CH Ad (Clicksor)

Sunday, May 25, 2014

জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস_Written By Lekhak (লেখক) [১৩শ খন্ড (চ্যাপ্টার ৩৬ - চ্যাপ্টার ৩৯)]

আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।




জীবন যে রকম - একটি উপন্যাস
Written By Lekhak (লেখক)








।।সাঁইত্রিশ-১।।

পরের দিন মিনুর বাড়ীতে বেশ কিছু ঘন্টা আমি ছিলাম। ও কিন্তু একবারও বুঝতে দেয় নি ওর অভিসন্ধিটা। আমার কাছ থেকে বিদিশার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, বিদিশাকে ফোনও করেছিল, অথচ আমাকে বিদিশা সেকথা বললেও মিনু একবারও তা বলেনি।

বিদিশা ভাবতেই পারেনি, মিনু ওকে ফোন করবে। ফোনটা যখন করেছে, বিদিশার মা ধরেছিল। মিনু নিজের পরিচয় দেয় নি। বিদিশা এসে ফোনটা ধরতেই ওকে ঠেস মেরে বলেছিল, "কাল তো দেব আসছে আমার বাড়ীতে। তুমি আসবে নাকি?"

আমাকে একনাগাড়ে কত কিছু বলে গেল বিদিশা। মিনুর বাড়ী থেকে ফেরার পর ফোন করে আমাকে বলল, "শখ মিটেছে তোমার? আঁশ মিটেছে? ধন্যি মেয়ে বাপু। এখনো তোমার পিছন ছাড়ে না।"

সেদিন বিদিশার মুখে ওই কথা শুনে মিনুর ওপরে আমিও খুব চটে গিয়েছিলাম। ভাবিনি আরো কত পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে রেখেছে মিনু। তার কিছুদিন পরেই ঘটল আর একটি মারাত্মক ঘটনা।

সেদিন ছিল রবিবার। মা বলল, সোদপুরে আমার বড়মামার বাড়ীতে যাবে। বাড়ীতে রান্না সব করাই আছে। শুধু ভাতটা ফুটিয়ে নিলেই হবে। বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা বলল, "বাড়ীতে একা রয়েছ বলে আমাকে ডাকছ? কি করবে তুমি?"

আমি বললাম, "কেন এর আগে যখন একা ছিলাম, তুমি বুঝি কোনদিন আসোনি আমার বাড়ীতে? মা, এই একটু পরেই বাড়ী থেকে বেরোবে। তারপরে সারাদিন আমি শুধু একা। এই মূহূর্তে একজনকে আমার খুব দরকার। বিদিশা ছাড়া আর কারুর নাম এই মূহূর্তে মনে করতে পারছি না।"

বিদিশা বলল, "বাহ্ আমাকেও তো বলে বেরোতে হবে। রবিবারে বাড়ী থেকে বেরুচ্ছি। বাড়ীতে বললেই তো বুঝে যাবে। মা বাবা তো জেনেই গেছে, তোমার বাড়ীতে যাবার জন্য আমি সবসময় পা বাড়িয়ে রয়েছি।"

বিদিশাকে বললাম, "শোন বিদিশা। আমি তোমার সাথে ছাড়া আর কারুর সাথে তো প্রেম করিনা। ফুলশয্যার রাতে স্বামী যেটা তার স্ত্রীর সাথে করে, সেটা যদি এই ফাঁকা বাড়ীতে হয়ে যায় মন্দ কি? সুযোগকে কখনো পায়ে ফেলতে নেই। একা একা বাড়ীতে বসে তোমার স্বপ্ন দেখবো, অথচ তুমি আসবে না এটা কি কখনো হয়? কখন আসবে বলো। মা কিন্তু ঠিক এক ঘন্টা পরেই বেরুবে।"

বিদিশা ফোনেই বলল, "তুমি কি করবে আমাকে? বিয়ের আগেই ফুলশয্যা সেরে নেবে? দাঁড়াও মাসীমাকে আমি বলছি।"

ওকে বললাম, "দেখো সৌগত বিয়েটা সেরে নিচ্ছে। তোমার আমার বিয়েটাও হয়তো হয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যে। বিয়ের আগে ফুলশয্যার প্র্যাকটিসটা করে নিতে অসুবিধে কি? মা তো সেই সুযোগই আমাদের করে দিয়ে যাচ্ছেন।"

একটু যেন ঘাবড়ে গেল বিদিশা। আমাকে বলল, "এই না। তারপরে কি থেকে কি হয়ে যাবে। মরি আর কি? ওসব শখটক তোমার পূরণ হবে না বাপু। বলো তো এমনি আমি যেতে পারি।"

আমি বললাম, "আচ্ছা বিদিশা? তুমি আসবে, আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। তোমার শরীর আমাকে ছুঁয়ে যাবে, আমার হৃদয়কে চঞ্চল করে তুলবে। সেই আশা নিয়েই তো আমি তোমাকে ডাকছি। তোমার কি মনে হয় না প্রেম মানেই একটা নিবিড় মূহূর্ত? যেখানে প্রেমের সাথে থাকবে একটু চুমোচুমি। নারীর সাহচর্য এক মধুর অনুভূতি। এর থেকে আমাকে কেন বঞ্চিত করছ বিদিশা? তুমি কি চাওনা মাঝে মধ্যে এই সখগুলো আমি পূরণ করি। মাঝে মধ্যে গোপন খেলাটা খেললে অসুবিধা কি বিদিশা? তুমি এখুনি চলে এস। দেরী কোরো না।"

বিদিশা একপ্রকার নাই বলে দিল আমাকে। আমাকে বলল, "তোমার গোপন খেলা আমি বার করছি। আজ তুমি জব্দ। বেশ হয়েছে। আজ বাড়ীতে একা থাকো। আমি আর যাচ্ছি না।"

একটু হতাশই হলাম। ভাবলাম, ঠিক আছে বিদিশা যদি না আসে, ঘুরতে ঘুরতে বিকেলবেলা ওর বাড়ীতেই চলে যাব। সময়টা কিছুটা হলেও অন্তত কাটবে। বিদিশা না থাকলে, কিছুই আমার ভাল লাগে না।

মা একটু আগেই বড়মামার বাড়ীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল এগারোটা। সারাটা দিন বাড়ীতে বসে কি করব তাই ভাবছি। হঠাৎই দরজায় কলিংবেল। ছুটে গেলাম। ভাবলাম, বিদিশাই এসেছে বোধহয়। আমাকে চমকে দেবার জন্যই না বলেছে তখন ফোনে। আমার সাথে মজা করতে বিদিশাও খুব ভাল পারে।

দরজা খুললাম। সামনে দেখি বিদিশা নয়। মিনু দাঁড়িয়ে। এক গাল হেসে আমাকে বলছে। "চমকে গেছিস না? আসলে তোদের বাড়ীর খুব কাছেই একটা দরকারে আমি এসেছিলাম। ভাবলাম, একটু ঢুঁ মেরে যাই। আজ তো রবিবার। তুই নিশ্চই বাড়ী থাকবি। তা আমাকে ভেতরে আসতে বলবি না? নাকি দরজা থেকেই বিদায় করে দিবি।"

মিনু হাসছে। আর আমি ভাবছি, এ আবার অসময়ে কেন এল? কি মুশকিল, বিদিশাও যদি আবার এখন এসে পড়ে?







।।সাঁইত্রিশ-২।।

মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়েই ওকে ঘরে ঢোকালাম। আমার মন বলছিল, হঠাৎ মিনুর আগমনটা উদ্দেশ্যপ্রনোদীত। মাঝে মাঝে এত ন্যাকামি করে মিনু, বিরক্তিতে গা জ্বলে যায়। ওর এই গায়ে ঢলানি স্বভাবটা আমি জানি, যতদিন কলেজে পড়েছি, মিনু আমার পিছু ছাড়েনি। এতদিন পরে গায়ে পড়ে এসে আবার মাঝে মধ্যেই আমার বাড়ীতে এসে হানা দিচ্ছে, এটা একধরণের ফন্দী ছাড়া আর কিছুই নয়। আগের দিন ও বাড়ীতে গিয়ে, পুনরায় ওর বোনকে গান শেখানোর জন্য ভীষন কাকুতি মিনতি করছিল মিনু। আমি একপ্রকার না-ই করে দিয়েছি। রীনা একটু দূঃখ পেয়েছে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি জানি, যতক্ষণ আমি রীনাকে গান শেখাব,মিনু এসে সামনে বসে থাকবে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। চোখের পাতা পড়বে না। ওর ওই দৃষ্টিতে আমার ভীষন অস্বস্তি হবে। মনোসংযোগে চীড় ধরবে। বলা যায় না রেগেমেগে ওকে কিছু বলেও দিতে পারি। মিনু অবশ্য এসবে অভ্যস্ত। আমার কাছে না শুনেও সেই একপ্রকার আমার পায়ের উপরেই সে পড়ে আছে।

মনে পড়ে কলেজে যেদিন মিনুকে প্রথম দেখেছিলাম, ও একটা কালো রঙের শাড়ী পড়ে এসেছিল। বগল কাটা ব্লাউজ। শাড়ীতে যত না ওকে আকর্ষনীয়া লাগছিল, তার থেকেও বেশি ঠিকরে পড়ছিল ওর নির্লজ্জ্বতা। মিনু বেশ ব্যাটাছেলেগুলোকে ধরে ধরে জবাই করতে পারে। কেন জানি না আমাকেও ও অত চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই সফল হয়ে দেখাতে পারল না। মিনুর বেশ আফশোসও হয়েছিল।

বিদিশার জন্যই ওকে এই হারটা স্বীকার করতে হয়েছিল, তাতে অবশ্য ওর কোন দূঃখ নেই। রীনাকে গান শেখাতে রাজী হয়ে যাওয়াটা মিনুর কাছে একপ্রকার মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতন। ঠিক দুদিন আগেই ও আমাকে এসে বলল, "দেব, আমার সন্মন্ধে অনেকে বাজে বাজে কথা সবাই বলছে, আমি কিন্তু এতটা নির্লজ্জ্ব নই। নিজের স্বার্থকে আমি কখনই বড় করে দেখি না। তুই ভাবিস, আমি খুব খারাপ। তাই আমার বাড়ীতে তোর যেতে ইচ্ছে হয় না, তাই তো? আজ থেকে তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশা যেমনটি আছে, ঠিক তেমনটিই তোর থাকবে। আমি তোদের মাঝে আর মাথা গলাবো না।"

তাও মনটা ভীষন খুচখুচ করছিল। শেষে মেষে এই সৌগতই আমাকে ভরসা দিল। বলা যায় ওর কথাতেই শেষপর্যন্ত আমি রীনাকে গান শেখাতে রাজী হয়ে গেলাম।

সেই প্রথমদিন থেকে সপ্তাহে একদিন করে আমি মিনুর বাড়ীতে আমি যেতাম। একঘন্টা রীনাকে গান শেখাতাম। মিনু সামনে এসে বসে থাকতো। আমার গান শুনতো। কিন্তু আমার প্রতি ওর দূর্বলতার কথা কখনো আর বলেনি। কলেজের শেষ কটাদিন, আমার সাথে দেখা হলে শুধু কথা বলত। কিন্তু ওর হাবভাবে, ওর আচরণে সেরকম কিছু আমার চোখে পড়ত না।

কলেজ ছাড়ার দুমাস বাদে আমি যখন মিনুর বাড়ী যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, তখন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিদিশার আপত্তি ছিল, সে কথা আমি আগেই বলেছি। একদিন বিদিশা এল কলেজে মুখ ভার করে। আমার সাথে সেভাবে ভাল করে কোন কথা বলছে না। ভেতরে ভেতরে যেন কোন চাপা রাগ, রাগটা ঠিক আমাকে দেখাতেও পারছে না। অথচ আমি ধরেই নিয়েছি, ওর মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে কিছু একটা শঙ্কা রয়েছে।

একটু জোর করতেই বিদিশা বলল, "তুমি প্রনব বলে কাউকে চেনো?"

আমি বললাম, "প্রনব বলে সেরকম তো আমি কাউকে চিনি না। সে কি আমাদের কলেজে পড়ে?"

বিদিশা বলল, "সেভাবে ওকে কোনদিন কলেজে আমিও দেখিনি। কালকে হঠাৎই তোমার সন্মন্ধে আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলল, আমার মনটাকে খারাপ করার চেষ্টা করছিল ছেলেটা। কে ও?"

ওকে বললাম, "মুখ না দেখলে কি করে বুঝব? আর আমার সন্মন্ধে খারাপ কথা বলবেই বা কেন সে তোমাকে? কি করেছি আমি? কারুর ক্ষতি করেছি?"

বিদিশা বলল, "প্রথমেই সে আমাকে বলল, দেব তো গেল ফসকে। এবারে কি করবে তুমি?"

আমি বিদিশাকে বললাম, "মানে?"

বিদিশা বলল, "আমার ইচ্ছে করছিল ছেলেটার মুখের ওপরে একটা চড় কসাতে। সবকটা দাঁত বার করে আমার মুখের সামনে এমন বিশ্রীভাবে টোনটিটকিরি কাটছিল ছেলেটা। ভীষন রাগ হচ্ছিল। আমি ওর কোন কথা শুনতে চাই না। তাও জোর করে আমাকে বলল, দেব তোমাকে নিয়েও খেলছে, আবার মিনুকে নিয়েও খেলতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত মিনুরই জয় হবে তুমি দেখে নিও। দেব শীগগীরই তোমাকে টা টা আর বাই বাই করে দেবে। সেদিনটা আসতে আর খুব বেশী বাকী নেই।"

আমি বিদিশার কথায় ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কে এই প্রনব বলে ছেলেটা? বিদিশাকে এই কথাটা বলার কারণই বা কি? মাথামুন্ডু কিছু ভেবে পেলাম না। শুভেন্দুকে ডাকলাম। শুভেন্দু এল। বলল, "আমি খবর নিয়ে দেখছি। কে এই প্রনব? দরকার পড়লে মিনুকেও জিজ্ঞাসা করছি। রহস্যটা খুঁজে বার করছি।"

সত্যি কথা বলতে কি, কলেজে আমার শত্রু সেরকম কেউ ছিল না। এখন বিদিশার প্রতি যদি কারুর দূর্বলতা থেকে থাকে, তাহলে সেটা অন্য কথা। আমি যেন বিদিশার কষ্টটা বুঝে ওকে আর সেদিন কিছু বললাম না। মনে হল, মিনুকে নিয়ে বিদিশার দ্বিধা এখনো কাটেনি। মিনু যখন কথা দিয়েছে, আমার প্রতি ওর দূর্বলতাটা আর নেই। তখন প্রনব বলে এই ছেলেটাই বা কেন বিদিশার কান ভাঙাতে যাবে। তাহলে কি মিনুই এই খেলাটা খেলেছে?

পরের দিন মিনু এল কলেজে। প্রথমেই এসে বলল, "প্রনব বলে আমি কাউকে চিনি না। আর এ কলেজের যে ছেলে নয়, তাকে এত গুরুত্ব দেওয়া কেন?"

আমাকে বলল, "বিদিশাকে এই পরের কথায় কান না দেওয়াটা বলে, একটু তুই বন্ধ কর। সবকিছুতেই তোকে আর আমাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, আমারও বাপু সহ্য হয় না।"

মিনুর সঙ্গে তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন কথা বলা আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। রীনাকেও গান শেখানো বন্ধ করে দিয়েছি। হঠাৎই একদিন আমার পায়ে ধরে আবার সাধা শুরু করে দিল মিনু। আমাকে বলল, "যেটা সত্যি নয়, সেটা নিয়ে শুধু শুধু তুই পড়ে আছিস। খামোকা রীনাকেও তুই গান শেখাতে যাওয়া বন্ধ করে দিলি। আচ্ছা আমার কি দোষ বল তো? তুই যেন আমাকেই দোষী সাব্যাস্ত করতে চাইছিস। আমি কি প্রনব বলে ছেলেটাকে বিদিশার কাছে পাঠিয়েছি?"

সেদিন বিদিশাকেও অনেক বুঝিয়েছিল শুভেন্দু। - "এসব কথার কান দেওয়ার কোন দরকার নেই। দেব কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, নিজে খুব ভালো বোঝে। যেদিন বুঝবে, মিনুর বাড়ীতে ও নিজে থেকেই যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তুই কেন এসব কথায় কান দিয়ে মন খারাপ করছিস? কেন দেবের প্রতি কি তোর ষোলো আনা বিশ্বাস নেই?"







।।আটত্রিশ-১।।

এতদিন বাদে সেই মিনুই আবার আমার বাড়ীতে আসা আরম্ভ করেছে। আমি না পারছিলাম ওকে দোড়গোড়া থেকে বিদায় করতে, না পারছিলাম মুখের ওপরে সরাসরি কিছু কটু কথা বলে দিতে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই আমার ভুল ধারণাটা ভেঙে দিল মিনু। আমাকে বলল, "আমি কিন্তু তোকে আমার বাড়ী যাওয়ার কথা আর বলব না। একবার তুই আমাকে না করে দিয়েছিস। রীনাকেও না বলে দিয়েছিস, সুতরাং গান শেখানোর প্রসঙ্গ আর নয়।"

আমি বললাম, "তাহলে তুই হঠাৎ?"

মিনু বলল, "কেন তোর কাছে কি এমনি আসতে নেই?"

আমি বললাম, "তাও কারণ তো কিছু একটা থাকবেই। সাত সকালে এসে হাজির হয়েছিস। তোর আসার কারণটা কি, খুলে বল।"

মিনু বলল, "আমার কেন জানি না দেব, তোকে আমার মনের কথাটা বলতে খুব ইচ্ছে করে। এই ধর তোকে যদি আমি বলি, দেব তোকে আমার সেই আগের মতন পেতে খুব ইচ্ছে করে। তুই রেগে যাবি। আমি জানি তোর কানের লতিটাও তখন লাল হয়ে যাবে। প্রেমকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতন আমার তো বিদিশার মতন রূপ নেই। যে তোকে বলব, বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও। আমি আসলে খুব ভুল করেছিলাম। মানুষতো পদে পদে ভুল করে। ধরে নে তোর প্রতি আমার দূর্বলতাটা একপ্রকার ভুল।"

মিনুকে বললাম, "ছাড় না ওসব পুরোনো কথা। কি জন্যে এসেছিস তুই বল।"

মিনু বলল, "আমি না ঠিক তোর মতই আর একজনের প্রেমে পড়ে গেছি। আজ তোকে সেকথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।"

আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মিনুকে বললাম, "শুনে খুশী হলাম। তা সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিটি কে?"

মিনু বলল, "ছেলেটির চাউনির মধ্যে কী একটা অদ্ভূত আকর্ষন আছে জানিস তো। কিছু কিছু ছেলেদের চোখ থেকে এমন দুটি ঝরে পড়ে। মনে হয়, তারা যেন হৃদয়ের সবটুকু দেখতে পাচ্ছে। কথার মধ্যেও এক অদ্ভূত কুহক মায়া আছে। মনে হয় ও বুঝি এক জাদুকর। কেমন করে মেয়েদের মন চুরি করতে হয়, সে বিদ্যা ও শিখেছে সযত্নে।"

আমি বললাম, "এতদিন ধরে যে মিনুর প্রেমে সবাই পাগল। সেই মিনু কিনা কারুর প্রেমে পড়েছে। ব্যাপারটা তো ইন্টারেস্টিং। তা বিয়েটা কবে করছিস? আর ছেলেটিই বা কে?"

মিনু বলল, "বিয়ের দিনক্ষনটা আমি তার উপরই ছেড়ে দিয়েছি। ওখানে আমার কোন তাড়াহূড়ো নেই। শুধু ছেলেটাকে একটা মেয়ে বড় জ্বালাচ্ছে। সে আমারই মতন তাকে ভালবাসে। এখন আমার প্রেমিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কাকে ছেড়ে সে কার কাছে যাবে? আমার কাছে না তার কাছে?"

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিনুর মুখটা তখন বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মনে মনে বললাম, এ আবার কি কথা?কাকে না কাকে পছন্দ করে বসে আছে, তাকে আবার অন্য একটি মেয়েও ভালবাসে। তার মানে আবারো সেই নিরীহ কোন ছেলেকে নিয়ে টানাটানি, মিনুর চক্করে পড়ে একটা ভালো ছেলের মাথানষ্ট। নিরীহ ছেলেটা বলি হল, আর কি?

ওকে বললাম, "তোর মতলবটা কি বলতো? এতো আমার সাথে বিলকুল মিলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কার কথা বলছিস তুই?"

মিনু একগাল হেসে বলল, "কারো কথা বলছি নারে বাবা। ওফ, তোকে কিছু বলতে যাওয়াই মুশকিল। সবসময় কিছু একটা ধরে বসে থাকিস তুই। আমি তো এমনি বলছি।"

ভীষন বিরক্তি হচ্ছিল আমার। মনে হল, যতক্ষণ আমার ঘর থেকে ও বিদায় না হচ্ছে রেহাই নেই। কি করে যে ভাগাবো, সেটাও বুঝতে পারছি না। ও আমাকে বলল, "এই দেব, চা খাওয়াবি?"

আমি বললাম, "মা তো ঘরে নেই। তাহলে বস, আমি চা করে নিয়ে আসছি।"

কি বলতে কি বলে বসলাম, মিনুর দেখলাম, মুখটা বেশ খুশী খুশী হয়ে উঠল। মা'র ঘরে না থাকাটা ওর কাছে যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতন। উঠে আমারই পেছন পেছন চলে এল মিনু। আমাকে বলল, "তুই একা কেন চা করবি? চল আমিও তোকে সাহায্য করছি।"

আমার রান্নাঘরে যেখানে স্টোভটা রাখা রয়েছে, মিনু আমার পিছন পিছন ঠিক ওখানটাই এসে দাঁড়ালো। অস্বস্তি হচ্ছে আমার। একে মা ঘরে নেই। মিনু জ্ঞানহারা হয়ে হঠাৎ যদি কিছু করে বসে আমার আফশোসের শেষ থাকবে না। বেয়ারাপনা শুরু করলে আর এক কেলেঙ্কারী। সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে মিনুর কোন জুড়ি নেই।

হঠাৎই পেছনে দাঁড়িয়ে মিনু বলল, "রীনার খুব মন খারাপ। তুই ওকে হ্যাঁ বলে আসিস নি। ও আর গান গাইবে না বলছে। রেওয়াজও বন্ধ করে দিয়েছে। বলছে, দেবদা যতক্ষণ না আমাকে আবার গান শেখাতে না আসছে, আমি আর হারমোনিয়াম ধরব না। এবার থেকে গান গাওয়া আমি ছেড়ে দিলাম।"

আমি বললাম, "দেখ, গান তো সেভাবে আমি কাউকেই শেখাই না। তুই জোর করেছিলিস, তাই রীনাকে গান শেখাতে আমি রাজী হয়েছিলাম। ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা কর। মাষ্টারের কি অভাব আছে? বেস টা তো ভালভাবে তৈরী হয়ে গেছে। তাছাড়া রীনার গলায় সুর আছে। গলাও মিষ্টি। আর আমি তো একজনের কাছে ওকে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়াই বা বন্ধ করে দিল কেন? থাকলে এতদিনে তো ভাল তৈরী হয়ে যেত।"

মিনু বলল, "আমি অনেক বুঝিয়েছি। কিছুতেই আমার কথা শুনছে না। তাই তো তোর কাছে ছুটে এলাম।"

মিনুকে এবার মুখের ওপর না ই বলে দিতে হল আমাকে। ওকে বললাম, আমাকে মাফ কর মিনু। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমার মাথার উপরে এখন অনেক দায়িত্ব। তাছাড়া সময়েরও খুব অভাব। কথা দিয়েও যখন কথা রাখতে পারব না। তখন শুধু শুধু আশ্বাস দিয়ে কোন লাভ নেই। আমি পারব না। কিছুতেই পারব না।"

হঠাৎই মিনু আমার হাতটা ধরল। ওর এই হাত ধরার মানেটা আমার কাছে পরিষ্কার হল তখনই, যখন মিনু বলল, "তোকে একবার রিকোয়েস্ট করব। তুই একবার অন্তত আমার বাড়ী আয়। রীনাকে তুই ই বোঝা। আমার দ্বারা ওটা সম্ভব নয়।"

আমি মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু বরাতে যে আমার দূঃখ আছে। তখনো জানতাম না। কথায় বলে পৃথিবীর সব থেকে সুখী লোকও যেকোন মূহূর্তে দূঃখী বনে যেতে পারে। হঠাৎই বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে যাবার মতন মিনুকে বলে বসলাম, "কবে যেতে হবে বল? আমি গিয়ে বোঝাবো রীনাকে। আশাকরি ও নিশ্চই আমার কথা ফেলবে না।"

মিনুর সঙ্গে আমার ব্যবধানটা যতটাই বেড়েছিল, ঠিক ততটাই আবার কমে গেল সেই মূহূর্তে। ওর ওই আমন্ত্রণের মধ্যে যে একটা রহস্য আছে, তখনো আমি নিশ্চিত নই। ধরেই নিলাম মিনু সত্যি কথাটা বলছে। অন্তত রীনার কথা ভেবে মিনুর বাড়ীতে আমার যাওয়া দরকার।

মিনুকে চা করে খাওয়ালাম। একগাল হেসে মিনু বলল, "তোর ভারী ভয় শুধু আমাকে নিয়ে। এতই তুই বিদিশাকে ভালবাসিস, অন্যকোন মেয়েছেলের সংস্পর্ষেও আসতে চাস না। আরে আমরা তো ভাল বন্ধু হতে পারি না কি? মিনু নয় তোর ভালবাসার পাত্রী হতে পারল না। কিন্তু বন্ধু হতে চাইলেও তুই কি না করবি আমাকে? কেন বিদিশার কি ছেলেবন্ধু একেবারেই নেই?"

মিনুকে বললাম, "আগে হয়তো ছিল। কিন্ত আমার সঙ্গে প্রেম শুরু করার পর থেকে, যতদূর জানি, বিদিশার কোন ছেলেবন্ধু নেই।"

হো হো করে হেসে উঠল মিনু। আমাকে বলল, "তোর সাথে শুক্লারও তো খুব ভাল দোস্তী ছিল। তা বিদিশা সেখানে কোন আপত্তি করেনি?"

আমি বললাম, "শুক্লা নিজেই তো পরে সৌগতর সাথে প্রেম করেছে। আপত্তি থাকবে কেন? তাছাড়া শুক্লার সঙ্গে সেভাবে তো আমি কোনদিন মিশিনি। বিদিশা প্রথম প্রথম সেটা দেখে একটু অস্বস্তিতে ভুগলেও, পরে খুব সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া শুক্লা, বিদিশা দুজনেই ওরা খুব ভাল বন্ধু। খামোকা বিদিশা রাগ করতে যাবে কেন?"

মিনু বলল, "এই আমিই কারুর ভাল বন্ধু হতে পারলাম না। তাই না? সবার দুচোখের বিষ হয়ে গেছি। আমার যেন কারুর কাছে মুখ দেখানোর আর জো নেই।"

মিনুকে বললাম, "এসব মন খারাপের কথা ছাড়। এবার তুই বল, তুই নিজে বিয়েটা কবে করছিস?"







।।আটত্রিশ-২।।

একটা হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে মিনু যেন আমার মুখের দিকে তাকালো। আমাকে বলল, "আমি ভাবছি, এ জীবনে বিয়ে থা আর করব না।"

আমি বললাম, "কেন রে?"

মিনু বলল, "আমার তো অনেক বদনাম আছে। বিয়ে করলেই কি বদনাম সব ধুয়ে যাবে? ওসব বিয়ে ফিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই। ফটর ফটর করে কটা অজানা সংস্কৃত মন্ত্র পড়লেই কি সব হয়ে যায় নাকি? দাউ দাউ আগুনে হাত রাখলেই কী আর সতী হওয়া যায়? আমাদের এই মেয়েদের শরীরটাকে নিয়ে সব থেকে বড় জ্বালা, মনের অরণ্যে সবসময় জ্বলছে দাউ দাউ আগুন। তোরা যতই বলিস না কেন, মেয়েরা লজ্জ্বাবতী লতা। আমি তো বিশ্বাস করি না। বিধাতা আমাদের ওভাবেই তৈরী করেছে। বিশ্বে এমন কোন পুরুষ আছে কি যে আমাকে সেন্ট পার্সেন্ট খুশি করতে পারবে? আমার মনে হয়, কেউ বোধহয় এমনটা সুখী হয় না। সুখী সুখী মুখ করে বসে থাকে সব। এসব দের ন্যাকামি আমি পছন্দ করি না।"

ভাবছিলাম, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ওকে হয়তো বলে বসত, জিও বেটি হাজার সাল। তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। তুই শালি ঠিক কথা জেনেছিস তো। সত্যি এই পৃথিবীতে এমন কোনো আখাম্বা দন্ড নেই যা মেয়েদের একশো ভাগ সুখি করতে পারে। তবুও তো তার মধ্যে সুখ খুঁজে নিতে হয়। এক দন্ড থেকে আর এক দন্ডে নিরন্তর পরিভ্রমণ করতে হয়। দেখতে হয় কে সব থেকে বেশি আনন্দ দিতে পারে।

মিনুকে দেখে আমার ওই মূহূর্তে তাই মনে হল। এ মেয়ে বিয়ে থা সত্যি আর করবে না। শুধু শুধু ঘনঘন বয় ফ্রেন্ড চেঞ্জ করবে।

ভাগ্যিস আমার কপালটা এরকম নয়। আমাকে নিয়ে বিদিশা ছেনাল খেলা খেলবে না কোনদিন। কিছুদিন খেলাটা চলল, তারপর এঁটো পাতার মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল ডাস্ট বিনে। পরে দেখছি, কুকুরের কাড়াকাড়ি।

জীবন নাটকের পরবর্তী অধ্যায় যে শুরু হচ্ছে তার একটু পরেই, তখনো জানি না। মিনু একেবারে হাত পা ছড়িয়ে আমার সাথে বসার ঘরে সোফায় বসে কথা বলছে। ঠিক তখুনি শুনলাম, দরজায় কলিংবেলের শব্দ। চমকে উঠলাম। এই সময় কে এল?

দরজা খুললাম, দেখি বিদিশা দাঁড়িয়ে।

আমার হাটবিটটা একটু বেড়ে গেল। ওর মুখটা দেখে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ যেন ভূত দেখার মতন দেখছি। বিদিশাকে বললাম, "তুমি যে বললে বড় আসবে না? হঠাৎই চলে এলে? আমাকে তো জানালে না?"

চিরকালের যারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়, জন্মজন্মান্তরেও যারা পরষ্পরকে ভালবাসে। ভগবান কখনো কখনো তাদের মধ্যে বাধার প্রাচীর তৈরী করে দেন। সেই মূহূর্তে বাঁধার প্রাচীরটি কে? সেটা অবশ্য বুঝতে অসুবিধে নেই। কিন্তু আমি চাইলেও, বিদিশা যেন সেটা মন থেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারল না। ঘরে ঢুকেই আমাকে বলল, "মিনু এসেছে, তোমার কাছে, এটা তো তুমি আমাকে আগে বলো নি।"

মিনু ততক্ষনে বিদিশাকে দেখে ফেলেছে। ওকে বলল, "এই তো বিদিশা। এতক্ষণ তোমার কথাই হচ্ছিল। অনেক দিন বাঁচবে তুমি। এসো এসো ভেতরে এসো। কতদিন তোমায় দেখি না।"

বিদিশার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। মুখ তুলতে পারছে না। আমি ব্যাপারটা সহজ করে দেবার জন্য বললাম, "আসলে মিনু, রীনার জন্যই আমার কাছে এসেছে। রীনা খুব ঝামেলা পাকাচ্ছে বাড়ীতে। গানটান সব বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে আমি যতক্ষণ না বোঝাচ্ছি, মিনু বলছে কোন কাজ হবে না। রীনাকে বোঝানোর জন্য আমাকে একবার অন্তত যেতেই হবে।"

বিদিশা মুখ তুলে একবার মুখের দিকে তাকালো। বুঝতেই পারলাম, কথাটা মনে ধরে নি ওর। যেন মিনুকে আমার ফ্ল্যাটে দেখে হঠাৎই ছন্দোপতন ঘটে গেছে। মনের মধ্যে জমে উঠছে অনিশ্চয়তার ইঞ্চি ইঞ্চি ধুলো। অথচ ওকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। মিনু আর কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসেনি। এসেছে শুধু রীনার জন্যই। বিদিশা হয়তো যেটা ভাবছে, সেটা ভুল।

ঠিক সেই মূহূর্তে মিনু হয়ে গেল বিদিশার কাছে বিভীষিকার মতন। হঠাৎ আমাকে বলে বসল, "আমি তাহলে যাই? তুমি মিনুর সঙ্গে গল্প করছ, জানলে আসতাম না।"

মিনু খুব চালাক। সঙ্গে সঙ্গে ও উঠে পড়ল। বিদিশাকে বলল, "না, না, একি? তুমি যাবে কেন? এই তো এবার আমিই যাব। টাইম হয়ে গেছে। দেব তাহলে আমি আসি। টা টা বাই। তুই কিন্তু রীনার কথাটা মনে রাখিস। ভুলে যাস না।"

মিনুকে বিদায় দিয়ে আমি এবার বিদিশাকে নিয়ে পড়ে গেলাম। ওকে বললাম, "কি হয়েছে? মিনুকে দেখে খারাপ ভাবছ? আরে বাবা, আমি তো ওকে ডাকিনি। ও নিজেই এসেছে। হঠাৎ করে দরজা খুলে দেখি মিনু দাঁড়িয়ে। কি করব বল? ঘরে এসে বলল, রীনার জন্য আমাকে একবার নাকি যেতে হবে।"

বিদিশা বলল, "এখন কি মনে হচ্ছে জানো? এই পৃথিবীতে আমি বুঝি আর সুখী নই।"

আমি বললাম, "কেন এ কথা বলছ বিদিশা?"

বিদিশা বলল, "সুখ নামের একটা সুখপাখীকে হৃদপিন্ডের মধ্য বন্দী করতে চাইছিলাম। সেই পাখিনী ভীষন চালাক। হঠাৎই খাঁচা খুলে ফুড়ুত করে উড়ে যেতে চাইছে নীল আকাশে।"

ভীষন খারাপ লাগল ওর কথা শুনে। বললাম, "কেন আমাকে অবিশ্বাস করছ বিদিশা? আমি তো সত্যি কথাই বলছি।"

বিদিশা বলল, "তোমাকে বলেছিলাম না। ওকে বেশী প্রশ্রয় দিও না। সাতঘাটে জল খাওয়া একটা মেয়ে। ওকে তুমি বিশ্বাস করো?"

আমি বললাম, "আমিও করি না বিশ্বাস। বলছি তো। ও নিজে থেকেই আমার কাছে এসেছে।"

বিদিশা বলল, "তাহলে কথা দাও, ওর বাড়ীতে কোনদিন যাবে না। ও ডাকলেও যাবে না।"

বিদিশাকে বললাম, "কথা দিলাম।"

বিদিশা বলল, "আমার মাথায় হাত রেখে বলো, সত্যি।"

আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, "সত্যি, সত্যি, সত্যি। এই তিন সত্যি করলাম তোমার কাছে।"

হঠাৎ পুরোনো কথা চিন্তা করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দাটায় এলাম। জানি মা ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবারটা টেবিলে রাখা রয়েছে। আমাকে খেয়ে নিতে হবে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদটা সরে গেছে। কোথা থেকে একরাশ মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। অসময়ের কুচকুচে কালো মেঘ। এ মেঘকে যে আমি এসময় দেখবো আশাই করিনি। বেচারী চাঁদ হবো হবো সন্ধে থেকেই দুহাতে দু মুঠো জোৎস্না ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। চাঁদ বোধহয় অকালেই ঝরে পড়ল। মাঝরাতেই ঢলে পড়েছে চাঁদ। তাহলে কি আমার জীবনটাও তাই?.....

মনে পড়ছিল, বিদিশাকে একদিন অনেক রাত অবধি একা পেয়ে একটা গান গেয়েছিলাম, "এখনি বিদায়, বোলো না। এখনো আকাশে চাঁদ জেগে আছে। কোন কথা তো এখনো হল না। এখনি বিদায় বোলো না।"

বিদিশা আমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। আর যখন ফিরেই এল। সেই চাঁদটাকে কিন্তু আমি আর দেখতে পাচ্ছি না।







।।উনচল্লিশ।।

মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে। কেন জানি না শুক্লার বাড়ী থেকে ফিরে আসার পরই শরীরটা কিরকম খারাপ লাগছিল আমার। পেটের কাছটা কেমন ব্যাথা ব্যাথা করছিল। ঠিক যেমন আলসার কোলাইটিসের সময় ব্যাথাটা ওঠে, ঠিক তেমনই। ভীষন একটা যন্ত্রণা অনুভব করে বারান্দা থেকে আমি ঘরে ফিরে এলাম। কোমরের কাছটায় হাত দিয়ে একটু কাতরাতে শুরু করেছি। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলাম, "ও মা গো। আবার সেই যন্ত্রণা।"

ঘরের মধ্যে জলের বোতলটাও নেই। উঠে যে খাওয়ার ঘরে ফিল্টারের কাছে যাব, একটু জল খাবো। সে সামর্থও নেই। আমার চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, বুঝতে পারছি এ যন্ত্রণা সারা রাত ভোগাবে আমায়। সকাল অবধি আর ঘুম হবে না।

কোমরের দুপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। টানটান পুরো শরীরটা নিমেষের মধ্যে ব্যাখায় আবার কুঁকড়ে গেল। যন্ত্রণাটা তখন ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উঠছে। মনে হল, এই সময় কাউকে যদি পাশে পেতাম খুব ভাল হত। কেন যে ব্যাথাটা থেকে থেকে এরকম কষ্ট দেয় বুঝি না। এই বেশ আছি, আবার শরীরটা খুব খারাপ। সুস্থ সবল শরীরটা হঠাৎই বিষন্ন, ভীষন দূঃখী। কি জানি মনের সঙ্গে বোধহয় শরীরেরও একটা যোগসাজশ আছে বোধহয়। একটা অলৌকিক কোন শক্তি। যে শক্তিটাই আমাদের ঠিক থাকতে দেয় না।

মা ঘুমোচ্ছে অন্যঘরে। এই মূহূর্তে মাকে ডাকাটা ঠিক হবে না। মা আমার অনেক কষ্ট করে, সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে। মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত আমি ঘটাতে চাই না। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে তাই যন্ত্রণাটা সহ্য করার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। মনে হল পেটের ভেতরে কে যেন হাতুড়ী মারছে, এক্ষুনি নাড়িভূড়ি সব বেরিয়ে পড়বে। একটা অসহায় মানুষের মতন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, "হায় ভগবান। এতটা কষ্ট দিও না আমায়।"

বিচিত্র মানুষের শরীর। হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেল, অমনি শরীরটা বিগড়ে গেল, ব্যস, হয়ে গেল তার দফারফা। ডাক্তার বলেছিল, "খাওয়াদাওয়ার কিছু গড়বড় হলেই কিন্তু এই রোগটা মাঝে মধ্যে আবার দেখা দেবে। সুতরাং সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে। গোলমাল হলেই ব্যাথাটা আবার আপনাকে কষ্ট দেবে। আর ব্যাথা যদি না কমে, তাহলেই বুঝবেন, বাথরুমে গিয়ে আবার সেই থোকা থোকা রক্ত। ডাক্তার ডেকে, ওষুধ খেয়ে হয়রানি। নার্সিংহোমে ভর্তী। এক গাদা শুধু পয়সা নষ্ট।"

 -- "আমি কি এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি না?"

 - "হ্যাঁ পারেন। তারজন্য খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করতে হবে। আমি জানি, আপনি কাজের মানুষ, কিন্তু বাইরের হাবিজাবি খাওয়া একদম চলবে না। তাহলেই কিন্তু....."

 -- "কিন্তু ডাক্তার আমি তো এই শেষ কয়েক মাসে বাইরে উল্টোপালটা কিছু খাই নি। তাহলে কেন এমন হচ্ছে?"

মনে হল আপন মনে আমি কথা বলছি বিড় বিড় করে। ডাক্তার আমার পাশে নেই। অথচ আমার মনে হচ্ছে আমি যেন ডাক্তারের সাথেই কথা বলছি।

অনেক কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস জল নেবার জন্য ফিল্টারের দিকে এগোতে লাগলাম। মনে হল গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, সমস্ত শরীরটা জবজব করছে ঘামে, এইবার মনে হয় ধুপ করে আমি মাটিতে পড়েও যাব। যেন শরীরে শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই আমার। রোগটা হঠাৎই শরীরে নতুনভাবে দানা বেঁধেছে, আমার সমস্ত শক্তিকে সে কেড়ে নিতে চাইছে।

ফিল্টার থেকে আমি গ্লাসে জল গড়াতে লাগলাম। তলপেটের কাছটা চিনচিন করছে। পেটের কাছটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম, "বিদিশা, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না যেতে, তাহলে হয়তো এই কষ্ট কোনদিন আমার হত না। আজ তুমি ফিরে এসেছো। তাও পুরোন ব্যাথা সেই আমাকে আবার কষ্ট দিচ্ছে।"

এবার জল গড়াতে গিয়ে দুম করে মাটিতে পড়েও গেলাম। মাথার কাছটা ভীষন জোরে আঘাত লাগল। মনে হল মাটিতে লেগে মাথার পিছনটা যেন নিমেষে ফুলে আলুর মতন ঢোল হয়ে গেল। মেঝেতে গ্লাসটা পড়ল, ঝনঝন করে একটা শব্দ বয়ে গেল।

বেশ জোরে শব্দটা হয়েছে। মা'রও ঘুম ভেঙে গেছে আওয়াজ শুনে। মা, ছুটে এসেছে। দেখছে, মেঝেতে শুয়ে আমি ব্যাথায় কাতরাচ্ছি। আমার পেটের কাছটা আর মাথার পিছনে, দুটো জায়গাতেই ভীষন ব্যাথা অনুভব করছি। আমি আর পারছি না।

মা বেশ ভয় পেয়ে গেল। আমাকে বলল, "কি হয়েছে তোর?"

আমি বললাম, "মা, মনে হচ্ছে সেই আলসার কোলাইটিসের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়েছে। ভীষন কষ্ট হচ্ছে।"

মা বলল, "আমাকে ডাকবি তো তুই? দেখেছ কান্ড। ওঠ, ওঠ, দেখি একটু কষ্ট করে।"

আমার কাঁধটা ধরে, মা আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগল। নিজেই কেমন শক্তিশূণ্য হয়ে গেছি। মাকে বললাম, "মা দেখো তো ওষুধের বাক্সেতে কোলাইটিসের ওষুধটা আছে কিনা? ভীষন ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না।"

 - "দূর পাগল। অমন কথা মুখে আনতে আছে?"

মা, তাড়াতাড়ি ওষুধের বাক্স থেকে একটা ট্যাবলেট বার করে, আমার মুখে দিল। ফিল্টার থেকে জল গড়িয়ে আমার মুখে ঢালতে লাগল। আমাকে বলল, "আস্তে আস্তে ওঠার এবার চেষ্টা কর, আমি তোকে বিছানায় নিয়ে যেতে সাহায্য করছি। কেন ব্যাথাটা কি খুব বেশী হচ্ছে?"

মা'কে বললাম, "উঠতে পারছি না মা, ভীষন ব্যাথা হচ্ছে। আমি আর পারছি না।"

আমার কষ্ট দেখে মা ভীষন নার্ভাস হয়ে পড়েছে, বুঝতে পারছি মা না এবার কাঁদতে শুরু করে দেয়। হঠাৎই দেখছি, আমার মাথার কাছে বিদিশা। আমাকে বলছে, "ওঠো একটু চেষ্টা করে। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়, তাহলে আমারই বা চলবে কি করে?"

ভীষন কাঁদছে বিদিশা। আমি ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার হাত বিদিশার চোখের কাছে কিছুতেই পৌঁছোচ্ছে না।

কেন এমন হচ্ছে আমার? ভীষন বাজে একটা অসুখ। চোখে শুধু ঝাপসা দেখছি। মাথাটাও ঘুরছে বনবন করে। আবছা আবছা দেখছি, সারা ঘর জুড়ে শুভেন্দু, রনি, মাধুরী এমনকি শুক্লাও অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করছে। আমার দিকে ওরা ঘনঘন তাকাচ্ছে, আমার দিকে হাত বাড়াতে চাইছে অথচ আমার এই অস্থির অবস্থা দেখেও, ওরা যেন আমার জন্য কিছুই করতে পারছে না।

মা চেঁচিয়ে উঠে বলল, "ওঠ, খোকা। একটু চেষ্টা কর। আমি তোকে ধরছি। ওষুধ তো খেয়েছিস। এবারে ব্যাথা কমে যাবে। একটু চেষ্টা কর। একটু ধৈর্য ধর।"

কোনরকমে মা'কে ধরে আমি ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। শরীরের সমস্ত রয়ে যাওয়া শক্তিগুলো দিয়ে মায়ের হাতটা ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। আবার শরীরটা মাটিতে আছড়ে পড়ল। কে যেন মেঝের সঙ্গে আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইছে। শরীরটা মেঝের সঙ্গে একেবারে গেঁথে গেছে। পৃথিবীর যেন কোন শক্তিই নেই, আমাকে টেনে তোলে।

 -- "ভগবান আমাকে দয়া কর। আমি বাঁচতে চাই। ওহ্ কি কষ্ট, কি যন্ত্রণা। কি ভয়ানক ব্যাথা। আমার পেট থেকে এখন সারা শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে ওই ব্যাথাটা। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার চোখের পাতা বুজে গেল। কাল সকালে চোখ খুলে সূর্যের মুখটা আমি বোধহয় আর দেখতে পারব না।"

জ্ঞান হারাবার আগে, শেষবার মায়ের মুখ থেকে একটা চীৎকার শুনলাম। মা চেঁচিয়ে উঠল খোকা বলে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।






কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য। 





লেখক(Lekhak)-এ লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

লেখক(Lekhak)-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click here

মূল ইন্ডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ


হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ

No comments:

Post a Comment