আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
কাজল নদীর জলে,
ভরা ঢেউ ছল ছলে,
প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া।
সোনার বরণী মেয়ে,
বলো কার পথ চেয়ে,
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।।
আমাদের এই কাহিনী একটা মেয়েকে নিয়ে। ওর চোখ সব সময় জলে ভর্তি থাকে। বাইরে থেকে সেই জল হয়ত সবসময় দেখা যায় না, কিন্তু মনের অতলে সেই চোখ সব সময় জলেই ভর্তি থাকে। অপরের গানের কথা অনুসারে সে সোনার বরণী মেয়ে নয়। ওর গায়ের রঙ আকদম কষ্টি পাথরের মত কালো। ও কারো কথা স্মরন করে কোন নদী বা খালের জলে প্রদীপ ভাসায় না। ও জীবনে কেউ আসেই নি যে তাকে স্মরন করবে বা প্রদীপ ভাসাবে। সে প্রদীপ ভাসায় মনের নদী তে, কল্পনার প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোয় খুঁজে বেড়ায় জীবনের মানে।
এই মেয়েটিকে আমি ভীষণ কাছের থেকে চিনি। আমি ওর মনের সুখ দুঃখ সবই জানি। আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওর জীবনে প্রদীপ জ্বালাতে। আমি নিজে জ্বালাতে পারিনি কারন ওর সাথে আমার পরিচয় হয় আমার বিয়ের পরে। এই কাহিনী সেই মেয়েটিকে নিয়ে। এই কাহিনির সব চরিত্র হয়ত সত্যি নয়, তথাপি সব ঘটনা গুলো সত্যি। এই কাহিনী দিয়ে আমি বোঝাতে চাই আমাদের কলকাতার বাঙালি সমাজের এক অংশ আজও সেই আশাপূর্ণা দেবীর “সুবর্ণলতা”-এর যুগেই পড়ে আছে। এই কাহিনীতে সেক্স হয়তো সেই ভাবে আসবে না।
মানসী উদাস হয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিল। ওর মনে পড়ছিল সেদিন কলেজে ওর সাথে বাকি ছেলে মেয়েরা, যাদের ও বন্ধু বলে জানতো তারা কিভাবে ওর সাথে কথা বলছিল।
মানসী চার বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে ছোটো। ছোটো ছেলে বা মেয়েরা সাধারণত সব থেকে আদরের হয়। কিন্তু যে বাড়ীতে আটটা ছেলে মেয়ে সেখানে মনে হয় সেরকম হয় না। তাই মানসী শুধু আরেকটা মেয়ে ছিল। ওর মায়ের বিয়ের হয়েছিল অনেক ছোটো বয়সে। তারপর ২৫ বছর ধরে উনি ওনার স্বামীকে ছেলে মেয়ে উপহার দিয়ে গিয়েছেন। ওর বাবা বাংলাদেশ থেকে এসে শিয়ালদহ অঞ্চলে ৩০ টাকা দিয়ে দুটো ঘর ভাড়া করে থাকতেন, প্রেস আর কাগজের ব্যবসা করতেন। ওনার জীবনে একটাই লক্ষ ছিল কিভাবে পয়সা উপার্জন করা যায়। উনি বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এক বিশাল বড়লোকের মেয়ে সুলগ্নার সাথে। সেই বিয়েতে বেলঘরিয়াতে ১০ কাঠা জায়গা সহ বেশ বড় একটা বাড়ি পেয়েছেন। তাই ওনারা সপরিবারে শিয়ালদা ছেড়ে ওই বেলঘড়িয়ার বাড়িতেই থাকেন। মানসী তখন এইটে পড়ত। স্কুলে পড়তে পড়তেই ওর আরও দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায়। প্রত্যেকের একটা বা দুটো করে বাচ্চাও হয়ে গিয়েছিল।
এখন মানসী প্রথম বর্ষ বাংলা অনার্সের ছাত্রী। ওর খুব ইচ্ছা ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়বে কিন্তু ওর বড়দা রাজী হননি। কারন সায়েন্স পড়ানোর খরচ অনেক বেশী। সুলগ্না বৌদি অনেক বোঝানর চেষ্টা করেছিল কিন্তু বড়দা মেনে নেন নি। দুবছর আগে মানসী মাধ্যমিক ৮২% নম্বর নিয়ে পাস করলে বড়দা আর সুলগ্না বৌদির মধ্যে কথা হয়েছিল।
- তুমি কি চাও না তোমার বোন কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ?
- তুমি কি ভেবেছ সায়েন্স পড়ালেই দাঁড়িয়ে যাবে ?
- তাও সায়েন্স পরলে সুযোগ অনেক বেশী।
- কিন্তু সায়েন্স পড়ালে মাসের খরচ একটু বেশী, টিউশনি দিতে হবে, আবার উচ্চ মাধমিক পাস করলে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইবে। অত খরচ করতে পারব না আমি।
- তোমাকে খরচ করতে হবে না। তোমার বোন আমারও বোন। আমার টাকা থেকে খরচ করে অকে পড়াবো ও যা পড়তে চায়।
- দেখো তোমার বাবা তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, তাই তোমার সব দায়িত্ব আমার। সেখানে তোমার টাকা আর আমার টাকার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
- তার মানে কি আমি আমার ইচ্ছা মত কিছুই করতে পারব না ?
- তোমার ইচ্ছাতেই তো সব হয়। শুধু আমার সন্মতি দরকার হয়। এই সবই তো তোমার।
এরপরে সুলগ্না বৌদি আর কিছু বলেনি। সুলগ্না বৌদি বড়লোকের মেয়ে হলেও ওনার মধ্যে কোন অহঙ্কার ছিল না। উনি সবাইকে সাথে নিয়ে চলতেন। ছোট বড় ভেদাভেদ করতেন না। অন্যদিকে বড়দা বাইরে থেকে দেখাতেন উনি সবার সাথে আছেন কিন্তু এটাও বুঝিয়ে দিতেন যে উনি সব থেকে বড়। ওনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে উনি সেটা মেনে নেবেন না। উনি সবাইকে এটাও বুঝিয়ে দিতেন যে ওনার অনেক পয়সা (আসলে ওনার বৌয়ের পয়সা)।
মানসীর বাবা শুধুই ব্যবসা দেখতেন আর চিন্তা করতেন কিভাবে আরও পয়সা বানান যায়। তাই বড়দা যা যা করতেন উনি তাকে সমর্থন করতেন। দুজনের উদ্দেশ্য একই ছিল। মানসীর মা ছিলেন একদম শরত চন্দ্রের উপন্যাসের গ্রামের মায়ের মতন। শুধু উনি শহরে থাকতেন। রান্না করা, সবাইকে খাওয়ানো আর সবার স্বাস্থের কথা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতেন না। মানসীর দুই অবিবাহিত দাদা উচ্চ মাধমিক কোনোরকমে পাশ করার পর ওর বাবার ব্যবসা দেখত। মানসীর অবিবাহিতা দিদিও প্রায় সেইরকম। পড়াশুনাও করেনি, কোন কাজও করে না। নামে মাত্র গান শেখে।
যাই হোক এতক্ষন মানসীর বাড়ির সবার পরিচয় দেওয়া হল। এবার আমাদের গল্পে ফেরা যাক। সেদিন যখন কলেজে গিয়েছিল মানসী তখন সেই দিন তা অন্য সব দিনের মতই সাধারন একটা দিন ছিল। কিন্তু এখন আর মানসীর তা মনে হচ্ছে না।
মানসী বুদ্ধিমতী মেয়ে। পড়াশুনাতেও ভাল। ঘরের সব কাজই করতে পারে। রান্নাও ভালই করে। সমাজের হিসাবে ওর একটা জায়গাতেই সমস্যা আছে। ওর গায়ের রঙ খুব কালো। বাড়ীতে মায়ের আদরের মেয়ে আর সুলগ্না বৌদির ভালবাসার ননদ হলেও কলেজে কোন বন্ধু নেই। মানসী এতদিন ক্লাসের অনেককেই বন্ধু ভাবত। আজ ওর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু ও পড়াশুনায় ভাল ছিল প্রায় সব শিক্ষক বা শিক্ষিকারাই ওকে ভাল চোখে দেখতেন। যদিও কেউ ওকে কোন বেশী সুবিধা দিতেন না বা প্রশ্রয় দিতেন না। কিন্তু কেউই ওকে তিরস্কার করার সুযোগ পেতেন না।
ক্লাসের প্রায় পনেরো জন ছেলে মেয়ে, যাদের মানসী এতদিন বন্ধু বলে জানত, সবসময় ওর সাথেই ঘুরত। সাথে না বলে বলা যায় ওর পেছন পেছন ঘুরত। মানসী যা বলে সব কথা শুনত। একসাথে আড্ডা দিত। ওর সব থেকে কাছের ছিল কস্তূরী, শিলা, অমিত আর অসীম। সেদিন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস নিয়ে আলচনা হচ্ছিল। গোবিন্দদাসের দুটো কবিতা নিয়ে সেদিন অনেক কথা হয়।
১।
মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল।
বার কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণে মরম মরি জাত।।
দশ দিশ দামিনী দহই বিথার।
হেরইতে উচকই লোচনভার।।
ইথে যদি সুন্দরি তেজবি গেহ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।
গোবিন্দদাস কহ ইথে কি বিচার।
ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার।।
২।
সই , কেমনে ধরিব হিয়া ?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া ,
এমতি করিল কে ?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!
যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয় ,
ওই ক্লাসের পড়ের ক্লাস অফ ছিল। দুপুর বেলা বাইরে ভীষণ রোদ, তাই ছেলে মেয়েরা ওই ক্লাসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল।
ওই ক্লাসের পড়ের ক্লাস অফ ছিল। দুপুর বেলা বাইরে ভীষণ রোদ, তাই ছেলে মেয়েরা ওই ক্লাসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল।
কস্তূরী – রাধা আর কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে কেন যে এত সাহিত্য বুঝিনা
অমিত – কৃষ্ণ সেইরকম কিছু বলত না, রাধাই ওর ওপর ফিদা হয়ে গিয়েছিলো
শিলা – রাধা কি করে যে ওই কুচকুচে কালো রঙের একটা ছেলেকে পছন্দ করলো কে জানে
অসীম – ছেলেদের কালো ফর্সা হয় না। তোর রাধা যদি কালো হত আর কৃষ্ণ ফর্সা হত তবে ওদের প্রেমও হত না আর এত সাহিত্যও হত না।
মানসী – একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা ভালবাসা গায়ের রঙ দেখে হয় না
কস্তূরী – কিন্তু আমি বুঝলাম না গোবিন্দদাস শেষ লাইনটা কেন বলেছে
শিলা – কোন লাইনটা ?
কস্তূরী - ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার
মানসী – দেখ ধনুকের থেকে বাণ ছেড়ে দিলে যেমন ফিরে আসে না। টিউবের থেকে টুথপেস্ট বের করার পরে যেমন ফেরত দেওয়া যায় না। সেইরকম রাধা রানীর মন কৃষ্ণের সাথে আটকে গেছে। সেটা আর ছাড়ানো যাবে না। প্রেম একবার হয়ে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
অমিত – বেশ সুন্দর উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দিলি মাইরি
শিলা – পরের কবিতায় যা লিখেছে সেই রকম হলে আমারও দুঃখ হয়
অসীম – কি রকম ?
শিলা - সই , কেমনে ধরিব হিয়া ? আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমার আঙ্গিনা দিয়া!
কস্তূরী – তোর সাথে কে করে ওইরকম ?
শিলা – কেন এই অসীম হতচ্ছাড়াটা
কস্তূরী – অসীম তো তোকে ভালবাসে ?
শিলা – বাল ভালবাসে, শুধু আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওই পেত্মিটার পেছন পেছন ঘোরে
অমিত – পেত্নি আবার কে ?
শিলা – কেন এই মানসী, কালো পেত্নি
অমিত – ছিঃ তুই এই ভাবিস ! ও আমাদের বন্ধু না ?
শিলা – বন্ধু ! নেহাত মানসী পড়াশুনায় একটু ভাল তা না হলে ওর সাথে আমি জীবনে কথাই বলতাম না।
কস্তূরী – আমিও তো কালো
শিলা – তুই মোটেই ওর মত কালো নয়
অসীম – এই আলোচনা এখন না করলেই নয় ?
শিলা – আমি তোর আর অমিতের মত পেছনে বলি না। যা ভাবি সেটা সামনা সামনিই বলি
কস্তূরী – তাও চুপ কর প্লীজ
মানসী – না না ওকে বলতে দে, ওরা কি ভাবে সেটা জানা দরকার।
শিলা – ওই অসীম তোকে এত পাত্তা দেয় সেটা শুধু তোর কাছ থেকে তোর সুলগ্না বৌদির বানানো নোটস গুলো নেবে বলে।
অসীম – মোটেই না। আমি আর অমিত মানসীকে বন্ধু হিসাবেই দেখি।
শিলা – ওই অমিতের কথা আর বলিস না
অমিত – আমি আবার কি করলাম ?
শিলা – তুই অসীমকে কি বলেছিস আমি জানি
মানসী – কি বলেছে
কস্তূরী – কিচ্ছু বলেনি। ছেড়ে দে ওইসব ফালতু কথা।
মানসী – ছাড়তে হবে না, আমিও শুনি আর জানি আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে কি ভাবে
শিলা – অমিতের ধান্দা তোর কাছ থেকে নোটস নেওয়া। আর তোকে বন্ধুত্বের জালে ফাঁসিয়ে তোর শরীরটাকে ভোগ করা।
কস্তূরী – ছিঃ
অমিত – মোটেও না
শিলা – একদম মিথ্যা কথা বলবি না। তুই বলিসনি অসীমের কাছে “মানসীর বুক দুটো দেখেছিস? একদম ডাঁসা পেয়ারা, কিন্তু ফজলি আমের সাইজের। পরীক্ষা হয়ে গেলে একদিন ওকে পটিয়ে মস্তি করবো। তারপর ওই কালো ভুতকে আর চেনারও দরকার হবে না”। কেউ বন্ধুদের শরীর দেখে !
কস্তূরী – ছিঃ অমিত ছিঃ, তোকে আমার বন্ধু বলে ভাবতেও গা শিরশির করছে
অমিত – দেখ সেদিন অসিমের সাথে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম। মানসী বিশ্বাস কর আমি আসলে এইরকম ভাবি না।
মানসী - ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার
মানসী আর বসে থাকেনি। কাঁদেও নি। একবার কান্না এসেছিলো কিন্তু নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। যাদের ও বন্ধু ভাবতো তারাও যে এত নিচু মনের সেটা ও বুঝতে পারেনি। ও মনে মনে শিলাকে ধন্যবাদ দেয় সবার মুখোস খুলে দেবার জন্য। শিলা হয়তো সুন্দরি বলে অহংকারী। কিন্তু সত্যি কথা বলার সাহস রাখে। অসীম বা অমিতের মত গিরগিটি নয়। ওই ঘটনার পরে মানসী যখন চলে আসছিল, কস্তূরীও ওর সাথে চলে এসেছিলো। কস্তূরী ওকে কিছু বোঝাতে চাইছিল, কিন্তু তখন মানসীর শোনার মত মানসিকতা ছিল না। কস্তূরী নিজে সুন্দরী নয় বা ওর ফিগারও ছেলেদের চোখে আকর্ষণীয় নয় তাই কস্তূরী মানসীর দুঃখ বোঝে। ও সেদিন কস্তূরীকে পরে কথা বলবে বলে একাই বাড়ি ফিরে আসে। এই সন্ধ্যে বেলায় আকাশে চাঁদ কে একা দেখে ও এইসব কথাই ভাবছিল।
ও ভাবছিল চাঁদ তো কত সুন্দর কিন্তু তবুও এত বড় আকাশে একা। যখন একাদশীতে চাদের আল কম থাকে তখন চাঁদের চারপাশে সব তারারা ভিড় করে থাকে। পূর্ণিমাতে চাঁদের রূপ সম্পূর্ণ বিকশিত হলে কোন তারাই ঈর্ষায় চাঁদের কাছে আসে না। কিন্তু মানসীর ওই চাঁদের মত রূপ নেই। তাই একাদশী বা পূর্ণিমা কখনোই ওর চারপাশে কেউ থাকে না। ওকে সবাই কয়লার মত বাইরে ফেলে রাখে। আগুন জ্বালানোর জন্য ঘোরে নিয়ে আসে। আগুন শেষ হয়ে গেলে ছাই করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
একসময় ভাবছিল কি হবে এই জীবন রেখে কিন্তু ওর মা আর সুলগ্না বৌদির কথা মনে আসে। ভাবে কখনো হয়তো সুলগ্না বৌদির মত মানসিকতার কোন একটা ছেলে ওকে দেখবে আর পছন্দ করবে। মানসী নিজেও নিজের জীবনকে খুব ভালবাসে। আর ও কাপুরুষ নয় যে জীবন থেকে পালিয়ে যাবে। ও ভেবে নেয় ও এই লড়াই চালিয়ে যাবে। ও বোঝে যে ও প্রায় একাই ওর দলে কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে যে ও কখনো পিছু হটবে না। ওর “Gone with the wind” সিনেমার স্কারলেটের কথা মনে পড়ে। যেখানে স্কারলেট বলেছিল, “আমি আর ক্ষিদেতে কাঁদবো না”। মানসীও চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করে “আমিও আর কালো বলে ভেঙ্গে পড়বো না”।
একসময় আকাশের ভাঙ্গা চাঁদ মেঘে ঢেকে যায়। মানসী তাও ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবতে থাকে কি ভাবে মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসবে।
সুলগ্না বৌদি মানসীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ছাদে চলে আসে। বৌদি জানত যে মানসীর মন খারাপ হলে ও ছাদে এসেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুলগ্না – আমার রাঙা দিদির কি হয়েছে আজকে ?
মানসীকে ওর বাড়ীতে সবাই রাঙা পিসি, রাঙা মাসি বা রাঙা দিদি বলে ডাকে। তাই ওর বৌদিও ওকে রাঙা দিদি বলে।
মানসী – কিছু হয়নি গো, এমনি চাঁদ দেখছিলাম।
সুলগ্না – আমি জানি আমার এই দিদি কোনদিন চাঁদ দেখতে আসে। কে কি বলেছে তোমাকে ?
মানসী ওর বৌদির কাছে কিছু লুকায়না। সেদিন কলেজের বন্ধুদের সাথে যা যা হয়েছিল সব কথা বলে দেয়।
সুলগ্না – এতেই এত মন খারাপ হয়ে গেল ? কটা ছেলে মেয়ে তোমাকে কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলেছে। ওই কথাগুলোই ওদের নীচতার পরিচয় দিয়েছে। তুমি তাতে মন খারাপ কেন করবে ?
মানসী – আমি ওদের কথার জন্য মন খারাপ করছি না
সুলগ্না – তবে মন খারাপ কিসে হল !
মানসী – আমার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। আমি কিভাবে ওদের আমার বন্ধু ভেবেছিলাম। কেন আমি মানুস চিনতে পারিনি !
সুলগ্না – তাতেই বা কি হয়েছে ! তুমি এখনও শিখছ। এইসময় দু একটা ভুল হতে পারে। সেই ভুলের জন্য মন খারাপ না করে সেখার চেষ্টা কর।
মানসী – সেটাই ভাবছিলাম
সুলগ্না – চল এবার খেয়ে নেবে।
মানসী পরদিন কলেজ যায়। তারপর দিনও যায়। রোজই কলেজ যায়। ও নিজেকে একটুও বদলায় না। মানে নিজের মনে অনেক বদল আনে। তবু ওর তথাকথিত বন্ধুদের সাথে ওর ব্যবহার বদলায় না। ও এখন খোলা মনে বুঝতে চেষ্টা করে কে কে ওকে এক্সপ্লয়েট করছে। আর কে কে ওর সত্যি কারের বন্ধু। কিছু ছেলে মেয়ে কোনদিকেই ছিল না। একমাত্র কস্তূরীকে দেখে ওর মনে হয় শুধুই বন্ধু। একদিন সেই কস্তূরীর সাথে ওর কথা হচ্ছিল।
কস্তূরী – তুই একটুও বদলালি না
মানসী – কিসে বদলাতে বলছিস
কস্তূরী – এই যে যাদের তুই বন্ধু ভাবতিস, ওরা তোকে কি ভাবে সেটা জানার পরেও তুই ওদের সাহায্য করিস
মানসী – ওরা আমাকে বন্ধুর মত দেখে না, কিন্তু আমিতো ওদের আমার বন্ধুই ভাবি
কস্তূরী – সে আবার হয় নাকি ! বন্ধুত্ব কখনো একতরফা হয় না
মানসী – সে ঠিক। ওরা আমাকে কি ভাবে তাতে আমার কি আসে যায়। আমি আমার মতই ভাববো।
কস্তূরী – অদ্ভুত মেয়ে তুই !
মানসী – কার যেন লেখায় একটা কথা পড়েছিলাম, মনে হয় বিবেকানন্দ বলেছিলেন।
কস্তূরী – কি ?
মানসী – সে উত্তম না বলে তুমি উত্তম কেন হইবে না।
আরেকদিন ওদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
কস্তূরী – তুই এত কালো বলে তোর খুব দুঃখ না ?
মানসী – আমি কালো বলে আমার কোন দুঃখ নেই
কস্তূরী – এই যে সবাই তোকে কালো বলে নাক সিটকায়, তোর খারাপ লাগে না ?
মানসী – আমি কালো বলে আমার খারাপ লাগে না। বা আমি কালো বলে আমার কোন দুঃখ নেই।
কস্তূরী – তোর একটুও দুঃখ নেই !
মানসী – আমার দুঃখ আমার বন্ধুদের জন্য। ওরা এখনও মানুষ চিনতে পারে না। ওরা জানে না কার কাছ থেকে কি আশা করতে হয়।
কস্তূরী – আর সবাই এখনও তুচ্ছ গায়ের রঙকে বেশী মর্যাদা দেয় !
Tumi_je_amar-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here
মূল ইনডেক্স-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
কাজল নদী
Written By Tumi_je_amar
Written By Tumi_je_amar
শুরু করার আগে
কাজল নদীর জলে,
ভরা ঢেউ ছল ছলে,
প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া।
সোনার বরণী মেয়ে,
বলো কার পথ চেয়ে,
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।।
আমাদের এই কাহিনী একটা মেয়েকে নিয়ে। ওর চোখ সব সময় জলে ভর্তি থাকে। বাইরে থেকে সেই জল হয়ত সবসময় দেখা যায় না, কিন্তু মনের অতলে সেই চোখ সব সময় জলেই ভর্তি থাকে। অপরের গানের কথা অনুসারে সে সোনার বরণী মেয়ে নয়। ওর গায়ের রঙ আকদম কষ্টি পাথরের মত কালো। ও কারো কথা স্মরন করে কোন নদী বা খালের জলে প্রদীপ ভাসায় না। ও জীবনে কেউ আসেই নি যে তাকে স্মরন করবে বা প্রদীপ ভাসাবে। সে প্রদীপ ভাসায় মনের নদী তে, কল্পনার প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোয় খুঁজে বেড়ায় জীবনের মানে।
এই মেয়েটিকে আমি ভীষণ কাছের থেকে চিনি। আমি ওর মনের সুখ দুঃখ সবই জানি। আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওর জীবনে প্রদীপ জ্বালাতে। আমি নিজে জ্বালাতে পারিনি কারন ওর সাথে আমার পরিচয় হয় আমার বিয়ের পরে। এই কাহিনী সেই মেয়েটিকে নিয়ে। এই কাহিনির সব চরিত্র হয়ত সত্যি নয়, তথাপি সব ঘটনা গুলো সত্যি। এই কাহিনী দিয়ে আমি বোঝাতে চাই আমাদের কলকাতার বাঙালি সমাজের এক অংশ আজও সেই আশাপূর্ণা দেবীর “সুবর্ণলতা”-এর যুগেই পড়ে আছে। এই কাহিনীতে সেক্স হয়তো সেই ভাবে আসবে না।
প্রথম পরিচ্ছদ - উদাসী হাওয়া
(#০১)
মানসী উদাস হয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিল। ওর মনে পড়ছিল সেদিন কলেজে ওর সাথে বাকি ছেলে মেয়েরা, যাদের ও বন্ধু বলে জানতো তারা কিভাবে ওর সাথে কথা বলছিল।
মানসী চার বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে ছোটো। ছোটো ছেলে বা মেয়েরা সাধারণত সব থেকে আদরের হয়। কিন্তু যে বাড়ীতে আটটা ছেলে মেয়ে সেখানে মনে হয় সেরকম হয় না। তাই মানসী শুধু আরেকটা মেয়ে ছিল। ওর মায়ের বিয়ের হয়েছিল অনেক ছোটো বয়সে। তারপর ২৫ বছর ধরে উনি ওনার স্বামীকে ছেলে মেয়ে উপহার দিয়ে গিয়েছেন। ওর বাবা বাংলাদেশ থেকে এসে শিয়ালদহ অঞ্চলে ৩০ টাকা দিয়ে দুটো ঘর ভাড়া করে থাকতেন, প্রেস আর কাগজের ব্যবসা করতেন। ওনার জীবনে একটাই লক্ষ ছিল কিভাবে পয়সা উপার্জন করা যায়। উনি বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এক বিশাল বড়লোকের মেয়ে সুলগ্নার সাথে। সেই বিয়েতে বেলঘরিয়াতে ১০ কাঠা জায়গা সহ বেশ বড় একটা বাড়ি পেয়েছেন। তাই ওনারা সপরিবারে শিয়ালদা ছেড়ে ওই বেলঘড়িয়ার বাড়িতেই থাকেন। মানসী তখন এইটে পড়ত। স্কুলে পড়তে পড়তেই ওর আরও দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায়। প্রত্যেকের একটা বা দুটো করে বাচ্চাও হয়ে গিয়েছিল।
এখন মানসী প্রথম বর্ষ বাংলা অনার্সের ছাত্রী। ওর খুব ইচ্ছা ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়বে কিন্তু ওর বড়দা রাজী হননি। কারন সায়েন্স পড়ানোর খরচ অনেক বেশী। সুলগ্না বৌদি অনেক বোঝানর চেষ্টা করেছিল কিন্তু বড়দা মেনে নেন নি। দুবছর আগে মানসী মাধ্যমিক ৮২% নম্বর নিয়ে পাস করলে বড়দা আর সুলগ্না বৌদির মধ্যে কথা হয়েছিল।
- তুমি কি চাও না তোমার বোন কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ?
- তুমি কি ভেবেছ সায়েন্স পড়ালেই দাঁড়িয়ে যাবে ?
- তাও সায়েন্স পরলে সুযোগ অনেক বেশী।
- কিন্তু সায়েন্স পড়ালে মাসের খরচ একটু বেশী, টিউশনি দিতে হবে, আবার উচ্চ মাধমিক পাস করলে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইবে। অত খরচ করতে পারব না আমি।
- তোমাকে খরচ করতে হবে না। তোমার বোন আমারও বোন। আমার টাকা থেকে খরচ করে অকে পড়াবো ও যা পড়তে চায়।
- দেখো তোমার বাবা তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, তাই তোমার সব দায়িত্ব আমার। সেখানে তোমার টাকা আর আমার টাকার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
- তার মানে কি আমি আমার ইচ্ছা মত কিছুই করতে পারব না ?
- তোমার ইচ্ছাতেই তো সব হয়। শুধু আমার সন্মতি দরকার হয়। এই সবই তো তোমার।
এরপরে সুলগ্না বৌদি আর কিছু বলেনি। সুলগ্না বৌদি বড়লোকের মেয়ে হলেও ওনার মধ্যে কোন অহঙ্কার ছিল না। উনি সবাইকে সাথে নিয়ে চলতেন। ছোট বড় ভেদাভেদ করতেন না। অন্যদিকে বড়দা বাইরে থেকে দেখাতেন উনি সবার সাথে আছেন কিন্তু এটাও বুঝিয়ে দিতেন যে উনি সব থেকে বড়। ওনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে উনি সেটা মেনে নেবেন না। উনি সবাইকে এটাও বুঝিয়ে দিতেন যে ওনার অনেক পয়সা (আসলে ওনার বৌয়ের পয়সা)।
মানসীর বাবা শুধুই ব্যবসা দেখতেন আর চিন্তা করতেন কিভাবে আরও পয়সা বানান যায়। তাই বড়দা যা যা করতেন উনি তাকে সমর্থন করতেন। দুজনের উদ্দেশ্য একই ছিল। মানসীর মা ছিলেন একদম শরত চন্দ্রের উপন্যাসের গ্রামের মায়ের মতন। শুধু উনি শহরে থাকতেন। রান্না করা, সবাইকে খাওয়ানো আর সবার স্বাস্থের কথা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতেন না। মানসীর দুই অবিবাহিত দাদা উচ্চ মাধমিক কোনোরকমে পাশ করার পর ওর বাবার ব্যবসা দেখত। মানসীর অবিবাহিতা দিদিও প্রায় সেইরকম। পড়াশুনাও করেনি, কোন কাজও করে না। নামে মাত্র গান শেখে।
যাই হোক এতক্ষন মানসীর বাড়ির সবার পরিচয় দেওয়া হল। এবার আমাদের গল্পে ফেরা যাক। সেদিন যখন কলেজে গিয়েছিল মানসী তখন সেই দিন তা অন্য সব দিনের মতই সাধারন একটা দিন ছিল। কিন্তু এখন আর মানসীর তা মনে হচ্ছে না।
(#০২)
মানসী বুদ্ধিমতী মেয়ে। পড়াশুনাতেও ভাল। ঘরের সব কাজই করতে পারে। রান্নাও ভালই করে। সমাজের হিসাবে ওর একটা জায়গাতেই সমস্যা আছে। ওর গায়ের রঙ খুব কালো। বাড়ীতে মায়ের আদরের মেয়ে আর সুলগ্না বৌদির ভালবাসার ননদ হলেও কলেজে কোন বন্ধু নেই। মানসী এতদিন ক্লাসের অনেককেই বন্ধু ভাবত। আজ ওর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু ও পড়াশুনায় ভাল ছিল প্রায় সব শিক্ষক বা শিক্ষিকারাই ওকে ভাল চোখে দেখতেন। যদিও কেউ ওকে কোন বেশী সুবিধা দিতেন না বা প্রশ্রয় দিতেন না। কিন্তু কেউই ওকে তিরস্কার করার সুযোগ পেতেন না।
ক্লাসের প্রায় পনেরো জন ছেলে মেয়ে, যাদের মানসী এতদিন বন্ধু বলে জানত, সবসময় ওর সাথেই ঘুরত। সাথে না বলে বলা যায় ওর পেছন পেছন ঘুরত। মানসী যা বলে সব কথা শুনত। একসাথে আড্ডা দিত। ওর সব থেকে কাছের ছিল কস্তূরী, শিলা, অমিত আর অসীম। সেদিন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস নিয়ে আলচনা হচ্ছিল। গোবিন্দদাসের দুটো কবিতা নিয়ে সেদিন অনেক কথা হয়।
১।
মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল।
বার কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণে মরম মরি জাত।।
দশ দিশ দামিনী দহই বিথার।
হেরইতে উচকই লোচনভার।।
ইথে যদি সুন্দরি তেজবি গেহ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।
গোবিন্দদাস কহ ইথে কি বিচার।
ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার।।
২।
সই , কেমনে ধরিব হিয়া ?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া ,
এমতি করিল কে ?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!
যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয় ,
ওই ক্লাসের পড়ের ক্লাস অফ ছিল। দুপুর বেলা বাইরে ভীষণ রোদ, তাই ছেলে মেয়েরা ওই ক্লাসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল।
(#০৩)
ওই ক্লাসের পড়ের ক্লাস অফ ছিল। দুপুর বেলা বাইরে ভীষণ রোদ, তাই ছেলে মেয়েরা ওই ক্লাসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল।
কস্তূরী – রাধা আর কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে কেন যে এত সাহিত্য বুঝিনা
অমিত – কৃষ্ণ সেইরকম কিছু বলত না, রাধাই ওর ওপর ফিদা হয়ে গিয়েছিলো
শিলা – রাধা কি করে যে ওই কুচকুচে কালো রঙের একটা ছেলেকে পছন্দ করলো কে জানে
অসীম – ছেলেদের কালো ফর্সা হয় না। তোর রাধা যদি কালো হত আর কৃষ্ণ ফর্সা হত তবে ওদের প্রেমও হত না আর এত সাহিত্যও হত না।
মানসী – একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা ভালবাসা গায়ের রঙ দেখে হয় না
কস্তূরী – কিন্তু আমি বুঝলাম না গোবিন্দদাস শেষ লাইনটা কেন বলেছে
শিলা – কোন লাইনটা ?
কস্তূরী - ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার
মানসী – দেখ ধনুকের থেকে বাণ ছেড়ে দিলে যেমন ফিরে আসে না। টিউবের থেকে টুথপেস্ট বের করার পরে যেমন ফেরত দেওয়া যায় না। সেইরকম রাধা রানীর মন কৃষ্ণের সাথে আটকে গেছে। সেটা আর ছাড়ানো যাবে না। প্রেম একবার হয়ে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
অমিত – বেশ সুন্দর উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দিলি মাইরি
শিলা – পরের কবিতায় যা লিখেছে সেই রকম হলে আমারও দুঃখ হয়
অসীম – কি রকম ?
শিলা - সই , কেমনে ধরিব হিয়া ? আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমার আঙ্গিনা দিয়া!
কস্তূরী – তোর সাথে কে করে ওইরকম ?
শিলা – কেন এই অসীম হতচ্ছাড়াটা
কস্তূরী – অসীম তো তোকে ভালবাসে ?
শিলা – বাল ভালবাসে, শুধু আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওই পেত্মিটার পেছন পেছন ঘোরে
অমিত – পেত্নি আবার কে ?
শিলা – কেন এই মানসী, কালো পেত্নি
অমিত – ছিঃ তুই এই ভাবিস ! ও আমাদের বন্ধু না ?
শিলা – বন্ধু ! নেহাত মানসী পড়াশুনায় একটু ভাল তা না হলে ওর সাথে আমি জীবনে কথাই বলতাম না।
কস্তূরী – আমিও তো কালো
শিলা – তুই মোটেই ওর মত কালো নয়
অসীম – এই আলোচনা এখন না করলেই নয় ?
শিলা – আমি তোর আর অমিতের মত পেছনে বলি না। যা ভাবি সেটা সামনা সামনিই বলি
কস্তূরী – তাও চুপ কর প্লীজ
মানসী – না না ওকে বলতে দে, ওরা কি ভাবে সেটা জানা দরকার।
শিলা – ওই অসীম তোকে এত পাত্তা দেয় সেটা শুধু তোর কাছ থেকে তোর সুলগ্না বৌদির বানানো নোটস গুলো নেবে বলে।
অসীম – মোটেই না। আমি আর অমিত মানসীকে বন্ধু হিসাবেই দেখি।
শিলা – ওই অমিতের কথা আর বলিস না
অমিত – আমি আবার কি করলাম ?
শিলা – তুই অসীমকে কি বলেছিস আমি জানি
মানসী – কি বলেছে
কস্তূরী – কিচ্ছু বলেনি। ছেড়ে দে ওইসব ফালতু কথা।
মানসী – ছাড়তে হবে না, আমিও শুনি আর জানি আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে কি ভাবে
শিলা – অমিতের ধান্দা তোর কাছ থেকে নোটস নেওয়া। আর তোকে বন্ধুত্বের জালে ফাঁসিয়ে তোর শরীরটাকে ভোগ করা।
কস্তূরী – ছিঃ
অমিত – মোটেও না
শিলা – একদম মিথ্যা কথা বলবি না। তুই বলিসনি অসীমের কাছে “মানসীর বুক দুটো দেখেছিস? একদম ডাঁসা পেয়ারা, কিন্তু ফজলি আমের সাইজের। পরীক্ষা হয়ে গেলে একদিন ওকে পটিয়ে মস্তি করবো। তারপর ওই কালো ভুতকে আর চেনারও দরকার হবে না”। কেউ বন্ধুদের শরীর দেখে !
কস্তূরী – ছিঃ অমিত ছিঃ, তোকে আমার বন্ধু বলে ভাবতেও গা শিরশির করছে
অমিত – দেখ সেদিন অসিমের সাথে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম। মানসী বিশ্বাস কর আমি আসলে এইরকম ভাবি না।
মানসী - ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার
(#০৪)
মানসী আর বসে থাকেনি। কাঁদেও নি। একবার কান্না এসেছিলো কিন্তু নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। যাদের ও বন্ধু ভাবতো তারাও যে এত নিচু মনের সেটা ও বুঝতে পারেনি। ও মনে মনে শিলাকে ধন্যবাদ দেয় সবার মুখোস খুলে দেবার জন্য। শিলা হয়তো সুন্দরি বলে অহংকারী। কিন্তু সত্যি কথা বলার সাহস রাখে। অসীম বা অমিতের মত গিরগিটি নয়। ওই ঘটনার পরে মানসী যখন চলে আসছিল, কস্তূরীও ওর সাথে চলে এসেছিলো। কস্তূরী ওকে কিছু বোঝাতে চাইছিল, কিন্তু তখন মানসীর শোনার মত মানসিকতা ছিল না। কস্তূরী নিজে সুন্দরী নয় বা ওর ফিগারও ছেলেদের চোখে আকর্ষণীয় নয় তাই কস্তূরী মানসীর দুঃখ বোঝে। ও সেদিন কস্তূরীকে পরে কথা বলবে বলে একাই বাড়ি ফিরে আসে। এই সন্ধ্যে বেলায় আকাশে চাঁদ কে একা দেখে ও এইসব কথাই ভাবছিল।
ও ভাবছিল চাঁদ তো কত সুন্দর কিন্তু তবুও এত বড় আকাশে একা। যখন একাদশীতে চাদের আল কম থাকে তখন চাঁদের চারপাশে সব তারারা ভিড় করে থাকে। পূর্ণিমাতে চাঁদের রূপ সম্পূর্ণ বিকশিত হলে কোন তারাই ঈর্ষায় চাঁদের কাছে আসে না। কিন্তু মানসীর ওই চাঁদের মত রূপ নেই। তাই একাদশী বা পূর্ণিমা কখনোই ওর চারপাশে কেউ থাকে না। ওকে সবাই কয়লার মত বাইরে ফেলে রাখে। আগুন জ্বালানোর জন্য ঘোরে নিয়ে আসে। আগুন শেষ হয়ে গেলে ছাই করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
একসময় ভাবছিল কি হবে এই জীবন রেখে কিন্তু ওর মা আর সুলগ্না বৌদির কথা মনে আসে। ভাবে কখনো হয়তো সুলগ্না বৌদির মত মানসিকতার কোন একটা ছেলে ওকে দেখবে আর পছন্দ করবে। মানসী নিজেও নিজের জীবনকে খুব ভালবাসে। আর ও কাপুরুষ নয় যে জীবন থেকে পালিয়ে যাবে। ও ভেবে নেয় ও এই লড়াই চালিয়ে যাবে। ও বোঝে যে ও প্রায় একাই ওর দলে কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে যে ও কখনো পিছু হটবে না। ওর “Gone with the wind” সিনেমার স্কারলেটের কথা মনে পড়ে। যেখানে স্কারলেট বলেছিল, “আমি আর ক্ষিদেতে কাঁদবো না”। মানসীও চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করে “আমিও আর কালো বলে ভেঙ্গে পড়বো না”।
একসময় আকাশের ভাঙ্গা চাঁদ মেঘে ঢেকে যায়। মানসী তাও ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবতে থাকে কি ভাবে মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসবে।
সুলগ্না বৌদি মানসীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ছাদে চলে আসে। বৌদি জানত যে মানসীর মন খারাপ হলে ও ছাদে এসেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুলগ্না – আমার রাঙা দিদির কি হয়েছে আজকে ?
মানসীকে ওর বাড়ীতে সবাই রাঙা পিসি, রাঙা মাসি বা রাঙা দিদি বলে ডাকে। তাই ওর বৌদিও ওকে রাঙা দিদি বলে।
মানসী – কিছু হয়নি গো, এমনি চাঁদ দেখছিলাম।
সুলগ্না – আমি জানি আমার এই দিদি কোনদিন চাঁদ দেখতে আসে। কে কি বলেছে তোমাকে ?
মানসী ওর বৌদির কাছে কিছু লুকায়না। সেদিন কলেজের বন্ধুদের সাথে যা যা হয়েছিল সব কথা বলে দেয়।
সুলগ্না – এতেই এত মন খারাপ হয়ে গেল ? কটা ছেলে মেয়ে তোমাকে কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলেছে। ওই কথাগুলোই ওদের নীচতার পরিচয় দিয়েছে। তুমি তাতে মন খারাপ কেন করবে ?
মানসী – আমি ওদের কথার জন্য মন খারাপ করছি না
সুলগ্না – তবে মন খারাপ কিসে হল !
মানসী – আমার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। আমি কিভাবে ওদের আমার বন্ধু ভেবেছিলাম। কেন আমি মানুস চিনতে পারিনি !
সুলগ্না – তাতেই বা কি হয়েছে ! তুমি এখনও শিখছ। এইসময় দু একটা ভুল হতে পারে। সেই ভুলের জন্য মন খারাপ না করে সেখার চেষ্টা কর।
মানসী – সেটাই ভাবছিলাম
সুলগ্না – চল এবার খেয়ে নেবে।
(#০৫)
মানসী পরদিন কলেজ যায়। তারপর দিনও যায়। রোজই কলেজ যায়। ও নিজেকে একটুও বদলায় না। মানে নিজের মনে অনেক বদল আনে। তবু ওর তথাকথিত বন্ধুদের সাথে ওর ব্যবহার বদলায় না। ও এখন খোলা মনে বুঝতে চেষ্টা করে কে কে ওকে এক্সপ্লয়েট করছে। আর কে কে ওর সত্যি কারের বন্ধু। কিছু ছেলে মেয়ে কোনদিকেই ছিল না। একমাত্র কস্তূরীকে দেখে ওর মনে হয় শুধুই বন্ধু। একদিন সেই কস্তূরীর সাথে ওর কথা হচ্ছিল।
কস্তূরী – তুই একটুও বদলালি না
মানসী – কিসে বদলাতে বলছিস
কস্তূরী – এই যে যাদের তুই বন্ধু ভাবতিস, ওরা তোকে কি ভাবে সেটা জানার পরেও তুই ওদের সাহায্য করিস
মানসী – ওরা আমাকে বন্ধুর মত দেখে না, কিন্তু আমিতো ওদের আমার বন্ধুই ভাবি
কস্তূরী – সে আবার হয় নাকি ! বন্ধুত্ব কখনো একতরফা হয় না
মানসী – সে ঠিক। ওরা আমাকে কি ভাবে তাতে আমার কি আসে যায়। আমি আমার মতই ভাববো।
কস্তূরী – অদ্ভুত মেয়ে তুই !
মানসী – কার যেন লেখায় একটা কথা পড়েছিলাম, মনে হয় বিবেকানন্দ বলেছিলেন।
কস্তূরী – কি ?
মানসী – সে উত্তম না বলে তুমি উত্তম কেন হইবে না।
আরেকদিন ওদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
কস্তূরী – তুই এত কালো বলে তোর খুব দুঃখ না ?
মানসী – আমি কালো বলে আমার কোন দুঃখ নেই
কস্তূরী – এই যে সবাই তোকে কালো বলে নাক সিটকায়, তোর খারাপ লাগে না ?
মানসী – আমি কালো বলে আমার খারাপ লাগে না। বা আমি কালো বলে আমার কোন দুঃখ নেই।
কস্তূরী – তোর একটুও দুঃখ নেই !
মানসী – আমার দুঃখ আমার বন্ধুদের জন্য। ওরা এখনও মানুষ চিনতে পারে না। ওরা জানে না কার কাছ থেকে কি আশা করতে হয়।
কস্তূরী – আর সবাই এখনও তুচ্ছ গায়ের রঙকে বেশী মর্যাদা দেয় !
প্রথম পরিচ্ছদ সমাপ্ত
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
Tumi_je_amar-এর লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereTumi_je_amar-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইনডেক্স-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:
Post a Comment