CH Ad (Clicksor)

Sunday, March 29, 2015

মহানগরের আলেয়া_Written By pinuram [চোদ্দ - রক্তের খেলা (০৩ - ০৪)]

আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




মহানগরের আলেয়া
Written By pinuram




চোদ্দ

রক্তের খেলা (#৩)

খোলা দরজা দিয়ে লোকজন, পুলিস নিয়ে বাপ্পা নস্কর ঘরে ঢুকেই কঠিন কণ্ঠে গর্জে ওঠে, "এইসবের মানে কি দানা? ফারহানকে কোথায় সরিয়েছিস তুই?"

দানা চোয়াল চেপে বাঁকা হেসে হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দেয়, "কার কথা বলছেন বাপ্পাদা?"

পেছনে পুলিস, নিতাই ইন্দ্রনীল সঙ্গে আরো অনেকে। বাপ্পা নস্কর এগিয়ে আসে ওর দিকে, "শালা মাদারচোদ, আমার সাথে বেইমানি।"

"বেইমান" কথা শুনে দানার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কোমরে রাখা পিস্তলে হাত চলে যায়। এমন সময়ে মহুয়া, কাজের মেয়ে মণিকে নিয়ে একটা ট্রেতে বেশ কয়েক কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। বাপ্পার রক্ত চক্ষু দেখে ক্ষণিকের জন্য বিচলিত হয় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে আময়িক হেসে বলে, "কি হলো বাপ্পাদা, এত সকালে একেবারে সবাইকে নিয়ে বাড়িতে হাজির।"

মহুয়ার অমায়িক হাসি দেখে বাপ্পা নস্কর কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। চোয়াল চেপে দানার দিকে রক্ত চক্ষু হেনে তাকিয়ে থাকে। দানা একটা চায়ের কাপ ওর হাতে ধরিয়ে হিমশীতল কণ্ঠে বলে, "চা খান, ঠাণ্ডা হন। ফারহানের সম্বন্ধে আপনার জেনে কি লাভ?"

পাশে দাঁড়ানো পুলিস ইন্সপেক্টর, ধীমান এগিয়ে এসে বলে, "ফারহানকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে, এটা পুলিস কেস মিস্টার মন্ডল।"

মহুয়া আর দানা ভালোভাবে বুঝতে পারে ওদের একটু মাথা গরম অথবা অসংযত পদক্ষেপ ওদের কোণঠাসা করে দেবে। বুক ভরে শ্বাস নেয় দানা, উত্তেজিত হলে একদম চলবে না, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। মহুয়া ওর হয়ে উত্তর দেয়, "আপনাদের হাসপাতালে যাওয়া উচিত আমার বাড়িতে নয়, আমার বাড়িতে ডাক্তার বদ্যি নেই।"

পুলিস ইন্সপেক্টর, ধীমান ওদের বলে, "আপনি আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না মিসেস মন্ডল।"

অতি সংযত মহুয়া মৃদু হেসে উত্তর দেয়, "আমার হাতে চায়ের কাপ, আইন আপনাদের হাতে। আর মিস্টার ধীমান, বাজারে গিয়ে একটা আলুর দোকানে আলু পছন্দ না হলে নিশ্চয় আপনি অন্য দোকানে যাবেন, তাই না।"

হতবাক ধীমান, বাপ্পা নস্কর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। মহুয়ার উত্তর শুনে পেছনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন ছেলের সাথে ইন্দ্রনীলও মুখ টিপে হেসে ফেলে। ইন্দ্রনীলের হাসি শুনে বাপ্পা নস্কর আরো ক্ষেপে যায়। মহুয়ার উত্তর শুনে পুলিস কি বলবে ভেবে পায় না। হসপিটালে কেউ মানতে চায় না যে ফারহানকে গত কাল এই হসপিটালে আনা হয়েছিল। খাতা কম্পিউটার ঘেঁটেও পুলিস কিছু উদ্ধার করতে পারেনি।

পুলিস ইন্সপেক্টর দানার দিকে এগিয়ে এসে বলে, "আপনাকে আমি গ্রেফতার করতে পারি জানেন?"

দানা চাপা হেসে বলে, "কি কারনে?"

পুলিস ইনস্পেক্টর উত্তর দেয়, "আইনের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য।"

মহুয়ার সাথে সাথে চোখে চোখে কথা হয় দানার, মহুয়া ইশারায় জানায় চরম চাল চালতে। সামনে পুলিস, সামনে অনেক লোকজন। দানা আলতো মাথা নাড়িয়ে বাপ্পা নস্করের দিকে একপা এগিয়ে যায়। ওই ভাবে এগিয়ে আসতে দেখে বাপ্পা নস্কর থতমত খেয়ে যায়। কি চলছে দানার মাথায়? ইন্দ্রনীল নিতাই সবাই দানার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। মহুয়ার ঠোঁটে বাঁকা হাসি, সোফায় বসে আলতো করে চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বাপ্পা নস্করের দিকে তির্যক দৃষ্টি হানে।

দানা, বাপ্পা নস্করের কাঁধে হাত রেখে কানে ফিসফিস করে বলে, "অভিনেত্রী নয়না বোস আর আপনার গোপন সম্পর্কের একমাত্র সাক্ষী আমি। এই জমি বন্টন, প্রোমোটারি ব্যাবসার অনেক গোপন তথ্য আমার হাতে আছে। আপনি কবে কোন প্রোমোটারকে খুন করেছেন, কবে কোন কাগজে হেরফের করেছেন, কোন আমলাকে কত টাকা খাইয়েছেন, কোন কোন পুলিস কত টাকা খেয়েছে। সব তথ্য প্রমান আমার কাছে আছে। আমি কিন্তু ওই তথ্য প্রমান সঙ্গে নিয়ে আর ফারহানকে নিয়ে সোজা খবরের চ্যানেল, পুলিস আর খবরের কাগজের দফতরে চলে যাবো।"

বাপ্পা নস্কর বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলছে দানা, এত কথা কি করে জানল? দানা ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলে, "কি করতে চান। চুপচাপ এইখান থেকে চলে যেতে চান, না ওই তথ্য প্রমান নিয়ে আমি পুলিস আর মিডিয়ার কাছে যাই সেটা চান।"

দানার কথা শুনে বাপ্পা নস্করের বুক থরথর করে কেঁপে ওঠে। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয় কপালে, চেহারা রক্ত শুন্য হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "মানে তুই....."

দানা আলতো মাথা দোলায়, "হ্যাঁ, অনেকদিন থেকেই জানি।"

বাপ্পা নস্কর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "শালী খানকী চুদিরবাই মাগী নয়না। মেয়েছেলের পেটে কথা থাকে না বাঁড়া। শালী রেন্ডীকে হাতে পেলে খুন করে দেব।"

দানা মাথা নাড়ায়, "না না, নয়না নয়। এরমধ্যে আবার নয়নাকে টানছেন কেন?" একটু থেমে চারপাশে দেখে ওকে বলে, "কি করতে চান? চুপচাপ চলে যাবেন না ওই তথ্য প্রমানের সাথে পুলিসের হাজতে যেতে চান? ওই খবর একবার বের হলে, বিমান চন্দ দুলাল মিত্র কিন্তু আপনাকে ছিঁড়ে খাবে।"

বাপ্পা নস্কর ফাঁদে পরে গেছে দেখে চোয়াল চেপে চাপা গর্জন করে ওঠে, "শালা তুই আস্তিনের সাপ। নিশ্চয় নয়না এই সব কথা তোকে বলেছে। মাগী যেমন আমাকে ঘুরিয়েছে ঠিক তেমনি তোকেও নাচিয়েছে, তাই না। আমি কি করতে পারি সেটা তোর ধারনার বাইরে। তোর এই কন্সট্রাকশান সাম্রাজ্য আমি শেষ করে দেব। শালা আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া আমি বের করে দেব।"

দানা ক্রুর হেসে ফিসফিস করে বলে, "আপনিও অনেকের মাথায় বন্দুক রেখে আম জাম কাঁঠাল লিচু অনেক কিছু খেয়েছেন, তাই না? আর ওই পুলিস ইনস্পেক্টর ধিমান আপনার সাথী।"

মহুয়ার দিকে চোখ টিপে ইশারায় জানায়, কাজ হয়েছে।

মহুয়া মোবাইল তুলে ফোন কোন একজনকে করে, "হ্যালো, হ্যাঁ সময় হয়েছে এইবারে। তুমি তৈরি? ..... ঠিক আছে..... একখানা কপি নিয়ে সোজা "আপনার পাশে" খবরের চ্যানেলে পাঠিয়ে দাও, একখানা কপি সোজা "সকাল সকাল" খবরের কাগজে আর একখানা কপি নিয়ে সোজা ডেপুটি কমিশনার সাত্যকি চ্যাটারজির দফতরে চলে যাও।"

ওই কথা শুনে বাপ্পা নস্কর, ইন্সপেক্টর ধীমান মুখ চাওয়াচায়ি করে। একবার এই টেপ সর্ব সমক্ষে এলে সবাই ফেঁসে যাবে। নিতাই হাত মুঠি করে মহুয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মহুয়া ক্ষণিকের জন্য আতঙ্কে কেঁপে ওঠে কিন্তু কানের ওপর থেকে মোবাইল সরায় না। ধীমান মনে হয় ইচ্ছে করেই পেছনে সরে যায়।

সেই দেখে দানা, বাপ্পার গলা বাজুর মাঝে কঠিন ভাবে চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, "এক পা এগোলে কিন্তু....."

এমন সময়ে সবাইকে অবাক করে মহেন্দ্র বাবু, পুলিসের ডেপুটি কমিশনার সাত্যকি চ্যাটার্জিকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। পেছন পেছন শক্তি বলাই নাড়ু কমল আর বেশ কয়েকজন পুলিস। সাত্যকি চ্যাটার্জিকে দেখে সবাই বিস্ময়ে একে ওপরের দিকে তাকায়। দানার হাতের থাবার মধ্যে বাপ্পা নস্কর থরথর করে কেঁপে ওঠে। পুলিস ইনস্পেক্টর ধীমান কি করবে কিছু ভেবে পায় না। বাপ্পাকে চোখের ইশারায় জানায় সে নিরুপায়। সাত্যকি চ্যাটার্জি আর মহেন্দ্র বাবুকে দেখে মহুয়া আর দানাও কম অবাক হয়নি। কে খবর দিয়েছে মহেন্দ্র বাবুকে? মনা আর পিন্টু নিশ্চয়। বাপ্পা নস্কর আর বাকি ছেলেদের উপেক্ষা করে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে সাত্যকি চ্যাটার্জি একটু মাথা নুইয়ে অভিবাদন সারে। মহেন্দ্র বাবু একটা সোফায় বসে পড়েন।

সাত্যকি চ্যাটার্জি মহুয়াকে বলেন, "বৌমা সেই সকালে বেড়িয়েছি, ভালো করে চা খেতে পারিনি। এক কাপ চা দাও আগে।"

মহুয়া স্মিত হেসে মাথা নুইয়ে কাজের মেয়ে মণিকে চা বানানোর নির্দেশ দেয়।

সাত্যকি চ্যাটার্জি সবার দিকে একবার তাকিয়ে ধীমানকে কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, "কি ব্যাপার ধীমান, এইখানে এত সকালে? কার কি হয়েছে?"

ধীমানের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। আমতা আমতা করে বলে, "না মানে এইখানে ওই কালকের কেসের সম্বন্ধে এসেছিলাম।"

সাত্যকি চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করেন, "এই খানে কেন? দানার বাড়ি কি হসপিটাল?"

ধীমান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়, "না মানে মিস্টার বাপ্পা নস্করের অনুমান যে মিস্টার মন্ডল ফারহানকে হসপিটাল থেকে সরিয়ে দিয়েছে।"

সাত্যকি চ্যাটার্জি হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, "সরিয়ে দিয়েছে মানে? এত সংবেদনশীল একটা কেস আর রাতে তুমি হসপিটালে পাহারা রাখনি? কেন রাখোনি? আর বাপ্পা নস্কর কে? ওর অনুমান অনুযায়ী কি তুমি চলো?"

ধীমানের গলা শুকিয়ে আসে। বাপ্পা নস্করের কাঁধের ওপরে দানার হাতের থাবা আরো শক্ত হয়ে বসে যায়। নিতাইয়ের সঙ্গে আসা ছেলেগুলো চুপিসারে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে শক্তি আর আকরাম। ইন্দ্রনীল এক কোনায় দাঁড়িয়ে মিচকি মিচকি হেসে ঘরের চারদিকে দেখে। কিছু পরে কাজের মেয়ের সাথে মহুয়া একটা ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে আসে। মহেন্দ্র বাবুর হাতে চায়ের কাপ দেওয়ার সময়ে তিনি ওর মাথায় হাত দিয়ে অভয় প্রদান করেন।

মহুয়ার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সাত্যকি চ্যাটার্জি ওকে জিজ্ঞেস করে, "বৌমা তোমাদের কি এরা হুমকি দিয়েছে?"

ওই কথা শুনে নিতাইয়ের গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাপ্পা নস্কর দরদর করে ঘামতে শুরু করে দেয়। মহুয়া স্মিত হেসে দানার দিকে তাকায়। বাপ্পা নস্কর কাতর চাহনি নিয়ে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই উন্মুখ মহুয়া কি বলে।

মহুয়া কে চুপ থাকতে দেখে সাত্যকি চ্যাটার্জি ধীমানকে কড়া কণ্ঠে বলেন, "কি এমন বলেছো যে বৌমা কথা বলতে পারছে না? হ্যাঁ?"

ওর ধ্যাতানি খেয়ে ধীমানের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সাত্যকি চ্যাটার্জি ওকে বলেন, "তোমার সামনে হুমকি দিয়েছে আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেছ? এই সব লোকেদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিয়েছো? আইপিসি ধারা পাঁচশো তিন, বাড়িতে চড়াও হয়ে ধমকি দেওয়া, আইপিসি ধারা চারশো একচল্লিশ, চারশো বিয়াল্লিশ। কি ধীমান লেখো, না হলে এইবারে তোমার বিরুদ্ধে আমাকে পদক্ষেপ নিতে হবে।"

ধীমানের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বাঘের মতন সাত্যকি চ্যাটার্জি এক এক করে সবাইকে বধ করছেন।

বাপ্পা নস্কর, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, "না মানে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে ফারহানকে দানাই ওই হসপিটাল থেকে সরিয়েছে।"

সাত্যকি চ্যাটার্জি যেন হঠাৎ বাপ্পা নস্করকে দেখতে পায় এমন ভাব দেখায়। ওর দিকে ভীষণ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে বলেন, "আপনি বাজারে যান?"

বাপ্পা নস্কর মাথা দোলায়, "হ্যাঁ"

সাত্যকি চ্যাটার্জি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, "গিয়ে দেখলেন একটা দোকানের আলু ভালো নয়। আপনি কি ওই দোকান থেকে আলু কিনবেন না অন্য দোকানে যেখানে ভালো আলু পাওয়া যাবে সেখানে যাবেন?" দানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি সত্যি সরিয়েছ ফারহানকে?"

দানা আলতো মাথা দোলায়, "হ্যাঁ, স্যার।"

সাত্যকি চ্যাটারজি হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, "কেন সরিয়েছ? জানো না এটা বড় সংবেদনশীল মামলা।"

কি বলতে চাইছেন সাত্যকি চ্যাটার্জি? দানা একবার মহুয়ার দিকে তাকায় একবার মহেন্দ্র বাবুর দিকে তাকায়। দুইজনে মাথা নাড়িয়ে বলে কিছুই বুঝতে পারছে না। দানার মনে হয়, সাত্যকি ওর প্রশ্নের মাঝে উত্তর দিয়ে দিয়েছেন তাই সেই উত্তর হাতড়ে উত্তর দেয়, "ফারহান আমার খুব ভালো বন্ধু। ওই হসপিটালে ওর চিকিৎসা ঠিক মতন হবে না তাই ওকে সরাতে বাধ্য হয়ছি।"

সাত্যকি চ্যাটার্জি স্মিত হেসে ধীমানের দিকে তাকিয়ে বলেন, "এবারে বুঝলে কেন সরানো হয়েছে। যাই হোক গতকাল তুমি ফারহানের স্টেটমেন্ট নিয়েছো?"

ধীমান মাথা নাড়ায়, "না স্যার, মানে ডাক্তাররা বলেছিলেন যে বাহাত্তর ঘন্টার আগে ফারহানের জ্ঞান ফিরবে না।"

সাত্যকি চ্যাটার্জি আবার একটা হুঙ্কার দেয়, "তাহলে এইখানে কি মেলা লেগেছে যে এইখানে এসেছো? যাও।"

ধীমান আর বাকি পুলিসেরা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। নিতাই আর বাকি ছেলেরা ওদের বাড়ি থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। ঘরে শুধু মাত্র ইন্দ্রনীল, মহুয়া আর দানার থাবার মধ্যে ছুঁচোর মতন বাঁধা পড়া বাপ্পা নস্কর, মহেন্দ্র বাবু আর সাত্যকি চ্যাটার্জি। বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ার পরে দানা বাপ্পা নস্করের ঘাড়ের ওপর থেকে হাতের বেড় হালকা করে। ছাড়া পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছটফটিয়ে ওঠে বাপ্পা নস্কর।

সাত্যকি চ্যাটারজি বাপ্পা নস্করের চোখে চোখ রেখে বলে, "একবার শুধু আপনার বিরুদ্ধে প্রমান যোগাড় করা বাকি। তাহলেই....."

বাপ্পা নস্কর আমতা আমতা করে বলে, "না মানে আমি....."

দানা, হিমশীতল কণ্ঠে বাপ্পা নস্করের চোখে চোখ রেখে শাসায়, "আমার পরিবারের দিকে চোখ তুলে তাকাতে চেষ্টা করবেন না একদম। চোখ উপড়ে হাতে ধরিয়ে দেব। রেল স্টেশানের পাশে আগে চোরাই চাল বিক্রি করতেন ঠিক সেইখানে বসে ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না কিন্তু বাপ্পা নস্কর।"

বাপ্পা নস্কর রাগে অপমানে গজগজ করতে করতে ইন্দ্রনীলকে সঙ্গে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। এতক্ষণ যেন একটা বিশাল ঝড় বয়ে গেছে ওদের বসার ঘরে। ওরা বেড়িয়ে যেতেই সাত্যকি চ্যাটার্জি আসল ঘটনা জানতে চান। দানা আর মহুয়া ওকে জানায় ওদের অনুমান বাপ্পা নস্কর, ফারহানের গুলি লাগার পেছনে দায়ী। ভুপেনের দেখান ছেলেটার সম্বন্ধে চেপে যায় দানা, কারন সেই ছেলেটা ইতিমধ্যে মাছেদের খাদ্য হয়ে গেছে। দানা জানায়, যদিও ওদের হাতে কোন প্রমাণ নেই তবে আজকের সকালের বাপ্পা নস্করের আহত রূপ দেখে ওদের বদ্ধমূল ধারনা প্রতিত হয়। মহেন্দ্র বাবুকে না জানানোর জন্য তিনি একটু বকাবকি করেন। মনা আর পিন্টু রুহিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। ওরা বাপ্পা নস্কর আর পুলিস দেখে বেশ ভয় পেয়ে মহেন্দ্র বাবুকে ফোন করেছিল। দানা জানিয়ে দেয় হাতে তথ্য প্রমান এলে সাত্যকি চ্যাটার্জির হাতে তুলে দেবে, নিজের হাতে আইন তুলে নেবে না। কথাটা বলেই দানা আর মহুয়া চোখের ইশারায় একটু হেসে নেয়।

মহেন্দ্র বাবু আর সাত্যকি চ্যাটার্জি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই দানা আর মহুয়া হেসে ফেলে কিন্তু সেই সাথে জানে। ওদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। রক্তারক্তির খেলা ওদের জন্য নয়। সুচতুর বুদ্ধির জোরে একে একে সবাইকে মারতে চায় ওরা। তবে মাঝে মাঝে গায়ে যে আঁচড় কামড় লাগবে সেটার জন্য প্রস্তুত, ঠিক একটু আগেই যেমন একটা আঁচড় লেগে গেল, যদিও রক্তক্ষরণ হয়নি। ওরা বুঝতে পারে যে ওদের ওপরে এইবারে বাপ্পা নস্কর নজর রাখবে। খুব বেশিদিন এই খেলা আর খেলা উচিত নয়, এইবারে ওদের জাল গুটাতে হবে।

সারাদিন ঝড়ের বেগে কেটে যায়। দানা আর মহুয়া বেশ লুকিয়ে চুরিয়ে নার্সিং হোমে পৌঁছায়, জানে ওর পেছনে চর লেগে। তাই প্রথমে হিঙ্গলগঞ্জ, মহেন্দ্র বাবুর কাছে যায়। সেখানে ওরা ওইখানে বেশ ভুষা বদলে নকল চুল দাড়ি লাগিয়ে আর মহুয়া একটা বুরখা পরে অন্য গাড়ি করে নার্সিং হোমে যায়।

ডক্টর অভিজিৎ ভুঁইয়া আর ডক্টর মানস সোম, ফারহানের জ্ঞান ফেরানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফারহান তখন পর্যন্ত অজ্ঞান। ডাক্তারেরা বেশ চিন্তিত, হৃদপিণ্ড চলছে কিন্তু খুব ধীরে। জারিনা ওর হাত ছাড়বে না কিছুতেই। গতকাল থেকে সেই যে হাতখানি ধরে ছিল আর সেটা ছাড়ানো যাচ্ছে না। ভয়, যদি হাত ছেড়ে দিলে ফারহান চিরদিনের মতন পালিয়ে যায়। ওর অবস্থা দেখে বাকিদের আশঙ্কা আরো বেড়ে যায়। মহুয়া আর ফারহানের মায়ের প্রচেষ্টা বিফল। ফারহানের সাথেই খাবার খাবে, জেদ ধরেছে মেয়েটা। মেয়েটার না কিছু হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। এক রাতের মধ্যে জারিনা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। উন্মাদনার শেষ সীমানায় দানা, জারিনার ওই ফোলা ফোলা লাল চোখ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না কিছুতেই।

দুপুরে একবার নয়নার ফোন এসেছিল, ফারহানের শারীরিক উন্নতির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। দানা জানিয়ে দেয় এখন ওর চোখ খোলেনি খুব পীড়নের মধ্যে দিয়ে সময় কাটছে ওদের। নয়নার বাড়ি থেকে পাহারা উঠিয়ে পালা করে এক এক জনে নারসিং হোম পাহারা দিয়ে চলেছে। অচেনা কাউকে দেখলেই আকরাম, নাসির, বলাই শক্তিরা হামলে পড়ে। আই.সি.ইউ তে অচেনা কাউকে ঢুকতেই দিচ্ছে না ওরা। নার্সিং হোম আর নার্সিং হোম নেই, এক দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিনত হয়ে গেছে। দুপুরের পরে ফারহানের মা আর নাফিসা বাড়িতে ফিরে যান। মহেন্দ্র বাবু, ফারহানের পরিবারকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়।

আগের দিনের মতন সেই বক্তৃতার ছড়াছড়ি আর টিভিতে নেই। সারাদিন বাপ্পা নস্কর এক প্রকার গৃহ বন্দী হয়ে থাকে। কোন সাংবাদিক ওর সাথে সারাদিনে কথা বলতে পারে না। মহুয়া আর দানা ভালো ভাবে বুঝে যায় যে ওদের বিরুদ্ধে বাপ্পা নস্কর ষড়যন্ত্র রচে চলেছে।

রাত দুটো বাজে। রুহি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে কাদা। দানা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু মহুয়া তখন জেগে। ঘুমন্ত দানার হাতখানি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে চিন্তা মগ্ন, কিন্তু মাথা একদম খালি।

ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে দানা আর মহুয়া। চোখে মুখে ছাপিয়ে ওঠে উৎসুক উত্তেজনা, এত রাতে কে এলো? কান পেতে শোনে আওয়াজ। এইবারে কলিং বেল নয়, খুব ধীরে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। মহুয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, "কে এলো?" দানা উঠে দাঁড়িয়ে পায়জামা গলিয়ে ওকে অভয় প্রদান করে। বিছানার পাশের ক্যাবিনেট থেকে পিস্তল বের করে হাতে তুলে নেয়। মহুয়া সঙ্গে সঙ্গে একটা মোটা গাউন চড়িয়ে নেয়। চরম উৎকণ্ঠায় ওর বাজু খামচে ধরে। বুকের মধ্যে উত্তেজনার হাতুরি পিটতে শুরু করে মহুয়ার। রুদ্ধশ্বাসে দানা বসার ঘরের দিকে খোলা পিস্তল হাতে এগিয়ে যায়। সদর দরজার ওপরে একটা ছোট সার্ভিলেন্স ক্যামেরা লাগানো আছে। দরজার পাশেই তার ছোট স্ক্রিন। স্ক্রিনে আগন্তকের ছবি দেখে দানা হতভম্ব হয়ে যায়। সহস্র প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করে ওঠে। এত রাতে, একা, হঠাৎ, কেন?







রক্তের খেলা (#০৪)

মহুয়া ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে, "কে এসেছে?" হতবাক দানা ফিসফিস করে উত্তর দেয়, "ইন্দ্রনীল।" "একা?" "হ্যাঁ।" "কি চায়?" "আমি কি জানি। তুমি ভেতরে গিয়ে একটা কিছু পর আমি দেখছি।"

দরজা না খুলেই দানা জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার এতরাতে কেন?"

দরজার কাছে মাথা এনে ফিসফিস করে উত্তর দেয় ইন্দ্রনীল, "দরজা খোল, কথা আছে।"

দানা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, "ফোনে বল।"

ইন্দ্রনীল বলে, "ফোনে বলা যাবে না, দানা। দরজা খোল।"

মহুয়া ততক্ষণে একটা সালোয়ার কামিজ পরে নিয়ে তারপরে গাউন জড়িয়ে বসার ঘরে ঢুকে পড়ে। পিস্তল শক্ত করে ধরে দরজা খোলে দানা। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় এক ধাক্কা মেরে চোরের মতন ঘরে ঢুকে পড়ে ইন্দ্রনীল। দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মহুয়া আর দানার দিকে তাকায়। দানার হাতে পিস্তল দেখে একটু ভয় পেয়ে যায়।

মহুয়ার দিকে মাথা নুইয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে, "স্যরি ম্যাডাম এত রাতে এসেছি, তা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।"

দানা কঠিন কণ্ঠে বলে, "এদিক ওদিক না ঘুরে সোজা কথা বল, এতরাতে কেন এসেছিস?"

বাপ্পা নস্করের কোন লোকের ওপরে দানার একফোঁটা বিশ্বাস নেই।

ইন্দ্রনীল ওকে বলে, "প্লিস দানা আমাকে ভুল বুঝিস না।" দানা আর মহুয়া মুখ চাওয়াচায়ি করে, কি বলতে চাইছে ইন্দ্রনীল? ইন্দ্রনীল বলে, "ফারহানের খুনের পেছনে বাপ্পা নস্করের হাত আছে। এটা খুব বড় একটা চাল, আসন্ন নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য এই জঘন্য খেলা খেলেছে বাপ্পা নস্কর। ফারহানের গুলি লাগার পর থেকেই আমি আর আমার পরিবার খুব ভয়ে ভয়ে আছি।"

দানা হিমশীতল কণ্ঠে বলে, "আমার সাথে ছলনার খেলা খেলতে চেষ্টা করিস না ইন্দ্রনীল। আমি জানি বাপ্পা নস্কর ফারহানকে খুন করার চেষ্টা করেছে। তুই এতরাতে কেন এসেছিস? আমাদের ওপরে চর গিরি করতে তোকে পাঠিয়েছে?"

পিস্তল খানা তখন পর্যন্ত ওর হাতে।

ইন্দ্রনীল ওকে বলে, "না না না, আমি ওর চরগিরি করতে তোর এখানে আসিনি। শুধু তোকে সাবধান করতে এসেছি। বাপ্পা নস্কর কিন্তু তোদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তোর বাড়ির ওপরে নজর রেখেছে। ম্যাডাম আর মেয়েকে কোথাও সরিয়ে দে।"

দানা ঠাণ্ডা মাথায় ওকে বলে, "তোকে বিশ্বাস করার কোন কারন আমি খুঁজে পাচ্ছি না ইন্দ্রনীল। তোর বাপ্পা নস্করকে জানিয়ে দিস, আমার পরিবারের দিকে তাকালে ওর গলা নামিয়ে দেব আমি।"

ইন্দ্রনীল মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, "ম্যাডাম আপনি বলুন, আমি যদি বাপ্পা নস্করের দলের হব তাহলে কেন রাত দুটোতে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আপনার বাড়িতে আসব? আমি সত্যি বলছি ম্যাডাম, ফারহানের ঘটনার পরে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি। নিজেকে বাঁচাতে আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। এতদিনের পুরানো ড্রাইভারকে যদি বাপ্পা নস্কর নিজের স্বার্থে এমন ভাবে মারতে পারে তাহলে নিজের স্বার্থে আমাকেও একদিন মেরে ফেলতে কুণ্ঠা বোধ করবে না।"

দানা ক্রুর হেসে বলে, "তোর সাহায্য আমি চাই না, তোকে কোথায় পাঠাবে সেই নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। আমার অনেক লোক আছে এমনকি পুলিসের ডেপুটি কমিশনার সাত্যকি চ্যাটার্জি আমার চেনা। সুতরাং আমার টিকি ছোঁয়ার আগে তোর বাপ্পা নস্কর দশ বার ভাববে।"

ইন্দ্রনীল ম্লান হেসে বলে, "আজকেই দেখেছি তোর আসল ক্ষমতা। তুই ওকে যমের বাড়ি পাঠা আর যেখানে খুশি ইচ্ছে পাঠা আমার তাতে কোন ক্ষতি নেই। আমি শুধু তোকে সাবধান করতে এলাম ব্যাস।" মহুয়ার দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, "ম্যাডাম, প্লিস আমার কথা একটু বিশ্বাস করুন।"

মহুয়া ওকে একটা সোফায় বসতে বলে দানাকে অনুরোধ করে ওর কথা শোনার জন্য। ইন্দ্রনীলের চোখে মুখে চাপা উত্তেজনার ছাপ, সেটা মেকি না সত্যি বলা মুশকিল। মহুয়া ওর উলটো দিকের সোফায় বসে ফারহানকে খুনের পেছনের আসল উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করে। ইন্দ্রনীলের কথা শুনে দানার শরীর জ্বলে ওঠে।

ইন্দ্রনীল বলে, "নিতাই, বাইরে থেকে একটা ভাড়া করা গুন্ডা এনে ফারহানকে খুন করিয়েছে। আসল উদ্দেশ্য বিরোধী পক্ষকে আক্রমন করা। তোরা গত কালের বক্তৃতা শুনিস নি? কেমন ভাবে নেচে কুঁদে চিৎকার চেঁচামেচি করছিল।"

দানা মহুয়া গতকাল ফারহানের জন্য চিন্তিত ছিল ওরা টিভিতে বাপ্পা নস্করের জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেখার সময় পায়নি। ইন্দ্রনীল মোবাইলে তোলা গতকালের বক্তৃতার ভিডিও দেখায়। ফারহানের গুলি লাগার কিছুক্ষণ পরেই বাপ্পা নস্কর মঞ্চে উঠে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। "বিরোধী পক্ষ চায় না এই রাজ্যে ধার্মিক শান্তি বজায় থাকুক, বিরোধী পক্ষ চায় অরাজকতা, ধর্মের নামে মার দাঙ্গা। আমরা শাসক দল সেটা কিছুতেই হতে দেব না। আজকে আমার চার বছর পুরানো অতি বিশ্বস্ত ড্রাইভার ভাই, ফারহানকে গুলি করা হয়েছে। কালকে ফারহানের ভাই বন্ধুদের গুলি করে মারা হবে। এটা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। বিমান চন্দ, দুলাল মিত্র জঘন্য রক্তের খেলায় মেতে উঠেছে। জনগণ আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। আমাদের দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, সব ধর্মের মানুষকে আমরা সমান চোখে দেখি। তবে আমার ভাই সমান ফারহানকে কেন গুলি করতে গেল? আমাকে গুলি মারতে পারত ওরা। আমি এই দেশের স্বার্থে এই জনগনের স্বার্থে বুকে গুলি খেতাম। না, ওদের লক্ষ্য আমার ভাই সমান ফারহান ছিল। বন্ধুগণ, মায়েরা, বোনেরা, ভাইয়েরা, এই খুনের প্রতিকার আমাদের চাই। আসল খুনি ধরা পড়ুক এটাই আমরা চাই। ......" ইত্যাদি ইত্যাদি.....

দানার কান গরম হয়ে যায়, সেই সাথে মহুয়া চোখ বুজে নেয়। ক্ষোভে বিতৃষ্ণায় ঘৃণায় ওর চোখে জল চলে আসে। সত্যি এত নীচ এই রাজনীতি, থুড়ি দুর্নীতি। দানার হাত মুঠি হয়ে, ফারহানকে গুলি মারার আসল কারন ওর সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রচন্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে দানা, চোয়াল চেপে নিজের কপালে করাঘাত করে।

ওদের দিকে স্মিত হেসে ইন্দ্রনীল বলে, "সাত্যকি চ্যাটার্জিকে তোর বাড়িতে দেখে বাপ্পা নস্কর একদিনে গর্তে ঢুকে গেছে মাইরি। শালার হাত পা থরথর করে কাঁপছে, শালা কারুর সাথে কথা বলা দুরের কথা, দেখা পর্যন্ত করছে না।"

মহুয়া আর দানা তখন পর্যন্ত ওকে বিশ্বাস করে না। হতে পারে এটা বাপ্পা নস্করের একটা চাল তাই বাঁকা হাসি হেসে বলে, "দ্যাখ ইন্দ্রনীল, তুই এতরাতে একা এসেছিস বলেই যে তোকে বিশ্বাস করে নেবো এমন গরু আমরা নই।"

ইন্দ্রনীল ম্লান হেসে বলে, "সেটা তোদের ওপরে দানা। তবে ফারহানের এই ঘটনার পরে সত্যি আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছি। বিশেষ করে আমার মা আমার স্ত্রী খুব ভয় পেয়ে গেছে।"

দানা বাঁকা হেসে উত্তর দেয়, "আচ্ছা, এতদিন যখন এত লোককে খুন করছিল তখন এইসব মাথায় আসেনি তোর? এখন যেহেতু ফারহান আহত হয়েছে তখন টনক নড়েছে? তুই এতদিন ওর সাথে থেকে কাজ করেছিস। ওর নাড়ি নক্ষত্রের সম্বন্ধে সব কিছু জানিস। তাহলে সেটাই কাজে লাগা ওর বিরুদ্ধে ব্যাস।"

ইন্দ্রনীল উত্তর দেয়, "করতে চাইলেই করা যায় না। নিতাই আসলে ওর খুড়তুতো ভাই, তাই ছায়ার মতন ওর পাশে ঘোরাফেরা করে।"

বলে এক এক করে সব কিছু বলতে শুরু করে ইন্দ্রনীল। ঠিক যা যা, সঙ্গীতা তদন্ত করে উজাগর করেছে সব কিছু ইন্দ্রনীলের মুখে শোনে। দানা হেসে উত্তর দেয় এই সবকিছু আগে থেকেই জানে। সেই শুনে ইন্দ্রনীল আরো বিস্মিত হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে তাহলে এতদিন ওকে কেন কোণঠাসা করেনি? উত্তরে দানা জানায় সময়ে অপেক্ষায় ছিল আর বাপ্পা নস্কর যেহেতু ওকে সরাসরি কোন আঘাত হানেনি তাই ওকে এতদিন ওর বিরুদ্ধাচরণ করেনি। তবে এইবারে ঘা একদম হৃদয়ে লেগেছে তাই দানা এর প্রতিশোধ নেবে। দানাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় ইন্দ্রনীল, কিন্তু অত সহজে ভোলার মানুষ মহুয়া আর দানা নয় তাই জানিয়ে দেয় সময় হলে ওর সাহায্য নেবে।

ইন্দ্রনীল চলে যাওয়ার পরে মহুয়া আর দানা অনেকক্ষণ বসার ঘরে বসে থাকে, ভাবে এইবারে জাল উঠিয়ে নেওয়া উচিত। এতদিন যাদের ওপরে নজর রেখছিল তারা কখন কোন দিক থেকে আঘাত হানবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে বাপ্পা নস্কর বাড়ি এসে হুমকি দিয়ে গেছে সুতরাং খুব শীঘ্র একে সরাতে হবে। নয়না আর বিমান ওদের সম্পর্কে সব কিছু জেনে গেছে, সুতরাং আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু করে ওঠে। এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে অনেকে একসাথে শেষ হয়ে যায়।

মহুয়ার বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলে, "বিমান আর বাপ্পাকে সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে দাও, তাহলে দুইজনা দুইজনকে মেরে ফেলবে। ওইদিকে নয়নাকে একা মারলে চলবে না। সুমিতা আর সমুদ্র ওর খুব কাছের লোক। ওদেরকে কিছু করে সরাতে হবে না হলে ভবিষ্যতে আমাদের ওপরে হামলা করতে পারে। বিমান মরে গেলেই সিমোন আর মোহন ক্ষেপে উঠবে তখন কিছু একটা করে ওদের সরাতে হবে। সেটা পরে ভাবা যাবে তবে আগে বাপ্পাকে সরানো খুব দরকার।"

দানা বাঁকা হেসে বলে, "তুমি এমন ভাবে বলছ যেন আমি ওদের বলব আর ওরা একে ওপরের সামনে চলে আসবে। ছেলের হাতে মোয়া আর কি তাই না?" তারপরে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলে, "তুমি শুতে যাও আর আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও।"

মহুয়া হেসে ওকে জড়িয়ে বলে, "রাত পোহালে বুদ্ধি বাড়ে। সিগারেট শেষ করে আমার সাথে শুতে চলো।"

সিগারেট টানতে টানতে দানার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, মহুয়াকে বিস্তারে নিজের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলে। সব থেকে আগে নয়না আর বিমান চন্দের গোপন সম্পর্কের বিষয়টা বাপ্পার কানে তুলতে হবে আর সেটা নিতাইকে দিয়ে করাতে হবে। নিতাই নিশ্চয় মাঝে মাঝে মদ খায়, অথবা পান বিড়ি খায়। সেইখানে দানার ছেলেরা জটলা পাকিয়ে গল্পে গল্পে নয়না আর বিমানের গোপন সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করবে। সেই কথা নিতাইয়ের কানে গেলেই বাপ্পার কাছেও পৌঁছে যাবে। বাপ্পা নস্কর নিশ্চয় নিতাইকে বলবে নয়নার ওপরে নজর রাখতে। সেই সময়ে দানা একটু সাবধান করে দেবে নয়নাকে। কিছুদিন পরে দানা, নিজেই নয়নাকে বিমানের সাথে দেখা করার জন্য উস্কিয়ে দেবে, বলবে বাপ্পা নস্করকে হুমকি দিয়েছে তাই এত শান্ত হয়ে গেছে। বিমান চন্দ, নয়না দুইজনে বেশ খুশি এই ফাঁকে ওদের ওই বাগান বাড়িতে দেখা করার কথা উঠাবে দানা, আর যাতে সঙ্গে সমুদ্র আর সুমিতা থাকে সেই কথাও বলবে। ও বলবে সবাই মিলে একরাত চুটিয়ে মজা করতে চায়। নয়না এই ফাঁদে নিশ্চয় পা দেবে সেই সাথে বিমান চন্দ পা দেবে। ওইদিকে নিতাই যেহেতু নয়নার ওপরে নজর রেখে চলেছে সুতরাং যেই নয়না ওই দুর বাগান বাড়িতে পৌঁছাবে সঙ্গে সঙ্গে ওই খবর বাপ্পা নস্করের কানে পৌঁছে যাবে। একাকী নির্জন নিরালা বাগান বাড়িতে বিমান চন্দ আর নয়নাকে একসাথে খুন করার লোভ বাপ্পা নস্কর ছাড়তে পারবে না। নিতাই আর বেশ কয়েকজন বিশ্বস্ত ছেলে নিয়ে বাগান বাড়িতে গিয়ে খুনোখুনি করবে। সবাই শেষ, বাকি যারা বেঁচে থাকবে তাদের দানার ছেলেরা শেষ করে দিয়ে বেড়িয়ে চলে আসবে। সবাই ভাববে গোষ্ঠী দ্বন্দে দুই রাজনেতা, অভিনেত্রী প্রান হারিয়েছে আর বাকিরা প্রান হারিয়েছে।

মহুয়া সব শুনে মুচকি হেসে বলে, "বউয়ের কথা মাঝে মাঝে শুনতে হয় বুঝলে। এইবারে কাল সকালে যা করার কোরোখানে।"

বলে এক প্রকার কোলের ওপরে ঢলে পরে। সকাল পাঁচটা বাজতে যায় তখন।

ঘুম থেকেই উঠতে দেরি হয়ে যায় দানার। ফারহানের অবস্থার এখন কোন পরিবর্তন নেই, অফিসে যাওয়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। ভুপেন খবর দিয়েছে, নিতাইয়ের একজন ছেলে নাকি ওর বাড়ির ওপরে নজর রেখে চলেছে। ভুপেন আরো জানায় বাপ্পা নস্কর গতদিন আর বাড়ি থেকেই বের হয়নি। ইন্দ্রনীল নিতাই আর কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মী ছাড়া আর কারুর সাথে দেখা পর্যন্ত করেনি। দানা চিন্তায় পরে যায়, ইন্দ্রনীলকে বিশ্বাস করা উচিত না অনুচিত। জল্পনা করে কি ভাবে নিতাইয়ের কানে নয়না আর বিমানের গোপন সম্পর্কের বিষয় তোলা যায়, সেই সাথে নয়না আর বিমানকে কিভাবে বাকিদের সাথে ওই দূর গ্রামের বাগান বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলা যায়।

দানা বিকেলের দিকে ডাক্তারদের ফোন করে আর বাকিদের ফোন করে ফারহানের শরীর স্বাস্থের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে। অন্তত ফারহান চোখ না খোলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই, জারিনা সকালের দিকে একটুখানি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল ওই পায়ের কাছে মাথা দিয়ে। যাক মেয়েটা দুইদিন পরে একটু ঘুমিয়েছে তাহলে। চারপাশে সব কিছু এঁটে বসে গেছে।

এমন সময়ে নয়নার ফোন, "কি ব্যাপার তোমার? গতকাল থেকে বাপ্পা নস্কর একদম ঘুম মেরে গেছে?" হেসে জিজ্ঞেস করে, "একদম আছোলা বাঁশ ঢুকিয়েছ দিয়েছ নাকি ওর পোঁদে?"

দানা বাঁকা হেসে বলে, "হ্যাঁ সেই রকম। তা বিমান আর মোহন কেমন আছে?"

নয়না উত্তর দেয়, "গতকাল থেকে অনেক ভালো মতিগতি। এইবারে বাপ্পার বিরুদ্ধে নামার পরিকল্পনা কর আর কি। সামনের সপ্তাহে বাপ্পা নস্করের আরো একটা পথসভা আছে। লোহা গরম, এই সুযোগে হাতুড়ি পিটিয়ে দাও দানা।"

দানা মুচকি হাসে, "হ্যাঁ সেটাই করতে চলেছি।" মনে মনে হাসে, এইবারে সবাইকে একসাথে এক জায়গায় এনে ফেলতে চায়। একে ওপরে হাত দিয়ে মারতে চায়। দানা ওকে বলে, "আরে শোন না, বিমানকে বল একটু মস্তি করা যাক। বিমান, তুমি আমি সুমিতা সমুদ্র সবাই মিলে ওই গ্রামের বাগান বাড়িতে।"

নয়না মুচকি হেসে বলে, "আবার কি করতে চাও, বলো তো?"

দানা মাথা চুলকিয়ে হেসে বলে, "আরে না না..... বিমান থাকবে সমুদ্র থাকবে। এই দেখো মেয়ের কান্ড, তুমি সেদিন নিজে থেকে বলেছিলে বলেই একটু রগরগে সঙ্গম ধর্ষকাম হয়ে গেছিল, নাহলে আগে কি কোনোদিন তোমার সাথে করেছি ওই সব।"

নয়না মুচকি হেসে বলে, "শয়তান ছেলে, পাশে মিসেস নেই মনে হচ্ছে।"

মহুয়া পাশেই বসে ছিল আর ওদের কথোপকথন বেশ মন দিয়ে শুনছিল। কি চক্রান্ত দানা ফাঁদছে সেটা জানা দরকার, না হলে চোখের ইশারায় কখন কি করতে হবে সেটা বুঝবে কি করে। দানা মহুয়াকে কোলের কাছে জড়িয়ে বলে, "না না, মিসেস আর রুহি একটু বেড়িয়েছে তাই তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারছি।"

নয়ন ওকে বলে, "ভালো একটা পরিকল্পনা ফেঁদেছো। হ্যাঁ একটা আলোচনার দরকার আছে। মানে কি করে এরপরের পথসভায় তুমি কাজ করবে সেটা একটু বিষদে জানতে ইচ্ছে করছে। এইবারে একসাথে হলে, সুমিতাকে বিমানের কোলে ফেলে দেব, নে শালা করবি কর। সুমিতাও নতুন একটা বাড়া পাবে আর আমি আর তুমি ব্যাস।"

মহুয়া কটমট করে দানার দিকে তাকায়, ওই চাহনি দেখে ক্ষণিকের জন্য দানা কেঁপে ওঠে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে নয়নাকে বলে, "হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম সারা রাত ধরে। তবে কি জানো, আমার মনে হয় পরের সপ্তাহে এই মস্তির পার্টি রাখলে ভালো হয়। এখন লোহা গরম আছে সুতরাং বাপ্পাও গরম আছে। এখন তুমি একটু চুপচাপ থাক।"

দানার আসল উদ্দেশ্য আগে নিতাইয়ের কানে খবর পৌঁছান। সেটা হয়ে যাওয়ার পরে নয়নাকে খেলানো। নয়না উত্তরে জানিয়ে দেয় পরের সপ্তাহে বিমানের সাথে ওই বাগান বাড়িতে দেখা করার চেষ্টা করবে। দানার হাতে বেশি দিন সময় নেই, যত তাড়াতাড়ি ওর চাল ধরার আগেই সবাইকে জালে গুটাতে হবে।

মহুয়া কিছুক্ষণ দানার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে। তারপরে একটু ভেবে ওকে বলে, "এখুনি নয়নাকে শেষ করো না। ওর সাহায্যে, সিমোনে আর মোহনকে আমরা কুপোকাত করতে পারবো। নয়নাকে আরও কয়েকদিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"

দানা জিজ্ঞেস করে, "অর্থাৎ?"

মহুয়া মুচকি হেসে বলে, "সময় হলে জানিয়ে দেব। এখন ঘুমাও।"







কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 





পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

পিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

মূল ইনডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment