আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
মহানগরের আলেয়া
Written By pinuram
Written By pinuram
তেরো
চৌষট্টি ছক (#০৩)
দানার চোয়াল কঠিন হয়ে যায়, হাত মুঠি করে নিজের চরম ক্রোধ গিলে নেয়। চোখের সামনে রুহি আর মহুয়ার ছবি ভেসে ওঠে, এটাই ভয় পেয়েছিল দানা। যেমন নয়নার ওপরে নজর রেখেছিল ঠিক তেমনি নয়না ওর ওপরে নজর রেখেছে। দানা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "আমার পেছনে চর লাগিয়েছো তাহলে।"
নয়না ওর চোখের ওপরে চোখ রেখে বলে, "কি করব বলো, তুমি আমার অনেক কিছু জেনে ফেলেছো। নিজেকে বাঁচানোর জন্য ঢাল খুঁজতে আমাকে হতই তাই না? দেখো দানা, তোমাকে এখন খুব বিশ্বাস করি। এখন পর্যন্ত তুমি বাপ্পা নস্করকে আমার গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে লাগিয়ে দাওনি। বিশ্বাস করোন আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না।"
লাল ঠোঁটে কামুকী হাসি দিয়ে, "কারন তুমি আমাকে সেই রাতে প্রচন্ড সুখের যন্ত্রণা দিয়েছিলে। উম্মম্ম এত সুখ পেয়েছিলাম যে শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।"
দানা স্বস্তির শ্বাস নেয়, ধর্ষকামে নয়না আনন্দ পেয়েছে, সত্যি না মিথ্যে। তবে ওর চেহারা কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে নয়না ওর ওপরে ক্ষেপে নেই, ওকে এখন আগের মতন বিশ্বাস করে। তবুও সাবধান থাকতে হবে এই ধূর্ত চটুল নারীর থেকে। নয়না যেমন ওকে ব্যাবহার করতে চায় ঠিক তেমনি দানাও ওকে ব্যাবহার করতে চায়। দানা জানে, নয়না বাপ্পা নস্করকে খুন করতে চায়। কিন্তু বাপ্পা নস্করকে এখুনি সরাতে চায় না দানা।
বাপ্পা নস্কর ওর কোন ক্ষতি করেনি তাই নয়নাকে জিজ্ঞেস করে, "কি চাও তুমি?"
নয়না এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলে, "আমি কি চাই সেটা তুমি ভালো ভাবে জানো। তুমি এখন পর্যন্ত কিছু একটা ভেবেই বাপ্পা নস্করের কাছে মুখ খোলোনি। তাই না? এইবারে তুমি কি চাও সেটা আমি জানতে চাই।"
দানার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, মোহন খৈতানের বিশাল বাজেটের অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলো হাতে পেলে বাপ্পা নস্কর খুশি হয়ে যাবে। সেই সাথে বিমানের কাছে আসা যাবে। যতদূর ওর ধারনা, মৈনাককে নয়না খুন করেনি। হয়ত বিমান চন্দ নয় রমলা বিশ্বাস খুন করিয়েছে। সঙ্গীতার ভাঙ্গা হৃদয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় দানা। কিন্তু খুব মেপে চাল চালতে হবে দানাকে। কারন বিরোধী পক্ষ সবাই ধূর্ত কুটিল মানুষ।
তাও দানা একবার জানতে চায়, "তুমি কি সঙ্গীতার প্রেমিককে খুন করেছ?"
বিস্ফোরিত চোখে নয়না আঁতকে ওঠে, "কি বলছো? না না, আমি কাউকে খুন করাইনি দানা। তুমি ওকে ধর্ষণ করে ছেড়ে দিলে তারপরে আমি আর কোন খবর পাইনি। সঙ্গীতা কোথায় আছে আমি জানি না। বিশ্বাস করো দানা, আমি বুবাইয়ের নামে শপথ করে বলছি। সঙ্গীতাকে আমি একবার শুধু আঘাত করেছি আর করিনি কারন ও কারুর কাছে মুখ খোলেনি।"
দানা পাল্টা প্রশ্ন করে, "তুমি সঙ্গীতার ব্যাপারে আর কাকে জানিয়েছ? সত্যি বলো নয়না।"
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নয়না বলে, "ও হ্যাঁ, একবার কথায় কথায় বিমানকে বলেছিলাম ব্যাস আর কাউকে জানাইনি। বিশ্বাস করো দানা।"
মৈনাকের খুন দুইজনে করতে পারে, এক বিমান চন্দ দ্বিতীয় রমলা বিশ্বাস। বেশ কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে দানা বলে, "আমি ব্যাবসা করতে নেমেছি নয়না। মোহন খৈতানের বড় বাজেটের বেশ কয়েকটা অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প এলাকায় পরে রয়েছে। সেই গুলো চাই আমার।"
নয়না আকাশ থেকে পরে, "কি বলছো তুমি? আরে বাবা, আমি কি করে মোহন খৈতানের ওই প্রকল্প গুলো তোমাকে দেবো? তুমি টাকা চাও আমি দিতে পারি। এক কোটি দুই কোটি পাঁচ কোটি বল আমি যোগাড় করে দেব। কিন্তু....."
দানা হেসে ফেলে, "নয়না, এক কোটি টাকা পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। তুমি যদি বাপ্পা নস্করকে সরাতে চাও তাহলে মোহন খৈতানের ওই প্রকল্প গুলো আমার চাই।"
নয়না মাথা নাড়ায়, "সম্ভব নয় দানা, কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি মোহন খৈতানকে ঠিক তেমন ভাবে চিনি না।"
দানা মিচকি হাসে, "মিথ্যে কথা কেন বলছো। মোহন খৈতান, বিমান চন্দের বাল্যবন্ধু সেটা আশা করি ভালো ভাবে জানো।"
নয়না মাথা দোলায় "হ্যাঁ সেটা আমি জানি, কিন্তু....."
দানা নিজের পরিকল্পনা নয়নাকে জানায়, "তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমি এখন এই এলাকার বেশির ভাগ অর্ধ সমাপ্ত প্রোজেক্ট গুলো কিনে কাজ শুরু করেছি। তুমি বিমান চন্দকে বল, যদি মোহন খৈতান আমার নামে ওই অর্ধ সমাপ্ত প্রোজেক্ট গুলো করে দেয় তাহলে আবার কাজ শুরু করতে পারা যাবে। আমি আর মোহন খৈতান একসাথে মিলে কাজ করবো। এতদিনে মোহন খৈতানের অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে, এরপরের নির্বাচনে যদি বাপ্পা নস্কর আবার চলে আসে তাহলে বুঝতেই পারছো আশা করি। তুমি একবার বিমানের কানে এই কথা উঠাও দেখো ও কি বলে। আমি হলফ করে বলছি, পরের দিন আমার সাথে দেখা করতে চাইবে।"
নয়না অবাক হয়ে যায় দানার পরিকল্পনা শুনে। ওর আসল উদ্দেশ্য ঠিক ধরতে পারে না তবে এই টুকু বুঝে যায় দানা গভীর জলের মাছ। এর গায়ে হাত দেওয়া যে সে কাজ নয়।
নয়না মিচকি হেসে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার মেয়ে ভারী মিষ্টি, কি নাম?"
দানা স্মিত হেসে উত্তর দেয়, "রুহি।"
নয়না ওর সাথে হাত মিলিয়ে বলে, "এখুনি কথা দিতে পারছি না তবে আমাকে কয়েকদিন সময় দাও। আমি বিমান চন্দের সাথে আলোচনা করে তোমাকে জানাচ্ছি।"
গাড়িতে উঠেই দানা কপালে করাঘাত করে। দানা যেমন নয়নার ওপরে নজর রেখেছিল ঠিক তেমনি নয়না খুঁজে খুঁজে ওর দুর্বলতা জেনে ফেলেছে। রুহি আর মহুয়াকে আঘাত করলে দানা পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু মহুয়াকে কি করে বুঝানো যায় এই কথা? দানার লাল চোখ দেখে আক্রাম আর নাসির কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়। তীর বেগে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়িতে পৌঁছায় দানা। ঘরে ঢুকে আগে রুহিকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ থম মেরে বসে থাকে। মহুয়া যত জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে দানা নিরুত্তর। ওর ছলছল রক্তমাখা চোখের চাহনি দেখে মহুয়ার বুঝতে দেরি হয় না যে নয়না ওদের বিষয়ে জেনে গেছে।
দানা ওকে বলে, "প্লিস পাপড়ি আমার কথা শোন, তুমি মেয়েকে নিয়ে আজমের চলে যাও।"
দানার পাশ থেকে চলে যেতে হবে শুনেই মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে। জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলে, "না না, আমি কোথাও যাবো না।" ওর কোল থেকে রুহিকে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বলে, "তুমি ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নেই। তুমি না থাকলে আমরা বেঁচে কি করব, জিত।"
দানা চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকে। মহুয়া ওকে নয়নার সাথে কি আলোচনা হয়েছে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দানা ওকে সব কিছু বিস্তারে জানিয়ে দেয়। মহুয়া ওকে বলে, "ঠিক আছে জিত। তুমি এইবারে চাল দিয়ে এসেছ দেখা যাক নয়না কি করে। তবে মনে রেখো ওই নয়না হচ্ছে আমাদের তুরুপের তাস।" ওর হাতখানি চেপে ধরে বলে, "শেষ দেখা দেখেই যাবো জিত।"
দানা দুইজন কে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট রুহি কিছুই বুঝতে পারে না, কেন মায়ের চোখে ডাডার চোখে জল। তাই কচি হাত দিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।
ছোট অফিস কিন্তু এই কয়দিনে মহুয়া বেশ সুন্দর ভাবে সাজিয়ে নিয়েছে। একটা বড় কাঁচের দরজা দেওয়া কেবিনে মহুয়ার আর দানার বসার ব্যাবস্থা, যদিও বেশির ভাগ দিন মহুয়াকে একাই ওই কেবিনে কাটাতে হয়। কাজের মেয়ে মণিকে নিয়েই মহুয়া আফিসে আসে কেননা রুহি সাথে থাকে। এখন রুহিকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। তবে সকালে একটা প্লে স্কুলে যায়, যেদিন ইচ্ছে হয় যায় যেদিন ইচ্ছে হয় যায় না। মহেশ বাবু ওদের অনেক সাহায্য করেছেন এই অফিসের ব্যাপারে, দানার সাথে ঘুরে ঘুরে অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলোতে গিয়ে দেখাশুনা করার বিষয়ে আর কেনা বেচার বিষয়ে। মহেশ বাবুকে দানা নিজের কোম্পানিতে অংশীদার হতে অনুরোধ করেছিল কিন্তু মহেশ বাবু বেশি কতক ব্যবসায় আর মাথা গলাতে চান না।
বেশ অনেক গুলো অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প হাতে চলে আসে দানার। সবকটা প্রকল্পে অংশীদার হিসাবে কাজ শুরু করে দেয়। বাপ্পা নস্করকে জানিয়ে দেয় যে একবার এই প্রকল্প গুলো সম্পূর্ণ হলে, ওর নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য বেশ কয়েক কোটি টাকা দেবে। ইতিমধ্যে ইন্দ্রনীলের কাছ থেকে বাপ্পা নস্কর সব শুনেছে তাই দানার কথায় বিশ্বাস করে নেয়।
মহানগরের বুকে ঠাণ্ডা কমে এসেছে। কয়েক সপ্তাহ পরে রুহির জন্মদিন। মহেন্দ্র বাবুকে আমন্ত্রন জানিয়েছে, সেই সাথে সবাইকে। কেষ্টর ছেলে হয়েছে, দানা দেখা করতে গিয়েছিল। মহুয়ার খুব যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেই কালী পাড়ার বস্তি বলে দানা আর নিয়ে যায়নি। ওর গুমটিতে এখন তালা মারা, সেখানে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। বস্তির আর এলাকার খবরা খবর ঠিক পেয়ে যায় মদনা না হয় বলাইয়ের কাছ থেকে। ইন্দ্রাণী চলে যাওয়ার পরে শক্তি আর বলাইকে নিজের ব্যাবসায় লাগিয়ে দেয়।
সেদিন বিকেলে মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে একটা বড় রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিল দানা। মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে এই রেস্টুরেন্টে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে। বড় লোকেদের রেস্টুরেন্ট, উর্দি পরা দারোয়ান, উর্দি পরা বেয়ারা। খাওয়া দাওয়া শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই নয়নার সাথে মুখোমুখি। রুহি কোলে দানার পাশে মহুয়াকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে আসে নয়না। নয়নাকে এগিয়ে আসতে দেখেই মহুয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। প্রমাদ গোনে মহুয়া, এই মহিলা আবার কি চাল চালবে? বুকের মধ্যে টানটান উত্তেজনা নিয়ে সেটা বোঝার অপেক্ষায় মহুয়া। তপ্ত শ্বাসে দানার বাজু আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে চশমার পেছন থেকে আপাদমস্তক জরিপ করে নয়নাকে। নয়নার বেশ পেছনে সুমিতা আর সমুদ্র দাঁড়িয়ে পড়ে।
নয়না মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় মহুয়ার দিকে, "কেমন আছেন মিসেস মন্ডল?"
চোয়াল চেপে ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে আলতো হাত মিলিয়ে মহুয়া উত্তর দেয়, "ভালো আছি।"
নয়না ওদের দিকে দেখে দানাকে বলে, "তোমার সাথে একটু কথা ছিল। হাতে কি সময় আছে?"
ওর সামনে দাঁড়াতে একটুকু ইচ্ছে নেই তাই দানা উত্তর দেয়, "এখুনি ডিনার সেরে উঠেছি, ফোনে কথা হবে কেমন?"
মহুয়ার তীক্ষ্ণ চোখ নয়নাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নয়না ওই আগুনে চাহনি দেখে বেশ বিবৃত বোধ করে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না দানার স্ত্রী ওকে এমন তীক্ষ্ণ চোখে কেন জরিপ করে চলেছে। নয়নাকে হাতের সামনে পেয়ে একটু নাচিয়ে নেওয়ার ইচ্ছেটা দমাতে পারল না দুষ্টু মিষ্টি মহুয়া।
নয়নার বিবৃত বোধ কাটিয়ে আর দানাকে অবাক করে মহুয়া বলে, "তবে ডেসার্ট আরো একবার খেতে আপত্তি নেই।"
এতক্ষণ একটা চাপা শ্বাস বুকের মধ্যে আটকে রেখেছিল নয়না। মহুয়ার নিমন্ত্রনে সেই শ্বাস ছেড়ে বলে, "খুব ভালো কথা, মিসেস মন্ডল। এইখানে আইসক্রিম খুব ভালো পাওয়া যায়।"
রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে নয়নাকে মহুয়া জিজ্ঞেস করে, "আপনি কি বিমানের বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছেন?"
নয়না অবাক হয়ে যায়, এত তাড়াতাড়ি মহুয়া ওকে প্রশ্ন করবে সেটা ভাবতে পারেনি। নয়না একবার দানার দিকে তাকায় একবার মহুয়ার দিকে তাকায়। তারপরে মৃদু মাথা দুলিয়ে বলে, "হ্যাঁ, কিন্তু মানে আপনি....."
মহুয়া মৃদু হেসে বলে, "আগে একটা আইসক্রিম খাই তারপরে শুনবো আপনার কথা।"
মহুয়ার মিষ্টি অথচ তীক্ষ্ণ কথাবার্তা দানাকে অবাক করে দেয়। এ নারী যেন মিছরির ছুরি। মহুয়া চোরা হাসি দিয়ে দানাকে চুপ করে থাকতে অনুরোধ করে। টেবিলে বসে রুহি আইসক্রিম খাওয়ার চেয়ে মাখতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। সেই দেখে ওদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি চলে। ওদের অদুরে একটা টেবিলে সমুদ্র আর সুমিতা বসে অপেক্ষা করে।
নয়না ওদের বলে, "আমি বিমান চন্দের সাথে আলোচনা করেছি। বিমান একবার দানার সাথে দেখা করতে চায়।"
নয়নাকে জানতে দেওয়া যাবে না যে মহুয়া ওর সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে তাই চোরা হেসে জিজ্ঞেস করে, "বিশ্বজিতের বিষয়ে কি বলেছেন আপনি বিমানকে? সবকিছু পরিস্কার না হলে বিশ্বজিৎ ফাঁদে পা দেবে না।"
"ফাঁদ" কথাটা একটু জোর দিয়েই বলে মহুয়া।
নয়না অবাক, কে এই নারী? খেলা যেন সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে বলে, "না না, বিশ্বাস করুন মিসেস মন্ডল। এইখানে কোন ফাঁদ নেই।"
মহুয়া মৃদু হেসে নয়নার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, "বিমান চন্দ আশা করি ভালো ভাবেই জানে, বিশ্বজিৎ বাপ্পা নস্করের বিশ্বাসভাজন লোক। তাহলে এত সহজে কেন ওর সাথে দেখা করতে চাইবে? কিছু একটা আপনি বলেছেন। সেটা কি?"
ওই তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে নয়না একটু দমে যায় কিন্তু পাল্টা হেসে জবাব দেয়, "আপনি সত্যি অনেক কিছু জানেন তাহলে।"
মহুয়া মাথা দোলায় "হ্যাঁ।"
নয়না বুঝে যায় এই মহিলার সামনে মিথ্যে বলে বেশি ক্ষণ লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই বলতে শুরু করে, "দেখুন মিসেস মন্ডল, আমি বিমানকে বলেছি যে দানা বাপ্পা নস্করের লোক হলেও আমার খুব বিশ্বাসী।" মহুয়া ঠোঁট টিপে হাসে ওই কথা শুনে। নয়না ওকে বলে, "আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি দানা আমাদের কথা মতন কাজ করবে। কারন জানতে চাইল ওকে বললাম মোহন খৈতানের প্রকল্পের বিষয়ে। মোহনের সাথে বিষদে আলোচনা করেছে বিমান। বাপ্পা নস্করের দৌরাত্মের ফলে ওর প্রকল্প গুলো অনেকদিন থেকেই বন্ধ পড়ে আছে।" দানা সেই সম্পর্কে অবগত। নয়না আরো বলে, "বিমানের কথা মোহন ফেলবে না, তবে আগে দানার সাথে দেখা করতে চায় বিমান তারপরে মোহনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে।"
সবকিছু শোনার পরে মহুয়া মেকি কাতর কণ্ঠে ওকে অনুরোধ করে, "মিস বোস, আপনি আমার একটা কাজ করবেন, প্লিস।"
নয়না ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, "কি?"
মহুয়া চাপা হেসে বলে, "আমি ওদের আলোচনার রেকর্ডিং চাই আর সেটা আপনার পক্ষেই সম্ভবপর।"
নয়না বিস্ফোরিত নয়নে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, মহিলা বলে কি? একেবারে জালে জড়িয়ে ফেলতে চায় নাকি? তাও মহুয়ার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে নয়না বলে, "আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না তাই তো। ঠিক আছে দেখি কি করতে পারি আমি।"
অতি সুচতুর চাল দিয়েছে মহুয়া, এক বারের জন্য নয়নাকে সন্দেহ করতে দেয়নি যে ওরা ওর বিরুদ্ধে জাল ফাঁদছে। নয়নার সাথে হাত মিলিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, "আইসক্রিমের জন্য অনেক ধন্যবাদ, মিস বোস।" রুহিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দানাকে বলে, "চল জিত, অনেক রাত হয়ে গেছে।"
চৌষট্টি ছক (#০৪)
এতক্ষণ যেন একটা শীতল যুদ্ধ চলছিল ওই রেস্টুরেন্টের টেবিলে। আশেপাশের অনেক লোকের দৃষ্টি ছিল ওদের টেবিলের ওপরে। বিশেষ করে অভিনেত্রী নয়নার জন্য। ওরা উঠে যেতেই অনেকেই নয়নাকে ছেঁকে ধরে। মহুয়া আর দানা আর পেছনে তাকায়নি। বুকের মধ্যে একটা ভালো লাগার মৃদু মলয় নিয়ে দানা আর মহুয়া বেড়িয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে উঠেই মহুয়া খিলখিল করে হেসে ফেলে, "কেমন দিলাম বলো।"
দানা অবাক হয়ে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাছি মারতে ভয় পেত মহুয়া আর এই কয়দিনে এত পরিবর্তন? সত্যি ভালোবাসা মানুষের হৃদয় বদলে দেয়, মনে এক দুরন্ত শক্তির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়।
দানা গাড়ি চালাতে চালাতে ওকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি ওইখানে ঠিক কি করতে চাইছিলে বলো তো?"
মহুয়া হেসে ওর হাত ধরে বলে, "পারলে কুটিকুটি করে কেটে ফেলতাম, কিন্তু মেয়েটাকে দিয়ে অনেক কাজ করানোর বাকি, তাই না। তাই ছেড়ে দিলাম। পরে অনেক কাজে আসবে এই মেয়ে। আমার কথা লিখে রাখো।"
দানা জিজ্ঞেস করে, "কি রকম কাজে আসবে?"
মহুয়া হেসে বলে, "আরে দেখো না, ঠিক সময়ে তোমার নিজের বুদ্ধি খুলে যাবে। আমার মন বলছে এর সাহায্যে আমরা রমলাকে ধরতে পারবো, আর রমলাকে ধরতে পারলে হয়ত কঙ্কনা আর নাসরিনের খবর পাওয়া যাবে। আস্তিনে একটা তাস থাকা ভালো। নাও নাও গাড়ি চালাও এইবারে। ওইদিকে পিন্টু আবার মণির পেছনে লাইন মারছে বুঝেছো।"
হেসে ফেলে দানা, ওর কাজের মেয়ের পেছনে যে পিন্টু লাগবে সেটা ভালো ভাবেই জানত। মেয়েটা কালো হলেও দেখতে শুনতে ভালো, পিন্টু এলেই আগ বাড়িয়ে জল দেয়, ওর চোখের সামনে বেশ ঘোরাঘুরি করে।
ঠিক পরেরদিন দুপুর নাগাদ নয়না দানাকে ফোনে জানায় একবার বিমানের সাথে দেখা করতে। দানা জিজ্ঞেস করলে নয়না জানিয়ে দেয় দুর গ্রামের বাগান বাড়িতে বিমান চন্দ দানার সাথে দেখা করতে চায়। এই মহানগরের বুকে দেখা সাক্ষাৎ করা বিপ্পজনক, পাছে বাপ্পা নস্করের কানে কথা চলে যায় সেই ভয়ে। বিকেলের দিকে আকরাম নাসিরকে সাথে নিয়ে দানা বেড়িয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মহুয়া ওকে বারেবারে সাবধান করে দেয়। দেবুকে ফোন করে দানা, জানতে চায় বিমান চন্দ একা না সাথে কেউ আছে। দেবু ওকে জানায় যে বাড়ির মধ্যে বিমান চন্দ, নয়না, সমুদ্র ছাড়া আর কেউ নেই। সেই শুনে দানা স্বস্তির শ্বাস নেয়। ওর শুধু একমাত্র ভয় মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে। এই দুইজনে যদি পাশে না থাকত তাহলে অনেকদিন আগেই খুনোখুনিতে নেমে পড়তো।
গ্রামের ওই নির্জন বাগান বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বুকের ভেতর টানটান উত্তেজনা, বাড়ির ভেতরে কি শুধু মাত্র তিনজন না আরো কেউ অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে? দেবু নিশ্চয় বিমানের খাস লোক। ওকে কতটা বিশ্বাস করা যেতে পারে। সঠিক জানা নেই দানার। বড় বড় গাছের মাঝাখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি পাশাপাশি দাঁড় করানো। চিনতে অসুবিধে হয় না, একটা নয়নার অন্যটা বিমান চন্দের। ওর গাড়ির আওয়াজ শুনে সমুদ্র বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। পকেটের পিস্তল দেখে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দানা, পেছন পেছন আকরাম আর নাসির।
সমুদ্র এগিয়ে এসে ওদের তিনজনকে দেখে বলে, "শুধু মাত্র তুই ভেতরে ঢুকতে পারবি, আর কেউ নয়।"
দানা মৃদু হেসে বলে, "ওরা বাড়িতে ঢুকতে আসেনি রে। চল চল ভেতরে চল।" ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিসফিস করে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে, "কি রে, বিমানের কি মতিগতি রে?"
সমুদ্র বাঁকা হেসে বলে, "শালা কুত্তা, তুই এই কয়দিনে অনেক ঝানু মাল হয়ে গেছিস। যাই হোক বিমানের মতিগতি ভালোই আছে।" চোখ টিপে চোরা হেসে বলে, "বুঝতেই পারছিস পাশে নয়নাকে পেয়েছে।" দুইজনেই হেসে দেয় ওই কথায়।
যদিও এর আগে অনেক বার নয়নাকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছে, তবে দানা কোনোদিন ভেতরে ঢোকেনি। ছোট বাড়ি তাই বসার ঘর ছোট। একটা ছোট কাঁচের টেবিলের চারপাশে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা সোফা। ওকে দেখেই নয়না আময়িক হেসে উঠে দাঁড়ায়। বিমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিমান আপাদমস্তক দানাকে জরিপ করে। কিছুদিন আগে এই ছেলেটা নয়নার গাড়ি চালাত আর আজকে ওকে পাশে বসিয়ে কথা বলতে হবে ভেবেই ওর চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু নয়না যা বলেছে সেটা যদি দানা করতে পারে তাহলে অনেক লাভবান হবে। দানা অল্প মাথা নুইয়ে বিমানের সামনের একটা সোফায় বসে পড়ে। ওদের মাঝখানের সোফায় নয়না বিরাজমান।
বিমান সোজাসুজি দানাকে প্রশ্ন করে, "দেখ দানা, নয়নার কথা শুনেই তোমাকে ডাকা। আমি কি চাই সেটা আশা করি ভালো ভাবে জানো। আগে সেটা সম্পন্ন হোক তারপরে মোহনের সাথে আমি তোমার দেখা করিয়ে দেব।"
দানা জানে এইখানে ওর বস্তির মানসিকতা নিয়ে থাকলে চলবে না। ওকে এক ধুরন্ধর খেলোয়ার হতে হবে। চোয়াল চেপে বাঁকা হেসে বিমানকে বলে, "আপনি আগে মোহন খৈতানের অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলো আমার নামে করান তারপরে বাপ্পা নস্করকে সরানোর ব্যাবস্থা আমি করবো।"
বিমান ধূর্ত এক হাসি দিয়ে বলে, "তোমার মতন হাজার হাজার মানুষ চড়িয়ে খাই। আগে তুমি তোমার কাজ করো, তারপরে আমি করবো।"
দানা হাত মুঠো করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বিমান চন্দের দিকে হিমশীতল চাহনি দিয়ে বলে, "বাপ্পা নস্করকে সরানোর ইচ্ছে আমার নেই বিমান বাবু। তার দৌলতে আমার ব্যাবসা ভালোই চলছে। মাঝ পথে বাপ্পা নস্করকে উস্কিয়ে সেই ব্যাবসায় ক্ষতি আমি করতে চাই না।" নয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁত পিষে বলে, "বাকিটা আমি কি করতে পারি সেটা নয়না আপনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। আমি আসি কেমন।"
ওই চাহনি দেখে নয়নার বুক এক অজানা শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দানার হাত ধরে বলে, "না না যেও না। বিমান করবে।" বিমানের দিকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে নয়না, "তুমি কি করছো? এটা কেন বুঝতে পারছো না যে দানা আমার খুব বিশ্বাসী। সেদিন তোমাকে আর আমাকে একসাথে দেখার পরেও কিন্তু বাপ্পার সামনে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি। বুঝতেই পারছো দানা আমার কথা কতটা মেনে চলে। তুমি মোহনের সাথে কথা বলো। ওকে বুঝাও, ওকে মানাও। এইভাবে প্রকল্প গুলো পড়ে থাকলে তোমার লোকসান মোহনের লোকসান। তার চেয়ে ওই প্রকল্প গুলো দানার নামে করে দিতে পরামর্শ দাও। বাপ্পা নস্কর ভাববে দানা তোমাদের হাতের মুঠোতে করে ফেলেছে। বাপ্পা নস্কর নিশ্চিন্ত হলেই দানা ওর ওপরে চরম আঘাত হানতে পারবে।"
মুখের সামনে হাত মুঠি করে বিমান অনেকক্ষণ চুপচাপ দানার দিকে তাকিয়ে চিন্তা মগ্ন হয়ে যায়। দানাও চুপচাপ বিমান চন্দকে আর নয়নাকে পড়ার চেষ্টা চালায়। ইষ্ট নাম জপ করে দানা, এইবারে ধরা পড়ে যাবে না তো এই দুইজনার কাছে। দুইজনেই একসাথে জালে উঠে গেছে। চোখে মুখে জয়ের ছোঁয়া, কিন্তু এই ভাবব্যাক্তি কিছুতেই ওদের সামনে দেখান যাবে না।
বেশ কিছুক্ষন পরে গলা খাঁকড়ে দানা বিমানকে জিজ্ঞেস করে, "কি ভাবলেন বিমান বাবু? হাত বাড়াবেন না আমি চলে যাবো। বুদ্ধিমতী নয়না কিন্তু সঠিক বুদ্ধি দিয়েছে। মোহন খৈতানের প্রকল্প গুলো আমার হাতে চলে এলে বাপ্পা নস্কর নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে আমি ওর লোক আর তখনি ওকে আঘাত করার মোক্ষম সুযোগ চলে আসবে।"
বিমান চন্দ অনেক ভেবেচিন্তে দানার কাছ থেকে দুইদিনের সময় চায়। নয়নাকে বুদ্ধিমতী বলাতে খুব খুশি। মনে প্রাণে দানাকে ধন্যবাদ জানায়। গাড়িতে ওঠার আগে দানার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে কানে কানে বলে, "তোমার স্ত্রী সত্যি ভারী সুন্দরী, তাই বলে কি আমাকে ভুলে যাবে?"
দানা মাথা নাড়িয়ে ওর গালে আলতো টোকা দিয়ে বলে, "ইসসস তুমি না সত্যি বড় মিষ্টি। যাই হোক পারলে এই আলোচনার রেকর্ডিংটা দিও।"
নয়না মিচকি হেসে মাথা দোলায়, "সমুদ্র সব রেকর্ড করেছে। তোমার চিন্তা নেই, দিয়ে দেব।" দানার হাত ধরে অনুরোধ করে, "একদিন বিকেলে মিসেস আর মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো।"
দানা মাথা দোলায়, সময় করে একদিন আসবে। তবে মনের গভীরে এক শঙ্কা দেখা দেয়। নয়না এই হাসি হাসি চেহারার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে সেটা কিছুতেই ধরতে পারে না। মনে মনে একটা জয়ের হাসি নিয়ে ওইখান থেকে বেরিয়ে পড়ে দানা।
বাড়িতে এসে মহুয়াকে সব খুলে বলতেই ওকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খায়। একে একে ওদের জালে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সবাই, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। কঙ্কনা আর নাসরিনের খবরাখবর নেই, রমলা বিশ্বাস না বিমান চন্দ, কে মৈনাকের আসল খুনি সেটাও জানা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত রমলার পেছনে চর নিযুক্ত করা হয়নি, রমলার দুর্বলতা শুধু মাত্র নয়না জানে কিন্তু ওকে বেশি চেপে ধরলে উলটো ফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সেইদিন রাতে নয়না ওকে ফোনে জানায় যে বিমান রাজি আছে মোহনের সাথে দেখা করানোর জন্য আর মহুয়ার নির্দেশ অনুযায়ী ওদের আলোচনা সমুদ্র রেকর্ড করে নিয়েছে। পরের বার দেখা হলে সেই টেপ দিয়ে দেবে।
রুহির জন্মদিন, দিন দুয়েক আগে থেকেই আজমের থেকে মহুয়ার বাবা মা এসে গিয়েছিলেন। মহুয়ার বাবা মাকে দেখে দানা বেশ বিবৃত বোধ করে, জানে মহুয়ার বাবা মা রক্ষণশীল রাজস্থানি পরিবার। বিধবা মেয়ে আবার একটা প্রেম করছে আর বিয়ে ছাড়াই ওর সাথে আছে সেটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। লোকেশের খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে আর দানার সাহচর্যে এই কয়দিনে মহুয়া অনেক বদলে গেছে। আজমেরের সেই ঘরের মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকা মেয়ে আর নেই সেই স্থানে দৃঢ় এক নারী দাঁড়িয়ে। মহুয়া পরিস্কার নিজের বাবা মাকে দানার বিষয়ে জানিয়ে দেয়, ওর রুহির "ডাডা"কে যেন এই নিয়ে যেন বিশেষ প্রশ্ন ওদের না করা হয়।
সকাল থেকেই বাড়িতে লোকজন, লোকজন বন্ধুবান্ধব মানে সবাই দানার লোক, কালী পাড়ার মানুষ। মদনা, বলাই, মনা পিন্টু বাজারে ব্যাস্ত। বিকেলে মহেন্দ্র বাবু আসবেন, সাথে শঙ্কর আর রমিজ সপরিবারে আসবে। বাকি ছেলেরা ঘর সাজাতে ব্যাস্ত। পিন্টু আবার কাজের মেয়ে মণির পেছনে লাগতে ব্যাস্ত। কেষ্ট, রজনী আর সদ্যজাত পুত্রকে ওদের বাড়িতে রেখে দিয়ে ট্যাক্সি চালাতে বেরিয়ে যায়। অনেকদিন পরে সবাইকে একসাথে দেখে দানা বেশ খুশি। মহুয়ার কোন বন্ধু বান্ধবী নেই এই শহরে, বিয়ের পর থেকে একরকম গৃহ বন্দী হিসাবেই জীবন যাপন করে গেছে। দানার সঙ্গ পাওয়ার পরেই মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছে। তাই ওর বন্ধু বান্ধবীরাই মহুয়ার কাছের লোক। ওকে বাঁচানোর সময়ে এরাই দানাকে সাহায্য করেছিল। ছোট ছোট পায়ে সারা ঘর মাতিয়ে রুহি নেচে বেড়ায়। জিজ্ঞেস করলেই উত্তর দেয়, "মাই হ্যাপি বার্ডে, মাই হ্যাপি বার্ডে।" বলে একটু নেচে নেয়।
সন্ধ্যের পরেই ঘর ভর্তি হয়ে যায় লোকজনে। মনা আর পিন্টু বসার ঘর, বেলুন, ফিতে আর ফুল দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। মদনা মনে হয় শহরের কেকের দোকানে হত্যে দিয়ে বসে ছিল, চার থাক ওয়ালা একটা বিশাল সাদা ক্রিম কেক নিয়ে ঘরে ঢোকে। কেকের আকার রুহির অর্ধেক, কেক দেখে রুহিকে আর থামানো যায় না, এখুনি কেক খাবে বলে বায়না। বরুন, সুনিতা বৌদি আর ওদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে কেষ্ট বিকেল বেলা দানার বাড়ি পৌঁছে যায়। মহেন্দ্র বাবুর জন্য সবাই অপেক্ষা করে। বেশ কিছু পরে শঙ্কর আর রামিজের পরিবারের সাথে মহেন্দ্র বাবু এসে যান।
কেক কেটে খাওয়ার চেয়ে বেশি মাখামাখি হয়, রুহি একটু খানি খেয়ে নিজেই মেখে সাদা পুতুল হয়ে বসে পরে। সেই নিয়ে খুব হাসা হাসি। মহেন্দ্র বাবু, দানা আর মহুয়াকে একসাথে দেখে বেশ খুশি।
মহুয়ার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে একটা দামী সুন্দর সোনার হার উপহার দেন আর বলেন, "এইবারে সোজা বিয়ে খেতে চাই বৌমা, পরেরবার যেন ওই সিঁথিতে সিন্দুর দেখি।"
মহুয়া লাজুক হেসে মহেন্দ্রবাবুকে বলে, "আপনার ছেলে দেরি করলে আমি কি করতে পারি বলুন।"
দানা মাথা চুলকায় এইবারে বিয়েটা সেরে ফেলতে হয়। চোখ পাকিয়ে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দেয় রাতে ওকে আর আস্ত রাখবে না একদম ফুঁড়ে বেড়িয়ে যাবে। দুষ্টুমি ভরা চোখের চাহনি দেখে মহুয়ার কান গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
শঙ্কর আর রমিজ ওকে একদিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, "হ্যাঁ রে ফারহান কই?"
সত্যিই তো, এতক্ষণ ফারহানের কথা মনে ছিল না কারুর। সঙ্গে সঙ্গে দানা, ফারহানকে ফোন করে, "এই বানচোদ, গান্ডুচোদা কোথায় গাঁড় মারাচ্ছিস বে? এখুনি বাড়ি পৌঁছা না হলে তোর গাঁড় ফুটিফাটা করে দেব।"
ফারহান ঠিক দরজায় ছিল, পাশে জারিনা। ফোন ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে, "কুত্তার বাচ্চা একটু আস্তে চিল্লা শালা।"
জারিনা আসবে এটা সবার আশাতীত, দানার মুখে জারিনার নাম শুনেছে শুধু, এইবারে চাক্ষুষ দেখে মহুয়া বেশ খুশি। যদিও ওদের দৈহিক সম্পর্কের ব্যাপারে সব জানে তবে এটাও জানে সেই সব শুধু কামের বশে দানা লিপ্ত হয়েছিল। ওর সঙ্গে থাকার পরে দানা অন্য কোন নারীর দেহ স্পর্শ করেনি।
জারিনা মহুয়াকে দেখে বলে, "তুমি সত্যি মিষ্টি দেখতে, তাই দানা আর আমার কাছে আসে না।"
দানা ছাড়া অন্য কারুর মুখে এই ধরনের কথাবার্তা শুনতে মহুয়া একদম অভ্যস্ত নয়। সঙ্গমের বার্তালাপ শুধু মাত্র প্রেমিকের মুখেই মানায় তাই জারিনার কথায় বেশ বিবৃত বোধ করে। সঙ্গে সঙ্গে ফারহান অবস্থার সামাল দেয়, "আরে না না, আজকাল দানা খুব ব্যাস্ত তাই দেখা সাক্ষাৎ একটু কমে গেছে।" জারিনার কান টেনে ফিসফিস করে বলে, "কোথায় কি বলতে হয় তাও কি শিখিয়ে দিতে হবে?"
জারিনা বুঝে যায় তাই জিব কাটে। ফারহান সবাইকে জানায় দুই মাস পরে ওদের নিকাহ। রুহির জন্মদিনেই সবাইকে নিমন্ত্রন জানিয়ে যাচ্ছে তবে পরে কার্ড দেবে সবাইকে। হাসি হইচই হট্টগোল মিলিয়ে মেলা বসেছে বাড়িতে। এত খেলনা আর পুতুল পেয়ে রুহি কি করবে ভেবে পায় না। জারিনা আর ফারহান ওর জন্যে একটা জোড়া সোনার বালা উপহার দেয়। দানা মানা করা স্বত্তেও ফারহান জোর করে রুহিকে ওই বালা পড়িয়ে দেয়।
এই হই হট্টগোলের মাঝে আবার শঙ্কর আর রমিজ দানাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যায়।
দানা কারন জিজ্ঞেস করলে রমিজ ওকে বলে, "শোন, সঙ্গীতার সম্বন্ধে তোর সাথে জরুরি কথাবার্তা আছে।"
উৎসুক দানা জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার রমিজ ভাই?"
শঙ্কর ওকে বলে, "সঙ্গীতার মুখ থেকে সব কিছু শোনার পরে আমরা রমলা বিশ্বাসের ওপরে নজর রেখেছিলাম। সব কিছু তথ্য প্রমান হাতে আসার পরেই তোকে জানাবো ভেবেছিলাম। রমলা বিশ্বাসের একটা ছেলে আছে।"
দানা প্রশ্ন করে, "তাতে অসুবিধে কোথায়?"
শঙ্কর গলা নামিয়ে ওকে বলে, "ওই ছেলে রমলার কানীন পুত্র। বর্তমান রাজনেতা দুলাল মিত্রের ঔরসে ওই ছেলের জন্ম। রমলা যখন কলেজে পড়ত তখন দুলাল মিত্রকে ভালবাসত, সেই সময়ে ওই ছেলের জন্ম হয়। কিছু পারিবারিক কারনে দুইজনের আর বিয়ে হয় না কিন্তু রমলা ওই সন্তানের জন্ম দেয়। দুলাল মিত্র তখন সবে রাজনীতিতে ঢুকেছে, এই কালিমা ঢাকার জন্য ওরা ওই সদ্যজাত শিশুকে একটা অনাথালয়ে দিয়ে দেয়। দুলাল মিত্র পরে বিয়ে করে ওর বাবার চেনাশোনা একজনের সাথে আর রমলার বিয়ে হয়ে গেল অন্য একজনের সাথে। তবে ওরা দুইজনে ওই ছেলের ওপরে নজর রেখেছিল। বর্তমানে বেলপাহাড়ির এক আবাসিক স্কুলে থেকে সেই ছেলে পড়াশুনা করে। এই ব্যাপার কাক পক্ষীতেও জানে না, না দুলালের স্ত্রী জানে না রমলার স্বামী জানে। ওই ছেলের পড়াশুনার খরচ খরচা সব কিছু দুলাল মিত্র দেয়। মাঝে মাঝে রমলা আর দুলাল ওই স্কুলে গিয়ে ছেলের সাথে দেখা করে আসে তবে ছেলে এখন পর্যন্ত বাবা মায়ের আসল পরিচয় জানে না। যে অনাথালয়ে ছেলেটা বড় হয়েছিল সেইখানের অধ্যাপিকা শুধু এদের আসল পরিচয় জানে।"
দানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোমরা এত গোপন খবর জানলে কি করে?"
রামিজ বলে, "অনেকদিন থেকেই ওকে অনুসরন করছিলাম। একদিন দেখলাম রমলা, পরিবার ছাড়াই গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে ঘুরতে গেল। সন্দেহ হল আর আমরা পিছু নিলাম। মহানগর ছাড়িয়ে অনেকদুরে একটা হোটেলে দেখালাম রমলা বিশ্বাসের সাথে দুলাল মিত্র দেখা করলো। গভীর চক্রান্তের গন্ধ পেলাম, আর পেছন ছাড়লাম না। দুইজনে ওই অনাথালয়ে গেল সেই ছেলেটার সাথে দেখা করতে। বেশ বড় ছেলে, একদম মায়ের মতন দেখতে। ওকে দেখেই সবকিছু আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল।"
দানা বুক ভরে শ্বাস নেয়, তাহলে এই সেই দুর্বলতা যার কথা নয়না ওকে বলেছিল। এইবারে রমলাকে কোণঠাসা করা সহজ হয়ে যাবে। এইবারে মৈনাকের খুনির ব্যাপারে জানা যাবে, সঙ্গীতার চোখের জলের প্রতিশোধ নেওয়া যাবে।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
পিনুরামের লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereপিনুরামের লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল ইনডেক্স এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
No comments:
Post a Comment