আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
এপ্রিলের মাঝামাঝি বুধাদিত্য দুই সপ্তাহের জন্য অস্ট্রেলিয়া যায় অফিসের কাজে। সমীর ঝিলাম দুজনেই ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিল। সেই নিয়ে বুধাদিত্যের কি হাসি, বলে ওকি অগস্ত্য যাত্রা করছে নাকি যে একেবারে দল বেধে ছাড়তে এসেছে। অগস্ত্য যাত্রার কথা শুনে ঝিলামের চোখ ছলছল করে ওঠে। সমীর না থাকলে ঝিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে বলত, যে ওইরকম কথা বলতে নেই। যাবার আগে ঝিলাম বারবার ওকে জানায় যে ওখানে পৌঁছে অন্তত একটা এস.এম.এস যেন করে দেয় যে ঠিক করে পৌঁছে গেছে, আর যেন ওর ঘুমের ব্যাঘাত না করে। অপেক্ষা করে থাকবে ওর পৌঁছানর খবরের জন্য। বুধাদিত্য ওকে জানিয়ে দেয় যে পৌঁছে ফোন করে দেবে। বুধাদিত্য মেলবোর্ন পৌঁছেই ফোন করেছিল। ভোরেরবেলা মেলবোর্ন পৌঁছায়, তখন ঝিলাম ঘুমিয়েছিল, মাথার কাছেই ফোন রেখে দিয়েছিল। এক ডাকেই ফোন ধরে ঘুম ঘুম চোখে ওকে বলে, “ভালো করে পৌঁছে গেছ? এবারে আর আমাকে জ্বালাতন করো না একটু ঘুমাতে দাও।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর ঘুম জড়ানো মিষ্টি গলার আওয়াজ শুনে। হাজার মাইল দূর থেকে সেই গলার আওয়াজ শুনে ফোন বুকের কাছে ধরে বুধাদিত্য। এখানে ওকে কেউ দেখতে যাচ্ছে না, ও কি করছে। মোবাইলে ওর ছবিটা খুলে একবার দেখে ছোটো একটা চুমু খায়।
সিডনি থেকে সমীরের জন্য একটা জিন্স কেনে আর ঝিলামের জন্য একটা ভারসাসের কাঁধের ব্যাগ কেনে। তার সাথে ঝিলামের জন্য একটা হাল্কা বেগুনি রঙের খুব সুন্দর ইভিং গাউন কেনে। মনের কোনায় সযত্নে একটা স্বপ্ন একে নেয়, ভবিষ্যতে কোনদিন এই গাউন ঝিলামকে পরাবে, তবে সমীরের সামনে নয়। সেদিন শুধু ঝিলাম আর বুধাদিত্য থাকবে, জানেনা সেইদিন কোনদিন আসবে কি না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি নেই। ফিরে এসে এয়ারপোর্টে নেমেই সমীরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দিল্লী পৌঁছে গেছে। সমীর আর ঝিলাম দুজনেই ওর বাড়িতে এসেছিল সেইদিন বিকেলবেলায়। সমীর আর ঝিলাম ওর আনা উপহার পেয়ে খুব খুশি, সমীরের জন্য আলাদা করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছিল এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি দোকান থেকে। ইচ্ছে করেই মদ কেনেনি, কেননা ঝিলামকে কথা দিয়েছিল।
দিনেদিনে সমীরের অফিসের কাজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই অফিসের ট্রিপে বাইরে চলে যায় একদিন দুদিনের জন্য। ঝিলাম সেই নিয়ে বিশেষ কথা বাড়ায় না, কেননা কাজের জন্য যায় সমীর। একদিন অস্ত্রেলিয়া থেকে এক ক্লায়েন্ট আসে, বুধাদিত্য আর সি.টি.ও তাকে নিয়ে লাঞ্চে বের হয়, হোটেল সাংরিলা, অরিয়েন্টাল এভিনিউ’তে। দিল্লীর বেশ নামী দামী হোটেল। তিনজনে বসে নিজেদের কাজে গল্পে মশগুল হটাত চোখ পরে দুরে একটা টেবিলে। পেছন থেকে দেখে মনে হয় যেন লোকটাকে কোথায় দেখেছে। লোকটার সামনে এক সুন্দরী মেয়ে বসে। দুজনের হাবভাব আচার আচরনে দেখে মনে হল বেশ ভালভাবে পরস্পরকে চেনে আর বেশ হেসে কথা বলছে দুজনে। কিন্তু বুধাদিত্যের চোখ আটকে থাকে সেই লোকটার দিকে। ওর দিকে পিঠ থাকার দরুন মুখ দেখতে পায়না। পেছন থেকে সমীরের মতন দেখতে। বাথরুমে যাবার আছিলায়, ঝিলামকে ফোন করে জানে যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে কোন অফিসের কাজে। কিছু বলেনা বুধাদিত্য, বাথরুম থেকে বেড়িয়ে সেই লোকের মুখোমুখি হয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পরে সমীর, যেন ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে, সামনে বুধাদিত্য। বুধাদিত্য চুপ করে একবার ওর লাল মুখের দিকে তাকায় আর দুরে টেবিলে বসা সেই মেয়েটার দিকে তাকায়। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই মেয়েটা কে? সমীর আমতা আমতা করে জানায় যে অফিস কলিগ। বুধাদিত্য ওকে জানতে দেয় না যে ঝিলামের কাছে আগে থেকেই সমীরের আহমেদাবাদ যাবার খবর আছে। শুধু একটা কথা বলে চলে যায়, মিথ্যেটা না বললেই ভালো হত। বলে যে, পরে এই নিয়ে কথা হবে। সমীরের যেন বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। বুধাদিত্যের দিকে এক পা এগিয়ে হাত ধরতে যায়, কিন্তু ততক্ষণে বুধাদিত্য নিজের টেবিলে গিয়ে বসে পরে। ঝিলামকে এইসব কথা কিছুই জানায় না। ভাবে একবার সোজা সমীরের সাথে কথা বলে দেখবে আগে।
একদিন দুপুরে ঝিলাম অফিসে না ঢুকে ফোন করে বুধাদিত্যকে নিচে আসার জন্য। গলার স্বরে একটু আহতভাব। নিচে নেমে দেখে যে ঝিলাম বাইরে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। অন্যদিনে রিসেপ্সানে বসে থাকে, পেপার বাঁ কোন ম্যাগাজিন পড়ে যতক্ষণ না বুধাদিত্য নেমে আসে। ঝিলামের মুখের ভাব দেখে বুঝে যায় যে সমীরের সাথে হয়ত কোন বিষয়ে মনমালিন্য ঘটেছে। গাড়ি চেপে বাড়ি ফেরার সময়ে ঝিলাম অস্বাভাবিক ভাবে চুপ। বুধাদিত্য আড় চোখে ওর দিকে তাকায় আর গাড়ি চালায়।
ঝিলামের উচ্ছল গলার আওয়াজ না পেয়ে বড় আহত হয়, জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে? সমীরের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
ঝিলাম মাথা দুলিয়ে বলে, “কই না ত।” ঠোঁটে জোর করে হাসি টেনে বলে, “কেন আমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নাকি?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “তোমার চোখ মুখ বলছে যে কিছু একটা ঘটেছে আর সেটা সমীরের সাথেই। কি হয়েছে আমাকে বলবে না?”
ঝিলাম একটু আহত গলায় বলে, “একটু দেরি করে অফিসে ফিরলে তোমার অসুবিধে আছে?”
বুধাদিত্য গাড়ি ঘুড়িয়ে নেয় অফিসের দিকে। ঝিলামের ম্লান চেহারা বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন কি হয়েছে?”
ঝিলাম নিচু স্বরে বলে, “জানো, কাল ওর একটা ক্রেডিট কার্ডের বিল এসেছিল। সেটা খুলে দেখেছি বলে কত কথা শুনিয়ে দিল আমাকে। আমি যেন ওর কেউ না, এমন একটা ভাব দেখাল সমু।”
চোখের কোল ভিজে এসেছে ঝিলামের। “মাঝে মাঝে আজকাল কি রকম আলগা আলগা ব্যাবহার করে আমার সাথে। আজকাল আবার মদ খাওয়া ধরেছে, কিছু বলতে গেলেই রেগে যায়।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ঝিলামের কথা শুনে। অফিস পৌঁছে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বাড়ি না ফিরে ওকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে ফাঁকা এন.এইচ-১ হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম চুপ করে পাশে বসে থাকে, কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। বিকেল গড়িয়ে আসে, দুজনে চুপ। ঝিলামের বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়।
বুধাদিত্য ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সমীরকে সোজাসুজি প্রশ্ন কেন করছ না?”
ঝিলাম ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “কি জিজ্ঞেস করব?”
বুধাদিত্য, “সোজাসুজি জিজ্ঞেস কর, যে ওর কি কাউকে মনে ধরেছে নাকি?”
বুধাদিত্যের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ঝিলাম। সমীর ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে, না ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্যকে বলে, “না না, এটা নয়, হয়ত ওর কাজের জন্য খুব ব্যাস্ত থাকে তাই হয়ত মাঝে মাঝে মদ খায় আর রাত করে বাড়ি ফেরে।”
বুধাদিত্য, “একবার জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে।”
ঝিলাম, “তোমার ত বন্ধু, তুমি না হয় একবার জিজ্ঞেস কর।
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, একবার সমীরকে হাতেনাতে ধরতে হবে, প্রমান যোগাড় করে ওর সামনে দাঁড়াতে হবে। না হলে সমীর প্রতিবারের মতন কিছু না কিছু আছিলায় এড়িয়ে যাবে বুধাদিত্যের প্রশ্নবান আর কোন এক গল্প বানিয়ে বলে দেবে। ঝিলামের মন ভোলানোর জন্য ওকে জিজ্ঞেস করে স্কুলের কথা, বাড়ির কথা। বাড়ির জন্য শপিং করেছিল কিন্তু বাড়ি যাওয়া হয়নি। ঝিলাম ভেবে রেখেছে যে গরমের ছুটিতে দুর্গাপুর যাবে। অবশ্য সে কথা এখন সমীরকে জানায়নি, তবে ইচ্ছে আছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। ঝিলাম সমীরকে ফোন করে কিন্তু ফোন রিং হয়ে যায়। ঝিলাম বার কয়েক ফোন করার পরে আর করে না। ঝিলামে কে নামিয়ে দেবার পরেও ঝিলাম দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। ঝিলাম ওকে ঘরে আসতে বলে। ঝিলামের মুখ দেখে বুধাদিত্য আর পিছিয়ে থাকতে পারে না। গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ওর সাথে হাঁটতে শুরু করে। ঝিলাম কিছু কেনাকাটা করে, বুধাদিত্য ওকে সেই সব ব্যাগ নিতে সাহায্য করে। পাশে বুধাদিত্যকে পেয়ে ঝিলামের মনে যেন একটু বল আসে। বাড়িতে ঢুকেই আগে বুধাদিত্যের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে আনে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে ঝিলামের মন একটু হাল্কা হয়। বুধাদিত্য বাড়ি ফিরে যায়।
বুধাদিত্য একদিন সমীরকে সোজাসুজি ফোনে জিজ্ঞেস করে হোটেল সাংরিলায় দেখা মেয়েটার কথা। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে সমীর। বুধাদিত্য চেপে ধরে সমীরকে কোন ঠাসা করে বলে দেয় যে সেদিন ঝিলামকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে। সমীর ধরা পরে যায়, বিকেলে দেখা করার কথা বলে। বিকেলে দেখা হয় দুই বন্ধুর। বুধাদিত্যকে সমীর জানায় যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ওদের বম্বের অফিসের একজন। বুধাদিত্য ঠিক মানতে পারে না, পাল্টা জিজ্ঞেস করে যে, যদি অফিস কলিগ হয়ে থাকে তাহলে কেন এত লুকোচুরি, কেন ঝিলামকে বলেছিল যে আহমেদাবাদ যাচ্ছে? সমীরের কাছে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকে না। বুধাদিত্য ওকে সাবধান করে দেয়, বলে যে, নারীসঙ্গ করছ কর, বুধাদিত্য নিজে কিছু কাল আগে পর্যন্ত অনেকের সাথে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরলে যেন একবার ভেবে দেখে সমীর, ঘরে একজন বউ আছে। সমীর চুপ করে ওর কথা শুনে যায়। শেষে জানায় যে শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক আছে সেই মেয়েটার সাথে। বুধাদিত্য জানতে চায় সেই মেয়েটার নাম আর ঠিকানা, সমীর এড়িয়ে যায়। বলে যে একদিনের দেখা, এত প্রশ্ন বাণে কেন জর্জরিত করছে? সব ভুলে এবার নতুন করে ঝিলামকে কাছে টেনে নেবে সমীর। বুধাদিত্য ওকে বাড়ি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতন সাবধান বানী দেয়।
সেদিনের পরে ঝিলামের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে। সমীর মাঝে মাঝেই আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, ঝিলামকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজারে বের হয়। ঝিলাম বেশ খুশি সমীরের আচরনে। ঝিলামের অফিসে হানা দেওয়া একটু কমে গেছে। আগে যেখানে পাঁচ দিনে চারদিন হানা দিয়ে আব্দার করত বাড়ি পৌঁছে দাও সেখানে আজকাল হয়ত দু’দিন অফিসে আসে। সমীর নতুন বাইক কিনেছে, মাঝে মাঝই ঝিলামকে স্কুল থেকে নিতে আসে। সমীর ঝিলামকে নিতে আসলে মাঝে মাঝে দু’জনে মিলে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে যায়। ঝিলামের মুখে হাসি দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আলমারি খুলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা সেই ইভিনিং ড্রেস টা দেখে আর ম্লান হাসে। মনের মধ্যে যে স্বপ্ন গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেটা হয়ত এই যাত্রায় আর সফল হবে না। সমীরের এই আচরনে বুধাদিত্যের ভাল লাগে তবে মনের কোনে একটু ব্যাথাও জাগে।
এক মাস কেটে যায়। সমীর আর ঝিলামের সাথে দেখা সাক্ষাৎ অনেক কমে যায়। ঝিলাম মাঝে সাঝে ফোন করে, খবরা খবর নেয়। বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায় ঝিলাম, মনে মনে বোঝে যে সমীরের সাথে নিশ্চয় বুধাদিত্য কথা বলেছে তাই সমীর বদলে গেছে।
দেশের খুব বড় একটা মোবাইল অপারেটারের সাথে মিটিং করতে একবার পুনে যায় বুধাদিত্য, দিন দুয়েকের কাজ। এবারে যাবার আগে ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোন কথা হয়না। রাতের বেলা কাজের শেষে একদিন বুধাদিত্য অফিসের বাকি লোকদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায় কাজের খুশিতে পার্টি দেবার জন্য। সেখানে সমীরের মুখোমুখি হয়। বুধাদিত্য প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায় সমীরকে দেখে, জিজ্ঞেস করে কি কারনে পুনেতে? যথারীতি সমীর এক উত্তর দেয় যে অফিসের কাজে এসেছে। রাতের বেলা ঝিলামকে ফোন করে জানতে পারে যে সমীর পুনে গেছে অফিসের কাজে। অনেকদিন পরে ঝিলাম ওর গলার আওয়াজ পেয়ে খুব খুশি হয়, জানায় যে সমীর অনেক বদলে গেছে নাকি। তবে আজকাল অফিসের কাজে হামেশাই বাইরে থাকে। একটু সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কিছু বলে না, শুধু জানায় যে সমীরের সাথে দেখা হয়েছে ওর। সেটা শুনে ঝিলাম একটু অবাক হয়ে যায়। বুধাদিত্যকে জানায় যে কিছু আগে নাকি সমীরের সাথে কথা হয়েছিল, কিন্তু ওদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে সমীর ওকে কিছুই জানায় নি। সমীরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে কোন হোটেলে উঠেছে না হলে একবার দেখা করে আসত বুধাদিত্য। ঝিলামের কথা শুনে ওর নাকে একটা সন্দেহের গন্ধ আসে। সমীর খুব বড় একটা খেলা খেলছে ঝিলামের সাথে।
পরেরদিন ভাগ্যবশত সমীরের সাথে একটা চাইনিজ রেস্তুরেন্টে দেখা হয় বুধাদিত্যের। এবারে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে ওর সাথে সেই মেয়েটা যাকে ও হোটেল শাংরিলতে দেখেছে। সমীরের ওপরে যা সন্দেহ করেছিল সেটা চোখে দেখে প্রতীত হয় যে সমীর অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে নিজের মোবাইলে। একটা ভিডিও তুলে নেয়, যেখানে সমীর বেশ গা এলিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে গল্প করছে, কাঁটা চমচে নুডুলস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বেশ হাত ধরে আছে সমীরের, দেখে মনে হল ওদের প্রেম অনেক গভীর খাদে বয়ে চলেছে। চোখের সামনে ঝিলামের চেহারা ভেসে ওঠে। খাবার পরে বুধাদিত্য সোজা ওদের টেবিলে যায় আর সমীরের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সমীর ওকে দেখে ভুত দেখার মতন থমকে যায়। এবারে হাতেনাতে ধরা পরে গেছে সমীর। পাশে বসা মেয়েটা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। বুধাদিত্য সমীরকে বাইরে ডাকে কিছু কথা বলার জন্য।
বাইরে যেতেই বুধাদিত্য সমীরকে চেপে ধরে, “কি ব্যাপার একটু খোলসা করে জানা আমাকে।”
সমীর একটু রেগে যায় ওর কথায়, “তোর সব ব্যাপারে মাথা গলাবার কি দরকার। আমি আমার জীবন নিয়ে কি করব না করব সেটা তোকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখের সামনে ঝিলামের হাসি মাখানো মিষ্টি মুখ ভেসে ওঠে। সমীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে ঝিলাম। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরকে বলে, “তোদের দুজনকে দেখে ত মনে হয় না যে তোদের সম্পর্ক শুধু মাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকেও তুই ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?”
সমীর প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়, “না রে, তোকে বলেছিলাম ত, এই ব্যাস ফ্লার্টিং, শালা আর কি, এক রাত ব্যাস কাম খালাস।”
বুধাদিত্য, “এটা এক রাতের ব্যাপার নয় সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে সমীর। এই মেয়ে হোটেল শাংরিলাতে ছিল, এই মেয়ে হয়ত কাল তোর সাথে ছিল।”
সমীর কিছু বলতে যাবার আগেই বুধাদিত্যের সব সন্দেহ দূর করে মেয়েটা সমীরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে সমু, এনি প্রবলেম?”
বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর, যাক কানে শুনে সন্দেহের ভিত অনেক মজবুত হয়ে গেছে। সমীর মেয়েটাকে ভেতরে যেতে বলে। ওকে বলে যে অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই একটু কথা বলেই টেবিলে ফিরে যাবে। মেয়েটা একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায় একবার সমীরের মুখের দিকে তাকায়, তারপরে চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যেতেই সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “ঝিলাম যা চায় সেটা ও পেয়ে গেছে। আমি আমার জীবনে কি করছি না করছি সেটা ওর দেখার দরকার নেই।”
বুধাদিত্য, “সমীর, ঝিলাম তোর বিয়ে কর বউ, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি তোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না, ছেলে হয়েছিস যখন তখন যে শালা এদিকে ওদিকে মুখ মারবি সেটা আর নতুন কি? কিন্তু শালা মুখ মারতে গিয়ে প্রেমে পড়বি আর বাড়িতে বউ একা থাকবে?”
সমীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরে জিজ্ঞেস করে রাতে খালি আছে কিনা? বুধাদিত্য নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় আর বলে রাতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। বিস্তারিত ভাবে কথা বলতে চায় সমীর ওর সাথে। রাতে সমীর ওর হোটেলের ঘরে আসে। বুধাদিত্য ওকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করে যে দুজনে একসাথে এক রুমে থাকছে কি না। মাথা দুলিয়ে মেনে নেয় সমীর, যে মেয়েটা আর সমীর এক রুমে আছে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বুধাদিত্য কারন জানতে চায়, কেন সমীর ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সমীরের সাথে কথাবার্তা টেপ করার জন্য চুপিচুপি মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য।
সমীর বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “আগেও তোকে জানিয়েছিলাম ঝিলামের কথা। জানিনা তোর মনে আছে কি না। চাকরি পাওয়ার পরে ঝিলাম যে আরও বদলে যাবে সেটা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ও সুন্দরী, ও ভীষণ আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি ও ভীষণ জেদি আর বদরাগী। চাকরি পাওয়ার পরে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবসময়ে। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, স্কুলে বেড়িয়ে যায় আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। রাতে আমার দেরি হয় ফিরতে, সেই নিয়ে ওর কথা শুনতে হয়। ওর কথা সারে আট’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত নিয়ম কানুন মেনে চলা বড় কঠিন। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই দুই, তিন মাসে। জোর করে গাড়ি কেনার জন্য, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বাইক কিনি। আজকাল আবার আমার পয়সার হিসাব চায়। কই, আমি’ত ওর চাকরির পয়সার হিসাব চাই না? আমার আতে লাগে যখন আমার খরচ খরচার ওপরে হাত লাগাতে চায়।”
বুধাদিত্য চুপচাপ শুনে যায়। সমীর বলে চলে, “আজকাল জানিস আর আমাদের সেক্স হয়না। কোলকাতায় থাকাকালীন ঝিলাম উদ্দাম ছিল, প্রচন্ড উচ্ছল ছিল, সেই ঝিলাম অনেক বদলে গেছে। আমি বাড়ি ফিরি, ঝিলাম ঘুম চোখে দরজা খুলে আমার জন্য খাবার গরম করে শুতে চলে যায়। আমি চুপচাপ ওকে না ঘাটিয়ে নিজের খাবার খাই। এমত অবস্থায় আর কি একসাথে থাকা যায়? তুই জানিস না, এই দিল্লী এসেই ওর একটা মিসক্যারেজ হয়েছিল। তারপরে আমাদের শারীরিক সম্বন্ধ অনেক কমে যায়। আমাকে দোষ দেয় যে আমার নাকি স্পারম কাউন্ট কম।”
বুধাদিত্য, “তুই কি সে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলি কোনদিন?”
সমীর, “না আমার কিছু হয়নি, ওর মা হবার ক্ষমতা নেই। ওর গাইনি দেখে বলেছিল যে ওর গর্ভাশয়ে কিছু সমস্যা আছে।”
বুধাদিত্য, “দ্যাখ, আমি সেসব বিশেষ জানি না, তবে আমার মনে হয় তোর একবার ডাক্তার দেখান উচিত। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে একটা মিস্ক্যারেজের পরে একটা মেয়ের মনে বড় আঘাত লাগে, সেই আঘাত কাটতে একটু সময় লাগে। তুই কি সেই সময় টুকু ঝিলামকে দিয়েছিস?”
সমীর চুপ করে থাকে, বুধাদিত্যের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঝিলামের দিকে তারপরে হয়ত আর ফিরেও তাকায়নি ঠিক ভাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে বম্বের সেই মেয়েটার কথা। বুধাদিত্য দু’টো সিগারেট জ্বালায়, একটা সমীরকে দেয়। সমীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, “বম্বে অফিসে নন্দিতার সাথে দেখা।” মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, অবশেষে সমীরের জীবনের নতুন নারীর নাম জানা গেল, নন্দিতা। সমীর বলে চলে, “এক বিকেলে মিটিঙ্গের পরে আমার মাথায় এই সব চিন্তা ভাবনা ঘোরে, আমি খুব ড্রিঙ্ক করি। আর ড্রিঙ্কের বশে নন্দিতাকে মনের কথা বলে দেই, সেদিন রাতে দু’জনে আমার রুমে এসে পাগলের মতন সহবাস করেছিলাম। আমি তারপরে ওর প্রতি ঝুঁকে যাই। নন্দিতাকে ফেলে দেওয়ার এখন উপায় নেই। আমি সেইজন্য নন্দিতাকে দিল্লীতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিকে ঝিলাম, একদিকে নন্দিতা। একজন কে ছাড়তে পারিনা বাড়ির চাপে, আত্মীয় সজ্জনের চাপে, অন্যজনকে ছাড়তে পারিনা কেননা মন মানে না।”
সব কথা বলে সমীর চুপ করে থাকে। বুধাদিত্যের কান লাল হয়ে যায় সব কথা শুনে, জিজ্ঞেস করে সমীরকে, “কি করতে চাস তুই? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এই রকম দুই নৌকায় পা দিয়ে ত চলা যায় না।”
সমীর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, “মাঝে মাঝে মনে হয় ডিভোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু ওর পরিবার, আমার পরিবার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, এমন কি ঝিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ঝিলাম, অনেক বার করেছিল। আমি ঝিলামকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এক সবল পুরুষ, যেকোনো নারীকে সঙ্গমের সুখ দিতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নন্দিতাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি ঝিলামের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না কোনদিন। ও আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না কোনদিন। আমি কোথায় কি করছি, না করছি সেটা ওর জেনে দরকার নেই। আমিও দেখতে যাবো না ও কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে রাত কাটাচ্ছে।”
ঝিলামের মতন মিষ্টি, পবিত্র মেয়ের নামে ওই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যায় বুধাদিত্য। মনে হয় এক থাবরে মাথা ফাটিয়ে দেয় সমীরের, গর্জে ওঠে বুধাদিত্য, “ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছে? ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেছে? ঝিলামের নামে এই কথা বলার আগে তোর বুকে একবারের জন্য বাঁধল না? তোকে বুকে আগলে বাঁচিয়ে এনেছে আর তুই মাদা... শালা শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত, বউয়ের নামে এত জঘন্য অপবাদ দিলি?”
সমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “সারা জীবন ধরে কি আমাকে সেই এক কথা শুনাতে চাস? ঝিলামের প্রতি তোর অত দরদ কিসের বোকা... তুই কি আমার বউয়ের সাথে শুয়েছিস?”
রাগে কাঁপতে শুরু করে বুধাদিত্য, কান মাথা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে দেয়। সত্যি ওর বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝিলাম বসবাস। যদিও ঝিলাম সেই কথা এখন জানেনা জানলেও হয়ত এই জানে যে বুধাদিত্যের মনে কোন পাপ নেই। মনকে শক্ত করে বেঁধে নেয় বুধাদিত্য, হৃদয়ের টান যেন চোখে না এসে যায়। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “মাদার... কুত্তারবাচ্চা, এই কথা বলতে তোর একবার বাধল না? গত ছয় বছর পরে তোদের পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, দিল্লীতে আমার নিজের বলতে কেউ আছে। আজ আমার বুকের সেই আশা সেই ভালোবাসা খানখান করে দিলি তুই।”
সমীররে মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। সমীর মনেপ্রানে জানে যে বুধাদিত্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সেই রাতে। চুপ করে থাকে, সমীর, বুধাদিত্য গর্জে ওঠে, “বেড়িয়ে যা শালা, বোকা... এখুনি বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে। মাদা... একবার ভেবেছিলাম তোদের থেকে দুরে চলে যাব, কিন্তু যাবো না এবারে। তোর জ্বলানো এই আগুনের খেলার আমি শেষ দেখে যাব। ঝিলামের চুলের ডগা যদি এই আগুন ছোঁয়, কথা দিচ্ছি, তুই শালা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবি না।”
সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পরে, রাগে, দুঃখে দুচোখ লাল হয়ে গেছে ওর। রোষ ভরা নয়নে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি, আর তুই যদি আমাদের মাঝে আসিস তাহলে সেই আগুনে তোকে জ্বালিয়ে দেব।”
সমীর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, বুধাদিত্য হাতের মুঠি শক্ত করে চেয়ারে বসে থাকে। ভীষণ রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয়, একবার মনে হয় সমীরকে খুন করে ওর কবল থেকে ঝিলামকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ওকে আইনের চোখে, ঝিলামের চোখে নিচ, ঘৃণ্য অপরাধী বলে প্রমানিত করবে। মাথা কাজ করে না বুধাদিত্যের।
পিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
দ্বিতীয় অঙ্ক
Written By pinuram
Written By pinuram
দশম পর্বঃ নোনাধরা প্রাচীর (#1)
এপ্রিলের মাঝামাঝি বুধাদিত্য দুই সপ্তাহের জন্য অস্ট্রেলিয়া যায় অফিসের কাজে। সমীর ঝিলাম দুজনেই ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিল। সেই নিয়ে বুধাদিত্যের কি হাসি, বলে ওকি অগস্ত্য যাত্রা করছে নাকি যে একেবারে দল বেধে ছাড়তে এসেছে। অগস্ত্য যাত্রার কথা শুনে ঝিলামের চোখ ছলছল করে ওঠে। সমীর না থাকলে ঝিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে বলত, যে ওইরকম কথা বলতে নেই। যাবার আগে ঝিলাম বারবার ওকে জানায় যে ওখানে পৌঁছে অন্তত একটা এস.এম.এস যেন করে দেয় যে ঠিক করে পৌঁছে গেছে, আর যেন ওর ঘুমের ব্যাঘাত না করে। অপেক্ষা করে থাকবে ওর পৌঁছানর খবরের জন্য। বুধাদিত্য ওকে জানিয়ে দেয় যে পৌঁছে ফোন করে দেবে। বুধাদিত্য মেলবোর্ন পৌঁছেই ফোন করেছিল। ভোরেরবেলা মেলবোর্ন পৌঁছায়, তখন ঝিলাম ঘুমিয়েছিল, মাথার কাছেই ফোন রেখে দিয়েছিল। এক ডাকেই ফোন ধরে ঘুম ঘুম চোখে ওকে বলে, “ভালো করে পৌঁছে গেছ? এবারে আর আমাকে জ্বালাতন করো না একটু ঘুমাতে দাও।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর ঘুম জড়ানো মিষ্টি গলার আওয়াজ শুনে। হাজার মাইল দূর থেকে সেই গলার আওয়াজ শুনে ফোন বুকের কাছে ধরে বুধাদিত্য। এখানে ওকে কেউ দেখতে যাচ্ছে না, ও কি করছে। মোবাইলে ওর ছবিটা খুলে একবার দেখে ছোটো একটা চুমু খায়।
সিডনি থেকে সমীরের জন্য একটা জিন্স কেনে আর ঝিলামের জন্য একটা ভারসাসের কাঁধের ব্যাগ কেনে। তার সাথে ঝিলামের জন্য একটা হাল্কা বেগুনি রঙের খুব সুন্দর ইভিং গাউন কেনে। মনের কোনায় সযত্নে একটা স্বপ্ন একে নেয়, ভবিষ্যতে কোনদিন এই গাউন ঝিলামকে পরাবে, তবে সমীরের সামনে নয়। সেদিন শুধু ঝিলাম আর বুধাদিত্য থাকবে, জানেনা সেইদিন কোনদিন আসবে কি না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি নেই। ফিরে এসে এয়ারপোর্টে নেমেই সমীরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দিল্লী পৌঁছে গেছে। সমীর আর ঝিলাম দুজনেই ওর বাড়িতে এসেছিল সেইদিন বিকেলবেলায়। সমীর আর ঝিলাম ওর আনা উপহার পেয়ে খুব খুশি, সমীরের জন্য আলাদা করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছিল এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি দোকান থেকে। ইচ্ছে করেই মদ কেনেনি, কেননা ঝিলামকে কথা দিয়েছিল।
দিনেদিনে সমীরের অফিসের কাজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই অফিসের ট্রিপে বাইরে চলে যায় একদিন দুদিনের জন্য। ঝিলাম সেই নিয়ে বিশেষ কথা বাড়ায় না, কেননা কাজের জন্য যায় সমীর। একদিন অস্ত্রেলিয়া থেকে এক ক্লায়েন্ট আসে, বুধাদিত্য আর সি.টি.ও তাকে নিয়ে লাঞ্চে বের হয়, হোটেল সাংরিলা, অরিয়েন্টাল এভিনিউ’তে। দিল্লীর বেশ নামী দামী হোটেল। তিনজনে বসে নিজেদের কাজে গল্পে মশগুল হটাত চোখ পরে দুরে একটা টেবিলে। পেছন থেকে দেখে মনে হয় যেন লোকটাকে কোথায় দেখেছে। লোকটার সামনে এক সুন্দরী মেয়ে বসে। দুজনের হাবভাব আচার আচরনে দেখে মনে হল বেশ ভালভাবে পরস্পরকে চেনে আর বেশ হেসে কথা বলছে দুজনে। কিন্তু বুধাদিত্যের চোখ আটকে থাকে সেই লোকটার দিকে। ওর দিকে পিঠ থাকার দরুন মুখ দেখতে পায়না। পেছন থেকে সমীরের মতন দেখতে। বাথরুমে যাবার আছিলায়, ঝিলামকে ফোন করে জানে যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে কোন অফিসের কাজে। কিছু বলেনা বুধাদিত্য, বাথরুম থেকে বেড়িয়ে সেই লোকের মুখোমুখি হয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পরে সমীর, যেন ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে, সামনে বুধাদিত্য। বুধাদিত্য চুপ করে একবার ওর লাল মুখের দিকে তাকায় আর দুরে টেবিলে বসা সেই মেয়েটার দিকে তাকায়। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই মেয়েটা কে? সমীর আমতা আমতা করে জানায় যে অফিস কলিগ। বুধাদিত্য ওকে জানতে দেয় না যে ঝিলামের কাছে আগে থেকেই সমীরের আহমেদাবাদ যাবার খবর আছে। শুধু একটা কথা বলে চলে যায়, মিথ্যেটা না বললেই ভালো হত। বলে যে, পরে এই নিয়ে কথা হবে। সমীরের যেন বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। বুধাদিত্যের দিকে এক পা এগিয়ে হাত ধরতে যায়, কিন্তু ততক্ষণে বুধাদিত্য নিজের টেবিলে গিয়ে বসে পরে। ঝিলামকে এইসব কথা কিছুই জানায় না। ভাবে একবার সোজা সমীরের সাথে কথা বলে দেখবে আগে।
একদিন দুপুরে ঝিলাম অফিসে না ঢুকে ফোন করে বুধাদিত্যকে নিচে আসার জন্য। গলার স্বরে একটু আহতভাব। নিচে নেমে দেখে যে ঝিলাম বাইরে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। অন্যদিনে রিসেপ্সানে বসে থাকে, পেপার বাঁ কোন ম্যাগাজিন পড়ে যতক্ষণ না বুধাদিত্য নেমে আসে। ঝিলামের মুখের ভাব দেখে বুঝে যায় যে সমীরের সাথে হয়ত কোন বিষয়ে মনমালিন্য ঘটেছে। গাড়ি চেপে বাড়ি ফেরার সময়ে ঝিলাম অস্বাভাবিক ভাবে চুপ। বুধাদিত্য আড় চোখে ওর দিকে তাকায় আর গাড়ি চালায়।
ঝিলামের উচ্ছল গলার আওয়াজ না পেয়ে বড় আহত হয়, জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে? সমীরের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
ঝিলাম মাথা দুলিয়ে বলে, “কই না ত।” ঠোঁটে জোর করে হাসি টেনে বলে, “কেন আমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নাকি?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “তোমার চোখ মুখ বলছে যে কিছু একটা ঘটেছে আর সেটা সমীরের সাথেই। কি হয়েছে আমাকে বলবে না?”
ঝিলাম একটু আহত গলায় বলে, “একটু দেরি করে অফিসে ফিরলে তোমার অসুবিধে আছে?”
বুধাদিত্য গাড়ি ঘুড়িয়ে নেয় অফিসের দিকে। ঝিলামের ম্লান চেহারা বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন কি হয়েছে?”
ঝিলাম নিচু স্বরে বলে, “জানো, কাল ওর একটা ক্রেডিট কার্ডের বিল এসেছিল। সেটা খুলে দেখেছি বলে কত কথা শুনিয়ে দিল আমাকে। আমি যেন ওর কেউ না, এমন একটা ভাব দেখাল সমু।”
চোখের কোল ভিজে এসেছে ঝিলামের। “মাঝে মাঝে আজকাল কি রকম আলগা আলগা ব্যাবহার করে আমার সাথে। আজকাল আবার মদ খাওয়া ধরেছে, কিছু বলতে গেলেই রেগে যায়।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ঝিলামের কথা শুনে। অফিস পৌঁছে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বাড়ি না ফিরে ওকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে ফাঁকা এন.এইচ-১ হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম চুপ করে পাশে বসে থাকে, কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। বিকেল গড়িয়ে আসে, দুজনে চুপ। ঝিলামের বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়।
বুধাদিত্য ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সমীরকে সোজাসুজি প্রশ্ন কেন করছ না?”
ঝিলাম ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “কি জিজ্ঞেস করব?”
বুধাদিত্য, “সোজাসুজি জিজ্ঞেস কর, যে ওর কি কাউকে মনে ধরেছে নাকি?”
বুধাদিত্যের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ঝিলাম। সমীর ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে, না ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্যকে বলে, “না না, এটা নয়, হয়ত ওর কাজের জন্য খুব ব্যাস্ত থাকে তাই হয়ত মাঝে মাঝে মদ খায় আর রাত করে বাড়ি ফেরে।”
বুধাদিত্য, “একবার জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে।”
ঝিলাম, “তোমার ত বন্ধু, তুমি না হয় একবার জিজ্ঞেস কর।
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, একবার সমীরকে হাতেনাতে ধরতে হবে, প্রমান যোগাড় করে ওর সামনে দাঁড়াতে হবে। না হলে সমীর প্রতিবারের মতন কিছু না কিছু আছিলায় এড়িয়ে যাবে বুধাদিত্যের প্রশ্নবান আর কোন এক গল্প বানিয়ে বলে দেবে। ঝিলামের মন ভোলানোর জন্য ওকে জিজ্ঞেস করে স্কুলের কথা, বাড়ির কথা। বাড়ির জন্য শপিং করেছিল কিন্তু বাড়ি যাওয়া হয়নি। ঝিলাম ভেবে রেখেছে যে গরমের ছুটিতে দুর্গাপুর যাবে। অবশ্য সে কথা এখন সমীরকে জানায়নি, তবে ইচ্ছে আছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। ঝিলাম সমীরকে ফোন করে কিন্তু ফোন রিং হয়ে যায়। ঝিলাম বার কয়েক ফোন করার পরে আর করে না। ঝিলামে কে নামিয়ে দেবার পরেও ঝিলাম দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। ঝিলাম ওকে ঘরে আসতে বলে। ঝিলামের মুখ দেখে বুধাদিত্য আর পিছিয়ে থাকতে পারে না। গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ওর সাথে হাঁটতে শুরু করে। ঝিলাম কিছু কেনাকাটা করে, বুধাদিত্য ওকে সেই সব ব্যাগ নিতে সাহায্য করে। পাশে বুধাদিত্যকে পেয়ে ঝিলামের মনে যেন একটু বল আসে। বাড়িতে ঢুকেই আগে বুধাদিত্যের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে আনে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে ঝিলামের মন একটু হাল্কা হয়। বুধাদিত্য বাড়ি ফিরে যায়।
দশম পর্বঃ নোনাধরা প্রাচীর (#2)
বুধাদিত্য একদিন সমীরকে সোজাসুজি ফোনে জিজ্ঞেস করে হোটেল সাংরিলায় দেখা মেয়েটার কথা। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে সমীর। বুধাদিত্য চেপে ধরে সমীরকে কোন ঠাসা করে বলে দেয় যে সেদিন ঝিলামকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে। সমীর ধরা পরে যায়, বিকেলে দেখা করার কথা বলে। বিকেলে দেখা হয় দুই বন্ধুর। বুধাদিত্যকে সমীর জানায় যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ওদের বম্বের অফিসের একজন। বুধাদিত্য ঠিক মানতে পারে না, পাল্টা জিজ্ঞেস করে যে, যদি অফিস কলিগ হয়ে থাকে তাহলে কেন এত লুকোচুরি, কেন ঝিলামকে বলেছিল যে আহমেদাবাদ যাচ্ছে? সমীরের কাছে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকে না। বুধাদিত্য ওকে সাবধান করে দেয়, বলে যে, নারীসঙ্গ করছ কর, বুধাদিত্য নিজে কিছু কাল আগে পর্যন্ত অনেকের সাথে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরলে যেন একবার ভেবে দেখে সমীর, ঘরে একজন বউ আছে। সমীর চুপ করে ওর কথা শুনে যায়। শেষে জানায় যে শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক আছে সেই মেয়েটার সাথে। বুধাদিত্য জানতে চায় সেই মেয়েটার নাম আর ঠিকানা, সমীর এড়িয়ে যায়। বলে যে একদিনের দেখা, এত প্রশ্ন বাণে কেন জর্জরিত করছে? সব ভুলে এবার নতুন করে ঝিলামকে কাছে টেনে নেবে সমীর। বুধাদিত্য ওকে বাড়ি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতন সাবধান বানী দেয়।
সেদিনের পরে ঝিলামের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে। সমীর মাঝে মাঝেই আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, ঝিলামকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজারে বের হয়। ঝিলাম বেশ খুশি সমীরের আচরনে। ঝিলামের অফিসে হানা দেওয়া একটু কমে গেছে। আগে যেখানে পাঁচ দিনে চারদিন হানা দিয়ে আব্দার করত বাড়ি পৌঁছে দাও সেখানে আজকাল হয়ত দু’দিন অফিসে আসে। সমীর নতুন বাইক কিনেছে, মাঝে মাঝই ঝিলামকে স্কুল থেকে নিতে আসে। সমীর ঝিলামকে নিতে আসলে মাঝে মাঝে দু’জনে মিলে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে যায়। ঝিলামের মুখে হাসি দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আলমারি খুলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা সেই ইভিনিং ড্রেস টা দেখে আর ম্লান হাসে। মনের মধ্যে যে স্বপ্ন গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেটা হয়ত এই যাত্রায় আর সফল হবে না। সমীরের এই আচরনে বুধাদিত্যের ভাল লাগে তবে মনের কোনে একটু ব্যাথাও জাগে।
এক মাস কেটে যায়। সমীর আর ঝিলামের সাথে দেখা সাক্ষাৎ অনেক কমে যায়। ঝিলাম মাঝে সাঝে ফোন করে, খবরা খবর নেয়। বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায় ঝিলাম, মনে মনে বোঝে যে সমীরের সাথে নিশ্চয় বুধাদিত্য কথা বলেছে তাই সমীর বদলে গেছে।
দেশের খুব বড় একটা মোবাইল অপারেটারের সাথে মিটিং করতে একবার পুনে যায় বুধাদিত্য, দিন দুয়েকের কাজ। এবারে যাবার আগে ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোন কথা হয়না। রাতের বেলা কাজের শেষে একদিন বুধাদিত্য অফিসের বাকি লোকদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায় কাজের খুশিতে পার্টি দেবার জন্য। সেখানে সমীরের মুখোমুখি হয়। বুধাদিত্য প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায় সমীরকে দেখে, জিজ্ঞেস করে কি কারনে পুনেতে? যথারীতি সমীর এক উত্তর দেয় যে অফিসের কাজে এসেছে। রাতের বেলা ঝিলামকে ফোন করে জানতে পারে যে সমীর পুনে গেছে অফিসের কাজে। অনেকদিন পরে ঝিলাম ওর গলার আওয়াজ পেয়ে খুব খুশি হয়, জানায় যে সমীর অনেক বদলে গেছে নাকি। তবে আজকাল অফিসের কাজে হামেশাই বাইরে থাকে। একটু সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কিছু বলে না, শুধু জানায় যে সমীরের সাথে দেখা হয়েছে ওর। সেটা শুনে ঝিলাম একটু অবাক হয়ে যায়। বুধাদিত্যকে জানায় যে কিছু আগে নাকি সমীরের সাথে কথা হয়েছিল, কিন্তু ওদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে সমীর ওকে কিছুই জানায় নি। সমীরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে কোন হোটেলে উঠেছে না হলে একবার দেখা করে আসত বুধাদিত্য। ঝিলামের কথা শুনে ওর নাকে একটা সন্দেহের গন্ধ আসে। সমীর খুব বড় একটা খেলা খেলছে ঝিলামের সাথে।
পরেরদিন ভাগ্যবশত সমীরের সাথে একটা চাইনিজ রেস্তুরেন্টে দেখা হয় বুধাদিত্যের। এবারে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে ওর সাথে সেই মেয়েটা যাকে ও হোটেল শাংরিলতে দেখেছে। সমীরের ওপরে যা সন্দেহ করেছিল সেটা চোখে দেখে প্রতীত হয় যে সমীর অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে নিজের মোবাইলে। একটা ভিডিও তুলে নেয়, যেখানে সমীর বেশ গা এলিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে গল্প করছে, কাঁটা চমচে নুডুলস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বেশ হাত ধরে আছে সমীরের, দেখে মনে হল ওদের প্রেম অনেক গভীর খাদে বয়ে চলেছে। চোখের সামনে ঝিলামের চেহারা ভেসে ওঠে। খাবার পরে বুধাদিত্য সোজা ওদের টেবিলে যায় আর সমীরের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সমীর ওকে দেখে ভুত দেখার মতন থমকে যায়। এবারে হাতেনাতে ধরা পরে গেছে সমীর। পাশে বসা মেয়েটা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। বুধাদিত্য সমীরকে বাইরে ডাকে কিছু কথা বলার জন্য।
বাইরে যেতেই বুধাদিত্য সমীরকে চেপে ধরে, “কি ব্যাপার একটু খোলসা করে জানা আমাকে।”
সমীর একটু রেগে যায় ওর কথায়, “তোর সব ব্যাপারে মাথা গলাবার কি দরকার। আমি আমার জীবন নিয়ে কি করব না করব সেটা তোকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখের সামনে ঝিলামের হাসি মাখানো মিষ্টি মুখ ভেসে ওঠে। সমীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে ঝিলাম। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরকে বলে, “তোদের দুজনকে দেখে ত মনে হয় না যে তোদের সম্পর্ক শুধু মাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকেও তুই ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?”
সমীর প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়, “না রে, তোকে বলেছিলাম ত, এই ব্যাস ফ্লার্টিং, শালা আর কি, এক রাত ব্যাস কাম খালাস।”
বুধাদিত্য, “এটা এক রাতের ব্যাপার নয় সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে সমীর। এই মেয়ে হোটেল শাংরিলাতে ছিল, এই মেয়ে হয়ত কাল তোর সাথে ছিল।”
সমীর কিছু বলতে যাবার আগেই বুধাদিত্যের সব সন্দেহ দূর করে মেয়েটা সমীরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে সমু, এনি প্রবলেম?”
বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর, যাক কানে শুনে সন্দেহের ভিত অনেক মজবুত হয়ে গেছে। সমীর মেয়েটাকে ভেতরে যেতে বলে। ওকে বলে যে অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই একটু কথা বলেই টেবিলে ফিরে যাবে। মেয়েটা একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায় একবার সমীরের মুখের দিকে তাকায়, তারপরে চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যেতেই সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “ঝিলাম যা চায় সেটা ও পেয়ে গেছে। আমি আমার জীবনে কি করছি না করছি সেটা ওর দেখার দরকার নেই।”
বুধাদিত্য, “সমীর, ঝিলাম তোর বিয়ে কর বউ, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি তোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না, ছেলে হয়েছিস যখন তখন যে শালা এদিকে ওদিকে মুখ মারবি সেটা আর নতুন কি? কিন্তু শালা মুখ মারতে গিয়ে প্রেমে পড়বি আর বাড়িতে বউ একা থাকবে?”
সমীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরে জিজ্ঞেস করে রাতে খালি আছে কিনা? বুধাদিত্য নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় আর বলে রাতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। বিস্তারিত ভাবে কথা বলতে চায় সমীর ওর সাথে। রাতে সমীর ওর হোটেলের ঘরে আসে। বুধাদিত্য ওকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করে যে দুজনে একসাথে এক রুমে থাকছে কি না। মাথা দুলিয়ে মেনে নেয় সমীর, যে মেয়েটা আর সমীর এক রুমে আছে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বুধাদিত্য কারন জানতে চায়, কেন সমীর ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সমীরের সাথে কথাবার্তা টেপ করার জন্য চুপিচুপি মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য।
সমীর বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “আগেও তোকে জানিয়েছিলাম ঝিলামের কথা। জানিনা তোর মনে আছে কি না। চাকরি পাওয়ার পরে ঝিলাম যে আরও বদলে যাবে সেটা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ও সুন্দরী, ও ভীষণ আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি ও ভীষণ জেদি আর বদরাগী। চাকরি পাওয়ার পরে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবসময়ে। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, স্কুলে বেড়িয়ে যায় আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। রাতে আমার দেরি হয় ফিরতে, সেই নিয়ে ওর কথা শুনতে হয়। ওর কথা সারে আট’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত নিয়ম কানুন মেনে চলা বড় কঠিন। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই দুই, তিন মাসে। জোর করে গাড়ি কেনার জন্য, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বাইক কিনি। আজকাল আবার আমার পয়সার হিসাব চায়। কই, আমি’ত ওর চাকরির পয়সার হিসাব চাই না? আমার আতে লাগে যখন আমার খরচ খরচার ওপরে হাত লাগাতে চায়।”
বুধাদিত্য চুপচাপ শুনে যায়। সমীর বলে চলে, “আজকাল জানিস আর আমাদের সেক্স হয়না। কোলকাতায় থাকাকালীন ঝিলাম উদ্দাম ছিল, প্রচন্ড উচ্ছল ছিল, সেই ঝিলাম অনেক বদলে গেছে। আমি বাড়ি ফিরি, ঝিলাম ঘুম চোখে দরজা খুলে আমার জন্য খাবার গরম করে শুতে চলে যায়। আমি চুপচাপ ওকে না ঘাটিয়ে নিজের খাবার খাই। এমত অবস্থায় আর কি একসাথে থাকা যায়? তুই জানিস না, এই দিল্লী এসেই ওর একটা মিসক্যারেজ হয়েছিল। তারপরে আমাদের শারীরিক সম্বন্ধ অনেক কমে যায়। আমাকে দোষ দেয় যে আমার নাকি স্পারম কাউন্ট কম।”
বুধাদিত্য, “তুই কি সে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলি কোনদিন?”
সমীর, “না আমার কিছু হয়নি, ওর মা হবার ক্ষমতা নেই। ওর গাইনি দেখে বলেছিল যে ওর গর্ভাশয়ে কিছু সমস্যা আছে।”
বুধাদিত্য, “দ্যাখ, আমি সেসব বিশেষ জানি না, তবে আমার মনে হয় তোর একবার ডাক্তার দেখান উচিত। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে একটা মিস্ক্যারেজের পরে একটা মেয়ের মনে বড় আঘাত লাগে, সেই আঘাত কাটতে একটু সময় লাগে। তুই কি সেই সময় টুকু ঝিলামকে দিয়েছিস?”
সমীর চুপ করে থাকে, বুধাদিত্যের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঝিলামের দিকে তারপরে হয়ত আর ফিরেও তাকায়নি ঠিক ভাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে বম্বের সেই মেয়েটার কথা। বুধাদিত্য দু’টো সিগারেট জ্বালায়, একটা সমীরকে দেয়। সমীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, “বম্বে অফিসে নন্দিতার সাথে দেখা।” মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, অবশেষে সমীরের জীবনের নতুন নারীর নাম জানা গেল, নন্দিতা। সমীর বলে চলে, “এক বিকেলে মিটিঙ্গের পরে আমার মাথায় এই সব চিন্তা ভাবনা ঘোরে, আমি খুব ড্রিঙ্ক করি। আর ড্রিঙ্কের বশে নন্দিতাকে মনের কথা বলে দেই, সেদিন রাতে দু’জনে আমার রুমে এসে পাগলের মতন সহবাস করেছিলাম। আমি তারপরে ওর প্রতি ঝুঁকে যাই। নন্দিতাকে ফেলে দেওয়ার এখন উপায় নেই। আমি সেইজন্য নন্দিতাকে দিল্লীতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিকে ঝিলাম, একদিকে নন্দিতা। একজন কে ছাড়তে পারিনা বাড়ির চাপে, আত্মীয় সজ্জনের চাপে, অন্যজনকে ছাড়তে পারিনা কেননা মন মানে না।”
সব কথা বলে সমীর চুপ করে থাকে। বুধাদিত্যের কান লাল হয়ে যায় সব কথা শুনে, জিজ্ঞেস করে সমীরকে, “কি করতে চাস তুই? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এই রকম দুই নৌকায় পা দিয়ে ত চলা যায় না।”
সমীর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, “মাঝে মাঝে মনে হয় ডিভোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু ওর পরিবার, আমার পরিবার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, এমন কি ঝিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ঝিলাম, অনেক বার করেছিল। আমি ঝিলামকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এক সবল পুরুষ, যেকোনো নারীকে সঙ্গমের সুখ দিতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নন্দিতাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি ঝিলামের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না কোনদিন। ও আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না কোনদিন। আমি কোথায় কি করছি, না করছি সেটা ওর জেনে দরকার নেই। আমিও দেখতে যাবো না ও কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে রাত কাটাচ্ছে।”
ঝিলামের মতন মিষ্টি, পবিত্র মেয়ের নামে ওই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যায় বুধাদিত্য। মনে হয় এক থাবরে মাথা ফাটিয়ে দেয় সমীরের, গর্জে ওঠে বুধাদিত্য, “ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছে? ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেছে? ঝিলামের নামে এই কথা বলার আগে তোর বুকে একবারের জন্য বাঁধল না? তোকে বুকে আগলে বাঁচিয়ে এনেছে আর তুই মাদা... শালা শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত, বউয়ের নামে এত জঘন্য অপবাদ দিলি?”
সমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “সারা জীবন ধরে কি আমাকে সেই এক কথা শুনাতে চাস? ঝিলামের প্রতি তোর অত দরদ কিসের বোকা... তুই কি আমার বউয়ের সাথে শুয়েছিস?”
রাগে কাঁপতে শুরু করে বুধাদিত্য, কান মাথা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে দেয়। সত্যি ওর বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝিলাম বসবাস। যদিও ঝিলাম সেই কথা এখন জানেনা জানলেও হয়ত এই জানে যে বুধাদিত্যের মনে কোন পাপ নেই। মনকে শক্ত করে বেঁধে নেয় বুধাদিত্য, হৃদয়ের টান যেন চোখে না এসে যায়। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “মাদার... কুত্তারবাচ্চা, এই কথা বলতে তোর একবার বাধল না? গত ছয় বছর পরে তোদের পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, দিল্লীতে আমার নিজের বলতে কেউ আছে। আজ আমার বুকের সেই আশা সেই ভালোবাসা খানখান করে দিলি তুই।”
সমীররে মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। সমীর মনেপ্রানে জানে যে বুধাদিত্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সেই রাতে। চুপ করে থাকে, সমীর, বুধাদিত্য গর্জে ওঠে, “বেড়িয়ে যা শালা, বোকা... এখুনি বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে। মাদা... একবার ভেবেছিলাম তোদের থেকে দুরে চলে যাব, কিন্তু যাবো না এবারে। তোর জ্বলানো এই আগুনের খেলার আমি শেষ দেখে যাব। ঝিলামের চুলের ডগা যদি এই আগুন ছোঁয়, কথা দিচ্ছি, তুই শালা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবি না।”
সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পরে, রাগে, দুঃখে দুচোখ লাল হয়ে গেছে ওর। রোষ ভরা নয়নে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি, আর তুই যদি আমাদের মাঝে আসিস তাহলে সেই আগুনে তোকে জ্বালিয়ে দেব।”
সমীর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, বুধাদিত্য হাতের মুঠি শক্ত করে চেয়ারে বসে থাকে। ভীষণ রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয়, একবার মনে হয় সমীরকে খুন করে ওর কবল থেকে ঝিলামকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ওকে আইনের চোখে, ঝিলামের চোখে নিচ, ঘৃণ্য অপরাধী বলে প্রমানিত করবে। মাথা কাজ করে না বুধাদিত্যের।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment