আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
মহানগরের আলেয়া
Written By pinuram
Written By pinuram
ষোল
সাপের কোঠর (#০৪)
রুহিকে বাড়িতে রেখে দিয়েই মহুয়া আর দানা, নয়নার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নয়নার বাড়ির সামনে গিয়ে আকরামের সাথে দেখা হয়। আকরাম জানায়, বাড়িতে তখন পুলিস আসেনি, তবে ওর সেক্রেটারি আর ম্যানেজার এসে পৌঁছে গেছে। সবাই হয়তো দানা আর মহুয়ার অপেক্ষা করছে।
মহুয়াকে দেখে নয়না একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার অদৃষ্ট, আমার পাপের বোঝা আমার ভাইকে কেন পোহাতে হবে মহুয়া। আমার ভাই কারুর ক্ষতি করেনি মহুয়া, প্লিজ কিছু একটা করো।"
দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওই কথা শুনে, টাকার জোরে কত কাজের মেয়ের সর্বনাশ এই মন্দ বুদ্ধি ছেলেটা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন দানা না থাকলে হয়ত সঙ্গীতাকে আঁচড়ে কামড়ে আধমরা করে দিত। মহুয়ার দুই চোখে আগুন ঠিকরে পড়ছে, যেন বলতে চায়, কোন একসময়ে সুযোগ পেলে আমার মেয়েকে অপহরনের চক্রান্ত করেছিলে তাই না?
ঘর ভর্তি লোকজন, সেক্রেটারি আর ম্যানেজারের সাথে আরো বেশ কয়েক জন লোক এসে গেছে। সবার এক কথা, পুলিসে খবর দাও, আগে ওই স্মিতা নামের মডেল কে ধরা হোক তাহলেই কে অপহরন করেছে সেটা জানা যাবে। ময়নার সাথে যে দানার যোগাযোগ আছে সেটা নয়না জানে না। কিন্তু ময়নাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, ইতিমধ্যে শহর ছাড়িয়ে, এই প্রদেশ ছাড়িয়ে ট্রেনে করে ওরা অন্য শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য চলে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন ফোন আসেনি। নিতা এক কোনায় চুপচাপ বসে। কি চলছে ওর মনে? হয়তো ভাবছে, আপদ বিদায় হয়েছে ভালোই হয়েছে।
মহুয়া আড় চোখে একবার দানার দিকে তাকিয়ে নয়নাকে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে বলে, "কি করে হলো এই সব একটু খুলে বলো তো?"
নয়না চোখের জল মুছে সব ঘটনা খুলে বলে, যার অধিকাংশ মহুয়ার জানা। নয়না শুটিংয়ে ব্যাস্ত ছিল, এই কয়দিনে বুবাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার একদম সময় পায়নি। স্মিতা নামের মডেলটা বুবাইয়ের মনে ধরে যাওয়াতে ওকে বাড়িতে আসতে বলতো আর বুবাইয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য বেশ ভালো টাকাই দিত ওকে। সেদিন দুপুরে, বুবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে স্মিতা। প্রথমে গররাজি হয় নয়না, অচেনা একজনের সাথে বুবাইকে ছাড়তে নারাজ, কিন্তু বুবাই নাছোড়বান্দা, শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দেয়। বিকেলে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে স্মিতা আর বুবাই কোথাও বেড়াতে বের হয়। ট্যাক্সি শহর ছাড়িয়ে বড় রাস্তা ধরলে নিতার সন্দেহ হয়। স্মিতা ওকে বলে শহরের বাইরে একটা বড় পার্ক আছে সেখানে নিয়ে যাবে বুবাইকে। নিতা চুপ করে থাকে, কিন্তু যখন স্মিতাকে কারুর সাথে ফোনে কথা বলতে শোনে তখন নিতার সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে যায় যে স্মিতার অভিসন্ধি অন্য কিছু। সেটা সত্য প্রমানিত করে কিছুপরেই ওদের ট্যাক্সির সামনে একটা কালো রঙের ভ্যান গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই গাড়ি থেকে জনা চারেক মুখোশ পরা ছেলে নেমে ট্যাক্সি চালকের মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তারপরে নিতাকে আর স্মিতাকে বেঁধে ফেলে, ওদের চোখ বেঁধে নাকের ওপরে রুমাল চপে অজ্ঞান করে দেয়। তারেপরে ওরা বুবাইকে নিয়ে কোথাও চলে যায়। ট্যাক্সি চালক আর নিতার জ্ঞান ফিরলে দেখে যে, সেই স্থানে স্মিতা নেই। ওদের কাছের ফোন, টাকা পয়সা যা ছিল সব ওই দুস্কৃতিরা নিয়ে চলে গেছে। ট্যাক্সি চালকের সাহায্যে বাড়ি পৌঁছেই নয়নাকে ফোন করে সব জানিয়ে দেয় নিতা। শুটিং ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে মহুয়াকে ফোন করে নয়না।
ওরা সবাই ফোনের অপেক্ষায় বসে। এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা করে মাঝ রাত হয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার ওষ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। চোখের জল আর ফুরানোর নাম নেই। মহুয়া যত ওকে শান্ত হতে বলে ততই নয়না কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। দানা চুপচাপ গম্ভীর ভাবে সোফায় বসে ফোনের অপেক্ষা করে।
মাঝ রাতে নয়নার ফোন বেজে ওঠে। কাঁপা হাতে সবার দিকে তাকিয়ে নয়না ফোন উঠায়। অন্যপাশে এক অচেনা পুরুষের কণ্ঠস্বর ওকে বলে, "তোর ভাই ভালো আছে। যদি ওকে জ্যান্ত দেখতে চাস তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোর হিতৈষী বন্ধু বিশ্বজিৎ মন্ডলের কাছে মিস্টার মোহন খৈতানের প্রকল্পের যা কাগজপত্র আছে, সেই সব নিয়ে তমালগুড়ির রাস্তা ধর। ওই কাগজপত্র হাতে পেলে আমরা তোর ভাইকে ছেড়ে দেব। বাকি নির্দেশ মহানগর ছাড়ানোর পরে পাবি।"
আগন্তুকের নির্দেশ শুনে দানা আর মহুয়া যেমন স্থম্ভিত হয়ে যায় তেমনি নয়না অবাক হয়ে যায়। নয়না একবার মহুয়ার দিকে তাকায় একবার দানার দিকে। দানা ফাঁদে পড়ে গেছে, এটা যে সিমোন আর মোহনের কুটিল চাল সেটা বুঝতে একটুকু দেরি লাগলো না। এখন যদি দানা না বলে তাহলে নয়না প্রশ্ন উঠাবে, হয়ত মোহন সোজাসুজি বলে দেবে এই চক্রান্তের পেছনে দানার বুদ্ধি কাজ করছে। সমুদ্রের মৃত্যুতে নয়না একে ক্ষুদ্ধ আহত বাঘিনীর মতন ফুঁসছে, যদি জানতে পারে যে ওর ভাইয়ের এই অপহরনের পেছনে দানার হাত আছে, তাহলে দানা ঘোর বিপদে পরে যাবে। আর যদি দানা নয়নার সাথে কাগজ পত্র নিয়ে যায়, তাহলে ওর বেঁচে ফিরে আসার আশঙ্কা এক প্রকার নেই। ওইখানে নিশ্চয় সিমোনের সামনে পড়লে নয়নাকে সবকিছু খুলে বলে দেবে আর তখন দুইজনে একত্রে মিলে ওকে জ্যান্ত ছাড়বে না। মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে, সেই সাথে দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ওর মাথার ওপরে কেউ যেন গরম তরল গলানো লোহা ঢেলে দিয়েছে। আগন্তুক যে মোহন খৈতান নিজে সেটা প্রমান হয়ে যায়। পুলিসের কাছে যাওয়া যাবে না, নয়নার সামনে মুখ খোলা যাবে না। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে যায় মহুয়া আর দানা। পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে চোখে চোখে ইঙ্গিতে কথা সারে।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, "কি করবে?"
দানা ইঙ্গিতে জানায়, "দাঁড়াও দেখি।"
ফোন ছেড়ে মাথা নিচু করে নয়না কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, তারপরে মাথা নাড়িয়ে ওদের বলে, "মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র মানে ভাইয়ের কিডন্যাপের পেছনে ওদের হাত।" কাতর কণ্ঠে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "কি করবো দানা?"
দানা নিজেও জানে না কি করবে। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে গেছে। যেদিকে পা রাখবে সেদিকে সাক্ষাৎ মৃত্যু। যদি এখুনি নয়নাকে আসল কথা খুলে বলে তাহলেও ওর নিস্তার নেই আর যদি ওর সাথে যায় তাহলেও নিস্তার নেই। দানার চিন্তামগ্ন রূপ দেখে মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে। এইবারে দানাকে একদম জালে আটকে ফেলেছে সিমোনে, এই জাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কোন লক্ষন দেখতে পাচ্ছে না কেউই। দানা খানিকক্ষণ ভেবে চিন্তে ঠিক করে, কাগজ পত্র, বন্দুক পিস্তল লোকজন সাথে নিয়েই যাবে। তবে নয়নার চোখের আড়াল করে। আসলে দানা চায় সবাই শেষ হয়ে যাক, কিন্তু নয়না দেখে ফেললে লোকজন নিয়ে যেতে বাধা দেবে।
দানার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নয়না আরও বেশি বিচলিত হয়ে ওঠে। মহুয়ার হাত ধরে কাতর প্রার্থনা করে, "কি করবো বলে দাও।"
মহুয়ার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে উত্তর দেয়, "আমি জানি না নয়না।"
নয়না ওর হাত ধরে বলে, "এক বার শুধু একবার আমার ভাই ফিরে আসুক তারপরে ওদের আমি শেষ করে দেব।" কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, "প্লিজ, দানাকে বল মোহনের কাগজ পত্র নিয়ে আমার সাথে যেতে।"
দানা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় মহুয়াকে হ্যাঁ বলতে বলে। মহুয়া নয়নাকে বলে, "ঠিক আছে আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি, তুমি ততখনে তৈরি হয়ে নাও।"
নয়না ঘরে ঢুকতেই, মহুয়া দানাকে একদিকে টেনে মনের আশঙ্কা ব্যাক্ত করে জিজ্ঞেস করে, "এইবারে কি হবে গো? যদি কাগজ পত্র না নিয়ে যাও তাহলে ওইখানে গিয়ে সিমোনে সব কিছু নয়নাকে বলে দেবে আর দুইজনে একত্র হয়ে গেলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। আর যদি নিয়ে যাও তাহলেও বিপদ।"
বুক ভরে শ্বাস নেয় দানা, কিছুক্ষণ ভেবে নিজের পরিকল্পনা জানায়, "আমি কাগজ পত্র আর নয়নাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যাওয়ার কিছুপরে তুমি বাকিদের আমাকে অনুসরন করতে বলে দেবে। বেশি চিন্তা করো না, পাপড়ি।"
মহুয়া ছলছল চোখে ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে, কি বলে? চিন্তা করবে না? আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় এই দশ মিনিটে ওর গায়ের এক লিটার রক্ত শুকিয়ে গেছে আর ছেলেটা চিন্তা করতে বারন করে? মেয়েদের কি কোনোদিন বুঝেছে? ওর জামা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মহুয়া, একটু পরেই নয়নাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। জানে না সকালে ফিরবে আদৌ না ফিরবে না। যদি না ফেরে তাহলে সোজা পুলিশ, কিন্তু ততক্ষণে ওর যা সর্বনাশ হওয়ার সেটা হয়েই যাবে। তাও সিমোন আর মোহনকে ছাড়বে না মহুয়া। বিমানের বাগান বাড়ি যাওয়ার চেয়েও এটা বেশি ভয়ঙ্কর। সেই সময়ে ওদের কাছে একটা পরিকল্পনা ছিল এইবারে ওদের কাছে কোন পরিকল্পনা নেই। জানেই না মোহন খৈতান কোথায় বুবাইকে লুকিয়ে রেখেছে, জানেই না ওদের সাথে কতজন লোক থাকবে। মহুয়া ওর বাজু শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো ছেড়ে দিলেই উড়ে চলে যাবে চিরতরে। বারেবারে এই যাওয়া আর নিতে পারছে না মহুয়া, রোজদিন দানা বাড়ি থেকে বের হলে ওর বুক কাঁপে, ঠিক ঠাক বাড়িতে ফিরবে তো?
নয়না জিন্স আর শার্ট পরে তৈরি, পায়ে জুতো গলায় স্কার্ফ দেখে মহুয়া আর দানার কিঞ্চিত সন্দেহ হয়। দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে না যে একদম পুরুষ মার্কা পোশাক পরে যেতে হবে।
ওদের দিকে এগিয়ে এসে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কাছে পিস্তল আছে?"
দানা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, "তুমি পিস্তল নিয়ে কি করবে?"
চোয়াল শক্ত করে চোখের জল মুছে দানাকে উত্তর দেয়, "পিস্তল থাকলে দাও দানা।" তারপরে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি জানো না ভাইয়ের জন্য আমি কি করতে পারি। ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল বলে আমি আমার বাবাকে ছাড়িনি। আর এরা পর, এদের মাথায় গুলি করে তবে ফিরবো।"
নয়নাকে ক্ষান্ত করে দানা বলে, "আমি সাথেই আছি, চলো। যা হবার সেটা দুইজনে একসাথে মোকাবিলা করবো আমরা।"
ওইদিকে সবাই জানে যে এক মরণ ফাঁদে পা রাখতে চলেছে কিন্তু সেই কথা কেউই মুখ থেকে বলতে চাইছে না।
বের হওয়ার আগে নয়না আর্ত চোখে মহুয়ার হাত ধরে বলে, "পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও মহুয়া। আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ভীষণ এক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ ছিলাম। এতদিনে বলার সাহস হয়নি। আসলে কি জানো, বাপ্পা নস্করকে সরানোর পরে আমাদের মতলব ছিল দানাকে সরানোর। যে কোন বাবা মায়ের প্রাণ তার সন্তানের মধ্যে আটকে থাকে। রুহিকে অপহরন করলে দানা ভেঙ্গে পড়বে, আর তখন ওকে দিয়ে যা কিছু করিয়ে নেওয়া যাবে।"
কথাটা কানে যেতেই মহুয়ার চোখে আগুন ঠিকড়ে বের হয়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অতীব জ্বলন্ত জ্বালামুখী শান্ত করে হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দেয়, "তুমি এই ষড়যন্ত্র করেছিলে সেটা আমি জানতাম। ভেবেছিলাম নিজে মুখে স্বীকার করবে, কোনোদিন কিন্তু করলে না। যাইহোক, এখন যাও, দেখ কি হয়।"
বাড়ি থেকে নীচে নেমে নয়না নিজের গাড়িতে ওঠে। দানা, আকরামের কাছ থেকে আরো দুটো পিস্তল চেয়ে নেয়। নিজের দুইখানা নয়নাকে দেবে আর নিজের কাছে দুই খানা রাখবে। খৈতানের মুখোমুখি হলে কে কার সাথে মিলে যাবে তার ঠিকানা নেই। যদি নয়না আর সিমোন মিলে যায় তাহলে নিজের আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চাই, আর যদি না মেশে তাহলে নয়না সিমোনকে মারবে তার জন্য ওকে বন্দুক দিতে হবে।
গাড়িতে ওঠার আগে মহুয়া ওর হাত শক্ত করে ধরে ছলছল চোখে বলে, "সকালে ব্রেকফাস্টে কি খাবে?"
কথাটা শুনে দানার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, বুকের মাঝে প্রেয়সীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মহুয়া সর্বশক্তি দিয়ে দানাকে জড়িয়ে ধরে, যদি এটা ওদের শেষ দেখা হয় তাহলে ভোররাতে মা মেয়ে দুইজনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। এই জীবনে যদি দানা এসে ওর হাত না ধরে তাহলে আর কারুর হাত ও ধরবে না।
বহুকষ্টে মহুয়াকে আলিঙ্গন পাশ থেকে ছেড়ে দিয়ে নয়নার সাথে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির স্টিয়ারিং দানার হাতে। মহুয়া অনেকক্ষণ ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না রাতের অন্ধকারে দানার গাড়ি মিলিয়ে যায়। নয়না নির্বাক, দানা নির্বাক, মুখে কোন কথা নেই কারুর, দুইজনে চিন্তায় মগ্ন, কি হবে এরপরে। গাড়ি নিয়ে সোজা নিজের অফিসে যায়, সেখান থেকে খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়ে আবার গাড়িতে ওঠে। হাতে একটু সময় আছে, তাই ধীরে ধীরেই গাড়ি চালাতে থাকে।
ঠিক সেই সময়ে আবার নয়নার ফোন বেজে ওঠে। নয়না আর দানা মুখ চাওয়াচায়ি করে, ইঙ্গিতে ফোন উঠাতে বলে নয়নাকে। ফোনে অন্য পাশের আগন্তুক ওকে নির্দেশ দেয়, "বিশ্বজিতের কাছ থেকে কি মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়েছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
আগন্তুক নির্দেশ দেয়, "তাহলে এইবারে বিশ্বজিতকে গাড়ি থেকে নেমে যেত বল। তোকে বলে দিয়েছিলাম একা আসতে। আমাদের সাথে কোন চালাকি করতে যাস না নয়না।"
কথাটা শুনে মনে হল ওদের কেউ অনুসরন করছে না হলে এতক্ষণ পরে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতো না। গাড়ি আবার দানার অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার গলা শুকিয়ে গেছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। একা যাওয়া ভীষণ বিপদ। দানা ওকে শান্ত করে বলে গাড়ির ডিকিতে বন্দী হয়ে ওর সাথেই যাবে। নিরুপায় নয়না দানার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের পার্কিংয়ে চলে যায়। নামার আগে নিজের দুটো পিস্তল নয়নার হাতে তুলে দিয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয় কি ভাবে গুলি চালাতে হবে। নয়না জানে একবার ওদের হাতে পড়লে ওর নিস্তার নেই সুতরাং যদি মরতে হয় তাহলে ওদের মেরে ফেলে তবেই মরবে আর সেই প্রস্তুতি নেয়। দানা ওকে আরো বলে, কোমরে অথবা পকেটে পিস্তল সবাই রাখে আর ওকে নিশ্চয় মোহনের লোকেরা পরীক্ষা করবে। পকেটে পিস্তল থাকলে অতি সহজে ধরা পরে যাবে, সুতরাং পিস্তল দুটো পায়ের গোড়ালিতে বেঁধে দেয়। এত নীচ পর্যন্ত কেউই আর পরীক্ষা করে দেখবে না, সুযোগ বুঝে যেন নয়না গুলি চালায়। দানা পাশেই থাকবে। চুপচাপ সব কথা মন দিয়ে শোনার পরে দানাকে কি বলবে ভেবে পায় না নয়না।
নয়নার ছলছল চোখ দেখে দানার শরীর রিরি করে জ্বলে ওঠে। একবার মনে হয় এইখানেই ওকে মেরে ফেলে দিক কিন্তু নিজের হাতে রক্ত মাখাতে চায় না। কিন্তু যদি সিমোন ওকে সব কিছু বলে দেয় তাহলে দানার নিস্তার নেই। খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র নয়নাকে দিয়ে গাড়ির ডিকির মধ্যে ঢুকে পড়ে। নয়না ডিকি বন্ধ না করে দানাকে ভেতর থেকে টেনে ধরে থাকতে বলে। আকরামের দেওয়া দুটো পিস্তল নিজের গোড়ালিতে বেঁধে গুটিসুটি মেরে গাড়ির ডিকিতে ঢুকে পড়ে। নয়না ওকে বলে, ওর কাছে যেমন নির্দেশ আসবে, সুযোগ মতন দানাকে জানিয়ে দেবে।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করে দেয়, অন্ধকার দম বন্ধ হয়ে আসা ডিকির মধ্যে থেকে কিছুই বোঝা যায় না কোথায় যাচ্ছে। তমালগুড়ির রাস্তা মোহনের বাগান বাড়ির রাস্তা থেকে ভিন্ন দিকে, এইদিকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটাই চিন্তা। একটাই ভরসা, ওদের পেছনে হয়ত এতক্ষণে আকরাম, নাসির শক্তি বলাই সবাই অনুসরন করছে। অবশ্য এই অনুসরনের বিষয়ে নয়নার অজানা।
অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পরে নয়নার জোর গলা শোনা যায়, "মেটেবাড়ি পার করেছি।" কিছুপরে, "বাঁ দিকে গ্রামের মধ্যে ঢুকলাম। ...... সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। ...... পেছনে একটা গাড়ি আসছে। ......"
গাড়ি যেমন নাচানাচি শুরু করেছে সেটা থেকে অনায়াসে বোঝা গেল যে গাড়ি এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে। কিছুদুর গিয়ে গাড়ি থেমে গেল। পাশে আরো একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। অন্ধকারে ছোট বদ্ধ ডিকিতে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়।
সাপের কোঠর (#০৫)
একটা পুরুষের কণ্ঠ স্বর শোনা গেল, "একা এসেছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
পুরুষের কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করে, "কাগজ পত্র?"
নয়না চাপা কণ্ঠে গর্জে ওঠে, "আগে ভাইকে দেখি তারপরে।"
পুরুষ কণ্ঠ উত্তর দেয়, "ঠিক আছে। পেছনে আয়।"
কয়েকটা পায়ের আওয়াজ গাড়ির পেছনের দিকে এগিয়ে আসে, মনে হয় দুইজন। সঙ্গে সঙ্গে দানা, গোড়ালি থেকে পিস্তল বের করে হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ, কি দেখল কে জানে তবে নয়নার সাথে ওই দুষ্কৃতীদের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। গোড়ালি থেকে দুটো পিস্তল বের করে হাতে তুলে নেয় দানা। অতি সন্তর্পণে ডিকি খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেড়িয়ে আসে। সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বিলেতি আমলের বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। দেখে অনেকটা ভুতুরে বাড়ির মতন মনে হল। দুটো পিস্তলের ডগায় সাইলেন্সার লাগিয়ে হাতে পা টিপে টিপে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ভাঙ্গা জানালার মধ্যে দিয়ে ভেতরের আলো দেখা পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে ভাঙ্গাচোরা বৈঠক খানায় মোহন আর চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবার হাতেই বন্দুক। বুবাইকে কোথাও দেখতে পায় না। দুইজন দুষ্কৃতি নয়নার মাথায় পিস্তল রেখে দাঁড়িয়ে।
আহত ক্ষুব্ধ নয়নার দিকে এগিয়ে এসে মোহন দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে ওঠে, "শালী তোর জন্য আমার বন্ধু আজ মারা গেছে।"
নয়না পাল্টা সুরে বলে, "নিজের ক্ষমতায় কুলায়নি, শেষ পর্যন্ত ভাইকে হাতিয়ার করে আমাকে ধরলি? ভাবিস না তোরা বেঁচে যাবি।" বলেই বাঁকা হাসি দেয়।
মোহন ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "আজ তুই বাঁচবি না। তোকে শেষ করার জন্য এইখানে ডাকা।" বলে নয়নাকে চেপে ধরে মাটির ওপরে বসিয়ে দেয়।
আহত সাপের মতন ফুঁসে ওঠে নয়না, "আমার ভাই কোথায়?" ওর হাতের ফাইল গুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
মাটি থেকে ফাইল গুলো উঠিয়ে এক এক করে দেখে মোহন ক্রুর হাসি দিয়ে বলে, "শালা মাদারচোদ দানা, আমার প্রকল্প হাতাতে গেছিল। তোর ভাইকে অপহরন করার পরিকল্পনা আসলে কার জানিস?"
দানা চোখ বন্ধ করে নেয়, এটা অবশ্যাম্ভাবি। মোহন অথবা সিমোন নয়নাকে বলেই দিত। নয়না ফুঁসে ওঠে, "মানে?"
অট্টহাসিতে ফেটে পরে মোহন খৈতান, হাতের পিস্তল নয়নার নাকের সামনে নাচিয়ে বলে, "তোর সুহৃদ বন্ধু, তোর হিতৈষী দানার ষড়যন্ত্র এটা।"
নয়নার চোখ জ্বলে ওঠে, মাথা ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "না, বিশ্বাস করি না। আগে বল, আমার ভাই কোথায়?"
পাশের একটা ছেলেকে মোহন নির্দেশ দেয় বুবাইকে আনতে। মোহন কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "দানা তোর হিতৈষী, তোর সাথে আসেনি কেন? তোকে একাই আমার কাছে পাঠিয়েছে মরার জন্য? (চুকচুক করে মোহন) ইসসস আজকে রাতে তুই শেষ হবি আর আমার প্রকল্প গুলো আমার হাতে চলে আসবে।"
নয়না চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে, হয়ত দানাকেই খুঁজছে ওর চোখ। দুই চোখে ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "তোমরা তো ওর মেয়েকে অপহরন করতে চেয়েছিলে তাই না? আর সেটা আমার হাত দিয়েই করাতে। এটা ওর মাথার উপজ কোনোদিন হতে পারে না মোহন, এই পরিকল্পনা সিমোনের মাথার উপজ।"
ঠিক তখনি একটা ছেলে বুবাইকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। বুবাইয়ের পেছন পেছন হাসতে হাসতে সিমোন ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। সিমোনকে এইখানে দেখে একদিকে দানা আর অন্যদিকে নয়না, দুইজনে অবাক হয়ে যায়। ওরা ভাবতে পারেনি সিমোন নিজে এইখানে আসবে।
বুবাইকে দেখে নয়না কেঁদে ওঠে, "আমার ভাইকে ছেড়ে দাও। তোমার কথা মতন আমি তোমার প্রকল্পের কাগজ পত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি আর নিজেও এসেছি। জানি তুমি আমাকে আজ রাতে শেষ করে দেবে। কিন্তু সত্যি বলছি বিমানের মৃত্যুর পেছনে আমি দায়ী নই।"
বুবাইকে ছেলেটা ছেড়ে দিতেই এক দৌড়ে দিদির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর মুখে শরীরে হাত বুলিয়ে স্নেহ করে জিজ্ঞেস করে, "কিছু করেছে তোমাকে সোনা?"
বুবাই মাথা নাড়িয়ে সিমোনকে দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, "মেরেছে আমাকে।"
হিংস্র নয়নার চোখ থেকে জলের জায়গায় রক্ত ঠিকরে বেড়িয়ে আসে। প্রাণপণ শক্তি দিয়ে বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মোহনের দিকে রক্ত চক্ষু হেনে জিজ্ঞেস করে, "একে কেন মেরেছো? একি ক্ষতি করেছে তোমাদের?"
সিমোন চিবিয়ে চিবিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "না না এ কোন ক্ষতি করেনি তবে শালা মাদারজাত ভাই তোর। যখন থেকে এসেছে বোকাচোদা ছেলে শুধু দুদু খাবে দুদু খাবে বলে কাঁদছে। অত বড় ছেলেটা শেষে কিনা আমার বুকে হাত দেয়? কোন আস্পর্ধায় আমার বুকে হাত দেয়।" ওর দিকে পিস্তল উঁচিয়ে গর্জে ওঠে, "তোদের দুটোকেই আজকে শেষ করে দেব।"
নয়না চকিতে গোড়ালি থেকে দুটি পিস্তল একসাথে বের করে "দুম দুম" "দুম দুম" করে পর পর মোহনকে আর সিমোনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। দুটো গুলি মোহনের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। সিমোনে কাঁধে লাগে দুটো গুলি। অতর্কিত হামলায় মোহন কিছু বুঝতে পারে না কিন্তু ততক্ষনে গুলি ওর পেট বুক ফুঁড়ে বেড়িয়ে গেছে। বাকি ছেলেগুলো হিংস্র নয়নার রক্ত চক্ষু দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্ধ নয়নার পিস্তল ওদের দিকে তাগ করা, এক পা নড়লে গুলি ওদের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে।
রক্তাক্ত মোহন খৈতান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর সিমোন চিৎকার করে, "নাআআআ....." মোহনকে জড়িয়ে ধরে। রক্তাক্ত স্বামীর মাথা কোলে তুলে সিমোন নয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে ওঠে, "তুই একে গুলি করলি?" বলেই পাশে একটা লাঠির মতন কিছু ছিল সেটা হাতে নিয়ে নয়নাকে মারতে উদ্যত হয়।
হিংস্র ক্ষুদ্ধ নয়না ফুঁসতে ফুঁসতে বাকিদের দিকে পিস্তল তাগ করে মোহনের দিকে এগিয়ে যায়। নয়নার হাতে দুটো পিস্তল দেখে সিমোনের চেহারা আতঙ্কে রক্ত শূন্য হয়ে যায়। দানা চুপচাপ জানালা দিয়ে দেখে যায়, এর মধ্যে একজন শেষ, একজন আহত একজন ক্ষুদ্ধ। ক্ষুদ্ধ নয়নাকে যদি সিমোনে না মারে তাহলে ওর মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। এখন কেন শক্তি, নাসির বলাইদের দেখা নেই, বারেবারে ঘড়ি দেখে দানা। এতক্ষণে ওদের এইখানে এসে যাওয়ার কথা।
মোহন আর সিমোনের দিকে এগিয়ে যায় নয়না। রক্তাক্ত মোহনের গলার ওপরে পা তুলে মাটির সাথে পিষে ধরে নয়না গর্জে ওঠে, "আমার বাবা আমার ভাইকে মারতে গেছিল তাকে পর্যন্ত ছাড়িনি। তোকে কেন ছেড়ে দেব?"
বলেই মোহনের মাথা লক্ষ্য করে আরো একটা গুলি করে, যার ফলে ওর মাথার খুলি গুঁড়িয়ে যায় আর সিমোনের কামিজ রক্তে ভেসে যায়।
মৃত মোহনের মাথা কোলে করে সিমোন আর্তনাদ করে ওঠে, "একি করলে তুমি? এই সব দানার ষড়যন্ত্র এইসব না হলে কি আর তোমার ভাইকে আমরা কিডন্যাপ করতে পারি? ওই আমাদের হাতে তোমার ভাইকে তুলে দিয়েছে।"
মোহন শেষ, সিমোন শেষ পর্যন্ত সত্য উজাগর করেই দিয়েছে। এইবারে দানাকে সামনে আসতেই হবে, নয়নার সম্মুখীন হতেই হবে, জানালার পেছনে আর লুকিয়ে থাকা নয়। তাল ঠুকে শেষ পর্যন্ত পিস্তল হাতে জানালা ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। জানালা ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে নয়না, ছলছল চোখে একবার ওর দিকে তাকায়। দুই হাতের পিস্তল পাশের ছেলেগুলোর দিকে তাগ করে এগিয়ে আসে নয়নার দিকে।
বুবাইকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দিদিকে জড়িয়ে ধরে। ভাইকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে নয়না। পাশের ছেলে গুলো দানার দিকে এগিয়ে আসতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে দানার হাতের পিস্তলের গুলিতে এক এক করে দুইজনে প্রান হারায়। বাকি দুইজন সেখান থেকে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচে।
ছলছল চোখে নয়না এক হাতে পিস্তল এক হাতে ভাইকে জড়িয়ে একবার দানার দিকে তাকায়। তারপরে সিমোনের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমাকে মারার ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আমি যদি ওর মেয়েকে অপহরন করতাম যেটা তোমরা করাতে চেয়েছিলে তাহলে কি ও আমাকে ছেড়ে দিত? কিন্তু আমার ভাই কেন সিমোন....." উত্তরের অপেক্ষা করে না নয়না। কথাটা শেষ করেই সিমোনের মাথা লক্ষ্য করে একটা গুলি করে ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। প্রাণহীন সিমোন নিজের প্রাণহীন স্বামী মোহনের পাশে লুটিয়ে পড়ে।
দানার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়, এর পরের গুলি ওর মাথা অথবা বুক লক্ষ্য করেই হবে সেটা অজানা নয়। তবুও দানা নয়নার দিকে পিস্তল তাগ করে না। আহত হিংস্র বাঘিনী নয়নার চোখে চোখ রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দানাও জানে এই নারীকে এইখানে শেষ করে দেওয়া উচিত, নয়না বেঁচে থাকলে ওর সমুহ বিপদ, ওর পরিবারের সমুহ বিপদ।
নয়না আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে ম্লান হেসে বলে, "সত্যি আমার মরে যাওয়াই উচিত, তাই না দানা? আমি বেঁচে থাকলে তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কে দেখবে? তুমি দেখবে? না না....." বলতে বলতে বুবাইকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। বুবাই দিদিকে দুই হাতে জড়িয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে দেয়। জল ভরা চোখে নয়না, একবার ভায়ের মাথায় চুমু খেয়ে ওর কানের ওপরে বন্দুক ধরে। স্মিত হেসে নয়না বলে, "আমি সত্যি ভীষণ পাপী, দানা। এই দেখো, আমি রুহিকে অপহরন করতাম আর অদৃষ্ট ঠিক আমার ভাইকে এদের হাতেই অপহরন করিয়ে সেই শাস্তি আমায় দিল। সমু আর সুমিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই পৃথিবীতে আমার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে নেই দানা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কেউ দেখবে না দানা।"
"দুম" একটা গুলি সোজা বুবাইয়ের মাথার খুলি ভেদ করে দেয়। দানার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। বুবাই কেঁপে ওঠে, ফুটো মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে নয়নার সারা চেহারা আর জামা ভিজিয়ে লাল করে দেয়। চোখ বন্ধ করে মৃত ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। দানা হাত থেকে পিস্তল ফেলে চুপচাপ স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে থাকে। নয়না যে নিজের ভাইকে মেরে ফেলবে সেটা দানা স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহন হয়ত ওদের পৌঁছানর আগেই বুবাইকে মেরে ফেলবে।
ঠিক তখনি বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দড়াম করে সামনের দরজা খুলে শক্তি আকরামের সাথে পুলিস এসে প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে। দানার শরীর পাথরের মতন শক্ত হয়ে যায়। মন থেকে চেয়েছিল নয়নার মৃত্যু হোক কিন্তু এইভাবে শেষ পর্যন্ত? দানা ধারনা করতে পারেনি যে নয়না নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করবে। দানা ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহনের হাতে নয়না আর তার ভাই খুন হবে আর কঙ্কনা আর নাসরিনের খুনে সিমোনেকে ফাঁসিয়ে দেবে। কিন্তু একা নয়না যে সবাইকে হত্যা করবে সেটা ওর ধারনার বাইরে ছিল, বিশেষ করে নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করার ব্যাপারটা।
শক্তি ধীর পায়ে দানার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতে মোবাইল তুলে দেয়। নিথর দানা, শক্তির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ওর দিকে তাকায়। শক্তি ইশারায় জানায় ফোনের অন্যপাশে মহুয়া। দানা মোবাইল তুলে মহুয়ার সাথে কথা বলে।
মহুয়া ওইপাশ থেকে চাপা গলায় বলে, "জিত নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
দানা স্থম্ভিত হয়ে যায়। একি বলছে মহুয়া?
মহুয়া আবার দানাকে বলে, "জিত, প্লিজ নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
নির্বাক দানা এক ভাবে সামনে বসা নয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলে মৃত বুবাই, সারা শরীর ভাইয়ের রক্তে ভেসে গেছে নয়নার। দানা কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে একটু বলবে?"
মহুয়া উত্তরে বলে, "তুমি যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো। বাড়ি এসো তারপরে সব বলছি।"
দানা শক্তির দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। শক্তি মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই নয়না বলে ওঠে।
নয়না চোখ খুলে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো দানা, জীবনে প্রচুর পাপ করেছি। সমু নেই, আমার ভালোবাসা আমার বন্ধু আমার সবকিছু - সেই রাতে হারিয়ে গেছে।" নিজের কানের ওপরে পিস্তল রেখে ছলছল চোখে বলে, "মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে ভালো থেকো, দানা। আমি আমার সমুর কাছে চললাম।"
পুলিস ওর দিকে এগিয়ে যায় বিরত করতে। দানা হাত উঠিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "দাঁড়াও, প্লিজ দাঁড়াও। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
নয়না স্মিত হেসে জল ভরা চোখ বন্ধ করে মৃত বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে নিজের কানের ওপরে গুলি চালায় "দুম"। গুলিটা নয়নার মাথার খুলি ভেদ করে যায়, রক্তের ফিনকি বেড়িয়ে আসে। পুলিস, দানা আকরাম শক্তি সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। পুলিস কাউকেই বাঁচাতে পারে না।
দানা নিজের মাথা ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ ওইখানে বসে থাকে। ওর হাত থেকে মোবাইল মাটিতে পড়ে যায়। মোবাইলে মহুয়ার অস্ফুট আর্তনাদ শোনা যায়, "না......"
চারপাশে ছড়ানো মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র। শক্তি মনা এক এক করে সেই কাগজ পত্র গুলো উঠিয়ে ফাইল বদ্ধ করে। পুলিস নিজের কাজে লেগে পড়ে।
দানা কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল তুলে মহুয়াকে বলে, "হঠাৎ কি হলো?"
মহুয়া চাপা আহত কণ্ঠে উত্তর দেয়, "নয়না, বড়দার মেয়ে, শায়ন্তনি। বড়দার ডান হাতের আঘাতের দাগ, কুড়ি বছর আগের ওর মেয়ের দেওয়া। বাড়ি আসো, বড়দা বসে আছেন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"
চোখের সামনে সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় দানার। পুলিস ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব কিছু খুলে জানায়। সিমোনে আর মোহন, নয়নার ভাইকে অপহরন করেছিল। বুবাইকে ছাড়ার বদলে ওরা নয়নাকে খুন করতে চেয়েছিল আর চেয়েছিল দানার নামে যে সম্পত্তি আছে সেই গুলো হাতিয়ে নিতে। কিন্তু একা নয়না বাকি সবাইকে মেরে ফেলে আর সেটা চাক্ষুষ পুলিসের সামনেই হয়েছে। পিস্তলের কথা জিজ্ঞাসা করলে দানা জানায় ওর কাছে কোন পিস্তল ছিল না, নয়না কোথা থেকে পিস্তল যোগাড় করেছে সেটা ওর জানা নেই।
নয়নার মৃত্যু দানাকে বিশেষ নাড়া দেয়না তবে চোখের সামনে নিজের ভাইকে খুন করেছে সেটা দেখে দানা বেশ বিচলিত হয়ে ওঠে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নয়না কি চেয়েছিল সেটাই বোঝা গেল না। অর্থ যশ প্রতিপত্তি, না প্রেম ভালোবাসা? কাকে বেশি ভালবাসতো নয়না ওরফে শায়ন্তনি বসাক? উত্তর আসে রক্তাক্ত লুটিয়ে থাকা শায়ন্তনি বসাকের ভগ্ন হৃদয় থেকে..... সমুদ্রকে ভালবাসতো শায়ন্তনি বসাক, আর অভিনেত্রী নয়না বোসের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল রাজনৈতিক দলের নেত্রী হওয়ার। আর দূরে দানার বাড়িতে অপেক্ষায় এক পিতা, হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কাছে পাবার আশায় হয়তো বসে আছে। এই ছলনাময়ী মহানগর প্রচুর আলেয়ায় ভরা। ওর বাড়িতে অপেক্ষারত এক আলোকের জ্যোতি, মহুয়া।
********** পর্ব ষোল সমাপ্ত **********
********** সমাপ্ত **********
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইনডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment