আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
নিয়তির স্রোতস্বিনী
Written By SS_Sexy
Written By SS_Sexy
(#৫০)
ডক্টর মুখার্জী আমার মাথায় হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন, "কেউ তোমাকে ছেড়ে যাবে না আজ রুমু। বিজলীমাসি, শ্যামলীদি, অনুরাধা এরা সবাই আছে। আমি তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুয়ে শুয়ে তাদের সাথে কথা বল। আধঘণ্টা বাদে আমি তোমাকে আরো একটা ওষুধ দেব। সেটা খাবার দশ মিনিট পর তুমি বিছানা থেকে উঠতে পারবে। এখন এভাবেই শুয়ে থাক। আর ডাক্তার ছুটি না দিলে পেশেন্ট তার বাড়ি যেতে পারে না। এটা জান না?"
আমি তার কথা শুনে নিরুত্তর রইলাম। ডাক্তার বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা ঘরে এসে ঢুকল। শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমার একপাশে আর মাসি অন্যপাশে বসল। মাসি আমার মাথায় তার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এখন কেমন লাগছে রে মিনু তোর? একটু ভাল লাগছে?"
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, "হ্যাঁ মাসি। এখন অনেকটা ভাল লাগছে। কিন্তু কত রাত হল বল তো? আমরা বাড়ি কখন যাব?"
বিজলীমাসি একটু হেসে বলল, "তোকে এ’সব নিয়ে ভাবতে হবে না এখন। ডাক্তারবাবু আমাদের সকলকে রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দেবেন না। আর আমরা সবাই তো আছি। ভাবিস না। কিন্তু তোকে না তখন বললাম যে আমাকে আর মাসি বলে ডাকবি না। দিদি বলে ডাকবি।"
আমি বিজলীমাসির একটা হাত ধরে বললাম, "তুমি সত্যি আমার বাবাকে চিনতে মাসি?"
বিজলীমাসি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, "আবার মাসি? বলছি না এখন থেকে দিদি বলে ডাকবি। আর তোর বাবাকে চেনার কথা বলছিস? ওই ভগবানের মত লোকটা যে কতদিন আমাকে তার কোলে বসিয়ে আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছেন রে। অত ছোট বয়সের কথা আমার আর বেশী কিছু মনে নেই। দু’একটা কথা একটু একটু মনে আছে। আমি যে নীলু জেঠুর কোলে বসে খেতাম, সে’কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার"
বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "জেঠু জেঠীমার মুখটা আবছা আবছা মনে ছিল শুধু। ক’দিন আগে ডাক্তার বাবুদের এ বাড়িতে এসে তাদের ছবি দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তুই যে সেই নীলু জেঠুর মেয়ে, সেটা জানবার পর থেকে আমি রোজ রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদি। যে লোকটা আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছে, তার মেয়েকে দিয়েই আমি আর মা দশটা বছর ধরে ব্যবসা করেছি। আমার যে নরকেও ঠাঁই হবেনা রে"
বলতে বলতে শাড়ির খুঁট দিয়ে নিজের চোখ মুছতে লাগল।
বিজলীমাসিকে কাঁদতে দেখে আমার চোখেও জল চলে এসেছিল। কিন্তু অদম্য কৌতূহলের বশে আমি তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, "কিন্তু আমার মা বাবার সাথে তোমার দেখা কবে কোথায় হয়েছিল।"
বিজলীমাসিও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "সে তো প্রায় চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। তখন তো তোর জন্মও হয়নি। আমি তখন একটা কোলের শিশু। তখন নীলু জেঠু আর জেঠিমার কোন সন্তান হয় নি। আমি আর মা তো তোদের বাড়িতেই থাকতাম। আমার জন্মের পর পরই আমার বাবা আমাদের মা মেয়েকে একা ফেলে কোথাও চলে গিয়েছিল। আমার বাবা নীলু জেঠুর অফিসেই কাজ করত। মা-র মুখে শুনেছিলাম, তখন আমাদের আশ্রয় বলতে কিছু ছিল না। নীলু জেঠুই নাকি মাকে আর আমাকে তোদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর পাঁচ বছর আমরা তোদের বাড়িতে ছিলাম। নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব ভালবাসতেন। যখন মা আমাকে নিয়ে ওখান থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল তখন নীলু জেঠুর ছেলের বয়স ছিল প্রায় তিন বছর। তোর বড়দা আদির জন্মের পর থেকেই তো আমি সব সময় ওকে কোলে নিয়ে থাকতাম। আমার ঘরের ট্রাঙ্কের ভেতরে এখনও একটা সাদা কালো ছবি আছে। আমি তোর বড়দাকে কোলে নিয়ে সে ছবিটা উঠেছিলাম। ওখান থেকে চলে আসবার পর অনেক জায়গা ঘুরে শেষমেশ মা আমাদের ওই বাড়িটায় এসেছিল। বাসন্তী থেকে সে হয়ে গিয়েছিল ঝিমলি। আর আমি রেখা থেকে হয়ে উঠেছিলাম বিজলী। সে সব ইতিহাস এখন বলতে গেলে এক রাতেও বোধহয় শেষ হবে না। তবে সেই সময়কার একটা দিনের কথা এখনও আমার পরিস্কার মনে আছে। তোর বড়দা আদি একদিন বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ছুটে গিয়ে সে মেঝেতে পড়বার আগেই তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেদিন নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব আদর করেছিলেন। আমাকে নতুন একটা ফ্রক কিনে দিয়েছিলেন নীলু জেঠু।"
আমি বিজলীমাসির হাতটাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে বললাম, "সত্যি বলছ তুমি মাসি?"
বিজলীমাসি একটু ম্লান হেসে বলল, "গত দু’মাসের মধ্যে তোকে অনেকগুলো মিথ্যে কথা বলেছি রে মিনু। অনেক কথা তোর কাছে গোপন করে গেছি। শুধু আজকের এই দিনটার আশায়। আজ আর তোকে কোন মিথ্যে বলছি না রে। নীলু জেঠুর মত আর কাউকে আমি দেখিনি। আমি যে তাকে নিজের বাবার মতই ভালবাসতাম শ্রদ্ধা করতাম রে। আর উনিও আমাকে খুব ভালবাসতেন। আর গত দশটা বছর ধরে সেই নীলু জেঠুর মেয়েকে দিয়ে আমি বেশ্যাবৃত্তি করিয়েছি! এ’কথা যেদিন বুঝতে পেরেছি সে’দিন থেকেই যে মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি রে। যে লোকটাকে আমি ভগবানের মত শ্রদ্ধা করতাম তার আদরের মেয়েটাকে দিয়েই আমি এ’সব করিয়েছি, এ’কথা ভাবতেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বোন, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তো জানতাম না যে তুই আমার সেই জেঠুর মেয়ে। মা-ও যদি তোর আসল পরিচয় জানতে পারত, তাহলে সেও তোকে এ ব্যবসায় কিছুতেই নামাত না। আর ওই গজানন আরও দশ বছর আগেই এ দুনিয়া থেকে সরে যেত। কিন্তু প্রায় দু’মাস আগে যেদিন জানতে পারলাম যে তোদের পাশের বাড়ির রমেন কাকুর ছেলে তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোকে আমি তার হাতে তুলে দেব। রমেন কাকু আর সোনালী কাকিমার কথাও মনে আছে আমার। তাদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমাকে যা কিছু করতে হয় আমি সব করব। আজ সেই শুভদিনটা এসে গেছে। এখন আমি মরে গেলেও আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। তবে যে’কটা দিন বেঁচে থাকব রোজ নীলু জেঠু আর জেঠিমার কাছে প্রার্থনা করব, তারা যেন আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেন। আর পরকাল বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, আর সেখানে যদি তাদের সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে নীলু জেঠু আর জেঠিমার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব আমি।"
আমি বিজলীমাসির হাত ধরে বললাম, "তুমি সত্যি আমাদের ওই বাড়ীতে ছিলে? আমার বড়দাকে তুমি তোমার এই কোলে নিয়েছিলে?"
এমন সময় ঝুনুদি একটা গ্লাস হাতে করে ঘরে ঢুকে বলল, "হ্যাঁরে রুমু। রেখাদি একদম ঠিক কথা বলছে। আমি তো রেখাদি বা তার মাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু মা-র মুখে তাদের কথা শুনেছি। তোদের বাড়িতে বাসন্তীমাসি আর রেখাদি প্রায় বছর পাঁচেকের মত ছিল। আচ্ছা, এটা তুই আগে খেয়ে নে তো। তারপর বাকি কথা শুনিস" বলে গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি বিজলীমাসির কোল থেকে উঠবার চেষ্টা করতেই বিজলীমাসি আর শ্যামলীদি আমাকে ধরে টেনে ওঠালো। ঝুনুদিকে জিজ্ঞেস করলাম, "এখন আবার কী এনেছ এ’সব তুমি ঝুনুদি?"
ঝুনুদি আমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, "হরলিক্সের সাথে কিছু একটা ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছেন তোর ডাক্তারবাবু। আর কথা না বলে আগে এটা খেয়ে নে তো।"
আমি কোন কথা না বলে গ্লাসে চুমুক দিতেই ঝুনুদিদের কাজের মেয়ে শেফালী ঘরে ঢুকে বলল, "ও দিদি, লিপি বৌদি জানতে চাইল মুড়িঘণ্টটা কি আজই বানাবে তুমি?"
ঝুনুদি জবাব দিল, "নারে। আজ আর আমি কিচেনে যেতে পারব না। তুই লিপিকে বল, মাছের মুড়োটা যেন ভেঁজে রেখে দেয়। মুড়িঘণ্ট কাল দিনের বেলায় বানাবো।"
শেফালী পেছন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই ঝুনুদি আবার বলল, "একটু দাঁড়া শেফালী। ওর খাওয়া হলে গ্লাসটা নিয়ে যা। আর শোন, দাদার ঘর থেকে আদিকে এনে এখানে দিয়ে যাস তো। ও ওর মামির কাছে আসবার জন্য খুব কান্নাকাটি করছে। একটু এসে দেখে যাক। আর লিপিকে বলিস আজ রুমুকে কী খেতে দিতে হবে তা যেন তোর জামাইবাবুর কাছ থেকে জেনে নেয়। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসব।"
আমি খালি গ্লাসটা শেফালীর হাতে ফিরিয়ে দিতেই শেফালী চলে গেল। ঝুনুদি আমার কাঁধে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোর এখন কেমন লাগছে রে রুমু? ভাল লাগছে তো? না অন্য কিছু কোন অসুবিধে হচ্ছে?"
আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চেয়ে শান্ত ভাবে বললাম, "এখন ঠিকই আছি। কিন্তু ঝুনুদি ওই ছবিটা তোমরা কোত্থেকে পেলে গো? আমার মনে পড়ছে যেদিন আমাদের ওই সর্বনাশটা হয়েছিল তার আগের দিনই বড়দার কেনা নতুন ক্যামেরায় এ ছবিটা তোলা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটা তো তখনও প্রিন্ট করা হয়নি।"
ঝুনুদি আমার একটা হাত ধরে বলল, "তোর বড়দা আদিদা ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল মডার্ন স্টুডিওতে। তোর মনে আছে মডার্ন স্টুডিওর কথা? আমাদের স্কুলে যাবার রাস্তাতেই তো ছিল।"
আমার সে স্টুডিওর কথা মনে পড়তে বললাম, "হ্যাঁ মনে আছে। ঘোষপাড়ার মোড়ের মাথাতেই তো ছিল, তাই না?"
ঝুনুদি বলল, "হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। ওই ঘটনার মাস খানেক বাদে বাবা যেন কিভাবে জানতে পেরেছিলেন ছবিটার কথা। আদিদাই ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল সেখানে। বাবাই সে স্টুডিও থেকে ছবিটা এনেছিলেন। ছবিটা তখনই এভাবে বাঁধিয়ে আমাদের খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার বিয়ের ঠিক পর পরই মা বাবা চলে যাবার পর ভাইও সিভিল সার্ভিস পাশ করে চাকরীতে জয়েন করতে বাড়িটা তখন থেকেই খালি পড়ে ছিল। ভাই বাইরে চলে যাওয়াতে সে বাড়িতে থাকবার মত আর কেউ ছিল না। আমি ভাইকে বলেছিলাম বাড়িটা বেচে দিতে। কিন্তু ও তা করেনি। ভাড়া দিয়েছিল। বছর সাতেক পর ভাই যখন এখানে কোলকাতায় পোস্টিং পেল তখন আমার কথাতেই সে বাড়িটা বেচে দিয়ে এখানে এই বাড়িটা বানিয়েছে। আমরা তো তার বছর চারেক আগে থাকতেই দমদমের ওদিকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। এ বাড়ি কমপ্লিট হবার পর ভাই আমাদের সবাইকে এখানেই নিয়ে এসেছে। আর পুরোনো বাড়ির অনেক জিনিসের সাথে এ ছবিটাও নিয়ে এসেছে। তখন থেকেই এটা ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।"
ঝুনুদির গলাটা কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছিল। একটু থেমে সে আবার বলল, "তবে শুধু এ ছবিটাই নয়। তোদের বাড়ি থেকে ভাই একটা অ্যালবাম চেয়ে নিয়েছিল তোর মামাদের কাছ থেকে। আর এ বাড়িতে আসবার পর সে অ্যালবাম থেকে কয়েকটা ছবি স্টুডিওতে দিয়ে নতুন করে প্রিন্ট করে এনেছে। সে’সব ওপরে ভাইয়ের বেডরুমে আর ওপরের ড্রয়িং রুমে লাগানো হয়েছে। তোকে ফিরে পাবার আশা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ভাইকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারিনি কিছুতেই। মা বাবা জেঠু জেঠিমা আদিদা আর অভির ছবিগুলোতে ভাই রোজ মালা পড়িয়ে দেয় আর কাঁদে। এ বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে আমরা সবাইকে বলি যে ওগুলো টুপুর শ্বুশুর শাশুড়ি আর সম্বন্ধীদের ছবি। আর তোর ছবি দেখিয়ে বলি, এটা আমার ভাইবৌ"
বলতে বলতে ঝুনুদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঝুনুদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমিও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমাদের দু’জনের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সান্তনা দিতে লাগল।
এমন সময় শেফালী আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আদি শেফালীর কোল থেকে নেমে ছুটে এসে আমাকে আর ঝুনুদিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, "ও মামি, ও মা তোমরা কাঁদছ কেন গো?"
আমি ঝুনুদিকে ছেড়ে আদিকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, "আদি সোনা। সোনা বাবা আমার। আমরা যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না তাই তো কাঁদছিলাম। এবার তুমি এসে গেছ। আর কাঁদব না আমরা" বলে আদির দু’গালে একের পর এক চুমু খেতে লাগলাম।
আদি তার ছোট্ট ছোট্ট তুলতুলে হাতে আমার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, "আমি তো কখন থেকে তোমার কাছে আসতে চাইছিলাম। ওই বিড্ডু মামুটা খুব খারাপ। আমাকে শুধু শুধু আটকে রাখছিল। তাই তো আসতে পারিনি। বলে কি, তুমি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ।"
ঝুনুদিও নিজের চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে আদিকে জিজ্ঞেস করল, "তোর মামু কী করছে রে আদি?"
আদি আমার কোলে বসে বলল, "এতক্ষণ তো শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল মামু। তবে এখন শুধু শুয়ে আছে। কিন্তু মা আমি কিন্তু মামির সাথে শোব আজ। তুমি না করবে না কিন্তু।"
ঝুনুদি মুখে হাসি টেনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। কিন্তু মামির তো শরীরটা ভাল নেই। তুমি তাকে একটু রেস্ট নিতে দাও। তুমি এখন বাপীর কাছে যাও। নইলে মামির সাথে শুতে পারবে না কিন্তু।"
আদি প্রায় সাথে সাথে আমার কোল থেকে নেমে বলল, "ঠিক আছে। আমি তোমার কথা শুনছি। তুমিও কিন্তু আমাকে মামির সাথে শুতে দেবে।"
ঝুনুদি তার কথায় সায় দিতেই আমি আদির হাত ধরে বললাম, "ও ঝুনুদি, আমি যে তখন ওকে চকলেটটা খাওয়াচ্ছিলাম সেটার কি হল গো?"
ঝুনুদি কিছু বলার আগেই আদি বলে উঠল, "ওটা তো আমি খেয়ে ফেলেছি মামি। কিন্তু জানো মামি, মামুও আমার চকলেটটা থেকে একটা টুকরো খেয়েছে।"
আমি হেসে আদির মাথার চুল নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "খুব ভাল করেছ সোনা।"
ঝুনুদি বলল, "ঠিক আছে। মামি দিয়েছে বলেই আজ তোমাকে চকলেট খেতে দিয়েছি। কিন্তু মামির কাছে কিন্তু আর চকলেট খাবার বায়না ধরবে না। তাহলে মামি কিন্তু আবার হারিয়ে যাবে।"
আদি আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, "না, আমি মামিকে আর হারিয়ে যেতে দেব না। চকলেট চাই না আমি।"
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আদিকে বুকে চেপে ধরে আবার কেঁদে ফেললাম। ঝুনুদি আমার কাছ থেকে আদিকে টেনে নিতে নিতে বলল, "শেফালী ওকে নিয়ে যা ওর বাবার কাছে।"
শেফালী আদির হাত ধরে ওকে টানতে আদি যেতে যেতে বলল, "আমি আর চকলেট চাইব না মামি। তুমি কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাবে না।"
আমি আদির কথা শুনে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এবার অনুরাধা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কেঁদো না রুমুদি। এতগুলো বছর ধরে অনেক যন্ত্রণা তুমি সহ্য করেছ। আজ ভগবান যখন তোমাকে এমন একটা সুযোগ দিচ্ছেন, সেটাকে তুমি আর অবহেলা কোর না। টুপু যে তোমাকে কত ভালবাসে, তা তুমি না জানলেও আমি তো অনেক বছর আগে থেকেই তা জানি গো। টুপুর সাথে তুমি খুব সুখে থাকবে।"
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, "না রে অনু। সেটা হয় না রে। তুই তো জানিস আমি কতটা নোংরা। আমাদের সারা শরীরে যে নর্দমার পাঁক লেগে আছে রে। টুপুর মত পবিত্র নিষ্পাপ একটা ছেলের জীবন আমি জেনে বুঝে কি করে নষ্ট করি বল তো?"
এমন সময় ডক্টর মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম, "এ পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ম্যাডাম, যাতে একজন আরেকজনের জীবন নষ্ট করে দেয়। তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছিল ওই গজানন নামের বদমাশটা। সে বদমাশটা তার কৃতকর্মের একেবারে উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ রুমু। যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে কেউ কারো জীবন নষ্ট করে না। বরং সব রকম বিপদে আপদে একে অন্যের পাশে থেকে সাহায্য করে। একে অন্যের জন্য নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিতে পারে। আর টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসে সেটা তোমাকে আমি ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। বয়সে আমি ওর থেকে প্রায় ছ’বছরের বড়। কিন্তু তোমার প্রতি ওর মনের মধ্যে যত ভালবাসা আমি দেখেছি, তাতে আমি ওকে মনে মনে প্রণাম করি। নিজের চোখে না দেখলে এমন ভালবাসার কথা শুনে আমি সেটাকে শুধু একটা গল্প বলেই ভাবতাম। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি, তাকে তো আর গল্প বলা যায় না।"
ডক্টর মুখার্জী যে কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন সেটা বুঝতেই পারিনি। শ্যামলীদি ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার এনে আমাদের বিছানার সামনে রেখে বলল, "আপনি এখানে বসুন ডাক্তারবাবু।"
ডক্টর মুখার্জী চেয়ারে বসতে আমি তাকে কিছু একটা বলতে যেতেই অনুরাধা পেছন থেকে বলল, "হ্যাঁ রুমুদি। আমিও ঠিক সে’কথাই বলছি। তবে আমি তো টুপুকে অতটা কাছে থেকে দেখিনি যেমনটা উনি দেখেছেন। তবে টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসত তার আন্দাজ আমিও করতে পেরেছিলাম অনেক আগেই। তোমাকে তো কিছুটা আগেই বলেছি। কিন্তু কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে আমি গোপন করে গিয়েছিলাম রুমুদি। অবশ্য শুধু আমিই নই, শ্যামলীদি আর মাসিও কয়েকটা কথা তোমার কাছে গোপন রেখেছিল। আমার মনে হয় আজ সে কথাগুলো তোমাকে জানানো উচিৎ। শোনো রুমুদি, বিজলী মাসির বাড়িতে আমার আসা আর তোমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা কিন্তু একেবারেই কাকতালীয় নয়। তোমার কাছাকাছি যাবার জন্যেই আমি এখানে এসেছি। তবে প্রথম থেকে গুছিয়ে না বললে তুমি সেটা বুঝতে গিয়েও গুলিয়ে ফেলবে। তাই তোমার সাথে আমার দেখা হবার অনেক আগে থেকে সব গুছিয়ে বলছি শোন।"
আমি পেছন ঘুরে অনুরাধার হাত ধরে বললাম, "না অনু। ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির সামনে আমাকে এভাবে লজ্জা দিস না, প্লীজ।"
অনুরাধা এবার ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির দিকে দেখে বলল, "শান্তুদা, ঝুনুদি। তোমরা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সবটাই জানো। আমরা কী কাজ করি, কী আমাদের পেশা এসব তোমরা সবই জানো। কিন্তু অনেক কথাই এখনও রুমুদির অজানা আছে। সে’কথা গুলো বিশদভাবে খুলে না বললে রুমুদি আসল সত্যিটা বুঝতে পারবে না। কিন্তু সে’সব কথা খুলে বলতে গেলে দু’চারটে অনুচিত বা অশ্লীল কথা আমার মুখ থেকে বেরোতে পারে। রুমুদি তো আমার অতীত সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে। ঝুনুদিও নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। কিন্তু শান্তুদা, আপনি তো সে’সব জানেন না। তাই আমার কিছু কিছু কথা আপনাদের দু’জনের কাছেই শ্রুতিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু এই মূহুর্তে রুমুদিকে কথাগুলো বলা খুবই জরুরী। তাই আমি আপনাদের কাছে আগে থেকেই হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।"
এ’কথা বলে অনুরাধা আমার হাতটা ধরে বলল, "রুমুদি, তুমি যদি ভেবে থাক যে ঝুনুদি আর শান্তুদা আমার মুখে কথাগুলো প্রথমবার শুনছেন, তাহলে বলে রাখি, তোমার সে ধারণা সম্পূর্ণ ভূল। তারা অনেকটাই জানেন। আর গত দু’ তিন মাসে তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তার তো প্রতিটা কথাই তারা জানেন। আর জেনেছেন আমাদের মাধ্যমে। আমি, মাসি আর শ্যামলীদি সকলেই তাদের সব কিছু জানিয়েছি। আমাদের বাড়ির ডাক্তার ঘোষালও একটা পর্যায়ে আমাদের সাথে ছিলেন। তবে শুরুটা হয়েছিল বিদ্যুৎদার মাধ্যমে। আজ বিদ্যুৎদাও এ বাড়িতে আছেন। তিনিও সাক্ষী দেবেন যে আমি কোন কিছু বানিয়ে বলছি না। তবে বিদ্যুৎদার কথা বলার আগেও তোমাকে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। রুমুদি, তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি যে টুপু আমাকে একদিন বলেছিল যে ও কোন একটা মেয়েকে ভালবাসে আর তাকেই তখনও সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তোমাকে আমি বলিনি, কিন্তু আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে টুপু তোমাকেই ভালবেসেছিল। আর তোমাকেই যে টুপু ভালবাসত, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম সেদিন। ওই দুর্ঘটনার পরের দিন সকালে যখন আমাদের সারাটা শহর তোলপাড় হয়ে উঠেছিল, সেদিন আমি টুপুদের বাড়ি গিয়ে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন আমি টুপুর মা বাবা আর ঝুনুদিকে যেভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম অমন কান্না মানুষ শুধু তখনই কাঁদে যখন তাদের অত্যন্ত ভালবাসার কেউ সারা জীবনের জন্য তাদের ছেড়ে যায়। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যে পাশের বাড়ির কেউ নয়, ওদের বাড়িরই কেউ যেন মারা গেছে। আমি সেদিন ওদের বাড়িতে প্রায় ঘণ্টা চারেক ছিলাম। ওই চারটে ঘণ্টা আমি টুপুকে একভাবে জানালার শিক ধরে তোমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে বয়সে তোমার চেয়ে ছোট হলেও টুপু তোমাকেই ভালবাসত। আর আমার ধারণাই যে ঠিক সেটা বুঝতে পেরেছিলাম ওদের বাড়ি থেকে চলে আসবার সময়। আলুথালু বেশে ঝুনুদি আর তার বাবা মা পাগলের মত কাঁদতে শুরু করেছিলেন।"
এমন সময় হঠাৎ ঝুনুদি চাপা গলায় বলল, "অনু, তুই ওই দিনটার কথাগুলো আর তুলিস না রে ভাই। ও’কথা মনে পড়লে আমি যে আজও শিউড়ে উঠি। প্লীজ তুই ও’সব কথা তুলিস না।"
আমি তার কথা শুনে নিরুত্তর রইলাম। ডাক্তার বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা ঘরে এসে ঢুকল। শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমার একপাশে আর মাসি অন্যপাশে বসল। মাসি আমার মাথায় তার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এখন কেমন লাগছে রে মিনু তোর? একটু ভাল লাগছে?"
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, "হ্যাঁ মাসি। এখন অনেকটা ভাল লাগছে। কিন্তু কত রাত হল বল তো? আমরা বাড়ি কখন যাব?"
বিজলীমাসি একটু হেসে বলল, "তোকে এ’সব নিয়ে ভাবতে হবে না এখন। ডাক্তারবাবু আমাদের সকলকে রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দেবেন না। আর আমরা সবাই তো আছি। ভাবিস না। কিন্তু তোকে না তখন বললাম যে আমাকে আর মাসি বলে ডাকবি না। দিদি বলে ডাকবি।"
আমি বিজলীমাসির একটা হাত ধরে বললাম, "তুমি সত্যি আমার বাবাকে চিনতে মাসি?"
বিজলীমাসি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, "আবার মাসি? বলছি না এখন থেকে দিদি বলে ডাকবি। আর তোর বাবাকে চেনার কথা বলছিস? ওই ভগবানের মত লোকটা যে কতদিন আমাকে তার কোলে বসিয়ে আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছেন রে। অত ছোট বয়সের কথা আমার আর বেশী কিছু মনে নেই। দু’একটা কথা একটু একটু মনে আছে। আমি যে নীলু জেঠুর কোলে বসে খেতাম, সে’কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার"
বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "জেঠু জেঠীমার মুখটা আবছা আবছা মনে ছিল শুধু। ক’দিন আগে ডাক্তার বাবুদের এ বাড়িতে এসে তাদের ছবি দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তুই যে সেই নীলু জেঠুর মেয়ে, সেটা জানবার পর থেকে আমি রোজ রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদি। যে লোকটা আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছে, তার মেয়েকে দিয়েই আমি আর মা দশটা বছর ধরে ব্যবসা করেছি। আমার যে নরকেও ঠাঁই হবেনা রে"
বলতে বলতে শাড়ির খুঁট দিয়ে নিজের চোখ মুছতে লাগল।
বিজলীমাসিকে কাঁদতে দেখে আমার চোখেও জল চলে এসেছিল। কিন্তু অদম্য কৌতূহলের বশে আমি তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, "কিন্তু আমার মা বাবার সাথে তোমার দেখা কবে কোথায় হয়েছিল।"
বিজলীমাসিও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "সে তো প্রায় চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। তখন তো তোর জন্মও হয়নি। আমি তখন একটা কোলের শিশু। তখন নীলু জেঠু আর জেঠিমার কোন সন্তান হয় নি। আমি আর মা তো তোদের বাড়িতেই থাকতাম। আমার জন্মের পর পরই আমার বাবা আমাদের মা মেয়েকে একা ফেলে কোথাও চলে গিয়েছিল। আমার বাবা নীলু জেঠুর অফিসেই কাজ করত। মা-র মুখে শুনেছিলাম, তখন আমাদের আশ্রয় বলতে কিছু ছিল না। নীলু জেঠুই নাকি মাকে আর আমাকে তোদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর পাঁচ বছর আমরা তোদের বাড়িতে ছিলাম। নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব ভালবাসতেন। যখন মা আমাকে নিয়ে ওখান থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল তখন নীলু জেঠুর ছেলের বয়স ছিল প্রায় তিন বছর। তোর বড়দা আদির জন্মের পর থেকেই তো আমি সব সময় ওকে কোলে নিয়ে থাকতাম। আমার ঘরের ট্রাঙ্কের ভেতরে এখনও একটা সাদা কালো ছবি আছে। আমি তোর বড়দাকে কোলে নিয়ে সে ছবিটা উঠেছিলাম। ওখান থেকে চলে আসবার পর অনেক জায়গা ঘুরে শেষমেশ মা আমাদের ওই বাড়িটায় এসেছিল। বাসন্তী থেকে সে হয়ে গিয়েছিল ঝিমলি। আর আমি রেখা থেকে হয়ে উঠেছিলাম বিজলী। সে সব ইতিহাস এখন বলতে গেলে এক রাতেও বোধহয় শেষ হবে না। তবে সেই সময়কার একটা দিনের কথা এখনও আমার পরিস্কার মনে আছে। তোর বড়দা আদি একদিন বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ছুটে গিয়ে সে মেঝেতে পড়বার আগেই তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেদিন নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব আদর করেছিলেন। আমাকে নতুন একটা ফ্রক কিনে দিয়েছিলেন নীলু জেঠু।"
আমি বিজলীমাসির হাতটাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে বললাম, "সত্যি বলছ তুমি মাসি?"
বিজলীমাসি একটু ম্লান হেসে বলল, "গত দু’মাসের মধ্যে তোকে অনেকগুলো মিথ্যে কথা বলেছি রে মিনু। অনেক কথা তোর কাছে গোপন করে গেছি। শুধু আজকের এই দিনটার আশায়। আজ আর তোকে কোন মিথ্যে বলছি না রে। নীলু জেঠুর মত আর কাউকে আমি দেখিনি। আমি যে তাকে নিজের বাবার মতই ভালবাসতাম শ্রদ্ধা করতাম রে। আর উনিও আমাকে খুব ভালবাসতেন। আর গত দশটা বছর ধরে সেই নীলু জেঠুর মেয়েকে দিয়ে আমি বেশ্যাবৃত্তি করিয়েছি! এ’কথা যেদিন বুঝতে পেরেছি সে’দিন থেকেই যে মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি রে। যে লোকটাকে আমি ভগবানের মত শ্রদ্ধা করতাম তার আদরের মেয়েটাকে দিয়েই আমি এ’সব করিয়েছি, এ’কথা ভাবতেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বোন, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তো জানতাম না যে তুই আমার সেই জেঠুর মেয়ে। মা-ও যদি তোর আসল পরিচয় জানতে পারত, তাহলে সেও তোকে এ ব্যবসায় কিছুতেই নামাত না। আর ওই গজানন আরও দশ বছর আগেই এ দুনিয়া থেকে সরে যেত। কিন্তু প্রায় দু’মাস আগে যেদিন জানতে পারলাম যে তোদের পাশের বাড়ির রমেন কাকুর ছেলে তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোকে আমি তার হাতে তুলে দেব। রমেন কাকু আর সোনালী কাকিমার কথাও মনে আছে আমার। তাদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমাকে যা কিছু করতে হয় আমি সব করব। আজ সেই শুভদিনটা এসে গেছে। এখন আমি মরে গেলেও আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। তবে যে’কটা দিন বেঁচে থাকব রোজ নীলু জেঠু আর জেঠিমার কাছে প্রার্থনা করব, তারা যেন আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেন। আর পরকাল বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, আর সেখানে যদি তাদের সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে নীলু জেঠু আর জেঠিমার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব আমি।"
আমি বিজলীমাসির হাত ধরে বললাম, "তুমি সত্যি আমাদের ওই বাড়ীতে ছিলে? আমার বড়দাকে তুমি তোমার এই কোলে নিয়েছিলে?"
এমন সময় ঝুনুদি একটা গ্লাস হাতে করে ঘরে ঢুকে বলল, "হ্যাঁরে রুমু। রেখাদি একদম ঠিক কথা বলছে। আমি তো রেখাদি বা তার মাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু মা-র মুখে তাদের কথা শুনেছি। তোদের বাড়িতে বাসন্তীমাসি আর রেখাদি প্রায় বছর পাঁচেকের মত ছিল। আচ্ছা, এটা তুই আগে খেয়ে নে তো। তারপর বাকি কথা শুনিস" বলে গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি বিজলীমাসির কোল থেকে উঠবার চেষ্টা করতেই বিজলীমাসি আর শ্যামলীদি আমাকে ধরে টেনে ওঠালো। ঝুনুদিকে জিজ্ঞেস করলাম, "এখন আবার কী এনেছ এ’সব তুমি ঝুনুদি?"
ঝুনুদি আমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, "হরলিক্সের সাথে কিছু একটা ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছেন তোর ডাক্তারবাবু। আর কথা না বলে আগে এটা খেয়ে নে তো।"
আমি কোন কথা না বলে গ্লাসে চুমুক দিতেই ঝুনুদিদের কাজের মেয়ে শেফালী ঘরে ঢুকে বলল, "ও দিদি, লিপি বৌদি জানতে চাইল মুড়িঘণ্টটা কি আজই বানাবে তুমি?"
ঝুনুদি জবাব দিল, "নারে। আজ আর আমি কিচেনে যেতে পারব না। তুই লিপিকে বল, মাছের মুড়োটা যেন ভেঁজে রেখে দেয়। মুড়িঘণ্ট কাল দিনের বেলায় বানাবো।"
শেফালী পেছন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই ঝুনুদি আবার বলল, "একটু দাঁড়া শেফালী। ওর খাওয়া হলে গ্লাসটা নিয়ে যা। আর শোন, দাদার ঘর থেকে আদিকে এনে এখানে দিয়ে যাস তো। ও ওর মামির কাছে আসবার জন্য খুব কান্নাকাটি করছে। একটু এসে দেখে যাক। আর লিপিকে বলিস আজ রুমুকে কী খেতে দিতে হবে তা যেন তোর জামাইবাবুর কাছ থেকে জেনে নেয়। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসব।"
আমি খালি গ্লাসটা শেফালীর হাতে ফিরিয়ে দিতেই শেফালী চলে গেল। ঝুনুদি আমার কাঁধে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোর এখন কেমন লাগছে রে রুমু? ভাল লাগছে তো? না অন্য কিছু কোন অসুবিধে হচ্ছে?"
আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চেয়ে শান্ত ভাবে বললাম, "এখন ঠিকই আছি। কিন্তু ঝুনুদি ওই ছবিটা তোমরা কোত্থেকে পেলে গো? আমার মনে পড়ছে যেদিন আমাদের ওই সর্বনাশটা হয়েছিল তার আগের দিনই বড়দার কেনা নতুন ক্যামেরায় এ ছবিটা তোলা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটা তো তখনও প্রিন্ট করা হয়নি।"
ঝুনুদি আমার একটা হাত ধরে বলল, "তোর বড়দা আদিদা ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল মডার্ন স্টুডিওতে। তোর মনে আছে মডার্ন স্টুডিওর কথা? আমাদের স্কুলে যাবার রাস্তাতেই তো ছিল।"
আমার সে স্টুডিওর কথা মনে পড়তে বললাম, "হ্যাঁ মনে আছে। ঘোষপাড়ার মোড়ের মাথাতেই তো ছিল, তাই না?"
ঝুনুদি বলল, "হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। ওই ঘটনার মাস খানেক বাদে বাবা যেন কিভাবে জানতে পেরেছিলেন ছবিটার কথা। আদিদাই ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল সেখানে। বাবাই সে স্টুডিও থেকে ছবিটা এনেছিলেন। ছবিটা তখনই এভাবে বাঁধিয়ে আমাদের খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার বিয়ের ঠিক পর পরই মা বাবা চলে যাবার পর ভাইও সিভিল সার্ভিস পাশ করে চাকরীতে জয়েন করতে বাড়িটা তখন থেকেই খালি পড়ে ছিল। ভাই বাইরে চলে যাওয়াতে সে বাড়িতে থাকবার মত আর কেউ ছিল না। আমি ভাইকে বলেছিলাম বাড়িটা বেচে দিতে। কিন্তু ও তা করেনি। ভাড়া দিয়েছিল। বছর সাতেক পর ভাই যখন এখানে কোলকাতায় পোস্টিং পেল তখন আমার কথাতেই সে বাড়িটা বেচে দিয়ে এখানে এই বাড়িটা বানিয়েছে। আমরা তো তার বছর চারেক আগে থাকতেই দমদমের ওদিকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। এ বাড়ি কমপ্লিট হবার পর ভাই আমাদের সবাইকে এখানেই নিয়ে এসেছে। আর পুরোনো বাড়ির অনেক জিনিসের সাথে এ ছবিটাও নিয়ে এসেছে। তখন থেকেই এটা ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।"
ঝুনুদির গলাটা কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছিল। একটু থেমে সে আবার বলল, "তবে শুধু এ ছবিটাই নয়। তোদের বাড়ি থেকে ভাই একটা অ্যালবাম চেয়ে নিয়েছিল তোর মামাদের কাছ থেকে। আর এ বাড়িতে আসবার পর সে অ্যালবাম থেকে কয়েকটা ছবি স্টুডিওতে দিয়ে নতুন করে প্রিন্ট করে এনেছে। সে’সব ওপরে ভাইয়ের বেডরুমে আর ওপরের ড্রয়িং রুমে লাগানো হয়েছে। তোকে ফিরে পাবার আশা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ভাইকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারিনি কিছুতেই। মা বাবা জেঠু জেঠিমা আদিদা আর অভির ছবিগুলোতে ভাই রোজ মালা পড়িয়ে দেয় আর কাঁদে। এ বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে আমরা সবাইকে বলি যে ওগুলো টুপুর শ্বুশুর শাশুড়ি আর সম্বন্ধীদের ছবি। আর তোর ছবি দেখিয়ে বলি, এটা আমার ভাইবৌ"
বলতে বলতে ঝুনুদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঝুনুদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমিও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমাদের দু’জনের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সান্তনা দিতে লাগল।
এমন সময় শেফালী আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আদি শেফালীর কোল থেকে নেমে ছুটে এসে আমাকে আর ঝুনুদিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, "ও মামি, ও মা তোমরা কাঁদছ কেন গো?"
আমি ঝুনুদিকে ছেড়ে আদিকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, "আদি সোনা। সোনা বাবা আমার। আমরা যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না তাই তো কাঁদছিলাম। এবার তুমি এসে গেছ। আর কাঁদব না আমরা" বলে আদির দু’গালে একের পর এক চুমু খেতে লাগলাম।
আদি তার ছোট্ট ছোট্ট তুলতুলে হাতে আমার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, "আমি তো কখন থেকে তোমার কাছে আসতে চাইছিলাম। ওই বিড্ডু মামুটা খুব খারাপ। আমাকে শুধু শুধু আটকে রাখছিল। তাই তো আসতে পারিনি। বলে কি, তুমি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ।"
ঝুনুদিও নিজের চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে আদিকে জিজ্ঞেস করল, "তোর মামু কী করছে রে আদি?"
আদি আমার কোলে বসে বলল, "এতক্ষণ তো শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল মামু। তবে এখন শুধু শুয়ে আছে। কিন্তু মা আমি কিন্তু মামির সাথে শোব আজ। তুমি না করবে না কিন্তু।"
ঝুনুদি মুখে হাসি টেনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। কিন্তু মামির তো শরীরটা ভাল নেই। তুমি তাকে একটু রেস্ট নিতে দাও। তুমি এখন বাপীর কাছে যাও। নইলে মামির সাথে শুতে পারবে না কিন্তু।"
আদি প্রায় সাথে সাথে আমার কোল থেকে নেমে বলল, "ঠিক আছে। আমি তোমার কথা শুনছি। তুমিও কিন্তু আমাকে মামির সাথে শুতে দেবে।"
ঝুনুদি তার কথায় সায় দিতেই আমি আদির হাত ধরে বললাম, "ও ঝুনুদি, আমি যে তখন ওকে চকলেটটা খাওয়াচ্ছিলাম সেটার কি হল গো?"
ঝুনুদি কিছু বলার আগেই আদি বলে উঠল, "ওটা তো আমি খেয়ে ফেলেছি মামি। কিন্তু জানো মামি, মামুও আমার চকলেটটা থেকে একটা টুকরো খেয়েছে।"
আমি হেসে আদির মাথার চুল নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "খুব ভাল করেছ সোনা।"
ঝুনুদি বলল, "ঠিক আছে। মামি দিয়েছে বলেই আজ তোমাকে চকলেট খেতে দিয়েছি। কিন্তু মামির কাছে কিন্তু আর চকলেট খাবার বায়না ধরবে না। তাহলে মামি কিন্তু আবার হারিয়ে যাবে।"
আদি আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, "না, আমি মামিকে আর হারিয়ে যেতে দেব না। চকলেট চাই না আমি।"
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আদিকে বুকে চেপে ধরে আবার কেঁদে ফেললাম। ঝুনুদি আমার কাছ থেকে আদিকে টেনে নিতে নিতে বলল, "শেফালী ওকে নিয়ে যা ওর বাবার কাছে।"
শেফালী আদির হাত ধরে ওকে টানতে আদি যেতে যেতে বলল, "আমি আর চকলেট চাইব না মামি। তুমি কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাবে না।"
আমি আদির কথা শুনে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এবার অনুরাধা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কেঁদো না রুমুদি। এতগুলো বছর ধরে অনেক যন্ত্রণা তুমি সহ্য করেছ। আজ ভগবান যখন তোমাকে এমন একটা সুযোগ দিচ্ছেন, সেটাকে তুমি আর অবহেলা কোর না। টুপু যে তোমাকে কত ভালবাসে, তা তুমি না জানলেও আমি তো অনেক বছর আগে থেকেই তা জানি গো। টুপুর সাথে তুমি খুব সুখে থাকবে।"
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, "না রে অনু। সেটা হয় না রে। তুই তো জানিস আমি কতটা নোংরা। আমাদের সারা শরীরে যে নর্দমার পাঁক লেগে আছে রে। টুপুর মত পবিত্র নিষ্পাপ একটা ছেলের জীবন আমি জেনে বুঝে কি করে নষ্ট করি বল তো?"
এমন সময় ডক্টর মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম, "এ পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ম্যাডাম, যাতে একজন আরেকজনের জীবন নষ্ট করে দেয়। তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছিল ওই গজানন নামের বদমাশটা। সে বদমাশটা তার কৃতকর্মের একেবারে উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ রুমু। যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে কেউ কারো জীবন নষ্ট করে না। বরং সব রকম বিপদে আপদে একে অন্যের পাশে থেকে সাহায্য করে। একে অন্যের জন্য নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিতে পারে। আর টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসে সেটা তোমাকে আমি ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। বয়সে আমি ওর থেকে প্রায় ছ’বছরের বড়। কিন্তু তোমার প্রতি ওর মনের মধ্যে যত ভালবাসা আমি দেখেছি, তাতে আমি ওকে মনে মনে প্রণাম করি। নিজের চোখে না দেখলে এমন ভালবাসার কথা শুনে আমি সেটাকে শুধু একটা গল্প বলেই ভাবতাম। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি, তাকে তো আর গল্প বলা যায় না।"
ডক্টর মুখার্জী যে কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন সেটা বুঝতেই পারিনি। শ্যামলীদি ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার এনে আমাদের বিছানার সামনে রেখে বলল, "আপনি এখানে বসুন ডাক্তারবাবু।"
ডক্টর মুখার্জী চেয়ারে বসতে আমি তাকে কিছু একটা বলতে যেতেই অনুরাধা পেছন থেকে বলল, "হ্যাঁ রুমুদি। আমিও ঠিক সে’কথাই বলছি। তবে আমি তো টুপুকে অতটা কাছে থেকে দেখিনি যেমনটা উনি দেখেছেন। তবে টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসত তার আন্দাজ আমিও করতে পেরেছিলাম অনেক আগেই। তোমাকে তো কিছুটা আগেই বলেছি। কিন্তু কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে আমি গোপন করে গিয়েছিলাম রুমুদি। অবশ্য শুধু আমিই নই, শ্যামলীদি আর মাসিও কয়েকটা কথা তোমার কাছে গোপন রেখেছিল। আমার মনে হয় আজ সে কথাগুলো তোমাকে জানানো উচিৎ। শোনো রুমুদি, বিজলী মাসির বাড়িতে আমার আসা আর তোমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা কিন্তু একেবারেই কাকতালীয় নয়। তোমার কাছাকাছি যাবার জন্যেই আমি এখানে এসেছি। তবে প্রথম থেকে গুছিয়ে না বললে তুমি সেটা বুঝতে গিয়েও গুলিয়ে ফেলবে। তাই তোমার সাথে আমার দেখা হবার অনেক আগে থেকে সব গুছিয়ে বলছি শোন।"
আমি পেছন ঘুরে অনুরাধার হাত ধরে বললাম, "না অনু। ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির সামনে আমাকে এভাবে লজ্জা দিস না, প্লীজ।"
অনুরাধা এবার ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির দিকে দেখে বলল, "শান্তুদা, ঝুনুদি। তোমরা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সবটাই জানো। আমরা কী কাজ করি, কী আমাদের পেশা এসব তোমরা সবই জানো। কিন্তু অনেক কথাই এখনও রুমুদির অজানা আছে। সে’কথা গুলো বিশদভাবে খুলে না বললে রুমুদি আসল সত্যিটা বুঝতে পারবে না। কিন্তু সে’সব কথা খুলে বলতে গেলে দু’চারটে অনুচিত বা অশ্লীল কথা আমার মুখ থেকে বেরোতে পারে। রুমুদি তো আমার অতীত সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে। ঝুনুদিও নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। কিন্তু শান্তুদা, আপনি তো সে’সব জানেন না। তাই আমার কিছু কিছু কথা আপনাদের দু’জনের কাছেই শ্রুতিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু এই মূহুর্তে রুমুদিকে কথাগুলো বলা খুবই জরুরী। তাই আমি আপনাদের কাছে আগে থেকেই হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।"
এ’কথা বলে অনুরাধা আমার হাতটা ধরে বলল, "রুমুদি, তুমি যদি ভেবে থাক যে ঝুনুদি আর শান্তুদা আমার মুখে কথাগুলো প্রথমবার শুনছেন, তাহলে বলে রাখি, তোমার সে ধারণা সম্পূর্ণ ভূল। তারা অনেকটাই জানেন। আর গত দু’ তিন মাসে তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তার তো প্রতিটা কথাই তারা জানেন। আর জেনেছেন আমাদের মাধ্যমে। আমি, মাসি আর শ্যামলীদি সকলেই তাদের সব কিছু জানিয়েছি। আমাদের বাড়ির ডাক্তার ঘোষালও একটা পর্যায়ে আমাদের সাথে ছিলেন। তবে শুরুটা হয়েছিল বিদ্যুৎদার মাধ্যমে। আজ বিদ্যুৎদাও এ বাড়িতে আছেন। তিনিও সাক্ষী দেবেন যে আমি কোন কিছু বানিয়ে বলছি না। তবে বিদ্যুৎদার কথা বলার আগেও তোমাকে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। রুমুদি, তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি যে টুপু আমাকে একদিন বলেছিল যে ও কোন একটা মেয়েকে ভালবাসে আর তাকেই তখনও সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তোমাকে আমি বলিনি, কিন্তু আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে টুপু তোমাকেই ভালবেসেছিল। আর তোমাকেই যে টুপু ভালবাসত, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম সেদিন। ওই দুর্ঘটনার পরের দিন সকালে যখন আমাদের সারাটা শহর তোলপাড় হয়ে উঠেছিল, সেদিন আমি টুপুদের বাড়ি গিয়ে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন আমি টুপুর মা বাবা আর ঝুনুদিকে যেভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম অমন কান্না মানুষ শুধু তখনই কাঁদে যখন তাদের অত্যন্ত ভালবাসার কেউ সারা জীবনের জন্য তাদের ছেড়ে যায়। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যে পাশের বাড়ির কেউ নয়, ওদের বাড়িরই কেউ যেন মারা গেছে। আমি সেদিন ওদের বাড়িতে প্রায় ঘণ্টা চারেক ছিলাম। ওই চারটে ঘণ্টা আমি টুপুকে একভাবে জানালার শিক ধরে তোমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে বয়সে তোমার চেয়ে ছোট হলেও টুপু তোমাকেই ভালবাসত। আর আমার ধারণাই যে ঠিক সেটা বুঝতে পেরেছিলাম ওদের বাড়ি থেকে চলে আসবার সময়। আলুথালু বেশে ঝুনুদি আর তার বাবা মা পাগলের মত কাঁদতে শুরু করেছিলেন।"
এমন সময় হঠাৎ ঝুনুদি চাপা গলায় বলল, "অনু, তুই ওই দিনটার কথাগুলো আর তুলিস না রে ভাই। ও’কথা মনে পড়লে আমি যে আজও শিউড়ে উঠি। প্লীজ তুই ও’সব কথা তুলিস না।"
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
SS_Sexy-এর লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereSS_Sexy-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment