আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
মহানগরের আলেয়া
Written By pinuram
Written By pinuram
সাত
সাহচর্যের হাত (#০১)
একরাতেই দানার দেহ মন ভেঙ্গে যায়, এই পৃথিবীতে আর বেঁচে থেকে কি লাভ? ছলনাময়ীর কথায় ভুলে কাগজের সিঁড়ি চড়ে নিজের ভালবাসাকে নিজে হাতে হত্যা করেছে। ইন্দ্রাণী ওকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না, সেই যোগ্যতা হারিয়েছে। এই মহানগর ওর কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, ওর মা, মনসা মাসি আর শেষ পর্যন্ত যাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিল, সেই ইন্দ্রাণী। এই মহানগর ওকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাগে যত টাকা ছিল সব ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেয়, বাড়িতে থাকলে ওই টাকা গুলো ওকে বারেবারে ছোবল মারছিল। পাপ কর্মে আয় করা টাকা নিজের ওপরে খরচ করার ইচ্ছে ছিল না, না এই কালী পাড়ার বস্তির কারুর জন্য। একবার ভেবেছিল অধির বাবুর কাছে গিয়ে আবার ট্যাক্সি চালাবে, কয়েকদিন ট্যাক্সি চালিয়েই মন ভরে গেল। ট্যাক্সি চালানোতে আর মন বসে না তাই রোজ রাতে মদনার চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকে আর রাত বাড়লেই চোলাই গিলে নিজের গুমটিতে ফিরে কাঁদতে বসে। রাতের ঘুম একপ্রকার চলেই গেছে বলতে গেলে চলে। ইন্দ্রাণীর জল ভরা চোখ আর ওই টাকা ছুঁড়ে মারা ওকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়।
মাঝে মাঝেই দানার কাছে নাসরিন অথবা কঙ্কনার ফোন আসে, কিন্তু দানা ফোন উঠাতে সাহস পায় না। যদি ওরা একবার জানতে পারে যে দানা এই শহরেই আছে, তাহলে হয়ত লোক লাগিয়ে ওকে মেরে ফেলবে, অথবা পুলিশে ধরিয়ে দেবে। শেষে একদিন দানা ওর ফোন নাম্বার বদলে ফেলে। ক্ষমতা থাকলে কঙ্কনা আর নাসরিনকে খুন করত, কিন্তু ওরা অনেক ধনী আর ক্ষমতাশালী, ওদের সাথে সম্মুখ সমরে পেরে উঠবে না দানা। আর যুদ্ধ করতে গেলে যদি ইন্দ্রাণী অথবা ওর ছেলে মেয়েকে আঘাত করে, তাহলে দানা মরেও শান্তি পাবে না।
এই সব ভাবনা চিন্তা করে একদিন ঠিক করে এই মহানগর ছেড়ে চলে যাবে। অন্য কোন শহরে কিংবা গ্রামে গিয়ে আবার নতুন করে নিজের জীবন শুরু করবে। সাতপাঁচ ভেবে একদিন নিজের ব্যাগ গুছিয়ে কালী পাড়ার বস্তি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অনির্দিষ্টের পথে পাড়ি দেয়। কোথায় যাবে জানে না, কি ভাবে যাবে জানে না, শুধু জানে এই মহানগর ছেড়ে ওকে চলে যেতে হবে। যাবার আগে শেষ বারের মতন গোল বাগানে যায়, ইন্দ্রাণীর ফ্লাটের নিচে দাঁড়িয়ে ওর খালি বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকে, যদি একবার শেষ বারের মতন ওর দেখা পায়। বারান্দার আলো নেভান, শোয়ার ঘরে আলো জ্বলছে কিন্তু ইন্দ্রাণীর দেখা আর পায় না।
হতাশ হয়ে ভাঙ্গা বুক আর নিজের ব্যাগ নিয়ে নদীর ওইপারের বড় রেল স্টেশানে পৌঁছায়। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, আশে পাশের লোক সবাই ব্যাস্ত, সবার একটা গন্তব্যস্থল আছে, শুধু দানার নেই। অনেকেই ট্রেন থেকে নামছে, অনেকের চোখে আশার আলো, এই মহানগর ওদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। অনেকের চোখে হতাশা, অনেকেই হয়ত ওর মতন সব কিছু খুইয়ে এই মহানগর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পেছনের লোক ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি দাদা কোথায় যাবেন?" দানা শুন্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, "জানি না কোথায় যাবো।" কিছু লোক ওর শুন্য চোখ দেখে অবাক হয়ে যায়, কেউ কেউ হেসে বলে, "পাগল নাকি?" দানা উল্টে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, "আপনি কোথায় যাচ্ছেন?" উত্তরে পেছনের লোক জানায়, "খয়রাসোল, সেখানে আমার বাড়ি। এই মহানগরে চাকরি করি। সপ্তাহের শেষে দুইদিনের ছুটি পাই, তাই বাড়ি ফিরছি।"
আচ্ছা, এইখানে যত লোক আছে সবার নিশ্চয় বাড়িতে কেউ আছে। সবার চেহারা দেখে মনে হল সবাই খুশি শুধু মাত্র দানা দুঃখী, নিঃস্ব। দানা কি ভেবে লাইন থেকে বেড়িয়ে এসে আবার এলোমেলো হাঁটতে শুরু করে দেয়। ট্রেনে যেতে হলে টিকিট কাটতে হবে সেটা ভুলে যায়। আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় দেখে যে রেল স্টেশান থেকে বেড়িয়ে এসেছে। মাথার ঠিক নেই, পাশের একটা চায়ের দোকানে বসে চা খায় আর শুন্য চোখে নদীর ওপারে ঝলমলে মহানগরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এমন সময়ে ওর কাঁধে একটা শক্ত হাতের চাপড় পরে। দানা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ওর পেছনে ফারহান দাঁড়িয়ে। ফারহান ওকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি রে ভাই, কোথাও যাচ্ছিস নাকি?"
দানা কাষ্ঠ হাসি টেনে বলে, "ভেবেছিলাম কোথাও একটা যাবো কিন্তু ঠিক করতে পারছি না কোথায় যাবো।"
ওর কথা শুনে ফারহানের সন্দেহ হয় তাই দানাকে পালটা জিজ্ঞেস করে, "মানে কি বলতে চাইছিস তুই? নিজেই জানিস না কোথায় যেতে চাস?" ওর ভাসা ভাসা চোখের দিকে তাকিয়ে ফারহান প্রশ্ন করে, "তোর কি শরীর খারাপ?"
দানা মাথা নাড়ায়, "না রে শরীর খারাপ নয়।" কিছুক্ষণ থেমে ম্লান হাসি দিয়ে বলে, "এই মহানগর আমার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে তাই আমি চলে যাচ্ছি এই শহর ছেড়ে।"
ফারহান ওর পাশে বসে ওর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে, হয়ত বুঝতে পেরেছে ওর অন্তরদ্বন্দ, "তোর কি হয়েছে একটু খুলে বলত আমাকে?"
দানা নিজের ভাঙ্গা পাঁজর অন্তত কারুর সামনে এই ভাবে মেলে ধরতে নারাজ। জীবনে তিনজনের সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে মেলে ধরেছিল, আজ সেই তিনজনের মধ্যে কেউই ওর পাশে নেই। মা আর মনসা মাসি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন আর নিজেই ইন্দ্রাণীর ভালোবাসাকে খুন করেছে। ফারহানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ম্লান হেসে গল্প বানিয়ে বলে, ট্যাক্সি চালাতে আর চায় না তাই ভাবছে অন্য কোন শহরে গিয়ে কোন কাজ করবে।
ফারহান খানিক্ষণ ভেবে ওকে বলে, "এই শহর ছেড়ে চলে কেন যাবি? এই মহানগরের বুকে অনেক কিছু করতে পারিস। আচ্ছা সেটা ছাড়, তুই আমার সাথে চল। একজনের কাছে নিয়ে যাবো তিনি নিশ্চয় তোর জন্য কিছু না কিছু একটা ব্যাবস্থা করে দেবেন।"
দানা জানে, রাজনৈতিক দলনেতা বাপ্পা নস্করের ড্রাইভার তাই ওকে বলে, "নারে ভাই, বাপ্পার কাছে যেতে রাজি নই আমি। অনেক পাপ করেছি এক নেতার সাথে মিশে, সেই পাপের বোঝা আর বাড়াতে চাই না রে।"
ফারহান হেসে দেয়, "পাপ পুন্য জানি না, তবে যে মানুষের কাছে নিয়ে যাবো তিনি আমাদের এলাকার ভগবান। অদ্ভুত মানুষ এই মহেন্দ্র ঘোষ। চল চল, একবার ওনার আড্ডায় পা রাখলে বুঝতে পারবি।"
দানা ফারহানকে বিশেষ চেনে না তাই প্রথমে ওর সাথে যেতে দ্বিধা বোধ করে। কিন্তু ফারহানের চাপাচাপির ফলে শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যাগ উঠিয়ে ওর সাথে হাটা লাগায়। বুকের ভেতরে চাপা উৎকণ্ঠা জীবনের পথ আবার কোন দিকে মোড় নেবে এই অচেনা মানুষের হাত ধরে। হঠাৎ কেন ফারহান ওর প্রতি এত সদয় হল, এমন সব প্রশ্ন ওকে ঘিরে ধরে। তবে আর কিছু হারাবার নেই তাই শেষ পর্যন্ত ফারহানের অনুরোধে গাড়িতে উঠে হিঙ্গলগঞ্জ ডক এলাকার দিকে পা বাড়ায়। পথে যেতে যেতে ফারহান ওকে জানায়, বাপ্পার ছেলে বৌ ট্রেনে চেপে কোথাও বেড়াতে গেছে তাই রেল স্টেশানে এসেছিল ওকে ছাড়তে।
মহেন্দ্র ঘোষের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে, ভদ্রলোক বছর কুড়ি আগে ওদের এলাকায় এসেছিলেন তারপর থেকে ওইখানের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। কেউ জানেনা কোথা থেকে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি হিঙ্গলগঞ্জ এলাকার মুকুটহীন রাজা। মহেন্দ্র বাবু প্রতি শনিবার বাড়িতে কালী পুজো করেন। মহেন্দ্র বাবু অদ্ভুত মানুষ, এই মানসিকতার মানুষ ফারহান আগে কোথাও দেখেনি। মহেন্দ্র বাবু বিয়ে থা করেন নি, এই এলাকা মানুষ ওর সংসার। মানুষ হিসাবে বড় অদ্ভুত, বিদ্বান জ্ঞানী গুনি ব্যাক্তি, বাড়িতে বইয়ে ঠাসা, কিন্তু কাজ করেন সব নীতি বিরুদ্ধ। ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস পত্র, গাড়ির কল কব্জা ইত্যাদি থেকে সোনা দামী পাথর ইত্যাদি চোরাই করে আনা, বড় বড় প্রোমোটার বিল্ডারদের ধমক দিয়ে টাকা আদায় করা, কয়লা চুরি করা, বড় লোকেদের হুমকি দিয়ে টাকা তোলা ইত্যাদি। সেই টাকা উপার্জন করে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন, গরীব দুঃখীদের খাওয়ানো, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা, মন্দির মসজিদ গির্জায় টাকা দান, অনাথালয় নারী কল্যান কেন্দ্রে টাকা দান। এই দান ধ্যানের ব্যাপারে তিনি চুপচাপ থাকতে ভালোবাসেন। ওনার দাপটে ওই এলাকায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। পুলিসের ডেপুটি কমিশনার, সাত্যকি চ্যাটার্জি মহেন্দ্রবাবুর বন্ধু। তার চোখে অবশ্য ধুলো দেয় না, তবে সাত্যকি চ্যাটার্জি ভালো ভাবেই জানেন মহেন্দ্র বাবু কি কি কাজ করেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি কিন্তু মনে প্রানে প্রানবন্ত এক যুবক, মহেন্দ্র বাবুকে এলাকার সবাই "বড়দা" বলে ডাকে। ফারহান কাউকে ফোনে জানিয়ে দেয় ওর ব্যাপারে।
হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় এই মহানগরের ডক, জাহাজ বন্দর এলাকা। বড় ছোট মাঝারি অনেক ধরনের জাহাজ এসে এইখানে লঙ্গর করে। বড় রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে, অলিগলির মধ্যে দিয়ে দানাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। খুব ঘিঞ্জি এলাকা, সরু সরু গলি, ঠিক যেন ভুল্ভুলাইয়া। যার পথ জানা নেই অনায়াসে সে এই অলিগলির জালে হারিয়ে যাবে। সারাদিন খুঁজেও এখান থেকে বের হবার পথ পাওয়া মুশকিল। দুই বাড়ির মাঝে শুধু মাত্র একটা রিক্সা যেতে পারার মতন পথ। পথের দুইদিকে কোথাও দোকান, কোথাও কারুর বাড়ির উঠান। মিষ্টির দোকান, থেকে সোনার দোকান থেকে লোহার দোকান থেকে খাবারের দোকান, সব রকমের দোকান আছে এই হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায়। কোথা থেকে ভুরভুর করে বিরিয়ানি কোর্মার গন্ধ ভেসে আসছে, কোথা থেকে মিষ্টি পাতার পান, কোথাও বেশ ভালো মাংস রান্না হচ্ছে। কেউ কেউ আবার ওই গলির মধ্যেই দড়ি টাঙ্গিয়ে কাপড় মেলে দিয়েছে। রাতের বেলায় বিজলী বাতির আলোতে এই এলাকা বিভীষিকায় সুন্দর দেখায়।
ফারহানকে এই এলাকার অনেক লোকেই চেনে মনে হচ্ছে, কারুর সাথে দেখা হলেই, "কি ফারহান ভাই, ক্যামন আহেন?" ফারহান ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে, "আদাব চাচা, ভালো আছি।" কোন মহিলা ওকে দেখে বলে ওঠে, "এই ফারহান, মালিশের তেল এনে দিলি না যে?" ফারহান হেসে সেই মহিলাকে উত্তর দেয়, "ইসস চাচী, এই বয়সে আবার মালিশের শখ, চাচা কি আর মালিশ করে না গো?" কোথা থেকে কয়েকটা ছোট ছেলে দৌড়ে এসে বায়না ধরে, "ফারহান ভাই ফারহান ভাই, কুড়ি টাকা দাও না, বিরিয়ানি খাবো।" ফারহান পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, "সেলিমের দোকানে যাস নে যেন, ওর দোকানের বিরিয়ানি খেলে পেট খারাপ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো, মেহজাবিনে চলে যাস আর আমার নাম নিস।"
ফারহান ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, "এই এলাকার সবাই মোটামুটি সবাইকে চেনে। নাম না জানলেও মুখ চেনা। কিন্তু বড়দা আর তাঁর ছেলেদের সবাই চেনে।"
এমন সময় অন্ধকার ফুঁড়ে এক ব্যাক্তি ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই সুঠাম ব্যাক্তিকে দেখে ফারহান জড়িয়ে ধরে। সেই ব্যাক্তি ফারহানের সাথে হাত মিলিয়ে বলে দানার দিকে দেখিয়ে বলে, "তো এই-ই দানা নাকি?" তারপরে দানার দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মিলিয়ে বলে, "আমি শঙ্কর।"
ফারহান শঙ্করের সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, "শঙ্করদা, বড়দার ডান হাত। বাড়ি চল আরও অনেকের সাথে পরিচয় হবে।"
শঙ্কর বয়স পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ, স্বাস্থ্য ভালো, বেশ লম্বা চওড়া। ফারহান আর শঙ্করদা আগে আগে চলে আর দানা নিজের ব্যাগ কাঁধে ওদেরকে অনুসরন করে। সরু অলিগলি পেরিয়ে নদীর তীরে একটা পাঁচিলে ঘেরা দুই তলা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। ফারহান আর শঙ্কর ওকে ছোট দরজা দিয়ে একটা উঠানের মতন ফাঁকা জায়গায় এনে দাঁড় করায়। দুই তলা বাড়ি মাঝে উঠান, তিন পাশে সারি বাঁধা ঘর।
আচমকা কেউ ওর মাথার পেছনে কিছু দিয়ে বাড়ি মারে, টাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিক থেকে আরো একজন এসে ওর চোয়াল লক্ষ্য করে একটা ঘুসি চালিয়ে দেয়। দানা থতমত খেয়ে যায়, হঠাৎ ওকে এইখানে এনে মারছে কেন। মাথা ঝাঁকিয়ে খানিকক্ষণ এদিক ওদিকে দেখে, চারজন লোক মিলে শঙ্কর আর ফারহানকে ধরে ফেলেছে, আর ওর চারপাশে আরও জনা আটেক লোক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে একজন এসে ওর হাঁটুর পেছনে কিছু একটা দিয়ে মারে আর দানা মাটির ওপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
দানা এই বিশাল শক্তিশালী শরীর নিয়ে মার খাবে? শাক্য নদীর তীরে ওর গায়ে শক্তি ছিল না, কারন মদের সাথে কিছু মেশান ছিল, কিন্তু আজকে ওর গায়ে শক্তি ভরপুর। মাথা ঝাঁকিয়ে চোয়াল মুছে দেখে যে রক্ত, নাকের থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সামনে থেকে একজন ওকে মারতে এগিয়ে আসে। ওর চুলের মুঠি ধরে চোয়াল লক্ষ্য করে এক ঘুসি মারতে যায়। দানা মাথা পেছনে করে সামনের লোকের ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে এক ধাক্কা মারে। সামনের লোক ঊরুসন্ধি ধরে মাটিতে বসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দানা উঠে দাঁড়ায়, পেছন থেকে একজন ওর ঘাড় লক্ষ্য করে মারতে আসলে দানা সতর্ক হয়ে যায় আর পেছনের লোকের হাত ধরে টেনে ওই সামনের লোকের ওপরে ছুঁড়ে মারে। সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশ থেকে আরো দুইজনে দৌড়ে আসে। একজনের পেট লক্ষ্য করে এক লাথি কষিয়ে দেয় দানা, লোকটা পড়ে যেতেই ওর চোয়াল লক্ষ্য করে এক ঘুসি। দ্বিতীয় যে লোকটা ওকে অন্য পাশ থেকে মারতে এসেছিল সে একটু দাঁড়িয়ে যায়। তারপরে দানার পেট লক্ষ্য করে ঘুসি চালায়। দানা সরে গিয়ে ঘুসি বাঁচিয়ে দ্বিতীয় লোকটার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে লাথি কষিয়ে দেয়। দ্বিতীয় লোক ঊরুসন্ধি ধরে বসে পড়তেই দানা ওর গলা হাতের মধ্যে চেপে ধরে গর্জে ওঠে, "এই শালা মাদারজাত, তোদের কে পাঠিয়েছে? কঙ্কনা না নাসরিন?"
সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ ছয় জন লোক মিলে ওর ওপরে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুইজনে একসাথে ওর হাত ধরে ফেলে মাটিতে বসিয়ে দেয়, একজনে পেছন থেকে ওর গলা হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে দেয়, সামনের একজন ওর চোয়াল লক্ষ্য করে ঘুসি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্য জনে ওর চুলের মুঠি ধরে ফেলে। পাঁচজনে একসাথে ওকে ধরে কাবু করে ফেলে।
সাহচর্যের হাত (#০২)
ঠিক সেই সময়ে এক গুরু গম্ভীর কণ্ঠ স্বর শোনা যায়, "ছেড়ে দে, অনেক হয়েছে। শালা আট জনের মধ্যে চারজনকে একাই শুইয়ে দিল। তোদের কতবার বলি রোজ সাঁতার কাট, কিন্তু তোরা শুনবি না।"
সবাই ওকে ছেড়ে দিতেই দানা উঠে দাঁড়ায়। মহেন্দ্র বাবু, সৌম্য কান্তি ব্যাক্তি, দেখলেই বোঝা যায় যে ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। পরনে সাদা ধুতি, একটা সাদা গেঞ্জি, কপালে বড় লাল তিলক। ডান হাতের ওপরে বেশ পুরানো গভীর ক্ষত দাগ, দেখেই মনে হয় আইন বিরোধী কর্মের ফল। ফারহান আর শঙ্কর ওর দিকে এগিয়ে আসে, একজন একটা চেয়ার নিয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে। ফারহান ওর দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে ক্ষমা চেয়ে বলে, এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতে হলে একটা পরীক্ষা দিতে হয়, মনে হয় দানা পাশ করে যাবে এই পরীক্ষায়। সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়েন ভদ্রলোক।
ফারহান ওই ভদ্রলোকের সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, "এই হচ্ছেন আমাদের বড়দা।" ফিসফিস করে বলে, "পেন্নাম ঠোক রে।" ফারহানের সাথে সাথে দানাও সেই ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে।
মহেন্দ্র বাবু দানাকে আপাদ মস্তক জরিপ করে জিজ্ঞেস করে, "কি করিস তুই?"
দানা নাকের রক্ত হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে উত্তর দেয়, "আগে ট্যাক্সি চালাতাম কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না, তাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম।"
মহেন্দ্র বাবু ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, "মিথ্যে কথা বলছিস আর সেটাও ভালো ভাবে বলতে জানিস না তুই। নিশ্চয় প্রেমে ধাক্কা খেয়েছিস তাই মহানগর ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।"
মহেন্দ্র বাবুর কথা শুনে বাকি সবাই হেসে দেয়ে। মহেন্দ্র বাবু শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলে, "কি রে, এর নাক থেকে রক্ত পড়ছে একটু কিছু দে?"
সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন একটা কাপড় আর একটা ওষুধ দেয় ওর হাতে। দানা তাকিয়ে দেখে যার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে মাথা দিয়ে মেরেছিল সেই ব্যাক্তি ওর হাতে কাপড় আর ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে। মহেন্দ্র বাবু সেই ব্যাক্তির সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, রমিজ আন্সারি। ফারহান একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। শক্তি, মনা, কালী, বলাই, আক্রাম, নাসির, সোহেল, পিন্টু, নাড়ু আরো অনেকের সাথে, দানাও সবার সাথে হাত মিলিয়ে সন্ধি পাতিয়ে নেয়। সবাই মহেন্দ্র বাবুর সাথেই থাকে। এই বাড়িতে শঙ্কর আর রমিজ নিজেদের পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকে আর মহেন্দ্র বাবু তাঁর ছেলেদের নিয়ে একতলায় থাকেন।
একজন মহিলা এক থালা খাবার দাবার এনে ছেলেদের হাতে দিয়ে চলে যায়। সবার সাথে খাবার খেতে খেতে দানা এদিক ওদিকে চেয়ে দেখে। বাড়িটা বেশ বড় সড়, সব মিলিয়ে মনে হল দশ বারোটা ঘর হবে। অনেকের কোমরে পিস্তল গোঁজা দেখে দানা একটু চমকে যায়। ফারহান জানিয়ে দেয় চমকানোর কিছু নেই, ওই পিস্তল কোনদিন দুর্বল মানুষের ওপরে চালানো হয় না।
মহেন্দ্র বাবু ওর মারামারি করা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোর নাম কি?"
দানা উত্তর দেয়, "আমার নাম দানা।"
মহেন্দ্র বাবু হেসে জিজ্ঞেস করেন, "এটা কি ভালো নাম না ডাক নাম?"
দানা মাথা চুলকায়, কারুর ভালো নাম কি কখন দানা হতে পারে নাকি? তারপরে উত্তর দেয়, "না মানে এটা ডাক নাম, একটা ভালো নাম আছে বিশ্বজিৎ তবে ওই নামে আমাকে কেউ ডাকে না।"
মহেন্দ্র বাবু হেসে ফেলেন, "তোর এই দানা নামের একটা অর্থ আছে সেটা জানিস কি? হিব্রু ভাষায় দানা মানে বিদ্বান। কত পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিস তুই?"
দানা মাথা নাড়িয়ে জানায় এতদিন ওর ডাকনামের অর্থ জানত না তারপরে উত্তর দেয়, "বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম তারপরে মা মারা যাওয়াতে আর পড়াশুনা করে ওঠা হয়নি।"
মহেন্দ্র বাবু দানাকে প্রশ্ন করে, "আচ্ছা তোর এই বিশ্বজিতের মানে কি সেটা জানিস?"
দানা কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলে, "হ্যাঁ জানি, যে বিশ্ব জয় করে তার নাম বিশ্বজিৎ।" তারপরে হেসে দুই আঙ্গুল দিয়ে বন্দুক ইশারা করে বলে, "এই দিয়ে এখন বিশ্ব জয় করা যায়।"
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, "ওরে মূর্খ, ওই পিস্তল বন্দুক দিয়ে যদি সত্যি সত্যি বিশ্ব জয় করা যেত তাহলে সারা বিশ্বে মারামারি কাটাকাটি লেগে যেত, জলের পরিবর্তে রক্তের নদী বইত। বিশ্ব জয় করতে গেলে মানুষের মন জয় করতে হয়। স্বদেশে পুজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে।"
দানা মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "বড়দা এটা কোন ভাষা? কিছু বুঝলাম না যে?"
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, "এটা সংস্কৃত ভাষা। আমি যা বললাম তার মানে, যে বিদ্বান, যে অন্য মানুষের দুঃখ বোঝে সেই বিশ্ব জয় করে, নিজের দেশে শুধু মাত্র রাজার পুজো করা হয় কিন্তু ভালো মানুষের পুজো সব জায়গাতেই হয়। বিদ্বান মানে শুধু বই পুঁথি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘিলুর শ্রাদ্ধ করলাম সেটা নয় রে দানা। একজন মহান সন্ন্যাসী বলে গেছেন, এডুকেশান ইজ দা ম্যানিফেস্টেশান অফ দা পারফেকশান অলরেডি উইদিন ম্যান। এর মানেও নিশ্চয় কিছু বুঝিস নি তাই না?"
দানার মাথা এই কথা কিছুই ঢোকে না তাই মাথা নাড়িয়ে জানায় যে কিছুই ঢোকেনি। মহেন্দ্র বাবু ওকে পাশে বসিয়ে বলেন, "একজন মানুষের শিক্ষা দীক্ষার পরিপূর্ণতা সবসময়ে সেই মানুষের হৃদয়ে অভ্যন্তরে থাকে, সেইখান থেকেই আসে শিক্ষার আসল অর্থ।"
দানা মহেন্দ্র বাবুকে প্রশ্ন করে, "আচ্ছা বড়দা আপনি এত তত্ত কথা জানলেন কি করে?"
মহেন্দ্র বাবু ওকে বলে, "আমি প্রায় সব ধর্ম গ্রন্থ পড়েছি এই শিক্ষার খোঁজে। অবাক হচ্ছিস না আমাকে দেখে?"
দানার সাথে সাথে বাকি ছেলেরা অবাক হয়ে মহেন্দ্র বাবুর দিকে তাকায়। মহেন্দ্র বাবু হেসে ওদের বলে, "তোদের মানুষ করব বলে এইখানে এসেছি, বুঝেছিস। আমি অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেই এক বানী, মানুষকে ভালবাসতে শিখতে হয়।" বলেই হেসে ফেলেন, "যা এবারে ওঠ, অনেক হল আজকে। তারপরে বলবি বুড়ো ভাম বসিয়ে বসিয়ে জ্ঞান দিয়ে গেল।"
ফারহান প্রশ্ন করে, "তাহলে বড়দা এই কাজে কেন নেমেছেন?"
মহেন্দ্র বাবু ওর মাথায় হাত রেখে বলে, "আমি দুষ্টের নিধন করি তাই বন্দুক তুলে নিয়েছি হাতে। এদেশের যে রাজা সেই চোর তাই বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে। আমি ডাকাতি করি, সোনা চোরাই করি, বিদেশী মাল চোরাই করি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছি। তবে টাকার জন্যে আমি কোনোদিন কাউকে খুন করিনি, ড্রাগসের ব্যাবসা কোনোদিন করিনি। আমার হৃদয় যাদের বলেছিল যে এই মানুষকে খুন করে দাও, নর নারী নির্বিশেষে তাদের খুন করেছি। পুরুষ হোক কি মহিলা, যদি তোর হৃদয় বলে যে এই মানুষ সমাজের জন্য পূতিময় রোগ তাহলে তাকে সরিয়ে দিতে পিছপা হবি না কখন। কোনোদিন কোন অবলা নারীর গায়ে হাত তুলিনি, কোন নারীর শ্লীলতা হনন করিনি, কোন দরিদ্র মানুষের রুটি কেড়ে খাইনি। তোদের কেও সেই এক কথা বলি।"
বেশ কিছুক্ষণ ওইখানে বসে থাকার পরে ফারহান ওকে জানায় ওকে ফিরে যেতে হবে। দানা ব্যাগ উঠিয়ে নিতেই ফারহান বলে এইখানে থাকতে। ওকে জানায় যে শঙ্কর আর রমিজ মহেন্দ্র বাবুর দুই হাত। ওদের দুইজনের যেন কোনোদিন বিরাগ ভাজন না হয়। তারপরে কানে কানে জানায় ওর মতন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করুক, ভালো কারুর গাড়ি চালাবার চাকরি পেলে দানাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। কেষ্টর পরে ফারহানকে দেখে দানার মনে হয় সত্যি এক বন্ধু পেয়েছে এই মহানগরের বুকে। ফারহান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
শঙ্কর বাকি ছেলেদের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়। নিচের একটা বড় ঘরে আরো তিনজনের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা। ওই ঘরে চারখানা খাট পাতা, বলাই, নাসির আর শক্তি যারা বয়সে একটু ছোট তারা এই ঘরে থাকে। বাকিদের জন্য পাশের অন্য ঘর। রাতে ওই উঠানে লম্বা সার বেঁধে খাওয়া দাওয়ার পাত পরে। শঙ্করের স্ত্রী, মহিমা আর রমিজের স্ত্রী আবিদার ওপরে রান্না করার ভার, দুই নারীকে দেখে মনে হয় দুই বোন। রাতের বেলায় বাকিদের সাথে মদ খেতে খেতে আরো জানতে পারে যে, শঙ্কর আর রামিজের ছেলে মেয়েরা দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। সব খরচ এই বড়দা দেন। এই এলাকার অনেক ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ মহেন্দ্র বাবু বহন করেন।
পরের দিন সকাল থেকেই দানার অনুশীলন শুরু হয়ে যায়, ভোরবেলা সূর্য উঁকি মারার সময় থেকেই সবাই উঠে পড়ে। সকাল সকাল নদীর তীরে গিয়ে সাঁতার কাটতে হয়, সাঁতরে নদী পেরিয়ে ওইপাশে যেতে হবে। বাপ রে, এই গঙ্গা পার হওয়া, বিশাল ব্যাপার। দানা ছোট বেলায় কালী পাড়ার বস্তির পেছনের দিকের পুকুরে সাঁতার শিখেছিল, কিন্তু এযে বিশাল চওড়া নদী। প্রথম দিনে বেশি দুর যেতে পারল না, বাকিরা পারাপার করে দিল এক বারেই। এই নদী পারাপার করা যেন ওদের কাছে ছেলে খেলা। দুপুরের পরে বলাই, নাসিরের সাথে মাছ ধরার প্রশিক্ষণ চলে। বলাইকে জিজ্ঞেস করলে জানায় যে এই বিদ্যে একদিন ওর কাজে লাগবে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা ধৈর্যের পরীক্ষা করায়, ছিপ ধরে বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা, ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকো একভাবে কখন মাছে চারা খাবে, ফাতনায় টান ধরলেই ঢিল দিয়ে আগে মাছ খেলাও তারপরে টেনে উঠাও। তারপরে বিকেলে আবার পিস্তল বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ। কোনটা সাইলেন্সার, কোনটা ট্রিগার, কোনটা সেফটি ক্লাচ, কি ভাবে রিভলভারে গুলি ভরতে হয়, কি ভাবে পিস্তলে ম্যাগাজিন ভরতে হয় ইত্যাদি, কোন গুলি কত বোরের, কোন গুলিতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, পিস্তল রিভলভার খুলে কি ভাবে পরিস্কার করে আবার জোড়া লাগাতে হয় ইত্যাদি।
শক্তি বলাই নাসিরের তালিমে কয়েকদিনের মধ্যে দানা পিস্তল চালানো, ছিপ আর জাল নিয়ে মাছ ধরা আর সাঁতরে নদী পার হওয়া রপ্ত করে নেয়। নিত্যদিন ওর কাজ, সকালে নদীতে নেমে সাঁতার কেটে স্নান সেরে বাড়ি ফেরা, তারপরে খেয়ে দেয়ে মাছ ধরা, তারপরে এক ঘুম লাগানো, বিকেলে সবাই মিলে বসে জমিয়ে আড্ডা। কেউ দানাকে ওর প্রেমিকার বিষয়ে চেপে ধরলে দানা চেষ্টা করে এড়িয়ে যেতে, নিতান্ত যদি বলতেই হয় তখন ময়নার ঘটনা বলে। কি ভাবে পাশের গুমটির বিষ্টুর বউয়ের সাথে সহবাস করেছিল আর একদিন ময়না ফুরুত করে উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুখ ফুটে কারুর কাছে ওর ভালোবাসা, ইন্দ্রাণীর কথা বলতে পারে না। ইন্দ্রাণীর কাছে যে ও পাপী। রোজ রাতে ফাঁক পেলেই মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর হাসি হাসি চেহারা দেখে আর ভাবে কি করছে ইন্দ্রাণী, ওর কথা কি মনে করে? নিশ্চয় নয়, অথবা হয়ত হ্যাঁ। খুব ইচ্ছে করে একবার গোল বাগান যেতে, কিন্তু কি মুখ নিয়ে যাবে, আর যদি কোনভাবে নাস্রিন অথবা কঙ্কনার চোখে পরে যায় তাহলে ওরা ইন্দ্রাণীকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে বাঁধবে না। ইন্দ্রাণী সত্যি ওকে ভালবেসেছিল।
মহেন্দ্র বাবু কোনোদিন কোন গল্প ফেঁদে বসেন, দুর কোন প্রদেশের জঙ্গলে হাতির পিঠে চড়ে বাঘ, গন্ডার দেখেছিলেন তার গল্প, ভিন্ন প্রদেশের এক জঙ্গলে সিংহ দেখেছিলেন সেই গল্প। দানা ভাবে এদের কি কোন কাজ নেই। বলাই জানায় সময় হলেই কাজের জন্য ওকে নিয়ে বের হবে। ধীরে ধীরে সবার সাথে ভালো বন্ধুত্ত হয়ে যায়। দানা ওদের মধ্যে সব থেকে বেশি শিক্ষিত, বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে আবার ইংরেজি পড়তে পারে আর বলতেও পারে ভালো করে। ওর খাতির একটু বেড়ে যায় সবার চোখে, যতই হোক বিদ্যের দাম আলাদা। শঙ্কর আর রমিজের বিশ্বাসের লোক হয়ে উঠতে সময় লাগে না ওর। এই কয়দিনে ফারহান অবশ্য ওর সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখে। প্রায় দিনেই ফোনে ওকে আশ্বাস দেয়, সময় হলে আর ওর মতন কাজ পেলে ওকে এইখান থেকে নিয়ে যাবে। এই কয়দিনে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকা ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতেও পারেনি, সব সময়ে ওর পাশে বলাই না হয় শক্তি না হয় নাসির কেউ না কেউ থাকতো।
ফারহানের বিষয়ে একদিন নাসিরের কাছ থেকে জানতে পারে, ফারহানের বাড়ি এই হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায়, বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর ওর ভাবী নাফিসা ছাড়া আর কেউ নেই। ফারহান আগে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতো, পরে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে বাপ্পা নস্করের ড্রাইভারির কাজ করতে শুরু করে।
একদিন সকালে মহেন্দ্র বাবু ওদের সবাইকে ডেকে বলেন সমুদ্র পথে "ব্লু কুইন" নামক জাহাজে ওদের জন্য চোরাই করা সোনা আসছে। ওই সোনা এই দেশের জলে সীমানায় ঢোকার আগেই মাঝ সমুদ্র থেকে নৌকা করে নিয়ে আসতে হবে। সাগর পাড়ি দেবে দানা, জিজ্ঞাসু চোখে বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলাই ওকে বুঝিয়ে দেয় যে এইবারে আসল কাজে নামবে। প্রায় দিন দশেকের মতন নৌকায় থাকতে হবে, নৌকা বেয়ে মাঝ সমুদ্রে ওরা মাছ ধরার অছিলায় যাবে আর ওই জাহাজে ওদের লোক ঠিক করা আছে যারা ওদের দেখে সোনা ভরা বাক্স সমুদ্রের জলে ফেলে দেবে। সেই সোনা ভরা বাক্স নৌকার নিচে বেঁধে, মাছ ভর্তি নৌকা নিয়ে আবার এইখানে ফিরে আসতে হবে।
সাহচর্যের হাত (#০৩)
বিকেল থেকেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষা এসে গেছে। ঘন কালো বর্ষার মেঘ গুড়গুড় চড়চড় আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দেয়, থেকে থেকে বজ্র বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে কালো আকাশ চিরে খানখান করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক, ঝড় মাথায় নিয়ে নিশুতি রাতের অন্ধকারে দুই খানা নৌকায় জনা দশেক লোক যাত্রা শুরু করে। নৌকায় চড়ার আগে একবার মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর ছবি দেখে বুকের ওপরে লাগিয়ে নেয়। যদি এই ভয়ঙ্কর কাজে মৃত্যু হয় তাহলে ওর ছবি বুকে নিয়েই মরবে। এক নৌকার হালে রমিজ অন্য নৌকায় শঙ্কর। সবার পরনে গেঞ্জি লুঙ্গি, মাথায় কোমরে গামছা বাঁধা, পাকা মাঝি মোল্লা জেলেদের মতন সাজে সজ্জিত সবাই।
নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাছে পিঠে কোথাও একটা বাজ পড়ে। দানা চমকে ওঠে আর বাকি সবাই হেসে দেয় ওর চমকানি দেখে। যে মানুষ কোনোদিন শহরের বাইরে পা রাখেনি, সেই মানুষ নৌকায় পা রেখে অসীম সমুদ্র পানে ধেয়ে চলেছে। দুর্যোগের গভীর রাতে নদীর কালো কেটে এগোতে এগোতে দানার একটু গা ছমছম করছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ছমছমে ভাব কেটে যায়। এই কয়দিনে দানা বুঝে গেছে ওর জীবন ভিন্ন খাতে বইতে চলেছে।
সারা রাত ধরে মুষলধার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভোরের দিকে মোহনার কাছে পৌঁছে যায়। পুবের আকাশে লাল সূর্য জলের নীল রঙ বদলে দেয়। পেছনে তাকালে ঘন সবুজ বন জঙ্গল। রাতের বেলা ঠিক ভাবে ঘুম আসেনি দানার, নৌকার ছাদের ওপরে সারা রাত জেগে বসেছিল। কোন কোন সময়ে ওই ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বাঘের ডাক শুনতে পেয়েছিল। ডাক শুনে নাসির আর বলাইয়েরা একটু খানি চোখ মেলে তাকিয়ে এপাশ ওপাশ দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদের মনে হয় এই বাঘের ডাক সহ্য হয়ে গেছে, ওদের কাছে এই হুঙ্কার নতুন কিছু নয়।
দিন বাড়ার সাথে সাথে নৌকা সাগরের নীল জল কাটিয়ে অনন্ত দিগন্ত পানে বয়ে চলে। একটানা নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজে মাঝে মাঝে ঘুম চলে আসে চোখে। দুপুরে রান্না সারা হয় ওই নৌকায়, সামান্য ভাত আর ডাল, কাঁচা সবজি পাতি কিছু আনা হয়েছে। সেই খেয়ে আবার নৌকা চলতে শুরু করে।
যেদিকে তাকায় সেদিক শুধু জল আর জল। বড় বড় নীল রঙের ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার চুড়া। কাঠের নৌকা একবার ঢেউয়ের তালে ওপরে ওঠে একবার নিচে নামে। মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের দেখা দেয়, সমদ্রের বিশাল ঢেউ দেখে মনে হয় কালো জলের পাহাড় গর্জন করে ওদের নৌকা দুটো গ্রাস করে নেবে। কাঠের নৌকা একবার ওই কালো জলের পাহাড় চুড়ায় ওঠে আর পরক্ষনেই অতল সমুদ্র ওকে গিলে নেয়। বিভীষিকা ময় দুর্যোগের রাতে দানার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আসার যোগাড়। দানা কোনোদিন সমুদ্রে যায়নি, ছোট নৌকার উথাল পাথাল দোলের চোটে দানা চোখে অন্ধকার দেখে। কিছু খেলেই বমি করে ফেলে, চোখের সামনে অন্ধকার, বনবন করে মাথা ঘোরে সব সময়ে।
দুই দিন দুইরাত এইভাবে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে যায় ওদের নৌকা। বলাই, নাসির ওকে বলে কয়েকবার সমুদ্রে পাড়ি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এই দুইদিন যে কিছুতেই কাটতে চায় না। বমি করে শ্রান্ত হয়ে নিচের পাটাতনে বেশির ভাগ সময়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় দানা। ফাঁকা সময়ে গল্প করা ছাড়া আর টেপ রেকর্ডারে গান শোনা ছাড়া কোন কাজ নেই। গায়ের ঘামে নুনের গন্ধ, চামড়া পুড়ে দুইদিনে আলকাতরার মতন কালো হয়ে গেছে। রোদে নুন জ্বলে ত্বকের ওপরে ফোস্কা পড়িয়ে দিয়েছে, চুলে জট পাকিয়ে গেছে।
দুই দিনের দিন গভীর রাতে দুর দিগন্তে একটা কালো রঙের জাহাজের দেখা পায়। শঙ্কর আর রমিজ সবাইকে সতর্ক করে দেয়। কাজে নামার সময় এসে গেছে। ওইদিকে আকাশে আবার কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। ঘন কালো অন্ধকার আর বিশাল বিশাল ঢেউ চিরে ওদের নৌকা ওই বিশাল জাহাজের বেশ কাছে পৌঁছে যায়। নৌকার আলো বন্ধ করে রমিজ একটা টর্চ হাতে নিয়ে নৌকার ছাদে উঠে অপেক্ষা করে। এক মিনিট যেন এক ঘন্টা, রাত দুটো নাগাদ জাহাজের ডেকের ওপর থেকে একটা টর্চ বেশ কয়েক বার জ্বলে উঠে নিভে যায়। ঠিক সেই ইশারা মতন রমিজ তিন বার টর্চ জ্বালিয়ে নিভিয়ে সঙ্কেত দেয়। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর ঢেউয়ের গর্জনে কিছু কানে শোনা যায় না। তাও মনে হল জলের মধ্যে বেশ কয়েকটা বাক্স পড়ার ঝপাং আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে, বলাই, শক্তি, নাসির, আক্রাম সোহেল দাঁতের মধ্যে একটা টর্চ ধরে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে অতল সাগরের জলে ঝাঁপ দেয়। চোখের সামনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে দানা পিছোতে পারে না, ওযে ইন্দ্রাণীর ভালোবাসার পাপী। দানাও পিছিয়ে থাকে না, ঝাঁপ দিতে যাবে তখন শঙ্কর ওকে একটা টর্চ ধরিয়ে দিয়ে সাবধান করে দেয়। বমি করে দেহের শক্তি অনেকটাই খর্ব, কিন্তু সেইসব উপেক্ষা করে দানা জানিয়ে দেয় জলে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত। শঙ্করকে জানায় যে জীবনে সব কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। আসলে দানা চেয়েছিল, যদি এই বিভীষিকা ময় অতল সমুদ্র ওকে নিজের কোলে চিরদিনের মতন টেনে নেয় তাহলে এই পাপের বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। দানা চোখ বুজে একবার ইন্দ্রাণীর হাসি কান্না মেশানো চেহারা বুকে এঁকে নেয়, তারপরে টর্চ দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে জলে ঝাঁপ দেয়।
টর্চের আলোয় বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। ঘোলা জলে নিচের দিকে নেমে যায় সবাই, চারখানা বাক্সে বেলুনের মতন কিছু বাঁধা। জলের তলায় তলিয়ে যাবার আগেই ওই বাক্স গুলো নিয়ে বাকিদের সাথে নৌকায় উঠে আসে। নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দেয়। রমিজ একটা বাক্স টেনে উঠাতে যায় আর ঠিক তখনি একটা বড় ঢেউ ওদের নৌকায় আছড়ে পড়ে। বাক্স সমেত রমিজ জলের মধ্যে পড়ে যায়। তড়িৎ বেগে দানা টর্চ দাঁতে চেপে জলে ঝাঁপ দেয়। সাঁতরে সাঁতরে রমিজের গেঞ্জি টেনে ধরে, ওইদিকে বাক্স তলিয়ে যাবার উপক্রম। রমিজ খানিক থিতু হয়ে ওকে ওই বাক্স আনতে বলে। দানা আবার জলের তলায় ডুব মারে। কোনোরকমে সাঁতরে বাক্স তলিয়ে যাবার আগেই ধরে ফেলে। ততক্ষণে শঙ্কর আর সোহেল ওর সাহায্যের জন্য এসে যায়। তিনজনে বাক্স নিয়ে আর রমিজকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। রমিজ দানাকে জড়িয়ে ধরে ওর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানায়।
জাহাজের থেকে অনেকদুরে গিয়ে আবার নৌকা থেমে যায়। দানা বাকিদের সাথে ওই বাক্স বোঝাই সোনা নিয়ে আবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নৌকার নিচে একটা কাঠের পাটাতনের সাথে এক এক করে ওই বাক্সগুলো বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরে কাজ শেষ করে জল থেকে উঠে আসে।
সবাই বেশ খুশি, কাজ শেষ এইবারে মাছ ধরার পালা শুরু। মাছ ধরে নৌকা ভর্তি করে ফিরতে হবে। পরের চারদিন শুধু মাছ ধরেই কাটিয়ে দেয়। দানা জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে এই মাছ শুধু দেখানোর জন্য, না হলে জলের পুলিসের কাছে কি কৈফিয়ত দেবে। সারডিন, আইলা, লইটা, চিংড়ি এমন অনেক মাছে নৌকা বোঝাই করে শেষে আবার মহানগরের দিকে যাত্রা শুরু হয় ওদের।
হিঙ্গলগঞ্জে পৌঁছে রাতের অন্ধকারে সোনা বোঝাই বাক্স নামানো হয়। রাতের অন্ধকারেই সেই সব সোনা চলে যায় বিভিন্ন স্যাক্রার দোকানে। গাড়ি করে বস্তা ভর্তি টাকা চলে আসে। দানা শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে এইসব কাজ কারবার দেখে। সকালের আগেই বাড়ি থেকে সোনা উধাও হয়ে যায়, খালি বাক্স জলে ফিরে যায়। মহেন্দ্র বাবু সবাইকে কাজের জন্য টাকা দেন, শঙ্কর আর রামিজের বরাদ্দ পঁচাত্তর হাজার, বাকিদের পঞ্চাশ হাজার।
দানা নতুন ছেলে তাই ওকে ত্রিশ হাজার দেওয়া হয়, কিন্তু রমিজ জানায় যে দানা বাকিদের থেকে ভিন্ন, বুকে বল আছে, মরতে পিছপা হয় না। প্রথম বারেই সমুদ্রে গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে ওর জীবন বাঁচিয়েছে। সেই শুনে মহেন্দ্র বাবু বাকিদের মতন দানাকেও পঞ্চাশ হাজার দেন।
মাঝে মাঝেই শঙ্কর আর রমিজ, দানা আর বাকি ছেলেদের নিয়ে বড় বড় বিল্ডারদের কাছে যায় টাকা আদায়ের জন্য। কাউকে হুমকি দিতে হয় টাকার জন্য, কাউকে বন্দুক দেখাতে হয়। ভয় না দেখালে কারুর পকেট থেকে টাকা বের হয় না। পরে দানা জানতে পারে, মহেন্দ্র বাবু এই চোরাই সোনা বিক্রি করার টাকা, প্রোমোটারির ব্যাবসাতেও লাগিয়েছেন। যাদের টাকা দিয়েছিলেন যখন তারা টাকা ফেরত না দেয় তখনি তাদের কাছে বন্দুক নিয়ে যেতে হয়। ওই সোনা আর বিদেশী মাল রফতানি করে যে টাকা আয় করেন, তার বেশির ভাগ হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় বিতরন করে দেন। তারপরেও যে টাকা বেঁচে থাকে সেই টাকা এই বিল্ডারদের কাছে খাটান। সেইখান থেকেও যে টাকা আয় হয়, সেই টাকা আবার ঘোরাফেরা করে।
দানার কথা বার্তা বাকিদের থেকে আলাদা, অশোধিত ট্যাক্সি চালক হলেও গালি গালাজ কম দেয়, খালি সময়ে মহেন্দ্র বাবুর ঘরে ঢুকে বই পড়ার চেষ্টা করে। বেশ বড় ঘরের তিনদিকে বিশাল বিশাল কাঠের আলমারির তাকে সারি সারি বই সাজানো। ইংরেজি বাংলা হিন্দি উর্দু আরও বেশ কয়েকটা নাম না জানা বিদেশী ভাষার বই। দানা বাংলা আর ইংরেজি পড়তে জানে তাই মাঝে মাঝেই ওই বই গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। একদিন ওর এই বই পড়া মহেন্দ্র বাবুর চোখে পড়ে যায়, আর সেই থেকে মহেন্দ্র বাবু মাঝে মাঝেই ওকে ভালো ভালো বই পড়তে দেন। কখন কোন মহান সন্ন্যাসীর আত্মকথা, কখন বিদেশী লেখকের কোন বই। ইন্দ্রাণীর দৌলতে পাওয়া ওর শোধিত আচরনের জন্য, এই কয় দিনে দানা, মহেন্দ্র বাবু এবং বাকিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।
এইভাবে দুই আড়াই মাস কেটে যায়, এর মাঝে অনেকবার ওদের সমুদ্রে যেতে হয় চোরাই মাল আনার জন্য। কখন বাক্সে সোনা থাকে, কখন দামী পাথর, কখন গাড়ির কলকব্জা, কখন ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসপত্র। সমুদ্রযাত্রা দানার পক্ষে বড় অসস্তিকর। সমুদ্রে গেলেই ঢেউয়ের নাচনের চোটে ওর পেটের নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আসার যোগাড় হয়। দশদিন শুধু জল আর জল দেখা, সেই এক চেহারা দেখা, সেই এক গান চল্লিশ বার করে শোনা। মাঝে মাঝে ডকের গুদামে ঢুকে মাল চুরি করা হয়, সেই মাল আবার রাতারাতি বাইরে বিক্রি হয়ে যায়। দুই আড়াই মাসে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করে পকেটে অনেক টাকা এসে যায়, কিন্তু কোথায় খরচ করবে সেটা ভেবে পায় না। ট্যাক্সি চালক দানা, সভ্য সমাজের চোখে হয়ে ওঠে এক অসামাজিক মানুষ, যে রাতের পর রাত চোরাই মাল নিয়ে আসে দেশের মধ্যে, ডকের গুদাম থেকে মাল চুরি করে, রেলের ইয়ার্ড থেকে লোহা চুরি করে।
শঙ্কর আর রমিজ ছাড়া বাকিদের কারুর বিয়ে থা হয়নি। এতদিন মহেন্দ্র বাবুর বাড়িতে থেকে মহিলা বলতে মহিমা বৌদি আর আবিদা ভাবীর দর্শন পেয়েছিল, তবে ওই দুই নারীকে দানা সর্বদা মাতৃময়ী রূপেই দেখে এসেছে। মহেন্দ্র বাবুর বাড়ির চৌহিদ্দি থেকে বিশেষ বের হত না, আর বের হলে হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায় তেমন সুন্দরীর দেখা পাওয়া যেত না। এই এলাকায় যে বেশ্যা বৃত্তি হয় না সেটা নয়। হিঙ্গলগঞ্জ মাঝি মোল্লাদের এলাকা, এলাকার অন্যদিকে বেশ বড়সড় বেশ্যালয় আছে। যেখানে ওই নাসির, বলাই, শক্তি আক্রাম ওরা যায়। প্রায় রাতেই বাকি ছেলেরা মদ খেয়ে বেশ্যা বাড়িতে রাত কাটিয়ে ফুর্তি করে আসে। ওকে সবাই লিঙ্গ হীন পুরুষ বলে খেপায়, কিন্তু দানা চুপ করে মিচকি হেসে ওদের কথা শুনে যায়। মনে মনে হাসে দানা। এই কাজে নামার আগে দানা এত নারীর সাথে সহবাস করেছে, যে নারী অঙ্গের যৌনসুখ ওর কাছে ম্লান হয়ে গেছে। যার সাথে ভালোবাসা নেই তার সাথে সহবাস করে কি হবে।
একদিন দানা শঙ্করকে জানায় যে এই কাজ ওর বিশেষ ভালো লাগছে না, বিশেষ করে ওই সমুদ্রে যাওয়া। সমুদ্রে গেলেই ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়, মাথা ঘোরে, বমি পায় কিছু খেতে পারে না। শঙ্কর হেসে বলে, এটাই ওদের প্রধান কাজ, সমুদ্র থেকে মাল নিয়ে আসা। তবে এই বিষয়ে মহেন্দ্র বাবুর সাথে কথা বলবে। মহেন্দ্র বাবু ওকে একদিন ডেকে জানিয়ে দেন যদি দানা চায় তাহলে অন্য কাজ করতে পারে আর তাতে মহেন্দ্র বাবু সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু দানা গাড়ি চালানো ছাড়া আর অন্য কিছু কাজ জানে না, তাই অগত্যা মহেন্দ্র বাবুর কাছেই ওকে থেকে যেতে হয়।
ফারহান সপ্তাহে অন্তত একবার করে আসে হিঙ্গল গঞ্জে আর এলেই ওর সাথে দেখা করে। ওর বাড়ি এই এলাকাতেই কিন্তু কোনোদিন ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সেদিন দানা ঠিক করে নেয়, ফারহানকে সব জানাবে।
একদিন ফারহান ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি রে দানা, কেমন চলছে সব?"
দানা মিচকি হেসে জানায়, "এই এক রকম ভাই। তবে শালা ওই সমুদ্রে যাওয়া বড় বিপজ্জনক কাজ। আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার শালা ওই নৌকার দোলের চোটে আমার নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আসার যোগাড় হয়। শরীর খারাপ হয়ে যায় রে ভাই।"
ফারহান মিচকি হেসে ওকে বলে, "হ্যাঁ শালা, আমিও এই লাইনে এক বছর কাজ করেছিলাম। কিন্তু ওই সমুদ্রে যাওয়া আমারো ঠিক সইল না তাই কাজ ছেড়ে দিলাম। কাজ ছেড়ে দিলেও আজ পর্যন্ত বড়দার সাথে খাতির আছে।"
দানা ওকে মিনতি করে, "অন্য কিছু কাজ দ্যাখ না ভাই। আর কয়েক বার যদি আমাকে সমুদ্রে যেতে হয় তাহলে আমি মারা যাবো রে।"
ফারহান মাথা চুলকে বলে, "দ্যাখ ভাই এখুনি হাতে ভালো কোন কাজ নেই। সেই আবার ট্যাক্সি চালাবি তার চেয়ে ভালো, কোন বড়লোকের গাড়ি চালানো। টাকাও আছে খাটনি বিশেষ নেই, এই অফিসে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসা। বাপ্পা নস্করের অনেক চেনাজানা, দেখি তাঁকে বলে যদি কারুর গাড়ি চালানোর কাজ পাওয়া যায়।"
দানা ওর হাত ধরে বলে, "হ্যাঁ ভাই তাই দ্যাখ। এই সমুদ্রে গিয়ে আর হুমকি মেরে বেশি দিন এইখানে থাকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।"
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment