আমরা টেক্সট ফরম্যাটে গল্প দেয়ার জন্য দুঃখিত, যারা ফন্ট সমস্যার কারনে পড়তে পারবেন না তাদের কাছে আগেই জানিয়ে রাখছি। আরও দুঃখিত গল্পগুলো চটি হেভেনের স্পেশাল ফরম্যাটে না দিতে পারার জন্য। খুব শিগগিরই গল্পগুলো এডিট করে চটি হেভেন ফরম্যাটে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো। এই অসঙ্গতির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
নিয়তির স্রোতস্বিনী
Written By SS_Sexy
Written By SS_Sexy
(#৫৪)
আমি ওর বুক থেকে মাথাটা তুলে কৌতূহলী চোখে ওর মুখের দিকে চাইতেই টুপু আমার গালে হাত রেখে বলল, "দু’মাস আগে ওই ফার্ম হাউসে গিয়ে বিদ্যুৎ যখন তোমার ছবি তুলে এনে আমাকে দেখিয়েছিল, আমি তো তখন থেকেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। শান্তুদা যখন অনুরাধা আর ডাক্তার ঘোষালের মাধ্যমে মাসির ফোন নাম্বার পেয়ে তার সাথে কটাক্ট করেছিলেন, তখন মাসি তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দেবার বিনিময়ে টাকার দাবী করতেও আমরা টাকা দিতে প্রস্তুত ছিলাম।
অবশ্য এটা আমরা মনে মনে আগেই ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই মাসি আমাদের জানিয়েছিল যে গজাননের ভয়ে তুমি মাসির বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইছ না। তখন আমরা তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে ব্যাপারটা পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত মাসি যেন তোমাকে সুরক্ষিত রাখে। গজাননের খোঁজ আমরা করছি। মাসি তখন বলেছিল যে শুধু গজানন নয়, ওর দলের অন্য সবাইকেও পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই তুমি পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। তখন মাসি আর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যতদিন পর্যন্ত গজানন আর তার দলের অন্য সবাইকে জেলে পুরতে না পারব ততদিন তুমি মাসির ওই বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি আমার থেকেই গিয়েছিল। মাসির বাড়িতে থাকা মানেই তো তোমাকে দিয়ে সে তার ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কিন্তু ভগবান সদয় হয়েছিলেন বলেই অনুরাধা ও বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোবার দু’দিন বাদেই মাসি আবার আমাদের বাড়ি এসেছিল। তখন সে তোমার আসল পরিচয় জানতে পেরেছে। আর সেটা জানতে পেরেই সে আমাদের কথা দিয়েছিল। এখানে এসে মা, বাবা আর জেঠু জেঠিমার ছবি দেখে আর আমাদের সকলের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর আমাদের বলেছিল যে গজাননের হদিশ তার জানা আছে। কিন্তু তার সঙ্গীসাথীদের খোঁজ দুর্গাপুরের ওদিকেই পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা। তবে সে সেদিনই আমাদের কথা দিয়ে গিয়েছিল যে করেই হোক তোমাকে সে আমাদের হাতে তুলে দেবেই। আর এর বিনিময়ে সে একটি পয়সাও নেবে না। তখন আমি, দিদি, শান্তুদা, বিদ্যুৎ, বিজলীদি আর অনুরাধা মিলে দলবদ্ধ ভাবে গজাননের সঙ্গীসাথীদের খোঁজ করতে শুরু করলাম। আমি নিজে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আর বিদ্যুৎ সরকারী উকিল হবার দৌলতে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে বারো বছর পুরোনো ওই কেসটাকে আবার নতুন করে খুলি। তবে সবচেয়ে বড় কাজটা কিন্তু বিজলীদিই করেছে। সে গজাননের ওই দলের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা খুঁজে বের করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল। আমরা সেটা সাথে সাথে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। গত সপ্তাহেই মুর্শিদাবাদ পুলিশ আমাদের জানালো যে আসানসোলের কাছে গজানন সহ ওর দলের আরও পাঁচজনকে তারা অ্যারেস্ট করেছেন। তবে গজাননকে তারা জীবিতাবস্থায় ধরতে পারেনি। গজাননের মুখটাকে শুধু অক্ষত রেখে ওর শরীরের বাদবাকী গোটা অংশটাই নাকি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখা হয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে। ওর পুরুষাঙ্গের দুটো অংশ নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। খবরটা পরের দিন প্রকাশিত হয়। জীবিত অন্য পাঁচজনের বিরূদ্ধে বারো বছর আগের সেই মামলায় লুঠতরাজ, ধর্ষণ আর খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আর গজাননের দলের আরও দু’জন দুষ্কৃতী নাকি ইতিমধ্যেই আলাদা আলাদা সময়ে মারা গেছে। কিন্তু গজাননের দলের সাথে অন্য কোন দলের সংঘর্ষ হয়েছিল, এ ব্যাপারে পুলিশ কোন সূত্র খুঁজে পায় নি। তবে আমার মনে হয়, ওই অন্য দলটার পেছনেও বুঝি বিজলীদির কোনও হাত আছে। কিন্তু পুলিশ যখন সেটা ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আমিও কোন প্রশ্ন তুলিনি। তবে বিজলীদিই যদি সত্যি এ’সবের পেছনে থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেও হয়ত কোন না কোন ভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে। তবে সেটা যা-ই হোক। বিজলীদির সাহায্য ছাড়া গজাননের ওই দলটাকে পুলিশ হয়ত কখনোই ধরতে পারত না। তাই তোমার জীবনের সমস্ত কাটা নির্মূল করার পেছনে তার একটা বিরাট অবদান আছে। তুমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস কোর না প্লীজ। গজাননকে খুন করার পেছনে বা গজাননের দলটাকে ধরিয়ে দেবার পেছনে যদিও তার কোনও হাত থেকে থাকে, আমি চাই না, যে সে’সব কথা নিয়ে আমরা কোনও আলোচনা করি। গতকাল মুর্শিদাবাদ জেলা আদালতে জীবিত পাঁচজন দুষ্কৃতীর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তাই ওরা আর বেঁচে থাকতে জেল থেকে বেরোতে পারবে না। গজাননের কালো ছায়াটা তোমার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য সরে গেছে, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।"
টুপুর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল, বিজলীদি আমাকে বলেছিল যে গজাননের বাড়া কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবে। গজাননের মৃতদেহ টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার পুরুষাঙ্গের দুটো টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়নি, এ’সমস্ত কথা কাগজে প্রকাশিত হয়নি। কেন কে জানে। তবে আমারও মনে হল গজাননকে বুঝি বিজলীদিই খুন করেছে।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে টুপু আমার হাতটা ধরে বলল, "কী ভাবছ রুমু? আমার কথাটা রাখবে তো? বিজলীদিকে গজাননের মৃত্যুর ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করবে না তো?"
আমি মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বললাম, "নাহ, কিচ্ছু বলব না। তবে বিজলীদি আমার জন্য যা করল তাতে আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।"
টুপু আমার দুটো হাত একসাথে মুঠো করে ধরে বলল, "উহু, শুধু তুমি একা নও রুমু। আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব চিরকাল। কিন্তু এবার ওঠো। চলো, নিচে দিদিরা সবাই যে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে" বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুলল।
আমিও দাঁড়িয়ে বললাম, "কিন্তু টুপু, আমার মনে হয় তোমরা ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু ভেবে দ্যাখ। আমার মত একটা মেয়ে, যে কিনা বারো বছর ধরে একটা বেশ্যা হয়ে জীবন কাটিয়েছে, তাকে বিয়ে করে তোমরা প্রতিদিন প্রতি পদে পদে হেনস্থা হবে। নিজের কষ্ট সইবার মত ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু তোমাকে, ঝুনুদিকে যে আমি কোন কষ্ট দিতে চাই না। আমার জন্য তোমরা সবাই কেন এমন ............"
আমার মুখের ওপর টুপুর ঠোঁটদুটো নেমে এসে আমার কথা থামিয়ে দিল। আমাকে দু’হাতে নিজের বুকে চেপে ধরে টুপু আমার ঠোঁট দুটোকে নিজের মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে আবেগভরা চুমু খেতে লাগল। কয়েকটা মূহুর্তে পেরিয়ে যাবার পর আমার মনে হল আমার শরীরটা যেন টুপুর দু’হাতের বন্ধনের মাঝে গলতে শুরু করেছে। টুপু বেশ কিছুক্ষণ ধরে এমন পাগলের মত আমায় চুমু খেল যে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হল এক যুগ বাদে কেউ যেন আমাকে আদর করছে। নিজের অজান্তেই আমার হাতদুটো টুপুর গলা জড়িয়ে ধরল। আমিও যে কখন ওর চুমুর জবাবে চুমু দিতে শুরু করেছি, এটা বুঝতেই পারিনি।
একসময় টুপু আমাকে চুমু খেতে খেতেই দেয়ালের দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে একসময় আমার মুখ থেকে নিজের ঠোঁট টেনে তুলে বলল, "এসো আমরা একসাথে মা-বাবা আর জেঠু জেঠিমাকে প্রণাম করি।"
আমার শরীরটা তখন অল্প অল্প কাঁপছিল। কিন্তু এ কম্পন যে আগের মত নয় সেটাও বুঝতে পারছিলাম। জীবনে প্রথমবার প্রেমিকের চুম্বনজনিত কম্পনের স্বাদ পেয়ে ক্ষণিকের জন্য অভিভূত হয়ে পড়লাম যেন। টুপু আমার গালে গাল চেপে মা-বাবার ছবিতে কপাল ছোঁয়াল। আমিও সে ছবিতে প্রণাম করলাম। দু’চোখ ছাপিয়ে এল আমার আবার।
কাকু কাকিমার ছবিতে প্রণাম করবার সাথে সাথেই বাইরে থেকে ঝুনুদির গলার ডাক শুনলাম, "ভাই।"
আমরা তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে দাঁড়াতেই টুপু জবাব দিল, "হ্যাঁ দিদি, আয়" বলতেই ঝুনুদি আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি নিজেকে সামলে নিতে ঝুনুদি জিজ্ঞেস করল, "কিরে হয়েছে তোদের কথা? চল। সবাই যে তোদের দুটিকে জোড়ে দেখবার জন্য আকুল হয়ে বসে আছে।"
টুপু বলল, "হ্যাঁ দিদি, আমরা তো বেরোচ্ছিলাম এখনই।"
আদি ঝুনুদির কোল থেকে নেমে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "ও মামি, চল না। আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে। আজ আমি তোমার হাতে খাব তো।"
আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে আমার বুকে চেপে ধরে বললাম, "হ্যাঁ বাবাসোনা। চল। এখন থেকে আমিই তোমাকে রোজ খাইয়ে দেব।"
নিচের ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল আমাকে আর টুপুকে একসাথে ঘরে ঢুকতে দেখে। ঘরের সোফায় কুলোয়নি। আরও অনেকগুলো চেয়ারে অনেকে বসে ছিল। ডক্টর মুখার্জী, শ্রীময়ী, বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা, শেফালী ছাড়াও আরও একজনকে দেখেই বুঝলাম ইনিই সেই বিদ্যুৎবাবু। ফার্ম হাউসে সামন্তর সাথে এই লোকটাকেই সেদিন দেখেছিলাম আমি। আমাকে আদিকে কোলে নিয়ে ঢুকতে দেখে ঘরের সবাই উঠে দাঁড়াল। ঝুনুদি আর টুপু আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকতেই কে যেন শাঁখে ফুঁ দিল। আর সেই সাথে সামনে পেছনে থেকে দু’তিনজন উলু দিয়ে উঠল। আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নামাতেই অনুরাধা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কনগ্রেচুলেশনস রুমুদি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু কন্যাপক্ষের লোক। কনের বোন আমি। তোমার মামারাও সবাই আসছেন বিয়েতে। তাদের সবাইকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। তারা তো কালই আসতে চাইছিলেন। শান্তুদা তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন যে আসছে মাসের সাত তারিখে তোমাদের বিয়ে। তারা সবাই দু’ তিন দিন আগেই সপরিবারে চলে আসবেন এখানে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। কালই তোমাদের বিয়ের অ্যাপ্লিকেশন রেজিস্ট্রি অফিসে জমা করা হবে। বিদ্যুৎ-দার হাতের ফর্মটায় শুধু এখন সই করে দাও।"
বিদ্যুৎ সেন্টার টেবিলের ওপর একটা ফর্ম আর কলম দেখিয়ে বলল, "এসো টুপুদা, তোমরা দু’জন এটাতে এখনই সই করে দাও। আমি এটা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাব আজ। কাল সকালে কল্যান আমার বাড়ি থেকে এটা নিয়ে যাবে।"
অনুরাধা আমার কোল থেকে আদিকে টেনে নিতেই ঝুনুদি আমাকে আর টুপুকে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। ম্যারেজ অ্যাপ্লিকেশনে সই করবার পর আমি ডক্টর মুখার্জীর কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত ছোঁয়াতে যেতেই সে আমার হাত ধরে ফেলে বলল, "উহু উহু, আমি আমার শালা বৌয়ের প্রণাম নিতে পারব না। শালা বৌ আর নন্দাইয়ের সম্পর্কের মাঝে প্রণাম এসে গেলে তো এমন রোমান্টিক সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, গুরুজন হিসেবে একটা আশীর্বাদ তোমাকে করাই যায়" বলে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, "ভাল থেকো। সুখী থেকো। আর আমার এতদিন বাউণ্ডুলে হয়ে থাকা শালাবাবুটাকে সুখে রেখো।"
আমি ঘুরে ঝুনুদির মুখোমুখি হতেই সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "নারে সোনা, তোকে কাউকে প্রণাম করতে হবে না। শুধু আমার ভাইটাকে নিয়ে তুই সুখে থাকিস, তাহলেই আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে" বলে কেঁদে ফেলল।
আমি নিজেকে সামলে বিদ্যুতের দিকে ঘুরতেই বিদ্যুৎ হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, "নমস্কার ম্যাডাম। টুপুদাকে আমি দাদার মত শ্রদ্ধা করি। তাই আমাকে যদি আপনি আপনার দেবর বলে ভাবেন, তাহলেই আর কিছু চাই না। আর আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় তো হয়েই গেছে।"
আমি একটু মুচকি হাসতেই শ্রীময়ী আমার কাছে এসে বলল, "সে আর তোমাকে বলতে হবে না। আমি তো বৌদিকে টুপুবৌদি বলে ডাকব আজ থেকে।"
আমি সকলের সাথে হাসি বিনিময় করে ঘরের এক কোনায় শ্যামলীদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্যামলীদি আমাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমারও দু’চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। শ্যামলীদিকে বুকে চেপে ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "আমাকে আশীর্বাদ কর শ্যামলীদি। বাকি জীবনটা যেন ভালভাবে কাটাতে পারি। গুবলুকে ভাল করে পড়তে বলবে। ওর সারা জীবনের পড়া শোনার খরচ আমি দেব। তুমি শুধু ওকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বোলো।"
শ্যামলীদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "ভগবান এতদিন বাদে যখন মুখ তুলে চেয়েছেন তখন তুই নিশ্চয়ই সুখে থাকবি রে বোন। জানিনা আর তোর সাথে বসে আগের মত সুখ দুঃখের কথা বলতে পারব কি না। তবু তোর যদি কখনও এই বুড়ি শ্যামলীদির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে ফোন করিস। মাসির ফোন নাম্বার তো তোর বরের কাছে আছেই। তবে গুবলুটার খুব মন খারাপ হবে রে।"
শ্যামলীদিকে ছেড়ে বিজলীদির দিকে চাইতেই দেখি তার চোখদুটোও জলে ভরা। আমি তার দিকে চাইতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "এই প্রায়শ্চিত্তটুকু করবার সুযোগ আমাকে দিয়েছিস বলে তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রে মিনু। না না, আর মিনু নয়। তোকে এখন থেকে রুমু বলেই ডাকব। এখন আমি মরে গেলেও আমার কোন আফসোস নেই। জেঠু জেঠিমাকে অন্ততঃ বলতে পারব যে তোমাদের রুমু ভাল আছে। ও সুখে আছে। ওকে আমি ভাল লোকের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। আর শোন, ডাক্তার বাবু তো আজ কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়ছেন না। অনেক রাত হয়ে গেল। ফিরে যেতে তো ঘণ্টা দুয়েক আরও লাগবে। তাই আজ এখন খেয়েই আমরা তিনজনে চলে যাব। তোকে কথা দিয়েছিলাম যে তুই নিজে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না চাইলে আমি তোকে কখনও তাড়িয়ে দেব না। এখন তুই বল। তুই কি আমার বাড়িতেই থাকবি? না এখানে ডাক্তারবাবুর এই পরিবারে থাকবি?"
আমি কোন কথা না বলে বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলল, "আর কাঁদিসনে বোন। ভগবানের দয়ায় তোর দুঃখের দিন আজ শেষ হল। তবে শোন, আমি জানি, এ বাড়িতে তুই খুব সুখে থাকবি। তবু যদি কখনো কোন প্রয়োজনে আমার কথা মনে পড়ে তাহলে একফোটাও ইতস্ততঃ না করে আমাকে ফোন করবি। আমি যেখানেই থাকিনা কেন, সব সময় আমাকে তোর পাশে পাবি। আগে তোকে যে’সব কথা দিয়েছিলাম। তা যেমন রেখেছি, ভবিষ্যতেও তাই করব। শুধু গত দশটা বছরের জন্য আমাকে মাফ করে দিস বোন। আর মনে রাখিস এ বাড়ির এনারা সকলে ছাড়াও তোর আরেকটা দিদি আছে। আর সে দিদিটা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোর পাশে থাকবে। বিপদে আপদে যে কোনও কাজে প্রয়োজন হলে শুধু আমার কাছে খবরটা পাঠাস। আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে তোর কাছে চলে আসব।"
আমি বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে "দিদি" বলে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আবার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "কান্না থামা বোন। বারোটা বছর ধরে তো অনেক কেঁদেছিস তুই। আজ থেকে আমি তোর মুখে শুধু হাসি দেখতে চাই। তুই তো জানিস, আমরা বেশ্যা। সকলেই জানে আমাদের মধ্যে কোন ভালবাসাবাসি থাকে না। আমরা শুধু আমাদের শরীর বিলিয়ে পয়সা কামাতে পারি। সেটাই তো আমাদের ধর্ম। আমাদের কর্ম। আজ তোর জন্য আমি ধর্মুচ্যুত হয়েও খুব সুখ পাচ্ছি রে। তবে তোকে কিন্তু আর আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। তুই এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবি। তোর ঘর থেকে পুরোনো জামাকাপড় টাপর কিচ্ছু আনতে হবে না তোকে। ঝুনু আর টুপু তোর জন্যে প্রচুর নতুন নতুন পোশাক শাড়ি ব্লাউজ কিনে রেখেছে। তাই ওই পুরনো জিনিসগুলো এ বাড়িতে না আনাই ভাল। তবে তোর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যদি কিছু থেকে থাকে, যা তোর কাজে লাগবে, তাহলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দিস। আমি সে’সব এখানে পৌঁছে দেব।"
বিজলীদির কথা শুনে নিজের চোখ মুছতে মুছতে অনুরাধার দিকে চাইতেই সে আমার কাছে এসে হেসে বলল, "জানো রুমুদি? আজ থেকে মাসি আমাকেই তার বাড়ির মক্ষিরানী করে দিয়েছে।"
আমি জোর করে একটু হেসে বললাম, "ভালই তো। বিজলীদির ব্যবসায় খুব পসার হবে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে তুই যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ওখানে গিয়েছিলিস সেটা তো পুরো হয়ে গেছে। তাই হয়ত আর ওখানে থাকবি না।"
অনুরাধাও হেসে গলা নামিয়ে বলল, "প্রথমে তো আমিও খানিকটা সে’রকমই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেটা করাটা ঠিক হবে না। এমন নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় পেয়ে সেটাকে ছেড়ে যাওয়াটা ভুল হবে। তাই ভাবছি এখানেই থেকে যাব। এমন সুন্দর বাড়িউলী আর এমন নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথায় পাব বলো তো? আর আমি যা চাই, সেটা তো এখানে থেকেও পাবো। মাঝে মাঝে ফোন কোরো। তোমাদের খবরাখবর জানিও।"
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বিজলীদিরা রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে গেল। পরের মাসের সাত তারিখে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হল। এই একটা মাস আমি বাড়ির দোতলার গেস্টরুমে শান্তুদা আর ঝুনুদির ছেলে আদিকে সঙ্গে নিয়ে শুয়েছি। স্কুলের সময়টুকু ছেড়ে আদি সর্বক্ষণ আমার সাথে সাথে থেকেছে।
বড়মামা, মেজমামা আর ছোটমামারা সকলেই মামিদের নিয়ে আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়ের তিনদিন আগে চলে এসেছিল। তিন মামাই আমাকে এতগুলো বছর পর দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। মামাদের থাকবার জন্য বাড়ির কাছাকাছি আলাদা একটা গেস্ট হাউস ভাড়া করা হয়েছিল।
তিনতলার ছাদের ওপর ছোটখাটো একটা প্যাণ্ডেল বানানো হয়েছিল। যেখানে জনা পঞ্চাশেক লোকের খাবার ব্যবস্থা আর পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। বাইরের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। বিজলীদির বাড়ি থেকে প্রত্যেকেই নাকি আমাদের বিয়েতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজলীদি আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে ও বাড়িতেই আলাদা করে এক বৃহস্পতি বারে পার্টির আয়োজন করার কথা দিয়ে সবাইকে থামিয়েছিল। এসেছিল শুধু বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা আর গুবলু। বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ীও এসেছে। গত একমাসে শ্রীময়ী আমার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। কিন্তু টুপুবৌদি ছাড়া আমাকে সে আর অন্য কোন নামে সম্বোধন করে না। বড়মামাদের বাড়ির চারজন, মেজমামার বাড়ির ছ’জন আর ছোটমামার বাড়ির পাঁচজন এসেছিল। টুপুর কাকা জ্যেঠা মামা মাসি বলে কেউ নেই। শুধু এক পিসি আছেন রাঁচিতে। কিন্তু বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন বলে তার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। তিনি সেখান থেকে তার আশীর্বাদী একটা খুব সুন্দর বেনারসি শাড়ি আর একটা গলার হার পাঠিয়েছেন আমার জন্যে। এ বাড়ির চার পাঁচ জন ছাড়া সান্তুদার প্রাইভেট চেম্বারের কর্মচারী আর স্টাফেরা ছাড়া বিয়েতে হাজির ছিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, আর তার অফিসের এক এসিস্ট্যান্ট আর কয়েকজন চাকর বাকর। আর বাইরের লোক বলতে ছিল ডেকোরেটর আর ক্যাটারিং-এর লোকজনেরা। আর কয়েকজনের গাড়ির ড্রাইভার। সবমিলে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন লোকের সমাগম হয়েছিল।
শ্রীময়ী আর অনুরাধা মিলে কনে সাজানোর কাজ করল। আয়নায় নিজের চেহারাকে দেখে আমি নিজেই যেন চিনতে পারছিলাম না। রেজিস্ট্রির সময় কনের তরফ থেকে সাক্ষ্য দিলেন আমার তিন মামা আর অনুরাধা। বরের পক্ষ থেকে সাক্ষী দিলেন সান্তুদা, ঝুনুদি আর বিদ্যুৎ। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যেই বিয়ে সমাধা হয়ে গেল। তারপর পার্টি। আর রাত ন’টার পর থেকে ডিনার চালু হয়েছিল। প্রচুর ছবি তোলা হল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ অতিথিরা সবাই চলে গেল। বাড়িতে রয়ে গেল শুধু বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ী।
সবাই চলে যাবার পর ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে ধরে তিনতলার টুপুর বেডরুমে নিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। দারুণ সুন্দর করে ফুলশয্যার খাট সাজানো হয়েছে। ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে নিয়ে দেয়ালে টাঙানো মা-বাবাদের ছবিগুলোর সামনে নিয়ে যেতেই আমি আর টুপু ছবি হয়ে যাওয়া লোকগুলোকে প্রণাম করলাম। মনে মনে মা-কে বললাম, ‘মাগো, আমাকে আশীর্বাদ কর মা। আমি যেন এ বাড়ির সবাইকে খুশী রাখতে পারি। ঝুনুদি শান্তুদা আর টুপুর মনে যেন কখনও দুঃখ না দিয়ে ফেলি’।
মনে মনে এমন প্রার্থনা করতেই মনে হল আমার মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিল। চমকে চোখ মেলে এদিক ওদিক চাইতেই শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করল, "কিগো টুপুবৌদি, এভাবে চমকে উঠলে কেন?"
আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, "না না, কিছু না এমনি।"
ঝুনুদি বলল, "ভাই, রুমু, তোরা বাবা মা আর জেঠু জেঠিমার কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নে। তারা যেখানেই থাকুন, সকলেই আজ প্রাণভরে তোদের দুটিকে আশীর্বাদ করবেন।"
আমরা প্রণাম সেরে উঠতেই ঝুনুদি আমাদের বিছানার দিকে নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, "কিরে রুমু? কী আশীর্বাদ চাইলি মা বাবার কাছে?"
আমি ঝুনুদির দিকে একটু ঘুরে বললাম, "আমি মা বাবা, কাকু কাকিমা আর দাদাদের কাছে শুধু এ আশীর্বাদই চেয়েছি যে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি যেন তোমাদের সাথে একসাথে থেকে তোমাদের সবাইকে খুশী রাখতে পারি।"
ঝুনুদি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, "পাগলী কোথাকার। নিজের জন্যে কিছু চাইলি না?"
আমিও মৃদু হেসে বললাম, "নিজের জন্যেই তো অমন আশীর্বাদ চাইলাম।"
"আচ্ছা বেশ করেছিস" বলতে বলতে আমাকে আর টুপুকে পাশাপাশি বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, "শ্রীময়ী এ ঘরের সবগুলো আলো জ্বেলে দে তো। আর পাশের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেখ একটা ক্যামেরা আছে, ওটাও নিয়ে আয়"
বলে টুপুকে বলল, "ভাই তখন হুড়োহুড়িতে রুমুর সাথে আমি আলাদা করে একটাও ছবি ওঠাতে পারিনি। এবার তুই কয়েকটা স্ন্যাপ নে। রুমুর সাথে আমি আর শ্রীময়ী উঠব। তারপর আমি শুধু তোদের দু’জনের দুটো স্ন্যাপ নেব। আজকের এ দিনটা যে আমার সবচেয়ে খুশীর দিন। এ দিনটার স্মৃতি তো সারাজীবন চেরিশ করবআমরা সবাই।"
অবশ্য এটা আমরা মনে মনে আগেই ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই মাসি আমাদের জানিয়েছিল যে গজাননের ভয়ে তুমি মাসির বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইছ না। তখন আমরা তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে ব্যাপারটা পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত মাসি যেন তোমাকে সুরক্ষিত রাখে। গজাননের খোঁজ আমরা করছি। মাসি তখন বলেছিল যে শুধু গজানন নয়, ওর দলের অন্য সবাইকেও পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই তুমি পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। তখন মাসি আর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যতদিন পর্যন্ত গজানন আর তার দলের অন্য সবাইকে জেলে পুরতে না পারব ততদিন তুমি মাসির ওই বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি আমার থেকেই গিয়েছিল। মাসির বাড়িতে থাকা মানেই তো তোমাকে দিয়ে সে তার ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কিন্তু ভগবান সদয় হয়েছিলেন বলেই অনুরাধা ও বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোবার দু’দিন বাদেই মাসি আবার আমাদের বাড়ি এসেছিল। তখন সে তোমার আসল পরিচয় জানতে পেরেছে। আর সেটা জানতে পেরেই সে আমাদের কথা দিয়েছিল। এখানে এসে মা, বাবা আর জেঠু জেঠিমার ছবি দেখে আর আমাদের সকলের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর আমাদের বলেছিল যে গজাননের হদিশ তার জানা আছে। কিন্তু তার সঙ্গীসাথীদের খোঁজ দুর্গাপুরের ওদিকেই পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা। তবে সে সেদিনই আমাদের কথা দিয়ে গিয়েছিল যে করেই হোক তোমাকে সে আমাদের হাতে তুলে দেবেই। আর এর বিনিময়ে সে একটি পয়সাও নেবে না। তখন আমি, দিদি, শান্তুদা, বিদ্যুৎ, বিজলীদি আর অনুরাধা মিলে দলবদ্ধ ভাবে গজাননের সঙ্গীসাথীদের খোঁজ করতে শুরু করলাম। আমি নিজে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আর বিদ্যুৎ সরকারী উকিল হবার দৌলতে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে বারো বছর পুরোনো ওই কেসটাকে আবার নতুন করে খুলি। তবে সবচেয়ে বড় কাজটা কিন্তু বিজলীদিই করেছে। সে গজাননের ওই দলের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা খুঁজে বের করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল। আমরা সেটা সাথে সাথে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। গত সপ্তাহেই মুর্শিদাবাদ পুলিশ আমাদের জানালো যে আসানসোলের কাছে গজানন সহ ওর দলের আরও পাঁচজনকে তারা অ্যারেস্ট করেছেন। তবে গজাননকে তারা জীবিতাবস্থায় ধরতে পারেনি। গজাননের মুখটাকে শুধু অক্ষত রেখে ওর শরীরের বাদবাকী গোটা অংশটাই নাকি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখা হয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে। ওর পুরুষাঙ্গের দুটো অংশ নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। খবরটা পরের দিন প্রকাশিত হয়। জীবিত অন্য পাঁচজনের বিরূদ্ধে বারো বছর আগের সেই মামলায় লুঠতরাজ, ধর্ষণ আর খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আর গজাননের দলের আরও দু’জন দুষ্কৃতী নাকি ইতিমধ্যেই আলাদা আলাদা সময়ে মারা গেছে। কিন্তু গজাননের দলের সাথে অন্য কোন দলের সংঘর্ষ হয়েছিল, এ ব্যাপারে পুলিশ কোন সূত্র খুঁজে পায় নি। তবে আমার মনে হয়, ওই অন্য দলটার পেছনেও বুঝি বিজলীদির কোনও হাত আছে। কিন্তু পুলিশ যখন সেটা ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আমিও কোন প্রশ্ন তুলিনি। তবে বিজলীদিই যদি সত্যি এ’সবের পেছনে থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেও হয়ত কোন না কোন ভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে। তবে সেটা যা-ই হোক। বিজলীদির সাহায্য ছাড়া গজাননের ওই দলটাকে পুলিশ হয়ত কখনোই ধরতে পারত না। তাই তোমার জীবনের সমস্ত কাটা নির্মূল করার পেছনে তার একটা বিরাট অবদান আছে। তুমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস কোর না প্লীজ। গজাননকে খুন করার পেছনে বা গজাননের দলটাকে ধরিয়ে দেবার পেছনে যদিও তার কোনও হাত থেকে থাকে, আমি চাই না, যে সে’সব কথা নিয়ে আমরা কোনও আলোচনা করি। গতকাল মুর্শিদাবাদ জেলা আদালতে জীবিত পাঁচজন দুষ্কৃতীর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তাই ওরা আর বেঁচে থাকতে জেল থেকে বেরোতে পারবে না। গজাননের কালো ছায়াটা তোমার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য সরে গেছে, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।"
টুপুর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল, বিজলীদি আমাকে বলেছিল যে গজাননের বাড়া কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবে। গজাননের মৃতদেহ টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার পুরুষাঙ্গের দুটো টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়নি, এ’সমস্ত কথা কাগজে প্রকাশিত হয়নি। কেন কে জানে। তবে আমারও মনে হল গজাননকে বুঝি বিজলীদিই খুন করেছে।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে টুপু আমার হাতটা ধরে বলল, "কী ভাবছ রুমু? আমার কথাটা রাখবে তো? বিজলীদিকে গজাননের মৃত্যুর ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করবে না তো?"
আমি মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বললাম, "নাহ, কিচ্ছু বলব না। তবে বিজলীদি আমার জন্য যা করল তাতে আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।"
টুপু আমার দুটো হাত একসাথে মুঠো করে ধরে বলল, "উহু, শুধু তুমি একা নও রুমু। আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব চিরকাল। কিন্তু এবার ওঠো। চলো, নিচে দিদিরা সবাই যে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে" বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুলল।
আমিও দাঁড়িয়ে বললাম, "কিন্তু টুপু, আমার মনে হয় তোমরা ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু ভেবে দ্যাখ। আমার মত একটা মেয়ে, যে কিনা বারো বছর ধরে একটা বেশ্যা হয়ে জীবন কাটিয়েছে, তাকে বিয়ে করে তোমরা প্রতিদিন প্রতি পদে পদে হেনস্থা হবে। নিজের কষ্ট সইবার মত ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু তোমাকে, ঝুনুদিকে যে আমি কোন কষ্ট দিতে চাই না। আমার জন্য তোমরা সবাই কেন এমন ............"
আমার মুখের ওপর টুপুর ঠোঁটদুটো নেমে এসে আমার কথা থামিয়ে দিল। আমাকে দু’হাতে নিজের বুকে চেপে ধরে টুপু আমার ঠোঁট দুটোকে নিজের মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে আবেগভরা চুমু খেতে লাগল। কয়েকটা মূহুর্তে পেরিয়ে যাবার পর আমার মনে হল আমার শরীরটা যেন টুপুর দু’হাতের বন্ধনের মাঝে গলতে শুরু করেছে। টুপু বেশ কিছুক্ষণ ধরে এমন পাগলের মত আমায় চুমু খেল যে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হল এক যুগ বাদে কেউ যেন আমাকে আদর করছে। নিজের অজান্তেই আমার হাতদুটো টুপুর গলা জড়িয়ে ধরল। আমিও যে কখন ওর চুমুর জবাবে চুমু দিতে শুরু করেছি, এটা বুঝতেই পারিনি।
একসময় টুপু আমাকে চুমু খেতে খেতেই দেয়ালের দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে একসময় আমার মুখ থেকে নিজের ঠোঁট টেনে তুলে বলল, "এসো আমরা একসাথে মা-বাবা আর জেঠু জেঠিমাকে প্রণাম করি।"
আমার শরীরটা তখন অল্প অল্প কাঁপছিল। কিন্তু এ কম্পন যে আগের মত নয় সেটাও বুঝতে পারছিলাম। জীবনে প্রথমবার প্রেমিকের চুম্বনজনিত কম্পনের স্বাদ পেয়ে ক্ষণিকের জন্য অভিভূত হয়ে পড়লাম যেন। টুপু আমার গালে গাল চেপে মা-বাবার ছবিতে কপাল ছোঁয়াল। আমিও সে ছবিতে প্রণাম করলাম। দু’চোখ ছাপিয়ে এল আমার আবার।
কাকু কাকিমার ছবিতে প্রণাম করবার সাথে সাথেই বাইরে থেকে ঝুনুদির গলার ডাক শুনলাম, "ভাই।"
আমরা তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে দাঁড়াতেই টুপু জবাব দিল, "হ্যাঁ দিদি, আয়" বলতেই ঝুনুদি আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি নিজেকে সামলে নিতে ঝুনুদি জিজ্ঞেস করল, "কিরে হয়েছে তোদের কথা? চল। সবাই যে তোদের দুটিকে জোড়ে দেখবার জন্য আকুল হয়ে বসে আছে।"
টুপু বলল, "হ্যাঁ দিদি, আমরা তো বেরোচ্ছিলাম এখনই।"
আদি ঝুনুদির কোল থেকে নেমে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "ও মামি, চল না। আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে। আজ আমি তোমার হাতে খাব তো।"
আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে আমার বুকে চেপে ধরে বললাম, "হ্যাঁ বাবাসোনা। চল। এখন থেকে আমিই তোমাকে রোজ খাইয়ে দেব।"
নিচের ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল আমাকে আর টুপুকে একসাথে ঘরে ঢুকতে দেখে। ঘরের সোফায় কুলোয়নি। আরও অনেকগুলো চেয়ারে অনেকে বসে ছিল। ডক্টর মুখার্জী, শ্রীময়ী, বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা, শেফালী ছাড়াও আরও একজনকে দেখেই বুঝলাম ইনিই সেই বিদ্যুৎবাবু। ফার্ম হাউসে সামন্তর সাথে এই লোকটাকেই সেদিন দেখেছিলাম আমি। আমাকে আদিকে কোলে নিয়ে ঢুকতে দেখে ঘরের সবাই উঠে দাঁড়াল। ঝুনুদি আর টুপু আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকতেই কে যেন শাঁখে ফুঁ দিল। আর সেই সাথে সামনে পেছনে থেকে দু’তিনজন উলু দিয়ে উঠল। আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নামাতেই অনুরাধা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কনগ্রেচুলেশনস রুমুদি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু কন্যাপক্ষের লোক। কনের বোন আমি। তোমার মামারাও সবাই আসছেন বিয়েতে। তাদের সবাইকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। তারা তো কালই আসতে চাইছিলেন। শান্তুদা তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন যে আসছে মাসের সাত তারিখে তোমাদের বিয়ে। তারা সবাই দু’ তিন দিন আগেই সপরিবারে চলে আসবেন এখানে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। কালই তোমাদের বিয়ের অ্যাপ্লিকেশন রেজিস্ট্রি অফিসে জমা করা হবে। বিদ্যুৎ-দার হাতের ফর্মটায় শুধু এখন সই করে দাও।"
বিদ্যুৎ সেন্টার টেবিলের ওপর একটা ফর্ম আর কলম দেখিয়ে বলল, "এসো টুপুদা, তোমরা দু’জন এটাতে এখনই সই করে দাও। আমি এটা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাব আজ। কাল সকালে কল্যান আমার বাড়ি থেকে এটা নিয়ে যাবে।"
অনুরাধা আমার কোল থেকে আদিকে টেনে নিতেই ঝুনুদি আমাকে আর টুপুকে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। ম্যারেজ অ্যাপ্লিকেশনে সই করবার পর আমি ডক্টর মুখার্জীর কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত ছোঁয়াতে যেতেই সে আমার হাত ধরে ফেলে বলল, "উহু উহু, আমি আমার শালা বৌয়ের প্রণাম নিতে পারব না। শালা বৌ আর নন্দাইয়ের সম্পর্কের মাঝে প্রণাম এসে গেলে তো এমন রোমান্টিক সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, গুরুজন হিসেবে একটা আশীর্বাদ তোমাকে করাই যায়" বলে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, "ভাল থেকো। সুখী থেকো। আর আমার এতদিন বাউণ্ডুলে হয়ে থাকা শালাবাবুটাকে সুখে রেখো।"
আমি ঘুরে ঝুনুদির মুখোমুখি হতেই সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "নারে সোনা, তোকে কাউকে প্রণাম করতে হবে না। শুধু আমার ভাইটাকে নিয়ে তুই সুখে থাকিস, তাহলেই আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে" বলে কেঁদে ফেলল।
আমি নিজেকে সামলে বিদ্যুতের দিকে ঘুরতেই বিদ্যুৎ হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, "নমস্কার ম্যাডাম। টুপুদাকে আমি দাদার মত শ্রদ্ধা করি। তাই আমাকে যদি আপনি আপনার দেবর বলে ভাবেন, তাহলেই আর কিছু চাই না। আর আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় তো হয়েই গেছে।"
আমি একটু মুচকি হাসতেই শ্রীময়ী আমার কাছে এসে বলল, "সে আর তোমাকে বলতে হবে না। আমি তো বৌদিকে টুপুবৌদি বলে ডাকব আজ থেকে।"
আমি সকলের সাথে হাসি বিনিময় করে ঘরের এক কোনায় শ্যামলীদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্যামলীদি আমাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমারও দু’চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। শ্যামলীদিকে বুকে চেপে ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "আমাকে আশীর্বাদ কর শ্যামলীদি। বাকি জীবনটা যেন ভালভাবে কাটাতে পারি। গুবলুকে ভাল করে পড়তে বলবে। ওর সারা জীবনের পড়া শোনার খরচ আমি দেব। তুমি শুধু ওকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বোলো।"
শ্যামলীদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "ভগবান এতদিন বাদে যখন মুখ তুলে চেয়েছেন তখন তুই নিশ্চয়ই সুখে থাকবি রে বোন। জানিনা আর তোর সাথে বসে আগের মত সুখ দুঃখের কথা বলতে পারব কি না। তবু তোর যদি কখনও এই বুড়ি শ্যামলীদির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে ফোন করিস। মাসির ফোন নাম্বার তো তোর বরের কাছে আছেই। তবে গুবলুটার খুব মন খারাপ হবে রে।"
শ্যামলীদিকে ছেড়ে বিজলীদির দিকে চাইতেই দেখি তার চোখদুটোও জলে ভরা। আমি তার দিকে চাইতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "এই প্রায়শ্চিত্তটুকু করবার সুযোগ আমাকে দিয়েছিস বলে তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রে মিনু। না না, আর মিনু নয়। তোকে এখন থেকে রুমু বলেই ডাকব। এখন আমি মরে গেলেও আমার কোন আফসোস নেই। জেঠু জেঠিমাকে অন্ততঃ বলতে পারব যে তোমাদের রুমু ভাল আছে। ও সুখে আছে। ওকে আমি ভাল লোকের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। আর শোন, ডাক্তার বাবু তো আজ কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়ছেন না। অনেক রাত হয়ে গেল। ফিরে যেতে তো ঘণ্টা দুয়েক আরও লাগবে। তাই আজ এখন খেয়েই আমরা তিনজনে চলে যাব। তোকে কথা দিয়েছিলাম যে তুই নিজে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না চাইলে আমি তোকে কখনও তাড়িয়ে দেব না। এখন তুই বল। তুই কি আমার বাড়িতেই থাকবি? না এখানে ডাক্তারবাবুর এই পরিবারে থাকবি?"
আমি কোন কথা না বলে বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলল, "আর কাঁদিসনে বোন। ভগবানের দয়ায় তোর দুঃখের দিন আজ শেষ হল। তবে শোন, আমি জানি, এ বাড়িতে তুই খুব সুখে থাকবি। তবু যদি কখনো কোন প্রয়োজনে আমার কথা মনে পড়ে তাহলে একফোটাও ইতস্ততঃ না করে আমাকে ফোন করবি। আমি যেখানেই থাকিনা কেন, সব সময় আমাকে তোর পাশে পাবি। আগে তোকে যে’সব কথা দিয়েছিলাম। তা যেমন রেখেছি, ভবিষ্যতেও তাই করব। শুধু গত দশটা বছরের জন্য আমাকে মাফ করে দিস বোন। আর মনে রাখিস এ বাড়ির এনারা সকলে ছাড়াও তোর আরেকটা দিদি আছে। আর সে দিদিটা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোর পাশে থাকবে। বিপদে আপদে যে কোনও কাজে প্রয়োজন হলে শুধু আমার কাছে খবরটা পাঠাস। আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে তোর কাছে চলে আসব।"
আমি বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে "দিদি" বলে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আবার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "কান্না থামা বোন। বারোটা বছর ধরে তো অনেক কেঁদেছিস তুই। আজ থেকে আমি তোর মুখে শুধু হাসি দেখতে চাই। তুই তো জানিস, আমরা বেশ্যা। সকলেই জানে আমাদের মধ্যে কোন ভালবাসাবাসি থাকে না। আমরা শুধু আমাদের শরীর বিলিয়ে পয়সা কামাতে পারি। সেটাই তো আমাদের ধর্ম। আমাদের কর্ম। আজ তোর জন্য আমি ধর্মুচ্যুত হয়েও খুব সুখ পাচ্ছি রে। তবে তোকে কিন্তু আর আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। তুই এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবি। তোর ঘর থেকে পুরোনো জামাকাপড় টাপর কিচ্ছু আনতে হবে না তোকে। ঝুনু আর টুপু তোর জন্যে প্রচুর নতুন নতুন পোশাক শাড়ি ব্লাউজ কিনে রেখেছে। তাই ওই পুরনো জিনিসগুলো এ বাড়িতে না আনাই ভাল। তবে তোর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যদি কিছু থেকে থাকে, যা তোর কাজে লাগবে, তাহলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দিস। আমি সে’সব এখানে পৌঁছে দেব।"
বিজলীদির কথা শুনে নিজের চোখ মুছতে মুছতে অনুরাধার দিকে চাইতেই সে আমার কাছে এসে হেসে বলল, "জানো রুমুদি? আজ থেকে মাসি আমাকেই তার বাড়ির মক্ষিরানী করে দিয়েছে।"
আমি জোর করে একটু হেসে বললাম, "ভালই তো। বিজলীদির ব্যবসায় খুব পসার হবে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে তুই যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ওখানে গিয়েছিলিস সেটা তো পুরো হয়ে গেছে। তাই হয়ত আর ওখানে থাকবি না।"
অনুরাধাও হেসে গলা নামিয়ে বলল, "প্রথমে তো আমিও খানিকটা সে’রকমই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেটা করাটা ঠিক হবে না। এমন নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় পেয়ে সেটাকে ছেড়ে যাওয়াটা ভুল হবে। তাই ভাবছি এখানেই থেকে যাব। এমন সুন্দর বাড়িউলী আর এমন নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথায় পাব বলো তো? আর আমি যা চাই, সেটা তো এখানে থেকেও পাবো। মাঝে মাঝে ফোন কোরো। তোমাদের খবরাখবর জানিও।"
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বিজলীদিরা রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে গেল। পরের মাসের সাত তারিখে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হল। এই একটা মাস আমি বাড়ির দোতলার গেস্টরুমে শান্তুদা আর ঝুনুদির ছেলে আদিকে সঙ্গে নিয়ে শুয়েছি। স্কুলের সময়টুকু ছেড়ে আদি সর্বক্ষণ আমার সাথে সাথে থেকেছে।
বড়মামা, মেজমামা আর ছোটমামারা সকলেই মামিদের নিয়ে আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়ের তিনদিন আগে চলে এসেছিল। তিন মামাই আমাকে এতগুলো বছর পর দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। মামাদের থাকবার জন্য বাড়ির কাছাকাছি আলাদা একটা গেস্ট হাউস ভাড়া করা হয়েছিল।
তিনতলার ছাদের ওপর ছোটখাটো একটা প্যাণ্ডেল বানানো হয়েছিল। যেখানে জনা পঞ্চাশেক লোকের খাবার ব্যবস্থা আর পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। বাইরের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। বিজলীদির বাড়ি থেকে প্রত্যেকেই নাকি আমাদের বিয়েতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজলীদি আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে ও বাড়িতেই আলাদা করে এক বৃহস্পতি বারে পার্টির আয়োজন করার কথা দিয়ে সবাইকে থামিয়েছিল। এসেছিল শুধু বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা আর গুবলু। বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ীও এসেছে। গত একমাসে শ্রীময়ী আমার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। কিন্তু টুপুবৌদি ছাড়া আমাকে সে আর অন্য কোন নামে সম্বোধন করে না। বড়মামাদের বাড়ির চারজন, মেজমামার বাড়ির ছ’জন আর ছোটমামার বাড়ির পাঁচজন এসেছিল। টুপুর কাকা জ্যেঠা মামা মাসি বলে কেউ নেই। শুধু এক পিসি আছেন রাঁচিতে। কিন্তু বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন বলে তার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। তিনি সেখান থেকে তার আশীর্বাদী একটা খুব সুন্দর বেনারসি শাড়ি আর একটা গলার হার পাঠিয়েছেন আমার জন্যে। এ বাড়ির চার পাঁচ জন ছাড়া সান্তুদার প্রাইভেট চেম্বারের কর্মচারী আর স্টাফেরা ছাড়া বিয়েতে হাজির ছিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, আর তার অফিসের এক এসিস্ট্যান্ট আর কয়েকজন চাকর বাকর। আর বাইরের লোক বলতে ছিল ডেকোরেটর আর ক্যাটারিং-এর লোকজনেরা। আর কয়েকজনের গাড়ির ড্রাইভার। সবমিলে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন লোকের সমাগম হয়েছিল।
শ্রীময়ী আর অনুরাধা মিলে কনে সাজানোর কাজ করল। আয়নায় নিজের চেহারাকে দেখে আমি নিজেই যেন চিনতে পারছিলাম না। রেজিস্ট্রির সময় কনের তরফ থেকে সাক্ষ্য দিলেন আমার তিন মামা আর অনুরাধা। বরের পক্ষ থেকে সাক্ষী দিলেন সান্তুদা, ঝুনুদি আর বিদ্যুৎ। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যেই বিয়ে সমাধা হয়ে গেল। তারপর পার্টি। আর রাত ন’টার পর থেকে ডিনার চালু হয়েছিল। প্রচুর ছবি তোলা হল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ অতিথিরা সবাই চলে গেল। বাড়িতে রয়ে গেল শুধু বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ী।
সবাই চলে যাবার পর ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে ধরে তিনতলার টুপুর বেডরুমে নিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। দারুণ সুন্দর করে ফুলশয্যার খাট সাজানো হয়েছে। ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে নিয়ে দেয়ালে টাঙানো মা-বাবাদের ছবিগুলোর সামনে নিয়ে যেতেই আমি আর টুপু ছবি হয়ে যাওয়া লোকগুলোকে প্রণাম করলাম। মনে মনে মা-কে বললাম, ‘মাগো, আমাকে আশীর্বাদ কর মা। আমি যেন এ বাড়ির সবাইকে খুশী রাখতে পারি। ঝুনুদি শান্তুদা আর টুপুর মনে যেন কখনও দুঃখ না দিয়ে ফেলি’।
মনে মনে এমন প্রার্থনা করতেই মনে হল আমার মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিল। চমকে চোখ মেলে এদিক ওদিক চাইতেই শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করল, "কিগো টুপুবৌদি, এভাবে চমকে উঠলে কেন?"
আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, "না না, কিছু না এমনি।"
ঝুনুদি বলল, "ভাই, রুমু, তোরা বাবা মা আর জেঠু জেঠিমার কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নে। তারা যেখানেই থাকুন, সকলেই আজ প্রাণভরে তোদের দুটিকে আশীর্বাদ করবেন।"
আমরা প্রণাম সেরে উঠতেই ঝুনুদি আমাদের বিছানার দিকে নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, "কিরে রুমু? কী আশীর্বাদ চাইলি মা বাবার কাছে?"
আমি ঝুনুদির দিকে একটু ঘুরে বললাম, "আমি মা বাবা, কাকু কাকিমা আর দাদাদের কাছে শুধু এ আশীর্বাদই চেয়েছি যে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি যেন তোমাদের সাথে একসাথে থেকে তোমাদের সবাইকে খুশী রাখতে পারি।"
ঝুনুদি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, "পাগলী কোথাকার। নিজের জন্যে কিছু চাইলি না?"
আমিও মৃদু হেসে বললাম, "নিজের জন্যেই তো অমন আশীর্বাদ চাইলাম।"
"আচ্ছা বেশ করেছিস" বলতে বলতে আমাকে আর টুপুকে পাশাপাশি বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, "শ্রীময়ী এ ঘরের সবগুলো আলো জ্বেলে দে তো। আর পাশের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেখ একটা ক্যামেরা আছে, ওটাও নিয়ে আয়"
বলে টুপুকে বলল, "ভাই তখন হুড়োহুড়িতে রুমুর সাথে আমি আলাদা করে একটাও ছবি ওঠাতে পারিনি। এবার তুই কয়েকটা স্ন্যাপ নে। রুমুর সাথে আমি আর শ্রীময়ী উঠব। তারপর আমি শুধু তোদের দু’জনের দুটো স্ন্যাপ নেব। আজকের এ দিনটা যে আমার সবচেয়ে খুশীর দিন। এ দিনটার স্মৃতি তো সারাজীবন চেরিশ করবআমরা সবাই।"
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
SS_Sexy-এর লেখা এই গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
click hereSS_Sexy-এর লেখা গল্পগুলোর ইনডেক্স-এ যেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
মূল গল্পটির ইনডেক্স-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
হোমপেজ-এ যেতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
Enter your comment...hi
ReplyDelete