এই ছোটো বাড়িতে কি ভাবে মানিয়ে নেবে। গ্রীষ্মকাল বাড়িতে এ.সি লাগানোর মতন শখ কোনদিন হয়নি ওর। বারেবারে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মিস্টার সেনের গরম লাগলে কি করা যাবে? দেবায়ন আসস্থ করে জানিয়ে দেয় অইসব অবান্তর ভাবনা চিন্তা দূর করে দিতে। দেবায়ন, মায়ের সাথে কাজে সাহায্য করে। দেবায়ন বারবার বলে যে মিস্টার সেন অথবা পারমিতা, ওদের বাড়িতে এসে কোন রকম অসুবিধেতে পড়বে না। দেবশ্রীর মন তাও মানে না। দুপুরের জন্য, মাটন বিরিয়ানি সেই সাথে কষা মাংস। রাধাবল্লভি, ছোলার ডাল, ইত্যাদি বেশ কয়েক প্রকার ব্যাঞ্জন তৈরি করা হয়ে গেছে।
দুপুর বেলায় অনুপমা, বাড়ির সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যায় দেবায়নের বাড়িতে। দুই পরিবারের মিলনে বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। গরমে ঘেমে যান মিস্টার সেন, সেই দেখে দেবশ্রী একটু ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পরে। পারমিতা হেসে জানিয়ে দেয় একদিন ঘামিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। দুপুরে খাবার সময়ে দেবশ্রী, মিস্টার সেনকে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। অনুপমা আর দেবায়ন প্রমাদ গোনে, হয়ত দেবশ্রী মিস্টার সেনকে সব কিছু বলে দেবে। দেবশ্রী আর মিস্টার সেন একসাথে দেবায়নের দিকে তাকায়, দুইজনের চোখে ভিন্ন প্রশ্ন। দেবায়ন হালকা মাথা দুলিয়ে, “না” বলে। উত্তর একটা, কিন্তু ভিন্ন প্রশ্নের ভিন্ন অর্থ বহন করে সেই মাথা নাড়া। মিস্টার সেন দেবশ্রীকে বলেন, এই তথ্য প্রযুক্তির সময়ে সব ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার শেখা একটু জরুরি। কোন শিক্ষা ফেলা যাবে না, ভবিষ্যতে কোন না কোন ভাবে কাজে লেগে যাবে। দ্বায়িতজ্ঞান পূর্ণ অভিবাবকদের মতন মিস্টার সেন আর দেবশ্রী, দেবায়ন আর অনুপমাকে কম্পিউটার শেখার জন্য অনুমতি দেয়। অনুপমা খাওয়ার পরে দেবশ্রীকে অনুরোধ করে যে ওদের ফার্মের প্লানের কথা এখুনি যেন ওর বাবাকে না জানায়। বুদ্ধিমতী দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ওদের আই.টি ফার্মের কথা মিস্টার সেনের সাথে আলোচনা করবে।
গ্রীষ্মের ছুটির মাঝে একদিন দেবায়ন আর অনুপমা, পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা কম্পিউটার সংস্থায় যায় খোঁজ খবর নিতে। এক বছরের ফাস্ট ট্রাক কোর্স, তাড়াতাড়ি সব শেখানর জন্য একটু পয়সা বেশি লাগবে সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে সময় একটু বেশি দিতে হবে। দুটো সেমেস্টারে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার কথা শুনে দেবায়ন একটু ইতস্তত করে, মাকে ফোনে জানায় টাকার কথা। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যত টাকা লাগে তার জন্য তৈরি। দেবায়ন আর অনুপমা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে। শনিবার আর রবিবার সারাদিন ক্লাস, সেই সাথে সপ্তাহে দুই দিন, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার বিকেলে দুই ঘন্টার ক্লাস। একদিকে কলেজের ফাইনাল ইয়ার, সেইসাথে কম্পিউটার ক্লাস। দেবায়ন আর অনুপমা বুঝতে পারে সামনের দিন গুলো ওদের নিঃশ্বাস ফেলার মতন সময় থাকবে না। কম্পিউটার সংস্থা থেকে বেড়িয়ে দেবায়ন আর অনুপমা, ফ্লুরিস কাফেতে বসে।
অনুপমা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ গো, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, এইসব আমরা পারব ত? মানে কলেজ আর কম্পিউটার একসাথে।”
এক প্রশ্ন দেবায়নের মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু অনুপমাকে আসস্থ করে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পারবো। তুমি কলেজের পড়াশুনাতে মন দাও আর আমি কম্পিউটার ক্লাসে।”
অনুপমা, “মানে, তুমি কি কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে দেবে নাকি? গ্রাজুয়েশান না করলে মামনি কিন্তু তোমাকে আস্ত রাখবে না।”
দেবায়ন হেসে বলে, “না রে পাগলি মেয়ে। আমি বলছিলাম, তুমি আমাকে কলেজের নোটস দিয়ে হেল্প করবে আর আমি তোমাকে কম্পিউটার শিখিয়ে দেব। পড়াশুনা বন্টন করে নেব আমাদের মাঝে।”
অনুপমা, “দেখ পুচ্চুসোনা, আমার কম্পিউটার না শিখলেও চলবে। আমি ত শুধু তোমার সাথে কাটাব বলে জয়েন করেছি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, এই কম্পিউটার কিন্তু পরে করলেও চলবে। গ্রাজুয়েশানটা একটু ঠিক করে করে নাও।”
দেবায়ন, “উফফফ বাবা, সেই জন্য বলছি, তুমি ফিসিক্স পড় আর বাকি আমার ওপরে ছেড়ে দাও।”
অনুপমা, “তোমার মাথার মধ্যে কি ঘুরছে একটু পরিষ্কার করে আমাকে জানাবে?”
দেবায়ন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “তোমাকে কতবার এক কথা বলতে হয় একটু বলত? আমরা কলেজের পরে একটা আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলব ব্যাস আবার কি।”
অনুপমা দেবায়নের হাত ধরে মিনতির সুরে বলে, “সোনা, বড্ড ভয় করছে।”
দেবায়ন, “কম্পিউটার শিখছি বলে ভয় করছে? কেমন মেয়ে তুমি?”
অনুপমা, “না সোনা, সেটা নিয়ে ভয় নয়। জানিনা, তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বড় একটা ঝড় আসবে।”
দেবায়ন অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে প্রেয়সীর চোখ দুটি ছলছল করছে, কাঁধের উপরে হাত রেখে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে, “কি হল তোমার?”
অনুপমা, “আচ্ছা পুচ্চু, এই কম্পিউটার শিখে তুমি কোন চাকরি করতে পারো না?”
দেবায়ন অবাক হয়ে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত এই প্রশ্ন কেন? নিজের বাবাকে অবিশ্বাস করছ তুমি?”
অনুপমার মনে ঠিক সেই কথাই জেগেছিল, প্রানের মানুষ যে অলীক স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে গেছে সেটা দেখে একটু আহত হলেও সেটা লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলে, “না মানে কিছু না। মানে আমরা পারবো ত এই সব করতে?”
কথা ঘুরিয়ে দেয় বুদ্ধিমতী অনুপমা, “আগামী সপ্তাহে কলেজ শুরু। কলেজে এবারে অনেক জোড়া পাখী দেখব। পরাশর জারিনা নতুন প্রেমে বিভোর, ওইদিকে আমাদের সেই পার্টিতে সঙ্গীতা আর মিচকে প্রবাল জুটি বেঁধে নিল। আচ্ছা একটা কথা বল, পরাশর আর জারিনা, ওদের সম্পর্কের কি হবে? না মানে আমার ত মনে হয় না দুইজনের বাড়ির কেউ মেনে নেবে। দুইটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে মেয়ের সম্পর্ক। সমাজের চোখে খুব বড় ব্যাপার। ওদের পরিবার ওদের মেনে নেবে কি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “চেষ্টা করতে দোষ কি? এই দেখ না, মানুষ আগে পাখী দেখে শুধু উড়ার স্বপ্ন দেখত। কেউ যদি এগিয়ে না এসে ডানা না লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকত তাহলে কি আজ প্লেন বলে কিছু হত? কাউকে ত পথ দেখাতে হয়, প্রেম কি আর ধর্ম, জাত পাত মানে? মানলে কি আর তুমি আর আমি এই জায়গায় বসে কফি খেতাম।” বলেই দেবায়ন অনুপমার গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “ধুত, তুমি না একদম শয়তান। এত লোকের মাঝে একি করলে? এটা কি লন্ডন নাকি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “কাউকে একটা শুরু করতে হয়।”
অনুপমা, “এটা ভারতবর্ষ পুচ্চু। আরও এক হাজার বছর ধরে বয়ে যাবে এই গঙ্গার জল, কিন্তু এখানের মানুষের মনের বিচারধারা বদলাবে না পুচ্চু। এরা শিবলিঙ্গ পুজ করবে, ফুল বেল পাতা চড়াবে, দুধ মধু ঢালবে। কিন্তু সেই লিঙ্গ আর যোনির আসল অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করে পরে থাকবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা খাজুরাহ, কোনারক দেখতে যাবে কিন্তু যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে লজ্জা পাবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা নারীহত্যা করতে পিছপা হবে না, নারীদের উপরে অত্যাচার করতে পিছপা হবে না, কিন্তু মা কালী, মা দুর্গার পুজোতে লাখ লাখ টাকা চাদা দেবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা ভালোবাসার সন্মান দিতে জানে না কিন্তু রাধা গোবিন্দর পুজোতে নেচে কুদে বেড়াবে, এই হল আমাদের দেশ।”
দেবায়ন হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত দার্শনিক হয়ে উঠলে? ছাড়ো এসব কথা, মিমি সুন্দরীর কি খবর?”
অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “ধুর বাবা, পাশে বৌ বসে তাও স্বাশুরির দিকে নজর। একে নিয়ে আর পারা গেল না।”
দেবায়ন অনুপমা গাল টিপে বলে, “আচ্ছা না হয় ওর কথা না জিজ্ঞেস করলাম, একবার আমার পায়েল সুন্দরীর কথা শুনি।”
অনুপমা, “পায়েল ভালো আছে, প্রত্যেকদিন কথা হয় ফোনে। ওর বাবা বাড়ি ফিরে এসেছে তাই বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া এক প্রকার বন্ধ। কলজে খুললে আবার ওর দেখা পাবে।”
দেবায়ন অনুপমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায়। সেখানে পারমিতার সাথে দেখা। আজকাল পারমিতা মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দেবায়নকে বাড়িতে দেখে পারমিতা বেশ খুশি, অনেকদিন পরে দেবায়নের সাথে দেখা। অনুপমা, মায়ের চেহারার লালিমা দেখে বুঝে যায় মায়ের মনের অভিব্যাক্তি, মনে মনে হেসে ফেলে। পারমিতা দেবায়নকে বলে আজকাল আর ওর দিকে নজর দিচ্ছে না। দেবায়ন হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে নিশ্চয় দেবে, বর্তমানে দেবায়নের মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক কাজের ভার। পারমিতা হাসে, অনুপমার গাল টিপে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নকে কেড়ে নেবে না। অনুপমা, মাকে জড়িয়ে ধরে জানিয়ে দেয় সেই বিশ্বাস টুকু দেবায়ন আর মায়ের উপরে আছে।
কলেজ শুরু হয়ে যায় এক সপ্তাহের মধ্যে। সেই সাথে শুরু হয়ে যায় কম্পিউটার ক্লাস। কম্পিউটার ক্লাসে বেশি ছাত্র ছাত্রী নেই, বিকেলে যাদের সাথে ক্লাস করে অনুপমা আর দেবায়ন, তারা সকলেই কর্মরত মানুষ, কাজের তাগিদায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি শিখতে এসেছে। ক্লাসের ম্যাডাম, মিস সুপর্ণা চ্যাটারজি বেশ ভালো মহিলা, কম ছাত্র ছাত্রী থাকায় তার পড়ানোর বেশ সুবিধা। কম বয়সি শিক্ষিকা দেখে দেবায়নের অতি পুরাতন স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই সুপর্ণাকে অবান্তর প্রশ্নে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে, আর অনুপমা পাশে বসে বকে মেরে চুপ করিয়ে রাখে। ম্যাডামের পেছনে লাগতে পিছপা হয় না দেবায়ন।
প্রতিদিন সকালে পায়েল, অনুপমার বাড়িতে আসে সালোয়ার পরে, অনুপমার বাড়িতে ড্রেস বদলে, স্কার্ট টপ অথবা ছোটো জিন্স ফ্রিল শার্ট পরে দুই বান্ধবি গাড়ি নিয়ে কলেজে বেড়িয়ে পরে। কলজে খোলার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে পায়েলের চেহারায় এক খুশির ছোঁয়া ভেসে ওঠে। অনুপমা সেই হাসি সেই আনন্দের আলোক ছটা দেখে বুঝে যায় পায়েলের জীবনে এক নতুন ব্যাক্তির আগমন ঘটেছে। কলেজের পথে একদিন পায়েল জানায় যে একটা ছেলের সাথে ওর দেখা হয়েছে। অনুপমা সেই ছেলেটার সম্বন্ধে জানতে চাইলে পায়েল বলে যে ওর পিসতুতো দাদার এক বন্ধু, ডালহৌসিতে একটা অফিসে চাকরি করে। প্রেম প্রীতি পর্যন্ত কথা এখন যায়নি তবে ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে পায়েলের। অনুপমা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তাহলে অঙ্কনের সাথে পায়েলের কোন সম্পর্ক নেই। অনুপমা জানতে চায় ছেলেটার সাথে কবে দেখা করাবে। পায়েল মিচকি হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ছেলেটার সাথে দেখা করাবে। ছেলেটার নাম জানতে চাইলে জানায় যে অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, বাড়ি নৈহাটি।
অনুপমা কলেজে এসে দেবায়নকে পায়েলের কথা জানায়। দেবায়ন পায়েলকে উত্যক্ত করার জন্য বলে শেষ পর্যন্ত কি হাত ছাড়া হয়ে গেল? পায়েলকে সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দেয় মজা করে। সঙ্গম সম্ভোগের সময়ে কামাবেগে পায়েল বলেছিল যে দেবায়নের জন্য ওর শরীর অবারিত দ্বার। পায়েলের গালের রঙ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। অনুপমা, পায়েলকে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে যে কথা না রাখলে কিন্তু দেবায়ন একদিন ওকে ধরে নিয়ে জোর করে সঙ্গম করবে। অনুপমা কথায় পায়েল শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়। অনুপমা হেসে জানিয়ে দেয় যে ওরা মজা করতে চাইছিল।
গরমের ছুটির শুরুতে, দেবায়নের বাড়ির একরাতের পার্টি সব বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে এক নতুন যোগসুত্র স্থাপন করে দেয়। সঙ্গীতা, ছোটো স্কার্ট, হাতা বিহীন টপ ছেড়ে সালোয়ার কামিজ অথবা লম্বা স্কার্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছে। প্রবালের চোখ দেখলে বোঝা যায় দুই বছর আগেকার সেই প্রবাল এখন সঙ্গীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রেয়া, সঙ্গীতা, পায়েল আর অনুপমার বন্ধুত্ত আগে থেকেই বেশ ঘন ছিল, সেই এক রাতের পরে ওদের বন্ধুত্ত যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে। প্রবাল আগে কারুর সাথে বিশেষ কথা বলত না, ওর মুখে কথা ফুটেছে। ধিমান আর পরাশর আগে দেবায়নকে একটু অন্য নজরে দেখত কারন ওদের নজর অনুপমার দিকে ছিল, কিন্তু নিজেদের বান্ধবী পেয়ে যাওয়ার পরে আর সেই রাতের পার্টির পরে সবার মনের দ্বার যেন খুলে গেছে। ওদের ক্লাস একটু ছন্ন ছাড়া ছিল আগে, গ্রীষ্মের ছুটির পরে সবার রঙ সবার চালচলন পালটে যায়, দেখে মনে হয় যেন এক হাতের পাঁচ আঙুল সবাই, একটা আঙ্গুলে ব্যাথা পেলে সম্পূর্ণ হাত যেন ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে।
একদিন লাঞ্চের পরে কোন ক্লাস ছিল না, সব বন্ধু বান্ধবীরা ফ্লুরিস কাফেতে চলে আসে আড্ডা মারতে। শ্রেয়া একবার অনুরোধ করেছিল রূপককে ডাকার জন্য, সবাই চেঁচিয়ে ওঠে যে বাইরের কাউকে ডাকা যাবে না। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া আর ধিমান চুপচাপ বসে পরে। গল্প চলাকালীন পায়েল কিছু পরে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। অনুপমা আর সবাই কারন জিজ্ঞেস করাতে পায়েল জানায় যে তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে ওর বাবা বকা দেবেন। পায়েলের বাবার সম্বন্ধে শ্রেয়া আর অনুপমা ভালো ভাবে জানে। পায়েল চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, অনুপমা একবার মাথা উঠিয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। সাধারণত অনুপমা সাথে থাকলে পায়েল ওর সাথেই বাড়ি ফেরে, কারন পায়েলকে ওর বাড়িতে নেমে জামা কাপড় বদলে বাড়ি ফিরতে হয়। পায়েলের আচরনে অনুপমার মনে একটু সন্দেহ হয়, অনুপমা জোর করে জিজ্ঞেস করে পায়েলের বাড়ি ফেরার আসল কারন। এমন সময়ে পায়েলের মোবাইলে ফোন আসে। সবাই বুঝে যায় যে পায়েল কারুর সাথে দেখা করতে চলেছে। সব বান্ধবীরা পায়েলকে চেপে ধরে ওর মনের মানুষের কথা জিজ্ঞেস করে। চাপাচাপির ফলে শেষ পর্যন্ত পায়েল, সেই ব্যাক্তিকে জানিয়ে দেয় যে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে তাই সেদিন আর দেখা করতে পারবে না। গল্পের মোড় ঘুরে যায় সবার প্রেম কাহিনীর দিকে। অনুপমা পায়েলকে তার প্রেম কাহিনী শোনানোর জন্য চেপে ধরে।
পায়েল মুখে লাজুক হাসি নিয়ে বলতে শুরু করে, “তোরা যখন মুসউরি বেড়াতে গেলি তার মাঝে একদিন আমি পিসির বাড়ি, নৈহাটি বেড়াতে গেছিলাম।”
সঙ্গে সঙ্গে সবার প্রশ্ন ছেঁকে ধরে অনুপমা আর দেবায়নকে, “এই কি রে তোরা কবে মুসউরি বেড়াতে গেছিলি? একা একা, তোদের সাহস কম নয় ত?”
দেবায়ন আর অনুপমা ফিকফিক করে হেসে ফেলে। পায়েল উত্তর দেয় অনুপমার হয়ে, “ওরে ছাগল, দেবায়নের মায়ের সাথে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। বিয়ের আগেই মেয়ে স্বাশুরিকে হাত করে নিয়েছে। দেবায়নের মা, বউমা বলতে একেবারে অজ্ঞান, পারলে কাল ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আর ওইদিকে দেবায়নকে আর বলিস না, কাকু কাকিমা পারলে দেবায়নকে মাথায় করে রাখে। বর্তমানে দুই বাড়ির এমন সম্পর্ক, বুঝলি কিছু।”
অনুপমা একপ্রকার দেবায়নের কোলে শুয়ে ছিল, সেখান থেকে উঠে পায়েলের মাথায় চাটি মেরে জিজ্ঞেস করে, “ধুর শালা, তুই তোর গল্প বল না শুনি।”
পায়েল, “আমার গল্প বিশেষ কিছু না। পিসির বাড়ি নৈহাটি গেলাম সেখানে পিসতুত দাদার এক বন্ধুর সাথে দেখা হল। নাম অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, ডালহৌসিতে একটা এক্সপোর্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে তবে এই মাত্র কথা। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কয়েক বার, ভালো ছেলে, তবে প্রপোস করেনি এখন। যেদিন প্রোপস করবে তারপরের দিন তোদের জানিয়ে দেব।”
পায়েলের মুখে নাম শুনে সঙ্গীতা একটু ভাবনায় পরে যায়, পায়েলকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা নৈহাটির কোথায় থাকে। পায়েল জানায়, যে নৈহাটির মীরা বাগানে ওদের বাড়ি। পায়েল কারন জিজ্ঞেস করে সঙ্গীতাকে।
সঙ্গীতা জানায়, “আমার মামা বাড়ি মীরা বাগানে, আমি ছেলেটাকে ভালো ভাবে না হলেও একটু চিনি। ছেলেটা একটু বকাটে আছে, তুই শুধু একটু সাবধানে থাকিস। পুজোতে মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে অনেক বার দেখেছি প্যান্ডেলে বসে শালা ঝারি মারছে। প্রবলেম শালা ঝারি মারা নিয়ে নয়, তবে ওর আচার ব্যাবহার আমার ঠিক মনে হয় নি। কেমন ইতর ছোটলোকের নজর ওর। ও ডালহৌসিতে চাকরি করে কি না জানিনা।”
পায়েলের সাথে দিনে চার পাঁচের আলাপ, “কই না ত আমার সেইরকম কিছু মনে হল না ওকে দেখে? পিসতুতো দাদার ভালো বন্ধু, দেখতে শুনতে ভালো, বেশ পয়সা ওয়ালা বাড়ির ছেলে। ওদের নাকি বেশ বড় ব্যাবসা আছে স্টেসানের কাছে।”
সঙ্গীতা ম্লান হেসে বলে, “জানিনা ভাই, তবে একটু বাজিয়ে নিস। ফাটা ঢোল কিনে ফেললে কিন্তু সারা জীবন সেটা কাঁধে বইতে হবে।”
সঙ্গীতার কথা শুনে সবাই পায়েলের দিকে তাকিয়ে সাবধান করে দেয়। পায়েল জানিয়ে দেয় যে একবার ভালো ভাবে জেনে বুঝে নেবে তারপরে না হয় ভালোবাসা প্রেমের কথা চিন্তা করে দেখবে।
উনবিংশ পর্ব (#02)
সঙ্গীতার কথা শুনে সবাই পায়েলের দিকে তাকিয়ে সাবধান করে দেয়। পায়েল জানিয়ে দেয় যে একবার ভালো ভাবে জেনে বুঝে নেবে তারপরে না হয় ভালোবাসা প্রেমের কথা চিন্তা করে দেখবে।
পায়েলের পরে সবাই সঙ্গীতাকে ছেঁকে ধরে ওদের প্রেমের গল্প শোনার জন্য। সঙ্গীতা চোরা চোখে একবার প্রবালের দিকে তাকায়, অনুপমা সঙ্গীতার থুতনি নাড়িয়ে বলে, “বাপরে, যে মেয়ের মুখে কিনা সকাল বিকেল খই ফুটত সেই মেয়ের চোখে লাজুক হাসি। ও মা গো, রাখি কোথায় এই মেয়েকে।”
প্রবালের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “মাল আমার জন্মদিনে রান্না করতে করতে আমার সুন্দরী বান্ধবীকে হাতিয়ে নিলি। আমি কি পেলাম? আমার প্রেসেন্ট চাই।”
প্রবাল মাথা নিচু করে লাজুক হেসে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি চাস বল।”
ধিমান চেঁচিয়ে ওঠে, “অনুপমার জন্মদিনের মতন একটা ধাসু পার্টি চাই।”
ওই দিনের পার্টির কথা সব বন্ধু বান্ধবীদের মনে গাঁথা। সঙ্গীতা আর প্রবাল ছিল না কিন্তু সঙ্গীতা জানে সেই রাতে পার্টিতে কি হয়েছিল। সেই কথা মনে পরে যেতেই সঙ্গীতার সাথে সাথে অনুপমার মুখ লাল হয়ে যায়। দেবায়ন অনুপমার কানেকানে জিজ্ঞেস করে যে পার্টি একটা করা যেতেই পারে।
পেছন থেকে সমুদ্র চেঁচিয়ে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ সেদিনের মতন পার্টি চাই।”
ধিমান আর দেবায়ন হেসে ফেলে সমুদ্রের কথা শুনে। দেবায়ন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “শালা চুপ করে যা। বেশি বকলে যেখান থেকে বেড়িয়েছিস সেখানে ঢুকিয়ে দেব আবার। বোকাচোদা, নিজের মুরোদ নেই ফাউ খেলে সেদিন পার্টিতে টিকে গেলি।”
তনিমার দিকে সবার নজর চলে যায়। তনিমা কোন রকমে শ্রেয়ার পেছনে মুখ লুকিয়ে নেয় লজ্জায়।
অনুপমা, সঙ্গীতা আর প্রবালকে বলে, “তোদের বিয়ে যেদিন হবে সেদিন একটা প্রেসেন্ট নেব।”
দেবায়ন এবারে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে বাল, তুই শালা কি চুপ করে থাকবি?”
রজত, “শালা প্রেম করলি ত করলি শেষ পর্যন্ত জারিনা, একজন মুসলিম মেয়েকে? তোর বাড়ির লোক ওর বাড়ির লোক মেনে নেবে? শালা তোকে কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবে দুই বাড়ির লোক, সেটা ভেবেছিস।”
পরাশর, “প্রেম ভালোবাসা ভাই ধর্ম মানে না। জারিনা আর আমি ভালো ভাবে জানি আমরা কি করছি, এর পরিণতি তুই যা বলেছিস, সেটা ঘটার সম্ভাবনা আশি থেকে নব্বুই শতাংশ। তবে ওই যে বাকি থাকে দশ শতাংশ, আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে নিজেদের আত্মীয় সজ্জন পরিবারকে বুঝাতে চেষ্টা করব। যদি শেষ পর্যন্ত না হয় আমাদের মিল, তাহলে দেখা যাবে।”
সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠে। বাধ্য হয়ে পরাশর মাথা চুলকিয়ে ওদের প্রেমকাহিনী গোড়া থেকে বলতে শুরু করে, “গত অক্টোবরে ঠিক পুজো শেষ হয়ে গেছে। এক সন্ধ্যেবেলায় আমি পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে দাঁড়িয়ে, বাড়ি যাবো বলে বাসের অপেক্ষা করছি। ঠিক পাশ দিয়ে একদল মেয়ে হেঁটে গেল, তার মধ্যে একজন ভারী সুন্দরী দেখতে। পাশের মেয়েদের সাথে দেখে বুঝলাম যে ও মুসলিম, কিন্তু জারিনাকে দেখে একদম মনে হয় না। জারিনাকে দেখে মনে হল যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে একটা ডানা কাটা পরী, অরদিক থেকে আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। হাতে স্কুলের ব্যাগ, পরনে স্কুল ড্রেস দেখে বুঝতে পারলাম যে স্কুলে পড়ে, কিন্তু বেশ ডাগর দেহের কাঠাম। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কিছুদুর ওদের পেছন পেছন হাটলাম। ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ওরা কোচিং থেকে ফিরছে। তারপরে কলেজ ছুটি হলেই আমি পার্ক সার্কাস মোড়ে চলে যেতাম। প্রায় দিন আমি ওখানে ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম ওই সময়ে। কোনদিন দেখা হত, কোনদিন হত না। মাঝে মাঝে জারিনা হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকাত, আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। আবার যেই ওরা হাঁটতে শুরু করত আমি ওদের পিছু নিতাম। ওই দুই পা চলেই ওর প্রেমে পরে গেলাম আমি, জানি না তখন কি করব। কিন্তু জারিনার চোখের অধরা ভাষা আর রুপের টান প্রতিদিন বিকেলে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ওই পার্ক সার্কাস মোড়ে। রোজদিন চোখে চোখে কথা হত কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পেতাম না।”
অনুপমা, শ্রেয়ায় সবাই মাথা নাড়ায়, “তুই শালা সত্যি একটা সুন্দরীকে লাইন মেরেছিস। এবারে শালা বিয়ের পিঁড়িতে যাবি না কবর খানায় যাবি সেটাই দেখার।”
দেবায়ন অনুপমাকে থামিয়ে দিয়ে পরাশরকে বলে, “বাল, শুধু চোখেই দেখা না আরও কিছু হল। শালা, লাইনে আনলি কি করে?”
পরাশর, “বলছি বাড়া, বলছি। প্রত্যেক দিন ওর জন্য অপেক্ষা করতে যেন আমার ভালো লাগত। জারিনা মাঝে মাঝে হাঁটার গতি কমিয়ে দিত, আমি বুঝতে পারতাম বেশ। ওই শুধু চলার পথের সাথী হিসাবে একটু বেশিক্ষণ দেখা হত আমাদের। এর মাঝে ব্যাগড়া বাধায় চার পাঁচ খানা ছেলে, রোজ ওরা অইসময়ে ওই খানে দাঁড়িয়ে থাকে আর মেয়েদের দেখে কমেন্ট মারে। মেয়েগুলো কোনোরকমে ওদের না দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে জারিনা আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকত যখন ওই ছেলেরা কমেন্ট করত। একদিন মাথা খারাপ করা ব্যাপার হল। রাস্তায় কিছু একটা পড়েছিল আর তাতে হোঁচট খেয়ে জারিনা পরে গেল। বইয়ের ব্যাগ হাত থেকে ছিটকে গেল ওই ছেলেদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলোর হাসি আর লুটপুটি। একটা ছেলে ব্যাগ তুলে দিতে এসে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বেশ উগ্র মন্তব্য করল। আমার মাথায় রক্ত চেপে গেল সেই দেখে। শালা একদম ফিল্মি হিরোর মতন একটাকে ধরলাম আর কষিয়ে গালে একটা চড় কসালাম। ছেলে গুলোর বয়স বেশি না তবে শালা বাঞ্চোতদের দেখে মনে হচ্ছিল চুল্লু খাওয়া মাল। একটা ছেলে ছুরি বের করে আমাকে মারতে তেড়ে আসে। আমি যাকে ধরেছিলাম, তার শ্বাস নলি চেপে বললাম ছুরি দেখালে ওখানেই ওর গলা টিপে দেব। হই হট্টগোলে মেয়েরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। এমন সময়ে একজন মাথার পেছনে বাড়ি মারল, আমি তাও যে ছেলেটাকে ধরেছিলাম তাকে ছাড়লাম না। ততক্ষণে জারিনা আর বাকি মেয়েরা চিৎকার করে লোকজন জড় করে ফেলে। বাকি ছেলেগুলো পালিয়ে যায় কিন্তু একটাকে ধরে রেখেছিলাম। লোকজন জড় হয়ে যে ছেলেটাকে ধরেছিল তাকে মারতে মারতে চলে গেল। আমার মাথায় যে বাড়ি মেরেছিল সেখানে বেশ ব্যাথা করছিল, ফুলে উঠেছিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখি রক্ত পড়ছে। জারিনা আর মেয়েরা আমার মাথা থেকে রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায়। আমি মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম, জারিনা দৌড়ে এল আমার দিকে। ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে আমার রক্ত বন্ধ, ব্যাথা বন্ধ হয়ে গেল। জারিনা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে আর একজনের জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ভিজিয়ে আমার মাথায় চেপে ধরে। ওর নরম তুলতুলে আঙ্গুলের স্পর্শে, মাথার ব্যাথা উধাউ হয়ে বুকের ব্যাথা শুরু করে দেয়।”
রজত, “উরি বাস, একদম শাহরুক খান স্টাইল মেরেছিস। তারপরে কি মাথা ফাটা নিয়ে বাড়ি গেলি নাকি?”
পরাশর, “না রে, একবার ভেবেছিলাম যে কাকাকে একটা ফোন করি। আমার ছোটো কাকা, লাল বাজার ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর, তারপরে ভাবলাম এত ছোটো ব্যাপারে আর কাকাকে জ্বালাতন করা কেন। জারিনা জানাল ওর বাবা ডাক্তার, পাশেই ওদের বাড়ি। ওর বাবা বাড়িতেই আছেন। আমাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গেল। ব্যাস, একদম মাথায় বাড়ি খেয়ে রক্ত নিয়ে হিরোর এন্ট্রি নিলাম। জারিনাদের বেশ বড় দোতলা বাড়ি, পার্ক সার্কাস মোড় থেকে একটু ভেতরে। একতলায় ভাড়াটে আর ওর বাবার একটা চেম্বার। বিকেলে ওর বাবা চেম্বারে ছিলেন। বাড়িতে ঢোকার পরে জারিনার একদম অন্য রুপ। রাস্তায় বান্ধবীদের সাথে কোনদিন বেশি কথা বলতে শুনিনি কিন্তু বাড়িতে ওর মুখে যেন খই ফুটছে। ওর আম্মিজানের কাছে আমার কত তারিফ, কত কিছু। ওর আব্বাজান, ডক্টর মিসবাউল মতিন আনসারি, পিজি হস্পিটালের মেডিসিনের প্রফেসার। ওর বড় ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিচে গিয়ে ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে আসে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হল, মিষ্টি খাওয়ান হল। পরিচয় পর্ব শেষ হল। ওর দাদা, দানিস আন্সারি, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। ওর মা, নাজমা আন্টি খুব ভালো একদম মাটির মানুষ। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে ঢাকায় ওদের মামাবাড়ি। ওর মায়ের সাথে কথাবার্তা পরিচয়ে বিশেষ গোঁড়া বলে মনে হল না। কেননা ওকে অথবা ওর মাকে বুরখা পড়তে দেখিনি। কথার ছলে একসময়ে জারিনা আমার ফোন নাম্বার নেয়।”
দেবায়ন, “বোকাচোদা গাঁড় মেরেছে। প্রপোসালের আগেই শ্বশুর বাড়ি এন্ট্রি মেরে দিলি? তোকে কিমা বানিয়ে দেয় নি ওর বাবা? তুই মাল বাড়িতে কি বললি বে? তোর বাবা জেঠা কি বলল?”
পরাশর, “না রে ওদের বাড়িতে ওদের দেখে আমার সেই রকম মনে হয়নি। মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি বলে আর জারিনার হাসির ফোয়ারা দেখে মনে হয় আঙ্কেলের আমাকে একটু ভালো লেগে যায়। বাড়ি ফিরে আসার পরে মা জিজ্ঞেস করল আমার মাথা ফাটার কথা, আমি বানিয়ে একটা গল্প বললাম। ঘুমাতে গেলাম কিন্তু চোখের সামনে জারিনার মুখ ভেসে ওঠে। কিন্তু আমার মনে সংশয় থেকে গেল, সত্যি কি জারিনা আমার প্রেমে পড়বে? সংশয় দূর হয় গভীর রাতে। প্রায় রাত একটা বাজে, এক অজানা নাম্বার থেকে ফোন এল আমার কাছে। অন্য দিকে একটা মেয়ের গলা, প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কেমন আছি, আমার মাথার ব্যাথা কেমন আছে। আমি থ, রাত দেড়টার সময়ে একটা মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি কেমন আছি। আমি তখুনি ভেবে দেখলাম মেয়েটা জারিনা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ব্যাস আর কি, শুরু হল আমাদের লুকিয়ে প্রেম। আমি রোজ কলেজ ফেরত পার্ক সার্কাস মোড়ে ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। ঠিক সময়ে ওরা যখন আসতো, তখন বাকিরা জারিনাকে ছেড়ে একটু এগিয়ে যেত। বাস স্টান্ড থেকে ওর বাড়ির দরজা পর্যন্ত পাশাপাশি হাটা। এই টুকু আমাদের হাতে প্রেমের সময়, গল্প করার সময়। আমি শুধু ওর সারাদিনের গল্প শুনতাম, কানের মধ্যে ওর গলার আওয়াজ ভরে উঠত কিন্তু মন ভরত না। তাই রাতে ওর বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমি ওকে ফোন করতাম, রাত দেড়টা দুটো কোনদিন সকাল চারটে পর্যন্ত ফোনে গল্প করে কাটিয়েছি।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “উম্মম্ম দারুন প্রেম করেছিস মাইরি। প্রোপস করেছিস কবে? কি ভাবে করলি একটু শুনি?”
পরাশর, “দাঁড়া দাঁড়া, এত তাড়াহুড়ো করলে গল্পের ধারা মাটি হয়ে যাবে। প্রোপস করেছিলাম এক অধভুত ভাবে, ঠিক ভাবিনি সেদিন যে আমি ওকে প্রোপস করব। প্রথম দিকে একা বেড় হতে বেশ ভয় ভয় করত, ওই যা রাস্তায় কথা। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম আমার সাথে একা ঘুরতে যেতে ওর কোন অসুবিধে আছে নাকি। একা আমি আর ও বেড়াতে যাবো শুনে ওর চোখেমুখে খুশির ছোঁয়া লাগে। আমি ওকে পরীক্ষার আগে একবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একটু সংশয় ছিল, জারিনা যাবে কি না। ভয় ভয় আমি জিজ্ঞেস করলাম, মন্দিরে যাবার কথা। আমাকে হেসে বলল, নিশ্চয় যাবে বলল আমি ওকে নিয়ে যদি জাহান্নুমে যাই তাহলে ও সানন্দে আমার সাথে যেতে রাজি। সেদিন আমাকে আরেকটা কথা বলল, বলল যে ভগবান মানুষের বিশ্বাসে থাকে, ভগবান মানুষের ভালোবাসায় থাকে। ভালোবাসা যেমন মন্দির মসজিদ দেখে না, তেমনি ভগবান হিন্দু মুসলিম শিখ ক্রিস্টান দেখে না। অনেক বড় কথা বলেছিল ওই ছোটো মেয়েটা আমাকে। সত্যি বলছি, মন্দিরে গিয়ে আমি দেখলাম ওর ভক্তি। মন্দিরে বেশির ভাগ মানুষকে দেখলাম শুধু পাথরের মূর্তিকে প্রনাম করতে, সেখানে জারিনাকে দেখলাম যেন নিজের মাকে প্রনাম করছে। কপালে মন্দিরের সিঁদুরের টিপ পরে তাকিয়েছিল আমার দিকে, হাঁ হয়ে গেছিলাম ওর মুখ দেখে। সেদিন মনে হয়েছিল ওই মন্দির প্রাঙ্গনে ওকে জড়িয়ে ধরি। তারপরে ওর পরীক্ষা চলে এল মার্চে, খুব ভয়। সে কয়দিন আর দেখা হল না। পরীক্ষার পরে দেখা সাক্ষাৎ একটু কমে যায়, বাড়ি ছেড়ে বের হতে পারে না। বাড়ি থেকে বের হলে সাথে ওর এক বান্ধবী, আহীদাকে নিয়ে আসত। লুকিয়ে চুরিয়ে বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখতে গেছি তিনজনে, ব্যাস আর কি। তবে মাঝে মাঝে আহীদা আমাদের ছেড়ে দিত, শুধু বলে দিত যে বাড়ি ফেরার আগে যেন ওকে একটা ফোন করে দেওয়া হয় তাহলে আহীদা পার্ক সার্কাস মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
অনুপমা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ধুর বাড়া, প্রোপস করলি কি করে সেটা বল?”
সবাই একসাথে চেপে ধরে পরাশরকে।
পরাশর হেসে বলে, “ওর পরীক্ষার পরে একদিন ওদের নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। এক বিকেলে মেট্রোতে একটা হিন্দি সিনেমা দেখার পরে আউট্রাম ঘাটের স্কুপে বসেছিলাম আমরা তিনজনে। আহীদা নিচে গেছিল আমাদের আইস্ক্রিম নিয়ে আসার জন্য। বিকেলের সূর্য ঠিক দ্বিতীয় হুগলী সেতুর পেছনে পাটে বসতে চলেছে। ঘোলা গঙ্গার জলে কমলা রঙ লেগেছে, জারিনা চুপ করে বসে সেই গঙ্গার জল দেখে চলেছে। আমি আলতো করে ওর কাঁধে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি ভাবছে। আমার দিকে তাকিয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল, আমি চমকে গেলাম ওর শুকনো মুখ দেখে। আমি ওকে শুকনো মুখের কারন জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, যে কারন ওর জানা নেই। আমি ওকে নিজের দিকে টেনে নিলাম, বাম বাজুর উপরে মুখ ঘষে আমাকে বলল যে ওর খুব ইচ্ছে করছে এই ভাবে বসে থাকতে। আমি তখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে সাড়া জীবন আমার সাথে এই রকম ভাবে বসতে চায় কি না। চুপ করে আমার দিকে না তাকিয়ে বুকের উপরে মুখ গুঁজে মাথা নাড়িয়ে বলে, ওই রকম ভাবে লুকিয়ে থাকতে চায়। আমি ওর মাথায় ছোটো চুমু খেয়ে বলেছিলাম যে ওকে আমি বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখব। সেদিন দুই জনেই জানতাম আমাদের ভবিষ্যৎ অত প্রসস্থ নয়, আমাদের সম্পর্কের ধারা অতি সহজে সাগর সঙ্গমে মিলিত হবে না। হয়ত কোনদিন হবে না, কিন্তু ওই টুকু প্রেম, ওই টুকু ভালোবাসা দিয়ে বুক ভরিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। আহীদা এসে দেখে যে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বসে। আহীদার হাতের ছোঁয়ায় জারিনার সম্বিৎ ফেরে। চোখ মুছে হেসে আহীদাকে বলে সব কথা। আহীদা চুপ করে শুনে বলে যে এই ভয় পেয়েছিল, জানত এইরকম কিছু একটা হতে চলেছে। সাবধান করে দেয় জারিনাকে কিন্তু সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে আমাদের পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। জারিনা পালিয়ে বিয়ে করতে নারাজ, ওর আব্বাজানের বুকের পাঁজর, আম্মির চোখের মণি। আমাকে বলে যে ওর বাড়িতে যেতে, বাড়ির সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করতে। আমি তখন ওকে আমাদের বাড়ির ব্যাওয়ারে কিছুই জানাই নি।”
“আমাদের বাড়ি একদম গোঁড়া, জেঠু পুরানো দিনের মানুষ, বাবাকে হয়ত কিছু বুঝালেও বুঝবে কিন্তু জেঠুকে বুঝিয়ে ওঠা অসম্ভব। কাকার কথা কেউ কানে নেয় না বললেই চলে। আমি কাকিমাকে সব কথা জানিয়েছিলাম, কিন্তু কাকিমার কথা কেউ ধরতব্যের মধ্যে আনেনা। মাকে বলেছিলাম যে আমি যদি অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসি তাহলে আমার বাড়ি কি সেই সম্পর্ক মেনে নেবে? মা এক কথায় মানা করে দিয়েছিল আমাকে। বলেছিল মায়ের ঠাকুর ঘরে ভিন্ন ধর্মের মেয়ের প্রবেশ নিষেধ। বাবাকে অথবা জেঠুকে জানাবার প্রশ্ন ওঠে না। একাত্তরে আমার ঠাকুরদাকে নাকি মুসলমানেরা মেরে ফেলে দিয়েছিল, সেই রাগ আজ পর্যন্ত বুকে পুষে রেখেছে। ওদিকে জারিনা এখন ওর বাবার কাছে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি। জারিনার মা কিছুটা জানেন তবে আন্টি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
আব্বাজানকে একদিন না একদিন জানাতে হবে, সেইদিনের আশঙ্কা দিন গুনছে জারিনা। জারিনা জানে ভালো ভাবে যে আঙ্কেলকে জানালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে, জারিনা প্রস্তুত সেই বিশ্বজুদ্ধ সামাল দিতে। সব মিলিয়ে, আমার বাড়ি নাকচ করে দিয়েছে এক প্রকার আর ওইদিকে হয়ত আঙ্কেল জানলে কি হবে সেটা জানা নেই।”
উনবিংশ পর্ব (#03)
ধিমান মাথা চুলকে বলে, “শালা, তুই বাল একটা প্রেম করেছিস। হ্যাঁ গল্প শুনে মনে হচ্ছে প্রেম কাহিনী হচ্ছে একদম। লুকিয়ে চুরিয়ে প্রথম দেখা, লুকিয়ে চুরিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া, আর বড় কথা হচ্ছে বাড়ির সাথে যুদ্ধ। আমি শালা তার মানে ঠিক মতন প্রেম করে উঠতে পারলাম না আর। ঋতুপর্ণাকে একটা বন্ধুর পার্টিতে দেখলাম, তারপরে সেই বন্ধুকে বললাম যে বাল একটু লাইন করিয়ে দে। ব্যাস, ঋতু প্রথম দেখাতেই গলে গেছিল তাই ঋতুকে কাবু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বাবা মা জানে ঋতুর কথা, বাবার একটু আপত্তি আছে কারন ঋতু নার্স, মায়ের একদম চোখের মণি হয়ে গেছে ঋতু। বাবাকে বশ করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। অইদিকে ঋতুর পরিবারের দিক থেকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না আশা করা যায়। ওর বাবা নেই, ওর মা জানেন আমাদের ব্যাপার। ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে একবার আমার। আমাদের একদম নির্জলা, নির্ভেজাল প্রেম। কোন টানাপড়েন নেই, সোজা সরল গাড়ি একদম হাইওয়ে দিয়ে হাঁকিয়ে চলেছে।”
দেবায়ন হো হো করে হেসে বলে, “ভাই আমার অবস্থা এক। কলেজের প্রথম দিনে শালা হুমড়ি খেলাম অনুপমাকে দেখে।”
ধিমান, “শালা তুই একা না বে, অনেকে সেদিন হুমড়ি খেয়েছিল অনুপমাকে দেখে। বাল, তুই হাত মেরে নিলি।”
অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “বাল ছেঁড় তোরা, আমার পেছনে কলেজের অর্ধেক কেন শালা সারা কোলকাতা আমার পেছনে। এবারে সবাই যে যার মনের মানুষ পেয়ে গেছে, ব্যাস আবার কি। এবারে তনিমার একটা হিল্লে হলে হয়।”
দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কি আমাদের গল্প বলতে শুরু করে দিলে নাকি?”
দেবায়ন, “সবাই যখন বলছে তাই একটু বলে দেই আর কি।”
পায়েল হেসে বলে, “সেদিন শালা বৃষ্টি না হলে বড় ভালো হত। তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি পেয়ে যেতাম আর এরা দুইজনে আটি চুষত।”
অনুপমা পায়েলের মাথায় টোকা মেরে বলে, “আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ও। আর কেন অপেক্ষা করতাম। সেদিন যদি কিছু না বলত তাহলে ট্যাক্সির নিচে চলে আসতাম।”
পরাশর, “ওকে ওকে ঠিক আছে, যে টুকু আছে সেই টুকু শুনি একটু।”
দেবায়ন, “যাই হোক সিঁড়িতে ধাক্কা খাওয়ার কথা কারুর অজানা নেই। তারপরে একটু বন্ধুত হল, তারপরে একদিন কফি হাউসে করলাম প্রোপস, ডারলিং একবারে গলে মোম। আমার মাকে কয়েক মাস আগে জানিয়েছি, মা অনু বলতে অজ্ঞান। আর কাকু কাকিমার এক অবস্থা, বাড়ির লোকের সাথে যুদ্ধ নেই, কথা কাটাকাটি নেই, একদম হাইওয়ে দিয়ে চলছে আমাদের প্রেমের গাড়ি। একটু এবর খাবড় না থাকলে ঠিক বোঝা যায় না যে হ্যাঁ প্রেম করছি।”
পায়েল চেঁচিয়ে বলে, “শালা তোর গল্প আমি সব জানি। তুই বাড়া আর বুক ফুলিয়ে কিছু বলতে যাস না।”
দেবায়ন পায়েলকে মিচকি হেসে বলে, “কেন সেদিন রাতে কি ডোজ ঠিক পড়েনি? আবার চাই নাকি?” অনুপমা, দেবায়নের বাজুতে চিমটি কেটে চুপ করে যেতে অনুরোধ করে।
গল্প করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বাড়ির উদ্দেশ্যে কিছু পরে সবাই রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে অনুপমা পায়েলকে একবার অগ্নিহোত্রীর কথা জিজ্ঞেস করে। পায়েল সত্যি কথা বলে ফেলে, অনুপমাকে বলে যে অগ্নিহোত্রীর ব্যাপারে বিষদ কিছু জানা নেই তবে ওর পিসতুত দাদার বন্ধু হিসাবে ভালো লাগে এই মাত্র। পরিচয়ের পরের পর্বের দিকে এগোনোর আগে একবার অন্তত অগ্নিহোত্রীর ব্যাপারে সম্পূর্ণ জেনে নেবে।
পরাশরের সাথে দেবায়নের কথা হয়। পরাশর জানায় যে কিছু দিনের মধ্যে ঈদ, ঈদে জারিনার বাড়িতে জারিনার মা ওকে ডেকেছে। নিজেদের সম্পর্কের সম্বন্ধে কিছু কথাবার্তা বলতে চায় পরাশর, বুকের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বাজছে তাও ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাবার ছেলে নয়।
বাড়ি ফিরে অনুপমা দেখে যে ওর ভাই মুখ শুকনো করে বসে আছে। ভাইকে কারন জিজ্ঞেস করলে, অঙ্কন উত্তর দেয় যে একটা বাইকের বায়না ধরেছিল, বাবা বকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। অনুপমা ভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে। মাকে জিজ্ঞেস করে বাইক না কিনে দেওয়ার কারন। পারমিতা জানায় যে অঙ্কনের ইদানিং পড়াশুনায় বিশেষ মন নেই। কোচিঙের স্যার নাকি একদিন পারমিতাকে ফোনে জানিয়েছে যে মাঝে মাঝে অঙ্কন কোচিঙয়ে আসে না। অনুপমা সব শুনে রেগে যায়। অঙ্কনকে খাবার পরে নিজের ঘরে নিয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে কচিঙ্গে না যাবার কারন। মুখ দেখে অনুপমা বুঝতে পারে যে অঙ্কন প্রেমে পড়েছে। লাজুক হেসে অঙ্কন জানায় যে কয়দিন কোচিং যায় নি, সেই কয়দিন এক বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছিল। ভাইয়ের নতুন প্রেমের কথা শুনে অনুপমা উৎসুক হয়ে যায়। ভাইয়ের বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করাতে, অঙ্কন জানায় যে স্কুলের এক বান্ধবী, নাম গরিমা মিত্তল, মাড়োয়ারি মেয়ে। অনুপমা গরিমার ফটো দেখতে চাইলে, মোবাইলে একটা মেয়ের ফটো দেখায় অঙ্কন। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, পাতলা আর ছিপছিপে গড়নের, মুখের গঠন ডিম্বাকৃতি, গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। অনুপমার কাছে অঙ্কন বায়না ধরে যে বাবাকে বলে কয়ে ওকে বাইক দিয়ে হবে। অনুপমা জিজ্ঞেস করলে জানায় যে বাইকে গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে কোলকাতা ঘুরবে। অনুপমা হেসে ফেলে ছোটো ভাইয়ের কথা শুনে। অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে রাতে দেবায়নকে ফোনে ভাইয়ের সব কথা জানিয়ে দেয়। দেবায়ন বলে যে ছেলে বড় হয়ে গেছে, নিজের মনের মতন সাথী খুঁজে পাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এখন খেলা ধুলা করে বেড়াবে কিছু দিন, মন ভরে গেলে হয়ত নতুন সাথী খুঁজতে বেড়িয়ে যাবে।
কয়েকদিন পরে বাবাকে অনেক অনুরোধ করে অঙ্কনের জন্য বাইক কেনা হয়। বাইক পেয়ে অঙ্কন ভারী খুশি, সেই সাথে অনুপমা জানিয়ে দেয় যে, এবারে যেন পড়াশুনাতে মন দেয় আর যেন কোনদিন কোচিং পালিয়ে সিনেমা দেখতে না যায়। অনুপমা, মাকে একদিন রাতে জানায় যে ওর ভাই প্রেম করছে। সেই শুনে পারমিতা খুব খুশি, অঙ্কনকে বলে গরিমাকে বাড়িতে ডাকতে। উচ্চমাধ্যমিকে যাবার পরে অঙ্কনের বয়সের সাথে সাথে আচরনের অনেক পরিবর্তন ঘটে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কথা বলা। আগে শুধু দিদির সাথেই মন খুলে কথা বলতে পারত, মায়ের কাছে মন খুলে কথা বলার অবকাশ কোনদিন পায়নি। মায়ের মুখে গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে অঙ্কন জানিয়ে দেয় যে ভবিষ্যতে একদিন নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাড়িতে আসবে।
অনুপমা আর দেবায়নের জীবনে নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ বিদায় নেয়। মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যেন সাজ সাজ রব পরে যায়, সকালে উঠে কলেজে দৌড়ানো, তারপরে কম্পিউটার ক্লাস, অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা। দেবায়নকে ওর মা জানিয়ে দিয়েছেন যে কম্পিউটার ক্লাসে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তাই টাকা একটু সঞ্চয় করে নিয়ে পুজোর আগে দেবায়নের জন্য বাইক কিনে দেবে। দেবায়ন বোঝে মায়ের কষ্ট, তাই বাইকের জন্য বেশি আব্দার করেনি। দেবশ্রী একদিন বিকেলে অফিস থেকে এসে বলে যে এক শুক্রবার অনুপমাকে নিয়ে বাড়িতে আসতে, অনেকদিন দেখা পায়নি হবু বৌমার। সেই শুনে দেবায়ন বেশ খুশি। দেবশ্রী, পারমিতাকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে আগামী শুক্রবার অনুপমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে, দিন দুই থাকবে দেবশ্রীর কাছে। রাতের বেলা দেবায়ন আর অনুপমা, ফোনে গল্প করে কাটিয়ে দেয়।
পরেরদিন বিকেলে কলেজের পরেই দুইজনে বাড়ি পৌঁছে যায়। সেদিন দেবশ্রী তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরে। হবু শ্বাশুরিকে দেখে অনুপমা বেশ খুশি। দেবশ্রী অনেকদিন অনুপমাকে দেখেনি তাই বেশ খুশি। অনুপমা আর দেবশ্রী রান্না ঘরে রান্নায় ব্যাস্ত। দেবায়ন বসার ঘরে বসে ওর জীবনের প্রধান দুই মহিলাকে দেখে।
অনুপমা মিচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি দেখছ এমন ভাবে?”
দেবায়ন, “কেন তোমাদের দেখতে দোষ আছে নাকি?”
দেবশ্রী হেসে বলে, “আজকে কিন্তু অনু আমার কাছে শোবে। ভুলেও বেড়াতে যাবার কথা ভাবিস না যেন।”
হেসে ফেলে দেবায়ন, “না না, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কেউ তোমাদের আলাদা করতে পারবে না। এহেন অবস্থায় দুই সিংহীর মাঝে কেন এক ছোটো হরিণ শাবক নিজের প্রান দেয়?”
অনুপমা, “হ্যাঁ আর বলতে, তুমি হরিণ শাবক। তাহলে রাতে শুধু ঘাস খেয়ে থাকবে আর আমরা কষা মাংস আর লুচি খাবো।”
খাবার সময়ে দেবায়ন মাকে বলে, “মা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আবার কি করলি তুই, না নতুন কিছু চাই তোর।”
দেবায়ন বলে, “না মা, এবারে প্রবলেম ঠিক আমার নয়। আমার এক বন্ধুর, পরাশর।”
অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, তোমাকে কিছু একটা উপায় বের করতে হবে।”
দেবশ্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি উপায়, কি ব্যাপার। সব কথা শুনি আগে তারপরে বিচার করা যাবে।”
দেবায়ন বলতে শুরু করে, “মা, আমাদের এক বন্ধু আছে পরাশর। আমাদের সাথে পড়ে। সেই ছেলে একটা মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার নাম জারিনা, বেশ মিষ্টি দেখতে। মুশকিল হচ্ছে, পরাশরের বাড়িতে কেউ জারিনাকে মেনে নেবে না। ওইদিকে জারিনার বাড়িতে জারিনার মা একটু নরম হয়েছেন। ঈদের পরে পরাশর জারিনার বাড়িতে গিয়েছিল। জারিনার আম্মিজান পরাশর আর জারিনার সব কথা জানে, মন মানতে চাইলেও সমাজ আত্মীয় সজ্জন যে মানতে চায় না। জারিনার বাবাকে জারিনার মা কথার ছলে পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে কিছু আচ আগে থেকে দিয়েছিলেন। জারিনার বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন এহেন সম্পর্ক সম্ভব নয়। পরাশরকে বলেছেন যে মেয়েকে সেই ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে যেন ভাবে না যে মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। সেই কথা শুনে, পরাশর আর জারিনা খুব ভেঙ্গে পরে। জারিনা কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, সেই সাথে আত্মহত্যার কথা বলে। মেয়ের মুখ দেখে ওর আব্বাজান কিছুটা নরম হন, কিন্তু জারিনার আব্বাজানের এক কথা, পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে সেই সাথে জারিনার বাবা, পরাশরের পরিবারের সাথে কথা বলতে চায়। এখানে সমস্যা হচ্ছে যে, পরাশরের মা এক কথায় জানিয়ে দিয়েছে যে ভিন্ন ধর্মীর মেয়েকে বাড়ির বউমা করে আনতে নারাজ। কোন এক সময়ে পরাশরের ঠাকুরদাকে বাংলাদেশে মুসলমানেরা হত্যা করেছিল, সেই কথা নিয়ে আজো বসে আছে ওর বাবা জেঠা। পরাশর কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না।”
অনুপমা, “মামনি, তুমি আমাদের ডিকশনারি, তুমি কিছু উপায় বলে দাও।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে, “তোরা দুইজনে কি সারা পৃথিবীর সমস্যার সমাধান করতে বেড়িয়েছিস?”
অনুপমা বায়না ধরে, “না মামনি, কিছু একটা তোমাকে করতেই হবে। জারিনার বাবাকে কিছু করে বুঝাতে চেষ্টা করতে হবে আর সেই সাথে পরাশরের বাড়িকে। জারিনার বাবা কিছুটা নরম হয়েছেন, এবারে পরাশরের বাড়িকে কি করে নরম করা যায় সেটা বলে দাও।”
দেবশ্রী বলে, “কেন? যেমন ভাবে জারিনা ওর বাড়িকে নরম করেছে তেমনি ভাবে মানসিক চাপ দিয়ে পরাশর নিজের পরিবারকে চাপে ফেলুক।”
দেবায়ন, “মা, সে কাজ করা হয়ে গেছে। ওর বাবা আর জেঠা ওকে ত্যাজপুত্র করে দেবে বলেছে। অইসব আত্মহত্যার কথা ধোপে টেকেনি পরাশরের বাড়িতে। ওর কাকাও কিছু বুঝিয়ে উঠতে পারেনি ওর বাবা জেঠাকে।”
দেবশ্রী, “কাল একবার পরাশরকে বাড়িতে ডাক, আগে ওর সাথে কথা বলে দেখি। আর আমি একজন বাইরের মানুষ হয়ে কি মুখে দুই বাড়ির সাথে কথা বলব?”
দেবায়ন আর অনুপমা বেশ চিন্তায় পরে যায়। দুই পরিবারের সাথে যেচে কথা বলা ঠিক নয়, যেখানে দেবশ্রী দুই পরিবারের কাউকে চেনে না। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে পরাশরের সাথে কথা বলে সব কিছু জেনে তবে কিছু একটা বিচার করবে। পরের দিন যথারীতি পরাশর, দেবায়নের বাড়িতে আসে। সেই সময়ে অনুপমা অথবা দেবায়ন, দুইজনেই কম্পিউটার ক্লাসে ছিল, তাই পরাশরের সাথে দেখা হয় না। বিকেলে বাড়িতে ফিরে দেবায়ন, মাকে পরাশরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। দেবশ্রী জানায় যে বর্তমানে ওদের পড়াশুনাতে মন দেওয়া উচিত। সময় মতন সব ঠিক হয়ে যাবে।
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, কি করে ঠিক করবে তুমি?”
দেবশ্রী হেসে বলে, “পরাশরের মুখে সব কিছু শুনলাম। ওদের যৌথ পরিবার, ওর জেঠা বাড়ির কর্তা। ওর জ্যাঠা পুরানো দিনের মানুষ, শুনে মনে হল ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। ওর বাবাকে হয়ত বুঝান সম্ভব হবে, তবে মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলতে হবে। ওর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর হলে কি হবে, বাড়িতে ভিজে বেড়াল। ওর মায়ের আর ওর কাকিমার কথা বলা যেতে পারে শুধু হেঁসেল ঠ্যালা ছাড়া আর কিছু নয়। এমন যৌথ পরিবার এখন এই কোলকাতায় আছে। ওর জেঠুর সামনে নাকি কারুর মুখ ফোটে না। অনেক ভালো ভালো শাল গাছ আমার সামনে নুইয়ে পড়েছে। যেখানে ছলকপটে কাজ হয় না, সেখানে ভালোবাসা দিয়ে কাজ হয়। ভাবছি একদিন দুই বাড়িকে আমাদের বাড়িতে নেমতন্ন করব। কিন্তু তার আগে কোন এক আছিলায় তোদের মধ্যে কাউকে পি.জি হসপিটালে গিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করতে হবে। তোদের দুই জনের মধ্যে কেউ এগিয়ে গেলে তারপরে না হয় আমি ওর বাবার সাথে পরিচয় করতে পারব। তারপরে, পরিচয় বাড়লে জারিনার পরিবারকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে অসুবিধে হবে না। এবারে পরাশরের বাড়ি কি করে যাওয়া যায়। দেবায়ন আশা করি ওদের বাড়িতে গেছে, তাই অনায়াসে একদিন ওদের ডেকে বাড়িতে খাওয়ান যায়। ওই দিনে জারিনার বাবা মা আর পরাশরের বাবা মায়ের সাথে এক সাথে কথা বলব। সামনা সামনি দুই অভিভাবককে বসিয়ে কথা বলে বুঝিয়ে দেখি।”
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, “তোমার কাছে সব কিছুর সমাধান আছে, তাই না মামনি।”
দেবশ্রী হেসে বলে, “গত কাল থেকে অনেক তেল মেরেছিস, তাই ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি।”
দেবায়ন, “কিন্তু কি করে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় হবে? সেটা একটু বলে দাও?”
দেবশ্রী, “সব বুদ্ধি কি আমি দেব নাকি? যেমন করে পরাশর জারিনার বাড়িতে গেছে, ঠিক তেমন করে তোমাকে ওর বাড়ির লোকের সাথে পরিচয় করতে হবে।”
অনুপমা হেসে বলে, “চিন্তা নেই মামনি, পার্ক সার্কাস মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি ওর ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দেব, ব্যাস আবার কি। পরাশর সাথেই থাকবে, অগত্যা ওকে নিয়ে জারিনার বাড়িতে যেতেই হবে।”
সেই শুনে দেবায়ন অনুপমার চুল টেনে বলে, “মা এবারে তোমার বউমা কিন্তু আমার ওপরে চড়াও হচ্ছে। মারপিট করলে কিন্তু আমি ছেড়ে দেব না।” দুইজনে মারামারি শুরু করে দেয়।
দেবশ্রী মৃদু ধমক দিয়ে বলে, “ঠিক আছে, দেখা যাক, ওই ঠ্যাঙ ভাঙ্গতে হবে না। দেখি কাউকে পাই কিনা যে পি.জি হসপিটালে কাজ করে। তার মারফত একবার ডক্টর মিসবাউলের সাথে দেখা করে আসব।”
খাওয়া শেষ, দেবায়ন টিভি দেখতে ব্যাস্ত। মায়ের কড়া নির্দেশে অনুপমার ধারে কাছে যেতে পারেনি। গত রাতে ঘুমিয়ে যাবার পরে মায়ের রুমে উঁকি মেরেছিল দেবায়ন। যথারীতি, প্রেয়সীর অর্ধ নগ্ন শরীর দেখে ক্ষান্ত হয়ে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের বিছানায় এসে, লুক্কায়িত বাক্স থেকে অনুপমা, পারমিতার প্যান্টি বের করে নাকের কাছে শুঁকে আত্মরতি করে ঠাণ্ডা করতে হয়েছে নিজেকে।
সেদিন অনুপমা একটা পাতলা স্লিপ গায়ে দিয়ে দেবায়নের কোল ঘেঁসে বসে টিভি দেখছিল। টিভির দিকে বিশেষ মন ছিল না অনুপমার, মন বড় আনচান করছিল একটু দেবায়নের সান্নিধ্য পাওয়ার। দেবশ্রীর রুমের দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে দুই জনে পরস্পরের ঠোঁটের মাঝে বিলীন হয়ে যায়। চুম্বনে মর্দনে কামাগ্নি জ্বলে উঠতে বিশেষ সময় নেয় না, কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। দেবশ্রী নিজের রুম থেকে অনুপমাকে ডাক দেয়, বলে যে সোমবার ওদের কলেজ আর দেবশ্রীর অফিস, সুতরাং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে যাতে সকাল সকাল উঠতে পারে। অগত্যা অনুপমা, দেবায়নের কোল থেকে উঠে শুকনো মুখে দেবশ্রীর রুমে ঢুকে পরে। দেবশ্রী কিছু অফিসের কাজে ব্যাস্ত।
রাতে মামনিকে অফিসের কাজে ব্যাস্ত দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “তোমার অফিসে ইদানিং কি কাজ খুব বেড়ে গেছে?”
উনবিংশ পর্ব (#04)
দেবশ্রী, ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তা একটু বেড়ে গেছে।”
অনুপমা, “দিল্লীর কথা কি হল? তুমি কি ভেবেছ?”
ম্লান হেসে দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তোরা যখন দিল্লী যাবি না তাহলে আমি গিয়ে কি করব? তাই আর সেই নিয়ে ভাবছি না। দেখি আরো কয়েক মাস এমনিতে আমি মিস্টার ঠাকুরকে একটু হিন্ট দিয়েছি যে আমার দিল্লী আসা হবে না। তাই মনে হয় আমার কাজ বেড়ে গেছে। কোলকাতা অফিসের সাথে সাথে অন্য অফিসের কাজ গুলো আমার ঘাড়ে ধিরে ধিরে এসে পড়ছে।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” দেবশ্রী জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে অনুপমার দিকে তাকায়, অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথ অথবা মল্লিকা তোমাকে ফোন করে?”
প্রশ্ন শুনে দমে যায় দেবশ্রী, মুসউরি ভ্রমণের পরে বেশ কয়েক মাস খুব ফোনে কথা হত ধৃতিমানের সাথে। গত কয়েক সপ্তাহে সেই ফোনের কথা একটু কমে আসে। অনুপমার দিকে ম্লান হেসে বলে, “হ্যাঁ, কথা হয়, কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
অনুপমা হেসে বলে, “না এমনি জিজ্ঞেস করছি। মিস্টার দেবনাথ কিছু বলেছে তোমাকে, কোলকাতা আসছে কি ওরা?”
হেসে ফেলে দেবশ্রী, “তোর মামনিকে কি এই বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চাস? তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
অনুপম হেসে দেয়, “না সেটা নয় মামনি, তবে তুমি বড্ড একা। আমি জানি অনেক কিছু তাই বলছিলাম। তুমি একবার মিস্টার দেবনাথ কে বলে দেখতে পারো কোলকাতায় আসার কথা। দেখো না কি বলে?”
দেবশ্রী, “আমার বলা কি সব? ওর একটা মেয়ে আছে না, মল্লিকার ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি?”
অনুপমা বলে, “হ্যাঁ তা আছে বৈকি। তুমি কি করবে কিছু ভাবলে?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “মেয়ে আমার অনেক বড় হয়ে গেছে। ছাড় অইসব আলোচনা, চল শুয়ে পরি।”
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলে, “মামনি প্লিস একটু দেবায়নের কাছে যাবো?”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “একদম দুষ্টুমি নয়। কাল সকাল সকাল ওঠা আছে, তোদের কলেজ আর আমার অফিস আছে।”
পরেরদিন কলেজে পৌঁছান মাত্র, পরাশর দেবায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে যে পায়ের ধুলো দিতে। বাবা মায়ের কথা শুনে আর জারিনার বাড়ির কথা শুনে একপ্রকার দুই জনে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। জারিনা ভেঙ্গে পড়েছে, চাইলেও দেখা করতে পারছে না পরাশরের সাথে। দেবায়নের মায়ের কথা শুনে একটা আশার ক্ষীণ আলো এই ঘন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। পরাশর বলে যে দেবায়নের মা বলেছেন কোন ভাবে নাম পরিচয় না জানিয়ে জারিনার সাথে পরাশরের মায়ের সাক্ষাৎ করাতে হবে। জারিনাকে দেখে এক মেয়ে হিসাবে পছন্দ হয়ে গেলে তারপরে পরাশরের মায়ের মন গলানো সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু কি ভাবে সেটা সম্ভব হবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না পরাশর। অনুপমা বলে যে একটা উপায় করে দেবে যাতে পরাশরের মায়ের সাথে জারিনা সাক্ষাৎ হয়। পরাশর, অনুপমাকে বলে যদি ওদের পরিবার রাজি হয়ে যায় জারিনা আর পরাশরের সম্পর্কে, তাহলে সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে অনুপমা আর দেবায়নের কাছে। অনুপমা হেসে বলে, কাজের সময় যেন পাশে থাকে তাহলেই হবে। পরাশর বলে যে পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেবায়নের মায়ের সাথে জারিনার বাবার পরিচয় করিয়ে দেবে। দেবায়ন, পরাশরের কানেকানে মজা করে জানায় যে জারিনার সাথে প্রথম রাত দেবায়ন কাটাতে চায়। সেই কথা শুনে পরাশর মারতে ছোটে দেবায়নকে।
একদিন শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনার কলেজ যায় জারিনার সাথে দেখা করতে। ওদের দেখে জারিনা অবাক হয়ে যায়। অনুপমা আর শ্রেয়াকে দুঃখের কথা জানায় জারিনা। পরাশরের সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়, মাঝে মাঝে কলেজের অছিলায় দুই একবার দেখা করেছে, কিন্তু ভয় ভয়, ওদের একসাথে কেউ দেখে জারিনার বাড়িতে যদি বলে দেয় তাহলে ওর আব্বাজান বকাবকি করতে পারে। অনুপমা ওকে শান্ত করে বলে যে পরাশরের বাড়িতে যেতে হবে। সেই শুনে জারিনা যেন আকাশ থেকে পরে, জারিনা জিজ্ঞেস করে কি ভাবে পরাশরের বাড়িতে যাবে। জারিনা জানে পরাশরের মায়ের মতিগতি, এক ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ। অনুপমা হেসে বলে যে ওরা সব বন্ধু বান্ধবীরা পরাশরের বাড়িতে যাচ্ছে, পরাশরের মায়ের হাতের পায়েস খাবার জন্য। সেই আছিলায় জারিনাকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। ওদের বাড়িতে যাবার পরে সবাইকে বন্ধু হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে, কারুর নাম ঠিক জানানো হবে না। জারিনাকে কিছু করে পরাশরের মাকে হাত করতে হবে, রান্না ঘরের কাজে, বাড়ির কাজে সাহায্য করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরাশরের মায়ের মন জয় করতে হবে। সব পরিকল্পনা শুনে জারিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনাকে সাহস জুগিয়ে বলে যদি পরাশরকে বিয়ে করতে হয় আর পরাশরকে যদি ভালোবাসে তাহলে অনেক কিছু করতে হবে। জারিনা রাজি হয়ে যায় পরাশরের বাড়িতে যাবার জন্য, মুখে হাসি টেনে বলে সব কিছু করতে রাজি এমনকি পরাশরের সাথে জাহান্নুমে যেতে রাজি।
কলেজের বাইরে দেবায়ন, ধিমান আর পরাশর দাঁড়িয়ে ছিল। জারিনাকে নিয়ে বের হবার পরে ছয়জনে পরাশরের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সারা রাস্তা জারিনা পরাশরের হাত ছারেনা এক মুহূর্তের জন্য। দুইজনের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরাশর আগে থেকে ওর মাকে জানিয়ে রেখেছিল যে কলেজের কয়েকজন বন্ধু ওর বাড়িতে দুপুর বেলা আসবে। সেই মতন পরাশরের মা সব বন্ধুদের জন্য পায়েস বানিয়ে রেখেছিল।
বাড়িতে ঢোকার আগে, জারিনাকে জড়িয়ে ধরে পরাশর। জারিনা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ওর মা অপমানিত করে তাড়িয়ে দেবে না তো? দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের দিকে চাওয়াচায়ি করে। অনুপমা বলে যে কেউ এখুনি নিজেদের পরিচয় দেবে না, শুধু কলেজের বন্ধু বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে সবাই, কারুর নাম এখুনি বলবে না পরাশরের মায়ের কাছে। পরিকল্পনা মতন পরাশরের বাড়িতে ঢোকে সবাই। পরাশরের মা সবাইকে বসার ঘরে বসতে বলে। জারিনা, অনুপমা আর শ্রেয়ার মাঝখানে চুপচাপ বসে থাকে। অনুপমা জারিনাকে ঠেলে বলে যে ঘরের কাজে পরাশরের মাকে সাহায্য করতে। জারিনার ছোটো বুকে বাজতে শুরু করে যুদ্ধের দামামা। একবার সবার দিকে তাকিয়ে নেয়। পরাশর পারলে লুকিয়ে যায় কোথাও, ওর মা একবার জানতে পারলে কেটে ফেলবে জারিনা আর পরাশরকে। জারিনা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে পরাশরের মা ওদের জন্য খাবার প্লেটে সাজাচ্ছিলেন। জারিনাকে আসতে দেখে পরাশরের মা একটু হাসেন। জারিনা প্লেটের মধ্যে সবকিছু সাজাতে সাহায্য করে, সেই সাথে পরাশরের মায়ের সাথে গল্প করে মন ভুলানোর জন্য। প্লেটে খাবার সাজিয়ে বসার ঘরে আসে পরাশরের মা আর জারিনা। জারিনার কান লাল হয়ে গেছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আশঙ্কায় ওর বুকের খাঁচা ফেটে পড়ার যোগাড়। বসার ঘরে সবাইকে খাবার দেবার পরে পরাশরের মা চলে যান।
অনুপমা জারিনাকে ঠেলে পরাশরের মায়ের পিছু নিতে বলে। জারিনা একবার উপরের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পরাশরের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোন কথা নেই, আসন্ন আশঙ্কায় সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। কিছু পরে ভেতর থেকে হাসির কলতান শোনা যায়, জারিনা বেশ গল্পে মশগুল হয়ে গেছে পরাশরের মায়ের সাথে। বেশ কিছু পরে পরাশরের মা জারিনাকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকায়। সবাই চুপ। পরাশরের মা বলেন যে বেশ ভালো পরিকল্পনা করেছে জারিনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর। সেই সাথে পরাশরের মা জানান যে জারিনাকে তার পছন্দ আছে কিন্তু ওর জেঠু আর বাবাকে মানাতে একটু কষ্ট হবে। জারিনা হবু স্বাশুরিকে জড়িয়ে ধরে বলে যে যদি ওদের সম্পর্কের সুস্থ সুরাহা না হয় তাহলে গঙ্গায় ডুবে মরবে দুইজনে। পরাশরের মা হেসে ফেলে জারিনার কথা শুনে, সেই সাথে জানিয়ে দেন যে কিছু একটা ব্যাবস্থা করা যাবে তবে ওনার একার পক্ষে সম্ভব নয় ওর বাবাকে বোঝানো। দেবায়ন জানায় যে ওর মা সেই কাজে সাহায্য করবে। পরাশরের বাড়ির সবাইকে একদিন নেমতন্ন করবে দেবায়ন সেই সময়ে দেবায়নের মা চেষ্টা করবেন পরাশরের বাবার সাথে কথা বলতে। পরাশরের মা, জারিনার গলায় একটা সোনার হার পড়িয়ে দেয়। জারিনার চোখে জল চলে আসে সেই সাথে পরাশরের মায়ের চোখে জল চলে আসে। পরাশরের মা, পরাশরকে বলে যে ওদের জন্য আরো একদিন নেমন্তন্ন রইল সেদিন ওর হবু বউমা রান্না করবে। সে যা রান্না করবে তাই পরাশরের মা ওর জেঠুকে আর বাবাকে রাতে খেতে দেবে। জারিনা বলে যে রান্না করতে সে এখুনি প্রস্তুত।
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে পরাশরের বাড়ি থেকে সবাই বেড়িয়ে আসে। যাবার আগে অনুপমা আর দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে নেমন্তন্নের কথা। দেবায়ন জানায় যে মায়ের সাথে কথা বলে একটা দিন ধার্য করে ওদের সবাইকে ডাকা হবে। দেবায়ন জানায় না যে সেদিন জারিনার বাড়ির লোক কেও নেমন্তন্ন করা হবে। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই জারিনা, অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে ট্যাক্সির মধ্যে। জারিনা আর পরাশর খুব খুশি, একটা বাধা কাটল, বাকি বাধা কি করে কাটবে সেই চিন্তায়। দেবায়ন জানায় সময়ের সাথে সাথে বাকি বাধা ধিরে ধিরে লুপ্ত হয়ে যাবে।
পরাশর এর মাঝে একদিন দেবায়নের মাকে পি.জি হসপিটালে নিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দেবশ্রী, জারিনার বাবা, ডক্টর মিসবাউল আন্সারির সাথে কথা বলেন পরাশর আর জারিনার সম্পর্কের ব্যাপারে। ডক্টর আন্সারি দেবশ্রীর কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে যান। তিনি জানিয়ে দেন যে হসপিটালে এই সব আলোচনা করা ঠিক নয়। দেবশ্রী বলেন নিরুপায় হয়ে হাতপাতালে আসতে হয়েছে যেহেতু দেবশ্রী ডক্টর আন্সারিকে চেনে না তাই। ডক্টর আন্সারি হেসে প্রতি উত্তরে দেবশ্রীকে নিজেদের বাড়িতে ডাকেন একদিন। হাস্পাতাল থেকে বেড়িয়ে দেবশ্রী পরাশরকে বলে, কথা বলে দেখবে কত টা কি করা যায়। দেবশ্রী পরাশরকে আসস্থ সুরে বলে পড়াশুনায় মন দিতে, বিয়ে শাদির জন্য এখন একটা বছর হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়োতে কোন কিছুর সুস্থ সুরাহা হবে না।
দেবায়ন আর পরাশরকে নিয়ে একদিন বিকেলে ডক্টর আন্সারির বাড়িতে যান দেবশ্রী। ডক্টর আন্সারি নিজের চেম্বারে সেদিন বেশ ব্যাস্ত ছিলেন। জারিনাকে দেখে দেবশ্রীর বেশ ভালো লাগে, সেই সাথে জারিনার মা, নাজমার সাথে কথাবার্তা হয়। নাজমা বলেন যে প্রথম দিন থেকেই পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তবে মেয়ের মুখে সব শুনে মায়ের মন শেষ পর্যন্ত গলে যায়। তার ভয় এই গোস্টি নিয়ে, এই গোসটির মাথারা এই শাদী নিকাহর বিরুদ্ধে যাবেন। ওইদিকে জারিনা বেঁকে বসে আছে, পরাশরকে বিয়ে না করতে পারলে গঙ্গায় ডুব দেবে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না নাজমা। দেবশ্রী, জারিনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে আর যেন আত্মহত্যার কথা মুখে আনে না। ডক্টর আন্সারি কাজের ফাঁকে উপরে এসে দেবশ্রী আর বাকিদের সাথে দেখা করে যান। ডক্টর আন্সারি কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েকে খুব ভালবাসেন তবে এই গস্টি দ্বন্দের মাঝে পরে এক ঘরে হয়ত হতে হবে। ডক্টর আন্সারি বলেন পরাশর যদি ধর্মান্তরিত হয় তাহলে দুই জনের সম্পর্কের একটা সুরাহা হতে পারে। দেবশ্রী চিন্তিত, ওইদিকে নাজমা কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। জারিনার চোখ ছলছল। দেবশ্রী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে সপরিবারে নিজের বাড়িতে একদিন রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করেন। দেবায়ন, পরাশর সবাই বেশ চিন্তিত, দেবশ্রী ওদের আস্বাস দিয়ে বলে যে কিছু একটা উপায় তিনি বের করবেন। ডক্টর আন্সারি জানিয়ে দেন যে পরাশরের বাড়ির সাথে দেখা করতে চান, দেবশ্রী জানিয়ে দেন যে সময় মতন সব ঠিক করে দেবেন।
বর্ষা কাল কেটে গেছে, মুসউরি থেকে বেড়িয়ে আসার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। আকাশে থোকা থোকা পোজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়ায়। কলেজের সাথে সাথে দেবায়ন আর অনুপমার কম্পিউটার ক্লাস পুরোদমে চলে। এর মাঝে এক রবিবার, দেবায়ন পরাশরের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোককে রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করে আসে।
সকাল বেলাতেই অনুপমা দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায় দেবায়নের মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য। পরাশর আর জারিনা বারেবারে অনুপমাকে ফোনে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে। বারেবারে জিজ্ঞেস করে কোন অঘটন ঘটাবে কি না। পরাশর বেশ ভয়ে ভয়ে আছে, ওর বাবা গম্ভির প্রকৃতির মানুষ। পরাশরের মা একবার ওর বাবাকে বলতে চেষ্টা করেছিল জারিনার ব্যাপারে কিন্তু তিনি শুনতে নারাজ।
বিকেলে জারিনার সাথে, জারিনার মা বাবা দেবায়নের বাড়িতে পৌঁছে যায়। ওদের আসার কিছু পরেই পরাশরের বাবা মা পৌঁছে যায়। জারিনা একটা সুন্দর সাদা রঙের সালোয়ার পরে এসেছিল। দেবায়নের মা সবাইকে বসার ঘরে বসিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। পরাশরের বাবা সুরঞ্জন বাবু, দেবায়নের মাকে এই নিমন্ত্রনের কারন জিজ্ঞেস করে। ডক্টর আন্সারিকে দেখে তার বুঝতে বিশেষ দেরি হয় না এই নিমন্ত্রনের আসল কারন। সুরঞ্জন বাবু কিঞ্চিত রেগে পরাশরের মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে দেখে। পরাশর দাঁত পিষে শ্বাস রুদ্ধ করে দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। জারিনা শক্ত করে অনুপমার হাত ধরে ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী দুই বাড়ির অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
দেবশ্রী বলেন, “পরাশর আর জারিনা, ওদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে আপনাদের কাছে।”
পরাশরের মা, রঞ্জিকা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে সব বুঝতে পেরে যায়। নাজমা একবার পরাশরের দিকে তাকায়, অন্যদিকে রঞ্জিকা তার হবু বউমা, জারিনার দিকে তাকায়। পরাশর আর জারিনা, শ্বাস রুদ্ধ করে আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে গেছে।
ডক্টর মিসবাহুল দেবশ্রীর উত্তরে বলেন, “দেখুন দিদি, আপনি জানেন যে দুই ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই আমি আপনাকে একটা উপায় বলেছিলাম যে যদি পরাশর ওর ধর্ম বদলে নেয় তাহলে এই নিকাহর ব্যাপারে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
সুরঞ্জন বাবু চোয়াল শক্ত করে একবার পরাশরের দিকে একবার পরাশরের মায়ের দিকে তাকিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বলে, “তোমরা সব কিছু জানতে তাই তো? এই বিবাহ কিছুতেই সম্ভব নয়।”
ডক্টর মিসবাহুলের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বলেন, “কেন আমার ছেলে ধর্মান্তরিত হবে? এই বিয়েতে আমার মত নেই, এই সম্পর্ক হতে পারে না।”
পরাশরের মা প্রমাদ গুনে পরাশরের বাবাকে চুপ করতে বলে। দেবশ্রী শীতল কণ্ঠে বলেন, “কেন এই বিবাহ সম্ভব নয়? জারিনা কি দেখতে খারাপ? জারিনার কি কোন দোষ আছে? জারিনা পড়াশুনায় ভালো, কমার্স নিয়ে একটা বড় কলেজে পড়ছে। ভালো শিক্ষিত বাড়ির মেয়ে। ওর দাদা, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়ছে। এমত অবস্থায় আপনার আপত্তি কোথায়?”
দেবশ্রীর উত্তরে ডক্টর মিসবাহুল বলেন, “দেখুন দিদি, আমি বিশেষ কোন তর্কে যেতে চাই না। আমি জানি পরাশর কি করেছে না করেছে। আপনার সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়ে গেছে। আমার এই একটা শর্ত যে পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে, তবেই আমি আমার মেয়ের নিকাহ ওর সাথে দেব।”
উনবিংশ পর্ব (#05)
সুরঞ্জন বাবু গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “ছেলে ধর্মান্তরিত হলে আমি ওকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেব। ওই রকম ছেলে আমার চাই না।”
পরাশর রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবশ্রী পরাশরকে শান্ত করে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “রাগের বশে কিছু করে বসলে সেটা সমস্যার সুরাহা হয় না, বরং এক নতুন সমস্যা তৈরি হয়। আমার কথা একটু শুনুন, তারপরে নিজেদের কথা বলবেন।”
ডক্টর মিসবাহুল বিচক্ষণ ব্যাক্তি তিনি চুপ করে থাকেন। সুরঞ্জন বাবু, দেবশ্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার এতে কি আসে যায়? ছেলে আমার, ও কাকে বিয়ে করবে না করবে সেটা আমরা ভেবে দেখব। পরাশর আমাদের বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে ওর একটা কর্তব্য আছে কি নেই বাড়ির প্রতি।”
রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপ করেছিলেন, কিন্তু সুরঞ্জন বাবুর এহেন মন্ত্যবে আহত হয়ে রাগত কণ্ঠে ধমকে ওঠেন, “প্লিস একটু মাথা ঠাণ্ডা করে কথা শোনো। এমন ভাবে রেগে গেলে কোন কিছুর সুরাহা হয় না।”
সুরঞ্জন বাবু চুপ করে যান।
দেবশ্রী ম্লান হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমার এখানে কোন স্বার্থ নেই। আমার ছেলের বন্ধু হিসাবে, পরাশর আমার কাছে এসেছিল, ওদের ভালোবাসা দেখে আমার মনে হল এদের একটা সুস্থ সুরাহা করা উচিত। নাহলে দুটি প্রান হয়ত হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। অন্তিমে কেউ সুখী হবে না।”
ডক্টর মিসবাহুল অবাক হয়ে বলেন, “আপনি নিঃস্বার্থে এদের জন্য করছেন?”
দেবশ্রী হেসে বলে, “না না, আজকাল কেউ কি আর নিঃস্বার্থে কাজ করে। আপনার মেয়ে সুরঞ্জন বাবুর বউমা হলে, ঈদে ওর হাতের বিরিয়ানি খেতে পারবো, পায়া, মটন কোর্মা কত কিছু খেতে পারবো। সেই স্বার্থে আমি এই কাজে নেমেছি।”
দেবশ্রীর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে শুধু মাত্র সুরঞ্জন বাবু ছাড়া। দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার, আপনি শিক্ষিত আপনি একটা কারন আমাকে দেন কেন জারিনা আপনার বাড়ির বউমা হতে পারবে না।”
সুরঞ্জন বাবু নিচু কণ্ঠে বলেন, “না মানে, বুঝতেই পারছেন কেন এই সম্পর্কে আমার অমত।”
দেবশ্রী, “ছেলে মেয়ে ভিন্ন ধর্মের সেই নিয়ে আপনার অমত। আপনি হিন্দু, ডক্টর মিসবাহুল মুসলমান, এই জন্য অমত।”
সুরঞ্জন বাবু মৃদু মাথা নাড়ান। দেবশ্রী বলে, “আমি ভগবান মানি, তবে ধর্মের নামে এই আচার ব্যবহার মানি না। আমি ধর্ম অথবা ভগবান একটু ভিন্ন ভাবে মানি, সময় আমাকে তাই শিখিয়েছে। আমি আপনাদের দুইজনকে আঘাত করতে চাই না, তবু বলি। এই ধর্ম আর তাঁর আচার ব্যাবহার মানুষের তৈরি, ভগবানের নয়। ভগবান গাছ পালা, নদী নালা, পশু পাখী মানুষ তৈরি করেছিলেন। তাই পৃথিবীর সব জায়গার গাছ পালা, নদী নালা, মানুষ এক রকমের দেখতে। সব জায়গার মানুষের একটা নাক, দুটো চোখ, দুটি হাত, দুটি পা। সবাই মুখ দিয়ে খায়, চোখ দিয়ে দেখে। একটা ছোটো বাচ্চা যখন জন্ম গ্রহন করে তখন সে জানে না তার ধর্ম কি। তার মুখ থেকে প্রথম শব্দ বের হয় কান্নার আওয়াজ, অ্যাঁ। সেই “অ্যাঁ” কান্নার আওয়াজ অনেকটা “মা” ডাকের মতন শোনায়। তাই “মা” ডাক পৃথিবীর সব ভাষাতেই এক। সেটা আলাস্কার কোন প্রত্যন্ত জায়গায় হোক, অথবা ইংল্যান্ডের রানীর বাড়ি হোক, অথবা চিনের দেয়ালের পেছনে হোক অথবা ভারতের কোন শহরে। মাকে সব বাচ্চা মা বলেই ডাকে। সেই ডাক তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না, তেমনি ভালোবাসা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, সেটা বুকের ভেতর থেকে আসে। মানুষ যত বড় হয়, তারা নিজের সুবিধার্থে, পারিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভাষা, ধর্ম আচার ব্যাবহার, জীবন শৈলী ইত্যাদি গঠন করে।”
দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “ধরুন আপনার এক্সিডেন্ট হল, আপনাকে নিয়ে হাস্পাতালে যাওয়া হল। সেখানে আপনার রক্ত চাই, তখন কি আপনি জিজ্ঞেস করবেন রক্তদাতার নাম?”
সুরঞ্জন বাবু মাথা নাড়িয়ে বলেন “না”
দেবশ্রী বলেন, “আপনার শরীরে হয়ত ভিন্ন ধর্মীর রক্ত দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে তোলা হল, সেখানে আপনার আপত্তি থাকবে না। আপনি কোনদিন রেস্তোরাঁতে খেতে যান না? সেখানে কোনদিন জিজ্ঞেস করেছেন যে শেফের ধর্ম কি? রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার আপনার ভালো লাগবে। যখন একটা জীবন অপারেশান থিয়েটারে ছটফট করে তখন এই সব কথা মাথায় আসে না। শুধু একটু ভালোবাসার সময়ে আপনাদের মাথায় আসে জাত পাত, ধর্ম বিদ্বেষ, উঁচু নিচু, বড়োলোক গরিব। এই সব জাত পাত ধর্ম বিদ্বেষ সব কিছু মানুষের মনের তৈরি। এই দুইজনের জন্য এই সব একটু দুরে রাখতে পারবো না আমরা?”
সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল চুপ। ঘরের বাকি সদস্য চুপ করে দেবশ্রীর কথা শুনে যায়। জারিনা অনুপমার হাত ধরে পাথর হয়ে গেছে। অনুপমার কানেকানে বলে যে এত কথা কেউ কোনদিন ওর আব্বাজানের সামনে বলতে সাহস পায়নি। অনুপমা জানিয়ে দেয় যে ওর মামনি অন্য ধাতুর তৈরি মানুষ, যত কঠিন লোহা হোক না কেন, তাদের হৃদয় গলাতে তিনি সক্ষম।
দেবশ্রী, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি একজন নামকরা ডক্টর। আপনি যখন একজনের চিকিৎসা করেন, তখন তার রোগ চিকিৎসা করেন না তাকে নাম দেখে চিকিৎসা করেন। আমি আর্টসের ছাত্রী ছিলাম, বিজ্ঞান পড়িনি তবে আমি ছোটবেলা থেকে ছেলেকে পড়াতে পড়াতে একটু বিজ্ঞান শিখে ফেলি আর তাই দিয়ে বিচার করেছিলাম এই মহামহিম শক্তি কে। বোঝার চেষ্টা করেছি আসল ভগবানকে। আমার মধ্যে, একটা গাছের মধ্যে, একটা কুকুরের মধ্যে, একটা মাছের মধ্যে বহিরাঙ্গের অনেক তফাত কিন্তু ধর্মে বলে ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান। আমি ও বলি ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু একটু অন্য ভাবে মানি। আমরা সবাই অনু পরমানু দিয়ে গঠিত। সবার দেহে সেই প্রোটন নিউট্রন এলেক্ট্রন আছে। সেই এটমের মধ্যে যে শক্তি সেই ভগবান। অমান্য করতে পারেন?”
ডক্টর মিসবাহুল মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দেবশ্রী বলেন, “সেই শক্তি কিন্তু এই হিন্দু, মুসলমান, শিখ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ তৈরি করেনি, করেছি আমরা কারন আমাদের মাথায় একটা ঘিলু বলে বস্তু আছে। আমরা ভাবনা চিন্তা করতে পারি আর তাই সকলকে হাতের মুঠিতে রাখার জন্য ভগবানের দোহাই দিয়ে একসময় তৈরি হয় এই ধরম। আমার বলার বক্তব্য এই টুকু, যে সামান্য একটা মানুষের তৈরি নিয়মের বাধা নিয়ে কেন দুই ছোটো ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেওয়া? তাতে কি ওরা সুখী হতে পারবে? একবার চেয়ে দেখুন ওদের চোখের দিকে তারপরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন।”
ডক্টর আনসারি পরাশরের দিকে তাকায় আর সুরঞ্জন বাবু জারিনার দিকে তাকায়। দুই ছেলে মেয়ের চোখে জল, ছলছল থমথমে চেহারায় দুইজনে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী বলে, “তবে হ্যাঁ, আমি যখন বাড়িতে ডেকেছি ডিনারের জন্য তখন যেন না খেয়ে চলে যাওয়া না হয়।”
সুরঞ্জন বাবু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “এত কথা আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বলেনি। আপনার সাথে যুক্তি তর্কে দার্শনিক তথ্যে পেরে ওঠা বড় কষ্টকর। আপনার বক্তব্য গভীর অর্থ বহন করে যা খন্ডন করা অসম্ভব। তবে আমাকে একটু ভাবতে সময় দেন।”
দেবশ্রী হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবছেন? খাবার কথা না কবে বিয়ে দেবেন সেটার কথা?”
ডক্টর মিসবাহুল হেসে ফেলেন, “আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা বড় মুশকিল। কিন্তু সমাজ, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে?”
দেবশ্রী বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “আপনারা কি ছেলে মেয়েদের শুকনো মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? সত্যি কথা বলতে লোকেরা কি বলবে, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে সেই নিয়ে বড় মাথা ঘামাই। যাদের সুখ দুঃখে আমাদের দাঁড়ানো উচিত তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের কথা শুনতে ব্যাস্ত হয়ে যাই যারা হয়ত আমাদের খেয়ে আমাদের পেছনে নিন্দা করে বেড়ায়। আপনাদের কিছু হলে আপনার ছেলে বউমা, মেয়ে জামাই এসে দাঁড়াবে। দেবায়নকে নিয়ে আমি যখন অথৈ জলে পড়েছিলাম, তখন আমার কোন আত্মীয় আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আপনার দুই জনে একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনাদের কোন আত্মীয় আপনাদের পেছনে আপনাদের নিন্দা করে নি?”
নির্বাক সুরঞ্জন বাবু, নির্বাক ডক্টর মিসবাহুল। দেবশ্রী হেসে বলেন অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে আমার বউমা। সমাজ কে কি বলল না বলল তাতে আমার আসে যায় না। তবে ওই দুষ্টু মেয়েটার মুখের হাসির জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত।”
সুরঞ্জন বাবু দেবশ্রীকে বললেন, “দিদি, সব বুঝলাম। আপনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন সব মেনে নিলাম। আমাদের পরিবারের কথা একটু বলি আপনাকে। আমাদের যৌথ পরিবার, আমার দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে বছর আটেক আগে তার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার ওই একটা ছেলে, পরাশর বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে বউমা হবে বাড়ির বড় বউমা। ভবিষ্যতে তার কাঁধে সবাইকে পরিচালনা করার ভার আসবে। তাই আমি...”
কথা শেষ করতে দেয় না দেবশ্রী কারন তার অজানা নয়, তাই বললেন, “আমি সব জানি, পরাশর আমাকে সব কিছু বলেছে। দেখুন, আমি বলছি না আজকেই জারিনাকে আপনার বউমা করে নিয়ে যেতে। আপনি আপনার দাদাকে বুঝিয়ে বলুন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের মতি গতি, মানুষের চিন্তা ধারা বদলায়। আশা করি আপনি সেই চেষ্টা করবেন। আর আসল কথা, বউমা কেমন লেগেছে সেটা আগে বলুন।”
নাজমা আর রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, কোন কথা না বলে শুধু দেবশ্রীর কথা শুনে গেছে। নাজমা বললেন, “জানেন দিদি, প্রথম যেদিন পরাশর মাথা ফাটিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল, সেদিন আমি মেয়ের মুখ দেখে বুঝে গেছিলাম, ওই ফাটা মাথার কারন।”
নাজমার কথা শুনে পরাশরের কান লাল হয়ে যায়, জারিনা পারলে অনুপমার পেছনে লুকিয়ে যায়।
সেই শুনে হেসে ফেললেন রঞ্জিকা, “আমার বাড়িতে দেবায়ন আর অনুপমা, জারিনাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি ওকে দেখে। তারপরে যখন দেখলাম যে ফুটফুটে মেয়েটা রান্না ঘরে এসে আমাকে সাহায্য করছে তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। বড় মিষ্টি মেয়ে। এত পাকা যে আমাকে বলে চোখে কাজল পড়লে নাকি আমার চোখ দুটি বড় বড় দেখাবে।”
রঞ্জিকা জারিনার দিকে দেখে হেসে ফেলে। জারিনা লজ্জায় অনুপমার পেছনে মুখ লুকায়। রঞ্জিকা সুরঞ্জন বাবুকে বললেন, “দেখো, সত্যি বলছি, বাড়িতে এই সব নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। আমার আর কাকলির কথা কেউ শোনে না। দেবশ্রীদি’র মতন যুক্তি দিয়ে বুঝাতে আমি পারতাম না। আমি জানিনা তোমার কি মত, তবে বউমা আমার ভারী মিষ্টি।”
ডক্টর মিসবাহুল বললেন, “আমার একটু সময় চাই, মানে আমাদের পরিবার আরো গোঁড়া। সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা, সবাইকে মানিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমি যা ভেবে এসেছিলাম, সেই ভাবনা চিন্তা যুক্তি তক্ক আপনার দর্শন শাস্ত্রের কাছে নগন্য। আমি কোনদিন এই ভাবে ধর্মকে, ভগবানকে দেখিনি। আজকে আপনার কথা শুনে মনে হল আমরা কেন, পৃথিবীর সবাই যদি আপনার মতন চোখ খুলে একটু দেখতে পারত তাহলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠত। সত্যি বলতে আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, এই প্রথম পরাজয়ে আমি দুঃখিত নেই। কিন্তু বুঝতেই পারছেন।”
সুরঞ্জন বাবু সমস্বরে বলেন, “একই অবস্থা আমার পরিবারের। দুঃসাধ্য তবে আপনার কথা শুনে মনে হল অসম্ভব কিছুই নয়।”
দেবশ্রী, “আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনাদের দুইজনের পারিবারিক সমস্যার কথা। অনেক সময় আছে, জারিনার কলেজ শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। পরাশরের কলেজ শেষ হতে এক বছর বাকি। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়, আপনার সেই চেষ্টা করুন।”
ডক্টর মিসবাহুল মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “দুই জনের পড়াশুনা শেষ হোক আগে তারপরে ব্যাবস্থা করব।”
সুরঞ্জন বাবু বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এস্ট্রে নিশ্চয় আপনার বাড়িতে পাওয়া যাবে না?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে, “আমি সিগারেট খাই নাকি?”
দেবায়ন তাড়াতাড়ি একটা কাপে একটু জল নিয়ে টি টেবিলে রাখে। সুরঞ্জন বাবু একটা সিগারেট বের করে ডক্টর মিসবাহুলের দিকে এগিয়ে দেয়। ডক্টর মিসবাহুল হেসে বলেন যে একটাই ধরাতে, জারিনা জন্মাবার পরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে বেয়াই মশাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা কঠিন। নাজমা, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে বারন করে। সুরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, আর রাগ কেন এবারে হয়ত দুই বেয়াই মিলে সিগারেট খেয়ে মনের গ্লানি দূর করবে।
রঞ্জিকা হেসে বলেন, “দিদি, আপনার ওই এটম, নিউট্রন শুনে আমার পেটের ইলেক্ট্রন কামড় দিচ্ছে। আমি আমার বেয়ানকে নিয়ে রান্না ঘরে চললাম। আপনি যা ভালো বুঝবেন সেটা করুন।”
পরাশরের মায়ের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এতক্ষণ বাড়িতে যেন ছোটো একটা ঝড় বয়ে গেল। দেবশ্রীর সামনে বসে ছোটো দুই সোফায় ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলেন। দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরকে কাছে ডেকে সবাইকে প্রনাম করতে বলেন। জারিনা আর পরাশর, সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল কে প্রনাম করার পরে দেবশ্রীকে প্রনাম করে।
রঞ্জিকা পরাশরকে বলে, “দিদিকে একদম সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করিস, নাহলে এই যাত্রায় কিছু সম্ভব হতো না।”
দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরের মাথা চুম্বন করে আশীর্বাদ করেন। জারিনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। পরাশর দেবায়নকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন। চারপাশের বদ্ধ আবাহাওয়ায় একটা খুশির আমেজ। বসার ঘরের দেয়ালে দেবায়নের বাবা, সায়ন্তনের একটা বড় ছবি ঝুলান। দেবশ্রী একবার সেই ছবির দিকে জল ভরা চোখে তাকায়। তারপরে দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, তোরা সন্তুষ্ট? চার জনে দৌড়ে এসে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে।
******************* উনবিংশ পর্বের সমাপ্তি *******************
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment