CH Ad (Clicksor)

Sunday, March 8, 2015

পাপ কাম ভালোবাসা_Written By pinuram [ঊনত্রিংশ পর্ব (চ্যাপ্টার ০৫ - চ্যাপ্টার ০৬)]

আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




পাপ কাম ভালোবাসা
Written By pinuram





পর্ব ২৯ (#৫)

অনুপমার চিন্তার গতিতে বাধা প্রাপ্তি হয় পায়েলের হাতের ছোঁয়ায়, "কোথায় হারিয়ে গেলিরে? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি রে। আমারো খুব দুঃখ লাগছে, কিন্তু কি করতে পারি বল। পুলিস কি কিছু করছে?"

অনুপমা ছলছল চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে, একে কি দেবায়নের বিষয়ে বলা ঠিক হবে? শ্রেয়া আর রূপকের ওপরে সন্দেহ করেছে ভেবেই মনের ভেতরে কুণ্ঠাবোধ জেগে ওঠে। মন পরে থাকে নির্জীব শায়িত দেবায়নের পাশে। চোখ মুছে বহু কষ্টে হাসি টেনে বলে, "না রে, হারিয়ে যায়নি আমি। তোর সাথে একটু গোপন কথা আছে। ভাই ছাড়া আর কাউকে বলসি না যেন।"

পায়েল অধীর চিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধরা গলায় বলে, "পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি।"

কথাটা কানে যেতেই দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পায়েলের, অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, "কোথায় কেমন আছে, আমাকে এখুনি নিয়ে চল আমি ওকে দেখতে চাই।"

নির্জীব দেবায়নের মুখ মনে পড়তেই কেঁদে ফেলে অনুপমা, "কোমায় চলে গেছে রে আমার পুচ্চু....."

আঁতকে ওঠে পায়েল, "না....." বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে।

ধীরে ধীরে এক এক করে সব ঘটনা ব্যাক্ত করে পায়েলের কাছে। পায়েল ওকে প্রবোধ দেয় যে একদিন দেবায়ন ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। এই প্রবোধ নিশ্চিত কিনা জানা নেই তাও বান্ধবীর মুখে সান্ত্বনা বাক্য শুনে অনুপমার মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয়। শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, পায়েল জানায়, অনুপমার নির্দেশ মতন ওদের দেখাশোনার ভার শ্রেয়া করে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে এসে পায়েলকে সঙ্গে নিয়েই অফিসে যায়। নিজেকে অনুপমার স্থানে বসাতে চেষ্টা করেনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই অফিস আর পায়েল অঙ্কনকে সামলে রেখেছে।

রোজদিনের মতন একটু পরেই শ্রেয়া ওদের বাড়িতে আসে। অনুপমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "কিরে তুই এলি আর আমাদের খবর পর্যন্ত দিলি না? কি হয়েছে? কেমন আছিস? দেবুকে খুঁজে পেলি?"

ঝড়ের মতন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অনুপমা উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়ার ওপরে অহেতুক সন্দেহ করেছিল ভাবতেই ওর চোখে জল চলে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে শেষ পর্যন্ত দেবায়নের বিষয়ে বিস্তারে সব কথা জানায়। সব কিছু শোনার পরে শ্রেয়াও পায়েলের মতন অধৈর্য হয়ে ওঠে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য। অনুপমা জানায় এখন ওর কোলকাতায় কিছু কাজ বাকি আছে। ওরা জানতে চাইলে সত্য লুকিয়ে জানায় যে ধৃতিমানের বিষয়ে বিস্তারে খোঁজ নিতে চায়। এখুনি সবাই মিলে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুই করার নেই। পায়েল আর শ্রেয়াকে অফিসে চলে যেতে বলে।

পায়েল আর শ্রেয়া অফিসে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনুপমা ব্যাগ খুলে দেবায়নের বাড়ি থেকে আনা ফাইল খুলে বসে পড়ে। কন্সট্রাকশান কোম্পানির কাগজ খানা বারেবারে পড়ে দেখে। এই কাগজের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই কাগজের আসল অর্থ বের করতে পারলে দেবায়নের আসল উদ্দেশ্য অথবা খুনির আসল উদ্দেশ্য হয়ত জানা যাবে। দেবায়ন বিশেষ কিছুই জানায়নি নিবেদিতার সম্পর্কে। যদিও ওর বাবার সাথে নিবেদিতার অনেকদিনের পরিচয় কিন্তু কোনোদিন ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিল না নিবেদিতার। আর তার আসল কারন, মায়ের আর নিবেদিতার মনোমালিন্য। কি কারনে এই মনোমালিন্য, আর কি কারনে বাবার সাথে এত সুহৃদ সম্পর্ক। নিবেদিতার বিষয়ে বিস্তারে জানা দরকার। নিবেদিতার বিয়ে চোদ্দ বছর আগে একজন এন.আর.আইয়ের সাথে হয়েছিল, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নিবেদিতার ছেলে, অঙ্কুশের জন্ম ডিভোর্সের এক দেড় বছর পরে হয়। অঙ্কুশের পিতার পরিচয় অনুপমার অজানা, হয়ত এই পৃথিবীর অজানা। কোন গুপ্ত প্রেমের ফল স্বরূপ অঙ্কুশের জন্ম। হয়ত দেবায়ন এই বিষয়ে জেনে গিয়েছিল আর নিবেদিতাকে ব্ল্যাকমেিল করেছে। তাই কি নিবেদিতা ওকে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কোম্পানির কাগজ অন্য কথা বলছে। এই কাগজ অনুযায়ী, দুটি কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত করে একটা বড় কোম্পানির মালিক হতে চলেছে নিবেদিতা। কিন্তু কন্সট্রাকশান কোম্পানি মালিকানা নিবেদিতার নামে তাহলে দেবায়নের কি লাভ এইখানে?

ভাবতে ভাবতে হটাত মাথায় ঝিলিক খেলে যায় অনুপমার। অঙ্কুশ অবিকল ভাইয়ের ছোট বেলার মতন দেখতে, ঠিক সেই নাক সেই রকম কোঁকড়ানো চুল, গাল দুটো টোপাটোপা আর চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তের ছটা। বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক। অঙ্ক মেলাতে অসুবিধে হয় না। অঙ্কুশের পিতার সম্বন্ধে জানা দরকার। এই উত্তর পেয়ে গেলে ওর কাছে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।

মা নিবেদিতাকে দেখতে পারে না। মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখে। নিবেদিতার সম্বন্ধে মায়ের কাছ থেকে হয়ত অনেক কিছু জানা যেতে পারে ভেবেই অনুপমা কাগজ হাতে পারমিতার কাছে যায়।

পারমিতার ঘরে ঢুকে অনুপমা মাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।"

মেয়েকে ওইভাবে বিদ্ধস্ত রূপে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিতা প্রশ্ন করে, "হ্যাঁ, বল কি হয়েছে?"

অনুপমা একটু খানি থেমে জিজ্ঞেস করে, "নিবেদিতার সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল। তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনিবনা হয়না, তার কারন কি জানতে পারি?"

পারমিতা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে জরিপ করে উত্তর দেয়, "হঠাৎ নিবেদিতার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিস কেন? নিবেদিতার ওপরে কি তোর সন্দেহ হচ্ছে নাকি?" একটু থেমে, ওকে বসতে বলে, "দেখ অনু, পায়েলের কাছ থেকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি সব শুনেছি। আমি জানিনা আততায়ী কে। কিন্তু আর যাই হোক নিবেদিতা এই কাজ করতে পারে না ও সেই রকমের মেয়ে নয়।"

অনুপমা মাথা নাড়ায়, "না মা, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক কিন্তু তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনে না?"

পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, "হ্যাঁ, নিবেদিতার সাথে কোনোদিন আমার সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। তোকে শুরু থেকে বলি তাহলে। শ্বশুর মশায় মানে তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় থেকেই নিবেদিতার বাবা, মিস্টার চৌধুরী আর তোর জেঠু, রাজেশ এই কোম্পানি চালাত। তারপরে এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে আমার হাতে চলে আসে। কি ভাবে আসে সেটা তোর অজানা নয়।"

কথাটা বলার সময়ে কুণ্ঠাবোধে পারমিতার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, "ততদিনে নিবেদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে নিবেদিতার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপরে নিবেদিতার ডিভোর্স হয়ে যায় আর নিবেদিতা কোলকাতা ফিরে এসে কোম্পানির ভার সামলায়। আমার মাথায় এই ব্যাবসার প্যাঁচ কলাকৌশল কোনোদিন ঢুকত না তাই আমি বিশেষ কোনোদিন অফিসে যেতাম না। আমার কাজ ছিল অন্য, ক্লায়েন্ট ধরার জন্য আমি কি করতাম সেটাও তোর অবিদিত নয়। তোর বাবা নিজের অফিস আর এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি নিয়েই পড়ে থাকত। তবে তোর বাবার চেয়ে নিবেদিতা নিজের ঘাড়ে পুরো কন্সট্রাকশান কোম্পানির তত্তাবধনের ভার তুলে নেয়। এত কিছু করার পরেও ওর অংশ খুব কম ছিল আর সেই নিয়ে অখুশি ছিল। মাস গেলে আমার একাউন্টে মোটা টাকা আর তার তুলনায় যে সব কাজ করে তার একাউন্টে আমার চেয়ে অনেক কম টাকা। আমি অফিসে গেলেই আমার থেকে দূরে থাকত, আমার দিকে এক ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাত। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোন বচসা হয়নি কিন্তু নিবেদিতা আমাকে দেখতে পারত না। আমি অফিসের মালিক হয়েও কর্মচারীদের মধ্যে আমার বিশেষ কোন স্থান ছিল না। ওর এই নাক উঁচু ভাব, অফিসে সবাই ওকে সমীহ করে, সেই হিংসা, এইসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে নিবেদিতা খুব কর্মঠ মেয়ে, মার্জিত কিন্তু কঠোর, সুনিপুণ দক্ষতায় কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে।"

মায়ের মুখে নিবেদিতার স্তুতি শুনতে পাবে সেটা অনুপমার পক্ষে আশাতীত ছিল। ভেবেছিল হয়ত মা, নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, কিন্তু নিবেদিতার চরিত্রে কোন খুঁত ওর মা ওকে জানাতে পারল না। সব শুনে অনুপমা একটু চিন্তায় পরে যায়, "হুম, বুঝলাম সব কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাচ্ছি না। নিবেদিতার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তাই না?"

পারমিতা মাথা দোলায়, "হ্যাঁ।"

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, "ডিভোর্সের এক থেকে দেড় বছর পরে অঙ্কুশের জন্ম। অঙ্কুশের পিতা কে, সেই নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি?"

পারমিতার চেহারা হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। বার কতক ঢোঁক গিলে মেয়েকে প্রশ্ন করে, "হঠাৎ এই নিয়ে প্রশ্ন করলি কেন? কি জানিস তুই?"

মায়ের চেহারার এই ফ্যাকাসে রঙ অনুপমার তীক্ষ্ণ চাহনি এড়াতে পারে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি জানো, অঙ্কুশের বাবা কে?"

পারমিতা কঠিন ভাবে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে, "এই খবর তোর জেনে কি লাভ? অঙ্কুশের পিতার পরিচয়ের সাথে দেবায়নের এই দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক?"

পারমিতার চোখের এই কঠোর চাহনির পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে। এর উত্তর জানার জন্য ওকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কাগজ বের করতে হয়। কোম্পানির কাগজ হাতে নিয়েই পারমিতা রুদ্ধশ্বাসে অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জোড়া ছলকে ওঠে পারমিতার, অস্ফুট কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, "এই কাগজ কোথা থেকে পেয়েছিস তুই?"

অনুপমা মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে প্রশ্ন করে, "আমি শুধু এর উত্তর জানতে চাই মা। আততায়ী যেই হোক কিন্তু এই কাগজ পড়ার পরে আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছে। কে আসল দোষী। এই দেবায়ন কি আসলে আমার ভালোবাসার পুচ্চু নয়?"

পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে অস্ফুট আঁতকে ওঠে, "না, হ্যান্ডসামের মতন ছেলে হয় না। তোর পুচ্চু তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে অনু।"

ওর দেবায়ন যে ওকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে কিন্তু সেই কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার পরে ওর চোখ জোড়া ভেসে যায়। পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে মনে শক্তি জুগিয়ে বলে, "হ্যান্ডসাম ওর বিশাল হাতের মাঝে সবাইকে আগলে রাখতে চায়। সবাইকে মানে, তোকে, আমাকে, তোর বাবাকে পায়েল অঙ্কন সব্বাইকে। কোন কিছু ভেঙ্গে যাক সেটা কিছুতেই হ্যান্ডসাম চায় না। এই সম্পর্কের সম্বন্ধে আর এই কাগজের ব্যাপারে কিছু নাই বা জানলি।"

মায়ের চোখের জল দেখে অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না, অঙ্কুশ কেন অবিকল ওর ভাইয়ের মতন দেখতে। মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে, "তাহলে তুমি জানতে আগে থেকে?"

সম্মতি জানিয়ে মৃদু মাথা দোলায় পারমিতা, "হ্যাঁ, আমি সব জানি তবে আগে জানতাম না। দেবায়ন কি ভাবে যেন এই সব কিছু জেনে গিয়েছিল আর সেই আমাকে বুঝিয়ে বলে। প্রথমে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু হ্যান্ডসামের কথা শুনে মনে হল, ভালো কি শুধু একটা মাত্র মানুষ কেই বাসা যায়? তোর বাবা আগে আমাকে সেই ভাবে ভালবাসত না, আর সেই কারনেই নিবেদিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আমি এতদিন তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমি এতদিন এরতার বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি। নিবেদিতা আর তোর বাবা একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে আর এই দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে কাটাতে সাথে তোর বাবার সাথে নিবেদিতার প্রেম হয়ে যায়। আর....."

অনুপমা ছলছল চোখে কম্পিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, "অঙ্কুশ তাহলে আমার ভাই?"

পারমিতা সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলায়, "হ্যাঁ, অঙ্কুশ তোর ভাই, তোর রক্ত।"

অনুপমার মাথার শিরা ঝনঝন করে ওঠে। পারমিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "তবে দেবায়ন কাউকে আঘাত করতে চায়নি তাই তোকে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করায়। শুরুতেই যদি দেবায়ন তোকে সব কিছু বলে দিত তাহলে তুই কাউকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতিস না তাই তোর সাথে নিবেদিতার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তুই যেমন আমাকে ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল অন্তত নিবেদিতার সাথে তোর বান্ধবীর মতন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। অঙ্কনকে যেমন ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল ঠিক সেই ভাবে অঙ্কুশের ওপরে তোর যেন সেই স্নেহ গড়ে ওঠে। তারপরে তোর হাত ধরে নিবেদিতার সাথে পায়েল আর অঙ্কনের সুহৃদ সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই গ্রুপ কোম্পানি আমাদের পরিবারের মধ্যেই রয়েছে। নিবেদিতাকে কন্সট্রাকশান কোম্পানির সম্পূর্ণ ভার দেওয়া দেবায়নের মাথার উপজ। তোর বাবা আর দেবায়ন হোটেল নিয়ে থাকবে এই ঠিক হয়, আর তুই পায়েল আর অঙ্কন তোর আই.টি কোম্পানি নিয়ে থাকবি। এই ভাবেই দুই পরিবার এক করতে চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তোর বাবা সব শুনে সেদিন দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই প্রথম সোমেশকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভালোবাসা বড় কঠিন বস্তু, তাই নয় কি অনু?"

সব কিছু শোনার পরে অনুপমা চোখ বন্ধ করে বসে পরে। ওর দুই চোখ বেয়ে অঝোর ঝারায় অশ্রুর বন্যা বয়ে চলে, এত ভালোবাসা রাখবে কোথায়? একটি মাত্র জীবন ওর কাছে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, অবুঝের মতন কিছু না জেনেই বাবাকে, নিবেদিতাকে, রূপককে সন্দেহ করেছিল। এরা সবাই ওর জন্য ভাবে, ওর জন্য চিন্তা করে, ওর দুঃখে দুঃখিত হয়, ওর হাসিতে হাসে।

পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "জানি দেবায়ন চলে যাওয়াতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি তোর জীবনে দেবায়নের জায়গা আমরা কেউই পূরণ করতে পারব না তবে আমরা সবাই তোর পাশে আছি রে অনু।"

অনুপমা ফুঁপিয়ে ওঠে, মায়ের সান্ত্বনা বাক্য শোনার পরে মনে হয় মাকে সত্যি বলা ভালো, "পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি। তবে....."

পারমিতা ওই শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "এই কথা কেন আমাদের জানাস নি?"

অনুপমা ধরা গলায় উত্তর দেয়, "তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কে আসল দোষী তাই।"

পারমিতা ওকে প্রশ্ন করে, "দেবায়ন কোথায়, কেমন আছে?"

অনুপমা ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, "খুব খারাপ অবস্থায় আছে মা। জানি না কি হবে। ওর অনেক হাড় ভেঙ্গে গেছে। দেবায়ন কোমায় চলে গেছে, মা। আমি কি করব মা?" বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনুপমা।

মেয়ের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "দেবায়নকে যখন খুঁজে পেয়েছিস তখন কোমায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক ও তোর কাছে ফিরে আসবেই। তুই চিন্তা করিস না। দেবশ্রীদি এই বিষয়ে জানে?"

অনুপমা মাথা দোলায়, "হ্যাঁ জানে। মামনি খুব ভেঙ্গে পড়েছে।"

পারমিতা জিজ্ঞেস করে, "দেবশ্রীদি কোথায়, দেবায়ন কোথায়?"

চোখের জল মুছে অনুপমা উত্তরে বলে, "দেবায়নকে আমি দিলিপ বাবুর কাছে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মামনি দেবায়নের কাছে।" তারপরে মাকে সব কথা বিস্তারে জানায় অনুপমা।

সব কিছু শোনার পরে পারমিতা ব্যাস্ত হয়ে যায়, ওকে বলে, "আমি এখুনি তোর বাবাকে ফোন করছি। আমরা থাকতে এই সময়ে দেবশ্রীদি একা থাকতে পারে না। আমি এখুনি তোর বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেতে চাই।"

পারমিতা সঙ্গে সঙ্গে, সোমেশ বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনুপমার বাবা সব কিছু শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে যান। বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে বাবার সামনে যেতে দ্বিধা বোধ করে অনুপমা। কিন্তু ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এই কথা ওর বাবা জানতে পারবে না। পারমিতা ওকে সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অনুপমা জানায় ওর বদলে পায়েলকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাক। অনুপমা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। ওর সন্দেহের তালিকার শেষ ব্যাক্তি, ধৃতিমানের বিষয়ে কিছুই তল্লাসি করা হয়নি। হয়ত এইবারে ওর তীর সঠিক স্থানে লাগবে।







পর্ব ২৯ (#০৬)

ঠিক সেই সময়ে পায়েল অফিস থেকে একাই ফিরে আসে। ওকে দেখে অনুপমা ওকে মা বাবার সাথে ব্যাঙ্গালোর যেতে বলে। পায়েল সেই শুনে খুব খুশি হয় সেই সাথে অনুপমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে যে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। শ্রেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে পায়েল ওকে জানায়, কিছু আগে রূপকের নামে অফিসে কুরিয়ারে একটা চিঠি আসে। সেই চিঠি পড়ে রূপক আর শ্রেয়া তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায়। খবর শুনে অনুপমা ওকে ওই চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।

পায়েল ওর হাতে একটা সাদা খাম দিয়ে জানায়, "এই খামটা আসার পরেই শ্রেয়া আর রূপক বেড়িয়ে পড়েছে। তুই অহেতুক চিন্তা করে শরীর খারাপ করবি তাই রূপক তোকে জানাতে বারন করেছিল। তুই চিন্তা করসি না, রূপক ঠিক ওই আততায়ীকে খুঁজে বের করবে। তুই আমাদের সাথে ব্যাঙ্গালোর চল।"

সাদা খামের মধ্যে কাগজটা হাতে ধরে দেখে অনুপমা। একটা সাদা কাগজে ইংরেজি হরফে কম্পিউটার প্রিন্টে লেখা, "যদি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানতে চাও তাহলে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে কাল ভোরের মধ্যে লাভা পৌঁছাও। একা আসবে, কাউকে সাথে নিয়ে এলে বিপদ।"

অনুপমা চোখের জল মুছে দৃঢ় কণ্ঠে ওকে বলে, "না আততায়ীকে খুঁজে ওকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না রে।" ওর হাতে হাত রেখে বলে, "আমার কিছু কাজ আছে পায়েল। তুই মায়ের সাথে ব্যাঙ্গালোর যা। আমি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি যদি আততায়ীর আসল পরিচয় জানা যায়।"

অঙ্কন বাড়ি এলে, বিকেলের মধ্যে সোমেশ বাবু পারমিতা, পায়েল আর অঙ্কনকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ফাঁকা বাড়িতে থাকতে একদম ভালো লাগে না অনুপমার। ধৃতিমানের বিষয়ে এখন কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। নিবেদিতার ওপরে সন্দেহ করেছিল ওর কাছে একবার যাওয়া উচিত। সাত পাঁচ ভেবে গাড়ি নিয়ে নিবেদিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে অনুপমা।

পথে যেতে যেতে রূপককে ফোন করে, "তুই কোথায়?"

রূপক গাড়ি চালাচ্ছিল তাই শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে উত্তর দেয়, "কেমন আছিস তুই?"

অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, "তোরা কোথায়?"

শ্রেয়া উত্তর দেয়, "এই একটু বেড়িয়েছি, কাল বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব।"

অনুপমা ধরা গলায় বলে, "আমাকে জানাতে দোষ? পায়েল আমাকে সব বলেছে।"

শ্রেয়া ওকে উত্তর দেয়, "নারে সোনা, তুই একা নস। আমরা সবাই মিলে ঠিক দেবায়নের আততায়ীকে খুঁজে বের করব। তুই একটু বিশ্রাম কর আমরা কাল বিকেলের মধ্যে কোলকাতা ফিরে এসে তোকে সব কিছু জানাব।"

অনুপমা ওদের সাবধানে যেতে বলে দেয় আর লাভা পৌঁছে যেন একটা ফোন করে বলে জানিয়ে দেয়। শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা সাবধানেই যাবে বলে ফোন রেখে দেয়। অনুপমা ভাবতে বসে কি ভাবে নিবেদিতার সামনে যাবে। বাবা আর নিবেদিতার সম্পর্কের বিষয়ে জানার পরে ওর সামনে দাঁড়ানো ওর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর। নিবেদিতা এতদিন হাসিমুখে ওর সাথে বান্ধবীর মতন ব্যাবহার করে গেছে। এর মূলে দেবায়নের মাথা ছিল সেটা অনুপমা এতদিন জানত না, আর অহেতুক দেবায়ন আর নিবেদিতার মাঝের এক বিতর্কিত সম্পর্কের আভাস খুঁজে বেড়াচ্ছিল বলে নিজেকে ধিক্কার দেয়।

এমন সময়ে ওর কাছে পরাশরের ফোন আসে, "তুই কোথায়? আজকে আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল তোর। বেশ কিছু খবর পাওয়া গেছে।"

অনুপমা উৎসুক হয়ে ওঠে, "কি খবর?"

পরাশর উত্তর দেয়, "আজকে কাকা ঘনসিয়ালির পুলিস ইনস্পেকটর রোহনকে ফোন করেছিল। যে ছেলেটা সেই রাতে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, সেই ছেলেটার লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের মধ্যে। তবে ওই ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেছে কিন্তু তাতে বিশেষ কিছুই লাভ হয়নি। ওই ছেলেটা ওই এলাকার ছেলে। রঞ্জিতের সাথেও কথাবার্তা বলেছে কাকু। আমরা যে সব জিনিস পত্র ওই জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেই গুলো নিয়ে তুই যদি একবার বাড়িতে আসিস তাহলে বেশ ভালো হয়।"

অনুপমা ওকে বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখুনি তোর বাড়িতে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ এইদিকে আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। কেউ একজন আজকে অফিসে রূপকের নামে একটা কুরিয়ার করে চিঠি পাঠিয়ে বলেছে যে সে নাকি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানে। তাই শ্রেয়া আর রূপক লাভার জন্যে বেড়িয়ে গেছে।"

পরাশর খানিকক্ষণ ভাবার পরে বলে, "রূপকের নামে চিঠি? ঠিক মিলছে না। হঠাৎ রূপকের নামে কেন চিঠি পাঠাতে যাবে? তুই কি সেই চিঠি দেখেছিস?"

অনুপমা উত্তরে জানায়, সেই চিঠি ওর হাতে। বাড়ি ফিরে যে সব জিনিসপত্র জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছিল সেই সব নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বাড়ি পৌঁছে যাবে। গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি থেকে প্লাস্টিক ভর্তি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে পরাশরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিবেদিতার বাড়ি আর এই যাত্রায় যাওয়া হয় না।

পরাশরের বাড়ি যাওয়ার পথে নিজেই একবার সেই চিঠি খুলে দেখে। বারেবারে পড়েও বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারে না। তারপরে ওর মনে হয়, হঠাৎ এই চিঠি রূপকের নামে কেন এসেছে? আততায়ী কি রূপককে চেনে? যদি আততায়ী রূপক আর দেবায়ন দুই জনকে চেনে তাহলে ওদের অফিসের লোক ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কারন রূপক যাদবপুর থেকে পাশ করেছে আর দেবায়ন অন্য একটা কলেজ থেকে পাশ করেছে। দুইজনের দেখা সাক্ষাৎ শুধু মাত্র এই অফিস ছাড়া আর কোথাও নয়। আততায়ী নিশ্চয় এই দুইজনার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চায়। সেই রকম হলে একমাত্র ইন্দ্রনীলকে সন্দেহ হয় কিন্তু ইন্দ্রনীল অনেকদিন থেকেই দেশে আসেনি আর মিস্টার হেরজোগ খবর নিয়েছেন যে ইন্দ্রনীল বর্তমানে লন্ডনে। ইন্দ্রনীল ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তি যার সাথে দেবায়ন আর রূপকের শত্রুতা হতে পারে সে মানুষ সূর্য। কিন্তু রূপক খবর নিয়ে দেখেছে যে সূর্য সেই সময়ে কোলকাতায় ছিল আর ওর এই কাজ করার ক্ষমতা নেই।

খাম খানা উল্টে পাল্টে দেখে অনুপমা। কোথা থেকে এসেছে সেটা একমাত্র অফিসের রেজিস্টারে খুঁজে পাওয়া যাবে। রাত হলেও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারকে অফিসে নিয়ে যেতে বলে। অত রাতে অফিসে শুধু মাত্র নেটওয়ার্কের ছেলেরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। গার্ড ওকে দেখে রীতিমতন অবাক হয়ে যায়। অনুপমা রিসেপসানে বসা গার্ডের কাছে কুরিয়ারের রেজিস্টার চেয়ে ওই চিঠির ঠিকানা খুঁজে বের করে। চিঠিটা দুই দিন আগে, লাভা থেকে রূপকের নামে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠি আততায়ী নিজেই পাঠিয়েছে, নিশ্চয় এইবারে রূপকের ওপরে হামলা করবে। খাটলিং, লাভা সব পাহাড়ি এলাকা খুঁজেছে আততায়ী। বেশ বুদ্ধি ধরে যাতে নির্জনে আততায়ী নিজের কাজ হাসিল করতে পারে। অফিসের কারুর সাথে দেবায়ন আর রূপকের একত্রে শত্রুতা হতে পারে না তবুও একবার সন্দেহ দুর করার জন্য মনীষাকে জিজ্ঞেস করা। সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা মনীষাকে ফোন করে জানতে চায় ওদের অফিসের কেউকি লম্বা ছুটিতে গেছে? মনীষা উত্তর দেয়, কেউই লম্বা ছুটিতে যায়নি। আরো জানায় যেদিন দেবায়নের এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেদিন অফিসে সবাই এসেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা, আবার শ্রেয়াকে ফোন করে। বার কতক ফোন বেজে যাওয়ার পরে শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি রে কি হয়েছে?"

অনুপমা উদ্বেগজনিত কণ্ঠে ওকে বলে, "তোরা এখন কোথায়?"

শ্রেয়া বলে, "এই বহরমপুর পেরিয়েছি। কেন কি হয়েছে?"

অনুপমা উত্তর দেয়, "তোরা লাভা যাস নে। ওই চিঠি আততায়ী নিজে লিখেছে যাতে রূপককে মারতে পারে। তোরা ফিরে আয় এখুনি ফিরে আয়।"

শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "মানে? না আমরা এর শেষ দেখে তবেই ফিরব। যদি আততায়ী নিজেই দেখা করতে চেয়েছে তাহলে ওকে শেষ করেই ফিরব। তুই চিন্তা করিস না অনু....."

অনুপমা কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে, "প্লিস শ্রেয়া, আমার কথা শোন। আমি জানি তোরা সবাই দেবায়নের জন্য চিন্তিত কিন্তু এই আততায়ী দেবায়ন আর রূপক, দুইজনের শত্রু। আততায়ী দুইজনকে মারতে চায় তাই ত আর কারুর নামে চিঠি পাঠায়নি শুধু মাত্র রূপকের নামে পাঠিয়েছে। প্লিস আমার কথা শোন তোরা ফিরে আয়।"

শ্রেয়া উত্তর দেয়, "ঠিক আছে আমরা ফিরে আসছি। কাল সকালে দেখা হবে।"

কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা বলে, "না তোরা আমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা কর। আমি আসছি আর দেরি করলে চলবে না, হাতেনাতে আততায়ীকে ধরতে হবে এইবারে।"

শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা অনুপমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা করে থাকবে। অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে পরাশরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ও বহরমপুরের জন্য যাত্রা করছে। পরাশর সঙ্গে যেতে চাইলে জানায় ওকে পথে উঠিয়ে নেবে। পরাশরকে উঠাতে গিয়ে ওর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেক্টর নিরঞ্জন বাবুর সঙ্গে দেখা হয়। নিরঞ্জন বাবু জানিয়ে দেন তিনি তার টিম নিয়ে ওদের পেছনে থাকবে। অনুপমা আর পরাশর গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করে দেয়। ওদের অনেকদিনের ড্রাইভার, কমল এতদিনে বুঝে গেছে দেবায়নের কি হয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার তীর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়।

অনুপমা পরাশরকে বলে, "আমরা এতদিন ভুল পথে তদন্ত করছিলাম। আমাদের শেষের দিক থেকে তদন্ত না শুরু করে শুরুর দিক থেকে তদন্ত শুরু করা উচিত ছিল। আসল তদন্তের সব কিছু তোমার হাতের কাছে। দেখা যাক আমরা কি কি খুঁজে পেয়েছি।"

অনুপমা সিটের ওপরে প্লাস্টিকের ব্যাগ রেখে জঙ্গল থেকে আনা জিনিস পত্র গুলো এক এক করে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে দেয়। সিগারেট প্যাকেট দেখে পরাশরকে বলে, "আততায়ী বেশ বড়লোক না হলে ক্লাসিক রেগুলার খায় না।" কয়েকটা কাগজের টুকরো ঘেঁটে দেখে বলেন, "আততায়ী এই কোলকাতার লোক, এই দেখ।" বলে একটা খবরের কাগজের টুকরো পরাশরের হাতে ধরিয়ে কোনার দিকে দেখিয়ে বলে, "এটা স্টেটসম্যান কাগজ। গ্রামের লোকটা বলেছিল যে আততায়ী পাঞ্জাবী কিন্তু আততায়ী বাঙ্গালী আর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য পাঞ্জাবী সেজেছে। আততায়ী আমাদের ওই খাটলিং যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল। রূপকের ইমেল গুলো যদি চেক করা যায় তাহলে আই পি এড্রেস পাওয়া যাবে।" কুরিয়ারের চিঠিটা হাতে নিয়ে ভালো ভাবে দেখে বলে, "হুম, এই চিঠি লাভা থেকে পাঠানো হয়েছে। ওইখানে এই কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুব কম হবে নিশ্চয়। এই চিঠির ডকেট নাম্বার দেখালে অনায়াসে দুই দিন আগে কে এই চিঠি পাঠিয়েছে সেটা জানা যাবে। আততায়ীর একটা চেহারা পাওয়া যাবে। লাভা খুব ছোট জায়গা, আততায়ীকে দিনের আলোতে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ অসুবিধে হবে না।"

পরাশর অবাক হয়ে অনুপমার তারিফ করে বলে, "তুই একেবারে শার্লক হোমস হয়ে গেছিস দেখছি।"

অনুপমা স্মিত হেসে মাথা দোলায়, "না রে অতদুর সাগর পাড়ে কেন যাচ্ছিস। আমাদের গড়পার ফেলুদা হতে একটু চেষ্টা করছি আর তুই আমার তোপসে।"

কমল হুহু করে গাড়ি চালিয়ে রাত বারোটার মধ্যে বহরমপুরে পৌঁছে যায়। ওদের দেখে রূপক আর শ্রেয়া ওদের থেমে যাওয়ার কারন জিজ্ঞেস করে। অনুপমা বিস্তারে সব কিছু খুলে বলার পরে ওরা সবাই আবার যাত্রা শুরু করে দেয়। কমল, রূপকের গাড়ি চালায় আর ওরা চারজনে অনুপমার গাড়ি করে লাআভ্র উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পেছনে নিরঞ্জন বাবু একটা গাড়িতে কয়েক জন সাদা পোশাকের পুলিস নিয়ে ওদের অনুসরন করেন। সবার মধ্যে টানটান চাপা উত্তেজনা কারুর চোখে মুখে ক্লান্তির লেশ মাত্র নেই। রূপক চরম ক্ষোভে এক প্রকার গজগজ করতে করতে দ্রুত বেগে গাড়ি চালায়।

অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, "তুই অত টাকা পেলি কোথা থেকে রে?"

শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, "সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন। তোর জন্য সব কিছু দিতে রাজি।"

অনুপমার দুই চোখ ছলকে ওঠে, "একবার আমাকে জানাতে পারলি না?"

শ্রেয়া ওর গালে আলতো চাপড় মেরে বলে, "তুই ও আমাদের দেবুর ব্যাপারে জানাস নি তাই না? তোর মাথার অবস্থা আমি বুঝি রে অনু। ছাড় সেই সব কথা এখন ওই আততায়ীকে ধরাটা আমাদের আসল উদ্দেশ্য।"

ভোরের দিকে জলপাইগুড়ি হয়ে ওদের গাড়ি লাভার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শিলিগুরি থেকে সেবক রোড ধরে। কমল জানায়, কালিম্পং হয়ে লাভা যাওয়ার চেয়ে গরুবাথান হয়ে লাভা পৌঁছাতে অনেক সহজ তাই ওরা মালবাগান টি এস্টেটের রাস্তা ধরে গরুবাথান হয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ লাভা পৌঁছে যায়। এই লাভাতেই ওদের জন্য আততায়ী অপেক্ষা করে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা চারপাশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগোতে থাকে। সাদা পোশাকে নিরঞ্জন বাবু ওদের সাথে থাকেন। আড়াল থেকে নিশ্চয় আততায়ী ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা কিছুই জানায় নি আততায়ী। তার অর্থ, আততায়ী নিশ্চয় এইবারে ওদের সাথে যোগাযোগ করে জানাবে কোথায় দেখা করতে চায়। কিন্তু ওদের দেরি দেখে নিশ্চয় আততায়ী সতর্ক হয়ে গেছে।

কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুঁজে পেতে ওদের বেশি দেরি লাগে না। চিঠি আর ডকেট নাম্বার দেখতেই কুরিয়ার নেওয়ার মেয়েটা খাতা দেখে জানায় যে তিন দিন আগে একজন এই চিঠিটা দুপুর বেলায় কুরিয়ার করেছে। নিরঞ্জন বাবু মেয়েটাকে বলেন এটা খুনের কেস এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ওই লোকটার বিষয়ে জানতে চান। মেয়েটা জানায় যে লোকটা কোন পাঞ্জাবী নয়, তিনি দাড়ি গোঁফ ওয়ালা একজন বাঙ্গালী মুসলমান, নাম মহম্মদ ইকবাল হোসেন। রেজিস্টার খুঁজে ইকবালের মোবাইল নাম্বার ওদের লিখে দেয়। নিরঞ্জন বাবু ওই মোবাইল নাম্বারে ফোন করে দেখেন মোবাইল নাম্বার ভুয়ো। তার অর্থ এই নাম এই বেশ ভুষা সব মেকি। মেয়েটা আরো জানায় যে আগন্তুকের বয়স পঞ্চাসের কাছাকাছি, মাঝারি গড়ন, ঘন ঘন সিগারেট খান। ওদের কুরিয়ার কোম্পানির সামনে একটা চায়ের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তারপরে এদিক ওদিক দেখে অনেক ওরে ওদের দোকানে কুরিয়ার করতে ঢুকেছিল। মেয়েটার দেওয়া আগন্তুকের বিবরন অনুযায়ী একটা ছবি আঁকে রূপক। সেই ছবি দেখে মেয়েটা জানায় যে আগন্তুক অনেকটা এই ছবির মতন দেখতে। একটা ছবি যখন পাওয়া গেছে তাহলে এইখানে খুঁজে বের করতে বিশেষ অসুবিধে হবে না ওদের। ওই ছবিটার বেশ কয়েকটা জেরক্স করিয়ে নিয়ে নিরঞ্জন বাবু তার সাথে আসা সাদা পোশাকের অফিসারদের হাতে দিয়ে আশে পাশের হোটেল গুলোতে খোঁজ নিতে বলেন।

খুঁজতে খুঁজতে একটা হোটেলের লোকের কাছ থেকে জানতে পারে যে এই রকম দেখতে একজন দুই দিন আগে ওদের হোটেল ছিল। তবে সেই আগন্তুকের নাম মহম্মদ ইকবাল নয়, তার দাড়ি গোঁফ ছিল না, তিনি একজন বাঙ্গালী, নাম রাজেশ সেন। অনুপমা চমকে ওঠে, এই নাম ওর প্রয়াত জেঠুর নাম। কিন্তু জেঠু প্রায় কুড়ি বছর আগে মারা গেছেন।

নিরঞ্জন বাবু অনুপমাকে শান্ত করে বলেন, "অত চমকে যাওয়ার কিছু নেই অনুপমা। এটা নিতান্ত কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। এখন পর্যন্ত যা যা নামধাম পাওয়া গেছে তার সবটাই ভুয়ো, সুতরাং এই হোটেলে যে ঠিকানা অথবা নাম আগন্তুক লিখিয়ে গেছে সেটাও ভুয়ো হবে। তবে লাভা বেশি বড় জায়গা নয় আততায়ীকে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না।"

হোটেলের লোকের কাছ থেকে আগন্তুকের ছবি চায় নিরঞ্জন বাবু। ছবি দেখে চমকে যাওয়ার পালা এইবারে নিরঞ্জন বাবুর। ছবি হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরে তিনি অবাক হয়ে বলেন, "এই লোক?" এই বলে তিনি অনুপমার হাতে ছবি ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "চিনতে পারছ একে?"

অনুপমা মাথা নাড়ায়, "না, এই ব্যাক্তিকে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।"

নিরঞ্জন বাবু স্মিত হেসে বলেন, "হুম, তোমার না চেনার কথা তবে রূপক আশা করি চিনতে পারবে।" বলে রূপকের হাতে ছবি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "কি রূপক চিনতে পারছ?"

রূপক মাথা নাড়ায়, "ঠিক মনে পড়ছে না।"

নিরঞ্জন বাবু বলেন, "ভুলে গেলে একে? তোমাকে আর দেবায়নকে খুন করার এনার কাছে সব থেকে বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। তোমাকে এই আগন্তুক রাস্তায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল এই লাভাতে নয়। তাই ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা লেখা নেই। তোমাকে সকালে এই জায়গায় আসতে বলার একটা মাত্র কারন কেননা সকালের দিকে রাস্তায় কুয়াশা হয়, পাহাড়ি রাস্তায় কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানো দুঃসাধ্য। তোমার গাড়িকে খাদে ফেলে দুর্ঘটনার রূপ দিয়ে দিত আততায়ী, তুমি জানতে পারতে না কে তোমাকে মারল। আমি হলফ করে বলতে পারি আততায়ী আমাদের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল কিন্তু সাধারণত সব মানুষ কালিম্পং হয়ে লাভা আসে। যেহেতু আমরা গরুবাথান হয়ে লাভা এসেছি সেই জন্য আততায়ী আর সুযোগ পায়নি আক্রমন করার। চল এইবারে আআদের বেড়িয়ে পড়তে হবে। আততায়ী ট্রেনে করে ফিরবে বলে মনে হয় না, নিশ্চয় প্লেন ধরবে। বাগডোগরা গিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলেই বোঝা যাবে।"

রূপক বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলে, "আচ্ছা এইবারে চিনেছি কে। শালা এইবারে আর আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।"

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, "কে এই লোক?"





কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 





পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

পিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment