আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
অসীম তৃষ্ণা
Written By pinuram
Written By pinuram
সপ্তম পর্ব
(#০১)
তিস্তার সাথে গল্প করলেও আদির মন পড়ে থাকে ওর রূপসী মায়ের কাছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিস্তার নরম পাছার আর নরম স্তন জোড়া আদর করতে করতে ওরা দুইজনেই আবার কামোত্তেজিত হয়ে ওঠে। তৃষ্ণার্ত দুই নর নারী আবার মেতে ওঠে কামনার খেলায়। এইবারে দুইজনেই বেশ সময়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের শরীর নিয়ে মেতে ওঠে।
বিকেল ছ’টা বাজে, এমন সময়ে আদির ফোন বেজে ওঠে। একটা অজানা ফোন নাম্বার থেকে ফোন আসায় আদি একটু বিরক্ত হয়ে যায়। কামসুখে পরিতৃপ্ত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল, এর মাঝে উটকো ফোন দেখে মাথা গরম হয়ে যায়।
ফোন তুলে বিরক্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করে, "হ্যালো কে বলছেন?"
ওইপাশের অজানা আগন্তুকের কণ্ঠ স্বর, "হ্যালো, আপনি কি মিস্টার আদিত্য সান্যাল?"
আদি উত্তর দেয়, "হ্যাঁ। কি ব্যাপার আপনি কে?"
আগন্তুক উত্তর দেয়, "আপনি ঋতুপর্ণা নামে কাউকে চেনেন?"
হঠাৎ এক অজানা অচেনা ব্যাক্তির মুখে মায়ের নাম শুনে আশঙ্কায় আদির বুক কেঁপে ওঠে। তিস্তাকে ছেড়ে উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়িয়ে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ, আমার মা। কেন মায়ের কি হয়েছে?"
আগন্তুক উত্তর দেয়, "তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসুন। আপনার মায়ের গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে।"
আদির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে আসে। সমগ্র পৃথিবীতে মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। না, একটু ভুল ভাবনা, হয়তো বাবা ওর পাশে থাকবে। তবে মায়ের এই দুর্দিনে ওদের পাশে সত্যি কি এসে দাঁড়াবে। সেটা আদৌ আদি জানে না। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। কঠিন চোয়াল, দাঁতে দাঁত পিষে অশ্রু সংবরণ করে আগন্তুক কে জিজ্ঞেস করে, "কি ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে? কোথায় হয়েছে?"
আগন্তুক শুধু মাত্র হসপিটালের নাম জানিয়ে ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে। তিস্তা আদির চেহারা দেখে উৎকণ্ঠা ব্যাক্ত করে। কিন্তু আদির নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হয়। কেন মাকে একা ছাড়তে গেল। যদি মাকে একটু রাজি করানো যেত তাহলে হয়তো মা প্রদীপের সাথে দেখা করতে যেত না। কিন্তু আদির যৌন তৃষ্ণা বড় বেড়ে গিয়েছিল। ওর লিঙ্গ এক যোনি রসে মাখামাখি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। চোয়াল চেপে তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে নেয়। তিস্তা ওকে কারন জিজ্ঞেস করাতে আদি সংক্ষেপে জানায় যে মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেই শুনে তিস্তা আঁতকে ওঠে।
আদি ছলছল চোখে তিস্তাকে অনুরোধ করে ওর সাথে হসপিটাল যেতে। তিস্তা কৌশিকের আসার উছিলা দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। বলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার কোন কথাই কৌশিক জানে না, সুতরাং এমত অবস্থায় কিছুতেই আদির সাথে হসপিটালে যেতে পারবে না বলে আক্ষেপ ব্যাক্ত করে। আদির শরীর তিস্তার প্রতি ঘৃণায় রিরি করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে তিস্তার সাথে ঝগড়া করার মতন মানসিকতা ওর থাকে না।
জামা প্যান্ট পড়তে পড়তে আদি তিস্তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "সত্যি তোমার মতন সুবিধাবাদী মেয়ে আর দুটো দেখিনি।"
তিস্তা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে, "প্লিজ আদি একটু বোঝার চেষ্টা করো। কৌশিক সত্যি জানে না তুমি আমার কাছে এসেছো। প্লিজ, আদি। ঋতুপর্ণা দিকে আমি সত্যি খুব সন্মান করি। তুমি যাও, আমি কৌশিককে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছে যাবো।"
আদি চোয়াল চেপে তিস্তাকে উত্তর দেয়, "না আর অত দরদ দেখাতে এসো না। আমি চললাম।"
তিস্তা ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে কৌশিক ফিরে এলে ওকে সঙ্গে নিয়ে হসপিটাল যাবে। কিন্তু আদি আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে বাইরে এসে দেখে আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি করে হসপিটাল পৌঁছে যায়।
হসপিটালে পৌঁছাতেই এদিক ওদিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে যে ওর মা গাড়ি এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হয়েছে। এমারজেন্সিতে গিয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন আগন্তুক ওর দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেয়। "আমি রবিন। আপনার মায়ের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে।"
আদি মাথা চেপে বসে পড়ে।
রবিন আদির কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "আপনার মা একটা রেড লাইট জাম্প করেছিল। অন্যদিক থেকে একটা বাস এসে গাড়ির ডান দিকে ধাক্কা মারে। রাস্তার ওপরে গাড়িটা পালটি খেয়ে যায়। সিট বেল্ট বাঁধা না থাকার ফলে আপনার মা বামদিকের সিটের ওপরে পড়ে যায়। গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে মাথায়, গালে গলায় ঢুকে গেছে। লোকজন ছুটে আসে আপনার মাকে বাঁচাতে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে শুধু মাত্র আপনার নাম নিয়েছিল। ওনার মোবাইল থেকে আপনার নাম বের করে আমি আপনাকে ফোন করি। তারপরে পুলিস আর এ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে এই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।"
আদি রবিন বাবুর হাত ধরে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, "আমার মা বেঁচে যাবে তো?"
রবিন বাবু খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলেন, "দেখুন আমি ডাক্তার নই তবে ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওপর ওয়ালার ওপরে ভরসা রাখুন আপনার মা ঠিক হয়ে যাবে।"
ডাক্তারেরা মাকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে চলে গেছে। আদি অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে মাথা ঠোকে। নিজেকে দোষারোপ করে। কেন মাকে একা ছাড়ল, কেন মাকে বুঝাতে পারল না যে প্রদীপের কাছে না গিয়ে ওর সাথে বিকেলটা বাড়িতে কাটাতে। কেন নিজের যৌন ক্ষুধার তাড়নায় তিস্তার কাছে গেল। ইত্যাদি ভেবে নিজেকে দোষারোপ করে আদি।
উৎকণ্ঠায় আর প্রচন্ড আশঙ্কায় আদির গলা শুকিয়ে আসে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আবার কখন দুরদার করে হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করে দেয়। আত্মীয় সজ্জন বলতে ওর কেউ নেই। সাহায্যের জন্য কাকে ফোন করবে ভাবতে ভাবতে আদি কমল জেঠুকে ফোন করে সব জানাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কমল জেঠু কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে চলে আসেন। কমল জেঠু ওকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে ঋতুপর্ণা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ছেলের মন কি আর সেই কথা মানে। যতক্ষণ না মাকে চোখের সামনে দাঁড়াতে দেখতে পারবে ততক্ষণ আদির স্বস্তি নেই।
কমল বাবু নিজে একজন বড় ডাক্তার। ঋতুপর্ণাকে চিকিতসারত ডাক্তার, ডক্টর অবিনাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদিকে জানায় মাথার আঘাত বেশ গুরুতর তবে প্রাণের আশঙ্কা নেই। সেই শুনে আদি মনে বল পায়। নার্স এসে জানায় এখুনি চার বোতল রক্তের দরকার। আদি নিজের বন্ধুদের ফোন করে। এক বোতল রক্ত এখুনি দিতে পারবে, কিন্তু বাকি তিন বোতলের জন্য বন্ধুদের ডাকে। অনির্বাণ বেশ কয়েকজন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে যায়। এর মাঝে পুলিস ওদের কাছে এসে গাড়ি থেকে পাওয়া ঋতুপর্ণার মোবাইল পার্স ইত্যাদি দিয়ে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই তিস্তা আর কৌশিক, হসপিটালে এসে হাজির হয়। আদি তখন কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলার মতন অবস্থায় ছিল না। তাও তিস্তা আর কৌশিকের প্রশ্নের উত্তরে সব কিছু ব্যাক্ত করে। নার্সের সাথে কৌশিক রক্ত দিতে চলে যায়। তিস্তা ওকে অভয় প্রদান করে, যে ওর মা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এক সেকেন্ড আদির কাছে এক ঘন্টা বলে মনে হয়, এক মিনিট ওর কাছে এক বছর। উৎকণ্ঠায় ওর জিব শুকিয়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ইষ্ট নাম জপ করে আদি। "ভগবান বলে যদি সত্যি কেউ থাকে তাহলে দয়া করে আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।"
কমল জেঠু ওকে জিজ্ঞেস করে, "তোর বাবাকে কি একটা ফোন করবি?"
আদি কি করবে ভেবে পায় না। সত্যি কি ওর বাবা আর ওর মাকে ভালোবাসে না? কিন্তু ওকে ভীষণ ভালোবাসে। হয়তো ছেলের এই ডাক শুনে বাবার মত বদলে যেতে পারে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আদি বাবাকে ফোন করে।
ওর কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনেই সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, "তোর কি হয়েছে রে? এমন ভাবে কাঁপছিস কেন?"
আদি কাঁপা গলায় বাবাকে জানায়, "পাপা" গলা ধরে আসে আদির, "মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, পাপা। মা হসপিটালে।"
সেই শুনে সুভাষ চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, "কি ভাবে কোথায় হয়েছে। এখন কি অবস্থা?"
আদি সবিস্তারে বাবাকে এক্সিডেন্টের কথা জানাতেই সুভাষ জানায় যত শীঘ্র সম্ভব সুভাষ কোলকাতা আসবে। সেই শুনে আদি বাবাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। দু চোখ ভরে আসে জলে।
সুভাষ ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলে, "এই তোর মায়ের কিছু হবে না। আমি নেক্সট ফ্লাইট ধরে কোলকাতা আসছি। সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না।"
এক ঘন্টা কেটে যায়। ডাক্তারেরা অপারেশান করেই চলেছে। ভেতর থেকে কোন খবর নেই। ওর বন্ধুরা, কমল জেঠু যতই ওকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে ততই আদি ক্ষেপে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে কপালে করাঘাত করে মনে মনে বলে, "যার যায় সেই বোঝে এই দুঃখ। একটু চুপ করে থাক সবাই।"
তিন ঘন্টা পরে অপারেশান থিয়েটার থেকে চিকিতসারত ডাক্তার বেরিয়ে আসে। কমল জেঠু, আদি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ঋতুপর্ণার কথা জিজ্ঞেস করে। ডক্টর অবিনাশ, ওদের নিয়ে নিজের চেম্বারে চলে যান। চেম্বারে বসে আদি আর কমল জেঠুকে সবিস্তারে আঘাতের বিবরণ দেন। ঋতুপর্ণার মাথার ডান দিকে বেশ ভালোই ফেটে গেছে। মাথা ফেটে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। মাথায় আঘাতের ফলে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়ে গেছে। ডাক্তারেরা সেই কাঁচ ইতিমধ্যে বের করে দিয়েছেন। বাঁ কাঁধের হাড়ে একটু চিড় দেখা গেছে, তা ছাড়া শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় একটু কেটে ছড়ে গেছে তাছাড়া গুরুতর আঘাত হয়নি। মাথায় আঘাতের জন্য ডাক্তারেরা একটু চিন্তিত। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আগামী বাহাত্তর ঘন্টা ঋতুপর্ণাকে পর্যবেক্ষণের জন্য আই সি ইউতে রেখে দেওয়া হবে।
ডাক্তার অবিনাশ ওকে বুঝিয়ে বলেন, "দেখো আদিত্য। মাথায় একটু আঘাত লেগেছে আর বাম কাঁধের হাড়টা একটু সরে গেছে। চিন্তা করার বিশেষ কোন কারন নেই। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তোমার মাকে আই.সি.ইউতে রাখা হবে। আই.সি.ইউতে নিয়ে যাওয়ার পরে একবার মাকে দেখে আসতে পারো।"
আদি নির্বাক হয়ে ডাক্তারের কথা শুনে যায়। ছলছল চোখে ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, "মা ঠিক হয়ে যাবে তো?"
কমল জেঠু ওর কাঁধে হাত রেখে অভয় প্রদান করে বলেন, "হ্যাঁ সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না। চল বাইরে চল।"
রাত বেড়ে ওঠে। রক্ত দেওয়ার পরে এক এক করে ওর বন্ধুরা বিদায় নেয়। তিস্তা জানিয়ে দেয়, যে ও ওর মায়ের স্কুলের সবাইকে ফোন করে এই দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দেবে। সকালে একবার সবাইকে নিয়ে দেখা করতে আসবে। কমল জেঠুর বয়স হয়েছে তাই আদি ওকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আই সি ইউর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে নার্স এসে ওকে খবর দেয় যে ঋতুপর্ণাকে আই.সি.ইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদি জিজ্ঞেস করে সে কি তার মাকে দেখতে পারে, উত্তরে নার্স জানায় যে ঋতুপর্ণার জ্ঞান এখন ফেরেনি তবে আদি মায়ের সাথে দেখা করতে পারে।
কাঁচের বড় দরজা ঠেলে আদি আই.সি.ইউতে ঢোকে। গলায় শ্বাস আটকে যায়। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। মাথায় ব্যান্ডেজ, সারা চেহারায় ব্যান্ডেজ, কাঁধে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ঋতুপর্ণা নিস্তেজ এক শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন সাদা বিছানায় শুয়ে। নাকে অক্সিজেনের নল, মুখের মধ্যে নল। এসির গুনগুন আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে ভেসে আসে না। আদির বুক কেঁদে ওঠে। চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। একি রূপ দেখছে। স্বপ্নেও ভাবেনি মাকে কোনোদিন এইভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখতে পাবে। হার্টবিট মনিটর ধুকপুক করে জানান দেয় যে হৃদপিণ্ড খুব ধীরে ধীরে চলছে। আদি একটা চেয়ার টেনে মায়ের পাশে বসে পড়ে।
বুকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে, "মা গো, একটি বার চোখ খোলো মা। দেখো তোমার দুষ্টু আদি এসে গেছে, মা। তোমার কিছু হবে না মা। প্লিজ একটা বার চোখ খোলো।"
সন্তানের আর্ত কান্না মায়ের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। নিস্তব্ধ প্রাণহীন মূর্তির মতন বিছানায় শুয়ে ঋতুপর্ণা।
আদি মায়ের ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গালে চেপে ধরে। মায়ের হাতটা যে বড় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এই হাতের ছোঁয়ায় আদি বড় হয়েছে। এই হাত ওকে কতবার খাইয়ে দিয়েছে, স্নান করিয়ে দিয়েছে, আদর করেছে, শীতের রাতে জড়িয়ে ধরেছে, গরমে যখন ঘেমে যেত তখন ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে, আদর করে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের ঠাণ্ডা হাত গালে ধরে চোখ বুজে সেই উষ্ণতার মিষ্টি পরশ খুঁজতে আপ্রান চেষ্টা চালায় ছেলের মন। কিন্তু ওর মায়ের হাতে সেই উষ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
ছোট বেলায় আদি একটু তোতলা ছিল, সব বাচ্চারাই একটু তোতলা থাকে, ঠিক ভাবে কথা ফোটে না তখন। ওর বাবা ওর মাকে আদর করে "ঋতু" বলে ডাকত। আদি তখন বাবার নকল করে মাকে "ইতু" বলে ডাকত। আধো আধো কণ্ঠে সেই "ইতু" ডাক ঋতুপর্ণার কানে মধুর মতন মনে হত। যেই ওর বাবা ওর গাল টিপে আদর করে বলত, "তবেরে ব্যাটা আমার নকল করা হচ্ছে। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।" তখনি আদি খিলখিল করে হাসতে হসাতে মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে নিত।
আদি মায়ের হাত খানি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, "ইতু, তোমার দুষ্টু আদি তোমার পাশে।" চোখ জ্বালা করে ওঠে। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "এমন অভিমান করে চুপ থাকলে কি করে বাঁচব বলো। তুমি যে আমার সব। আমাকে কে ঘুম পাড়াবে? কে আমাকে আদর করে দুষ্টু, শয়তান বলে ডাকবে।" চোখের নোনতা জল এসে ঠোঁটে লাগে আদির। মায়ের হাতের তালুতে ঠোঁট চেপে ধরে। "মা জানো বাবা আসছে। এইবারে চোখ খোলো মা।"
বুক কাঁপিয়ে ভীষণ ঝড় আছড়ে পড়ে।
(#০২)
কতক্ষণ ওইভাবে মায়ের নরম ঠাণ্ডা হাতখানি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসেছিল জানে না। আদির চোখ লেগে গিয়েছিল মায়ের পাশে বসে। রাত প্রায় বারোটা, ফোনের রিং শুনে আদির তন্দ্রা ভাব কেটে যায়।
ফোন উঠিয়ে দেখে বাবা ফোন করেছে, "তুই কোথায়?"
চোখের কোল মুছে ঘুমন্ত মায়ের নির্লিপ্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, "আমি আই.সি.ইউতে। তুমি কি এসে গেছ?"
সুভাষ উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
আদি বাবাকে আই.সি.ইউতে আসতে বলে। কিছুক্ষণ পরে সুভাষ কাঁচের দরজা ঠেলে আই.সি.ইউতে ঢোকে। আদি বাবার দিকে তাকায়। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, বাবাকে বড় শ্রান্ত দেখায়। সুভাষ আদির পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতেই আদি ভেঙ্গে পড়ে।
আদি বাবার হাত চেপে ধরা গলায় বলে, "কি থেকে কি হয়ে গেল।"
সুভাষ ছেলেকে প্রশ্ন করে, "কি করে এই সব হল?"
আদি মায়ের সাথে প্রদীপের দেখা করার কথা লুকিয়ে বলে, "আজকে দুপুরে সোসাইটি মিটিং ছিল তারপরে মা একটু বের হয়ে গেল শপিং করতে। আমিও একটা বন্ধুর সাথে দেখা করতে বেরিয়ে গেলাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে একজন অচেনা ব্যাক্তি আমাকে ফোন করে জানাল যে মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। এসে দেখি মায়ের এই অবস্থা।"
কি ভাবে গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে, ডাক্তারেরা কি বলেছে সেই সব এক এক করে বাবার কাছে ব্যাক্ত করলো। সব শুনে সুভাষ ম্লান হেসে ছেলেকে বলে, "মেয়েটাকে কত সাবধানে থাকতে বলতাম কিন্তু তোর মা শুনলে তো। বড্ড এডামেন্ট, বড্ড অনমনীয় মেয়ে। তোর খাওয়া দাওয়া হয়নি মনে হচ্ছে। চল, দুটো স্যান্ডুইচ এনেছি খেয়ে নিবি।"
আদির খিদে বলতে কিছুই ছিল না। বাবার সাথে দেখা হওয়ার পরে আদির খিদে পায়। ম্লান হেসে বাবাকে বলে, "তুমি তাহলে শেষ পর্যন্ত মাকে দেখতে এলে।"
সুভাষ ওর কাঁধে আলতো চাপড় মেরে হেসে বলে, "হুম, তোর কান্না দেখে কি আর চুপ থাকতে পারি। চল খেয়ে নিবি। ওর জ্ঞান ফিরলে তখন দেখা যাবে।"
আদি আর সুভাষ আই.সি.ইউর বাইরে এসে বসে। বাবার আনা স্যান্ডউইচ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে পেট ভরায়। সুভাষ ছেলেকে অভয় দিয়ে বলে যে ওর মায়ের কিছু হবে না। পাশে বাবাকে পেয়ে বুকের মধ্যে শক্তি ফিরে পায় আদি। বাবা তাহলে মাকে সত্যি খুব ভালোবাসে। খেতে খেতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, তাহলে হঠাৎ করে একদিন ওদের ছেড়ে চলে কেন গেল। এই প্রশ্ন আর জিজ্ঞেস করে না।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টির আওয়াজ। এইবারে পুজো মনে হয় জলে ভেসে যাবে। আদির দুঃখের সাথী হয়ে সারা আকাশ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। চুপচাপ আই সি ইউর বাইরে চেয়ারে বসে আদি মায়ের মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে। স্ক্রিনে মায়ের আর ছেলের একটা ফটো। কয়েক মাস আগে দক্ষিণেশ্বর গিয়ে তোলা হয়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতেই আদির চোখ ভারী হয়ে আসে। চেয়ারে বসেই সুভাষ আর আদি তন্দ্রা যায়।
সারা রাত তন্দ্রার মাঝেই আদি চমকে চমকে উঠেছিল। একবার করে আই.সি.ইউতে গিয়ে উঁকি মেরে মাকে দেখতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নার্স জানিয়ে দেয় সকালের আগে দেখা করতে দেওয়া যাবে না।
সকালে এক এক করে কমল জেঠু, সোসাইটির আরো অনেকে, মায়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, বিথিকা দেবী, তিস্তা আরো অনেক শিক্ষিকা দেখা করতে আসে ওর সাথে। কিন্তু ঋতুপর্ণা তখন অচৈতন্য।
কমল জেঠু একবার ডক্টর অবিনাশের সাথে দেখা করেন। সুভাষ আর আদিও সাথে যায়। ডক্টর অবিনাশ জানান যে প্রানহানীর আশঙ্কা একদম নেই, হার্ট বিট আগের থেকে উন্নতি হয়েছে। আশা করা যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। সেই শুনে আদি আর সুভাষ স্বস্তির শ্বাস নেয়।
বিকেলের দিকে একজন নার্স এসে ওদের জানায় যে ঋতুপর্ণার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সেই শুনে আদি বুক ভরে স্বস্তির শ্বাস নেয়। বাবার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে ধরা গলায় বলে, "তুমি এলে বলে না হলে হয়তো...."
সুভাষ ম্লান হেসে আদিকে বলে, "আমার জন্য ও কোনোদিন চোখ খুলবে না। তোর জোরেই খুলেছে। যা দেখা করে আয়।"
আদি বাবার হাত ধরে ভেতরে আসতে অনুরোধ করে। ধীর পায়ে আদির পেছন পেছন সুভাষ আই সি ইউতে ঢোকে। কমল জেঠু সাথেই ছিলেন। ওদের পেছনে কমল জেঠু।
আদি মায়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে এগিয়ে যায়। ঋতুপর্ণা ঘাড় উঁচু করে ভাষাহীন নয়নে আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশের নার্স কে কাছে ডেকে ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করে, "আমার ছেলে আদি, সে কোথায়?"
মায়ের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আদি। ত্রস্ত পায়ে মায়ের পাশে গিয়ে মায়ের হাত ধরে বলে, "মা এই তো আমি।"
শ্রান্ত চোখ, অবাক চাহনি, শূন্য চোখের তারা। ঋতুপর্ণা আদিকে প্রশ্ন করে, "তুমি কে? আমার ছেলে আদি, সে কোথায়?"
আদির শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ডুকরে কেঁদে ফেলে, "মা আমি, আমি তোমার আদি।"
ঋতুপর্ণা ধীরে ধীরে অতি কষ্টে আদির হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ আদির দিকে তাকিয়ে মিনমিন শ্রান্ত গলায় বলে, "আমার ছেলে তোমার চেয়ে অনেক ছোট। সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তুমি কি করে আমার ছেলে...."
ঋতুপর্ণার চোখ চলে যায় আদির পেছনে দাঁড়ানো সুভাষের দিকে। শ্রান্ত শূন্য চোখ জোড়া হঠাৎ করে ঘৃণার আগুনে জ্বলে ওঠে, "তুমি এইখানে? আমার ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?" অস্ফুট স্বরে ভাঙ্গা গলায় প্রচন্ড বেদনায় চেঁচিয়ে ওঠে ঋতুপর্ণা, "তুমি আমার ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছ তাই না। লম্পট, বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে।"
ভীষণ ভাবে কেঁপে ওঠে ঋতুপর্ণার সারা শরীর। অস্ফুট গোঁগোঁ করতে করতে সংজ্ঞা লোপ পায়। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার নার্স দৌড়ে আসে।
ওর মা ওকে চিনতে পারছে না। আদির বুকের পাঁজর ভেঙ্গে যায়। মায়ের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমি তোমার আদি মা। প্লিজ আমার দিকে একবার তাকাও।"
কিন্তু ওর মা, ঋতুপর্ণা সংজ্ঞা হারিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়েছে। ডক্টর অবিনাশের সাথে কমল জেঠুর কিছু কথা হয়। সঙ্গে সঙ্গে একজন নিউরো সার্জেনের ডাক পরে। নিউরো সার্জেন, ডক্টর শ্যামল এসে ঋতুপর্ণাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তৎক্ষণাৎ, এম.আর.আই, সি.টি.স্ক্যান করার নির্দেশ দেন।
ভাঙ্গা বুক আর হৃদয় ভাঙ্গা কান্না নিয়ে আদি আই সি ইউ থেকে বাইরে এসে ভেঙ্গে পরে বাবার কাঁধের ওপরে। "একি হয়ে গেল। মা কেন আমাকে চিনতে পারছে না। আমি এমন কি পাপ করলাম যে মা আমাকে...."
ভাষাহীন সুভাষ কি বলে ছেলেকে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। কার পাপের ফলে ঋতুপর্ণার এই অবস্থা।
বেশ কিছুপরে কমল জেঠু ওদেরকে ডক্টর শ্যামলের চেম্বারে নিয়ে যায়। ডক্টর শ্যামলের চেহারা বেশ চিন্তিত, কপালে ভাঁজ। সেই দেখে আদির বুক উৎকণ্ঠায় কেঁপে ওঠে।
ডক্টরকে জিজ্ঞেস করাতে, তিনি উত্তর দেন, "আবার তোমার মা জ্ঞান হারিয়েছেন। এইবারে সত্যি আমরা বেশ চিন্তিত। দেখো আদি, তোমার মায়ের পোস্ট ট্রমাটিক রেট্রোগ্রেড এমনেসিয়া হয়েছে। অর্থাৎ, তোমার মায়ের স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। তবে সম্পূর্ণ রূপে স্মৃতি লোপ পায়নি। বেশ কয়েকবছর তোমার মায়ের স্মৃতি হারিয়ে গেছে। সাধারণত গাড়ির দুর্ঘটনার পরে এই লক্ষন দেখা যায় তবে এই ক্ষেত্রে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে। সম্ভবত যখন এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেই সময়ে তোমার মা একটা নির্দিষ্ট সময়ের কথা অথবা ঘটনা নিয়ে খুব চিন্তা মগ্ন ছিল। তাই সেই দিনের পর থেকে সব ঘটনাবলী, স্মৃতি ইত্যাদি তোমার মায়ের মাথা থেকে হারিয়ে গেছে।"
চিন্তিত সুভাষ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, "এর প্রতিকার কি? এটা কি করে ঠিক করা যায় ডাক্তার বাবু।"
চিন্তিত ডক্টর শ্যামল বলেন, "দেখুন মিস্টার সান্যাল। এর সত্যিকারের প্রতিকার মেডিকেল সায়েন্সে অজানা। বিশেষ করে মাথার যে জায়গায় আঘাত হয়েছে সেই জায়গাকে হিপোকেম্পাস বলে। মাথার সেই স্থানেই আমাদের স্মৃতি গুলো নিউরন দ্বারা সঞ্চয় করা থাকে। স্মৃতি কখন মুছে যায় না। একটা নিউরন নতুন করে দানা বাঁধে অন্য নিউরনের সাথে আর নতুন জ্ঞান সঞ্চয় করে রাখে। আঘাতের ফলে কোথাও একটা অথবা বেশ কয়েকটা নিউরন আলাদা হয়ে গেছে। এর প্রতিকার ওষুধে নেই। মাথার ওই জায়গায় অপারেশান করা অসম্ভব। সম্মোহন করে অথবা সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। তবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। একটাই প্রতিকার, রুগীকে খুব সাবধানে রাখা। কোন ভাবে ওর মা যেন উত্তেজিত না হয়। মাথার মধ্যে যেন কোন চাপের সৃষ্টি না করা হয়। যতটা সম্ভব আরাম করা, ঢিলে ছেড়ে দেওয়া। ভালো খাওয়া দাওয়া করলে হয়তো আলাদা হয়ে যাওয়া নিউরন গুলো পুনরায় জোড়া লাগতে পারে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরে পেতে পারে। তবে একটা জায়গায় বড় খটকা লাগছে। আপনাকে চিনতে পারলো কিন্তু ছেলেকে কেন চিনতে পারলো না? কোন সময়ে কথা বলছিলেন আপনার মিসেস?"
সুভাষ মাথা নিচু করে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পরে উত্তর দেয়, "দশ বছর আগে, যখন আদি ক্লাস সিক্সে পড়ত তখন থেকেই আমাদের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরি হয়। এই দশ বছরে আদি অনেক বড় হয়ে গেছে, অনেক বদলে গেছে। তাই ঋতুপর্ণা ছেলেকে চিনতে পারে নি।"
ডক্টর শ্যামল বলেন, "বর্তমানে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপরওয়ালা কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।"
আদির সব রাগ ওর বাবার ওপরে পড়ে। ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে বাবার দিকে রোষকষিত নয়নে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "তোমার জন্য যদি মায়ের কিছু হয় তাহলে তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না।"
চুপচাপ অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সুভাষ। আদির শরীরের এক একটা স্নায়ু নিস্তেজ হয়ে যায়। চোখের সামনে আলো গুলো এক এক করে দুলতে শুরু করে দেয়। পায়ের তলার মাটি কাঁপতে শুরু করে দেয়। ফাঁকা বুক হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। মায়ের উষ্ণ পরশ হাতড়ে বেড়ায় চারপাশে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মা একা একা বুক বেঁধে ওকে বড় করেছে। আত্মীয় সজ্জন বলতে কেউ ছিল না, ছুটিতে সবাই মামা বাড়ি, জেঠুর বাড়ি কত জায়গায় যেত, কিন্তু নিকট পরিজনের অভাবে আদি কোথাও বেড়াতে যেতে পারত না। সেই নিয়ে আদি দুঃখ প্রকাশ করলে ওর মা ওকে গল্প বলে, আদর করে সব ভুলিয়ে দিত। এখন কে ওর এই বুক ভাঙ্গা বেদনা ভুলাতে সাহায্য করবে।
সুভাষ ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "দয়া করে ভেঙ্গে পড়িস না। আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে।"
দাঁতে দাঁত পিষে জল ভরা লাল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আদি জিজ্ঞেস করে, "তোমাদের যখন ডিভোর্স হয়েছিল তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তাহলে দশ বছর আগে কি এমন হয়েছিল যে মা তোমাকে দেখতে পারে না।"
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে সুভাষ শুরু করে তার অতীতের কাহিনী।
(#০৩)
এই শহর কোলকাতা থেকে অনেক দুর এক মফঃস্বল শহরে বাস করতো তেইশ বর্ষীয় সুভাষ সান্যাল। এক অভিজাত পাড়ার শেষ প্রান্তে এক বস্তি আর তার পাশে রেলের কলোনি। সেই কলোনিতে সুভাষের খুব ছোট তিন কামরার বাড়ি। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। বাবা রেলের এক সাধারন কর্মচারী। বড়দা বিয়েথা করে আলাদা হয়ে গেছে। দুই বোন, অপর্ণা আর সুজাতা তখন বেশ ছোট। কলেজ শেষ করে কাজের জন্য হন্যে হয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। চায়ের দোকানে আড্ডা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ওর বন্ধু, অনিলের বাবার ফটোর দোকানে গিয়ে বসে আর ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। সেই সুত্রে অনিলের বাবার কাছ থেকে ফটোগ্রাফি করা শিখে ফেলে। খুব বড় লোক না হলে সেই সময়ে বিয়ে পালা পার্বণে ভিডিও করা হত না তাই স্টিল ফটোগ্রাফির তখন খুব চল ছিল। সবার হাতে তখন ক্যামেরা থাকত না। অনিলের বাবার সাহায্যে এই বিয়ে পালা পার্বণে গিয়ে গিয়ে ফটো তুলতো। অনিলের বাবার দোকানে ফটো তুলে অন্তত ওর দিনের খাওয়ার খরচ, চা বিড়ির খরচ চলে আসে।
দেখতে হিন্দি ফ্লিমের হিরোদের মতন মোটেই ছিল না। পকেটে পয়সা না থাকার ফলে প্রেম করতে পারেনি। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে একজনকে খুব দেখতো। স্বপ্নে আঁকা শ্যাম বরন সুন্দরী কন্যে, অনিতাকে। অনিতার বাড়ি সুভাষের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। অনিতার বাবাও সুভাষের বাবার সাথে রেলে চাকরি করতেন। অনিতাকে শুধু মাত্র দুর থেকে দেখে যাওয়া ছাড়া সুভাষের সারা দিনে কোন কাজ ছিল না। মাঝে মাঝে দেখা হলে কথা হতো, ব্যাস সেই পর্যন্ত ওর দৌড়। সুভাষের মেজদা, অতিশ তখন একটা বড় সোনার দোকানের কর্মচারী। বড়দা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে মেজদার ওপরেই সংসারের ভার এসে পরে। একদিন ওর বুক ভেঙ্গে অনিতাকে বিয়ে করে ফেলল ওর মেজদা। বাবার অমত একদম ছিল না কারন অনিতার বাবা আর সুভাষের বাবা বন্ধু ছিলেন। যে মেয়েটাকে এতদিন মনের এক কোনায় পরীর মতন এঁকে রেখেছিল, নিজের বাড়িতে নিজের বৌদি হয়ে আসাতে সুভাষের বড় কষ্ট হল। তারপর থেকে সুভাষ এক প্রকার বাড়িতে আসা যাওয়া করা ছেড়ে দিল। সারাদিন এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়িয়ে কাটাতো আর অনিলের বাবার দোকানে কাজ করতো। অনেক রাতে বাড়িতে ফিরে কোনোরকমে দুটো ভাত মুখে গুঁজে বারান্দায় একটা তক্তপোষে শুয়ে পড়তো।
উঠতি বয়সের ছেলে, মাঝে মাঝে অনিল আর বন্ধুদের সাথে মদ খেত। যেদিন অতিশের সাথে অনিতার বিয়ে হয়, তার দুইদিন পরে মদ খেয়ে বেশ্যা পাড়ায় গিয়ে এক সুন্দরী বেশ্যার সাথে রাত কাটিয়ে নিজের কৌমার্য খুইয়ে আসে সুভাষ। সারা রাত মদের নেশায় সেই সুন্দরী মেয়েটাকে অনিতা ভেবেই যৌন সঙ্গম করে গিয়েছিল। কিছু টাকা অবশ্য অনিল দিয়েছিল আর বাকিটা ওর জমানো টাকা ছিল। অন্ধকার হলেই মাঝেই মাঝেই নেশার ঝোঁকে বেশ্যা পাড়ায় কাটিয়ে আসত সুভাষ।
সেই অভিজাত পাড়ায় এক বিশাল সাদা রঙের বাড়িতে এক কোলিয়ারির ম্যানেজার, বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসবাস। দুই ছেলের পরে একমাত্র কন্যে, অতীব সুন্দরী, ঋতুপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা মেজাজি মানুষ, এলাকায় বেশ নামডাক। মা, সুনিতা দেবী আর বাবার চোখের মণি, ঋতু। কচি বয়স হলেও অসম্ভব সুন্দরী ছিল ঋতুপর্ণা, বাবা মায়ের আদরে রাজ কুমারী, ঋতু। ভোরের সদ্য ফোটা গোলাপের কুঁড়ির মতন দেখতে। পান পাতার মতন মুখবয়াব, মাথায় মেঘের মতন ঢালাও চুল। আয়ত কাজল কালো দুই চোখে ছিল পাখীর মতন স্বাধীন হয়ে উড়ে যাওয়ার তীব্র বাসনা। গোলাপি কোমল অধরে যখন হাসি ফুটে উঠত তখন কোকিলের কুহু ধ্বনি মনে হত। সব থেকে আকর্ষণীয় ওর নিচের ঠোঁটের নীচে একটা ছোট তিল। বয়সের তুলনায় একটু বাড়ন্ত ছিল ওর দেহের গঠন। বুকের ওপরে উঁচিয়ে থাকা সদ্য গজিয়ে ওঠা তুলতুলে স্তন জোড়া পরনের কামিজ, ফ্রক ফুঁড়ে সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে উদত্য। পাতলা কোমর অনায়াসে হাতের মুঠোর মধ্যে চলে আসবে। আর তার ঠিক নীচে সদ্য ফুলে ওঠা সুগোল নিতম্ব। মত্ত চলনে রূপসী কন্যে সবার হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে চলে যেত। রূপকথার রাজকন্যে ঋতুপর্ণার রূপের কাছে ম্লান হয়ে যেত। পড়াশুনায় বিশেষ মাথা না থাকলেও নাচে গানে অতুলনীয় ছিল ঋতুপর্ণা। রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, পুজোর সময়ে, স্কুলে পাড়ায় যেখানেই নাচের কোন অনুষ্ঠান হত সেখানেই নাচত ঋতুপর্ণা। হাঁটার সময়ে যেন ঋতুপর্ণা হাঁটতো না, মনে হতো যেন নেচে বেড়াচ্ছে। ওর রূপের ডালি মেলে নাচ দেখার জন্য পাড়ার সবাই জড়ো হয়ে যেত সেই মঞ্চে। উচ্ছল উদ্দাম এক পাহাড়ি স্রোতস্বিনী, অধরা অপ্সরা।
সুভাষের চেয়ে প্রায় বছর আটেকের ছোট ঋতুপর্ণা তাই সুভাষের চোখে ঋতুপর্ণা এক দুষ্টু মিষ্টি ছোট মেয়ে ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পাড়ার বখাটে ছেলে গুলো বাকি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ইতর মন্তব্য করলেও কারুর সাহস হত না জাঁদরেল, বিদ্যুৎ বাবুর একমাত্র কন্যে, ঋতুপর্ণাকে কিছু মন্তব্য করে। তবে যখন ঋতুপর্ণা গাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতো, তখন রাস্তার মুখে অনেকে জটলা পাকিয়ে বসে থাকত এই অসামান্য রূপসীর দেখা পাওয়ার জন্য। বাবার গাড়ি হুস করে ওইসব ছেলেদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেত। ঋতুপর্ণা মজে থাকতো নিজের খেয়ালে, কোনোদিন কোন এক রাজকুমার ওর জীবনে আসবে আর কোন দুর দেশে মেঘের ভেলায় ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। স্কুলের দিদিমনি যখন অঙ্ক করাতেন তখন ঋতুপর্ণা অঙ্কের খাতায় আঁকিবুঁকি কাটত আর জানালার বাইরে তাকিয়ে আম গাছের বকুলের দিকে একমনে তাকিয়ে হারিয়ে যেত।
সেই সময়ে শীত কালে, পুজোর পরে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হত। সেদিন অঙ্কের পরীক্ষা, আর সেইদিন একটা রাজনৈতিক মিছিলের জন্য রাস্তায় গাড়ির যানজট। এই রাজ্যে ব্যাঙ্গে পেচ্ছাপ করলেও মিছিল ডাকা হয়, যানজট হয়ে সাধারন মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।
সুভাষ একটা বিড়ি টানতে টানতে সাইকেল নিয়ে দোকানে যাচ্ছিল। বিশাল জ্যাম দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সাইকেল নিয়ে এই জ্যাম পার হয়ে দোকানে পৌঁছাতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তবে খানিক দুরে একজনকে দেখে সুভাষ দাঁড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। যদি সেদিন ওইভাবে থমকে দাঁড়িয়ে না পড়ত তাহলে হয়তো বর্তমানের এই গল্প শুরু হত না। সুভাষ একভাবে বিড়ি টানতে টানতে ঋতুপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়ির দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে ঋতুপর্ণা। আয়ত কাজল কালো চোখ জোড়া জলে ভরে এসেছে।
ধবধবে সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির দরজা খুলে চোখে মুখে প্রবল উৎকণ্ঠার ছায়া নিয়ে সামনের বিশাল জ্যামের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে ঋতুপর্ণা। পড়াশুনায় ভালো না হলেও পরীক্ষা দেওয়া ওর চাই, না হলে বাবা বকবে। কিন্তু এই বিশাল যানজট পেরিয়ে সময় মতন স্কুলে পৌঁছানো বড় দায়। বাবা সকালেই ওকে অনেকবার করে বলেছিলেন, একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাস আজকে কিন্তু একটা মিছিল বের হবে। কিন্তু সারা সকাল নেচে বেড়িয়েছিল ঋতুপর্ণা। গাড়ি আছেই তো, কতক্ষণ লাগবে স্কুলে পৌঁছাতে। বড়দা একটু বকা ঝকা করতেই ওর মা এসে বাধা দেয়। আরে বাবা, একটা পরীক্ষা না দিলে কিছু হবে না। বাবা তড়বড়িয়ে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার আস্কারা পেয়েই মেয়েটা গোল্লায় গেল। সারাক্ষণ শুধু নাচ আর নাচ। সেই সাথে বড়দাও গলা মেলায়। বাবা, বড়দা ছোড়দা সবাই পড়াশুনায় খুব ভালো। সবাই চায় ঋতুপর্ণা অন্তত ভালো ভাবে পড়াশুনা করুক। কিন্তু অঙ্ক আর বিজ্ঞান যে ওর মাথার অনেকদুর থেকে পালিয়ে চলে যেত সেটা কে বুঝায়।
সুভাষ বিড়িটা মাটিতে ফেলে সাইকেল নিয়ে ঋতুপর্ণার গাড়ির সামনে এগিয়ে আসে।
সুভাষ স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, "কি রে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিস কেন?"
ঋতুপর্ণা প্রথমে থতমত খেয়ে যায়। বিশেষ চেনাজানা নেই, বিশেষ পরিচয় নেই তবে চিনতে পারে। পাড়ার শেষ প্রান্তে বাড়ি, বড়দার বিয়েতে ফটো তুলতে এসেছিল। এই পর্যন্ত ওদের পরিচয়।
বাবার বকুনির ভয়ে ঋতুপর্ণা ভুলে যায় ওদের মাঝের পরিচয়। ওকে দেখে প্রায় কেঁদে ফেলে, "আজকে অঙ্ক পরীক্ষা আর দেখো এই জ্যাম। কি করে যাই বলো তো?"
সুভাষ সাইকেল দেখিয়ে ওকে বলে, "চল সাইকেলে তোকে ছেড়ে দেই।"
ঋতুপর্ণার চোখ কপালে উঠে যায়, "সাইকেলে? পড়ে যাবো তো।" কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, "বাবা আজকে আমার পিঠের চামড়া তুলে দেবে।"
সুভাষ হেসে ফেলে, "কেন রে?"
ঋতুপর্ণা কোনরকমে চোখের কোল মুছে বলে, "বাবা অনেক করে বলেছিলেন যে জ্যাম হবে আমি শুনিনি তাই।"
সুভাষ ওকে বলে, "আচ্ছা, এখন আর কাঁদিস নে। চল চল সাইকেলে উঠে পর।"
ঋতুপর্ণা কোনোদিন সাইকেলে বসেনি। উভয় সঙ্কটে পড়ে যায়। গাড়ির চালককে বুঝিয়ে বলে যে বাড়িতে যেন এই কথা কারুর কানে না যায়। বাবাকে যেন বলা হয় যে গাড়িতে করেই ঋতুপর্ণা স্কুলে গেছে। না হলে ওর বাবা আর ওর বড়দা ওর পিঠের চামড়া তুলে ঢোল বানিয়ে দেবে। ঋতুপর্ণা কোনোরকমে সাইকেলের সামনের রডে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে পরে। সামনে বসতেই সুভাষের বুকের কাছে ঋতুপর্ণার মাথা এসে লাগে। মেয়েটার শরীর থেকে অসম্ভব এক মিষ্টি মাদক গন্ধ সুভাষকে মাতাল করে তোলে। সাইকেল চালিয়ে গাড়ি মাঝখান থেকে পথ করে ওরা এগিয়ে যায় স্কুলের দিকে। ঋতুপর্ণার দুইপাশে হাত রেখে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরার ফলে। কচি ফুলের কুঁড়িটাকে চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। ইসস, নাক কুঁচকায় সুভাষ, ওর মুখ থেকে ভুরভুর করে বিড়ির গন্ধ আসছে। সাইকেল চালানোর সময়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, ওর বুক ঠেকে যায় ঋতুপর্ণার পিঠের সাথে। সাদা সালোয়ার কামিজে ঋতুপর্ণা যেন নিষ্পাপ এক সুন্দরী অপ্সরা, ঠিক যে শিশিরে ভেজা সাদা পদ্ম ফুল।
স্কুলের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ নাক কুঁচকে ঋতুপর্ণা ওকে বলে, "ইসস এত বিড়ি খাও যে বিকট গন্ধ বের হচ্ছে।"
লজ্জায় পরে যায় সুভাষ, "আচ্ছা বাবা এই মাথা পেছনে করে নিলাম।"
ঋতুপর্ণা খিলখিল করে হেসে বলে, "না থাক, তাহলে আর সাইকেল চালাতে পারবে না।"
সুভাষ সাইকেল চালাতে চালাতে ঋতুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করে, "কেমন প্রিপারেশান হয়েছে?"
ঋতুপর্ণা ম্লান হেসে উত্তর দেয়, "ধুস, অঙ্ক একদম মাথায় ঢোকে না।"
সুভাষ ভেবেছিল রূপসী ঋতুপর্ণা পড়াশুনা বেশ ভালো হবে তাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "কেন রে, কোথায় অসুবিধে?"
ঋতুপর্ণা হেসে বলে, "আরে বাবা, একটা ট্রেন এত মিটার লম্বা, এত গতিতে একদিকে ছুটে চলেছে।" খিলখিল করে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলে, "যাক না দৌড়ে আমার বাবার কি। তাও দেখো ওদের, একটা লাইট পোস্ট অতিক্রম করতে কত সময় লাগবে সেটা নিয়ে অঙ্ক। ভারতীয় রেল কখন ঠিক সময়ে স্টেশানে পৌঁছাতে পারল না তার আবার সময় অঙ্ক কষে জানাও।"
হাসতে হাসতে সারা শরীর নড়ে ওঠে ঋতুপর্ণার।
সেই মিষ্টি মধুর কচি মেয়েটার হাসি শুনে সুভাষের বুকের রক্ত ছলকে ওঠে। নরম গালে মিষ্টি করে একটা চুমু খেতে বড় ইচ্ছে করে। বড় তরলমতি মিষ্টি হাসি, বড় নিষ্পাপ আপন ভোলা মন। সুভাষের মাথায় কোনোদিন অঙ্ক বিশেষ ঢুকত না তাই হেসে বলে, "ঠিক বলেছিস, যতসব আজগুবি অঙ্ক। তার চেয়ে ভূগোল ভালো।"
ঋতুপর্ণা হেসে বলে, "আচ্ছা তাই নাকি? বলো তো পৃথিবীর সব থেকে বড় মরুভুমি কোনটা?"
মাথা ঝাঁকায় সুভাষ, কবে যেন পড়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারে না। সাইকেল চালাতে চালাতে একটু ভেবে বলে, "হবে হয়তো কালাহারি নয়তো থর। কে জানে বাবা আমি অন্ডাল ছেড়ে কোথাও কোনোদিন যাইনি।"
হেসে ফেলে ঋতুপর্ণা, "তোমার ভূগোল আমার অঙ্কের মতন গোল।"
সুভাষ প্রশ্ন করে, "আচ্ছা তুই বলে দে।"
ঋতুপর্ণা উত্তর দেয়, "সাহারা মরুভুমি, আফ্রিকার উত্তরে। বুঝলে চাঁদু।"
ওদের মাঝে যে এর আগে কোনোদিন বিশেষ কোন পরিচয় ছিল না সেটা কেউ বলতে পারবে না। প্রান খোলা মেয়ে ছিল ঋতুপর্ণা, তাই অতি সহজে সুভাষের মতন একজনের সাথে গল্পে মেতে উঠল। গল্পে গল্পে স্কুল চলে আসে। অনেকেই যান জটের জন্য পরীক্ষা দিতে আসতে পারেনি, তাই পরীক্ষা একটু দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু সময়ের আগেই সুভাষ ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে।
সাইকেল থেকে নেমেই স্কুলের সামনে দাঁড়ানো একটা আলুকাবলি ওয়ালাকে দেখিয়ে ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে, "এই আলু কাবলি খাবে?"
সুভাষ হেসে মাথা নাড়ায়, "তোর পরীক্ষা দিতে হবে না? যা মন দিয়ে পরীক্ষা দিস।"
ঋতুপর্ণা ঠোঁট উল্টে ভেংচি কেটে বলে, "ধ্যাত তুমি না।" তারপরে নাক কুঁচকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, "টেনে টুনে চল্লিশ আনলেই হবে। বাকিটা মা ঠিক আমাকে বাঁচিয়ে নেবে।"
ঋতুপর্ণা কোমর দুলিয়ে, সারা অঙ্গে মাদকতাময় এক হিল্লোল তুলে মেয়েদের মাঝে হারিয়ে যায়। সবাই সাদা সালোয়ার কামিজ পরা তার মধ্যে সুভাষ ঠিক খুঁজে ঋতুপর্ণার ওপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। স্কুলের দরজার ভেতরে ঢোকার মুখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পরে ঋতুপর্ণা, মুচকি মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। সুভাষ এতটা আশা করেনি এই রূপসীর কাছ থেকে। হঠাৎ কি করে কি হয়ে গেল। সম্মোহিতের মতন সাইকেল নিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন মেয়েটার ছুটি হবে, কখন আবার ওই মিষ্টি চাঁদপানা মুখমণ্ডলের দর্শন হবে।
ঋতুপর্ণা এক প্রকার মুখ গোমড়া করেই ক্লাসে ঢুকে পড়ে। আলু কাবলি খাবার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল। বাবা মায়ের আদরের মেয়ে, দুই দাদার আদরের বোন কিন্তু জীবনে সেই স্বাধীনতা ছিল না। যা চাইতো তাই পেয়ে যেত শুধু স্বাধীনতা ছাড়া। অবশ্য ঋতুপর্ণা তখন সবে মাত্র ক্লাস নাইন, তাই বাইরে বের হলে সব সময়ে মায়ের সাথেই বের হত। একা একা কোথাও যাওয়া অথবা বাইরের খাবার খাওয়া বাড়ির কারুর একদম পছন্দ নয়। স্কুলের ছুটির পরে সব বান্ধবীরা আলু কাবলি, ফুচকা খায় কিন্তু ওর জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির ড্রাইভার, রঞ্জন কাকু ছুটি হলেও, মামনি চলে এসো, বলে ওকে গাড়িতে করে হুস করে বেরিয়ে যায়। অঙ্ক করতে বসে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁতের মাঝে পেন নিয়ে চিবিয়ে যায়। কালো সাদা অক্ষর গুলো হিব্রু ল্যাটিন হয়ে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে যায় ঋতুপর্ণা, তারপরে আর পেন উঠাতে হয়নি। অঙ্ক পরীক্ষা সেইবারে আগের বারের চেয়ে ভালোই হয়।
অনিল ওইদিকে খুঁজতে খুঁজতে স্কুলে চলে আসে। স্কুলের সামনের একটা চায়ের দোকানে সুভাষ বসে বিড়ি টানছিল আর ঋতুপর্ণার অপেক্ষা করছিল। জানে পরীক্ষার পরে আর ঋতুপর্ণা ওর সাইকেলে বসে বাড়ি ফিরবে না কারন দুপুরের আগেই যানজট ছেড়ে যাবে আর ওকে নিতে ওর বাড়ি থেকে গাড়ি চলে আসবে।
অনিল ওকে দেখে পিঠের ওপরে এক চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করে, "এই শালা এই মেয়েদের স্কুলের সামনে বসে কি বাল ছিঁড়ছিস।"
সুভাষ থতমত খেয়ে যায়, "না মানে এমনি।"
অনিল চোখ টিপে মুচকি হেসে বলে, "তুই নাকি বিবির মেয়েকে স্কুলে নিয়ে এসেছিস?" বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এলাকার সবাই "বিবি" বলে ডাকে।
সুভাষ অবাক হয়ে যায়, "তোকে কে বললো?"
অনিল ওর পাশে বসে হেসে বলে, "তুই হারামি কি ভেবেছিস কেউ দেখেনি? নরেন, বিমল, পটলা সবাই তোকে দেখেছে বিবির মেয়েকে তুই সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে এসেছিস। তাই বলে এইখানে হত্যে দিয়ে পরে থাকবি? ওরে বোকাচোদা ওই মেয়ে ওই রূপের ডালি নিয়ে কি আর তোর কোলে বসবে। ওর জন্য আকাশ থেকে সাদা ঘোড়ায় চেপে রাজকুমার আসবে। চল চল, বিমলের বড়দির ছেলের অন্নপ্রাশন। বাবা ডেকে পাঠিয়েছে, ফটো তুলতে যেতে হবে।"
সুভাষ মুখ কাঁচুমাচু করে অনুনয় করে, "আরে অন্নপ্রাশন সেই বিকেলে এখন প্লিজ তুই সামলে নে।"
অনিল চোখ কপালে তুলে বলে, "বোকাচোদা ছেলে, অন্নপ্রাশন কোনোদিন বিকেলে হয় না, দুপুরে হয়। বালের চোদা, এইখানে গাঁড় মারলে পেটে কিছু আসবে না। বাবা অলরেডি বায়না নিয়ে ফেলেছে, যদি তুই না যাস তাহলে বাবা মুখ দেখাতে পারবে না।"
অগত্যা সুভাষ চায়ের ভাঁড় ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলের সাথে দোকানে যায়। ক্যামেরা কাঁধে ফেলে অনিলের সাথে বিমলের বড়দির বাড়িতে পৌঁছায়। সারাদিন ফটো তোলে কিন্তু কানে ভেসে আসে ঋতুপর্ণার মিষ্টি কণ্ঠস্বর, "ধুত তুমি না।" মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়। "ধুত" শব্দটা অনেকবার আগেও শুনেছে তবে ঋতুপর্ণার মিষ্টি মধুর কণ্ঠ স্বর যেন ওই ছোট শব্দটির ধ্বনির সৌন্দর্য বেশি করে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসস, হাতে হয়তো একটু সময় ছিল। ওর সাথে দাঁড়িয়ে আলু কাবলি খেলে হয়তো আরো একটু বেশি সময়ের জন্য ঋতুপর্ণার পাশে থাকতে পারত। না না, বড় কচি মেয়ে ওর চেয়ে অনেক ছোট, কত ছোট হবে, হ্যাঁ আট বছরের মতন ছোট। এত কচি একটা মেয়ের প্রেমে পড়বে সেটা সুভাষের পক্ষে আশাতীত। ফটো তুলতে তুলতে অনেক সময় কেটে যায়। সন্ধ্যে নেমে আসে শহরের বুকে। ফটো তোলার পরে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে সুভাষ বাড়ির পথ ধরে।
ওদের হয়তো আর কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হবে না। ঋতুপর্ণা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ি ধরে স্কুলে চলে যাবে। সুভাষ সাইকেলে করে দাঁড়িয়ে থাকবে পথের পাশে। সারা রাত ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারল সুভাষ। বৌদি আর পূর্বতন সুপ্ত প্রেয়সী অনিতা ওকে ভাত দিয়ে যায়। চুপচাপ ডাল দিয়ে ভাত মেখে গলা ধক্করন করে ভাত গিলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় শুয়ে পরে। অনেকটা চিরাচরিত বাংলা সিমেনার মতন মনে হচ্ছে। আপন মনেই হেসে ফেলে সুভাষ।
পরেরদিন ঠিক স্কুলের সময়ে সুভাষ স্নান করে সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে ঋতুপর্ণার গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেইদিন কোন যান জট নেই, তাও এক অলীক কল্পনা করে অপেক্ষা করে থাকে। যদি একবার এই কচি নিষ্পাপ সুন্দরীর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও সেই অচেনা অথচ খুব চেনা পরিচিত গাড়ির দেখা পাওয়া যায়না। সুভাষের মনে ভয় ঢুকে যায়। বিদ্যুৎ বাবুর কানে কি ওদের এই পরিচয় হওয়ার ঘটনা পৌঁছে গেছে। আর তাই হয়তো ঋতুপর্ণাকে আর স্কুলে আসতে দেয়নি। অবশ্য পরে জানতে পেরেছিল যে সেদিন ঋতুপর্ণার কোন পরীক্ষা ছিল না।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment