আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
নিয়তির স্রোতস্বিনী
Written By SS_Sexy
Written By SS_Sexy
(#৫১)
অনুরাধা ডক্টর মুখার্জীকে বলল, "শান্তুদা, তুমি ঝুনুদিকে বোঝাও। আমি তাকে কষ্ট দেবার জন্য কিছু বলছি না। আর ঝুনুদি, বারো বছর পুরোনো কান্নার রেশ থেমে গেলেও রুমুদির খোঁজ পাবার দিন থেকেই তো তুমি আবার নতুন করে কাঁদতে শুরু করেছ। একটু একটু করে কেঁদে নিজেদের মনের বোঝা হালকা করেছ তোমরা দু’ভাইবোন। কিন্তু আজ রুমুদির মনের ভেতর যে কত কান্নার আবেগ একসাথে উথলে উঠতে চাইছে, সেটা বুঝতে পারছ না? ওর মনের ভেতর যে এখনও প্রচুর দ্বন্দ্ব আছে তার কারন এখনও প্রচুর প্রশ্ন ওর মনে জমা হয়ে আছে। সে প্রশ্নগুলোর জবাব পরিস্কার ভাবে না বোঝা পর্যন্ত রুমুদি পরবর্তী সিদ্ধান্তটা যে নিতে পারবে না, সেটা বুঝতে পারছ না?"
ডক্টর মুখার্জী ঝুনুদির পাশে বসে তাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, "হ্যাঁ ঝুনু, অনুরাধা একদম ঠিক কথা বলছে। আমিও সেটাই চাই। যারা যারা আমাদের এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল আজ তারা প্রায় সকলেই এখানে আছে। তাই রুমু বুঝতে পারবে যে আমরা মিথ্যে বানিয়ে কিছু বলছি না। অনুরাধা তুমি বলে যাও।"
অনুরাধা আমার ধরে থাকা হাতটায় আবার চাপ দিয়ে বলল, "হ্যাঁ রুমুদি। বিশ্বাস কর, আমি এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সেদিন ওদের দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুনছিলাম মেশোমশাই কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন যে আগের দিনই তোমাদের দুই পরিবারের কর্তাদের মাঝে নাকি কথা হয়েছিল যে তোমার বড়দার সাথে ঝুনুদির বিয়ে দেওয়া হবে। তুমি তোমার মা-বাবার মুখে এ’কথা শুনেছিলে কিনা জানিনা। কিন্তু ঝুনুদির বাবার মুখ থেকেই কথাটা শুনেছি আমি সেদিন। আর মাসিমা, মানে ঝুনুদির মা, কেঁদে কেঁদে বলছিলেন যে উনি তোমার মা বাবার হাতেপায়ে ধরে যে কোন ভাবেই তোমাকে তাদের পূত্রবধূ করে নেবার কথা ভাবছিলেন। তার কয়েক মাস বাদে আমি টুপুর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু টুপু আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে পরিস্কার ভাবে বলে দিয়েছিল যে সে তার ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে। আর তাকেই খুঁজে যাচ্ছে। আমি টুপুকে অনেক চেষ্টা করেও কব্জা করতে পারিনি। তারপর একদিন ওর পার্সে আমি তোমার ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিনই আমার কাছে পরিস্কার হয়েছিল যে টুপু শুধু তোমাকেই ভালবাসত। আর তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মন দিয়েছিলাম।"
ঝুনুদি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "দাঁড়া অনু। এখানে আমি একটু বলে নিই। তোর বোধহয় মনে আছে রুমু, সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছিল। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হচ্ছিল। সেদিন বাবার অফিসের এক কলিগের বাড়িতে কালীপুজো উপলক্ষ্যে বাবা আমাকে আর মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাই একা বাড়িতে ছিল। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দামুদার দোকানের পাশের একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় আমরা গিয়ে উঠেছিলাম। প্রায় সাথে সাথেই জেঠুও, মানে তোর বাবা, সেখানে এসে উঠেছিলেন। তিনি অফিস ফেরত বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলেন। জেঠু আমার চিবুক ধরে আদর করে হঠাতই বাবাকে বলেছিলেন যে বাবা মা যদি রাজী থাকেন তাহলে আমাকে আদিদার বৌ করে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। বাবাও তার জবাবে বলেছিলেন যে দু’এক দিনের মধ্যেই তারা এ ব্যাপারে কথা বলবেন। তবে আমার সামনেই তিনিও জেঠুকে বলেছিলেন যে আদিদার সাথে আমার বিয়ে দিতে এমনিতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তার একটা শর্ত ছিল। জেঠু জানতে চেয়েছিলেন কী শর্ত। বাবা তখন বলেছিলেন যে তিনি দু’বাড়ির মধ্যে মেয়ে বদল করতে চান। মানে আমাকে তোদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন আর তোকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবেন। জেঠু শুনে খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন যে ভাই তোর থেকে বছর দেড়েকের ছোট হলেও তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জেঠিমার সাথে পরামর্শ না করা পর্যন্ত কোন কথা দিতে পারবেন না। আমি আর মা সে’কথা শুনে খুব খুশী হয়েছিলাম। কারন আমরা জানতাম জেঠিমা এ দুটো সম্পর্কই মেনে নেবেন। তখন বাবা জেঠুকে নিমন্ত্রন করেছিলেন পরের রবিবার দুপুরে তোদের বাড়ির সকলে যেন আমাদের বাড়িতে খেতে আসে। কিন্তু সে দুপুর তো আর কোনদিন আসেনি আমাদের জীবনে। বাবার কলিগের বাড়ি সারা রাত জেগে কালীপুজো দেখে শেষ রাতের দিকে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। পরের দিন সকাল সাতটা না বাজতেই ওই বাড়ির লোকেরা আমাদের ডেকে উঠিয়ে জানিয়েছিল সেই দুঃসংবাদটা। বাবা সাথে সাথে ভাইকে ফোন করেছিলেন। ভাই ফোন ধরে কোন কথা বলতে পারেনি। শুধু হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। আমরা তড়িঘড়ি সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেকটা দুরেই ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে হয়েছিল। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, রিপোর্টার, নিউজ চ্যানেলের গাড়ি দিয়ে ছয়লাপ হয়ে ছিল পুরোটা এলাকা। আর হাজার হাজার লোকের ভিড় কাটিয়ে কোনরকমে আমরা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পেরেছিলাম। বাড়িতে ঢোকবার আগেই লোকের মুখে মুখে ছাড়া ছাড়া ভাবে শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে কত বড় একটা সর্বনাশ হয়েছে। মা বাবা তখনও জানতেননা যে ভাই তোকে ভালবাসত। কিন্তু আমরা ভাইবোন তো একঘরেই থাকতাম। আমি সেটা তার অনেক আগে থেকেই জানতাম। বাড়িতে গিয়ে ঢুকতেই ভাই আমাদের দেখে হাউহাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু কে আর কাকে সান্ত্বনা দেয় তখন। বাবা মা আর আমি নিজেও তো তখন একইভাবে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। জেঠু, জেঠিমা আর তোদের সবাইকে আমিও যে বড্ড ভালবাসতাম রে। মনে মনে স্বপ্নও দেখতাম আদিদার বৌ হয়ে আমি তোদের ও বাড়িটায় গিয়ে উঠব। তুই আমাকে বৌদি বলে ডাকবি। আমি আজও আদিদাকে ভুলতে পারিনি। আমাদের বিয়ের আগেই আমি শান্তুকে আদিদার কথা, তোদের সকলের কথা খুলে বলেছি। শান্তুও খুব ভাল। ছেলে হবার পর ও-ই ছেলের নাম রাখে আদিত্য। আদিদা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু যতবার আমার ছেলের নাম মুখে আনি ততবারই আদিদার কথা, তোর কথা, তোদের বাড়ির আর সকলের কথা আমার মনে আসে।"
ঝুনুদির গলাটা আবার খুব ভারী শোনাল। ডক্টর মুখার্জি ঝুনুদির কাঁধে হাত রেখে বললেন, "কেঁদো না ঝুনু। গত ছ’সাতটা বছর ধরেই তো তুমি আর টুপু রোজ এভাবে কেঁদে আসছ, সে তো আমি দেখেছিই। আজ ভগবান আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তার দয়াতেই আজ রুমুকে আমাদের মাঝে পেয়েছি। আজ আর কান্না কীসের? আজ তো আমাদের সকলের খুশীর দিন। তোমার মা বাবার স্বপ্ন আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে বল তো? তাই নিজেকে সামলে রুমুকে বোঝাও যে আমরা সকলেই তাকে ফিরে পাবার জন্য কত কী করেছি। টুপুর ভালবাসায় যদি শক্তি থাকে তাহলে রুমুও ওর মনের সন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে টুপুকে আপন করে নেবে। তবে ওর মনের ওপরেও তো এখন অসম্ভব চাপ রয়েছে। বারোটা বছরের গ্লানি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে ওকে একটু সময় তো দিতেই হবে। তাই অনুরাধা যা বলছে সেটাই আমাদের করা উচিৎ। আমাদের সব কথা শুনলেই রুমু হয়তো নিজের মনের গ্লানি আর সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারবে।"
আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। এদের সকলের কথা শুনতে শুনতে ঠিক করতে পারছিলাম না, আমার এ মূহুর্তে কী করা উচিৎ। আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চাইতেই ঝুনুদি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "তুই তো জানিস না রুমু। ভাইয়ের সাথে তো তোকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি। ওকে নিয়ে তোর মনের মধ্যে কোন ফিলিংস ছিল কি না সেটাও জানিনা। আর সেটা না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু ভাই যে স্কুলে পড়বার সময় থেকেই মনে মনে তোকে ভালবাসতে শুরু করেছিল, সেটা আমার অজানা ছিল না। আমাদের ঘরে তো রুম বেশী ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি আর ভাই একঘরে ঘুমোতাম। ও যখন ক্লাস নাইনে পড়ত তখন একদিন ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে তোর নাম মুখে আনছিল। তার পরের দিন ওকে চেপে ধরতেই ও সেটা আমার কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে ওর ভালবাসা হয়ত কোনদিনই স্বার্থক পরিণতি পাবে না। তোদের আর আমাদের দুটো বাড়ির মধ্যে ভাব ভালবাসা যতই থাকুক না কেন, দুটো বিরাট বাধা যে ভাইয়ের ভালবাসার পথে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে এটা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ভাইকে তখন থেকেই বুঝিয়েছিলাম যে কাউকে ভালবাসা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমাজ সংসারের প্রথার বিরূদ্ধে গিয়ে কিছু করাটা সত্যিই খুব কঠিন। ভাইও হয়ত আমার কথার মানেটা বুঝেছিল। কিন্তু নিজের মনকে যে সে আয়ত্বে রাখতে পারেনি, তোকে যে ও নিজের মন থেকে সরাতে পারেনি সেটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ওকে মাঝে মাঝেই বোঝাতাম। একে আমাদের দুটো পরিবারের ভেতর সামাজিক জাতপাতের পার্থক্য। তার ওপর ভাই তোর চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। তাই ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের হয়ে মা বাবার কাছে কোন অনুরোধ করতে পারিনি। কিন্তু যখন তোদের বাড়ি যেতাম, তখন জেঠিমার সাথে কথা বলবার সময় আমার মনে হত জেঠিমাও ভাইকে খুব পছন্দ করতেন। হালকা কথাবার্তার মাধ্যমে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা যদি জাতের বৈষম্যটা মেনে নিতে পারি, আর ভাই যদি তোর থেকে বয়সে ছোট না হত, তাহলে তিনিও তোদের বিয়ে দিতে রাজি হতেন। মা তো আদিদাকে যতটা ভালবাসতেন তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন তোকে। বারবার বলতেন তুই যদি ভাইয়ের চেয়ে বয়সে বড় না হতিস তাহলে তোকেই আমাদের বাড়ির বৌ করে ঘরে আনতেন। আর সেদিন সকালে যখন জেঠু আর বাবা ওই দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও’সব বলাবলি করছিলেন, সেদিন আমি আর মা দু’জনেই খুব খুশী হয়েছিলাম। বাবার কলিগের বাড়িতে সে রাতে মা শুধু তোর আর আদিদার কথাই বলছিলেন। কিন্তু ওই রাতেই যে আমাদের সব স্বপ্ন ওভাবে চুড়মার হয়ে যাবে, সেটা তো আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সকালে বাড়ি ফিরে ও’সব দেখে আমরা যখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছিলাম তখনই মা বাবা বুঝে গিয়েছিলেন যে ভাই তোকে ভালবাসত। আর আমিও যে আদিদাকে পছন্দ করতাম এ’কথা তো মা আগে থেকেই জানতেন। তুই হারিয়ে যাবার পর ভাই তো প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। একদম চুপচাপ থাকত। কারুর সাথেই কথা বলত না। শুধু রাতে আমার কাছে কেঁদে কেঁদে বলত যে তোকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। রাতের পর রাত জেগে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমি মা বাবাকে কথাটা জানিয়েছিলাম। প্রায় ছ’মাস ও ঘর থেকেই বেরোয় নি। সে বছর স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাও দিতে পারেনি। তখন প্রথমে আমাদের ওখানকার ডক্টর দেব আর পরে সেই ডাক্তারের নির্দেশে ওকে কলকাতার এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ও তো বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হত। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষায় কোন রকমে শুধু পাসমার্কটুকুই স্কোর করেছিল। বাবা, মা আর আমি কোনভাবেই ওর মন থেকে তোকে সরাতে না পেরে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাতে শুরু করেছিলাম যে ডাকাতগুলো বাকি চারজনের মত তোকেও খুন করে ফেলে যায়নি মানেই হচ্ছে তুই বেঁচে আছিস। আমরা যে কোন ভাবেই তোকে খুঁজে বের করব। কিন্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর পেড়িয়ে গেল, কেউ তোর হদিশ খুঁজে বের করতে পারল না। পুলিশ গোয়েন্দা কেউ সে মর্মান্তিক খুনগুলো আর তোর কিডন্যাপিং-এর ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারল না। একটা সময় আমি তোকে ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিলেও বাবা মা কিন্তু তাদের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে তুই বেঁচে আছিস। আর একদিন না একদিন আমরা ঠিক তোকে খুঁজে পাব। ওই ডাকাতগুলো তোকে ধরে নিয়ে যাবার পর তুই কতটা দুর্ভোগ ভোগ করবি, তা আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারছিলাম। মনে মনে ভয় হত, সেসব দুর্ভোগ সহ্য করতে না পেরে তুই আবার আত্মহত্যা করে না বসিস। কিন্তু তোকে কোনভাবে ফিরে পেলে তুই যে অবস্থাতেই থাকিস না কেন মা বাবা তোকে তাদের ছেলের বৌ করে নিতে রাজি ছিলেন। তোর মামারা যেদিন খবর পেয়ে এসেছিলেন, সেদিন বাবা তাদেরকে আমাদের বাড়ি এনে খাইয়ে ছিলেন। আর আমাদের ইচ্ছের কথা তাদের জানিয়েছিলেন। তারাও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন যে তোকে পেলে আমাদের হাতেই তুলে দেবেন। রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম আমরা সবাই। ঠাকুর যেন তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। তোকে আর আমরা কেউ খুঁজে পেলাম না। একসময় পুলিশের খাতাতেও তোদের কেস ফাইল চাপা পড়ে গেল। আমাদের বিয়ের দু’দিন পরেই তো মা বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বাবা তার শেষ কথায় আমাকে আর ভাইকে বলেছিলেন যে তুই একদিন না একদিন ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবি। আর সেদিন আমরা যেন তোকে খুঁজে বের করে ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে দিই। কিন্তু এতগুলো বছরেও তোর কোন হদিস আমরা পাইনি। ভাই চাকরি পেয়ে নর্থ বেঙ্গলের একটা জায়গায় চলে গেল। আমিও শান্তুর সাথে কালিয়াগঞ্জ থেকে কোলকাতা চলে এলাম। পাঁচ বছর পর ভাইও হুগলী কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কলকাতায় ফিরে এল। আমাদের বাড়িটা বেচে দেওয়া হল। এখানে বাড়ি বানানো হল। চার বছর আগে এ বাড়িতে আসবার পর থেকে আমি ভাইকে বোঝাতে শুরু করলাম যে তোকে আর আমরা ফিরে পাব না। ও যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতে। কিন্তু আমার আর শান্তুর হাজার বোঝানো সত্বেও ভাই কিছুতেই রাজি হয়নি। ও জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তোর জন্যে অপেক্ষা করে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল। তোকে না পেলে আজীবন অবিবাহিত থাকবে বলে শপথ নিয়েছিল। আমি আর শান্তুও হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একটা সময়। মাস দুয়েক আগে ......"
শেফালী একটা বড় ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঝুনুদি তার কথা থামাল। শেফালীর পেছন পেছন আরেকজন সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। সে ভদ্রমহিলাও ট্রে হাতে নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, "দিদি, তোমাদের জন্যে একটু চা করে আনলাম। ওপরেও দু’কাপ দিয়ে এসেছি তোমার ভাইদের।"
ঝুনুদি ভদ্রমহিলার হাত ধরে বলল, "ইশ, তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি গো লিপি। তোমাকে একা একা রান্নার সমস্ত কিছু দেখতে হচ্ছে। কিন্তু আমার যে কিচ্ছু করার নেই গো। আমাকে যে এদিকে একটু থাকতেই হচ্ছে। একটু কষ্ট করে সামলে নিও প্লীজ।"
লিপি নামের ভদ্রমহিলা সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বলল, "দিদি, তুমি এমন করে কেন বলছ বল তো? টুপুদার এমন একটা খুশীর দিনে আমরা সামিল না হয়ে থাকতে পারি। বল?"
সবার শেষে আমার সামনে এসে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েই লিপি আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, "হুঁ, এবার বুঝতে পেরেছি। টুপুদা কি এমনি এমনি ভীস্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল? ইশ এমন রূপসী এক প্রেমিকাকে কোন মানুষ কি ভুলতে পারে? সত্যি গো দিদি। টুপুদার প্রেমের জোর আছে গো, মানতেই হবে।"
আমি লিপির কথা শুনে একটু লজ্জা পেতেই ঝুনুদি বলল, "রুমু, এ হচ্ছে লিপি। মানে লিপিকা সেন। টুপুর অফিসের কলিগ আর আমার ছোট ভাইয়ের মত বিদ্যুৎ সেনের বৌ। বিদ্যুতের সাথেও তোর পরিচয় হবে। এই বিদ্যুতের মুখেই আমরা তোর খোঁজ পেয়েছিলাম তিনমাস আগে। লিপি অবশ্য বয়সে তোর থেকে বেশ ছোট। তুই ওকে নাম ধরেই বলবি আজ থেকে। ওরাও আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ আর হিতৈষী।"
আমি হাতজোড় করে লিপিকে নমস্কার করতেই লিপি আমার হাতদুটো ধরে বলল, "বয়স যার যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু তোমাকে টুপুবৌদি বলে ডাকব। কিন্তু তোমার সাথে আমি আজ আর আড্ডা দিতে পারব না। রান্না কিছুটা এখনও বাকি আছে। আমি কাল তোমার সাথে চুটিয়ে গল্প করব। আসছি গো দিদি"
বলে লিপি চলে গেল। শেফালীও লিপির পেছন পেছন বেরিয়ে গেল।
ঝুনুদি এক চুমুক চা খেয়ে বলল, "নাহ, মেয়েটা ঠিক সময়ে চা নিয়ে এসেছে রে। গলাটা শুকিয়ে আসছিল আমার। তা হ্যাঁ রুমু, তারপর শোন। সেটা বোধহয় ভাইয়েরই ভালবাসার জোর। মাস তিনেক আগে এই লিপির বর বিদ্যুৎ এসে আমাকে জানাল যে ঠিক তোর মতই দেখতে একটা মেয়ের ছবি সে আরেকজনের কাছে দেখে এসেছে। আর সে মেয়েটার নাম নাকি মিনু। ওর মুখে শুনলাম তার পরিচিত কোন এক সামন্তর ফার্ম হাউসে তুই নাকি আসছিস। বিদ্যুতের মুখে সব ঘটনা শুনে আমাদের মনটা সেদিন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে তুই বেঁচে থাকলে তোর জীবনে যে এমন একটা পরিণতিই হতে পারে, সেটা তো আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। তাই দুঃখ হলেও অবাক ততটা হইনি আমরা। তখন আমরা সবাই মিলে বসে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে তুইই আমাদের হারিয়ে যাওয়া রুমু কি না সেটা আগে কনফার্ম করতে হবে। ভাইও বলল যে তুই যদি সত্যিই আমাদের রুমুই হয়ে থাকিস, তাহলে তোর এমন পরিণতিতেও সে তোকে মেনে নেবে। তখন সবাই মিলে পরামর্শ করে বিদ্যুৎকেই দায়িত্ব দিলাম তোর আসল পরিচয়টা জানতে। আমি আর আমরা সকলেই জানি বিদ্যুতের ও’সব ব্যাপারের সাথে কোন সংস্পর্শ নেই। তাই অমন পরিবেশে ওকে পাঠাতে একটু ভয়ও হচ্ছিল আমার। কিন্তু সে ভয় দুর করে দিল লিপি। লিপি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল যে বিদ্যুৎকে কিভাবে কী করতে হবে তা সে নিজেই তাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ তোকে কী করে চিনতে পারবে সেটা বুঝিয়ে দিতে বলল। তোর বাঁ কানের লতির কাছে যে একটা কালো তিল আছে, সেটা আমার জানাই ছিল। আমি বিদ্যুৎকে সেটার কথা বললাম। তারপর ওই ফার্ম হাউসে তুই যেদিন সামন্তর কাছে গিয়েছিলি সেখানে কি হয়েছিল তা তোর জানাই আছে। সেদিন রাত দশটা নাগাদ বিদ্যুৎ এসে তার মোবাইলে তোর ছবি দেখিয়ে যখন জানাল যে আমার দেওয়া আইডেন্টিফিকেশন মার্কটা মিলে গেছে তখন আমি আর ভাই আবার কেঁদে ফেলেছিলাম"
বলতে বলতে ঝুনুদি আবার ফুঁপিয়ে উঠল।
আমার মনে পড়ল ফার্ম হাউসের ওই রাতের কথা। সেনসাহেব বলে একজন সামন্তবাবুর সঙ্গে ছিল। কিন্তু সে লোকটা আমাকে ছোঁয়ও নি। তার মোবাইলে আমার ছবি উঠিয়েছিল আর আমার মুখটাকে লোকটা কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সেদিন তার ব্যবহারে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, লোকটা কোন উদ্দেশ্যে সেখানে হাজির ছিল সেদিন।
বিজলীমাসি ঝুনুদিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, "এবার তুমি একটু বিশ্রাম নাও ঝুনু। অনেকক্ষণ ধরে তুমি কথা বলছ। এরপরের কথাগুলো না হয় আমরা বলছি। রাধা এর পরের কথাগুলো তুই বল।"
অনুরাধা পেছন থেকে আমার আরও একটু কাছে সরে এসে বলল, "সেরাতে বিদ্যুৎবাবুর মুখে সব কিছু শুনেই ঝুনুদিরা বুঝতে পেরেছিল যে তুমিই তাদের রুমু। আর সে রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আর সময় নষ্ট না করে তারা তোমার ঠিকানা খুঁজে নিয়ে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। পরের দিনই বিদ্যুৎবাবু সামন্তর কাছ থেকে মাসির বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছিল। কিন্তু অমন একটা বেশ্যাপল্লীতে যাবার মত সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছিল না এরা কেউ। আর অমন পরিবেশ থেকে তোমাকে বাইরে বের করে আনতেও নানা ধরণের ঝামেলা হতে পারে ভেবে তারা কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এর প্রায় মাস দেড়েক বাদে হঠাৎ একদিন টুপুর সাথে আমার দেখা হল মেদিনীপুরে। ও কোন একটা কাজে সেখানে গিয়েছিল। টুপুর ওপর যে একসময় আমার লোভ ছিল সে তো তোমাকে আগেই বলেছি। আর টুপু যে তোমাকেই ভালবাসত, আর তোমাকেই খুঁজে যাচ্ছিল, এ’কথাও তো আমার অজানা ছিল না। আমি ওর সাথে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তোমার কোনও খোঁজ পেয়েছে কি না। তখন প্রথমে ও বলতে না চাইলেও অনেক জোরাজুরির পর আমাকে বলেছিল যে তুমি বিজলীমাসির বাড়িতে আছ। কিন্তু তোমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসবার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। জগা দালালের মুখে আমি বিজলীমাসির নাম আগেই শুনেছিলাম। তখন আমি ওকে বললাম যে আমি ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করব। জগা দালালের মাধ্যমেই আমি সে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছই। কিন্তু কোন বাড়িউলিই যে তাদের কেনা মেয়েকে কারো হাতে ছেড়ে দেয় না এটাও আমার আগে থেকেই জানা ছিল। আর তোমার মত সুন্দরী একটা মেয়েকে যে মাসিও সহজে ছেড়ে দেবে না, সেটা নিয়েও মনে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই। আমার প্রথম কাজ ছিল তুমিই আমাদের রুমু কি না সেটা নিশ্চিত করা। সেটা তো ও বাড়িতে যেদিন গিয়ে উঠেছিলাম, সেদিনই হয়ে গিয়েছিল। আরও দুটো কাজের দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। আমার দু’নম্বর কাজ ছিল তোমার মানসিকতাটা জানা। টুপুর জীবনে তুমি আসতে রাজি আছ কি না, সেটা বোঝা। চেষ্টাও করেছি তা জানার। কিন্তু তোমার মনের ভেতর যে কতটা দ্বিধা ছিল সে’কথাও এদের সবাইকে জানিয়েছি আমি। আর তৃতীয় কাজটা ছিল তোমাকে মাসির ওই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা। সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কঠিণ কাজ। সেটা নিয়েই প্ল্যান করছিলাম আমরা। কিন্তু মাসি নিজেও যে তার ছোটবেলায় তোমাদের বাড়িতে থাকত এটা তো আমার জানা ছিল না। আমি যাবার পরের দিনই তো ডক্টর ঘোষালের চেম্বারে ফুল চেকআপ করতে গিয়েছিলাম আমরা দু’জন। সেদিন ডক্টর ঘোষালের ফোন নম্বর নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম শান্তুদাকে। শান্তুদা তারপর ডক্টর ঘোষালের কাছ থেকে মাসির ফোন নাম্বার জেনে নিয়েছিলেন। মাসির সাথে ফোনে কথা বলে তিনি জানতে পারলেন যে নগদ দশ লাখ টাকা পেলে মাসি তোমাকে তাদের হাতে তুলে দেবে......."
এমন সময় মাসি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আহা, এটা তো বলবি যে আমি তখনও রুমুর আসল পরিচয়টা জানতাম না। আমি যদি সেটা জানতুম তাহলে কি আর ......."
ডক্টর মুখার্জী ঝুনুদির পাশে বসে তাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, "হ্যাঁ ঝুনু, অনুরাধা একদম ঠিক কথা বলছে। আমিও সেটাই চাই। যারা যারা আমাদের এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল আজ তারা প্রায় সকলেই এখানে আছে। তাই রুমু বুঝতে পারবে যে আমরা মিথ্যে বানিয়ে কিছু বলছি না। অনুরাধা তুমি বলে যাও।"
অনুরাধা আমার ধরে থাকা হাতটায় আবার চাপ দিয়ে বলল, "হ্যাঁ রুমুদি। বিশ্বাস কর, আমি এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সেদিন ওদের দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুনছিলাম মেশোমশাই কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন যে আগের দিনই তোমাদের দুই পরিবারের কর্তাদের মাঝে নাকি কথা হয়েছিল যে তোমার বড়দার সাথে ঝুনুদির বিয়ে দেওয়া হবে। তুমি তোমার মা-বাবার মুখে এ’কথা শুনেছিলে কিনা জানিনা। কিন্তু ঝুনুদির বাবার মুখ থেকেই কথাটা শুনেছি আমি সেদিন। আর মাসিমা, মানে ঝুনুদির মা, কেঁদে কেঁদে বলছিলেন যে উনি তোমার মা বাবার হাতেপায়ে ধরে যে কোন ভাবেই তোমাকে তাদের পূত্রবধূ করে নেবার কথা ভাবছিলেন। তার কয়েক মাস বাদে আমি টুপুর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু টুপু আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে পরিস্কার ভাবে বলে দিয়েছিল যে সে তার ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে। আর তাকেই খুঁজে যাচ্ছে। আমি টুপুকে অনেক চেষ্টা করেও কব্জা করতে পারিনি। তারপর একদিন ওর পার্সে আমি তোমার ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিনই আমার কাছে পরিস্কার হয়েছিল যে টুপু শুধু তোমাকেই ভালবাসত। আর তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মন দিয়েছিলাম।"
ঝুনুদি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "দাঁড়া অনু। এখানে আমি একটু বলে নিই। তোর বোধহয় মনে আছে রুমু, সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছিল। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হচ্ছিল। সেদিন বাবার অফিসের এক কলিগের বাড়িতে কালীপুজো উপলক্ষ্যে বাবা আমাকে আর মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাই একা বাড়িতে ছিল। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দামুদার দোকানের পাশের একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় আমরা গিয়ে উঠেছিলাম। প্রায় সাথে সাথেই জেঠুও, মানে তোর বাবা, সেখানে এসে উঠেছিলেন। তিনি অফিস ফেরত বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলেন। জেঠু আমার চিবুক ধরে আদর করে হঠাতই বাবাকে বলেছিলেন যে বাবা মা যদি রাজী থাকেন তাহলে আমাকে আদিদার বৌ করে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। বাবাও তার জবাবে বলেছিলেন যে দু’এক দিনের মধ্যেই তারা এ ব্যাপারে কথা বলবেন। তবে আমার সামনেই তিনিও জেঠুকে বলেছিলেন যে আদিদার সাথে আমার বিয়ে দিতে এমনিতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তার একটা শর্ত ছিল। জেঠু জানতে চেয়েছিলেন কী শর্ত। বাবা তখন বলেছিলেন যে তিনি দু’বাড়ির মধ্যে মেয়ে বদল করতে চান। মানে আমাকে তোদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন আর তোকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবেন। জেঠু শুনে খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন যে ভাই তোর থেকে বছর দেড়েকের ছোট হলেও তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জেঠিমার সাথে পরামর্শ না করা পর্যন্ত কোন কথা দিতে পারবেন না। আমি আর মা সে’কথা শুনে খুব খুশী হয়েছিলাম। কারন আমরা জানতাম জেঠিমা এ দুটো সম্পর্কই মেনে নেবেন। তখন বাবা জেঠুকে নিমন্ত্রন করেছিলেন পরের রবিবার দুপুরে তোদের বাড়ির সকলে যেন আমাদের বাড়িতে খেতে আসে। কিন্তু সে দুপুর তো আর কোনদিন আসেনি আমাদের জীবনে। বাবার কলিগের বাড়ি সারা রাত জেগে কালীপুজো দেখে শেষ রাতের দিকে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। পরের দিন সকাল সাতটা না বাজতেই ওই বাড়ির লোকেরা আমাদের ডেকে উঠিয়ে জানিয়েছিল সেই দুঃসংবাদটা। বাবা সাথে সাথে ভাইকে ফোন করেছিলেন। ভাই ফোন ধরে কোন কথা বলতে পারেনি। শুধু হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। আমরা তড়িঘড়ি সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেকটা দুরেই ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে হয়েছিল। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, রিপোর্টার, নিউজ চ্যানেলের গাড়ি দিয়ে ছয়লাপ হয়ে ছিল পুরোটা এলাকা। আর হাজার হাজার লোকের ভিড় কাটিয়ে কোনরকমে আমরা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পেরেছিলাম। বাড়িতে ঢোকবার আগেই লোকের মুখে মুখে ছাড়া ছাড়া ভাবে শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে কত বড় একটা সর্বনাশ হয়েছে। মা বাবা তখনও জানতেননা যে ভাই তোকে ভালবাসত। কিন্তু আমরা ভাইবোন তো একঘরেই থাকতাম। আমি সেটা তার অনেক আগে থেকেই জানতাম। বাড়িতে গিয়ে ঢুকতেই ভাই আমাদের দেখে হাউহাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু কে আর কাকে সান্ত্বনা দেয় তখন। বাবা মা আর আমি নিজেও তো তখন একইভাবে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। জেঠু, জেঠিমা আর তোদের সবাইকে আমিও যে বড্ড ভালবাসতাম রে। মনে মনে স্বপ্নও দেখতাম আদিদার বৌ হয়ে আমি তোদের ও বাড়িটায় গিয়ে উঠব। তুই আমাকে বৌদি বলে ডাকবি। আমি আজও আদিদাকে ভুলতে পারিনি। আমাদের বিয়ের আগেই আমি শান্তুকে আদিদার কথা, তোদের সকলের কথা খুলে বলেছি। শান্তুও খুব ভাল। ছেলে হবার পর ও-ই ছেলের নাম রাখে আদিত্য। আদিদা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু যতবার আমার ছেলের নাম মুখে আনি ততবারই আদিদার কথা, তোর কথা, তোদের বাড়ির আর সকলের কথা আমার মনে আসে।"
ঝুনুদির গলাটা আবার খুব ভারী শোনাল। ডক্টর মুখার্জি ঝুনুদির কাঁধে হাত রেখে বললেন, "কেঁদো না ঝুনু। গত ছ’সাতটা বছর ধরেই তো তুমি আর টুপু রোজ এভাবে কেঁদে আসছ, সে তো আমি দেখেছিই। আজ ভগবান আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তার দয়াতেই আজ রুমুকে আমাদের মাঝে পেয়েছি। আজ আর কান্না কীসের? আজ তো আমাদের সকলের খুশীর দিন। তোমার মা বাবার স্বপ্ন আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে বল তো? তাই নিজেকে সামলে রুমুকে বোঝাও যে আমরা সকলেই তাকে ফিরে পাবার জন্য কত কী করেছি। টুপুর ভালবাসায় যদি শক্তি থাকে তাহলে রুমুও ওর মনের সন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে টুপুকে আপন করে নেবে। তবে ওর মনের ওপরেও তো এখন অসম্ভব চাপ রয়েছে। বারোটা বছরের গ্লানি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে ওকে একটু সময় তো দিতেই হবে। তাই অনুরাধা যা বলছে সেটাই আমাদের করা উচিৎ। আমাদের সব কথা শুনলেই রুমু হয়তো নিজের মনের গ্লানি আর সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারবে।"
আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। এদের সকলের কথা শুনতে শুনতে ঠিক করতে পারছিলাম না, আমার এ মূহুর্তে কী করা উচিৎ। আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চাইতেই ঝুনুদি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "তুই তো জানিস না রুমু। ভাইয়ের সাথে তো তোকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি। ওকে নিয়ে তোর মনের মধ্যে কোন ফিলিংস ছিল কি না সেটাও জানিনা। আর সেটা না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু ভাই যে স্কুলে পড়বার সময় থেকেই মনে মনে তোকে ভালবাসতে শুরু করেছিল, সেটা আমার অজানা ছিল না। আমাদের ঘরে তো রুম বেশী ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি আর ভাই একঘরে ঘুমোতাম। ও যখন ক্লাস নাইনে পড়ত তখন একদিন ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে তোর নাম মুখে আনছিল। তার পরের দিন ওকে চেপে ধরতেই ও সেটা আমার কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে ওর ভালবাসা হয়ত কোনদিনই স্বার্থক পরিণতি পাবে না। তোদের আর আমাদের দুটো বাড়ির মধ্যে ভাব ভালবাসা যতই থাকুক না কেন, দুটো বিরাট বাধা যে ভাইয়ের ভালবাসার পথে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে এটা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ভাইকে তখন থেকেই বুঝিয়েছিলাম যে কাউকে ভালবাসা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমাজ সংসারের প্রথার বিরূদ্ধে গিয়ে কিছু করাটা সত্যিই খুব কঠিন। ভাইও হয়ত আমার কথার মানেটা বুঝেছিল। কিন্তু নিজের মনকে যে সে আয়ত্বে রাখতে পারেনি, তোকে যে ও নিজের মন থেকে সরাতে পারেনি সেটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ওকে মাঝে মাঝেই বোঝাতাম। একে আমাদের দুটো পরিবারের ভেতর সামাজিক জাতপাতের পার্থক্য। তার ওপর ভাই তোর চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। তাই ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের হয়ে মা বাবার কাছে কোন অনুরোধ করতে পারিনি। কিন্তু যখন তোদের বাড়ি যেতাম, তখন জেঠিমার সাথে কথা বলবার সময় আমার মনে হত জেঠিমাও ভাইকে খুব পছন্দ করতেন। হালকা কথাবার্তার মাধ্যমে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা যদি জাতের বৈষম্যটা মেনে নিতে পারি, আর ভাই যদি তোর থেকে বয়সে ছোট না হত, তাহলে তিনিও তোদের বিয়ে দিতে রাজি হতেন। মা তো আদিদাকে যতটা ভালবাসতেন তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন তোকে। বারবার বলতেন তুই যদি ভাইয়ের চেয়ে বয়সে বড় না হতিস তাহলে তোকেই আমাদের বাড়ির বৌ করে ঘরে আনতেন। আর সেদিন সকালে যখন জেঠু আর বাবা ওই দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও’সব বলাবলি করছিলেন, সেদিন আমি আর মা দু’জনেই খুব খুশী হয়েছিলাম। বাবার কলিগের বাড়িতে সে রাতে মা শুধু তোর আর আদিদার কথাই বলছিলেন। কিন্তু ওই রাতেই যে আমাদের সব স্বপ্ন ওভাবে চুড়মার হয়ে যাবে, সেটা তো আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সকালে বাড়ি ফিরে ও’সব দেখে আমরা যখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছিলাম তখনই মা বাবা বুঝে গিয়েছিলেন যে ভাই তোকে ভালবাসত। আর আমিও যে আদিদাকে পছন্দ করতাম এ’কথা তো মা আগে থেকেই জানতেন। তুই হারিয়ে যাবার পর ভাই তো প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। একদম চুপচাপ থাকত। কারুর সাথেই কথা বলত না। শুধু রাতে আমার কাছে কেঁদে কেঁদে বলত যে তোকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। রাতের পর রাত জেগে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমি মা বাবাকে কথাটা জানিয়েছিলাম। প্রায় ছ’মাস ও ঘর থেকেই বেরোয় নি। সে বছর স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাও দিতে পারেনি। তখন প্রথমে আমাদের ওখানকার ডক্টর দেব আর পরে সেই ডাক্তারের নির্দেশে ওকে কলকাতার এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ও তো বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হত। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষায় কোন রকমে শুধু পাসমার্কটুকুই স্কোর করেছিল। বাবা, মা আর আমি কোনভাবেই ওর মন থেকে তোকে সরাতে না পেরে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাতে শুরু করেছিলাম যে ডাকাতগুলো বাকি চারজনের মত তোকেও খুন করে ফেলে যায়নি মানেই হচ্ছে তুই বেঁচে আছিস। আমরা যে কোন ভাবেই তোকে খুঁজে বের করব। কিন্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর পেড়িয়ে গেল, কেউ তোর হদিশ খুঁজে বের করতে পারল না। পুলিশ গোয়েন্দা কেউ সে মর্মান্তিক খুনগুলো আর তোর কিডন্যাপিং-এর ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারল না। একটা সময় আমি তোকে ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিলেও বাবা মা কিন্তু তাদের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে তুই বেঁচে আছিস। আর একদিন না একদিন আমরা ঠিক তোকে খুঁজে পাব। ওই ডাকাতগুলো তোকে ধরে নিয়ে যাবার পর তুই কতটা দুর্ভোগ ভোগ করবি, তা আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারছিলাম। মনে মনে ভয় হত, সেসব দুর্ভোগ সহ্য করতে না পেরে তুই আবার আত্মহত্যা করে না বসিস। কিন্তু তোকে কোনভাবে ফিরে পেলে তুই যে অবস্থাতেই থাকিস না কেন মা বাবা তোকে তাদের ছেলের বৌ করে নিতে রাজি ছিলেন। তোর মামারা যেদিন খবর পেয়ে এসেছিলেন, সেদিন বাবা তাদেরকে আমাদের বাড়ি এনে খাইয়ে ছিলেন। আর আমাদের ইচ্ছের কথা তাদের জানিয়েছিলেন। তারাও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন যে তোকে পেলে আমাদের হাতেই তুলে দেবেন। রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম আমরা সবাই। ঠাকুর যেন তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। তোকে আর আমরা কেউ খুঁজে পেলাম না। একসময় পুলিশের খাতাতেও তোদের কেস ফাইল চাপা পড়ে গেল। আমাদের বিয়ের দু’দিন পরেই তো মা বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বাবা তার শেষ কথায় আমাকে আর ভাইকে বলেছিলেন যে তুই একদিন না একদিন ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবি। আর সেদিন আমরা যেন তোকে খুঁজে বের করে ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে দিই। কিন্তু এতগুলো বছরেও তোর কোন হদিস আমরা পাইনি। ভাই চাকরি পেয়ে নর্থ বেঙ্গলের একটা জায়গায় চলে গেল। আমিও শান্তুর সাথে কালিয়াগঞ্জ থেকে কোলকাতা চলে এলাম। পাঁচ বছর পর ভাইও হুগলী কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কলকাতায় ফিরে এল। আমাদের বাড়িটা বেচে দেওয়া হল। এখানে বাড়ি বানানো হল। চার বছর আগে এ বাড়িতে আসবার পর থেকে আমি ভাইকে বোঝাতে শুরু করলাম যে তোকে আর আমরা ফিরে পাব না। ও যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতে। কিন্তু আমার আর শান্তুর হাজার বোঝানো সত্বেও ভাই কিছুতেই রাজি হয়নি। ও জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তোর জন্যে অপেক্ষা করে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল। তোকে না পেলে আজীবন অবিবাহিত থাকবে বলে শপথ নিয়েছিল। আমি আর শান্তুও হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একটা সময়। মাস দুয়েক আগে ......"
শেফালী একটা বড় ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঝুনুদি তার কথা থামাল। শেফালীর পেছন পেছন আরেকজন সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। সে ভদ্রমহিলাও ট্রে হাতে নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, "দিদি, তোমাদের জন্যে একটু চা করে আনলাম। ওপরেও দু’কাপ দিয়ে এসেছি তোমার ভাইদের।"
ঝুনুদি ভদ্রমহিলার হাত ধরে বলল, "ইশ, তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি গো লিপি। তোমাকে একা একা রান্নার সমস্ত কিছু দেখতে হচ্ছে। কিন্তু আমার যে কিচ্ছু করার নেই গো। আমাকে যে এদিকে একটু থাকতেই হচ্ছে। একটু কষ্ট করে সামলে নিও প্লীজ।"
লিপি নামের ভদ্রমহিলা সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বলল, "দিদি, তুমি এমন করে কেন বলছ বল তো? টুপুদার এমন একটা খুশীর দিনে আমরা সামিল না হয়ে থাকতে পারি। বল?"
সবার শেষে আমার সামনে এসে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েই লিপি আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, "হুঁ, এবার বুঝতে পেরেছি। টুপুদা কি এমনি এমনি ভীস্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল? ইশ এমন রূপসী এক প্রেমিকাকে কোন মানুষ কি ভুলতে পারে? সত্যি গো দিদি। টুপুদার প্রেমের জোর আছে গো, মানতেই হবে।"
আমি লিপির কথা শুনে একটু লজ্জা পেতেই ঝুনুদি বলল, "রুমু, এ হচ্ছে লিপি। মানে লিপিকা সেন। টুপুর অফিসের কলিগ আর আমার ছোট ভাইয়ের মত বিদ্যুৎ সেনের বৌ। বিদ্যুতের সাথেও তোর পরিচয় হবে। এই বিদ্যুতের মুখেই আমরা তোর খোঁজ পেয়েছিলাম তিনমাস আগে। লিপি অবশ্য বয়সে তোর থেকে বেশ ছোট। তুই ওকে নাম ধরেই বলবি আজ থেকে। ওরাও আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ আর হিতৈষী।"
আমি হাতজোড় করে লিপিকে নমস্কার করতেই লিপি আমার হাতদুটো ধরে বলল, "বয়স যার যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু তোমাকে টুপুবৌদি বলে ডাকব। কিন্তু তোমার সাথে আমি আজ আর আড্ডা দিতে পারব না। রান্না কিছুটা এখনও বাকি আছে। আমি কাল তোমার সাথে চুটিয়ে গল্প করব। আসছি গো দিদি"
বলে লিপি চলে গেল। শেফালীও লিপির পেছন পেছন বেরিয়ে গেল।
ঝুনুদি এক চুমুক চা খেয়ে বলল, "নাহ, মেয়েটা ঠিক সময়ে চা নিয়ে এসেছে রে। গলাটা শুকিয়ে আসছিল আমার। তা হ্যাঁ রুমু, তারপর শোন। সেটা বোধহয় ভাইয়েরই ভালবাসার জোর। মাস তিনেক আগে এই লিপির বর বিদ্যুৎ এসে আমাকে জানাল যে ঠিক তোর মতই দেখতে একটা মেয়ের ছবি সে আরেকজনের কাছে দেখে এসেছে। আর সে মেয়েটার নাম নাকি মিনু। ওর মুখে শুনলাম তার পরিচিত কোন এক সামন্তর ফার্ম হাউসে তুই নাকি আসছিস। বিদ্যুতের মুখে সব ঘটনা শুনে আমাদের মনটা সেদিন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে তুই বেঁচে থাকলে তোর জীবনে যে এমন একটা পরিণতিই হতে পারে, সেটা তো আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। তাই দুঃখ হলেও অবাক ততটা হইনি আমরা। তখন আমরা সবাই মিলে বসে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে তুইই আমাদের হারিয়ে যাওয়া রুমু কি না সেটা আগে কনফার্ম করতে হবে। ভাইও বলল যে তুই যদি সত্যিই আমাদের রুমুই হয়ে থাকিস, তাহলে তোর এমন পরিণতিতেও সে তোকে মেনে নেবে। তখন সবাই মিলে পরামর্শ করে বিদ্যুৎকেই দায়িত্ব দিলাম তোর আসল পরিচয়টা জানতে। আমি আর আমরা সকলেই জানি বিদ্যুতের ও’সব ব্যাপারের সাথে কোন সংস্পর্শ নেই। তাই অমন পরিবেশে ওকে পাঠাতে একটু ভয়ও হচ্ছিল আমার। কিন্তু সে ভয় দুর করে দিল লিপি। লিপি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল যে বিদ্যুৎকে কিভাবে কী করতে হবে তা সে নিজেই তাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ তোকে কী করে চিনতে পারবে সেটা বুঝিয়ে দিতে বলল। তোর বাঁ কানের লতির কাছে যে একটা কালো তিল আছে, সেটা আমার জানাই ছিল। আমি বিদ্যুৎকে সেটার কথা বললাম। তারপর ওই ফার্ম হাউসে তুই যেদিন সামন্তর কাছে গিয়েছিলি সেখানে কি হয়েছিল তা তোর জানাই আছে। সেদিন রাত দশটা নাগাদ বিদ্যুৎ এসে তার মোবাইলে তোর ছবি দেখিয়ে যখন জানাল যে আমার দেওয়া আইডেন্টিফিকেশন মার্কটা মিলে গেছে তখন আমি আর ভাই আবার কেঁদে ফেলেছিলাম"
বলতে বলতে ঝুনুদি আবার ফুঁপিয়ে উঠল।
আমার মনে পড়ল ফার্ম হাউসের ওই রাতের কথা। সেনসাহেব বলে একজন সামন্তবাবুর সঙ্গে ছিল। কিন্তু সে লোকটা আমাকে ছোঁয়ও নি। তার মোবাইলে আমার ছবি উঠিয়েছিল আর আমার মুখটাকে লোকটা কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সেদিন তার ব্যবহারে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, লোকটা কোন উদ্দেশ্যে সেখানে হাজির ছিল সেদিন।
বিজলীমাসি ঝুনুদিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, "এবার তুমি একটু বিশ্রাম নাও ঝুনু। অনেকক্ষণ ধরে তুমি কথা বলছ। এরপরের কথাগুলো না হয় আমরা বলছি। রাধা এর পরের কথাগুলো তুই বল।"
অনুরাধা পেছন থেকে আমার আরও একটু কাছে সরে এসে বলল, "সেরাতে বিদ্যুৎবাবুর মুখে সব কিছু শুনেই ঝুনুদিরা বুঝতে পেরেছিল যে তুমিই তাদের রুমু। আর সে রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আর সময় নষ্ট না করে তারা তোমার ঠিকানা খুঁজে নিয়ে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। পরের দিনই বিদ্যুৎবাবু সামন্তর কাছ থেকে মাসির বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছিল। কিন্তু অমন একটা বেশ্যাপল্লীতে যাবার মত সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছিল না এরা কেউ। আর অমন পরিবেশ থেকে তোমাকে বাইরে বের করে আনতেও নানা ধরণের ঝামেলা হতে পারে ভেবে তারা কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এর প্রায় মাস দেড়েক বাদে হঠাৎ একদিন টুপুর সাথে আমার দেখা হল মেদিনীপুরে। ও কোন একটা কাজে সেখানে গিয়েছিল। টুপুর ওপর যে একসময় আমার লোভ ছিল সে তো তোমাকে আগেই বলেছি। আর টুপু যে তোমাকেই ভালবাসত, আর তোমাকেই খুঁজে যাচ্ছিল, এ’কথাও তো আমার অজানা ছিল না। আমি ওর সাথে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তোমার কোনও খোঁজ পেয়েছে কি না। তখন প্রথমে ও বলতে না চাইলেও অনেক জোরাজুরির পর আমাকে বলেছিল যে তুমি বিজলীমাসির বাড়িতে আছ। কিন্তু তোমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসবার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। জগা দালালের মুখে আমি বিজলীমাসির নাম আগেই শুনেছিলাম। তখন আমি ওকে বললাম যে আমি ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করব। জগা দালালের মাধ্যমেই আমি সে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছই। কিন্তু কোন বাড়িউলিই যে তাদের কেনা মেয়েকে কারো হাতে ছেড়ে দেয় না এটাও আমার আগে থেকেই জানা ছিল। আর তোমার মত সুন্দরী একটা মেয়েকে যে মাসিও সহজে ছেড়ে দেবে না, সেটা নিয়েও মনে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই। আমার প্রথম কাজ ছিল তুমিই আমাদের রুমু কি না সেটা নিশ্চিত করা। সেটা তো ও বাড়িতে যেদিন গিয়ে উঠেছিলাম, সেদিনই হয়ে গিয়েছিল। আরও দুটো কাজের দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। আমার দু’নম্বর কাজ ছিল তোমার মানসিকতাটা জানা। টুপুর জীবনে তুমি আসতে রাজি আছ কি না, সেটা বোঝা। চেষ্টাও করেছি তা জানার। কিন্তু তোমার মনের ভেতর যে কতটা দ্বিধা ছিল সে’কথাও এদের সবাইকে জানিয়েছি আমি। আর তৃতীয় কাজটা ছিল তোমাকে মাসির ওই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা। সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কঠিণ কাজ। সেটা নিয়েই প্ল্যান করছিলাম আমরা। কিন্তু মাসি নিজেও যে তার ছোটবেলায় তোমাদের বাড়িতে থাকত এটা তো আমার জানা ছিল না। আমি যাবার পরের দিনই তো ডক্টর ঘোষালের চেম্বারে ফুল চেকআপ করতে গিয়েছিলাম আমরা দু’জন। সেদিন ডক্টর ঘোষালের ফোন নম্বর নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম শান্তুদাকে। শান্তুদা তারপর ডক্টর ঘোষালের কাছ থেকে মাসির ফোন নাম্বার জেনে নিয়েছিলেন। মাসির সাথে ফোনে কথা বলে তিনি জানতে পারলেন যে নগদ দশ লাখ টাকা পেলে মাসি তোমাকে তাদের হাতে তুলে দেবে......."
এমন সময় মাসি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আহা, এটা তো বলবি যে আমি তখনও রুমুর আসল পরিচয়টা জানতাম না। আমি যদি সেটা জানতুম তাহলে কি আর ......."
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
SS_Sexy-এর লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereSS_Sexy-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment