CH Ad (Clicksor)

Sunday, May 25, 2014

জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস_Written By Lekhak (লেখক) [১৪শ খন্ড (চ্যাপ্টার ৪০ - চ্যাপ্টার ৪২)]

আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস
Written By Lekhak (লেখক)







।।চল্লিশ।।

সকালে চোখ খুলে দেখি, বিছানায় শুয়ে আছি। কি করে ওই অবস্থায় বিছানায় এলাম তাও জানি না। আমার মাথার কাছে দেখি মা বসে আছে। ডাক্তার এসেছেন। আমাকে পরীক্ষা করছেন, আমার তলপেট চেপে চেপে দেখছেন, ব্যাথাটা আছে না চলে আছে।

ওনার নাম ডাক্তার এস বাসু। আমাদের হাউজ ফিজিশিয়ান। সব কিছু পরীক্ষা টরীক্ষা করে বললেন, "শেষ কবে হয়েছিল, কোলাইটিস?"

আমি বললাম, "তাও সাত আট বছর আগে।"

আমাকে বললেন, "এখনো মিল্ক প্রোডাক্ট খাও তুমি?"

আমি বললাম, "না, ও তো অনেক দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি।"

ডাক্তার বললেন, "রোগটা এমনই। সামান্য কিছু থেকেই আবার ফর্ম করে নেয়। তাও ভয়ের কিছু নেই। তোমার কপাল ভাল, অত রাত্রে তোমার বন্ধু চলে এসেছিল গাড়ী নিয়ে। তোমার মা ভাগ্যিস তাকে ফোন করেছিলেন। আমাকেও ফোন করেছিলেন। আমি অত রাত্রে এসে দেখি, তোমার বন্ধু তার আগেই তোমাকে ওঘর থেকে তুলে এঘরে নিয়ে এসেছে। চোখে মুখে জল দিয়ে তোমার জ্ঞান ফেরানোর অনেক চেষ্টা করছে। আমি এসে তোমাকে আবার ওষুধ দিই। ব্যাথাটা ভাগ্যিস আর বাড়ে নি। তাহলে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হত। এখন কদিন ভারী খাবার একদম খাবে না। দু তিনদিন হালকা কিছু খাও। আর ঠান্ডা খাবার খাবে। গরম করা কোন জিনিষই নয়। তিন চারদিন বাড়ীতে পুরো রেস্ট নিতে হবে। অফিস, কাজ বন্ধ। তারপর তুমি আবার পুরোপুরি সুস্থ।"

আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, মা'কে বললাম, "কে এসেছিল মা?"

মা বলল, "শুভেন্দু।"

 -- "তুমি ফোন করেছিলে ওকে? অত রাত্রে?"

মা বলল, "কি করব বল? আমার টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে তখন। তোর যদি কিছু হয়ে যেত?"

বলেই মা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।

ডাক্তার এস বাসু মাকে বললেন, "আপনি কাঁদছেন কেন? ভয় তো যেটা ছিল সেটা কেটে গেছে। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেবেন না। কান্না থামান।"

মা'কে আমিও বললাম, "হ্যাঁ মা, কেঁদো না। তুমি তো জানোই। ব্যাথাটা যখন ওঠে, কেমন কষ্ট হয়। কাল রাতে যেন আরো বেশি বেশি করে হচ্ছিলো। সেই যে শুরু হল, তারপরেই সহ্যের বাইরে চলে গেলো।"

ডাক্তার এস বাসু হঠাৎ প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে মা'কে বললেন, "ছেলের এবার বিয়ে থা দিচ্ছেন না কেন? আপনি আর কত করবেন? এবার ঘরে বউ আসুক। ছেলেকে দেখুক।" বলেই আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, "কি দেব? তাই তো?"

আমি আর কি বলব? একটু লজ্জ্বা মতন মুখটা করে চুপ করে রইলাম। দেখছি মা এবার কান্না থামিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে। ডাক্তার এস বাসুর মুখেও হাসি। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। আমার দিকে চেয়ে মুখ গম্ভীর করে ডাক্তার বাসু বললেন, "বিদিশা কে?"

আমি অবাক। এই বিদিশার নাম, ডাক্তার এস বাসু জানলেন কি করে? বেশ খানিকটা বোকা বোকা মতন হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রয়েছি ডাক্তারের দিকে। উনি বললেন, "কাল রাত্রে তুমি বিছানায় শুয়ে কতবার বিদিশার নাম করেছো, সেটা কি জানো?"

দেখছি আমার মা'ও কথাটা শুনে চুপ করে রয়েছে। তারমানে কালরাতে আমি সত্যি অনেকবার বিদিশার নাম উচ্চারণ করেছি, অথচ আমার নিজেরই খেয়াল নেই।

ডাক্তার বাসু বললেন, "পারো যদি ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করে নাও। তোমার মা'ও তাহলে অনেকটা হালকা হবেন। কাল তোমার জন্য উনি যা টেনশনে পড়ে গেছিলেন, বলার নয়। আর ভাগ্যিস তোমার ওই বন্ধুটাও চলে এসেছিল অতরাত্রে।নইলে একা যে উনি কি করতেন, সেটাই ভাবছি।"

ডাক্তার বাসু এবার উঠে পড়লেন। যাবার আগে বলে গেলেন, "আজকের দিনটা অন্তত বিছানা থেকে উঠে বেশি হাটাহাটি কোরো না। একদম বেড রেস্ট। পেটের ওপর চাপ পড়বে তাহলে। ঘরের মধ্যেও চলাফেরা করার দরকার নেই। এ বেলাটা শুয়েই থাকো। পারলে সন্ধেবেলা একটু সো্ফার ওপরে গিয়ে বোসো। কিন্তু সেটাও অবস্থা বুঝে। আর আমি তোমার মা'কে বলে যাচ্ছি, যে ওষুধগুলো আমি লিখে দিয়েছি, ওগুলো উনি একটু কষ্ট করে কাউকে দিয়ে আনিয়ে নেবেন। ব্যাস্। কয়েকদিন খেলেই তুমি পুরোপুরি ফিট। তখন অফিস, কাজকর্ম্ম কোনো কিছু করতেই আর অসুবিধে হবে না।"

ডাক্তারকে এগিয়ে দেবার জন্য মা'ও ওনার পিছু পিছু গেল। আমাকে বলে গেল, "তুই শুয়ে থাক। আমি ওনাকে এগিয়ে দিয়ে এক্ষুনি আসছি।"






।।একচল্লিশ।।

শুয়ে শুয়ে ভাবছি, কি একটা মেয়ের সাথে আমি প্রেম করেছি। জীবন জুড়ে শুধুই বিষন্নতা। এই ভাবি, আমার জীবনটা বুঝি আশার আলো দেখতে শুরু করেছে, পরমূহূর্তেই আবার কালো অন্ধকার। ঠিক যেন দূঃস্বপ্নের মত প্রেম। একটা বিড়ম্বনা, মনের কষ্ট। প্রেম যেন এখানে অলৌকিক, এর কোনো বাস্তবতা নেই। আমি চিরকাল ভালবাসার কাছে নতজানু হয়ে থাকলাম। কিন্তু ভালবাসাকে সেভাবে ফিরে পেলাম কই? এরপরেও আমি বিদিশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো, বিড় বিড় করে ওর নাম উচ্চারণ করে যাবো, কাল যেমনটি করেছি। লোকে বলবে, আমি বোধহয় পাগল। পৃথিবীতে বিদিশা ছাড়া আর বুঝি মেয়ে নেই। পৃথিবীর সব লোকেদের হৃদয় বড় হয়ে যায় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে। আর আমার ক্ষেত্রে হবে ঠিক উল্টো। আমার বয়সটা বেড়ে যখন একদিন ষাট সত্তর বছর হবে, সেদিনও বোধহয় আমার হৃদয় ওই বিদিশাকে দিয়েই বসে থাকবে। লোকে বলবে, কি এক পাগলের প্রেম কাহিনী শুনছি। জীবনের এমন কাহিনী পড়লে লোকে প্রেম করাও ছেড়ে দেবে। 

বিদিশার চিন্তা ছেড়ে এবার আমার মনটা একটু শুভেন্দুকে নিয়ে পড়ল। অতরাত্রে কাল শুভেন্দু চলে এসেছে মায়ের ডাকে। সত্যিকারের জাত বন্ধু বলতে যা বোঝায়, সে হল, শুভেন্দু। আমার কপালে প্রেমটা স্থায়ী না হলেও বন্ধুটা খুবই ভাল জুটেছে। সময় অসময়ে শুভেন্দু সবসময় আমার পাশে। এত দরদ, বন্ধুপ্রীতি, অন্তরের টান। শুভেন্দুর সাথে আমার এই সম্পর্কটা টিকে যাবে আজীবন। ওর উপকারের কথা চিন্তা করতে করতে এবার আমার চোখে একটু জল এসে গেল। মা সেই সময় ঘরে ঢুকলো। আমাকে বলল, "কি রে, তোর আবার কি হল?"

আমি বললাম, "তা নয়, আসলে শুভেন্দুর কথা চিন্তা করছিলাম। তাই....."

আমার মাথার কাছে এসে বসলো মা। আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, "সত্যি হীরের টুকরো ছেলে। অতরাত্রে ওকে পাবো কিনা? ও আসবে কিনা? একটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমার চিন্তাটা কাটিয়ে দিল শুভেন্দুই। আমাকে বলল, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মাসীমা, আমি ঠিক আধঘন্টার মধ্যেই আসছি। শুধু বাড়ীর নিচে থেকে এসে আমি আপনাকে ডাক দেবো। আপনি দরজাটা খুলে দেবেন। ঠিক তাই। আধঘন্টার মধ্যেই দেখি, গাড়ী চালিয়ে সটান চলে এসেছে এখানে। ঘরে ঢুকেই আমাকে বলল, কই দেব কোথায়? তুই তখন খাওয়ার ঘরে মেঝেতে পড়ে রয়েছিস। তোর কোনো জ্ঞান নেই। তোকে ও একাই তুলে নিয়ে চলে এলো এ ঘরে। ততক্ষনে ডাক্তার বাসুও চলে এসেছেন। আমাকে একপ্রকার শুভেন্দুই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে কালকে। ডাক্তার চলে যাবার পরও ও অনেকক্ষণ ছিল। যাবার আগে বলেও গেল, দেবকে বলবেন, আমি কাল আবার আসবো। ফোন করবো। আর আপনি কিছু ভাববেন না। যদি আবার কোন সমস্যা হয়। আমাকে ডাক দেবেন। আমি ঠিক চলে আসবো।"

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু শুভেন্দু। ঠিক যেন লাখে একটা বন্ধু অমন জোটে কপালে। অত রাত্রে মা'র ডাকে যখন এক কথায় চলে এসেছে, তখন বিদিশাকেও নিশ্চই ফোন করে বলবে, শুভেন্দু। - "দেবের শরীর খারাপ। পারিস যদি দেখে আয় একবার।"

সত্যি কি বিদিশা তখন আসবে?

মা বললো, "তোকে একটা কথা বলা হয়নি। শুভেন্দু একটু আগেই ফোন করেছিল, সকালে উঠেই তোর খবর নিয়েছে। আমাকে বলল, দেবকে বলবেন, আমি ঠিক দুপুর বেলা আসছি। তারপর যতক্ষণ পারবো, আপনাদের ওখানে থাকবো। বিকেল বেলা হয়তো আমার বোন আর ওর স্বামী রনিও আসতে পারে। সবাই ওর কথা শুনে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সবাই দেবকে খুব ভালবাসে। আজ সকালে ওদের দুজনকে দেবের শরীর খারাপের কথা বলেছি। ওরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।"

আমি মনে মনে ভাবলাম, রনিকে আর মাধুরীকে আমার শরীর খারাপের কথা বলেছে শুভেন্দু। বিদিশাকে বলে নি? তাহলে নিশ্চই বিদিশাও একবার আসতো।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "কি ভাবছিস?"

আমি বললাম, "কই কিছু না তো?"

মা আমাকে বলল, "আর কি কাউকে ফোন করব? তোর মোবাইলটা থেকে কাকে কাকে ফোন করতে হবে বল? আমি করে দিচ্ছি।"

আমি বললাম, "আর কাউকে করতে হবে না। তুমি চুপ করে বসো তো। রনি আর মাধুরীরা আসবে। তাহলেই হবে। আর কাউকে ফোন করার দরকার নেই।"

মা বলল, "বিদিশাকে তোর শরীর খারাপের কথা জানাবি না?"

আমি অবাক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা যেন আমার প্রতি বিদিশার সত্যিকারের ভালবাসাটা এবার পরখ করে দেখে নিতে চায়। আমার শরীর খারাপের খবর শুনে বিদিশা আসে কিনা মা হয়তো সেটাই দেখতে চাইছে। নিশ্চই বিদিশা আসবে। কেন আসবে না? কিন্তু মা জানে না পরিস্থিতি কতটা প্রতিকূল। ঠিক এই মূহূর্তে বিদিশাও একটা জ্বালা যন্ত্রণায় মরছে, ঠিক আমারই মতন। বাঁধভাঙা বন্যার মতন হয়তো দূঃখ আর আফশোস আছড়ে পড়ছে বিদিশার জীবনে। কেউ ওর পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে। বিদিশা স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবনে ফিরতে পারবে না যতক্ষণ না ওর ডিভোর্সটা হচ্ছে। চিন্তা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হয়তো মুক্তি পেতে পেতে আরো কেটে যাবে কিছুদিন। কারণ আমি যে মাকে এখনো আসল কথাটা বলে উঠতে পারিনি। ওই শুভেন্দুই আমাকে বারণ করে রেখেছে।

টেবিলের ওপরে রাখা আমার মোবাইলটা ঠিকই তখনই বাজতে শুরু করেছে। মা উঠে বলল, "দাঁড়া, আমি দেখছি আবার কে ফোন করলো?"

ফোনটা ধরে মা হ্যালো বলাতেই আমি ভাবছি, কে আবার ফোন করলো? ঠিক তখনই মা দেখি কাকে বলছে, "হ্যাঁ দেবের তো খুব শরীর খারাপ। কাল রাতে খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। এখন ভালো আছে।"

আমি মা'কে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলাম, "কে ফোন করেছে মা?"

মা বলল, "শুক্লা, তোর সেই বন্ধুটা। যে এসেছিল আমাদের বাড়ীতে।"






।।বিয়াল্লিশ-১।।

শুক্লা ফোন করেছে, আমার শরীর খারাপের খবর শুনেছে যখন নিশ্চই আসবে। এরা আমাকে সবাই ভালবাসে। দেবের কিছু হলে সবার একটু চিন্তা হয় বৈকি। অসুখটাতো নতুন নয়। এর আগে কলেজে পড়ার সময়ও একবার বাড়াবাড়ি হয়েছিল। সেবার মনে আছে কলেজে বেশ কিছুদিন ধরে যাচ্ছি না বলে, সবাই এক এক করে আমার বাড়ীতে এসে হাজির হচ্ছে। প্রথম দিনই শুক্লা এসে বলল, "কি হয়েছে তোর? কলেজে যাচ্ছিস না। জানিস, আমাদের সবার মন খারাপ। দেব, আর কিছুদিন পরেই কলেজে অ্যানুয়াল ফাংশন। তার আগে তুই সুস্থ হয়ে উঠবি তো?"

আমি জানি অ্যানুয়াল ফাংশন আমাকে বাদ দিয়ে হবে না। দেবের উপস্থিতি না থাকা মানে সবারই মুখে এক কথা। - "দেব নেই। তাহলে কি হবে? যেভাবে ও সবকিছু সুন্দর ভাবে পরিচালনা করে, ওকে বাদ দিয়ে এই অনুষ্ঠান করা যায় না কি? তাছাড়া দেবের গান, ওর গান শোনবার জন্য তো উন্মুখ সবাই।"

আমি জানি স্বয়ং প্রিন্সিপাল ও আমাকে স্মরণ করেছেন। এই একটা সময়। যেখানে সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিভাবে গোটা অনুষ্ঠানটা সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করা যায়। কাকে কাকে শিল্পী হিসেবে বাছাই করা হবে। কে গাইবে, কে নাচবে আর কে আবৃত্তি করবে। আমি ছাড়া যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে সবাই।

শুক্লাকে বললাম, "আশা তো করছি দুতিনদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাব। আসলে আমার এই রোগটাই বড় বাজে। কখন শরীরের মধ্যে এসে হানা দেবে, আগে থেকে বোঝা খুব মুশকিল।"

শুভেন্দু এসে বলল, "স্যার বলছেন, হেমন্ত মুখার্জ্জী এই মারা গেলেন সবে। দেবকে বলো এবারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে ফাংশনটাকে অর্গানাইজ করতে। কিন্তু তুই যেভাবে রোগ বাঁধিয়ে বিছানায় বডি ফেলে দিয়েছিস, তুই ছাড়া এসব করবে কে?"

শুভেন্দুকে বললাম, "সারা কলেজে একটা ছেলে নেই? সবাই যেন প্রেম করাতেই ব্যস্ত। তুইও যে কি করলি, আমার মত গানটা শিখতে পারতিস তো।"

শুভেন্দু বলল, "যাকে দিয়ে যে কাজ হয় না, তাকে বলে কোন লাভ আছে কি? তুই আমাকে দিবি দায়িত্ব? তারপর কি করতে কি করে বসব। আর সবাই আমাকে গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিক আর কি?"

ওকে বললাম, "তোকে যা যা বলছি, তুই শুধু তাই করবি। বাকীটা আমি সুস্থ হয়ে সামলে দেবো।"

শুভেন্দু বলল, "তা আমাকে কি করতে হবে স্যার?"

আমি বললাম, "ডেকোরেটর ঠিক করবি, মাচা বাধার জন্য। শুধু এইটুকুই তোর দায়িত্ব।"

শুভেন্দু বলল, "ও তাই বল। এ আর এমন কি দায়িত্ব। আমি ভাবলাম, তুই বুঝি আমাকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দায়িত্ব দিবি বোধহয়।"

আমি বললাম, "তুই যদি বলিস, তোকে একটা চান্স দিতে পারি। একবার ট্রাই করে দেখতে পারিস। আমার মন বলছে, তুই ঝোলাবি না।"

শুভেন্দু থতমত খেয়ে বলল, "কিসের চান্স?"

আমি বললাম, "খালি গলায় দুলাইন গেয়ে দিবি। তোকে আমি ট্রেনিং দিয়ে দেবো।"

শুভেন্দু বলল, "ক্ষেপেছিস। গান গাইব আমি? হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে তারপর সব মাটি করি আর কি? শেষকালে সব বদনাম হয়ে যাক, আর কি?"

আমি বললাম, "কেন? দুলাইন গাইলে কি এমন অসুবিধে হবে? তোকে ট্রেনিং দেবো। বলছি তো? তাছাড়া কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্যও তো একঘন্টার একটা পার্ট থাকে। তার মধ্যে তুই দুলাইন গাইবি। কেউ কিছু মনে করবে না।"

শুভেন্দু বলল, "সুনীল দত্ত আর কিশোরকুমারের পড়োশান ছবিটা দেখেছিস? অনেক চেষ্টা করেও যখন কিশোরকুমার পারল না। তখন ওকে বলল, গানের সাথে শুধু লিপ মেলাতে। প্রথমে সুনীল দত্ত অনেক চেষ্টা করেছিল, গলা দিয়ে গাধার ডাক ছাড়া আর কিছুই বেরোয় নি। মাইরি দেব, তোকে সত্যি কথাটা বলছি, আমাকে তুই যদি চেষ্টা করিস, তাহলে ওই দত্ত সাহেবের মতই অবস্থা হবে আমার। তারপর সকলে আওয়াজ মারুক, হাসি ঠাট্টা করুক। ও আমি সইতে পারবো না। একটা কাককে বলছিস কোকিল হতে। তুই কি করে পারিস?"

আমি বললাম, "তুই যেভাবে বলছিস, তাতে মনে হচ্ছে, সায়রা বানু গান শুনবে অডিয়েন্সে বসে। তোর গান শুনে তোর প্রেমে পড়বে। এত ভয় পাওয়ার কি আছে বু্ঝি না। তাও যদি তুইও কারুর প্রেমে পড়তিস?"

চিরকাল যে আমার কথায় শুধু হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছে, শুধু এই একটি ব্যাপারেই ও যে রাজী হবে না আমি জানতাম। আসলে ওর সাথে মজা করবার মত একটা বিষয় পেয়েছিলাম বলে নাছোড়বান্দার মত আমিও ওর পেছনে লেগে ছিলাম। শুভেন্দু শেষ কালে বলল, "এই যে শোনো মহাশয়, আমাকে দিয়ে যখন অতই গান গাওয়ানো তোমার শখ। তখন তোমার বিদিশাকে দিয়ে একবার ট্রাই করে দেখো না। তিনি গাইবেন। আশাকরি তিনি তোমার কথা ফেলতে পারবেন না।"






।।বিয়াল্লিশ-২।।

আসলে বিদিশাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর আইডিয়াটা আমারো মাথায় আসেনি। তাছাড়া বিদিশা তো শুধু গান শুনতে ভালবাসে। ও কি গাইবে? তাছাড়া জোর করে সুযোগ দিলে পক্ষপাতীত্বর একটা ব্যাপার চলে আসে। সবাই বলবে, ও যেহেতু বিদিশা দেবের সাথে প্রেম করে, সুতরাং ওরজন্য একটা গোটা স্টেজ তুলে দিয়েছে দেব। আদিখেত্যা ছাড়া আর কি?

আমি বললাম, "বিদিশা তোরই মতন। একটু ভীতু টাইপের। অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়। প্রথমেই আমাকে ও না বলবে। তারপর জোরাজুরি করলে কান্নাকাটি শুরু করে দিতে পারে। তার চেয়ে বরং ওকে একটা কবিতা পাঠ করার জন্য বলব।"

শুভেন্দু বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "বিদিশা কবিতা পাঠ করবে? সত্যি করবে? উফঃ। দারুন হবে কিন্তু তাহলে ব্যাপারটা।"

তারপরেই আবার মুখটা উদাস মতন করে ও বলল, "কিন্তু তোর জন্য তার মন এখন খুব খারাপ। দেবের শরীর খারাপের খবর শুনে তিনি বিষন্ন হয়ে পড়েছেন। এই তোর কাছে এলো বলে। কালই কলেজে আমাকে বলেছে, ওর জন্য আমার ভীষন খারাপ লাগছে। কিছু ভাল লাগছে না। ওর শরীর খারাপ। আমাকে এখুনি ওর কাছে যেতে হবে।"

বিদিশা এল, শুভেন্দু থাকাকালীনই। এসেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ। অসুখ থেকে সেরে না ওঠা পর্যন্ত বিদিশা ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েছে আমার জন্য। আমাকে গাদা গাদা উপদেশ দিয়ে কতকিছু একনাগাড়ে বলে গেল বিদিশা। - "শোনো, এই অবস্থায় নিজেকে একদম নেগলেট করবে না। নিয়ম করে ওষুধ খাবে বুঝেছো? আর ডাক্তারের কথার একদম অমান্য করবে না। শরীর তাড়াতড়ি সুস্থ না হলে, আমাদের তখন কি হবে বলো তো? তুমি আমাকে কত চিন্তায় ফেলে দিয়েছো জানো?"

শুভেন্দুও ঠিক পাশেই বসে আছে। দেখছে, বিদিশা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হেসে বলল, "এই তো বিদিশা এসে গেছে। তোর আর চিন্তা নেই। তুই এমনি ভাল হয়ে যাবি।"

বিদিশাকে বলল, "শোন, তুই এই কদিন দেবের এখানেই থেকে যা। দেবের আদর যত্ন করবি। ওকে সেবা শুশ্রসা করবি। ওর শরীর সুস্থ হওয়াটা দরকার। সামনেই অ্যানুয়াল ফাংশন আছে না।"

বিদিশা মুখ বেঁকিয়ে বলল, "গুলি মারো অ্যানুয়াল ফাংশন। এদিকে আমার বরটার শরীর খারাপ। আর সবাই ফাংশন নিয়ে পড়েছে। আগে ওর শরীর সুস্থ হবে। তারপর ওসব ফাংশন নিয়ে কথা।"

বিদিশা আমার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে হঠাৎ। আবেগ অনুভূতি নয়। দেখছি, আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলছে, "তুমি সুস্থ হয়ে যাও গো। ভগবান, তুমি আমার বরটাকে সুস্থ করে দাও। সুস্থ করে দাও ভগবান। প্লীজ প্লীজ।"

শুভেন্দু হাঁ করে বসে দেখছে বিদিশার কান্ড। পরে আমাকে খুব সিরিয়াসলি একদিন বলেছিল। - "দেব সত্যিকারের ভালবাসা মানুষ বোধহয় একবারই বাসতে পারে। গভীর ভালবাসার সত্যি কি কোন বিকল্প হয়? যে সব মানুষ উদভ্রান্তের মতন বারে বারে প্রেমে পড়েন, দুর্বিবাকের মতন প্রেম যাদের জীবনে বারে বারে আসে। সত্যিকারের মহান প্রেমিক তাদেরকে বলা যায় কি? তোকে আর বিদিশাকে দেখে মনে হয়, সত্যি তোরা জীবনে আর কাউকে কোনদিন ভালবাসতে পারবি না। তোদের এই মহান প্রেমের জয় হোক।"

আমি সেদিন জানতাম না। প্রেম হল মানুষের জীবনে এক বজ্রপাত। এই প্রেমের বজ্রপাত একবার ঘটলে হৃদয়ভূমির সবকিছুই জ্বলে পুড়ে নিঃশ্বেস হয়ে যেতে পারে। আর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাতে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার বা নতুন করে প্রেমতরু অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার কোনো অবকাশ থাকে না।

আমি মানুষটা এমন নই। যে জীবনে বহুবার কোন না কোন নারীর প্রেমে পড়তে পারি আর প্রতিবারই মনপ্রাণ ঢেলে তাকে বিদিশার মতন ভালবাসতে পারি। এই বিদিশাই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ প্রেম। আমার জীবনে দ্বিতীয় প্রেম আসা তাই অসম্ভব।

সবাই যেটা মনে প্রাণে চেয়েছিল, চেয়েছিলাম আমিও অন্তত। সেটা কিছুতেই সফল হল না। শুভেন্দুকে বলেছিলাম, "আমার যখন যখন পঞ্চাশ বছর বয়স পেরিয়ে যাবে, তখনও দেখবি বিদিশার সাথে আমার প্রেম অটুট থাকবে। ও এমনি করেই আমাকে ভালবাসবে।"

হেসেছিল শুভেন্দু। আমাকে বলেছিল, "ভগবান করুক, তাই যেন হয়। এমন প্রেম জীবনে আসা মানে সেটা স্বপ্ন সমান। পঞ্চাশ বছর পরেও এক গভীর ও জীবন্ত প্রেমের মাঝে ডুবে থাকা যে সৌভাগ্যের কথা। এমন প্রেমের পূজো যে করতে পারে, তার জীবন যে কি সুখের আর আনন্দের হয়, তা তো বলাই বাহুল্য। তোদের এই অমর প্রেমের জয় হোক।"

শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ ধরে পুরোনো কথাগুলো চিন্তা করছিলাম। মা বললো, "আবার তুই পুরোনো কথা ভাবছিস, আর মনকে কষ্ট দিচ্ছিস? বললাম না শুভেন্দু একটু পরেই এসে পড়বে। অত কি চিন্তা করছিস?"

আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। মাকে বললাম, "মা শুভেন্দু আসবে বলেছে। খবর পেয়ে বিদিশাও আসবে। আমার মন তাই বলছে। তুমি দেখে নিও।"






কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 




লেখক(Lekhak)-এ লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

লেখক(Lekhak)-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment