আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
পাপ কাম ভালোবাসা
Written By pinuram
Written By pinuram
বিংশ পর্ব (#07)
দেবায়নের ঘুম কেটে গিয়ে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি হয়েছে পায়েলের?”
অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “পায়েলের খবর পাওয়া গেছে, তুমি এখুনি আমার বাড়িতে এসো।”
দেবায়ন মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী ওর জন্য জামা প্যান্ট নিয়ে তৈরি। দেবশ্রী, দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মেয়েটাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আয় আর যারা এর পেছনে আছে তাদের ছাড়িস না।”
দেবায়ন, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি যখন একবার বলে দিয়েছ, তাহলে আর সেই শয়তানদের রক্ষে নেই।”
রাত তখন বারোটা বাজে। বাইক নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে দেবায়ন। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই রূপক আর ধিমানকে ফোনে করে অনুপমার বাড়িতে যেতে বলে, জানিয়ে দেয় যে পায়েলের খবর পাওয়া গেছে। রূপক জানায় যে শ্রেয়া ওকে জানিয়েছে, সেই মতন ও শ্রেয়াকে নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধিমান জানিয়ে দেয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ও অনুপমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে।
বাইকের শব্দ শুনে অনুপমা দৌড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বসার ঘরে ঢুকে দেখে যে শ্রেয়া, রূপক, ধিমান, সঙ্গীতা সবাই পৌঁছে গেছে। পারমিতা অঙ্কনকে জড়িয়ে ধরে একধারে বসে। মিস্টার সেন, চুপ করে সোফার উপরে বসে আছেন। অঙ্কন চুপ করে গুম মেরে সবার দিকে তাকিয়ে। দেবায়ন জিজ্ঞেস করে অনুপমাকে, কি খবর।
অঙ্কন বলে, “এই কিছু আগে, মানে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার কাছে একটা ফোন আসে। কার ফোন জানি না। সেই লোকটা আমাকে ফোনে বলল যে একটা মেয়ে ওকে আমার নাম্বার দিয়ে সাহায্য চেয়েছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে ওই মেয়েটা মিষ্টি ছাড়া আর কেউ নয়। আমি এখুনি যাবো সেই লোকটার সাথে দেখা করতে আর মিষ্টি কে বাঁচাতে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় যাবি? লোকটা কে, কোথা থেকে ফোন করেছে কিছু জানিস? এত রাতে হয়ত কোন শত্রুর চাল হতে পারে। কি করে বিশ্বাস করা যায় যে লোক’টা সত্যি কথা বলছে?”
অঙ্কন রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে, “দিদির কিছু হলে তুমি কি করতে? এই রকম ভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে?” পারমিতা ছেলেকে শান্ত হতে বলে। অঙ্কন বলে, “আমার মন বলছে যে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। লোকটা নৈহাটির কাছাকাছি, মালঞ্চ নামে একটা গ্রাম থেকে ফোন করেছে। আমি যেতে চাই দেবায়নদা, মিষ্টি আমাকে ডাকছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে এর পেছনে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর হাত আছে। লোকটা যেই হোক আমি মিষ্টিকে বাঁচাতে যাচ্ছি। আমি ওকে বলেছি যে আমি আসছি। লোকটা আমাকে বলেছে যে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”
দেবায়ন বলে, “ঠিক আছে। লোকটার ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
অঙ্কন দেবায়নকে সেই আগন্তুকের ফোন নাম্বার দেয়। রূপক ধিমানকে বলে যে এক বার ঋতুপর্ণাকে খবর দিতে, কারন লোকটা জানিয়েছে যে পায়েলের শরীর খুব খারাপ, কথা বলার মতন শক্তি নেই, ঋতুপর্ণার দরকার লাগতে পারে। ধিমান ঋতুপর্ণাকে মেস থেকে নিয়ে আসতে বেড়িয়ে পরে।
দেবায়ন আগন্তুককে ফোন করে, “আপনি কে? আপনি এত রাতে পায়েলের খবর কি করে জানলেন?”
ওপর পাশে সম্পূর্ণ গ্রাম্য কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে, “বাবু, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, নাইলে মেয়েডা মারা যাবে। আপনারা আসুন তারপরে আমি সব জানাবো। বাবু আমি চোর কিন্তু কোন মেয়ের ইজ্জত চুরি করিনা। বাবু আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।”
লোকটার কণ্ঠ স্বর শুনে দেবায়ন বুঝতে পারে যে হয়ত লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না।
রূপক জিজ্ঞেস করে লোকটা কি বলল, দেবায়ন সবাইকে বলে যে ওদের বের হতে হবে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। দেবায়ন অনুপমাকে বলে যে একবার পরাশরকে ফোনে জানিয়ে দিতে যাতে ও জারিনার বাবাকে বলে রাখে। পায়েলকে কি রকম অবস্থায় পাবে জানে না, ডাক্তারের দরকার পড়তে পারে। অনুপমা সোজা জারিনাকে ফোন করে। জারিনা জানিয়ে দেয় যে ওর আব্বুকে সব জানিয়ে দেবে। জারিনা পরাশরকে ফোনে সব ঘটনা জানায়। পরাশর দেবায়নকে ফোনে জিজ্ঞেস করে যে দরকার পড়লে কাকাকে নিয়ে চলে আসবে। দেবায়ন বলে যে এখুনি কোন দরকার নেই পুলিশের, আগে পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসুক তারপরে পুলিশে দেবে না নিজেরা বিচার করবে সেটা পরের ব্যাপার।
অনুপমার বাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে রণক্ষেত্রের পরিচালনা গৃহ হয়ে ওঠে। সঙ্গীতা ওর মামাতো দাদা, রুদ্রকে ফোনে সব জানিয়ে দেয়। রুদ্র জানিয়ে দেয় ওর বন্ধু বান্ধব নিয়ে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। ধিমান কিছুক্ষণের মধ্যে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে উপস্থিত। ঋতুপর্ণা বেশ কয়েকটা স্যালাইন আর কিছু ইঞ্জেকশান, একটা আইস বক্সে নিয়ে এসেছে। দেবায়ন, অনুপমা আর শ্রেয়াকে বাড়িতে থাকতে বলে। দেবায়ন জানায় যে ওইখানে মারামারির মধ্যে মেয়েদের গিয়ে প্রয়োজন নেই। অনুপমা নাছোরবান্দা, পায়েলের সাথে যারা এই সব করেছে তাদের নিজে হাতে খুন করবে। পারমিতা আর শ্রেয়া কিছুতেই অনুপমাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দেবায়ন ধমক দেয় অনুপমাকে। ধমক খেয়ে থমথমে মুখে চুপচাপ বসে পরে অনুপমা। অঙ্কন যাবেই, ওকে বারন করা ঠিক হবে না বলে দেবায়ন ওকে আর বারন করে না। অনুপমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, তাই ধিমান একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করেছে। রূপক বলে যে শুধু সঙ্গীতার ফোন ছাড়া বাকি সবার ফোন অনুপমার বাড়িতে রেখে যেতে।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার মধ্যে সবাই বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে।
অনুপমা দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “তুমি পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে এস। ও হয়ত জানে না যে ওর মা মারা গেছে। আমি ওকে আমার সব দিয়ে দেব, শুধু আমার বান্ধবীকে ফিরিয়ে নিয়ে এস।” চোখ মুছে বলে, “শয়তান গুলোকে ছেরো না একদম।”
দেবায়ন পারমিতাকে বলে, “মা এক কথা বলেছে, চিন্তা করো না। পায়েলকে নিয়ে আসব আর সেই সাথে বাকিদের ওইখানে কবর দিয়ে আসব।”
একটা সুমোর মধ্যে, দেবায়ন, রুপক, ঋতুপর্ণা, সঙ্গীতা আর অঙ্কন। ধিমানের হাতে স্টিয়ারিং, ছয়জনে বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। জানে না কি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকার কেটে, গাড়ি দ্রুত গতিতে নৈহাটির দিকে ধেয়ে চলে। সময়ের সাথে ওদের লড়াই, দেরি হলে যদি পায়েলকে বাঁচান না যায় সেই চিন্তায় দেবায়ন ঘেমে যায়, ধিমান পাগলের মতন গাড়ি চালায়। চারপাশে ঘন কালো আঁধার, রাস্তায় শুধু ট্রাক ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে যায়। ব্যারাকপুর পার হতেই সঙ্গীতার কাছে ওর দাদার ফোন আসে। সঙ্গীতা জানায় ওর দাদা, রুদ্রর সাথে সেই লোকটার দেখা হয়েছে। লোকটা সত্যি কথাই বলছে, না হলে এত রাতে কল্যাণী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত না। ওদের জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষায় আছে। তীব্র গতিতে গাড়ি চালায় ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা নৈহাটির কল্যাণী রোডের মোড়ে পৌঁছে যায়।
রুদ্র, ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিল। সাথে প্রায় আরও দশ বারোটা ছেলে, সবার হাতে কিছু না কিছু, কারুর হাতে লাঠি, কারুর হাতে বড় ছুরি, কারুর হাতে দা। সবাই তৈরি এক রক্তাক্ত যুদ্ধের জন্য। রুদ্রকে দেখে সঙ্গীতা দৌড়ে যায়। গাড়ি থেকে দুটি মেয়েকে নামতে দেখে রুদ্র একটু ঘাবড়ে যায় বিশেষ করে ওর বোনকে দেখে। রুদ্র সঙ্গীতাকে আসার কারন জিজ্ঞেস করে। সঙ্গীতা জানায় যে পায়ল কে বাঁচাতে এসেছে। রুদ্র সেই আগন্তুককে ধরে এনে দেবায়নের সামনে এনে দাঁড় করায়। দেবায়ন তাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে।
অগন্তুক বলে, “বাবু আমি ছিঁচকে এক চোর, নাম জেনে আর কি হবে তাও বলি, আমার নাম শ্যাম। পুজোর মরশুম গ্রামের মানুষের কাছে পয়সা আসে এই সময়ে। গ্রামের দিকের সবার বাড়ি ঘরদোর আমার চেনা। ওই মালঞ্চের দিকে থাকি আমি। ওইখানে সমীর বাবুর অনেক জমিজমা, আম বাগান আর ফলের বাগান আছে। বেশ বড় লোক চাষা। বাগানের মাঝে ওদের একটা বেড়ার বাড়ি আছে যেখানে গরম কালে ওদের লোকেরা বাগান পাহারা দেবার জন্য থাকে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “এই সমীর বাবু কে?”
রুদ্র উত্তর দেয়, “অগ্নিহোত্রীর বাবার নাম সমীর। অনেক জমিজমা আছে আবার কাপড়ের ব্যাবসা আছে, বেশ বড়োলোক। পাড়ায় বেশ নাম ডাক, সেই সাথে খুব কুটিল প্রকৃতির লোক। তাবে চিন্তা করিস না তোরা, অগ্নিকে পেলে কুপিয়ে মারব। আমার বোনের বান্ধবী মানে আমার বোন।”
রুদ্র দুটো ছেলেকে বলল যে সঙ্গীতাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে, ওদের সাথে সঙ্গীতাকে গিয়ে কাজ নেই। সঙ্গীতা অনিচ্ছা সত্বেও ওর মামাবাড়ি চলে যায়। রুদ্র তারপরে বলে, “ঋতুপর্ণার দরকার আছে। এক কাজ করা যাক, আমরা হাঁটতে থাকি ততক্ষণে ওর মুখে সব কথা শোনা যাক।”
গাড়ি বড় রাস্তায় দাড়ি করিয়ে সবাই দল বেঁধে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। চারপাশে খালি মাঠ, মাঝ খান দিয়ে ভুতের মতন এগিয়ে চলে একদল ছেলে। শ্বাসের আওয়াজ আর পায়ের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, কোথাও দুরে ঝিঁঝিঁ পোকা একটানে সুর করে গান গেয়ে চলেছে।
শ্যাম তার কথা বলতে শুরু করে, “দুই তিন দিন ধরে দেখি সেই কুঁড়ে বাড়িটায় দুটো ছেলের আনাগোনা। তারমধ্যে একজন সমীর বাবুর ছেলে। গরম কালে ওইখানে মানুষ জন থাকে, কিন্তু এইসময়ে ওইখানে ছেলেদের দেখে আমার সন্দেহ হল। আমি তক্কে তক্কে থাকলাম, কি হচ্ছে জানার জন্য। আমি ওদের বাড়ির উপরে নজর রাখলাম, নিশ্চয় কিছু লুকিয়েছে, হয়ত চুরি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যের পরে দেখলাম যে ছেলেগুলো বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে, কিন্তু ভেতরে হ্যারিকেন জ্বালান। আমি চালের টালি সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যা দেখি, তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা ঘরে যেখানে খড় বিচুলি, লাঙ্গল ইত্যাদি থাকে সেই ঘরে একটা মেয়ে বাঁধা। মেয়েটার গায়ে কাপড় নেই বললেই চলে, শুধু মাত্র একটা ছেঁড়া নোংরা কামিজ। আমি মেয়েটার মুখের উপরে ঝুঁকে নাকের কাছে হাত নিয়ে দিয়ে দেখলাম যে শ্বাস চলছে, কিন্তু খুব ধিরে। আমি কি করব কিছু ভেবে পেলাম না। এসেছিলাম চুরি করতে কিন্তু মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট হল। মেয়েটা কোন রকমে চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখের করুন ভাষা দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কে ওকে বেঁধে রেখেছে, ওর বাড়ি কোথায়? মেয়েটার কথা বলার মতন শক্তি ছিল না। আমি আমার জামা দিয়ে মেয়েটাকে ঢেকে দিলাম। আমি চোর হতে পারি বাবু, কিন্তু কোন মেয়ের গায়ে আজ পর্যন্ত হাত তুলিনি। মেয়েটা আমাকে কোনমতে ইশারায় ফোনের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি আমার ফোন বের করে দিলাম। সেই ফোন হাতে ধরার মতন শক্তি ছিল না মেয়েটার হাতে। আমি এক একটা করে বোতামে আঙুল দিয়ে দেখালাম, আর সেই মতন আমাকে ইশারায় আপনার নম্বর জানাল। আমি যেরকম ভাবে ঢুকেছিলাম তেমনি বেড়িয়ে এলাম। আমি বের হবার কিছু পরে দেখলাম যে ওই দুজন ছেলে বাড়িতে আবার ঢুকেছে, ওদের হাতে খবরের কাগজে মোড়া মদের বতল। আমি বুঝতে পারলাম যে মদ খেয়ে এই মেয়েটার সর্বনাশ করবে ওরা। আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করলাম।”
দেবায়ন অঙ্কনের দিকে তাকায়। অঙ্কনের দুই চোখে আগুন ঝরছে, দাঁতে দাঁত পিষে চিবিয়ে বলে, “আমি তোমাকে বলেছিলাম বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ধরতে। যদি মিষ্টির কিছু হয় তাহলে আমি তোমাকে, মাকে আর বাবাকে কোনদিন ক্ষমা করব না।”
রূপক অঙ্কনকে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ ভাই, আমাদের হাতে কিছু ছিল না। আমরা জানতাম না যে পায়েল কোথায়। প্রমান ছাড়া ওদের গায়ে হাত দিলে পুলিস কেস হয়ে যেত।”
অঙ্কন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “দিদির কিছু হলে দেবায়নদা চুপ করে থাকত? তখন প্রমানের অপেক্ষা করত না নিশ্চয়।”
অঙ্কনের কথা শুনে দেবায়ন মাথা নিচু করে নেয়।
ঋতুপর্ণা অঙ্কনকে আসস্থ করে বলে, “ভাইটি, চুপ কর এখন। পায়েলের কিছু হবে না।”
সবাই আবার চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছুদুর যাবার পরে, দুরে একটা বাগানের দিকে দেখিয়ে দেয় শ্যাম। বলে ওর মাঝে একটা বেড়ার ঘর আছে তার মধ্যে পায়েলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পা টিপে টিপে সবাই এগোতে শুরু করে দেয় বাড়ি টার দিকে। সব থেকে আগে দেবায়ন আর রুদ্র, দুইজনের হাতে বাঁশের লাঠি। ঠিক পেছনে ধিমান আর রূপক। রুদ্র একটা বড় ছুরি রূপকের হাতে ধরিয়ে দেয়। বাকি ছেলেরা পেছনে। রুদ্র ইশারায় ওর সাথে আসা ছেলেগুলোকে বলে বাড়ি ঘরে ফেলতে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরের হ্যারিকেনের আলো দেখা যায়। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু চাপা শ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না।
শ্যাম গলা নিচু করে দেবায়নকে বলে, “বাবু, দরমার বেড়া, এক লাথিতে ভেঙ্গে যাবে দরজা।”
রুদ্র আর দেবায়ন দরজায় এক সজোরে লাথি মারতেই দরজা খুলে যায়। বিনয় আর অগ্নিহোত্রী, বেশ আরাম করে একটা তক্তায় বসে মদ গিলছিল আর গল্প করছিল, কি ভাবে পায়েলকে ভোগ করা যায়। দরজা ভাঙ্গার শব্দে চমকে ওঠে দুইজনে। ওদের হাতের কাছে একটা লাঠি ছিল, সেই টা তুলে নিল বিনয়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবায়ন, রুদ্র আর রূপক ঝাঁপিয়ে পরে দুটি ছেলের উপরে। এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুসি মারতে শুরু করে দেয় দুইজনকে। ততক্ষণে রুদ্রের বাকি বন্ধুরা দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে বেঁধে ফেলে। শ্যাম চোর বলে যে দিদিমনি পাশের ঘরে। ধিমান পাশের ঘরের দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে দেয়। ভেতরের দৃশ্য দেখে ধিমান আর ঋতুপর্ণা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর, একপাশে খড় বিচুলির গাদা। ঘরের এক কোনায় এক তাল ঘুঁটে, এক পাশে বস্তায় সার, খৈল রাখা। একটা বড় মাটির জালায় খৈল ভেজান, তার দুর্গন্ধে ঘরে টেকা দায়। কোন পশুকে হয়ত এত নোংরা অবস্থায় রাখা হয় না। দেবায়ন ঘরে ঢুকে পায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখে। ওর অবস্থা দেখে চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। ফর্সা রঙ আর ফর্সা নেই, কালী হয়ে গেছে। সুন্দরী পায়েলের সেই মূর্তি কালী মাখা, দেখলে মনে হয় যেন একটা শুকনো কঙ্কালের উপরে চামড়া জড়ানো। গায়ে একটা ছেঁড়া কামিজ ছাড়া নিচে কিছুই পরে নেই।
অঙ্কন দৌড়ে গিয়ে পায়লেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁপা গলায় পায়েলকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মিষ্টি আমি এসে গেছি।” চোখ ভিজে আসে অঙ্কনের। পায়েল কোনোরকমে চোখ খুলে একবার অঙ্কনের মুখের দিকে তাকায়, ঠোঁট জোড়া নড়ে ওঠে কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না। পায়েল, অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। অঙ্কন চিৎকার করে ওঠে, “মিষ্টি প্লিস সোনা, চোখ খোলো। প্লিস সোনা আমাকে ছেড়ে যেও না।”
শ্যাম অন্য ঘর থেকে একটা বোতলে জল নিয়ে ঋতুপর্ণার হাতে দেয়। ঋতুপর্ণা পায়েলের মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। পায়েলের শরীরে এতটুকু শক্তি ছিল না যে চোখ খুলে একবার সবাইকে দেখে। কোনোরকমে শেষ সম্বলের মতন অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে নিস্বার হয়ে পরে থাকে। অঙ্কন প্রাণপণে পায়েলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। ধিমান আর ঋতুপর্ণা ওর পাশে এসে বসে পড়ে।
বিংশ পর্ব (#08)
ঋতুপর্ণা ভালো ভাবে পায়েলকে দেখার পরে ধিমানকে বলে, “যার বেশি ভয় ছিল সেটা হয় নি, ওরা এখন রেপ করেনি পায়েলকে। তবে পায়েলের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। এতদিন হয়ত ঠিক ভাবে খেতে পায়নি। শরীরে কিছু বেঁচে নেই, প্রচন্ড ডিহাইড্রেট হয়ে গেছে। প্রচন্ড ট্রমাতে ভুগছে। এখুনি ওকে স্যালাইন দিতে হবে, ওকে নিয়ে আমাদের বেড়িয়ে পড়া উচিত না হলে শেষ রক্ষা করতে বড় মুশকিল হয়ে যাবে।”
অঙ্কন পারলে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে পায়েলকে। সব শক্তি দিয়ে আগলে ধরে থাকে, এমন কি ধিমানের উপরেও যেন ওর আর বিশ্বাস নেই। চোখে মুখে করুন ছাপ, বারেবারে পায়েলের মাথায় গালে হাত বুলিয়ে কানের কাছে বিড়বিড় করে চোখ খুলতে অনুরোধ করে। পায়েল অজ্ঞান, অঙ্কনের কাতর ডাক পায়েলের কানে পৌঁছায় না।
দেবায়ন চোখ বন্ধ করে একবার ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানায়। তারপরে ধিমানকে বলে, “তুই এদের নিয়ে বেড়িয়ে যা। রুদ্রের ফোন থেকে একবার পরাশরকে ফোন করে দে। জারিনার বাবাকে এমনিতে বলা আছে, সোজা জারিনার বাড়িতে নিয়ে চলে যাবি। একটা কথা মনে রাখিস, পুলিসে খবর একদম দিবি না।”
ধিমান জিজ্ঞেস করে, “কেন? এটা পুলিস কেস।”
অঙ্কন হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, “পুলিস শালা কিছুই করতো না। ওর বাবা মা যে কমপ্লেইন করে নি। কেন যাবো পুলিসের কাছে? আমি ওদের খুন করে তবে যাবো।”
দেবায়ন অঙ্কনকে শান্ত করে বলে, “তুই তোর মিষ্টিকে পেয়ে গেছিস। এবারে তুই ওকে নিয়ে বেড়িয়ে যা এখান থেকে। বাকিদের কি করতে হয় আমি দেখে নেব।”
রুদ্রের ফোন থেকে অনুপমাকে ফোন করে দেবায়ন, “পায়েল কে পাওয়া গেছে। ভাই আর ঋতুপর্ণা পায়েল কে নিয়ে এখুনি রওনা দিচ্ছে। তুমি শ্রেয়াকে নিয়ে জারিনার বাড়িতে চলে যাও। পরাশরকে বলবে পার্ক সার্কাসের মোড়ে দাঁড়াতে। ওইখানে থেকে এদের নিয়ে জারিনার বাড়িতে চলে যায় যেন। পরাশরকে বলে দেবে যেন ওর কাকা এইসবের কিছু জানতে না পারে।”
অনুপমা কেঁদে ফেলে দেবায়নের কথা শুনে, “তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো আমার কাছে। বড় দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে।”
শ্রেয়া বলে, “তুই চিন্তা করিস না, আমি ঠিক করে নেব খানে। তুই কখন আসবি?”
দেবায়ন, “এখানে এখন কাজ বাকি তারপরে আমি আসব। আর হ্যাঁ এক বার আমার মাকে জানিয়ে দিস যে পায়েল কে পাওয়া গেছে।”
ঋতুপর্ণা বেড়িয়ে যাবার আগে ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে দেবায়ন আর রূপককে বলে, “এরা যেন কালকের সূর্য না দেখতে পারে সেই ব্যাবস্থা করবে।”
দেবায়ন বলে, “তুমি শুধু পায়েলকে একটু দেখো, প্লিস। আমরা ছাড়া ওর আর কেউ দেখার নেই মনে হয়।”
রুদ্র ওর কয়েক জন বন্ধুকে বলে অঙ্কনদের গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। ধিমান থাকতে চাইলে দেবায়ন বলে যে গাড়িতে ওকে দরকার। একা ঋতুপর্ণা আর অঙ্কন হয়ত পায়েলকে সামলাতে পারবে না। পায়েলের নিস্বার দেহ, অঙ্কন কোলে তুলে নেয়। ধিমান বেড়িয়ে যাবার আগে, রাগের বশে বিনয়কে খান পাঁচেক সজোরে লাথি মেরে বেড়িয়ে পরে। দেবায়ন বলে, কোলকাতা পৌঁছে যেন রুদ্রের ফোনে একবার ফোন করে জানিয়ে দেয় ওদের সংবাদ। ধিমান মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে সব সংবাদ দিয়ে দেবে। পায়েল কে নিয়ে বেড়িয়ে যায় সবাই।
দেবায়ন অন্য ঘরে ঢোকে, একটা হ্যারিকেন ছাড়া আর কোন আলো নেই। বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর মুখ হাত পা বাঁধা। রুদ্র রূপক আর বাকিরা, ছেলে দুটোকে বেঁধে বেশ মার মেরেছে। শুধু গোঙ্গানো ছাড়া আর কোন আওয়াজ বের হয় না ছেলে গুলোর মুখ থেকে। দুটো ছেলে দেবায়নের দিকে রোষ ভরা চাহনি নিয়ে দেখে।
ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “তোদের মধ্যে বিনয় কে আর অগ্নিহোত্রী কে?” রুদ্র দেখিয়ে দেয় বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে।
দেবায়ন, রূপককে বলে, “বিনয়ের মুখ খুলে দে। ওর সাথে আমার কথা আছে।”
রূপক, বিনয়ের মুখ খুলে দিতেই বিনয় চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, “শালা আমার গায়ে হাত তুলেছিস তুই। তোকে এইখানে পুঁতে ফেলব। তুই আমাকে চিনিস না।”
রুদ্র গর্জন করে বলে, “তুই বাঞ্চোত জাত শয়তান। তোকে সবাই চেনে।”
দেবায়ন তির্যক হেসে বলে, “সকালের সূর্য দেখতে পেলে তবে না আমাকে পুঁতবি।”
দেবায়ন নিজের মোবাইল ফোন রূপকের হাতে ধরিয়ে বলে, “ভিডিও করতে শুরু করে দে। ওদের কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে তারপরে আমি ওদের বিচার করব।”
রুদ্রকে বলে, “বাকিদের বাইরে অপেক্ষা করতে বল। এই কথা শুধু তুমি আমি আর রূপকের মাঝে থাকবে।”
রুদ্র বাকি ছেলেদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দেয়। রুদ্রের বন্ধুরা ঘরের বাইরে চলে যায়। রূপক দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করতে শুরু করে। দেবায়ন বিনয়ের চুলের মুঠি ধরে গালে একটা সপাটে চড় কষিয়ে দেয়। ঠোঁটের কষ ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়। বিনয় কিছু বলার আগেই আরো একটা চড় গালে কষায় দেবায়ন। দেবায়নের কঠিন হাতের চড় খেয়ে বিনয় বুঝতে পারে যে এই বারে সুন্দরবনের বাঘের কবলে পড়েছে।
বিনয় বলে, “বড্ড পাপ করে ফেলেছি। দয়া করে ছেড়ে দাও আমাদের। আমি সত্যি বলছি, কোনদিন পায়েলের দিকে তাকাবো না।”
রুদ্র অগ্নিহোত্রীর মাথার পেছনে সজোরে এক লাথি মেরে বিনয়কে বলে, “বোকাচোদা ছেলে, করার আগে ভাবতে পারিস নি?”
দেবায়ন বিনয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করে, “পায়েলকে এই ভাবে ধরে রাখার পেছনে কে?”
বিনয়, পাশে পরে থাকা অগ্নিহোত্রীর দিকে দেখিয়ে বলে, “আমি কিছু করিনি, আমি কিছু জানিনা। যা করার ওই করেছে পায়েলকে।”
গা জ্বলে ওঠে দেবায়নের। রুদ্র, মেঝেতে পরে থাকা অগ্নিহোত্রীকে বেশ কয়েকটা লাথি মেরে বলে, “মাদারচোদ আজকে তোর বাড়া কেটে তোকে খাওয়াব। একটা মেয়েকে এমন ভাবে ধরে রেখে কষ্ট দেওয়া বের করে দেব।”
দেবায়ন বলে, “সব কথা শুরু থেকে বল আমাকে। অগ্নিহোত্রী পায়েলের সাথে প্রেমের নাটক করেছিল কেন? পায়েলের বাবা কোথায়? পায়েলের মায়ের মৃত্যু কি করে হয়েছে? পায়েল এত দিন কোথায় ছিল? সব কথা বল। এমনিতেও তোরা আজকে মরবি, বলে মরলে তোদের ভালো। পায়েল কোলকাতা চলে গেছে। আমার এক বন্ধুর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর। তুই না বললেও, কি করে বলাতে হয় সব কিছু জানা আছে আমাদের কাছে।”
বিনয় কোন রকমে কাতর মিনতি করে বলে, “আমি বলছি, সব বলছি। আসলে, আমার আর অগ্নিহোত্রীর অনেকদিন থেকেই পায়েলের ওপরে নজর ছিল। গত গরমের ছুটিতে পায়েল আমাদের বাড়িতে আসে। পায়েল শয়তানি করে অগ্নিহোত্রীর সাথে মিশে আমাদের মাঝে ঝগড়া বাঁধাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার আর অগ্নিহোত্রীর প্লান অন্য ছিল। আমরা নাটক করলাম যে আমাদের মধ্যে মনমালিন্য হয়ছে। অগ্নিহোত্রী পায়েলকে খেলিয়ে উঠাতে চেয়েছিল। আমাদের মতলব ছিল যে একবার পায়েলকে এই খানে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসব আর ধরে রাখব। অগ্নিহোত্রী পায়েলকে ভোগ করবে পারলে ওকে বিক্রি করে দেওয়া হবে কোথাও। আমার মতলব ছিল মামাকে ব্লাকমেল করে মামার কোটি টাকার বাড়ি নিজের নামে করে নেওয়া। কিন্তু বাধ সাধল কপাল। যেদিন পায়েলকে উঠিয়ে নিয়ে আসার কথা, সেদিন কি করে পায়েল আমাদের দেখে ফেলে আর অইখান থেকে চলে যায়। সবার সামনে আমাদের সাহস হল না পায়েলকে জোর করে গাড়িতে তোলার। ইতিমধ্যে দেখলাম একটা ছেলে ট্যাক্সিতে এসে পায়েলকে নিয়ে চলে গেল।”
রূপক আর দেবায়নের গা চিড়বিড় করে জ্বলতে শুরু করে দেয়। রুদ্র অগ্নিহোত্রীর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় বিক্রি করার মতলবে ছিলিস তোরা?”
রুদ্র, অগ্নিহোত্রীর মুখ খুলে দিতেই, অগ্নিহোত্রী কেঁদে দেয় হাউহাউ করে।
অগ্নিহোত্রী বলে, “আমি ওকে বিক্রি করতে চাইনি। আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। বিনয় সব মিথ্যে কথা বলছে।”
বিনয়, অগ্নিহোত্রীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, “মাদারচোদ ছেলে এখন মিথ্যে বলছিস? এখন মনে হয় তোর অন্য কিছু মতলব ছিল পায়েলকে নিয়ে।”
অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। দেবায়ন দুইজনের মাথা একসাথে ঠুকে দিয়ে গর্জন করে ওঠে, “চুপ শালা বোকাচোদা ছেলে। বিক্রি করেছিস কি করিস নি, সেটা পরের কথা।” বিনয়কে বলে, “তুই বাকি কথা বল।”
বিনয় বলে, “আমাদের প্লান ভন্ডুল হয়ে গেল। এর বেশ কয়েক মাস পরে একদিন মামা মাকে ফোন করে বলে যে পায়েল নাকি একটা ছেলেকে ভালোবাসে। যে ছেলেটাকে ভালোবাসে সে নাকি পায়েলের বান্ধবীর ভাই। সেই শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে সেই রাতেই কোলকাতায় মামার বাড়িতে চলে গেল। মা প্রথমে পায়েলকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে এই সব ছেলেদের সাথে মেলা মেশা করা খারাপ। পায়েল কোন কথা শুনতে চায় না, ও বাড়ি থেকে চলে যাবার কথা বলে। সেই কথা শুনে মামা পায়েলকে বেধরক মারে। মামী বাধা দিতে এলে মামা মামীকে খুব মারধোর করে। মা ও মামীর উপরে খুব তোলপাড় করে, মামীকে বলে যে মামীর জন্য পায়েল খারাপ হয়ে গেছে। মারধোর করার পরে, মামা পায়েলকে একতলায় মামার চেম্বারের পেছনে একটা ছোটো বাথরুমে বন্ধ করে দেয়। মা, মামাকে বুদ্ধি দেয় পায়েলের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে। আমি অনেক দিন আগেই মায়ের কান ভাঙ্গিয়ে রেখেছিলাম অগ্নিহোত্রীর কথা বলে। জানতাম একবার যদি অগ্নিহোত্রীর সাথে পায়েলের বিয়ে হয় তাহলে আমিও একটু সুখ পাবো, সেই সাথে কোটি টাকার বাড়ি পেয়ে যাবো।”
দেবায়ন দাঁত পিষে চুপচাপ শুনে যায় ওর কথাবার্তা। রূপক দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে সবকিছু মোবাইলে রেকর্ড করে। রুদ্র, অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিনয় বলে ওর কথা, “সেদিনের পর থেকে পায়েল নিচের বাথরুমে বন্দি হয়ে থাকে। মামা ওকে জোর করে, আর পায়েল জেদ ধরে বসে থাকে সেই অঙ্কন নামের ছেলেটার কাছে যাবে। মামা ওকে বাথরুম থেকে বের হতে দেয় না। ওই দিকে মামী কেঁদে কেঁদে সারা। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে একদিন মামাকে মারতে যায়। মামা বেগতিক দেখে মামীকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দেয় বা ওইরকম কিছু একটার ইঞ্জেকশান দেয়। সেদিনের পর থেকে মামীকে কিছু একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে নিস্তেজ করে রেখে দেয় মামা। বাড়িতে বাইরের কারুর প্রবেশ বন্ধ করে দেয়, বাড়ির পুরানো চাকরকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি মামাকে একদিন ফোন করে সব কথা জিজ্ঞেস করলাম, মামা আমাকে খুব ভালবাসত, মামা আমাকে সব কথা খুলে বলল। আমি মামাকে বুদ্ধি দিলাম, যে পায়েলকে যেন মামীর সামনে না আসতে দেওয়া হয়। আমি মামাকে বললাম যে এর মাঝে একদিন রাতে পায়েলকে নৈহাটি নিয়ে চলে আসব। কিন্তু এর মধ্যে একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়লাম আমি, তাই আর সময় মতন কোলকাতা যাওয়া হল না। ওইদিকে অগ্নিহোত্রী আমাকে রোজ দিন পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করত। আমি ওকে বলতাম যে পায়েল আর মামা এখন আমাদের হাতের পুতুল। যখন খুশি পায়েলকে নিয়ে আসা যায়। আমি জানতাম যে মামা ওকে বাথরুম থেকে কিছুতেই ছারবে না। একবার ছাড়া পেলে পায়েল পালিয়ে যাবে। মামা পায়েলের খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিল যাতে পায়েলের পালাবার মতন শক্তি না বাঁচে। ওইদিকে মামা রোজদিন মামীকে কোন ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিত।”
“কিছুদিন আগে, এক রাতে মামার ফোন। মা চমকে ওঠেন খবর শুনে। মামিমা মারা গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে নিয়ে মামাবাড়ি চলে গেলাম। মামা মাকে বললেন যে মামিমাকে রোজ দিন যে ওষুধ বা বিষ দিচ্ছিল সেই কারনে মামিমা মারা গেছেন। কোলকাতায় মামিমার দেহের শেষকৃত্য করতে হলে পুলিস কেস হয়ে যাবে, সবাই আমরা ফেসে যাবো। মা মামাকে বলল মামিমার দেহ নৈহাটি নিয়ে চলে আসতে। আমি মামাকে একদিকে ডেকে বললাম যে মামা যদি ওই বাড়ি আমার নামে করে দেয় তাহলে আমি সবকিছু ঠিক করে দেব। মামা আমাকে বাড়ির দলিল হাতে ধরিয়ে বলে যে আমি এই বাড়ি আমার হয়ে গেল। আমি, মা আর মামা, মামিমার মৃতদেহ সেই রাতে মামার গাড়িতে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলে এলাম। রাতের অন্ধকারে এই খানে বলা হল যে মামীর হার্ট এটাকে মৃত্যু হয়েছে। এইখানে মানুষকে বোঝানো সহজ, ওইখানে মারা গেলে তোরা পুলিস নিয়ে আসতিস সেটাও একটা ভয় ছিল মামার। তাই এইখানে মামীর শেষকৃত্য করা হয়। পায়েল এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। পায়েল জানেই না যে ওর বাবা ওর মাকে ওষুধ দিয়ে মেরে ফেলেছে।”
বিনয়ের কথা শুনে দেবায়ন রাগে কাঁপতে শুরু করে দেয়। গর্জন করে ওঠে বিনয়ের দিকে, “পায়েলের বাবা এখন কোথায়?”
বিনয় বলে, “আমাদের বাড়িতে।”
দেবায়ন, “তার মানে এতদিন ধরে পায়েল ওই বাথরুমে বন্ধ ছিল। কেউ খেতে পড়তে দেয় নি। কি রকম মানুষ ওই ডাক্তার? ওই শালা তোদের বাড়ি চলে আসার পড়ে পায়েলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেনি?”
বিনয়, “হ্যাঁ করেছিল। আমি বলেছি যে অগ্নিহোত্রী পায়েলকে নিয়ে দিঘা বেড়াতে গেছে। আসলে পায়েলকে ততদিন ওই বাড়িতেই আটকে রাখা হয়েছিল। দুই দিন আগে আমি আর অগ্নিহোত্রী রাতের অন্ধকারে, কোলকাতা গিয়ে পায়েলকে নিয়ে এইখানে রাখি। অগ্নিহোত্রীর প্লান ছিল বেশ কয়েক মাস ওকে রেপ করবে আর তারপরে একদিন ওকে বিক্রি করে দেবে।”
অগ্নিহোত্রী বলে, “বিনয় আমার নামে মিথ্যে বলছে। আমি কিছুই চাই নি ওর কাছ থেকে।”
রুদ্র, অগ্নিহোত্রীর চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে মুখ ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করে, “শালা সত্যি কথা বল, না হলে এখুনি মেরে ফেলে দেব।”
রূপক রেগে গিয়ে মোবাইল ছেড়ে, ছুরি বসাতে যায় বিনয়ের গলায়। দেবায়ন বাধা দেয় রূপককে। রূপক কাঁপতে কাঁপতে গর্জে ওঠে, “এই দুটোকে মেরে ফেলা ভালো।”
দেবায়ন বলে, “দাঁড়া আমার কাজ এখন শেষ হয়নি।”
রুদ্র আর রূপক, দেবায়নের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি মতলব?”
দেবায়ন বড় এক শ্বাস নিয়ে বলে, “দাঁড়া, সময় হলেই জানতে পারবি। এবারে অগ্নিহোত্রীর কথা শুনতে হবে। ওর শুধু মাত্র পায়েলকে বিয়ে করার মতলবে ছিল না, অন্য কিছুর মতলব ছিল।”
অগ্নিহোত্রী শেষ পর্যন্ত সত্যি কথা বলে, “আসলে আমি পায়েলকে ভুলিয়ে বিয়ে করার মতলবে ছিলাম। বিনয়ের মুখে শুনেছিলাম ওদের বিশাল বাড়ি, সেই বাড়ির দাম প্রায় এক কোটির মতন। আমি বিয়ে করার পরে পায়েলকে বেশ কয়েক মাস ভোগ করতাম আর তারপরে বাড়ি পেয়ে গেলে পায়েলকে বিক্রি করার মতলবে ছিলাম। আমরা পায়েল কে এখানে এনে ওকে খাবার দাবার দিয়ে সুস্থ করে তারপরে একটু ভোগ করার মতলবে ছিলাম। কারন পায়েলের যা অবস্থা ছিল তাতে ওকে ভোগ করার মতন কিছু ছিল না, হয়ত মরেই যেত। ওকে এত তাড়াতাড়ি আমরা মারতে চাইনি।”
দেবায়ন ঘুরিয়ে এক ঘুসি মারে অগ্নিহোত্রীর মুখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় অগ্নিহোত্রীর মুখ থেকে। রুদ্র রাগে কাঁপতে কাঁপতে, অগ্নিহোত্রীর গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে গর্জে ওঠে, “অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিস তুই। কালকের সূর্য দেখতে পাবি না, এটা আমি বলছি। তোকে মেরে ফেললে ভাববো যে পৃথিবী থেকে একটা পাপ কম হয়েছে।”
প্রচন্ড মার খেয়ে মেঝেতে পরে কুঁকড়ে যায় অগ্নিহোত্রী। দেবায়ন অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে বলে, “তোরা অনেক পাপ করেছিস। পায়েলকে অনেক কষ্ট দিয়েছিস এমন কি খুন করতে চেষ্টা করেছিস। তবে একজন আরও আছে যার সাজা পাওয়া উচিত। পায়েলের বাবা, ডক্টর কমলেশ সান্যাল।”
রূপক আর রুদ্র জিজ্ঞাসু চোখে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবায়ন বলে, “ওর বাবা, সুজাতা কাকিমাকে মেরেছে। পুলিস খুঁজে কোন প্রমান পাবে না কেননা তোরা কাকিমাকে পুড়িয়ে দিয়েছিস আর সব প্রমান শেষ করে দিয়েছিস।”
বিনয় মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ। মামিমার ডেথ সারটিফিকেটে হার্ট এটাক লেখা।”
বিংশ পর্ব (#09)
দেবায়ন বলে, “পায়েলের বাবাকে মারতে হবে তোদের।”
রুদ্র আর রূপক হাঁ করে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেটা কি করে সম্ভব?”
দেবায়ন বলে, “সব সম্ভব হবে। তার আগে পায়েলের বাড়ির দলিল আমার চাই। পায়েলের ভবিষ্যৎ আমার চাই।”
বিনয়, “পায়েলের বাড়ির দলিল আমি নিয়ে আসছি এখুনি, আমাদের ছেড়ে দে। আমরা কথা দিচ্ছি কোনদিন পায়েল কেন, মামাবাড়ির মুখ দেখব না।”
দেবায়ন, “উঁহু, তোদের ছেড়ে দিলে পাপ হবে। সুজাতা কাকিমার আত্মা শান্তি পাবে না।”
রূপক গর্জে ওঠে, “তোদের ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। পায়েলকে যেমন ভাবে কষ্ট দিয়েছিস, তারপরে তোদের মরে যাওয়া উচিত।”
দেবায়ন, “বিনয় আমাদের কাছে বাঁধা থাকবে। অগ্নিহোত্রী ঢুকবে বিনয়ের বাড়িতে, আগে ওই দলিল এনে আমাকে দেবে, তারপরে পায়েলের বাবাকে খুন করবে অগ্নিহোত্রী।”
বিনয় আর অগ্নিহোত্রী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, “না খুন আমাদের দ্বারা হবে না।”
রূপক বিনয়কে এক লাথি মেরে বলে, “খুনের চেয়ে বড় পাপ, এমন ভাবে ধরে রেখে একজনকে কষ্ট দেওয়া। জ্যান্ত একটা মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তার আত্মাকে মেরে ফেলা। তোরা পায়েলকে এক রকম মেরেই ফেলেছিলিস, ওই দিকে তোর মামা তোর মামীকে মেরে ফেলেছে। তোরা সবাই দোষী। দেবায়ন যা বলছে সেটা কর। এমনিতেও তোরা ধরা পড়বি, কেননা পায়েলকে দেখে পুলিস কেস হবে। পায়েল পুলিসকে সব বলে দেবে।”
অগ্নিহোত্রী বলে, “আচ্ছা যদি খুন করি ওর মামাকে তাহলে আমাদের ছেড়ে দেবে তোমরা।”
দেবায়ন হেসে বলে, “আমি ছেড়ে দেব।”
রূপক আর রুদ্র, রেগে যায় দেবায়নের ওপরে, “তুই কি বলছিস? এদের ছেড়ে কেন দেব? না মারলেও পুলিসের হাতে দেব।”
দেবায়ন, রূপক আর রুদ্রকে শান্ত করে বলে, “আগে আমার কাজ শেষ হোক তারপরে দেখছি।”
অগ্নিহোত্রীকে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তোর বাবা বেশ বড়োলোক। তার মানে তোদের বাড়িতে নগদ টাকা আছে?”
অগ্নিহোত্রী, “হ্যাঁ আছে, তোমাদের কত টাকা চাই বল, আমি দেব। এক লাখ, দুই লাখ পাঁচ লাখ? এই পুজোর মরশুমে কাপড়ের ব্যাবসা দারুন চলেছে। বাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা ক্যাস পড়ে আছে, আমি বাবার দেরাজ খুলে সব টাকা চুরি করে আনতে পারি এখুনি। সব টাকা তোমাকে দিয়ে দেব যদি আমাদের ছেড়ে দাও।”
দেবায়ন হাসতে হাসতে বলে, “হ্যাঁ, আমার টাকা চাই। বিনয় যাবে তোর বাড়িতে টাকা চুরি করতে আর অগ্নিহোত্রী যাবে বিনয়ের বাড়িতে পায়েলের বাবাকে মারতে। তারপরে তোদের ছেড়ে দেব আমি। এবারে বল, কার বাড়িতে কি করে ঢুকতে হয়?”
অগ্নিহোত্রী বিনয়কে বুঝিয়ে বলে, “ওই দু’তলার আমার রুমের জানালার একটা শিক খুলে যায়। সেই শিক সরিয়ে আমার রুমে ঢুকে যাবি। তারপরে নিচে চলে যাবি সিঁড়ি বেয়ে। বাবার রুম দেখেছিস তুই, বাবার কোমরে দেরাজের চাবি থাকে একটা দড়িতে বাঁধা। বাবা এখন আফিং মেরে মরার মতন ঘুমাচ্ছে। আমার টেবিলে কাঁচি পেয়ে যাবি, সেই কাঁচি দিয়ে খুব সহজে ওই দড়ি কেটে চাবি নিয়ে নিবি। বাবার মাথার কাছে যে দেরাজ আছে, তার নিচের তাকে একটা সিন্দুক দেখতে পাবি। চাবির থোকায়, সব থেকে বড় চাবিটা ওই সিন্দুকের। ওর মধ্যে পেয়ে যাবি পাঁচ লাখ টাকা।”
বিনয় দেবায়নকে বলে, “ওই টাকা দিলে আমাদের ছেড়ে দেবে তো?”
দেবায়ন বলে, “আগে অগ্নিহোত্রী পায়েলের বাবাকে খুন করে আসুক তারপরে।”
অগ্নিহোত্রীকে বলে, “তুই আগে বিনয়ের বাড়িতে ঢুকে পায়েলের বাড়ির দলিল আমার হাতে এনে দিবি। তারপরে আবার ঢুকে পায়েলের বাবাকে খুন করে বেড়িয়ে আসবি। পায়েলের বাবাকে যে খুন করেছিস তার প্রমান স্বরুপ ওইর মৃতদেহের ছবি তুই তোর মোবাইলে তুলে আনবি। ছুরি মারিস না, তাতে চেঁচামেচি হবে তুই ধরা পড়ে যাবি। পায়েলের বাবার মুখের উপরে বালিস চাপা দিয়ে মারবি। আর সব ঘটনা মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়ে আসবি।”
অগ্নিহোত্রী, “ঠিক আছে তাই হবে, কিন্তু আমাদের ছেড়ে দিতে হবে তারপরে।”
দেবায়ন বিনয়কে বলে, “আগে বল কি করে তোর বাড়িতে ঢোকা যায়? কোথায় পায়েলের বাড়ির দলিল? কোথায় পায়েলের বাবা ঘুমিয়ে আছে?”
বিনয় বলে, “মামা, নিচের ঘরে ধুমিয়ে। মামার ঘরের পাশেই আমার ঘর। দলিল আমার আলমারিতে রাখা, আলমারিতে কোন তালা দেওয়া নেই, সুতরাং দলিল আনতে কোন কষ্ট হবে না। মামা ঘরের দরজা ভেজান থাকে, সহজে খুলে যাবে। আমার বাড়িতে ঢুকতে হলে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছনের দরজায় শুধু খিল দেওয়া আছে, তালা মারা নেই। একটা তার দরজায় ঢুকিয়ে দিয়ে, একটু উপরের দিকে টান মারলে খিল খুলে যাবে আর অতি সহজে বাড়িতে ঢোকা যাবে।”
পরিকল্পনা মতন রুদ্র আর রূপক, বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে আবার বেঁধে ফেলে। রুদ্র ওর বন্ধুদের ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে আসে। ওর বন্ধুরা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার। রুদ্র সংক্ষেপে সব ঘটনা বলে, দেবায়নের পরিকল্পনার কথা বলে। রুদ্রের বন্ধুরা, ওদের ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে দেবায়নের ওপরে রেগে যায়। ওদের মধ্যে রুদ্রের এক বন্ধু, দেবাশিস, সে একটা খাঁড়া হাতে নিয়ে এসেছিল। তার রাগ অগ্নিহোত্রীর ওপরে বেশি ছিল। সে বলে, অগ্নিহোত্রীকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, ওকে খুন করবে। দেবায়ন সবাইকে ঠাণ্ডা করে বলে ওর কাজ এখন শেষ হয়নি। পরে জানাবে ওর পরিকল্পনা।
ছেলেরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে রাতের ঘন অন্ধকারে, বিনয়ের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাত প্রায় তিনটে বাজে। তখন পর্যন্ত ধিমানের ফোন পায়নি। দেবায়ন একটু চিন্তিত, কি হল ওদের সাথে। কিন্তু গাড়িতে কারুর কাছে ফোন নেই যে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে কত দূর পৌঁছেছে। দলের সব থেকে আগে, দেবাশিস হাঁটে খাঁড়া নিয়ে হাঁটছে, মাঝখানে বাকি ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর মুখ হাত বেঁধে একরকম টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। রুদ্র, রূপক আর দেবায়ন দলের সব থেকে পেছনে।
রূপক আর থাকতে না পেরে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই মাদারচোদ শেষ পর্যন্ত টাকার জন্য ওদের ছেড়ে দিবি? তুই শালা আরো জাত শয়তান।”
দেবায়ন রূপকের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করে বলে, “আমি ছেড়ে দেব বলেছি। কিন্তু পায়েল তোর বান্ধবী, তুই ছেড়ে দিবি বা রুদ্র ছেড়ে দেবে, সেই কথা কি কেউ ওদের বলেছে?”
রুদ্র হেসে বলে, “তোর শালা শকুনের মাথা।”
রূপক বলে, “না রে। এই ছেলেটা না হলে অনেক কিছুই হত না। এর মাথা শকুনের নয়, এ শালা অনেক বুদ্ধি ধরে। যাই হোক, টাকা গুলোর কি হবে?”
দেবায়ন রুদ্রকে বলে, “দেখো, বিনয় আর অগ্নিহোত্রী পায়েলকে ধরে রেখেছে। আইনের চোখে ওদের এমন কিছু বড় সাজা হবে না। ওদের সাজা আমরাই দেব। কাছেই গঙ্গা তাই ত?”
রুদ্র মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
দেবায়ন বলে, “ওর পাশে নিশ্চয় পুরনো কোন কারখানা থাকবে। যেমন ইট ভাটা অথবা লোহার কারখানা অথবা পাটের কারখানা?”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে জানায়, গঙ্গার পাড়ে বেশ কয়েকটা খালি পুরনো কারখানা আছে। সেখানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
দেবায়ন পরবর্তী পরিকল্পনা জানায়, “ওই দুইজনকে ওইখানে নিয়ে গিয়ে দুই জনের হাতে ছুরি দিয়ে বলা হবে পরস্পরকে খুন কর। যদি ওরা পরস্পরকে খুন না করে তাহলে ওদের গলায় পাথর বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে ব্যারাকপুর। ওইখানে ওদেরকে গঙ্গায় ডুবিয়ে দেব আর টাকা ডুবিয়ে দেব। আর যদি এখানে খুন করে তাহলে সব টাকা জ্বালিয়ে দেব সেখানে। কেউ যদি দেখে তাহলে এই ভাববে, যে টাকার জন্য একে অপরকে খুন করেছে। সকালে এক বাড়ির লোক জেগে দেখবে যে পায়েলের বাবা খুন হয়েছে। অন্য বাড়ি জেগে দেখবে যে পাঁচ লাখ টাকা চুরি গেছে। বাড়ির দুই ছেলেই নেই, পুলিস আসবে। ছেলেদের খোঁজ করা হবে। খুঁজে পাবে গঙ্গার ধারে দুটি লাশ আর পোড়া টাকা। অগ্নিহোত্রীর মোবাইলে পেয়ে যাবে পায়েলের বাবাকে কি ভাবে খুন করা হয়েছে। কেমন লাগলো আমার পরিকল্পনা?”
রূপক, দেবায়ন কে জড়িয়ে ধরে বলে, “গুরু, তোর পোঁদ মেরে একদিন তোকে সুখ দেব বাঞ্চোত।”
দেবায়ন বলে, “সমস্যা এখানেই শেষ নয় গুরু। পায়েলের বাবার খুন হবার পরে, পায়েলের পিসি পায়েলকে খুঁজতে কোলকাতা আসবে। এইখানে ততক্ষণে পুলিস কেস হয়ে যাবে। পায়েলের বাবা নিশ্চয় পায়েলের পিসিকে অনুপমা আর অঙ্কনের কথা বলেছে। সুতরাং পুলিস পায়েলের খোঁজে অনুপমার বাড়িতে আসতে পারে। সুতরাং পায়েলকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। শেষ সম্বল আমাদের এই রেকর্ড করা ভিডিও। পায়েল কে নিয়ে আর টানাটানি নয়। ওর পিসিকে বলব যে পায়েলের ধারে কাছে আসলে এই ভিডিও পুলিসের হাতে তুলে দেব। পায়েলের জীবনে কেউ আর বাধা হয়ে আসবে না।”
কল্যাণী হাইওয়ের কাছে আসতেই রুদ্রের ফোন বেজে ওঠে। ওপাশে পরাশরের গলা পেয়ে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার।
পরাশর বলে, “হ্যাঁ সব ঠিক আছে। আমি ওদের পেয়ে গেছি। পায়েলকে আব্বাজান একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে গেছে। স্যালাইন চলছে। অবস্থা একটু সঙ্গিন তবে বেঁচে যাবে।”
পরাশরের কথা শুনে দেবায়নার রূপকের মনে শান্তি হয়।
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “অনু কোথায়?”
পরাশর, “অনুপমা পায়েলের পাশে বসে। কিছুতেই বেডের পাশ থেকে ওঠানো যাচ্ছে না। তোর মা, মানে কাকিমা ফোন করে করে হয়রান। আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম যে সব ঠিক আছে, তাও কাকিমা জেদ করে। শেষ পর্যন্ত কাকিমাকে নারসিং হোমে নিয়ে আসতে হল। কাকিমাকে পেয়ে অনুপমা এখন একটু ঠিক আছে। অঙ্কন বেশ ভেঙ্গে পড়েছে।”
পরাশর তারপরে গলা নিচু করে বলে, “শালা কেস খেয়ে গেছি।”
দেবায়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাল, কি করেছিস তুই?”
পরাশর, “শালা এত রাতে বাড়ি থেকে বার হওয়াতে বাবা মায়ের সন্দেহ হয়। জিজ্ঞেস করে কারন, আমি আমতা আমতা করি। ততক্ষণে কাকা চলে আসে। কাকা চেপে ধরে আমাকে।”
পরাশরের হাত থেকে ফোন নিয়ে ওর কাকা, ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন বলে, “শোনো দেবায়ন, এমন কিছু করবে না যাতে তোমরা মুশকিলে পরো। তুমি ওদের ধরে থাক, আমি এক ঘন্টার মধ্যে ফোর্স নিয়ে পৌঁছে যাবো। আমি ধিমান আর ঋতুপর্ণার মুখ থেকে সব ঘটনা শুনেছি, পায়েলেকে দেখেছি। তুমি চিন্তা করো না, এটা পুলিস কেস। এখান থেকে পুলিস কে হ্যান্ডেল করতে দাও।”
দেবায়ন চিবিয়ে বলে, “এতদিন পায়েল যখন বেপাত্তা ছিল তখন পুলিস কিছু করেনি। পুলিসের কাছে গেলে পায়েলের কিছুই হত না। সুজাতা কাকিমা আজ বেঁচে থাকতেন আর পায়েলের এই দুর্দশা হত না। সব শেষ হয়ে যাবার পরে পুলিস কি করবে? আমি পুলিস চাই না, এইখানে এদের খুন করব আমি। আপনার যা করার আছে করে নিন।”
নিরঞ্জন বাবু কড়া কণ্ঠে ধমকে বলেন, “কিছু করবে না। আমি নৈহাটি থানার ওসিকে ফোন করে দিয়েছি, ওরা এতক্ষণে বিনয়ের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তোমরা এক পা এগোলে তোমাদের ধরবে। তোমরা কোথায় আছো সেটা বল?”
দেবায়ন আসেপাশের সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিয়ে পরাশরের কাকাকে বলে, “কেন বলব আমরা কোথায় আছি? আমরা অনুপমার বাড়িতে আড্ডা মারছি। কোন প্রমান আছে আপনার কাছে যে আমরা নৈহাটিতে? আমি জানি আপনার কাছে কোন প্রমান নেই। বাড়ির সবাই এক কথায় বলবে যে আমরা অনুপমার বাড়িতে আড্ডা মারছি। আমাদের আলিবাই আছে, আপনার পুলিস আমাদের চুলের ডগা ধরতে পারবে না। কয়জনকে ধরবেন আপনি?”
ইন্সপেটর নিরঞ্জন আহত কণ্ঠে বলেন, “আমি জানি, তোমার বিরুদ্ধে কোন প্রমান আমি পাবো না তবে তুমি কেন একজনের রক্তে নিজের হাত নোংরা করতে চাও। আমি আসছি ওইখানে, তোমার যেখানে আছো সেখানে দয়া করে দাঁড়িয়ে থাক। আমি এসে সব ঠিক করে দেব।”
দেবায়ন কিছুতেই মানতে নারাজ, চিবিয়ে চিবিয়ে পরাশরের কাকুকে বলে, “পায়েলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? কি করে বলেন এর পরে যে এদের আমি ছেড়ে দেব? আমি পায়েলের বাবাকে পর্যন্ত খুন করব। সুজাতা কাকিমার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠাবো ওকে আর এই বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে।”
ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন আহত কণ্ঠে বলে, “তুমি কিছুতেই শুনবে না তাহলে?”
দেবায়ন চাপা গর্জন করে ওঠে, “আপনার একটা ছোটো মেয়ে আছে তাই না? একবার ভেবে দেখুন এই অত্যাচার আপনার মেয়ের সাথে হয়েছে? কি করতেন আপনি? পুলিসের অপেক্ষা করতেন, না পাপীদের শাস্তি দিতেন?”
দেবায়ন মানতে নারাজ কিছুতেই, মাথায় রক্ত চড়ে যায় পুলিসের কথা শুনে। অগ্নিহোত্রীকে এক লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে গলার উপরে পা বসিয়ে দিয়ে ফোনে গর্জন করে ওঠে, “আপনার পুলিসকে বলবেন বড় রাস্তার ধারে দুটি লাশ পরে আছে, যেন তুলে নিয়ে যায়। পায়েলের বাবাকে মারতে পারলাম না বলে দুঃখ হচ্ছে তবে যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাবে সেদিন খুন করব আমি। তার জন্য যদি আমাকে চোদ্দ বছর অপেক্ষা করতে হয় রাজি আছি।”
অগত্যা নিরঞ্জন বাবু কিছুতেই দেবায়নকে শান্ত করতে পারে না। পুলিসের হস্তখেপের খবরে দেবায়নের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ফোন রূপককে ধরিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে দেয় বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে। বিনয়ের নাক ফেটে রক্ত বের হয় আর অগ্নিহোত্রী দেবায়নের লাথি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। দেবায়নের রুদ্র মূর্তি দেখে দেবাশিস, রুদ্র আর বাকি ছেলেরা ঘাবড়ে যায়। ওরা খুনের মতলব করে আসেনি। ওরা ভেবেছিল এই সব কান্ডের পরে ছেলেগুলোকে পুলিসের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু দেবায়ন তখন কারুর কথা শোনার মতন অবস্থায় নেই। দেবাশিস আর রুদ্র জড়িয়ে ধরে দেবায়নকে। রাগে ক্ষোভে দুঃখে দেবায়নের শরীরে শত অসুরের শক্তি ভর করে।
দেবায়ন চাপা গর্জন করে ওঠে, “পুলিস আসার আগে তোদের মেরেই ফেলব। শালা, শুয়োরের বাচ্চা, তোদের বাঁচিয়ে রাখলে আমি কোনদিন পায়েলের সামনে দাঁড়াতে পারবো না।”
নিরঞ্জন বাবুর সাথে রূপকের কথা হয়। রূপক, দেবাশিস আর রুদ্রকে নির্দেশ দেয় যে দেবায়নকে ওইখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। দেবাশিস কোনোরকমে দেবায়নকে টেনে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। রূপক কিছু পরে ওর কাছে এসে বলে যে দেবায়নের মা একবার দেবায়নের সাথে কথা বলতে চায়।
দেবশ্রী ফোন ধরে বলে, “বাবা, আমার কথা একবার শোন মন দিয়ে। নিরঞ্জন বাবু যাচ্ছেন যখন তখন আর এই সব উলটোপালটা কাজ করিস না। উনি বলেছেন যে উনি সব দেখে নেবেন, কি করতে হয় বিচার করে করবেন। নিরঞ্জন বাবু বিচক্ষণ ব্যাক্তি, ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর, পরাশরের কাকু, একবার অন্তত তাঁর কথা শুনে দ্যাখ।”
দেবায়নের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পায়েলের অর্ধনগ্ন ক্ষত বিক্ষত দেহ। কানে বাজে অঙ্কনের কাতর আর্তনাদ, “মিষ্টি, আমি এসে গেছি সোনা। একবার চোখ খোলো।”
প্রেয়সী অনুপমার চোখের জল, “তুমি শুধু আমার কাছে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আস।”
ঋতুপর্ণার ডাক, “এরা যেন কালকের সূর্য না দেখতে পায়।”
দেবায়ন মাকে বলে, “পরাশর ওর কাকাকে বলেছিল পায়েলের কথা। তখন কোথায় ছিল ওর কাকা? কার পেছনে পুলিসের রুল ঢুকাচ্ছিল? ওর কাকা যা পারবে করে নিক আমার। আমাকে পুলিস দেখাতে যেও না, আমি আজকে এদের খুন করবই।”
দেবশ্রী ছেলেকে ধমক দেয়, “পায়েল ফিরে এসেছে, পায়েলের সাথে রেপ হয়নি। ওর মায়ের জন্য সত্যি খারাপ লাগছে। কিন্তু তুই কিছু করবি না। ওদের যা করার আইন করবে, এই আমার শেষ কথা।”
রুদ্র বেগতিক দেখে, দেবাশিস আর বাকি বন্ধুদের বলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে মাঠের দিকে চলে যেতে। রূপক আর রুদ্র ক্ষুব্ধ, রুদ্ররুপী দেবায়নের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋজু দেবায়ন শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে, অন্ধকার মাঠের মধ্যে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে পায়েলের জন্য। এক ভালো বান্ধবীর এই সর্বনাশের প্রতিশোধ নিতে পারল না। সময় চলে যায়, দুরে মাঠের মধ্যে ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তার পাশে দেবায়ন বসে। রূপক আর রুদ্র নিরুত্তর হয়ে চুপচাপ বসে থাকে নিরঞ্জন বাবুর অপেক্ষায়।
বিংশ পর্ব (#10)
রুদ্র বেগতিক দেখে, দেবাশিস আর বাকি বন্ধুদের বলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে মাঠের দিকে চলে যেতে। রূপক আর রুদ্র ক্ষুধ, রুদ্ররুপী দেবায়নের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋজু দেবায়ন শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে, অন্ধকার মাঠের মধ্যে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে পায়েলের জন্য। এক ভালো বান্ধবীর এই সর্বনাশের প্রতিশোধ নিতে পারল না। সময় চলে যায়, দুরে মাঠের মধ্যে ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তার পাশে দেবায়ন বসে। রূপক আর রুদ্র নিরুত্তর হয়ে চুপচাপ বসে থাকে নিরঞ্জন বাবুর অপেক্ষায়।
সময়ের কেটে যায় বন্যার জলের মতন, সবাই নিস্তব্ধ। দুরে দুটি জিপ, লাল আলো জ্বালিয়ে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসে। রূপক রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতে থাকে। দুটি জিপ ওদের দেখে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিস গাড়ি থেকে নেমে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়। নিরঞ্জন বাবু এগিয়ে এসে রূপককে জিজ্ঞেস করে দেবায়নের কথা। দেবায়ন মাথা নিচু করে রাস্তার পাশে, মাটিতে বসে।
নিরঞ্জন বাবু কাছে এসে দেবায়নের কাঁধে হাত রাখে। দেবায়ন জল ভরা ক্লান্ত চোখে নিরঞ্জন বাবুর দিকে তাকায়। সেই চোখের চাহনি দেখে নিরঞ্জন বাবু বুঝতে পারে যে দেবায়ন ফোনে যা বলেছিল এক বিন্দু বানিয়ে বলেনি, নিজের মনের কথাই বলেছিল। রুদ্র মাঠের মাঝে ওর বন্ধুদের দেখিয়ে বলে যে ওই খানে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ধরে রাখা হয়েছে।
নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে আসস্থ করে বলে, “দেখো দেবায়ন, এইখানে পুলিসের হাত পা বাধা ছিল। কোন কমপ্লেন ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না। ওর বাবা মা কেউ কমপ্লেন করেনি। ছেলে মেয়েদের উপরে বাবা মায়ের অধিকার বেশি। কি করতে পারে আইন? আইন কানুন যে অন্ধ দেবায়ন।”
দেবায়ন চিবিয়ে বলে, “সর্বনাশ হয়ে যাবার পরে আইনের চোখ খোলে? রেপিস্টদের ধরে ধরে সবার সামনে ফাসি দেওয়ায় উচিত, তাহলে দেখবেন যে দেশে রেপ কমে যাবে, মেয়েদের ওপরে যে অত্যাচার হয় সব কমে যাবে। আর সুজাতা কাকিমা? তাঁর আত্মার কি হবে? আপনি পায়েলকে দেখেছেন? কথা বলেছে আপনার সাথে? কি বলেছে শুনি একবার?”
নিরঞ্জন বাবু চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। পায়েলকে দেখে তাঁর মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল, শরীরে শুধু হাড় ছাড়া কিছু বেঁচে নেই পায়েলের, কথা বলার শক্তি নেই পায়েলের। ততক্ষণে পুলিস টিমের বাকিরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে ধরে জিপের কাছে নিয়ে আসে। নিরঞ্জন বাবু রেডিওতে খবর নিয়ে জেনে নেন যে বিনয়দের বাড়ি থেকে পায়েলের বাবা আর বিনয়ের মাকে গ্রেফতার করেছে নৈহাটি পুলিস। ওইখানে খুব হইচই চলছে। বিনয়ের বাবা আর সমীর বাবু লোকজন জড় করে পুলিসকে বাধা দিচ্ছে। নিরঞ্জন বাবু সঙ্গে সঙ্গে ব্যারাকপুরে কথা বলে পুলিস ফোর্সের ব্যাবস্থা করেন। বুঝে যান যে, অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকলে চলবে না। একটা গাড়িতে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে তুলে দিয়ে ওইখানে অপেক্ষা করতে বলে। অন্য একটা গাড়িতে, রুদ্র রূপক আর দেবায়নকে নিয়ে নিরঞ্জন বাবু, মীরা বাগানের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথে যেতে যেতে, রূপকের কাছে সব ঘটনা জানতে চান। রূপক, দেবায়নের মোবাইলে তোলা ভিডিও নিরঞ্জন বাবুকে দেখায়। ভিডিও দেখে নিরঞ্জন বাবু স্তব্ধ হয়ে যায়, চোয়াল বারেবারে শক্ত হয়ে আসে। মীরা বাগানে ঢুকতেই ওদের বেশ বেগ পেতে হয়। রাত চারটে বাজে, কিন্তু প্রায় সারা মীরা বাগান জেগে উঠেছে। পুলিস হিমসিম খাচ্ছে লোকজন সামলাতে। নৈহাটি থানার ওসি, নিরঞ্জন বাবুদের গাড়ি দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন। নৈহাটি থানার ওসি বলেন যে, ডক্টর কমলেশ আর তাঁর দিদিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু কেউ মানতে চাইছে না।
নিরঞ্জন বাবু গাড়ি থেকে নেমে, পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসিকে দেখে। সমীর বাবু আর বিনয়ের বাবা এগিয়ে এসে নিরঞ্জন বাবুকে বলেন যে এরা নির্দোষ। দেবায়ন গাড়ি থেকে নামতে চায় কিন্তু বাকিরা ওকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে দেয়। নিরঞ্জন বাবু ওদের বলে যে, সমীর বাবুর ছেলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয় ধরা পড়েছে পুলিসের কাছে। ওরা সব কবুল করেছে এবং তার প্রমান আছে নিরঞ্জন বাবুর কাছে। নিরঞ্জন বাবু ওদের কে দেবায়নের মোবাইলে তোলা ভিডিও দেখিয়ে বলে যে এরপরে যা কিছু বলার, থানায় গিয়ে বলতে পারে। নিরঞ্জন বাবুর কথা শুনে আর ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে লোকেরা। পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি ভেঙ্গে পরে তখন। নিরঞ্জন বাবু, নৈহাটি থানার ওসিকে নির্দেশ দেন যে এটা ক্রাইম ব্রাঞ্চের কেস, সুতরাং এদের লাল বাজারে নিয়ে যেতে হবে। পুলিসের একটা জিপে, পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসিকে নিয়ে পুলিস কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রুদ্রকে নামিয়ে দেওয়া হয় ওর বাড়িতে। সঙ্গীতা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দাদাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে। দেবায়ন আর রূপকের সাথে দেখা করে সঙ্গীতা। নিরঞ্জন বাবু সঙ্গীতাকে জিজ্ঞেস করে যদি ওদের সাথে কোলকাতা ফিরতে চায় তাহলে বাড়ি পৌঁছে দেবে, সঙ্গীতাকে। রুদ্র জানিয়ে দেয় যে ওর বোনকে পরের দিন কোলকাতা পৌঁছে দেবে।
নিরঞ্জন বাবু গাড়িতে উঠে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “এবারে একটু শান্ত হবে? সবাই গ্রেফতার হয়ে গেছে। ওদের বিরুদ্ধে সব সাক্ষ্য প্রমান আমাদের কাছে আছে। পায়েলের বাবার যাতে যাবজ্জীবন হয় সেই মতন চার্জসিট ফাইল করা হবে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ছেড়ে দেবেন? কত বছর জেল হয় একটা মেয়েকে এমন ভাবে ধরে রেখে কষ্ট দিলে? আপনার আইন কি বলে?”
নিরঞ্জন বাবু গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। দেবায়ন রাগে গজগজ করতে থাকে, রূপক চুপচাপ পাশে বসে থাকে। দেবায়নের চোখে মুখে হেরে যাওয়ার ছাপ পরিষ্কার ফুটে ওঠে।
রূপক ওকে বলে, “দ্যাখ ভাই, পায়েলকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি এটা বড় কথা নয় কি? তুই কেন তোর হাত কারুর খুনে নোংরা করতে চাস। একবার নিরঞ্জন কাকুর কথা মেনে দ্যাখ, আমার মন বলছে যা হবে ঠিক হবে। পায়েলের বাবা গ্রেফতার হয়েছে, আইন তাকে উচিত সাজা দেবে। আইন আমাদের হাতে তুলে নেওয়া একদম উচিত নয়। একটু বুঝতে চেষ্টা কর। আমাদের সামনে অনেক বড় একটা জীবন পরে আছে, কেন ফালতু ফালতু পুলিসের খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে বদনাম নিতে চাস তুই? একবার ভেবে দ্যাখ, সায়ন্তন কাকুর কথা। তুই কি ভাবছিস, কাকুর আত্মা শান্তি পাবে কোনদিন? কাকিমার কথা ভাব, তোর নাম পুলিসের খাতায় উঠলে সারা জীবন একটা খুনের অপবাদ তোর সাথে থেকে যাবে।”
দেবায়ন চুপ করে শুনে যায় রূপকের কথা। বিচার করার শক্তি লোপ পেয়েছে দেবায়নের, তাও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে চুপচাপ থাকবে। গাড়ি বড় রাস্তায় দাঁড় করায় নিরঞ্জন বাবু। সামনের গাড়িতে, অগ্নিহোত্রী আর বিনয় বসে। পেছনে পুলিসের দুটো জিপ, একটাতে বিনয়ের মা আর পায়েলের বাবা। নিরঞ্জন বাবু পেছনের পুলিসদের নির্দেশ দেয় যে সোজা লাল বাজারে নিয়ে চলে যেতে। বিনয়ের মা আর পায়েলের বাবাকে নিয়ে রওনা দেয় পুলিসের জিপ। নিরঞ্জন বাবু অন্য জিপ থেকে একজন ইন্সপেক্টর কে ডেকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করেন। পাশের ইন্সপেক্টর একটা রিভলভার নিরঞ্জন বাবুকে দেয়। নিরঞ্জন বাবু আবার চুপচাপ গাড়িতে বসে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দেয়। গাড়ি আবার কল্যাণী হাইওয়ে ধরে কোলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
দুই পাশে ফাঁকা মাঠ, রাতের অন্ধকার কেটে দুটি গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। ব্যারাকপুর পেরিয়ে যাবার কিছুপরে নিরঞ্জন বাবু গাড়ি দাঁড় করাতে নির্দেশ দেয়। রূপক আর দেবায়নকে নিরঞ্জন বাবু গাড়ি থেকে নামতে অনুরোধ করেন। রূপক আর দেবায়ন, গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।
নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে বলে, “আইন ওদের শাস্তি দেবে আমি জানি।”
দেবায়ন আর রূপকের কাঁধে হাত রেখে বলে, “পায়েলকে আমি দেখেছি। অঙ্কনের কান্না আমি দেখেছি। পরাশর আমাকে আগেই বলেছিল এই সব কিন্তু আইনের হাত পা বাধা ছিল সেই সময়ে। আইন পুলিস তখন নিরুপায় ছিল, কিছু করার ছিল না আমাদের। পায়েলের আগের জীবন আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো না, দেবায়ন আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
নিরঞ্জন বাবু, অন্য ইন্সপেক্টরকে বলেন, “ওই দুটো কে নিয়ে মাঠের মধ্যে যাও, আর দৌড়াতে বল।”
ইন্সপেক্টর বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর হাতকড়া খুলে মাঠের মধ্যে দৌড়াতে বলে, বলে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিনয় আর অগ্নিহোত্রী দাঁড়িয়ে থাকে, পা নিঃসাড় হয়ে আসে ওদের। নিরঞ্জন বাবু গর্জে ওঠে, “যা পালা, কত জোরে পালাতে পারিস পালা। তোদের ছেড়ে দিলাম। তোদের বিরুদ্ধে এমন কিছু প্রমান নেই আমার কাছে, যা বলেছিস সব পায়েলের বাবার বিরুদ্ধে। তোদের ধরে নিয়ে গিয়ে কিছু করার নেই।”
অগ্নিহোত্রীকে বলে, “তোর বাবা সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। হাবড়ার দিকে একটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই মাঠ ধরে দৌড়াতে থাক।”
অগ্নিহোত্রী আর বিনয়, এক বার পরস্পরের দিকে তাকায়। নিরঞ্জন বাবু আবার বলেন, “তোর বাবা আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে তোদের ছেড়ে দেবার জন্য।”
একটু থেমে ম্লান হেসে বলেন, “কি করতে পারি বল, সমীর বাবুর কথা রাখতে হয় যে।”
হতভম্ব হয়ে দেবায়ন চেঁচিয়ে ওঠে নিরঞ্জন বাবুর দিকে, “কি করলেন আপনি? শালা পুলিস কে একদম বিশ্বাস করতে নেই।”
বিনয় আর অগ্নিহোত্রী, পাঁচ লাখ টাকার কথা শুনে নিরঞ্জন বাবুর কথা বিশ্বাস করে নেয়। মাঠে নেমে প্রানপন দৌড়াতে শুরু করে দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের একপাশে একটা জঙ্গলের দিকে যায় অগ্নিহোত্রী আর বিনয়। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দুই খানা রিভলভার গর্জে ওঠে, দুম দুম দুম দুম দুম দুম... পর পর বেশ কয়েকটা গুলি। নিরঞ্জন বাবু আর অন্য ইন্সপেক্টর একসাথে গুলি চালায় অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের দিকে। দেবায়ন আর রূপক পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। বাকি পুলিসেরা দৌড়ে যায় বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর দিকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না ওরা মরেছে না বেঁচে আছে। আরও দুটো গুলির আওয়াজ শুনতে পায় দেবায়ন। তারপরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে হাইওয়েতে। দুরে কয়েকটা লরি দেখা যাচ্ছিল। তারা দুরেই দাঁড়িয়ে পরে পুলিসের লাল বাতি দেখে। নিরঞ্জন বাবু দেবায়নের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে রেডিওতে খবর দেয় এম্বুলেন্স পাঠাতে। খবরে বলেন দুই কিডন্যাপিং কেসের আসামি পালাতে গিয়ে পুলিসের গুলিতে মারা গেছে তাদের লাশ পরে আছে ব্যারাকপুরের কাছে একটা জঙ্গলে।
ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে বলে, “আমার মেয়ের সাথে এই রকম হলে আমি কারুর অপেক্ষা করতাম না। নিজে হাতে সব কটাকে গুলি করে মারতাম। সুজাতাদির আত্মার আর পায়েলের মুক কান্নার জন্য করেছি। এরা তোমাদের নার্সিং হোমে পৌঁছে দেবে। দুপুরে আমি আসব, তখন সব বুঝিয়ে বলে দেব।”
বাকি পুলিস দল আসার আগেই অন্য গাড়িতে করে দেবায়ন আর রূপককে কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয় নিরঞ্জন বাবু। কোলকাতা পৌঁছাতে ওদের সকাল হয়ে যায়। গাড়ি সোজা ডক্টর মিসবাহুলের নার্সিং হোমের সামনে নামিয়ে দেয় ওদের।
নামিয়ে দেবার আগে একজন ইন্সপেক্টর ওদের বলে, “তোমরা একটা কথা মনে রাখবে। তোমরা কিছু দেখো নি তোমরা কিছু জানো না। তোমরা খবর পেয়ে পায়েল কে বাঁচাতে গেছিলে। পায়েলকে বাঁচিয়ে তোমরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে ধরে রেখেছিলে আর পুলিসকে খবর দিয়েছিলে। বিনয়ের কথা মতন, ওর মাকে আর মামাকে গ্রেফতার করে পুলিস। তারপরে তোমাদের নিয়ে আমরা চলে আসি।”
রূপক আর দেবায়ন মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় ওরা সব বুঝে গেছে।
নার্সিং হোমে ঢুকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে। দেবায়নের মা, মিস্টার সেন, অনুপমা, শ্রেয়া, পরাশর, জারিনা আর ধিমান। শ্রেয়া দৌড়ে এসে রূপকের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে নৈহাটির ঘটনা। রূপক সংক্ষেপে সবাইকে নৈহাটির কথা জানায়, সেই সাথে জানায় যে পায়েলের বাবা আর পিসিকে পরাশরের কাকু গ্রেফতার করেছে। ওদের বিরুদ্ধে সুজাতা কাকিমাকে খুনের মামলা চলবে। রূপক পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করে। ঋতুপর্ণা, আই.সি.ইউ বেড়িয়ে এসে জানায় যে পায়েল এই যাত্রায় বেঁচে যাবে। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত ওর মানসিক অবস্থা বলা কঠিন। দেবায়ন অনুপমাকে অঙ্কনের কথা জিজ্ঞেস করে। অনুপমা জানায় যে ভাই পায়েলের পাশেই বসে, ওকে ওইখান থেকে নড়ানো যাচ্ছে না একদম। সবাই চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু ভাই বলেছে যে যতক্ষণ না পায়েল চোখ খুলবে ততক্ষণ ও ওর পাশে বসে থাকবে।
বারো ঘণ্টা পরে পায়েল চোখ খোলে। পারমিতা সকালেই নার্সিং হোমে চলে এসেছিল। অঙ্কন সারা সময়ে পায়েলের পাশেই বসে ছিল। সেদিনের রাতে বন্দুকের গুলিতে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর মৃত্যু হয় সেই কথা শুধু মাত্র দেবায়ন আর রূপক জানে। ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন, ডক্টর মিসবাহুলের কাছে পায়েলের মানসিক অবস্থার কথা জানতে চায়। ডক্টর মিসবাহুল জানান যে পায়েলের মানসিক অবস্থা খুব সঙ্গিন, স্টেটমেন্ট দেবার মতন অবস্থায় পৌঁছায়নি তখন। নিরঞ্জন বাবু চিন্তায় পরে যান, চার্জশীট ফাইল করতে হলে পায়েলের স্টেট্মেন্টের খুব দরকার।
নিরঞ্জন বাবু, দেবায়ন ধিমান আর রূপককে থানায় ডাকেন। নিরঞ্জন বাবু এবং বাকি পুলিসের সামনে দেবায়ন আর রূপক সব কথা জানায়। মোবাইলের ভিডিও এবং রূপক আর দেবায়নের কথা মতন স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয়। পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি, ক্রাইম ব্রাঞ্চের কাছে সব কথা স্বীকার করে সেই মতন চার্জসিট তৈরি হয়। নিরঞ্জন বাবু সবাইকে নিয়ে পায়েলের বাড়িতে যায়। দরজার তালা ভেঙ্গে ঢুকে বাথরুমের জরিপ করে। পায়েলের বাবা দেখিয়ে দেয় যেখানে পায়েলকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। একতলার চেম্বারের পেছনে একটা ছোটো বাথরুম, বাথরুমের অবস্থা দেখে বোঝা যায় ওইখানে বিশেষ কারুর যাতায়াত নেই। প্রমান স্বরুপ সেখানে একটা দড়ি আর একটা গ্লাস পাওয়া যায়। তারপরে উপরে সুজাতা কাকিমার ঘরে ঢুকে তদারকি করে বাকি তথ্য প্রমান যোগাড় করে নিয়ে চলে যায় পুলিস। পুলিস ইতিমধ্যে পায়েলের মামা বাড়িতে খবর দেয়। পায়েলের মামা মামী এবং মামাতো দাদা নার্সিং হোমে পৌঁছে যান।
ডক্টর মিসবাহুল পায়েলের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। পায়েল একটু সুস্থ হওয়ার পরে নিরঞ্জন বাবুকে খবর দেওয়া হয়। নিরঞ্জন বাবু নার্সিং হোমে চলে আসেন পায়েলের স্টেটমেন্ট নিতে। পায়েল ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে, কারুর মুখে কোন কথা নেই সবাই পরস্পরের মুখ চাওচায়ি করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
পায়েল বড় বড় ক্লান্ত চোখে জিজ্ঞেস করে, “মা কোথায়?”
পারমিতা, পায়েলের পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই ভালো হয়ে যা, তারপরে সব কথা বলব।”
পায়েল, পারমিতার কোল ঘেঁষে জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বল, আমার মা কোথায়?”
পারমিতা, দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেবশ্রীদিকে একবার ডাকলে বড় ভালো হত।”
অনুপমা ওর মামনিকে ফোন করে। দেবায়নের মা অফিস থেকে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে নার্সিং হোমে চলে আসে। পায়েল দেবায়নের মাকে আগে কোনদিন দেখেনি। অনুপমা পরিচয় করিয়ে দেয় দেবায়নের মায়ের সাথে। নিরঞ্জন বাবু দেবায়নের মাকে ডেকে বলেন যে ওর স্টেটমেন্ট নেওয়া দরকার।
দেবশ্রী, পায়েলের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “তোমার শরীর কেমন আছে এখন?”
পায়েল মাথা নাড়ায়, আগের থেকে একটু ভালো। দেবশ্রী ধিরে ধিরে পায়েলের কাছে সব কিছু জানতে চায়। পায়েল অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে থাকে জল ভরা চোখে। অঙ্কন ওকে সাহস দিয়ে সব কিছু বলতে বলে। পায়েল এক এক করে সব কথা দেবশ্রীকে জানায়। পায়েলের বেদনা ভরা কাহিনী শুনে সবাই স্থম্ভিত হয়ে যায়। জন্মদাতা পিতা এত নিষ্ঠুর হতে পারে, সেটা ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পিঠে বেল্টের কালসিটে দাগ দেখায়, কব্জিতে দড়ির দাগ। দিনে একটা রুটি আর এক গ্লাস জল ছাড়া কিছু খেতে দেওয়া হয়নি ওকে। ওর বাবা বলেছিল যেদিন অঙ্কনের চিন্তা ছেড়ে দেবে সেদিন ওকে বাথরুম থেকে মুক্তি দেবে। পায়েল জানত ওর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে তাই জেদ ধরে বসে ছিল। অঙ্কনের চোখে জল চলে আসে সেই সব কথা শুনতে শুনতে। নিরঞ্জন বাবুর চোয়াল রাগে শক্ত হয়ে ওঠে, তিনি জানিয়ে দেন যে একটা স্টেটমেন্ট তিনি পরে তৈরি করে নিয়ে আসবেন সেখানে পায়েলের সই দিয়ে দিলে হয়ে যাবে। পায়েল বারেবারে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। দেবায়নের মা শেষ পর্যন্ত পায়েলের মায়ের মৃত্যুর কথা জানায়। পায়েল ডুকরে কেঁদে ওঠে তারপরে অজ্ঞান হয়ে যায়।
জ্ঞান ফেরার পরে পায়েল মামা, মামীর দিকে তাকিয়ে থাকে নিরুপায় হয়ে। পায়েলের অবস্থা দেখে ওর মামা ওকে তার সাথে নিয়ে যেতে চান। অনুপমা আর শ্রেয়া, পায়েলকে তার আত্মীয় সজ্জনের সাথে ছাড়তে নারাজ। নিজের বাবা আর নিজের পিসি যদি ওর সাথে এমন অত্যাচার করতে পারে তাহলে বাকিরা কেন পারবে না। অনুপমা আর শ্রেয়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। ওর মামা বলেন যে নিকট আত্মীয় হিসাবে পায়েলের ওপরে তার অধিকার আছে। নিরঞ্জন বাবু অবস্থার সামাল দেবার জন্য বলেন যে পায়েল, সাবালিকা হয়ে গেছে। পায়েলের মতামত ছাড়া কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারে না। সবার চাপে পড়ে ওর মামা বিরক্ত হয়ে বলেন যে তারা পায়েলের দায়িত্ব গ্রহন করতে চায় না ভবিষ্যতে।
কলেজ শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন কেউ না কেউ পায়েলের সাথে নার্সিং হোমে থাকে। কোনদিন অনুপমা, কোনদিন সঙ্গীতা, কোনদিন শ্রেয়া। পায়েলকে ফিরে পেয়ে সবাই বেশ খুশি। পায়েল মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পড়ে। বারেবারে মায়ের কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যেত। ডক্টর খুব চিন্তায় পড়ে যায়। এইমত অবস্থায় পায়েলের দায়িত্ব গ্রহনের জন্য কে এগিয়ে আসবে সেই চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। সেই সময়ে পারমিতা বলে যে, পায়েলের সব দায়িত্ব গ্রহন করতে রাজি আছে। অনুপমা আর অঙ্কন খুব খুশি হয় মায়ের কথা শুনে। মিস্টার সেন স্ত্রীর আর কন্যের কথা মেনে নিয়ে পায়েলকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
অনুপমার রুমেই পায়েলের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। অনুপমাই ওর সব দেখাশনার ভার নেয়। রাতের পর রাত অনুপমা ওর জন্য জেগে কাটিয়ে দেয়। পায়েল শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও, কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছে। ওর মন মানতে চায় না যে ওর মা ইহলোকে আর নেই। রাতে ঘুম আসে না পায়েলের, ছোটো বাচ্চা যেমন থেকে থেকে মাকে খোঁজে, বিছানায় শুয়ে পায়েল মাকে খোঁজে। সারা রাত অনুপমা ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। অঙ্কন পায়েলের মানসিক অবস্থা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পরে। পায়েল শরীর ঠিক হলেও ওর মানসিক পরিবর্তন ঘটে। উচ্ছল, চঞ্চল পায়েল আর সেই মেয়ে নয়। পায়েল খুব চুপচাপ এবং স্তিমিত হয়ে যায়। পায়েল আর নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায় না, পারমিতা ওকে যেতে দিতে চায় না। জানে পায়েল নিজের বাড়িতে ফিরে গেলে ওর মায়ের কথা মনে পরে যাবে, একা অত বড় বাড়িতে থাকা অসম্ভব পায়েলের পক্ষে। পায়েলের বাড়িতে তালা বন্ধ, মাঝে মাঝে পায়েলের মামা ফোনে পায়েলের খবরাখবর নেয় তবে ধিরে ধিরে সেটাও কমে আসে।
******************* বিংশ পর্ব সমাপ্ত *******************
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment